এই গল্পটি অন্যরকম হতে পারতো। হয়নি। কারণ, আসিফ যেভাবে গল্পটি এগিয়ে নিতে চেয়েছিল, মধুমিতা সেভাবে চায়নি। গল্পটি তাই ‘অতপর তাহারা সুখে শান্তিতে প্রেম করিতে লাগিল’—এই টাইপের হয়নি। তাই বলে মধুমিতা যেভাবে চেয়েছে, গল্পটি সেভাবেও লেখা হয়নি। হয়েছে তৃতীয় একটি ধারায়। এই গল্পে অযাচিতভাবেই নিশা চলে এসেছে। অথচ মধুমিতা চায়নি, আসিফও না। মানুষের জীবন তো সবসময় নিজের কল্পনায় সাজানো গল্পের মতো হয় না, তাই ওরা না চাইলেও বাস্তবে অবধারিতভাবেই নিশা চলে এসেছে।
আসিফ চেয়েছিল এই গল্পে শুধু সে আর মধুমিতা থাকবে। মধুমিতা চেয়েছিল ওদের দু’জনের পাশাপাশি তৃতীয় আরেকজনও থাকবে। তার বর কিংবা বয়ফ্রেন্ড। কিন্তু তৃতীয়জন হয়েছে নিশা, সম্প্রতি আসিফের প্রাইভেট টিউশনির ছাত্রী থেকে যার উত্তরণ হয়েছে প্রেমিকায়। মেয়েটি দেখতে আহামরি কিছু নয়। বিয়ের বাজারে ঘটক হয়তো উজ্জ্বল শ্যামলা বলে অতিরঞ্জন করবে। কিন্তু মধুমিতার কাছে ওকে শ্যামলাই মনে হয়েছে, ঔজ্জ্বল্যের তেমন কিছু নেই। তবে চোখ দু’টোতে কেমন যেন মায়া আর মাদক কামুকতার একটা মিশ্রণ আছে। আকর্ষণ বলতে ওইটুকুই। আর তাতেই আসিফ কাত হয়ে গেলো? আশ্চর্য! সব ছেলেই এক। ওদের কাছে যে মেয়ের চোখে শরীরের আমন্ত্রণ থাকবে, তাকেই ভালো লাগবে। মধুমিতা ওকে আরেকটু ম্যাচিউরড ভেবেছিল। কিন্তু তাহলে কি আর অমন একটা মেয়ের প্রেমে পড়ে! মাত্রই তো ইন্টারমেডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে। এই বয়সেই প্রেমে গদগদ। আসিফ ওকে ছাই পড়াচ্ছে। পরীক্ষায় গোল্লা মারা একেবারে নিশ্চিত। অবশ্য পরীক্ষায় গোল্লা মারলে নিশার হয়তো কিছুই যায় আসে না। ওর আসিফকে পেলেই হলো। তার বাবা-মা’রও নিশ্চয়ই অমত হবে না। এমন ছেলে তো সবসময় এত অনায়াসে পাওয়া যায় না।
তবে মধুমিতা যতটা অবাক হয়েছে, ততটা অবাক হওয়ার কথা ছিল না। এমন নয় যে, সে কিছুই জানতো না বা আঁচ করতে পারেনি। কথাটা আসিফ আগেও কয়েকবার বলেছে। মধুমিতা পাত্তা দেয়নি। প্রথমে ভেবেছিল ছেলেটা ওকে রাগানোর জন্য হেঁয়ালি করছে। অথবা হয়তো মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে। তার প্রতি মধুমিতার যে রকম মনোযোগ বা দৃষ্টি আছে, ঠিক সে রকম না। আসিফ তার চেয়েও কিছু বেশি, তার চেয়েও গভীর কোনো দৃষ্টি প্রত্যাশা করেছিল। কিন্তু মেয়েরা সব কৌশলই জানে, ভিন্ন প্রসঙ্গ অবতারণা করে তাই সে আসিফের মনোযোগ অন্য দিকে নিয়ে গেছে। তবে ও যে এই মেয়ের সঙ্গে প্রেমের ব্যাপারে এত সিরিয়াস বা সত্যি সত্যি এত দূর এগিয়েছে, তা বুঝতে পারেনি। আসিফ অবশ্য বলার চেষ্টা করেছে যে, সে নিজে এগোয়নি। মেয়েটা এগিয়েছে, সে সাড়া দিয়েছে মাত্র। ফল তো একই, তাই না?
