নাজমা রান্নাঘরের ফ্লোরে বটি পেতে দু-পা ভাঁজ করে বসেন। বসাটা যে খুব জুৎমতো হয়, তা না। বলতে কী, আজকাল ফ্লোরে বসতে কষ্টই হয়। বয়স! শরীর গেছে ভারী হয়ে। বুকের ভেতরে হাঁস-ফাঁস, শ্বাসেও কষ্ট। অবশ্য কাটাকুটির কাজটা টেবিলে বসেও করা যায়। বড় ছেলে চাকরি পেয়ে ছুরি চাপাতি পিলার কাটিং বোর্ড আরো কী কী সব কিনে দিয়েছে। ওই সবে দু-একবার চেবিলে বসে শাক-তরকারি যে কাটেননি তা নয়, কেটেছেন। তবে কিনা অনভ্যস্ত হাতে ঠিক স্বস্তি পাননি। পেঁয়াজ-রসুন কেমন পিছলে পিছলে যায়, আলু কী লাউ কোনটাই সাইজমতো কাটা যায় না। এক টুকরো বড় তো এক টুকরা ছোট। ছুরিতে কাটতেও ভয় ভয় লাগে। এই বুঝি ফসকে গিয়ে হাত কাটল। এক দিন তো আঙুল কেটে রক্তাক্তই হতে হলো। এখন আর ওইসবে চেষ্টাও করেন না নাজমা। যতœ করে তুলে রেখেছেন সব। অবরে-সবরে বড় মেয়ে মেঘনা বেড়াতে এলে সে ওইসব নামিয়ে কাটাকুটি করে। মেঘনা তাঁর সাথে গল্প করতে করতে কী অবলীলায় কাটাকুটি করে। কাটছে যে, সেদিকে ভালোমতো তাকায়ও না। না তাকানোতে মেয়ের যে অসুবিধা হয়, তা-ও না। শাক-তরকারি পেঁয়াজ-রসুনই হোক, কী মাছ-মাংসই হোক সবই সুন্দরভাবে কাটা হয়। তা মেঘনা হলো এই যুগের মেয়ে। তাদের কত রকমের গুণ! নাজমা সেই কোন পুরোনোকালের মানুষ, তাঁর ওইসবে কাজ করে পোষায়!
ফ্রিজ থেকে বের করা পলিথিনটা ফ্লোরে উপুড় করতেই পটলগুলো দেখে মেজাজটা খারাপ হয়ে যায় নাজমার। কিছুটা চিৎকারই করেন তিনি, ‘সোহাগী… সোহাগী, এই সোহাগী, গেলি কই!
খালাম্মা, আসছি।
আসছি বলে তো বছর পার করে দিলি। দুপুর থেকে সিরিয়াল দেখতে বসেছিস। এখনো দেখা শেষ হয়নি… দুই দিন ধরে বলছি, পটলগুলো বের করে রান্না কর। কোনো কথা তোর কানে গেলে তো!… পটল সবগুলো পচল। আমাদের কি টাকার গাছ আছে, যে জিনিসপত্র কিনবি আর নষ্ট করবি! একদিন বেগুন পচে, একদিন টমেটো পচে, আরেক দিন শাক শুকায়।
এই যে খালাম্মা, কী বলেন?
কী আর বলব? সারাদিন চেঁচাতে চেঁচাতে আমার গলা ব্যথা হয়ে যায়, উনি এসে জিজ্ঞেস করেন, কী, বলেন? রাত-দিন টিভির সামনে হাঁ করে বসে থাকিস কিভাবে? এই বাসায় ঢুকতে না ঢুকতে টিভির নেশা হয়ে গেল!… কবে পটলগুলো এনেছে তোর খালু। এতদিনেও রান্না করলি না। দেখ পচে কী অবস্থা!
