কাঁটাতারের প্রাচীরে লাশ হয়ে ঝুলে থাকতে তার আপত্তি না থাকলেও আমার আছে। বুড়োর আপত্তি রাত বিষয়ে। বিশেষ একটি রাতের জন্যই নাকি অপেক্ষা! অপেক্ষার চোখে তাকিয়ে থাকি। পরিবর্তিত প্রতিক্রিয়া লক্ষ করি। মনে মনে বিরক্ত হই—যত্তসব! আরে বাপু, বৃদ্ধ বয়সে এত ভিমরতি ক্যান? মৃত্যুর পরোয়না নিয়ে দুয়ারে যে কেউ একজন অপেক্ষা করছে, সে কথা খেয়াল আছে! নাহ, বুড়োর কোনো ভাবাবেগ নেই। ক্ষোভ-আক্ষেপ নেই। নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল। আমার পানে তাকিয়ে হাতের আঙুল উঁচিয়ে কাঁপা-কাঁপা গলায় বলে, বুজলিরে নানাভাই, ভিমরতি কেন্তক বুইড় কালেই ধরে। তুই যকুন বুইড়–হবি তোরউ ধরবে। হা হা হা।
কথাটা মিথ্যে নয়। বৃদ্ধদের জীবনে নানা কিসিমের ভিমরতি! কারও কারও বিবেক-বোধ লোপ পায়। শিশুর মতো আচরণ করে। আকাশের চাঁদ ছুঁয়ে দেখার বায়না ধরে। ভিমরতির আধিক্য আরও খানিক বৃদ্ধি পেলে বিপত্তি— স্কুলগামী মেয়েদের পথ আগলে দাঁড়ায়। ঝাঁপটে ধরে। কিংবা প্রবাসী নাতীর সুন্দরী স্ত্রীর অশান্ত যৌবনে ঢিল ছোড়ে। গভীর রাতে বাড়ির চারপাশে উঁকিঝুঁকি মারে। কিন্তু ওহাব আলীকে নিয়ে এ জাতীয় আশঙ্কা নেই। লোকটি মেজাজি বটে। প্রায়ই মেজাজ হারিয়ে নিচু স্বরে গালমন্দ করে—শালা, দেকি কিডা ঠেকায়! হয় তুমার একদিন, না হয় আমার একদিন। তুমাক না ঠাপালি যে মরিউ শান্তি হবেনান!
আর শান্তি! শান্তির জন্য একজীবনে কত উজান বাইবে! কত অপেক্ষা করবে! অপেক্ষার চোখ ঝাঁপসাপ্রায়! বিচিত্র অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ জীবন! সাতচল্লিশের দেশভাগ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ঘটে যাওয়া অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী সে! কবরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বয়সী গাছটার মতো নিঃসঙ্গ। নিঃসঙ্গতা দূর করতে মাঝে-মাঝে চায়ের দোকানে বসে। হাসি-তামাশা করে। ভাগাভাগির গল্প বলে। স্মৃতিচারণ করে। বাবার হাত ধরে কলকাতার রাস্তায় পথ হাঁটে। কৈশরের দিনগুলোয় ফিরে যায় ফিরে আসে। প্রাণ ঐশ্বর্যে ভরপুর এক কিশোর! ঝুম বৃষ্টিতে উতলা হয়ে ওঠে। মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা একজন কিশোর আড়মোড়া ভাঙে।
বুঝলিরে পথিক—কিছু বলতে গিয়ে থেমে যায়। উদ্যোগী হয়ে জিজ্ঞেস করি, কী জানব নানুভাই!