অবশ্য তাতে মধুমিতার কী-ই বা যায়-আসে! সে নিজে যা নিতে চায়নি, তা যদি অন্য কেউ নিয়ে যায়, তাতে আক্ষেপেরই বা কী আছে! তবু আসিফের কথায় বুকটা একটু কেঁপে ওঠে। এতদিন যা হেঁয়ালি ভেবেছে, সত্যিই কি তা হচ্ছে? আসিফ বলে রেখেছিল বিকেল পঁচটায় ‘ক্যাফে ম্যাংগো’র দোতলায় থাকতে। সারপ্রাইজ দেবে। ধানমন্ডি একত্রিশের কোণায় এই কফি শপ প্রেমিক-প্রেমিকাদের আড্ডা। ঠিক প্রেমিক-প্রেমিকা না হলেও ওরা দু’জন ওখানে বেশ কয়েকদিনই গেছে। শেষদিকে মধুমিতার ভালো লাগতো না। ওখানে যারাই যায়, সবাই তাদের প্রেমিক-প্রেমিকাই ভাবে।
ধুর! ম্যাংগোতে না। অন্য কোথাও চল।
না, ওখানেই সুবিধা।
কেন, কী সারপ্রাইজ দিবি?
তুই তো দেখি এখনো মহাগাধাই রয়ে গেলি। সরি, গাধী। আগে যদি বলেই ফেলি, তাহলে সারপ্রাইজ আর হলো কই? সেটা বিকেলেই দেখবি।
আলিয়ঁস ফ্রসেসে একটা আর্ট এক্সিবিশন দেখে দু’জন একসঙ্গেই বেরুচ্ছিল। প্ল্যান ছিল কোথাও একসঙ্গে লাঞ্চ সেরে মধুমিতা ফিরে যাবে রোকেয়া হলে আর আসিফ সূর্যসেনে। বিকেলে একসঙ্গে লাইব্রেরি-ওয়ার্ক। কিন্তু আসিফের সারপ্রাইজের কথা শুনে মধুমিতা দ্রুতই সিদ্ধান্ত পালটে নিল। ওর সঙ্গে আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। বুকের মধ্যে ধুঁক করে উঠেছে। মনে হয় সে সারপ্রাইজটা আঁচ করতে পেরেছে। মেয়েদের একটা সিক্সথ সেন্স আছে। এ ধরনের সময়ে ভালো কাজ করে। নিজেকে হঠাৎ ভীষণ একা মনে হচ্ছে। এখন বরং আসিফকে এভয়েড করাই ভালো। ওর সামনে কোনো ইমোশন এক্সপ্রেস করা যাবে না। সারপ্রাইজটা আগেভাগে টের না পাওয়ার কোনো কারণ নেই। মধুমিতা বুঝতে পারে। কিন্তু সে বুঝেও না বোঝার অভিনয়টা ঠিকমতো করতে পারছে কি না, তা বুঝে উঠতে পারে না। এই প্রথম তার আত্মবিশ্বাসের ভিত নড়ে ওঠে। আসিফের সঙ্গে থাকা এই সময়ে ভীষণ অস্বস্তিকর।
তুই বরং হলে যা। আমি একটু পিয়াদের বাসা থেকে ঘুরে আসি। ও কয়দিন ধরে বারবার যেতে বলছে। যাই যাই করে যাইনি। বিকেলে দেখা হবে ম্যাংগোতে।
হঠাৎ?