খালাম্মা, আপনি তো খালি পটল রান্নার জন্য বলেছেন। কী মাছ দিয়ে রাঁধব, কিভাবে রাঁধব, কিছুই বলেননি।
খালি মুখে মুখে তর্ক। কী মাছ-তরকারি রান্না করবি, তা প্রতি বেলা যদি আমাকেই বলে দিতে হয়, তো তুই আছিস কেন? নিজে বুদ্ধি করে রান্নাটাও করতে শিখলি না। কম দিন তো না এ বাসায় আছিস। পাঁচ মাস হয়ে গেল।কোন কাজই যদি না পারিস, তোর বাপকে বল তোকে নিয়ে যেতে।
আর এমন ভুল হবে না খালাম্মা।
এক কথা আর কত দিন বলবি! আসার দিন থেকেই তো এক জপ করছিস।… আকাশটা কেমন কালো হয়ে গেছে। যেকোনো সময় বৃষ্টি নামবে। ছাদ থেকে কাপড়গুলো নিয়ে আয়।
এই তো যাই, খালাম্মা। বললেও কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সোহাগী।
যাই বলে তো দাঁড়িয়েই রইলি খাম্বার মতো। যা, যা। বৃষ্টি নামলে সব ভিজবে।
ছাদ থেকে কাপড় নিয়ে এসে গুছিয়ে রাখতে না রাখতেই নাজমার ডাক। এই সোহাগী, সন্ধ্যা হয়ে গেল খেয়াল আছে! আমারই যদি সব কাজ করা লাগে, তোকে রেখে লাভটা কী। উফ্ মানুষ করতে পারলাম না মেয়েটাকে!… রান্না বসাবি কখন? আবার তো একটু পরেই টিভির সামনে বসবি।… ফ্রিজ খুলে বড় চিংড়ির প্যাকেটা আর শিং মাছের প্যাকেটটা বের কর।
সোহাগী মাছের প্যাকেট বের করে ট্যাপ ছেড়ে ছোট বালতিতে পানি ভরে তাতে ভিজায়।
সেদিন কত করে বললাম, শিং মাছগুলো কোটার সাথে সাথে ঘষে রাখ, তা না… এখন মাছ কখন ভিজবে, কখন ঘষবি, কখন রান্না বসাবি? এক রান্না করতেই তো রাত শেষ হয়ে যাবে। এমন শিংমাছ খাওয়া যায়! কালো কুচকুচে শিং মাছ দেখলে সবাই খাওয়া ছেড়ে উঠে যাবে।
একটু পরপর পানি বদলালে মাছ দেখতে না দেখতে আলাদা হয়ে যাবে।
দেখ কতক্ষণ লাগে মাছ ছাড়তে। তোর তো সব কিছুতেই আঠারো মাসে বছর। ফ্রিজ থেকে করলা বের কর। আমি আলু কুটছি। করলা আলু আর চিংড়ি মাছ ছোট ছোট টুকরা করে ভাজি হবে। তুই করলা কুটা শুরু কর। চাক চাক করে কুটবি। সেদিন যেমন করে কেটে দেখালাম তেমন করে কাটবি।… মনে আছে তো কিভাবে কেটেছিলাম? না এর মধ্যে ভুলে গেছিস?
না খালাম্মা, মনে আছে। গোল গোল কওে কেটে বিঁচি ফেলে দিতে হবে। পেঁয়াজও একরকম করে কাটতে হবে।
হয়েছে। আর কথা না বলে কাজ শুরু কর।
এক কাপ চা দেওয়া যাবে আমাকে?
তুমি আবার রান্না ঘরে কেন। এমনিতে তো সারাদিন চেঁচাও। টিভি রুম থেকেই তো চা চাইতে পারতে।
না, ভাবলাম এসেই বলে যাই। তা সোহাগীকে দিয়ে এক কাপ চা দিয়ো পাঠিয়ে। আমি বারান্দায় বসলাম।
সোহাগী মাছ ঘষছে। ওর হাত বন্ধ। যাও তুমি, আমিই দিয়ে আসব চা।
একটু যেন খিদাও লেগেছে। পারলে হালকা কিছু দিয়ো।
টোস্ট আছে। দিব। তুমি যাও। পুরুষ মানুষ রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকলে ভাল লাগে না।
তুমি আবার কষ্ট করবে কেন। সোহাগী না হয় হাত ধুয়ে চা-টা দিয়ে আসবে।
কেন সোহাগী চা দিয়ে আসলে কি বেশি মিষ্টি লাগবে? দেখছ ও কাজ করছে। তাও… এই জন্যই বলে, স্বভাব যায় না মলে।
তোমার সাথে আজকাল কথাই বলা যায় না। কোত্থেকে কোথায় চলে যাও। তোমার কষ্ট হবে ভেবেই বললাম।
হয়েছে, আমার কষ্ট নিয়ে কত যেন ভাব! জীবনই তো গেল তোমার বাঁদিগিরি করে।
