সে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। আয়নাতে নিজেকে দেখে। আয়নাটা তাকে দেখে। আয়না তার মুখ দেখে কিছু একটা বোঝে ও সঠিক বুঝে ওঠে। এবং তাকে নিষেধ করার আগেই ব্যাপারটা ঘটে। সে আয়নাতে বিশাল জোরে ঘুষিটাকে নিক্ষেপ করে—আমি আমাকে হত্যা করলাম। আয়নাটা চুরমার হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সে তাকিয়ে দেখল ড্রেসিং টেবিলের যেখানে আয়নাটা আটকানো ছিল সেখানে কিছু নেই, সেখানে তাকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। সে মেঝেতে তাকায়, দেখল, তার হাত পা চোখ কান মাথা বিভিন্ন জায়গায় ভেঙে পড়ে আছে। সে স্বস্তির শ্বাস ফেলে, যাক সুন্দরভাবে আত্মহত্যা করা গেল। একটা কাপড়ের ব্যাগে একটা করে টুকরো কুড়িয়ে ঢোকায়। আঙ্গুল হাত মাথা পা বুক পেট ব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে বাড়ির পেছনে এক জায়গাতে কবর দিয়ে দেয়—আমি আমাকে কবর দিলাম। ধর্মের বইতে লেখা আছে, কবর দেওয়ার পর, মানুষের চল্লিশ কদম হাঁটার জন্য যতটুকু সময় দরকার, ততটুকু সময় পর দুজন ফেরেশতা আসে কবরে। তাদের একজনের নাম মুনকার একজন নকির। একজন বয়রা ফেরেশতা একজন অন্ধ। সে বসে থাকে কখন মুনকার নকির আসে, সে অপেক্ষায়।
সে দুজন নারীকে হেঁটে আসতে দেখল। সে অবাক হয়। বেশ সাজগোজ করা দুজন নারীকে দেখে বিস্মিত হয়। দুজনের ঠোঁটেই গাঢ় লিপস্টিক মাখা। আঙুলে নীল নেইল পালিশ। গলায় সোনার মালা, লকেটে হীরের ঝলক। একজন জিনস আর টপস। একজন সুন্দর ঝকঝকে শাড়ি পরা। সে ভাবে—ফেরেশতা কি নারী হয় নাকি? ফেরেশতাদের আমি এতদিন পুরুষ বা পুরুষের মত ভেবে এসেছিলাম এখন দেখছি ফেরেশতা পুরুষ নয়, ফেরেশতা নারীলিঙ্গের। ফেরেশতা দুজন এসে তাকে গালাগালি করা শুরু করে। সে বলে—মহামান্য ফেরেশতাগণ, আমি তো জানি, ফেশেতারা এসে প্রথমে প্রশ্ন করেন, তারপরে, প্রশ্নর উত্তর দিতে না পারলে তবেই দুর্ব্যবহার করেন, আপনারা আগেই খারাপ ব্যবহার শুরু করেছেন কেন? তবে কি ধর্মগ্রন্থে ভুল লেখা আছে, মহম্মদ কি মিথ্যা কথা বলে চলে গেছেন? কী, এসব উল্টাপাল্টা কথা বলছ—বলে একজন ফেরেশতা কলার ধরে টেনে তুলে। আর একজন একটা হাত ধরে টেনে নিয়ে আসে। তাকে নিয়ে আসা হয় ড্রেসিংরুমের ভেতর, ড্রেসিং আয়নার সামনে—মনের বিষ ঝাড়তে আয়নাটা ভাঙা হয়েছে না, বউ, মেয়ের সাধ আহ্লাদ মেটানোর এতটুকু মুরোদ নেই আবার আয়না ভাঙা হয়েছে। আচ্ছা ফিরে এসে দেখব তোমার কী করি। তার ঘুম ভাঙার মতো করে ভুল ভাঙে। এরা ফেরেশতা নয়। একজন তার বউ, অন্যজন মেয়ে। মা মেয়ে বেরিয়ে যায়। সে শুধু বুঝতে পারে, সে যে আত্মহত্যা করেছিল বলে মনে করেছিল তা ঠিক না, তার আত্মহত্যা হয়নি। তার আত্মহত্যার পদ্ধতি ঠিক ছিল না। শুধু আয়নাটা ভেঙে গেছে। সে বিষণ্ন মনে বসে থাকে মনের তলে।