হঠাৎ মনে হলো। আগে ভুলে গিয়েছিলাম।
মধুমিতা ফিরে তাকায় না। একটা রিকশা ডেকে উঠে পড়ে। পিয়াদের বাসা কাছেই। সাতাশের কোণায়। অবশ্য ঘুরে যেতে হবে ধানমন্ডির ভেতর দিয়ে। মিরপুর রোড দিয়ে তো রিকশা চলে না।
ওদের সম্পর্কের বয়স প্রায় চার বচর । ফার্স্ট ইয়ার থেকে থার্ড ইয়ার। হওয়ার কথা তিন বছর। কিন্তু সেশন জট আর ছাত্র সংঘর্ষের সূত্রে ইউনিভার্সিটি বন্ধের কারণে এটুকুতে চার বছর ছুঁয়ে যায়। এই চার বছরে ওদের সম্পর্ক যেভাবে এগিয়েছে, তাকে ঠিক কিভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়? নিছক ক্লাসমেট সুলভ বন্ধুত্ব নয়, আবার প্রেমও নয়। বন্ধুত্বের অধিক, কিন্তু তাই বলে প্রেমের সমান ঠিক তা বলা যাবে না। প্রথম দিকে ক্লাসমেটদের অনেকেরই ধারণা ছিল হয়তো ওদের প্রেম হয়ে গেছে বা একসময় হয়ে যাবে। ওরা দু’জনই বন্ধুদের বুঝিয়েছে, আসলে ব্যাপারটা তেমন কিছুই নয়। কেউ কেউ নিজেদের মতো করে উপলব্ধি করেছে, কেউ করেনি। অবশ্য ক্যাম্পাসে ইদানিং ওদের মতো বেশ কিছু যুগলই দেখা যায়, যারা প্রেমিক-প্রেমিকা নয়, কিন্তু বন্ধুর অধিক। তবু শাহানা একদিন বলেছিল, একজন ছেলে আরেকজন মেয়ের মধ্যে কখনোই নিছক বন্ধুত্ব হতে পারে না। মধুমিতা শুধু হেসে বলেছে, দেখিস।
শাহানা কিংবা অন্য কারও দেখা হয়নি তেমন কিছুই। এই চার বছরেও ওরা প্রেমিক-প্রেমিকা হয়ে ওঠেনি। ইউনিভার্সিটিতে প্রথম দিনের পরিচয়ের পর থেকে বন্ধুত্ব গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়েছে। কিন্তু কোথায় যেন এসে থমকে গেছে। আর এগোয়নি।
পরিচয়ের পর্বটা ছিল মফস্বল থেকে আসা আর পাঁচ জন সাধারণ ছাত্রছাত্রীর মতো।
—আমি আসিফ। বগুড়ার ছেলে।
—আমার নাম মধুমিতা। পুরো নাম জান্নাতুল ফেরদৌস। জয়পুরহাট থেকে এসেছি।
—আরে তুমি দেখছি আমার দেশি। ভালোই হলো। আমাদের ওদিককার তেমন কারও সঙ্গে এখনো পরিচয় হয়নি। সূর্যসেনে একবড় ভাইয়ের রুমে উঠেছি। তুমি?
—রোকেয়া হল।
দু’জনেই বন্ধুত্ব বিকাশে বেশ সাবলীল। সেমিনারে যাওয়া, লাইব্রেরি ওয়ার্ক, টিএসসি’র আড্ডা, ক্লামের ফাঁকে চায়ের কাপে চুমুক, ছুটির দিনে এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ানো, রবীন্দ্র সরোবরে গান শোনা, ইউনিভার্সিটি বন্ধে বাড়ি যাওয়া—সবকিছুই একসঙ্গে চলে। অবশ্য প্রায় সময়ই অন্য বন্ধুরাও সঙ্গে থাকে। তবু ওরা দু’জন সবার সঙ্গে থেকেও নিজেদের নিয়ে আলাদা। একদিন কাশেম মোল্লার ছাপড়ায় চায়ের কাপে ধোঁয়া উড়িয়ে ওরা ‘তুমি’ থেকে ‘তুই’ হয়ে যায়।
—দেখেছিস, আমরা কী সহজেই ‘তুমি’ থেকে ‘তুই’ এ নেমে গেলাম?
—এটা কি নেমে যাওয়া নাকি উঠে আসা?
—মানে কী?
