সৎকৃত্
এখনো জল গড়াগড়ি করছে মাটিতে। এসব জলের গায়ে ভূ-কেন্দ্রের ঠিকানা লেখা। পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে জল আসে, কেন্দ্রে ফিরে যায়। জলগণের মধ্যে কেউ পুকুরের, কেউ সমুদ্রের, কেউ নদীর, কেউ খালের। জলগণের কেউ মিঠা, কেউ লোনা। জলগণের কেউ মিষ্টি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়, কেউ বিষ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। কেউ জীবিত মানুষের শরীর ধোয়ার কাজে লাগে, কেউ মৃতের শরীর ধোয়ার কাজে লাগে। প্রথম বাক্যে গড়াগড়ি করা জলগুলো মৃতশরীর ধোয়া জল। এই বাড়ির আঙ্গিনায় একটা কাঠের চৌকির ওপর মৃতশরীরটি ধোয়া হয়েছিল। ভেজা চৌকি থেকে টুপ টুপ করে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছে এখনো, বেশ পরপর। বিশ ত্রিশ সেকেন্ড পর পর জল পড়ছে—টুউপ… টুউপ… টুউপ। টুউপ বা টুপ বটে তবে নিঃশব্দ। নিঃশব্দ টুপ। টুপ শব্দ নিঃশব্দে ঝরে পড়ার শব্দ। প্রতিটি টুপ যেন পঞ্চাশ বা ষাট বা সত্তর বছর পর পর হচ্ছে। দেখতে দেখতে ক্লান্তি আসে। একবার একটা জলের ফোঁটা পড়ার পর আবার জমা হয়। জমা হয়, জমা হতে থাকে। জমা হয় ঝরে পড়ার মাপে। ঝরে পড়ার মাপ পূর্ণ হলেই—টুপ। বাড়িটা তুলনাপূর্ণভাবে ফাঁকা তবে দুই-একজন অতি দরদি পড়শী এখনো আছে। তাদের মুখ চোখে শোকের ছাপচিত্র, দরদের তৈলচিত্র, অংশগ্রহণের আনন্দচিত্র। লোকজন বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই কান্নার নতুন করে একটা সুর তুলেছিল মাজিফা ওরফে একটা মহিলা ওরফে যার বয়স ৪৮ বছর ওরফে ৬ সন্তানের মা। কান্নার সুরটা চলছে এখনো। নাকফুল খুলে নেওয়া হয়েছিল শ্বাস বন্ধ হওয়ার ক্ষণেকের মধ্যেই। এ কাজে পাড়াতে কিছু প্রসিদ্ধ মেয়েলোক থাকেন যাদের কিছু সিদ্ধস্মরণা, স্মরণ করিয়ে দেন—‘কানফুল, গলাফুল, চুলফুল খুলতে হবে’। কিছু মহিলা আছেন যারা সিদ্ধহস্তা, স্মরণ করিয়ে দেওয়া মাত্র খুলতে শুরু করেন। পাঠকগণ, নিশ্চয়ই আপনারা কর্পূরের গন্ধ পাচ্ছেন। যেহেতু দৃশ্যগুলোর গায়ে কর্পুরের গন্ধ লেপ্টে আছে সেহেতু বুঝতে পারা গেছে, একজন মানুষ ওরফে ৫০ বছর ওরফে একজন পুরুষ ওরফে রমজান মিস্ত্রি ওরফে ৬ সন্তানের বাপ মারা গেছে। লাশবাহী কাফেলা চলে যাওয়ার পরে মৃত বাড়ির যে চিত্র হয়, আমরা এতক্ষণ থেকে সে চিত্র দেখছি। কফিন কাফেলা বের হওয়ার আগে যেসব চিত্র ছিল সেগুলো হলো—মারা যাওয়ার পর, লাশের পাশের কোরান পাঠের আসর, লোকজনের যাওয়া-আওয়া, মুন্টুর বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ সংগ্রহ, বাজার থেকে কর্পূর-কাফন খরিদ, লুৎফরদের বাড়ির বরই পাতা ছিঁড়ে আনা—এসব। মাজিফা কাঁদছে কারণ তার