এ শহরে প্রচুর টাকা আছে। তার কোনো টাকা নেই। সামান্য চাকুরি। বউ মেয়ের সাধ আহ্লাদ মেটাতে এ চাকুরি বড়ই কৃপণ। চাকুরির এত কৃপণতা থাকলে বেঁচে থাকায় কঠিন। অথচ বউকে, মেয়েকে ভাল ভাল গয়না পরে, পোশাক পরে, বাইরে যেতে দেখতে হয়। এসব গয়না এসব পোশাক একটাও তার চাকুরি কিনে দেয়নি।
সে আত্মহত্যা করার একটা কার্যকর পদ্ধতির কথা চিন্তা করে। সে উঠে দাঁড়ায়। বাইরে যায়। কিছুদূর হেঁটে গেলে একটা দড়ির দোকান। দোকানে গিয়ে সে দড়ির দাম জিজ্ঞাসা করে। দড়ির দাম জিজ্ঞাসা করা দেখে, দোকানি সরু চোখে তার দিকে তাকায়। একটা দড়ি ঘষঘষে কণ্ঠে দোকানিকে বলে—এর কাছে দড়ি বেচ না এ লোকটা আত্মহত্যা করার জন্য দড়ি কিনতে চাইছে। লোকটা জিজ্ঞাসা করল—দড়ি কী কাজে লাগাবেন ভাই? ভাই বললো—গরু বাঁধব, গরুকে বেঁধে রাখব। তারপর জবাই দেব। গরু দুধ দিতে পারে না। দড়ি বললো—মিথ্যে বলছে লোকটা। দোকানি দড়িকে ধমক দেয়—চুপবে, টাকা আসা নিয়ে কথা আর কিছু জানার দরকার নাই। দোকানি তার দিকে তাকিয়ে বলে—নেন ভাই দড়ি নেন, গরুর গলার সাথে এ দড়ি বেশ মানানসই।
লোকটা দড়ি কিনে এনে একটা ফ্যানের সঙ্গে বাঁধে। দড়িটা তাকে বলে—শোন, তুমি ভুল করছ। আমি দড়ি। আমাকে দিয়ে গরু-ছাগল বা বস্তা বেঁধে রাখা হয় সে জিনিসটা রক্ষা করার জন্য। কিন্তু তুমি যা করতে যাচ্ছ তা রক্ষা নয়। এরপরেও তুমি যদি গলাতে বাঁধার চেষ্টা কর আমি তোমাকে হেল্প করব না, নিজেই ছিঁড়ে যাব। লোকটা দড়ির কথা মেনে নেয়। সে ভেবে দেখে, সত্যিই তো দড়ি তো আত্মহত্যার জন্য নয়। দড়ি তো মানুষ বাঁধার জন্য নয়। দড়ি গরু-ছাগল বাঁধার জন্য। সে নিজেকে কি গরু ছাগল ভাবতে শুরু করেছিল? তাকে তার পরিবারের লোকজন গরু-ছাগল ভাবে। দড়ি তাকে গরু ছাগল ভাবে না কেন? গরুও একটা কাজের প্রাণী। সে গরু নয়। সে দড়িতে আত্মহত্যা করবে না। সে শুয়ে থাকে। সে ঘুমে থাকে।
ভোরে ঘুম ভাঙলে দেখে, মা মেয়ে কত রাতে জানি ফিরে ঘুমিয়ে আছে এক জায়গায়। সে বেরিয়ে যায় বাসা থেকে গোসল করে, অফিসের পোশাক পরে। একটা ছোটো হোটেলে গিয়ে সামান্য নাস্তা করে অফিসের দিকে যাবে এমন একটি বাসের জন্য যাত্রী সারিতে দাঁড়ায়। বাস আসে অনেকক্ষণ পর। বাস থামে, বাস যায়। অফিসে পৌঁছে সে। অফিস তার কাছে পৌঁছে। অফিস তার কাছে এলো দশ মিনিট দেরি করে। ডেস্কে বসার কিছুক্ষণের মধ্যে বসের কলিংবেল তাকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে বসের কক্ষের ভেতর নিয়ে আসে। বস লোকটা কারণে অকারণে খারাপ ব্যবহার করে। তাকে সালাম দিতে ইচ্ছে করে না। সে তাকে সালাম দিল। বস বেশিরভাগ সময় সালামের উত্তর করেন না। তিনি বললেন—এত দেরি করে আসলেতো চাকুরি ছেড়ে দেওয়ায় ভাল। বউকে ছেড়ে আসতে মন চাই না, বউয়ের আঁচলের নিচে শুয়ে থাকবেন। বলতে বলতে একটা ফাইল বেশ জোরে টেবিলের উপর দিয়ে পিছলে দেয় তার দিকে। ফাইলটা এক ঘণ্টার মধ্যে