মিজান সাহেব আর কথা না বলে দরজার কাছ থেকে সরে যান। যান মনে একটু বিষাদ নিয়েই। তা হয়তো দোষ দেওয়া যায় না নাজমাকে। হয়তো কি?… না, মিজান সাহেব জানেন, তিনি দোষী। কোনো স্ত্রীই স্বামীর এমন অপরাধকে ক্ষমা করতে পারে না। তবে মিজান সাহেব জানেন, নাজমা তাকে মন থেকেই ক্ষমা করেছেন। সব ভুলেই তাঁর সংসার করে গেছেন। ভুলে গেছেন ঠিক, তা হলেও মানুষের মন তো। মনের গহিনে কোনো কোণে কাঁটাটা হয়তো ঠিকই খচখচ করে।
তখন নাজমার সাথে তাঁর সদ্য বিয়ে হয়েছে। দুজনে যাত্রাবাড়ীর দিকে একটা বাসায় ভাড়া থাকেন। দুই রুমের ছোট বাসা। এক রুম শোয়ার, এক রুম খাওয়া আর বসার জন্য। মিজান সাহেব সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকেন অফিসে। কোনো কোনো দিন গুলশানের অফিস থেকে ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায়। যদিও অফিসের গাড়িতেই আসা-যাওয়া করেন। তা হলেও গুলশান থেকে যাত্রবাড়ী কম দূরত্ব নয়। জ্যাম তো আছেই রাস্তার। নাজমা সারা দিন একাই থাকেন বাসায়। রান্না আর ঘর গুছিয়ে নাজমার দিন কাটে না। বিয়ের পর দুমাস না যেতেই নাজমা পাড়ায় একটা কিন্ডারগার্টেনে শিক্ষকতার চাকরি যোগাড় করে ফেললেন। মাস গেলে কিছু টাকা তো আসবেই। সেটা বড় কথা নয়, নাজমার সময়টা কাটছিল ভালো। অবশ্য রান্না-টান্নার একটু অসুবিধা হচ্ছিল। বিশেষত, সকালের নাস্তা বানানোর সময়ই নাজমাকে রেডি হতে হয়। দেখেশুনে গ্রাম থেকে একটা মেয়ে আনা হলো। বিধবা। তা বিধবা শুনলে যেমন মনে হয় সে মেয়ে তেমন নয়। বয়স বিশ একুশ হবে। দেখতে-শুনতেও মন্দ নয়।… সেদিন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় দুপুরের আগেই বাসায় চলে এসেছিলেন। নাজমা তখনো ফেরেনি। দুটার আগে ফেরেও না সাধারণত।… কাজের মেয়েটা মাথার কাছে বসে জলপট্টি দিচ্ছিল।… ঘি আর আগুন কাছাকাছি থাকলে যা হয়। দোষ না আগুনের, না ঘিয়ের। মিজান সাহেব তাঁর পদস্খলনের জন্য অন্তর থেকে অনুতপ্ত হয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু তাতে শেষ রক্ষা হয়নি। কাজের মেয়েটার প্রেগনেন্সির কারণটা নাজমা ঠিকই ধরতে পেরেছিল। তাতে জল কম গড়ায়নি। নাজমার বাপের বাড়ি চলে যাওয়া, দু-পক্ষের বৈঠক। একবার অবশ্য মৃদু স্বরে মিজান সাহেব ব্যাপারটা অস্বীকার করতে চেয়েছিলেন, নাজমা ডিএনএ টেস্টের কথা তুললে আর উচ্চবাচ্চ করেননি। পা পিছলেছিল ওই একবারই। কিন্তু নাজমার বিশ্বাসটা হারিয়েছেন চিরতরেই।
সোহাগী, তুই এত শুদ্ধ করে কথা বলিস কিভাবে?
আমিতো জন্ম থেকেই ঢাকায় থাকি খালাম্মা। আমাদের বস্তির পাশে সুন্দরমতো এক আপার স্কুল আছে। সেখানে আমি সিক্স পর্যন্ত পড়েছি। সেখানে কিছু দিন নাটকও করেছি।
তাই হবে।… সোহাগী, শোন। আমি বাসায় না থাকলে তোর চাচা তোকে একা রুমে ডাকে? করলা ভাজি নাড়তে নাড়তে নাজমা কেমন নিচু গলায় বলেন।
সোহাগী শিংমাছ ঘষছিল ভাঙা পাটাটাতে। অবাক গলায় বলল, আপনি কোথাও যান! গেলে তো আমাকে বাসায় তালা দিয়ে সবাই মিলে যান।
যা জিজ্ঞেস করি, তার জবাব দে।
না, কোনোদিন ডাকেনি তো। আর ডাকার কী আছে! কাজ থাকলে তো খালুর রুমে আমি এমনিই যাই।
বাসায় যদি তোর খালু একা থাকে, রুমে কোনো কাজে ডাকলেও যাবি না।… যদি হাত-পা টিপে দিতে বলে বা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে বলে খবরদার যাবি না।… আমি কি বলতে চাচ্ছি বুঝতে পারছিস তো?