—এটা তো ফ্রেন্ডশিপের পরবর্তী ধাপে উত্তরণ। কোনো কিছুতে উত্তরণ হলে ‘নেমে যাওয়া’র বদলে ‘উঠে আসা’ বলাটা মোর এপ্রোপ্রিয়েট হবে না?
—বাহ! তোর থট দেখি হাইলি ফিলোসফিক্যাল। ব্রাভো। তাহলে ‘তুই’-এ নামিনি, উঠে এসেছি। চমৎকার!
সেই থেকে ওদের সম্পর্কটা আরও কাছাকাছি হয়েছে অনেক। মধুমিতাও নামের ‘মধু’ ঝরিয়ে দিয়ে শুধু মিতা হয়ে উঠেছিল। নাম সংক্ষিপ্ত হওয়ার গল্পটি অবশ্য একটু ভালগার। টিএসসি’র এককোণে বসে আড্ডা দেওয়ার একফাঁকে আসিফ একদিন নতুন একটা প্রস্তাব দিয়ে বসে।
—আচ্ছা, তোর নামটা ছোট করে ডাকি? ‘মধুমিতা’, এত বড় নাম ডাকতে ভালো লাগে না।
—ন্যাকামি করছিস কেন? চার অক্ষরের নাম, তাই ডাকতে তোর এত কষ্ট! তুই তোতলা নাকি? তোর বউয়ের নাম যদি হয় খাদিজাতুল কোবরা, তাইলে কী ডাকবি? কোবরা?
—ধুর, হেঁয়ালি রাখ। ডাকবো কি না, বল।
—কী ডাকবি, মিতা? চাইলে ডাকতে পারিস।
—না, মধু।
—ধুর! এটা তো গেঁয়ো শোনাবে। এ যুগে ‘মধু’ কারও নাম হয়?
—কেন হবে না? সুস্বাদু জিনিষের নাম মধু হলেই তো এপ্রোপ্রিয়েট হবে। আমি না খেয়েই সার্টিফাই করছি। একবার চেখে দেখতে পারলে না হয় জাস্টিফাই করা যাবে। দিবি নাকি চান্স একটা?
—এক থাপ্পড় দেবো। তোর সাহস তো কম না।
—মধুমিতা কপট রাগটা চেহারায় বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারে না। খানিক পর দু’জনই হেসে কুটিকুটি হয়। ‘মধু’তে সন্ধি না হলেও ‘মিতা’য় আপত্তি হয় না। সেই থেকে অন্যদের কাছে ‘মধুমিতা’ থেকে গেলেও সে আসিফের কাছে ‘মিতা’ হয়ে ওঠে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। সম্পর্কটা ওই খোলামেলা আড্ডাবাজির গণ্ডি অতিক্রম করতে পারেনি কখনোই।
দু’জনই এই সম্পর্কের ডাইমেনশন নিয়ে নিজেরা নিজেরা অনেক ভেবেছে। নিজেরা এত কথা শেয়ার করে। কিন্তু নিজেদের এই ভাবনাটুকু খোলামেলা শেয়ার করেনি পরস্পর। আসিফ জানে, দিনে দিনে তার একটা দূর্বলতা জন্মে গেছে মধুমিতার প্রতি। আকর্ষণ ধীরে ধীরে বাড়ে। মেয়েটি সুন্দরী, স্মার্ট ও বুদ্ধিমতি। চোখের দৃষ্টি ভীষণ সুন্দর। তারও চেয়ে সুন্দর কথা বলার ঢং। এমন চাহনি আর আহ্লাদি কথা বলার ঢং আসিফের বুকের ভেতর কেবলই উথাল পাথাল ঢেউ তোলে। আসিফ এই ঢেউ ধরে রাখতে চায়। আসিফের সবচেয়ে পছন্দ মধুমিতার ব্যক্তিত্ব। কিন্তু এই ব্যক্তিত্বই কাল হয়েছে। মধুমিতার প্রেমে আসিফ পড়লেও তাকে বলতে পারে না। তার ব্যক্তিত্বকে সমীহ করে, আবার ভয়ও পায়। ভাবে, ও তাকে ফিরিয়ে দেবে। আসিফ যদিও জানে মধুমিতা তাকে খুব কাছের বন্ধু মনে করে, অন্য বন্ধুদের চেয়ে আলাদা করে ভাবে। কিন্তু কোথায় যেন একটা দেয়াল