স্বামী মারা গেছে। ৩০-৩২ বছরের সংসারচালের একটা খুঁটিনি হলো। কাঁদছে বড় অমনোযোগী হয়ে। অনেক কিছুই ভাবছে আর কাঁদছে। ভাবনা গভীর হলে কান্না ধীরে-ধীরে থামছে। কান্না থেমে গেছে মনে হতেই কাঁদতে শুরু করছে। আবার ছেঁড়া ভাবনা জোড়া লেগে যায়। ভাবনা গভীর কান্না ধীর, কান্না উচ্চ ভাবনা নিম্ন—এভাবেই চলছে সেই সকাল থেকে। তাদের ছেলে মেয়েরা একেকজন একেকরকম সমস্যা সৃষ্টি করেছে পৃথিবীতে বা একেক রকম সমস্যার ভেতর পড়ে আছে। এক ছেলে কোনোরকমে পড়া শেষ করে, চাকরি নেওয়া শেষ করে, বিয়ে করা শেষ করে জেলার বাইরে থাকে। এক ছেলে অত্র অঞ্চলের বিরাট মাথা ব্যথার কারণ হয়ে আছে। তার চাঁদাবাজি, গুণ্ডামি আর নেশাবাজিতে কাতর পুরো এলাকা। যে ছেলেটা পঙ্গু হয়ে জন্মেছিল সে শহরে গিয়ে ভিক্ষা করে, কোথায় ঘুমায় কোথায় থাকে তার স্থির ঠিকানা কেউ জানে না। জলের মতো টলমলে, জলের মতো অস্থির ঠিকানা অন্য আর একটা ছেলেরও। যেমনভাবে মেয়েদের প্রধান পেশা শীৎকার উৎপন্ন করা, তেমনই তাদের এক মেয়েও এ পেশা নিয়েছে। তার শীৎসঙ্গী বা স্বামী চাকুরে। ছেলে মেয়েরা নিজ নিজ পেশা আর সংসার নিয়ে ব্যস্ত। ‘বাবা-মায়ের কাছে আসা কম’ অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে। অবশ্য ফোনে নিয়ম মাফিক ‘যোগ-অযোগ’ আছিল এক মেয়ের। আজও এসেছে সে। মেয়েদের মধ্যে যে মেয়েটা মেজ সেও বিয়ে করেছিল কিন্তু যৌতুকের কারণে বা যেসব কারণে পৃথিবীতে তালাক হয় সেসব কারণের কোনো একটা কারণে তালাকা হয় সে। তার পর থেকে পাশের ছোট শহরটাতে সে নিয়মিত যাতায়াত করে। শহরের দাদারা, বাবারা, ছেলেরা, রিক্সারা, ড্রাইভাররা, শ্রমিকরা সবাই তাকে টাকা দিয়ে দিয়ে চিনে নেয় প্রতিদিন। টাকা নিয়ে সে ছেলে বুড়ো সকলের সঙ্গেই পরিচিত হয়। মাঝে মাঝে বাড়ি ফিরে আসে। আজ সে আসেনি। তার বাবার যখন সৎকার হচ্ছে তখন হয়ত অন্যকারও বিছানার সঙ্গে সে পরিচিত হচ্ছে। তবে ‘সে তার বাবাকে খুব ভালোবাসে, পরে শুনতে পেলে সে খুব করে কাঁদবে’ এমন কথা কেউ কেউ বলছে। সৎকার নিয়ে তেমন আর কিছু নয়। বিশ্ব-বিপুল সূত্র-মতে আমরা জানি, কিছুক্ষণ বা কিছুদিন পর আবার সৎকার হবে মাজিফার। বরই পাতা, কাঁচা বাঁশ, সাদা কাফন, পড়শীদের আসা যাওয়া, ছেলে মেয়েদের কান্না, কোরান পাঠ, চৌকি থেকে ফট ফট করে জল পড়া, নিচে জলের গড়াগড়ি আর জলের গায়ে ভূ-কেন্দ্রের ঠিকানা ছাপা। আর—টুপ… টুউপ… টু… উ… প…
ইতি—আখ্যানে বর্ণিত জীবনের চতুর্থ অধ্যায়ের জীবন ভাবনায় নির্ধারিত সৎকার বিষয়ক আখ্যানকারের ভাষ্য সমাপ্ত।
চমৎকৃত