আপনি কী বলেন এসব। বয়স্ক একটা মানুষ। যার মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে সে… খালু হলেন আমার বাপের বয়সী।
বাপের বয়সী, বাপ তো আর না। যা বললাম মনে রাখবি। কথাগুলো তোকে আরো আগেই বল উচিত ছিল। আমি বাসায় থাকলেও তোর খালুর কাছে বেশি ভিড়বি না। করলা ভাজিটা দেখিস, আমি তোর খালুর চা-টা দিয়ে আসি।
নাও, তোমার চা দিয়ে গেলাম। ঝালমুড়ি বানাতে দেরি হয়ে গেল।
মিজান সাহেব হাত বাড়িয়ে চা নেন। বলেন, ঝালমুড়ি বানানো তো অনেক ঝক্কির। এত কষ্ট করতে গেলে কেন। টোস্ট হলেই হতো।
রান্না করতে আজ একটু দেরি হতে পারে। তাই ঝালমুড়ি।
ও। আমি আরো ভাবলাম ঝালমুড়ি আমি পছন্দ করি বলে… তা আজকেও গ্যাসের প্রেসার কম নাকি?
গ্যাসের প্রেসার কম শুধু আমাদের বাসায় লাইনেই। কদিন আগে সোহাগী গিয়ে দেখে এসেছে, পাশের বাসায় ঠিকই আছে প্রেসার। সমস্যাটা আমাদের লাইনেই।… বাড়িওয়ালাকে বললাম কত বার, এই বাসার লাইনে সমস্যা আছে। সমস্যাটার গুরুত্বই দিচ্ছে না। তোমারও কোনো মাথাব্যথা নেই। বাড়িওয়ালাকে একবার বললেও তো পার।
দেখি, কাল সকালেই না হয় বলব।
আর বলেছ তুমি। কোনো কাজের কথা বললে সারা জীবনই এক কথা শুনেছি, কাল করব। সে কাল আর কোনোদিন আসে না।
তা আমি যাই। দেরি করলে আবার সোহাগী রান্নার বারোটা বাজাবে।… খাওয়া হয়ে গেলে বাটি আর কাপটা দিয়ে এসো কষ্ট করে।
ছেলে আর মেয়ে খেয়েদেয়ে যে যার রুমে চলে গেছে। মিজান সাহেব আজ একটু সকাল সকালই শুয়ে পড়েছেন। যদিও মধ্যরাতের আগে ঘুম আসবে না, জানা কথাই। তা হলেও শুয়েছেন। আগে রাত জেগে বই পড়তেন, এখন একটানা পড়লে চোখ দিয়ে পানি পড়ে। তাই সন্ধ্যার পর আর পড়েন না।
টিভি রুম থেকে শব্দ আসছে। নাজমা খুবই কম ভলিউমে টিভি দেখে। তাহলেও শব্দটা কানে আসছে মিজান সাহেবের। রাত বলেই বোধহয়।
বোধহয় চোখ লেগে এসেছিল। নাজমা মশারি উঁচিয়ে ভেতরে ঢুকতেই চটকা ভেঙে যায়। বলবেন না বলবেন না করেও মিজান সাহেব বলে ফেলেন, তুমি সোহাগীকে কী বলছিলে? তখন রান্নাঘরে?
ওহ! কান তাহলে ওই দিকেই ছিল! যা বলার বলেছি। মিথ্যা কিছু বলেছি নাকি?