দীর্ঘশ্বাস উগরিয়ে বলে, দলক (বৃষ্টি) হলি আমরা সব খেলায় মাইতি উঠতাম। ডেঙা-ডওর এক করতাম! গাঙের ধারে ছেঁচড় খেলতাম! সে কী মজারে ভাই! যেদি খেলতিস তালি বুজতিস।
বোঝার চেষ্টায় ত্রুটি রাখি না। দৃষ্টির প্রখরতায় তাকে নিরীক্ষণ করি। অনেক খেলার নাম শুনেছি কিন্তু ছেঁচড়ের কথা এই প্রথম! নদী বা পুকুরের ঢালে কাঁদা দিয়ে পিচ্ছিল রাস্তা বানিয়ে গ্রাম্য কিশোর জলে আছড়ে পড়তো। হৈ-হুল্লোড় করতো। সে কী মাতামাতি! একজনের গায়ের ওপর আরেকজন লাফিয়ে পড়তো! খেলতে গিয়ে মাটির ঘর্ষণে প্যান্টের পেছন দিক ছিঁড়ে যেত। তবু থামতো না। চোখ লাল করে ঘরে ফিরলে আব্দুল ওহাবকে আসামির কাঠগড়াই দাঁড়াতে হতো। বাবা-মা বকাবকি করতো।
মায়ের জন্য ইদানিং খুব বেশি বিচলিত। চলতে ফিরতে শুধু মা আর মা। মাকে ঠকানোর জন্য নিজেকে অপরাধী মনে হয়। ওই অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত হওয়া দরকার। কখনো মনে কৌতূহল জাগে, মায়ের জন্যই কি এতসব আয়োজন! নিত্যনতুন পরিকল্পনা! তা না হলে ফেরার জন্য উতলা হবে কেন! কেনই বা জীবনের নতুন সমীকরণ! ঘর ছেড়ে বাইরে বেরুনোর প্রয়োজন।
নাহ, বুঝি না!
এর দায় কার? দেশ-কাল না কি পাত্র?
পাত্র-পাত্রীর ভুমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। সাজানো সুখের সংসারে এক-একজন যেন সাক্ষাৎ বিভীষণ! আব্দুল ওহাব পাথর চোখে দীর্ঘশ্বাস ঝরায়। রাবনের মতো নিঃশব্দে দগ্ধ হয়। লোকটির দুর্ভাগ্য—বিশ্বায়নের কবলে শুধু দেশ নয় তার যৌথ পরিবার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। সন্তান-সন্ততিরা ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন প্রান্তে। কারও সঙ্গে কারও সংযোগ নেই। যতদিন সক্ষমতা ছিল, ততদিন এক ছাদের নিচে ধরে রেখেছিল। কিন্তু বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যপট বদলে গেল। সম্পর্কের সূতোয় পচন ধরলো। তখন মনে হয়েছিল, নিষ্ঠুর পৃথিবীতে কেউ কারও নয়। অতএব, মায়ের কাছে ফিরতে তার আপত্তি নেই। আমার আপত্তি ফেরার পথ ও প্রক্রিয়া নিয়ে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! চোয়াল শক্ত করে ঘাড় নাড়িয়ে প্রতিবাদ করে—না। রাতিই যাব। রাতির আন্ধারে যেরাম পলি আছালাম সেরাম কইরি ফিরি যাব।
পালিয়ে আসার পথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। রক্তস্রোত। ঘরে-বাইরে রায়োট। অস্থিত্বের প্রশ্নে হিন্দু-মুসলমান মুখোমুখি। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। চতুর্দিকে খুন আর খুন। খুনের রক্তে মাটির উর্বরা কমেছে। সম্পর্কের মাঝে কাঁটাতারের বেড়া উঠেছে।
কোথায় উঠবে তুমি?
মানে?
মানে, কার কাছে, কোথায় উঠবে?
একগাল হেসে জানায়, ক্যান, কৃষ্ণনগর! আমার মার কাছে! তুই যাবি আমার সঙ্গে?
দুঃখের মাঝেও মুখ টিপে হাসি, আর মা!
অসুস্থ শয্যায় সারাক্ষণ মার কথা মনে হয়। তার মলিন মুখচ্ছবি মনের পর্দায় উঁকিঝুঁকি মারে। দু’হাত বাড়িয়ে যেন দাঁড়িয়ে রয়েছে। লোকটি বিছানার ওপর উঠে বসে। মনে মনে ভাবে, পাখির ডানায় ভর করে এক্ষুণি কৃষ্ণনগরে ফিরে যাবে।
দুই.