দাঁড়িয়ে আছে। সে বুঝতে পারে, মধুমিতা সম্পর্কটা ঠিক প্রেম অবধি টেনে নিতে চায় না। হয়তো তার ব্যক্তিত্বটাই লাগাম হিসেবে কাজ করে। হয়তো বা অন্য কিছু। কিন্তু আসিফ প্রপোজ করতে সাহস পায় না। সে মোটামুটি নিশ্চত যে, এই প্রস্তাব মধুমিতা গ্রহণ করবে না। আর একবার রিফিউজড হয়ে গেলে তখন আবার স্বাভাবিক সম্পর্কটাও বিঘ্নিত হবে। বন্ধুত্বের অপমৃত্যু না হলেও সম্পর্কের সাবলীলতা নষ্ট হতে বাধ্য। আসিফ সেই ঝুঁকি নিতে চায়নি। প্রেমের প্রস্তাব দিতে গিয়ে বন্ধুতটাই নষ্ট হয়ে যাক, তা সে চায় না। তার চেয়ে অন্তত এমন একটা সুন্দর বন্ধুত্বই বরং টিকে থাক। মধুমিতাকে ছাড়া নিজের সকাল দুপুর সন্ধ্যা আপাতত ভাবতে পারে না আসিফ। ভবিষ্যতের কথা না হয় ভবিষ্যতেই ভাবা যাবে। এই সুন্দর সাহচর্যটা অন্তত টিকে থাক।
আসিফের সাহচর্য মধুমিতাও উপভোগ করে ভীষণ। সে যে তার ওপর ইমোশনালি অনেকটাই নির্ভরশীল, তাও মধুমিতা বোঝে। আসিফের এই নির্ভরতা মধুমিতাকে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী করেছে। নিজের ওপর অন্য কেউ নির্ভর করে, আশ্রয় চায়, এমনটা ভাবতে কার না ভালো লাগে! এমন ছেলের সঙ্গে সময় কাটাতে ভালো লাগে। নিজেকে বড় বড় মনে হয়, কখনো অভিভাবক ভাবও চলে আসে। এমন ছেলেদের বিশ্বস্ত অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে অনায়াসেই ভাবা যায়। কিন্তু তাদের বর বা বয়ফ্রেন্ডের ভূমিকায় ভাবা যায় না। বর বা বয়ফ্রেন্ড হবে এমন কেউ যার ওপর নির্ভর করা যায়, যার কাছে আশ্রয় নেওয়া যায়। সে হবে বন্ধুত্বে উদ্দাম আবার কিছুটা অভিভাবকত্বের ছোঁয়াও থাকবে সময়ে সময়ে। আসিফ এই দ্বিতীয় ভূমিকায় তেমন মানানসই নয়। এমন ছেলের প্রতি মমতা থাকে, তার ভালোবাসায় নিজেকে ঋদ্ধ করা যায়, ভালোও বাসা যায় অনেকটুকু। কিন্তু প্রেমিকের জন্য ধরে রাখা সবটুকু প্রেম তাকে দেওয়া যায় না। আসিফের মতো চমৎকার বন্ধুবৎসল ছেলে সচরাচর খুব একটা দেখা যায় না। মানবিক গুণাবলির উচ্চতায় সে হয়তোবা কিলিমানজারো কিংবা কে-টু, কিন্তু মাউন্ট এভারেস্ট থেকে একটু দূরেই থেকে যায়। মধুমিতা তার প্রেম শিকেয় তুলে রাখে স্বপ্নের রাজপুত্তুরের জন্য। ও নিশ্চিত জানে, সে আসবে একদিন এভারেস্টের সমান উচ্চতা নিয়ে, ভালোবাসার সব পাহাড় ছাড়িয়ে। সেদিন হয়তো আসিফ অনেক কষ্ট পাবে। আসিফের কষ্টে তার নিজেরও কষ্ট হবে। যদিও আসিফ সেই রাজপুত্র নয়, তবু তার দৃষ্টিতেই মধুমিতা নিজের নারীত্বকে প্রথম আবিষ্কার করেছিল, এ কথাই বা অস্বীকার করে কিভাবে! এই সব মনে হলেই ওর আসিফের জন্য অনেক কষ্ট হয়। নিজেকে অপরাধী মনে হয়। কিন্তু তার অপরাধই বা কী? আসিফের অন্তরঙ্গ বন্ধুত্বকে প্রশ্রয় দিয়েছে বটে, তার বেশি তো কিছু নয়। সে তো নিজ থেকে কোনো আমন্ত্রণ জানায়নি।
