এত্তগুলা মাছের সাথে ছোট বড় কুঁইচ্চা মাছ, কুরাল মাছ, ছোট পুঁটি মাছ, ছোট বেলে মাছ, বড় বড় মশা মাছ, কেঁয়ারা, জোঁক-তোক মিলায়ে সব ধরনের মাছ একাকার হয়ে ধরা পড়েছে জাঁকে। মাঝে মধ্যে এ্যাকুয়ারিয়ামে রাখা বিদেশি মাছের মতো কালারফুল মাছও মিলে যায়। নাবালক মিয়া এই সব দেখে দেখে মাঝেমধ্যে থ হয়ে তাকিয়ে থাকে। এতো সুন্দর মাছ কোথাত থেকে আসে? কেমনে? কোথায় থাকে? এদের কি আলাদা বংশধর আছে?
অনেকটা নাম না জানা অজানা মাছের মতো। রূপকথার গল্পের মাছের মতো। অথবা মাঝেমধ্যে শোনা যায় আমাদের পরিবেশে, মাটির অভ্যন্তরে কাদার ভেতরে লেপ্টে আছে এ্যালিয়ান। বাতাসের পরশেও নাকি মিশে আছে এ্যালিয়ান! এরা কি তাহলে এ্যালিয়ান মাছ হবে? নাবালক মিয়া আর রাকিদালী দু’জনই মাছের ডুলায় খুব সুন্দর করে কাঙ্ক্ষিত মাছগুলো নিয়ে কাঁদার একপাশে একটা পোটলা মতন জায়গায় সাজিয়ে রেখেছে।
সেও মুখে থু! দিয়ে আস্তে আস্তে জোঁকগুলো ছাড়াতে থাকে। একদম ভয় ডরহীন। একদম নির্বিকার। এও ব্যাটার এক জীবন তার!
এর মধ্যে দুইজনের পেটে ক্ষুধা লেগে আসে—নাবালক: ও রাকিদ ভাই। ক্ষুধা লাগছে। পেটে তো দানাপানি কিছু দিওন লাইগবো। চলো চলো, ওঠো ওঠো—সামান্য মুখে একটু ঝামটা দিয়ে নাবালক মিয়া আর রাকিদালী দু’জনই তাদের ময়লা হাত সামান্য করে ধুয়েছে নাকি ধোইনি তারও পাত্তা নাই। এরই মধ্যে পিঁয়াজ আর মরিচ ডলা দিয়ে শুরু করেছে গোগ্রাসে গিলে ভাত খাওয়া। পাশাপাশি রাকিদালীর— গত কাল-বউয়ের রান্না করা একটু ফাইশ্যা শুঁটকি মাছের দু’ একটা ঠ্যাং নাকি লেজ এর অবশিষ্ট ছিল; তারই ঝুল দিয়ে অমৃত খাওয়ার মতো এতো তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললো রাকিদালী, আহ্! প্রকৃতির কোলে বসে পৃথিবীর কোনো ঘোষ-ধনপতিও বুঝি এমন তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে পারবে না। এই তৃপ্তিতে এতো মধু আছে। সেই মধুতে এতোচিনি আছে যা বলার মতো না। পৃথিবীর কোনো আশ্চর্য পিরামিডের মতো। সপ্ত আশ্চর্যের মতো, হা করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই ।
আসলে এদের দেখে পৃথিবীর বড় বড় রাঘব বড় বড় ঘোষপতি, লাখপতি কোটিপতিও ঠাশকি খেয়ে যাবে। পৃথিবীতে এমন কোনো খোয়াব আছে কী? এক্কেবারে টাকা কড়ি ছাড়া খোয়াব? যে নির্ভেজাল কোনো খোয়াব বা স্বপ্ন দেখে, মানুষ এইসব দুই দিন্না সুখেরে ফু মেরে উড়ায়া দ্যায়। এমন সুখের ছইদানি-আঞ্জাম ছেড়ে আবারও নতুন করে সুখে থাকার, ভাল থাকার সবক নিবে; কে আছে এমুন মানুষ! এই সামান্য