জন্মসূত্রে আব্দুল ওহাব ব্রিটিশ ভারতীয়। ১৯৩০ সালে তৎকালীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে জন্ম। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও সাতচল্লিশের করাল গ্রাসে রাতারাতি জীবনচিত্র বদলে গেল। জন্ম হলো দুটি পৃথক রাষ্ট্র- হিন্দুস্তান ও পাকিস্তান। ওহাব আলীর বাবারা পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়েছিল। সপক্ষে কারণও ছিল। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগষ্ট সম্পূর্ণ নদীয়া জেলা পাকিস্থানের অর্ন্তভুক্ত হয়েছিল। ফলে সিদ্ধান্ত নিতে কষ্ট হয়নি। এলাকা ছেড়ে অন্যত্র যাওয়ার প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু মাত্র ৩ দিন পরে ১৮ আগস্ট কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর মহাকুমা বাদে অন্যান্য অংশ হিন্দুস্থানের অংশীভূত হয়। মানুষের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো! ভারত ভাগের চাইতে নদীয়ার বিভাজন প্রকট হয়ে উঠলো। স্বপ্নবাজ একদল মানুষকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিল।
আব্দুল ওহাবের মতে ওই ভাগাভাগিটা ছিল চুড়ান্ত অনাচার। নিয়মের পরিপন্থী। আক্ষেপ করে বলে, এ কেরাম নিয়মরে ভাই! একটা মানুষকে উরা দু’টুকরু করি ফেইল্লু! আইচ্চা, গলাকাটা মানুষ কি বাঁচে; না কি বাঁচতি পারে! উরা অন্যায় কইরিছে। ওগের জন্যিই আজ কপালের গেরো!
ভাবাভাবির বিশেষ সময় ছিল না। ইতোমধ্যে রায়ট শুরু হয়ে গেছে। হিসাবের গরমিল হলেই মৃত্য অনিবার্য। রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতায় সেদিন অসংখ্য বাঙালির কপাল পুড়েছে। হাতের মুঠোয় জীবন পুরে কেউ এপার থেকে ওপারে গেছে, কেউ ওপার থেকে এপারে এসেছে। কেউ লাশ হয়েছে। কেউ-বা আজন্মের মতো ঠিকানা হারিয়েছে। অদ্ভুত জীবন! চলার পথে কেউ কেউ জলভরা চোখে পেছন ফিরে তাকিয়েছে। সাতপুরুষের ভিটেমাটি। তীল তীল করে গড়ে তুলেছে। অথচ নিমেষেই শিকড়চ্যুত হয়ে যাচ্ছে। ভেঙে যাচ্ছে সামাজিক কাঠামো। জোতদার শ্রেণী দখলের খেলায় উন্মত্ত। সাধারণের জীবনে ঘোর অন্ধকার। অনেকে বুক চাপড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদেছে। মাটির ওপর অবাধ্য শিশুর মতো গড়াগড়ি দিয়েছে। পরিবারের মধ্যেও ভাগাভাগি। ওহাব আলীর জীবন থেকে মা বিভক্ত হয়ে গেল।
বিস্মিত হয়ে বলি, বলো কী নানু, মা-ছেলের সম্পর্ক কি ভাগ করা যায়!
যায়রে নানা যায়, সেদিন মা আমাকে পর কইরি দিছুলু।
কিন্তু কিভাবে?
জেদ ধরি বইসি থাইকলু। ভিটিমাটি ছাইড়ি সে কুথাউ যাবে না। কেউ তাকে নড়াতি পারবে না। দরকার হইলি ওকেনেই মরবে! তাছাড়া যে মাটিত জন্ম সে মাটিত মরাই নাকি ভালো। মরনকালে কষ্ট হয় না!
তারপর?
অনেক চিষ্টা তদ্বির করলাম কিন্তু কাজ হইলু না। ঘরের মাইজি (মেঝে) বুক দি মা আমার শুয়ি থাইকলু। ভাত-পানি ছুয়ি দেইখলু না। হাত-পা জড়ি ধইরি কলাম, এরাম নিষ্ঠুর হইয়ু না মা। আমাগের কথা ইট্টু চিন্তাভাবনা কর। একেন থাকলি লোকজন যে আস্ত রাখবেনান। চলো মা, একুনি বেরি পড়ি। বুকি হাঁচড়ি উপারে যায়ি উঠি। জানডা তো আগে বাঁচুক!
তারপর?
কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে বলে, কী আর করা, বাপজি আমাগের হাত ধইরি টানতি টানতি নিয়ি আইলু। আহা, মা থাকতিউ আমরা এতিম হলাম। ও মা, মাগো, তুমি কনে আছ। তুমাক ছাড়া যে আর দিন কাটছে না।
মা প্রসঙ্গে কথা উঠলে ওহাব আলী অভিমানী হয়ে ওঠে। ঘনঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। চোখেমুখে রাজ্যের অভিমান, মা তো পাথর! আমাগের কান্দা শুনি কত মানুষ কাঁইনলু কেন্তক মার চোখে পানি পইড়লু না! যেতুক্ষণ দেখা গেল পাথরের মতোন তাকি থাইকলু!