রমজান টেন পাস করার আগেই আর মাজিফা এইট পাস করার আগেই—উভয়েই প্রেমান্বিত। কারণ, রমজান হিন্দি গান খেলাতো গলায়, বাতাসের আগে সাইকেল চালাত, সিঁথি পরিপাটি, বাপের কষ্ট করে কামানো টাকা ওড়ানো, সিনেমার ডায়ালোগপ্রিন্ট কথাবার্তা মাজিফার পছন্দ ছিল। সিনেমা হলের সিনেমাতে যেসব নায়ক দেখা যায়, তাদের সঙ্গে রমজানের অনেক মিল। মাজিফার ‘এলোমেলো বাতাসে উড়িয়েছি শাড়ির আঁচল’ প্রিন্ট মনোভাব, লম্বা মাথার কেশ, চিরল দাঁতের হাসি, বাঁশির মত নাক, চুড়ির শব্দের মুড়কি মোয়া এবং তার ঝকঝকে করে মাজা মাজার কাঁসরকলসে সূর্য নেমে এসে চোখ ঝলসায়। ঝকঝকে করে মাজা কাঁসর কলস সূর্যের আলোয় সোনা হয়, আগুন হয়। রমজান পতঙ্গ প্রায় পুড়িতে চাইল, মাজিফা না করল না। প্রেমান্বিত। তারপর থেকে খুব গোপনে আলাপন, গোলাপালাপন, চিঠিলাপন, আলিঙ্গনালাপন। ‘যারা হেসে খেলে জীবন ভালবাসে’ তারা ‘তাদের দলে মিশে, ডিস্কো নাচে’ আর পড়াশোনার নাম করে বাবা মাকে ডিস্কো নাচাতে লাগল। তারা বুঝে গেল, তারা তারাকে ছাড়া বাঁচবে না।
ইতি—আখ্যানে বর্ণিত জীবনের প্রথম অধ্যায়ের মানুষভাবনায় নির্ধারিত চমৎকৃত বিষয়ক অধ্যায়ের আখ্যানের ভাষ্য সমাপ্ত।
শীৎকৃত্
পালিয়ে গিয়ে বিয়ে। পরিবারে পরিবারে না মানামানি। তারপর মানামানি। সময়গুলো লেপ্টে গেল ঘরে, বিছানায়। অথচ বাইরে মানুষের আর্তনাদ, তারা রমজানকে, মাজিফাকে ডেকেছিল। বাইরে স্কুল, পাঠাগার, বইয়েরা তাদের ডেকেছিল। বাইরে অফিসে প্রচুর কাজ তারা, বাইরে ছবি আঁকার ক্যানভাস তারা, কবিতা লেখার খাতা তারা তাদের ডেকেছিল। বাইরে বিজ্ঞানের প্রয়োজন, বাইরে রোগী, যান চালানোর লোক নেই, তারা তাদের ডেকেছিল। স্কুল কলেজ, বাবা মায়ের সুখদুঃখ তাদের ডেকেছিল। পশুপাখির কষ্ট, সুর-সংগীত সৃষ্টিতা তাদের ডেকেছিল। বাইরে ক্রিকেট-ফুটবলের মাঠ, বাইরে বহু নাট্যমঞ্চ তাদের ডেকেছিল। বাইরে মৃত মানুষ, সৎকার, তাদের ডেকেছিল। বাইরে অনেক ডাক, অনেক প্রয়োজন। প্রয়োজনেরা তাদের ডেকেছিল। কিন্তু তারা বিছানা ছেড়ে এলো না। শরীর কারণ, শরীর ব্যাকরণ। অথচ পৃথিবী মাজিফাকে দিয়েছে রমজানকে, রমজানকে দিয়েছে মাজিফাকে। পৃথিবী তাদের দিয়েছে আলো, বাতাস। তারা আর্ত হলে পৃথিবীর কিছু মানুষ দেখেছে, সেবা দিয়েছে। তাদের অবস্থানের জন্য জায়গা দিয়েছে পৃথিবী। ছবি দিয়ে তাদের চোখ ভরিয়েছে পৃথিবীর শিল্পীরা। কবিতা শুনিয়েছে পৃথিবীর কবিরা। গান শুনিয়েছে কণ্ঠগণ, কণ্ঠীগণ।
ইতি—আখ্যানে বর্ণিত জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের মানুষভাবনায় নির্ধারিত শীৎকৃত বিষয়ক অধ্যায়ের আখ্যানের ভাষ্য সমাপ্ত।
চিৎকৃত