সেরে রাখুন। ফাইলটা টেবিলের কাঁচের উপর দিয়ে পিছলে পড়ে যায়। ফাইলটা তুলতে গেলে টেবিলের উপর রাখা একটা গ্লাস তার হাতে লেগে পড়ে ভেঙে যায়। বস এবার চিৎকার দিয়ে ওঠে—আমাকে রাগ দেখানো হচ্ছে না, গ্লাস ভেঙে রাগ দেখানো হচ্ছে। আমি আজই কোম্পানির ডিরেক্টরের কাছে আপনার ব্যাপারে লিখে দিচ্ছি। স্যার আমি ইচ্ছে করে ফেলিনি, রাগও করিনি, প্লিজ স্যার ওপরে কিছু জানাবেন না। সে দারুণ হতাশায় ক্ষোভে বেরিয়ে আসে। ডেস্কে বসে। জন্ম নিয়ে ভাবে, বেঁচে থাকা নিয়ে ভাবে। মৃত্যু নিয়ে ভাবে। আত্মমৃত্যু নিয়ে ভাবে।
সন্ধ্যার আগে দিয়ে অফিসের ডেস্ক তাকে ছাড়ে বা সে ডেস্ক ছেড়ে ওঠে। পনের তলা এই বিল্ডিংয়ের ভেতর থেকে জানালা দিয়ে নিচের রাস্তার দিকে তাকায়। অজস্র কীট হেঁটে বেড়াচ্ছে। কিলবিল করছে মানুষ। মৃত পচা প্রাণীর শরীরের উপর যেমন পোকা দেখা যায় এই পনের তলার ছাদ থেকে ঠিক তেমন কীট মনে হচ্ছে মানুষগুলোকে। সে পনের তলা থেকে নেমে আসে। উপরের দিকে তাকায়। সে ভাবে, উপর থেকে কেউ যদি এখন তাকায় নিশ্চয়ই তার মনে হচ্ছে সেও একটা কীট। কিন্তু নিচে নেমে এসে তার এখন আর কাউকে কীট মনে হচ্ছে না। সে বিশাল বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে নিজে নিজে দুজন হয়। একজন নিচে থাকে অন্যজন পনের তলার উপর উঠে। নিচের জন উপরের ভাগকে দেখে, তার মনে হয় পনের তলায় একটা কীট দাঁড়িয়ে আছে। ওপরের জন নিচের জনকে দেখে তারও মনে হয় নিচে একটা কীট দাঁড়িয়ে আছে। ওপর নিচে নেমে এলে সে আবার এক হয়ে হাঁটতে থাকে। বেঁচে থাকার অর্থ তার কাছে মনে হয় একধরণের গোলামি। এ গোলামি থেকে মুক্তির উপায় সে চিন্তা করে। তার বউ, সেও এক গোলামির ভেতর আছে। তার মেয়ে, সেও এক গোলামির ভেতর পড়ে গেছে। আহা মেয়েটা যেখানে ছিল—জন্মের আগে কোথাওতো ছিল—নিশ্চয়ই সেখানে সে গোলাম ছিল না, বলে, জন্মের সময় কেঁদে উঠেছিল। আমরা সবারই জন্মের সময় কেঁদে উঠি কেন? এখানে মনে হয় আমরা আসতে চাইনি। সে স্টেশনের দিকে যায়। সে দাঁড়ানো ট্রেনের দিকে কাতর নয়নে তাকিয়ে থাকে। সে ঘড়ির দিকে দেখে। ঘড়িতে যা বাজছে তার দশ মিনিট পর ট্রেনটা ছুটে যাবে। সে সিদ্ধান্ত নেয় স্টেশন থেকে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াবে। ট্রেনটা গতি পেলে, গতি পেয়ে এগিয়ে এলে, তখন সেও চাকার ভেতর ঢুকে পড়ে অন্য স্টেশনের দিকে চলে যাবে। ট্রেনের ধাতব চাকা বলে উঠলো—তুমি যা ভাবছ, তার জন্য আমি তৈরি হইনি। আমি যাত্রীরাদের নিরাপদে পৌঁছে দেওয়ার জন্য হয়েছি। তুমি চলে যাও। সে ট্রেনের চাকার কথা মন দিয়ে শুনে। মনে মনে ভেবে দেখে, চাকারা ঠিক কথায় বলেছে। সে চলে আসে।