মা’র অভিমান ভাঙাতে বার বার চেষ্টা করেছে কিন্তু কাজ হয়নি। পাকিস্থানে থিতু হওয়ার পর ভাবলো, মা এবার আসবে। এলো না। বাংলাদেশ হওয়ার পর ভাবলো, এবার নিশ্চয় আসবে। এলো না। অভিমান বুকে নিয়ে মা একদিন অচিন ঠিকানায় পাড়ি জমালো। ছেলে-বউ সঙ্গে নিয়ে ওহাব আলী কৃষ্ণনগরের উদ্দেশে রওনা দিল। অন্তত শেষবারের মতো দেখতে চায়। মাকে জড়িয়ে ধরে অবোধ শিশুর মতো কাঁদতে চায়। কিছু কৈফিয়েত চায়। চোখের জলে বিদায় দিতে চায়। নাহ, ওই ইচ্ছে পূরণ হয়নি। কাঁটাতারের বেড়া তার পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে। এতিম ছেলের অসহায় আর্তনাদ কেবল শূন্যে প্রতিধ্বনিত হয়েছে।
তিন.
অসীম নিঃসঙ্গতা; নিঃসঙ্গতায় ডুবে থাকে সে। বাড়িটাও। ধারেকাছে জনবসতি ছিল না। বিস্তীর্ণ প্রান্তর। কুমার নদীর পাড়ঘেঁষা বিশেষ স্থানটাকে বসতির জন্য উপযুক্ত বলে মনে হয়েছিল। প্রথমে দোচালা খড়ের ঘর মাথা উঁচু করে দাঁড়ালো। তারপর আরেকটা। তারপর অসংখ্য। দেশান্তরী একদল মানুষ নতুন ঠিকানায় আশ্রয় নেয়। গড়ে ওঠে নতুন জনপদ—কালিদাসপুর। যাক, মাথা গোঁজার বন্দবস্ত তো হলো! সমুখেই কুমার নদী। নদীর পাড়ে এসে দাঁড়ালে মিষ্টি বাতাস ছুয়ে যেত। মুহূর্তের জন্য বিষণ্নতা কেটে যেত তখন। ভবিষ্যতের ভাবনায় বিচলিত হতো। সাঁঝের আলোয় ডিঙি নৌকায় চেপে জাল বিছিয়ে দিত। ভোরের আলোয় উঠে আসতো হরেক পদের সব মাছ। নদী বেয়ে কিছুদূর এগুলেই আলমডাঙ্গা শহর। ব্যবসাকেন্দ্র। ইংরেজদের আগমনের পূর্বে ভিনদেশি আফগান বা পারস্যের মুসলমানরা এ পথে যাতায়াত করতো। তাদের মাধ্যমেই শহরের পত্তন ও নামকরণ। ব্যবসার পাশাপাশি ধর্ম প্রচার করতো। ধারণা করা হয়, আরবি অ্যালেম শব্দ রূপান্তরের মাধ্যমে আলমডাঙ্গায় পরিবর্তিত হয়েছে। ওহাব আলীর বাবা এসব পরিবর্তনের ধার ধারেনি, কৃষ্ণনগরের পল্লী কালিদাসপুরের নামানুসারে জনপদের নামকরণ।
নদীর পানে তাকালে কষ্ট হয়। বুকে দীর্ঘশ্বাস বাজে। জল না থাকলে নদীর সৌন্দর্য কোথায়! জলের অভাব ছিল না। কিন্তু পদ্মার উজানে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ ও প্রতিবেশী ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে নদীর জীবনে দুর্দশা। জলের অভাবে ক্রমশ শীর্ণকায়। কৃষিভিত্তিক জীবনাচার ধ্বংসপ্রায়। নদীগুলো ঠিক নদী নয় ঋতুস্রাব বন্ধ হওয়া নারী যেন-বা!