পিয়ার সঙ্গে আড্ডা জমে না মোটেও। তেমন কিছু দরকার ছিল না। আসিফকে কিছুটা সময় এভয়েড করার জন্যই এই অজুহাত বের করেছিল। মনের মধ্যে সেই সারপ্রাইজের কথাই ঘুরেফিরে খোঁচা দিতে থাকে। ক্যাফে ম্যাংগোতে যেতে হবে পাঁচটায়। অস্বস্তি নিয়ে হলেও এই সময়টা পিয়ার সঙ্গেই পার করে। তারপর চারটার একটু আগেই বের হয়ে যায়। আসাদগেটের আড়ং হয়ে যাবে। সে যতই চায়, তার আশঙ্কা মিথ্যে হোক, আসিফ অন্য কোনো সারপ্রাইজ দিক, কিন্তু মন বলছে, টুডে ইজ দ্য ডে। আজই আসিফ সেই মেয়েটার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে। আজ থেকে তার আর আসিফের সম্পর্ক নতুন একটা ডাইমেনশনে প্রবেশ করবে। সে হয়তো আবারও মিতা থেকে মধুমিতা হয়ে উঠবে। কিছুই আর স্বচ্ছভাবে ভাবতে পারছে না। এতদিন শুনেছে আর নিজেও বিশ্বাস করেছে প্রেম থেকেই পজেসিভনেস হয়। কিন্তু আজ মধুমিতা ভীষণ পজেসিভ ফিল করছে। তবে কি সে খানিক হলেও আসিফের প্রেমে পড়েছিল? ‘খানিক প্রেম’ বলতে আছে না কি কিছু? এতদিন যে তার নিরঙ্কুশ দখলে ছিল, সে কি আজ তবে…
আসাদ গেটের আড়ংয়ে নেমে ঝটপট একটা সুন্দর দেখে ফতুয়া কিনে নেয়। খালি হাতে তো আর আশীর্বাদ করা যায় না। যদিও মেয়েটার দৈর্ঘ্য প্রস্থ কিছুই জানা নেই, তবু যেহেতু ফ্রি সাইজ, মাপমতো হয়ে যাবে নিশ্চয়ই। আচ্ছা, এমন তো হতে পারে যে, সে যা ভাবছে, মোটেও তা নয়। হয়তো নিশা পুরোপুরি একটা কাল্পনিক চরিত্র। হয়তো তাকে চাপে রাখার জন্য আসিফের উর্বর মস্তিষ্কের আবিষ্কার। হয়তো এতদিনের গল্পগুলো বানোয়াট, হয়তো হেয়াঁলি। এমনও তো হতে পারে, আজ আসিফ প্রপোজ করবে। চার বছরে যে কথা মুখ ফুটে বলেনি, আজ তা বলবে। হতে পারে না? আসিফ যে তার প্রমে পড়েছে, সেই কবেই তা তো ওরা দু’জনেই জানে। একজন বলে না, আরেকজন না বোঝার ভান করে এই যা। মধুমিতার মস্তিষ্ক বলে আজ নিশার সঙ্গে পরিচয় হবে, হৃদয় বলে আসিফ ওকে প্রপোজ করবে। প্রপোজ করলে মধুমিতা ‘হ্যাঁ’ বলবে না, সেটা তো পুরোনো সিদ্ধান্ত। কিন্তু ‘না’ বলবে কিভাবে, কোন কারণ দেখিয়ে সেই সিদ্ধান্ত তো কোনোদিন নেওয়া হয়নি।
এসব ভাবতে ভাবতেই ক্যাফে ম্যাংগো চলে আসে। ততক্ষণে সোয়া পাঁচটা বেজে গেছে। রিকশা বিদায় করে সরাসরি দোতলায় উঠে আসে। এককোণের একটা ছোট্ট টেবিলের সামনে আসিফ বসা। একা। তবে কি মস্তিষ্ক ভুল? তবে কি হৃদয়ের ধারণাই ঠিক? এতদিন তবে কি আসিফ শুধু হেঁয়ালিই করেছে নিশা নামের কাল্পনিক চরিত্রটি নিয়ে?