কিন্তু বেশিদিন শীৎকার চলে না শুধু শুধু। চিৎকারও আসে। কারণ তাদের বুক পার হলেই একটা থলে ছিল এবং তাতে প্যাচানো সাপের মতো নাড়িভূঁড়ি ছিল—সেসব নাড়িভূঁড়িতে—অন্তত শীৎকার সৃষ্টির জন্য যে শক্তি প্রয়োজন, সে শক্তি সৃষ্টি করতে খাদ্যের প্রয়োজন ছিল, এটা প্রথম বুঝতে পেরেছিল যার পিঠ বিছানায় ঠেকে থাকত সেই ভারবাহী। সে বলল—‘তোমার মা তো আগেই মারা গেছে, তোমার বাবাও মারা গেল। নাড়ির মজুদ সব শেষ এবার নাড়ি ভরার আয়োজনে বেরও।’ রমজান বলত—‘থামো কদিন যাক’। রমজান চিন্তায় পড়ল— ‘লেখাপড়াতো কিছু শিখিনি, আহা পড়াটা যদি শেষ করতাম। কাজ তো কিছু শিখিনি, যদি শিখতাম’। এ রকম সাত-পাঁচ (মোট বারো রকমের নয়, অসংখ্য ভাবনা আর হতাশা) ভাবনা ভাবে রমজান আর শুয়ে থাকে। মাজিফা বিরক্ত হতেই থাকল—‘তোমার মতো অপদার্থকে বিয়ে করে কী ভুলই না করেছি!’ রমজানের সিঁথি, ডায়ালোগপ্রিন্ট কথা, সাইকিং ইত্যাদির আর কোনো গুরুত্ব নেই। মাজিফার চিরল দাঁতযুক্ত মুখ হাসি ভুলে গালি পাড়তে লাগল রমজানকে। কালো কেশ, তেলহীন। আর রমজান, তার দেখা সে আপেলের মতো গালে এখন চুমুর বদলে চড়, কালো রেশম চুলে ফুল গোঁজার বদলে হাত গুঁজে হ্যাঁচড়াতে লাগল। আত্মপ্রসার দূরে যাক, আত্মক্ষরণই যখন কষ্টকর হয়ে গেল, তখন মরিয়া হয়ে উঠে দাঁড়াল মাজিফা। মনস্তাত্বিক যে সকল ব্যাপার আছে, সেগুলোর মধ্যে ঘৃণাই সব চাইতে বেশি শুদ্ধ। তাদের মধ্যে প্রচুর ঘৃণা-ঘৃণি হলো। নিজেরা নিজেদের কাছেই অবাক হয়ে গেল, এভাবে একে অন্যের কাছে ঘৃণিত হতে দেখে। একে অন্যকে ঘৃণা করার পরে নিজেদের প্রতিই তাদের ঘৃণা তৈরি হতে থাকে। ঘৃণা হয়। রমজান অগত্য একদিন বের হলো রাজের কাজে। গতকাল পর্যন্ত কাটল তার রাজমিস্ত্রির কাজ করে। তারপর ইটের পাঁজা মাজায় পড়ে, বুকে পড়ে। এরপর আর কিছু নেই। এরপর শুধু সৎকার অধ্যায়কে মেলাতে হবে।
ইতি—আখ্যানে বর্ণিত জীবনের তৃতীয় অধ্যায়ের মানুষভাবনায় নির্ধারিত চিৎকৃতবিষয়ক অধ্যায়ের আখ্যানকারের ভাষ্য সমাপ্ত।
টীকা: এতক্ষণ পুণ্যাখ্যানে যা বর্ণিত হলো, তা হলো—পৃথিবী এক নির্মম জন্তু। তবে মানুষের কিছুটা হলেও ভালো থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। পৃথিবীর নির্মমতার ভেতর থেকেও কিছুটা শান্তিশ্বাস নেওয়া যেতে পারে। প্রেম ব্যাপার ভালো ব্যাপার। কিন্তু তা মাজিফাকে বিলিয়ে দিতে হবে মানুষের দিকে, সৃষ্টির দিকে, রমজানের দিকে। আবার, রমজানকে এ প্রেম বিলিয়ে দিতে হবে মানুষের দিকে, সৃষ্টির দিকে, মাজিফার দিকে। আমাদের জীবন ব্যয়ের উদ্দেশ্য হোক পৃথিবীব্যাপী, পৃথিবীতে পৃথিবীর পৃথিবীত্ব আর তার জান্তবতার ধার কিছুটা কমানো।
আর হ্যাঁ, সব পেশাই সম্মানজনক, প্রাণজনক আমরা জানি। কিন্তু শুধু প্রাণ বাঁচানোটাই জীবন নয়, না বুঝে বেঁচে থাকাটা জীবন নয়, প্রবৃত্তির স্রোতে ভেসে যাওয়া জীবন নয়।
ইতি
আখ্যানকার