বাড়ি এসে শুয়ে পড়ে বেশ রাতে। শুয়ে শুয়ে শৈশব, কৈশোর, যৌবন বুকের ভেতর থেকে বের করে আনে। শৈশবের সঙ্গে, কৈশোরের সঙ্গে খুনসুটি করে। খুনসুটি শব্দ থেকে খুন শব্দাংশটিকে বিচ্ছিন্ন করে সেটাকে নিয়ে ভাবতে থাকে। খুন শব্দাংশটি এখন নতুন একটা পূর্ণ শব্দ। খুনটাকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। এসব শিক্ষিত ঘুম। এসব শিক্ষিত ঘুমের ঠিক মনে থাকে আজ ছুটির দিন, আজ বেশিক্ষণ ধরে তাকে ধরে রাখা যাবে। বেলা দশটার দিকে ঘুম ক্ষয় হয়ে যায়। সে উঠে আর বউ তাকে নাস্তা করতে বলে। সে নাস্তা করে বের হয়ে যায় রাস্তায়। হাতে বাজারের ব্যাগ। অপারেশন ক্লিনহার্ট চলছে দেশে। দেশের হার্ট ক্লিন করার চেষ্টা চলছে। একটু গ্যাঞ্জাম মতো জায়গায় এসে একটা আর্মির গাড়ি হঠাৎ করে থামে। নেমেই রিকশাওয়ালা, ঠেলাওয়ালা, হেঁটে যাওয়া মানুষকে পেটাতে শুরু করে। কেন পেটাতে শুরু করে, কার জন্য পেটাতে শুরু করে কিছু বুঝে উঠতে পারে না। কার হাত থেকে একটা মুরগি ছুটে গিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে একটা গাড়ির নিচে পড়ে গেল। গাড়িটা চলে গেলে মুরগির নাড়িভুড়িমাংসরক্তকে, মুরগির পেটে থাকা অপূর্ণ ডিমগুলোকে রাস্তার সঙ্গে চ্যাপ্টা অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখল সে। সে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একজন আর্মি সদস্য এসে তাকেও দুটা বাড়ি লাগিয়ে দিল। সে চমকে উঠে বলল—আমাকে কেন মারছেন? কী কারণে মারছেন? এই প্রশ্ন সম্ভবত ম্যাচের কাঠি ছিল। সেনাদের মগজ সম্ভবত বারুদ ছিল। তারা প্রশ্নকাঠিতে আরো জ্বলে গিয়ে মারতে থাকল, যতক্ষণ না সে মাটিতে পড়ে গেল। মাটিতে পড়ে গেলে লাত্থি দিয়ে তাকে গড়াগড়ি করিয়ে চলে গেল আর্মিগুলো। সে কষ্টে উঠে বসে। সে ক্ষোভে ঘৃণায় কেঁদে ফেলে। তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ে। লোকজন তাকে বাসা পৌঁছে দেয়। সে ভুলতে পারে না অপমান, সে ভুলতে পারে না গ্লানি। দুই তিন চার পাঁচ দিন যায়। সে ভুলতে পারে না। জীবনের প্রতি তার চরম বিতৃষ্ণা জন্মেছিল, জন্মে গেল আরও বেশি।
যেদিন সে একটু উঠতে পারল। সেদিন হেঁটে হেঁটে কীটনাশকের দোকানে গিয়ে হাজির হলো। সে কিছু কীটনাশক কিনে বাড়ি ফিরে এলো। টেবিলের ওপর কীটনাশক রেখে সোফায় গিয়ে বসে। সে কীটনাশকের দিকে তাকায়। কীটনাশকের দিকে তাকাতেই কীটনাশক বলে—আমি কিন্তু কীটনাশক, কীট নাশ করার নিমিত্তে তৈরিকৃত। তুমি আমার দিকে তাকিয়ো না, এগিয়ে এসো না। তুমি কি কীট যে আমাকে দিয়ে নাশ হবে? কীটনাশকের কথা শুনে সে মৃদু হাসে, কীটনাশকের দিকে হ্যাঁ সূচক মাথা দুলিয়ে তাকায়। সে এগিয়ে গেল কীটনাশকের দিকে। তরল কীটনাশক তার ভেতর গিয়ে মৃদু হেসে তার পরাণের সঙ্গে কথা বলা শুরু করল। সেও হেসে হেসে কীটনাশকের সঙ্গে কথা বললো কিছুক্ষণ, তারপর সে ঘুমিয়ে গেল কীটনাশকের ভেতর, কীটনাশক ঘুমিয়ে গেল তার ভেতর। তেলাপোকা জাতীয় পতঙ্গরা, কীটেরা, ইঁদুরেরা তাদের দিকে তাকিয়ে থাকলো সারারাত ধরে।