আস্তে বল। মেয়ে অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকে। ছেলেও জেগে আছে কি না, কে জানে।
আস্তে বললেই কী, জোরে বললেই কী। তোমার কীর্তি কে না জানে! ছেলে-মেয়েরা জানে না, মনে করেছ।
না, মিথ্যা তুমি বলেছ, তা বলছি না। কিন্তু এটা ঠিক হলো? মেয়েটা আসতে না আসতেই আমার নিন্দা শোনালে। এখন তো আমার কাছে ও সহজ হতে পারবে না।
সহজ হয়ে কাজ নেই।
দেখো, আমার একবার পা পিছলালো বলে সব সময় যে তা হবে এমন তো নয়। ওই একবারই তো, নাজমা। সে জন্য তো তোমার কাছে না হোক শতবার ক্ষমা চেয়েছি।
ক্ষমা যদি নাই করতাম, তো তোমার সংসার করতাম? তা হলেও তোমাকে আমি বিশ্বাস করতে পারি না। তাতে তুমি যা-ই মনে কর না কেন। বলে, পাশ ফিরে সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়েন নাজমা।
ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে ঠোঁটে লিপিস্টিক ঘষছে সোহাগী। লিপিস্টিকটা ছোট আপার। রক্তের মতো লাল। লিপিস্টিক লাগানো শেষ করে মুখে পাউডার ঘষে। ছোট আপার ছেড়ে যাওয়া লাল জামাটা পরে, শ্যাম্পু করা চুল আঁচড়ে যখন ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ায়, নিজেকে খুব সুন্দর লাগে।… ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সোহাগী। সে তো সুন্দরই। বলতে কী, তারা আট বোন সবাই সুন্দর। তবে সংখ্যার কাছে বোনদের সৌন্দর্য ম্লান হয়ে গেছে। আহা, বাবা কত শখ করে মেয়েদের নাম রেখেছে, আদুরি সোহাগী আহ্লাদী।
বাসার সবাই দুপুরে কোথায় গেছে! রাতে ফিরে খাবে। খালাম্মা বলে গেছেন, বেগুন দিয়ে ইলিশ মাছ রান্না করতে। আর পুঁটি মাছের টক।
ইলিশ সোহাগীর খুবই পছন্দের মাছ। বাবা বেঁচে থাকতে ইলিশ আনলে সেদিন ভাতে টান পড়ত। সোহাগী একা তিন-চার টুকরো ইলিশ আর অর্ধেক ভাত খেত। ভাজা ইলিশ খুবই পছন্দ তার। এমনিতে কটকট করে কথা শোনালেও খালাম্মা মানুষ ভালো। নিজেরা যা খায়, সবই খেতে দেয়।… যদিও কাজটা ঠিক হয়নি, তা হলেও সোহাগী কোটার সময় ইলিশ মাছের বড় এক টুকরো আলাদা করে রাখার লোভ সামলাতে পারেনি। টুকরোটা ফ্রিজের কোণে লুকিয়ে রেখেছে। তা বেশ বড়ই টুকরাটা। গাদা পেটি একসাথে। একটু ডিমও আছে। সেটা আজ বের করেছে সোহাগী। পানিতে ভিজিয়ে রেখেছে। সবাই ফিরতে ফিরতে ভেজে খেয়ে ফেলতে পারবে।
গরম ইলিশের টুকরোটা বাটিতে নিয়ে আয়েস করে টিভির সামনে বসে সোহাগী। শাকিব খানের সিনেমা হচ্ছে। শাকিব তার পছন্দের নায়ক। তার ওপর সাথে পছন্দের নায়িকা অপু। দেখতে দেখতে দুনিয়া ভুলে যায় সোহাগী। …বিরতিতে খেয়াল হয়, ও আল্লা মাছটা তো ঠান্ডাই হয়ে গেল! কী সুন্দর ঘ্রাণ। তেল উঠেছে কত! এমন মাছ খেতে ভুলে গেল সোহাগী। খালাম্মা ঠিকই বলে, টিভির সামনে বসলে হুঁশ থাকে না তার। অ্যাডের ফাঁকে মাছ ভেঙে মুখে দেয় সোহাগী। আহা, কী স্বাদ! সোহাগীর জিহ্বা আগে কখনো এত ভালো মাছের স্বাদ পায়নি।
কলিংবেলের আওয়াজে আঁৎকে উঠে সোহাগী। এত তাড়াতাড়ি তো ফেরার কথা না খালাম্মাদের। দ্রুত টিভি বন্ধ করে, জামা খুলে, মুখ ধুয়ে নেয়। ততক্ষণে দরজা যেন ভেঙে যাবে। হায় আল্লা, মাছটাই তো রয়েই গেছে। রসিয়ে রসিয়ে খাবে ভেবেছিল, কী হলো। সমানে তাকে ডাকছে খালাম্মা। সোহাগী পুরোটা মাছই মুখে পোরে, দ্রুত চিবিয়ে কোনোমতে গিলে দরজা খোলে।
কী ওে, সোহাগী! আমরা দরজা ভেঙে ফেলছি তোর হুঁশ নেই? টিভির সামনে বসেছিলি?