ওহাব আলী নিজেও স্বামীহারা নারীর মতো অসহায়। মানুষের অভাবে তার বিশাল বাড়িটা খাঁখাঁ করে। বিষণ্ন মনে লাঠি ভর দিয়ে চারপাশে পায়চারী করে। বাবার হাতে লাগানো গাছগুলোয় পরম মমতায় হাত বোলায়। প্রতিবেশীদের কেউ কেউ নতুন ঠিকানার সন্ধান দেয়। ওহাব আলী সেসব তোয়াক্কা করে না। একজীবনে আর কতবার ঠিকানা হারাবে! বরং পুরাতন ঠিকানায় ফিরে যাওয়ার কথা ভাবে। হায়, কতকাল মায়ের সঙ্গে দেখা নেই! কবরটা হয়তো অবহেলা অনাদরে পড়ে আছে। লতাগুল্মে আচ্ছাদিত। আমিও যাওয়ার কথা বলি, যাও নানুভাই, কিছুদিন বেড়িয়ে আসো।
কয়েক পা এগিয়ে এসে আমার কাঁধ ধরে দাঁড়ায় সে। প্রত্যয়ী হয়ে বলে, না নানাভাই, আর না; কুনুদিন আর ফিরবো না! মইরি গেলিউ না!
তাহলে?
ওকেনেই থাইকি যাব। মার কব্বরের পাশে একটা চালা তুইলবো।
কেন নানুভাই; কী আছে ওখানে?
ঠিকানা। ওইডিই আমার আসল ঠিকানা।
ঠিকানার খোঁজে ব্যাকুল লোকটি। প্রচলীত নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করে না। তাচ্ছিল্লের স্বরে বলে, ধুর, ওসব ভিছা পাছফুট ঠাপাইনির টাইম আছে! আমার গিরামে আমি যাব ঠেকাবে কুন শালা? আর ঠেকালিউ কী আমি শুইনবো। বুজি দেব কত ধানে কত চাইল!
চাউলের হিসেব ঠিকঠাক বুঝি না। তবে ঠেকানোর লোকের অভাব নেই। হাতে অস্ত্র নিয়ে সীমান্তরক্ষীরা সদা তৎপর। পারাপারের ক্ষেত্রে চোরাকারবারিদের খানিকটা ছাড় দিলেও জনগণের ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থান। তা না হলে ফ্যালানীর মতো মেয়েরা লাশ হয়ে কাঁটাতারে ঝুঁলে থাকবে কেন! কেনই বা সীমান্তে পাখির মতো মানষ খুন হবে! বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে যে পরিমাণ মানুষ খুন হয় পৃথিবীর অন্য কোনো প্রান্তে এটা কল্পনারও অতীত! আফসোস, ভাঙনের পর ভাঙনের মুখোমুখি হলাম অথচ মানুষ হতে ব্যর্থ হলাম! ভাগাভাগির ক্ষেত্রে নেতাদের ভুমিকা ছিল স্বেচ্ছাচারী। তাদের ভুলেই পাশাপাশি গ্রামে বসবাস করে আপনজনের সঙ্গে দেখা হওয়ার সুযোগ নেই। এটা অন্যায়। মানবতার পরিপন্থী। এ পন্থার বিরুদ্ধে আব্দুল ওহাব লড়াই করতে চায়।
কিছুদিন পরের কথা। সেদিন ছিল কৃষ্ণপক্ষ। বাতাসে আরোতির ধুপগন্ধ। দূর থেকে ওহাব আলী বাড়ির পানে তাকাই। ঘুটঘুটে অন্ধকার। লোকটি এমনই, মাঝে মাঝে আলো জ্বালাতে মনে থাকে না। পায়ে পায়ে অন্দর মহলে প্রবেশ করি। প্রদীপ জ্বালাই। ‘নানুভাই’ বলে ডাকাডাকি করি। প্রথমে আস্তে। তারপর উচ্চস্বরে। নাহ, সাড়াশব্দ নেই। পালিয়েছে নাকি!
মেঝেতে চোখ পড়তেই আঁতকে উঠি; একদলা কাঁচা রক্ত। জমাট বেঁধে আছে। কিসের রক্ত এ! এখানেই বা কিভাবে এলো? রহস্যময়। রহস্যের জাল ছিন্ন করতে হন্তদন্ত হয়ে ছুটি। মনের মধ্যে অজানা আশঙ্কা। না না এমনটা হতে পারে না, কিছুতেই না! ছুটতে ছুটতে ফাকা মাঠের মধ্যে এসে দাঁড়াই। চিৎকার করে ডাকি, ফিরে এসো নানুভাই, তুমি ফিরে এসো। তুমি না থাকলে আমাদের কী হবে! কালের সাক্ষী হয়ে কে অপেক্ষা করবে!
কুয়াশা আচ্ছাদিত মাঠের প্রান্তসীমায় প্রতিধ্বনিত হয়ে আমার কথাগুলো আমার কাছেই ফিরে আসে। ফেরে না কেবল শিকড়চ্যুত একজন মানুষ!