রসনায় এতো মজা! আহা! পেটের ভিতরের কোন্ প্যাঁচকি থেকেই-বা জিহ্বায়-চাঁটা এতো মজার রসনা আসে। এতো সুখ আসে। কোথা হইতে আসে এইসব গ্যালন গ্যালন সুখ। কোথা হইতে আসে এতো প্রাণশক্তি! অথচ বড় বড় ঘোষ-পতি, ভারী টাকাওয়ালাদের কেনো চোখে-মুখে স্বাদ নাই? তাদের কেন এই স্বাদ আসে না? তাদের পেটের সুখ কোথায় গেল? কোথায় গেল জিব্বার স্বাদ? রাতের আরাম ঘুম কোথায় গেলো উবে! অন্যদিকে আধা ময়লাহাতে খাওয়া সুখের ভাতের সাথে, পেটেও যে কতো ময়লা তারা প্রতিদিন হজম করে। আসলে সরাসরিনির্ভেজাল প্রকৃতির সাথে নিজেকেপ্রতিদিন ল্যাপ্টে রাখে বলেই আসে; পেটের ভেতরে, মনের ভেতরে,কোন ধরনের কচকচানি, প্যাঁচ-প্যাঁচানি নাই বলেই আসে। বাড়তি কোনো টেনশন নাই বলেই তাদের এত্তোসব দোষগুণ বাইরের প্রকৃতি এবং মনের প্রকৃতি মিলে সবটাই শুষে নেই।
মাছ মারা শেষ হলে রাকিদালী মাছগুলো নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেয়। উঠানের কোনামতো একটা জায়গায় ঠেশ্ মেরে বসে রাকিদালী।এবার নিজের বাড়ির উঠানেই রাকিদালী তার শরীরে কিছু একটা জিনিস আবিষ্কার করেছে। প্রতি পায়ের পাতায় পাতায়, হাঁটু থেকে শুরুপায়ের প্রত্যেকটি গিঁটের চিপা-চাপায় লেগে আছে জোঁক। কিছু জোঁক রক্ত খাওয়া শেষ হলে অমনিতেই ঝরে গেছে। কিছু আছে চোষতে চোষতে রানের দুই পাশে লাল-ঢ্যাবড্যাবা হয়ে আছে। একটু পরপর ঠুশ্ ঠুশ্ করে পড়তে থাকে জোঁক। কিছু জোঁক রাকিদালী নিজের হাতে—অনেকটা সোনা প্রেমি নারীরা, পরম যত্নে যেভাবে হাত থেকে সোনার বালা ছাড়িয়ে নেয়। ঠিক তেমনি। সেও মুখে থু! দিয়ে আস্তে আস্তে জোঁকগুলো ছাড়াতে থাকে। একদম ভয় ডরহীন। একদম নির্বিকার। এও ব্যাটার এক জীবন তার!
ডাক্তরি না ইনজিনিয়ারি! আমার পুলা তো দুবাই থাইকা বাড়ি করলো, বউ বানাইলো, জমি জিরাত করলো।
চলছে আষাঢ় মাসের ভরা বর্ষা। এখন পাহাড়ি এরিয়ায় বিল ঝিলগুলো এক ধরনের আঁষটে-ঘোলা লাল আবার স্বচ্ছ পানিতে মাতোয়ারা থাকে। মাঝে মাঝে ফাঁকে ফাঁকে সরল এবং গম্ভীর একটা ঘাই মারে। অদূরে দেখা যাচ্ছে, লতামিঞার মাঝারি ফিশিং নৌকাটি দুই পাশের পানি কেটে কেটে ধারালো হাঙরের মতো জাদরেল ভঙ্গিতে ছোটে আসছে। সামনের দিকে আসতেই দেখা গেল। মনকেমন কাঁঠাল। ভরপুর সবুজ আধা পাকা, কাল পাকা, কাল ঘন কালো কাঁঠাল। কিছু কাঁঠাল দেখে মনে হয় বর্ষার পানিতে অনেকদিন মজেছিল। বড় ধরনের পানির দাপানি খেয়েছে। রাকিদালী এর মধ্যে সে একটি কাঁঠাল বেছে নেয়; সাথে সাথে লতামিঞা বলে ওঠে কীরে তুইতো ভাই সেরা! এই ঘন আঁষটে লাল আবার ভজরঙ্গী টাইপের কালো কাঁঠাল কেউ ঘরে আনাতো দূরে থাক অনেকে চোখেও দেখতেচাইবে না। শুন্ আরো দুই একদিন যাক। এরপর খাইশ। কাঁঠালের কোঁয়াগুলো সেই বড় বড়।