—কী রে, তোকে এত বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত দেখাচ্ছে কেন? পিয়ার সাথে ঝগড়া করেছিস, না কি কুস্তি করেছিস?
—বাজে কথা রাখ। কী সারপ্রাইজ দিবি দে। না হয় হলে যাচ্ছি। টায়ার্ড লাগছে।
—আচ্ছা বাবা, মাত্রই তো এলি। পাঁচ মিনিট বস। এককাপ কফি অন্তত খা।
আসিফ কফির অর্ডার দেয়। ঠিক সেই সময় মেয়েটি ঢোকে। শ্যামলা মতো। চোখ দু’টো ছাড়া আর কোনো বিশেষত্ব নেই।
—এই হচ্ছে নিশা। তোকে তো ওর কথা আগেই বলেছি। যদিও তুই বিশ্বাস করিসনি।
—কে বলেছে বিশ্বাস করিনি? তবে এত যে সুন্দর আর মায়ামায়া চেহারা, সেটা তো বলিসনি। তুই ভীষণ লাকি।
—নিশা কপট লজ্জায় চোখ নিচু করে। আসিফ মধুমিতাকে পরিচয় করিয়ে দেয়।
—এই হচ্ছে তোমার মিতা’পু। ওর কথা তো শুনেছো অনেক। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, গার্জিয়ানও বলতে পারো।
তিন জন মুখোমুখি বসে। এ কোনো ত্রিভূজ প্রেমের উপাখ্যান নয়, আবার স্টেটকাট ট্র্যাডিশনাল প্রেমকাহিনীও নয়। তবে এই কাহিনীর কোথাও একটা ত্রিভূজ আছে। চুপচাপ তিন জন নিজের মতো করে সেই ত্রিভূজের পরিসীমায় পায়চারী করে। মধুমিতা ভেবেছিল, যদি কোথাও কোনো ত্রিভূজ থাকে, তবে সে নিজেই তার কেন্দ্র হবে। কিন্তু এই ত্রিভূজের কেন্দ্রে আসিফ, যদিও তাকে প্রথাগত ত্রিভূজ প্রেম বলা যাবে না। সে তো কখনো আসিফের প্রেমে পড়েনি। সত্যিই কি পড়েনি?
মধুমিতা কী বলবে, কী দিয়ে কথা শুরু করবে, বুঝতে পারে না। ওর অস্বস্তি বাড়তে থাকে। কফির কাপ হাতে নিয়ে নিশা নিস্তব্ধতা ভাঙে।
—আপু, আপনার এত কথা শুনেছি যে, আপনাকে আমার অপরিচিত মনে হয়নি মোটেও।
—তাই? এই শয়তানটা কী আর বলবে? নিশ্চয়ই গাদা গাদা বদনাম করেছে।
—মোটেও না আপু। আপনার এত প্রশংসা করে যে, আমার তো মাঝে-মাঝে হিংসেই হয়। সত্যিই আমার মনে হয় ওর চেয়ে বড় কোনো ফ্যান নেই আপনার। আমি তো গল্প শুনেই আপনার ফ্যান হয়ে গেছি।
মধুমিতা আড়ং থেকে কেনা ফতুয়ার প্যাকেটটা বের করে নিশার হাতে দেয়।
—দেখো তো পছন্দ হয় কি না। মনে হচ্ছে মাপে হয়ে যাবে।
—থ্যাঙ্কস আপু। কিন্তু আপনি কেন আনতে গেলেন?