না খালাম্মা, পায়খানায় গিয়েছিলাম। ঠোঁট দুটো একবার সাবধানে মুছে নেয় সোহাগী।
কতবার না বলেছি বাথরুম বলবি। এমনিতে তো কথাবার্তা শুদ্ধই বলিস।
বাথরুমে গিয়েছিলাম।
মাছ তরকারি বের করেছিস?
যাক বাবা, অন্যদিকে চলে গেছে কথা। সোহাগী হাঁফ ছাড়ে।… জি, খালাম্মা। ইলিশ মাছ। পুঁটি মাছ। বেগুনও বের করে রেখেছি।
শীঘ্রই রান্নার যোগাড় কর। ইলিশ মাছে লবণ-হলুদ মাখিয়ে রেখে, পেঁয়াজ কাট আট-দশটা। আমি কাপড় বদলে আসছি।
বিকাল থেকেই ঢোক গিলতে কষ্ট হচ্ছিল খুব। রাতে শুতে গিয়ে প্রথম বুঝতে পারল সোহাগী, গলায় কেন ব্যথা। কাঁটা! তাড়াহুড়ার ফল। একটা বিড়াল যদি পাওয়া যেত! দাদি সব সময় বলত, গলায় কাঁটা ফুটলে বিড়ালের পা ধরলে নাকি বের হয়ে যায় কাঁটা। সত্য-মিথ্যা কে জানে! তবে এত রাতে বিড়াল আর কোথায় পাবে!
নাহ, ঢোক গিলতে গিলতে গলা ব্যথা হয়ে গেল। একটু বোধহয় ফুলেছেও। শোয়া থেকে উঠে পা টিপে টিপে রান্নাঘরে ঢুকে একদলা শুকনা ভাত গেলে সোহাগী।… মুঠো মুঠো মুড়ি খায়, গিলে গিলে। পানি খায়।… নাহ, ঢোক গিললে লাগছে এখনো। এত রাত সবাই ঘুমে। আবার না জোরে শব্দ হয়। ডিম লাইটের আলোতেই পা টিপে টিপে বেসিনের কাছে গিয়ে গলায় আঙুল দেয় সোহাগী। গলা খাঁকারির সাথে হঠাৎ কেমন বমির মতো হয়ে যায়। কাঁটাটা বের হলো কি-না, বোঝা যায় না। চোখ ভর্তি পানি।
আচমকা পেছন থেকে শক্ত একটা হাত ঘাড় চেপে ধরে, এত শক্ত করে ধরেছে যে মাথা এক চুলও নাড়াতে পারে না সোহাগী। শোনা যায় খালাম্মার হিসহিসানি, হারামজাদি, শেষ পর্যন্ত বিপদটা ঘটালিই তুই। এতবার সতর্ক করলাম… এক্ষণ বের হ আমার বাসা থেকে।
হতভম্ব সোহাগী কিছু বুঝার আগেই নাজমা তাকে ঠেলতে ঠেলতে দরজার কাছে নিয়ে যান। দরজা খুলে চাপাস্বরে বলেন, বাইরে সিঁড়ির কাছে বসে থাকবি সকাল না হওয়া পর্যন্ত। সকাল হলে মাসের এই কয়দিনের টাকা দিয়ে দিব। তোর মুখ যেন আর না দেখি।
খালাম্মা, আমি কী করলাম! সোহাগী অবাক। মনে মনে ভাবে, খালাম্মা টের পেল কিভাবে!
এত করে বললাম তোর খালুর কাছ থেকে দূরে থাকবি।… না বাপের বয়সী… হেন-তেন… বাপের বয়সীর সাথে রং-ঢঙের ফল তো ফলল। হিং¯্র বাঘিনীর মতো চাপা স্বরে গজরাচ্ছেন যেন নাজমা।
হঠাৎই ব্যাপারটা বুঝতে পারে সোহাগী। যেন বাজ পড়ে মাথায়। কী বলছেন, খালাম্মা! শোনেন খালাম্মা, আপনি যা ভাবছেন… বলা শেষ হয় না সোহাগীর। নাজমা ততক্ষণে দরজা বন্ধ করে দেন।