মধুর মতো স্বাদ হইবো। কোঁয়ার ভেতরে ভেতরে কোঁয়া। একেবারে ঘনিষ্ট ঘনিষ্ট। একটার সাথে একটা লাগানো লাগানো। একটার সাথে একটা ল্যাপটানো ল্যাপটানো দেখবি। কইলাম তো খাইতে কিন্তু সেই স্বাদ হইবো। রাকিদ: হ হ স্বাদে ভরপুরতো অইবোই…
এই ভরা বর্ষায় বিলের মাঝখানে বস্তা বস্তুা কাঁঠাল দেখে মনে হলো বাংলাদেশের জাতীয় ফল কাঁঠাল নামটার সত্যতা আছে বলতে হবে।এই আধা আধা বৈরি প্রাকৃতিক সবুজের মাঝখানে দাঁড়িয়েই তা বুঝতে পারা যায়। এই ফল খাওয়ার সেরা মজা হলো সবুজ ঘাসের উপর বিছিয়ে-ফেলে, হাত পা ছড়িয়ে চল্লিশ পঞ্চাশ টা হাতের নোঙর দিয়ে একেকটা কোঁয়া একেক ভঙ্গিতে গিলতে থাকা। টসটসা কাঁঠালের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে ইয়াবড়ো সাদা সাদা পোস্ট পোস্ট বিচি। এরেই বলে সম্ভবত আরেক ভুরিভোজ। এমন কাঁঠাল খাওয়ার পর, দু’একদিন পেটে দানা পানি না দিলেও চলবে। এই কাঁঠালের হাইপ্রোটিন দু’একদিন শরীরে বেশ ভালই যোগান দেবে।
এই এলাকার, এইসব ছায়া ছায়া, মিশকালো নানা বাস্তবতা, দিন গুজরানগুলো দেখেই বড় হয়েছে সুমন। প্রত্যেকটা স্মৃতির পরতে পরতে জড়ানো কতো সোনা। কতো মায়া। একেবারে নিখাদ। মজা মজা। মদাং মদাং মাটি। এই মাটি এতো খাঁটি। এই মাটি এতো বাংলাবান্ধব।এতো ফলময়। এতো মাটিময়। এতো বলময়। এতো রসময়। যা যা খাও, সবকিছু ফ্রেস ফ্রেস।
এরমধ্যে হঠাৎ রাকীদালীর সাথে দেখা হয়ে যায় সুমনের। তাকে দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ে রাকিদ। ছোটবেলায় তার সন্তান রাসেলের সাথে এক সাথে খেলাধুলা করে বড় হয়েছে। সবকিছু মনে পড়ছে রাকিদের।
সুমন: আসসালামু আলাইকুম।
চাচা যে, কেমুন আছেন ?
পয়লা পয়লা সে চিনতে পারে নাই।
পরিচয় দেওয়ার পর। ওহ্ হো ব্যাটা, তুমি যে!
রাকিদালী সুমনকে আবেগে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে, বলে, তুমি হইলা আমার পুলার ল্যাংচা কালের বন্ধু। তোমার বাপও আমার ল্যাংচা কালের বন্ধু। তোমারে চিনুম না! তয় অহন কর কী?
সুমন: জি, আমি চাচা পড়াশোনা শেষ করে একটি বিদেশি ফার্মে আছি। থাকি ঢাকায়।
রাকিদালি: ঐ টা কীসের লাইন? ডাক্তরি না ইনজিনিয়ারি! আমার পুলা তো দুবাই থাইকা বাড়ি করলো, বউ বানাইলো, জমি জিরাত করলো। মা-বাপরে হজ্ব করাইলো, তুমি কিছু করলানি ? অ্যাঁ, করলা কিছু ভাইপুত? তুমি কী করলা?