—বোকা মেয়ে। বেস্ট ফ্রেন্ডের ফিয়ান্সিকে কি খালি হাতে আশীর্বাদ করতে হয়?
আসিফের অবাক হবার পালা। প্যাকেটটা আগেও দেখেছিল। ভেবেছে, হয়তো মধুমিতারই কিছু হবে।
—তুই এটা ওর জন্য কিনেছিস? কই আমি তো আগে থেকে তোকে কিছুই বলিনি। কী করে বুঝলি যে, আজ ও আসবে?
—তুই কি আমাকে এতই গাধা ভাবিস? তোর সারপ্রাইজটা যে কী হবে, তা বোঝার জন্য কি আইনস্টাইন হওয়ার দরকার আছে? আর জানিস না, মেয়েদের একটা সিক্সথ সেন্স থাকে? কী বলো নিশা?
বিভিন্ন প্রসঙ্গে কিছুক্ষণ কথা হয়। শেষ অব্ধি আড্ডা তেমন জমে না। মধুমিতার একা থাকতে ইচ্ছে করছে। এই সময়টায় একাই থাকা উচিত, ওদেরও নিজদের মতো করে সময় কাটাতে দেওয়া উচিত।
—আজ তাইলে যাই রে! সারাদিন বাইরে ঘোরাঘুরি করে ভীষণ টায়ার্ড লাগছে। তোরা গল্প কর। কাল ক্লাসে দেখা হবে। নিশা, তুমি কিন্তু যখন তখন চলে এসো হলে। চুটিয়ে গল্প করা যাবে। সারাদিন এই শয়তানটার সঙ্গে সময় কাটিয়ে যখন বোর হয়ে যাবে, তখনই না হয় এসো।
আসিফ বাধা দেয় না। এখন মধুমিতার একটু একা থাকা দরকার, তা বুঝতে পারে।
সিএনজিতে উঠে কিছুতেই ভাবনাটা দূর করতে পারে না। আসিফ শেষপর্যন্ত এই এভারেজ মেয়েটার প্রেমেই পড়লো? চোখ দু’টো ছাড়া আর কীইবা আছে মেয়েটার? এ ধরনের মেয়ের প্রেমে পড়ার মতো ছেলে তো আসিফ নয়। তবে কি মধুমিতার নির্লিপ্ততায় এটা আসিফের প্রতিশোধ স্পৃহা? ওকে কষ্ট দিয়ে আসিফের লাভ কী? ছেলেটা কি সত্যিই নিশাকে মধুমিতার মতো করে ভালোবাসতে পারবে? নাকি মেয়েটা কেবলই একটা ইগো’র বলি? আসিফ হয়তো মধুমিতাকে পায়নি। নিশা কি পাবে আসিফকে? নিশা হয়তো আসিফের ঠোঁট পাবে, আঙুল পাবে, নাভীমূলে তার আদিম স্পর্শ পাবে। কিন্তু আসিফের পূর্ণাঙ্গ সত্তটুকু পাবে কি?
সিএনজি থামিয়ে ফার্মেমি থেকে দশটা ভ্যালিয়াম নিয়ে এসেছে। খাবে কি না এখনো বুঝতে পারছে না। ঘুম না এলে তো খেতেই হবে। আজ যে ঘুম আসবে না তা বোঝার জন্য তো আর রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হবে না। রুমে আজ সে একা। তিথি গেছে মামার বাসায়, স্বপ্না দেশের বাড়িতে। রুমে ঢুকে কোনো রকমে দরোজা বন্ধ করে বিছানায় এলিয়ে পড়ে। বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। মধুমিতার অনেক কষ্ট হয়। নিজের জন্য, আসিফের জন্য, নিশার জন্য। ভেজা চোখে ভেসে ওঠে তিনজন পরাজিত মানুষের মুখচ্ছবি। মধুমিতা কেঁদেই চলে। হাতে ভ্যালিয়ামের স্ট্রিপ। স্বপ্নের রাজপুত্রের কথা আর মনে থাকে না।