পোয়াতি মাইয়া মাইনষের ওপর নাকি আলগা বাতাসের চোখ থাকে। সেই আলগা বাতাসের ঝাপটা একবার পড়লেই সব আউলা। রাইতের বেলা কোহকাফ নগরের জ্বিনেরা হা-হা করে ছুটে আসে পেটের বাচ্চা খাইতে। তাবিজ কবচ লোহার টুকরা সিথানে রাখতে হয়। না রাখলে তো সমস্যা, আর কয়দিন পরেই বাচ্চা হবে। ষাট পাওয়ারের টিমটিমে বাল্বের আলোয় একটা হামানদিস্তায় পান ছেঁচতে ছেঁচতে বুড়ি নিজের মনেই এসব বলতে থাকে। গোলাপ মিয়ার কানে তবু কথা ঢোকে না। সে তার ঝুলি থেকে নানা ধরনের চিমটে কাঁটা বের করে তুলো দিয়ে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করে। চার বেড়ার এই ঘর গেরস্থিতে তারা চারটে প্রাণী মাথা গুঁজে আছে। বড় মেয়েটা তার পোয়াতি মায়ের পাশে ঘুমিয়ে পড়েছে। জেগে আছে শুধু এই বুড়ি, গোলাপ মিয়ার মা। হামানদিস্তায় তার পান ছেঁচার ভোঁতা শব্দগুলোকে গোলাপ মিয়ার বুকের ধুকপুকানির মতো মনে হয়। আর অনেকক্ষণ ধরে মুখের সামনে একটা মাছি ভনভন করে বেড়ায়। সে ওটার শব্দও শোনে। কানে ঢোকে না কেবল বুড়ির আলাপ। বুড়ি আবার বলে চলে—পোয়াতি মাইয়া মাইনষের কি গামলা ভরা খাওন লাগে? এই সময় খাওন খাইতে হয় অল্প দুগ্গা। বেশি খাওনে প্যাটের বাচ্চা যদি বড় হয়া যায়, তাইলে তো সমস্যা। বিয়ানোর সময় বুঝব ঠ্যালা। কত কইরা কই, ও বউ এত ভাত খাইয়ো না। কে হুনে কার কথা। আমিও একটা মানুষ, আমারও আবার কথা। ও গোলাপ, তুই তোর বউরে কিছু কস না ক্যান? বিটিতো কথা শুনে না। কথা না শুনলে পিডের ওপর গুমগুম কিল দেস না ক্যান। গোলাপ মিয়া তার চিমটেটাকে চকচকে করতে করতে ধমকে ওঠে—ঘুমাওতো বুড়ি। যদিও বুড়ি তার কথা শুনেছে বলে মনে হয় না। কারণ সে তবু তার কথার কল চালাতেই থাকে। সত্তর বছরের জীবনে বুড়ির মুখের চামড়াতেই শুধু ভাঁজ পড়েছে তালপাখার মতো। কিন্তু গলার কলটা সমান তেজী থাকলেও শ্রবণটা একেবারেই গেছে। গোলাপের বিরক্ত লাগে, রাত-বিরেতে এসব অসহ্য বোধ হয়। সময় থাকতে বুড়ি কানটার যত্ন নিলো না। নইলে কী আর এই অবস্থা হতো। গোলাপ মিয়ার নিজেরওতো বয়স কম হয়নি, ত্রিশ-বত্রিশ তো হবেই। অষ্টাশির বন্যার কথা তার স্পষ্ট মনে আছে। এছাড়া এরশাদের আন্দোলনও সে ভালোই মনে করতে পারে। তবু সে এখনো নিয়মিত নিয়ম করে নিজের কান পরিষ্কার রাখে। এখনো খুটিনাটি শব্দ হলে তার কান খাড়া হয়ে ওঠে। শুধু অভাবের এই সংসারে নিত্য এটা ওটার জন্য আহাজারি, হায় হায় তার কানে ঢোকে না। অবশ্য গোলাপের পেশাই হলো কান পরিষ্কার করা। কাকরাইলের রাজমনি সিনেমা হলের গেটে আর রমনা পার্কে তার আসা যাওয়া গত দশ বছর ধরে। এই সময় সে কতো কতো মানুষের যে কান পরিষ্কার করেছে তার ইয়ত্তা নেই। আগে মানুষ বেশি বেশি সিনেমা দেখতো। তখন জসিম, মান্না, সালমান শাহদের সিনেমা দেখতে কতো মানুষ যে ভিড় করতো। ম্যাটিনি শোতে ঢোকার আগের কিছুটা ফাঁকে মানুষ নিজের কানটা পরিষ্কার করে নিতো।
গোলাপ মিয়ার ব্যবসাটাও তখন ভালো ছিলো। শো শেষে হল থেকে দল বেধে লোকগুলো যখন গুনগুন করে সিনেমার গান গাইতে গাইতে বের হতো তখন তার মনটা আনন্দে ভরে উঠতো। পরিষ্কার কান নিয়ে লোকগুলো নিশ্চই স্পস্ট শুনেছে। তাইতো সিনেমার গানগুলো ওদের মগজে গেঁথে আছে। অথচ এখন আর সিনেমা দেখতে মানুষ হলে আসে না। তবু গোলাপ মিয়া ওই যায়গার মায়া ছাড়তে পারে না। সন্ধ্যা পর্যন্ত সে তার কান পরিষ্কারের নানা চিমটা, কাঁটা, তেল নিয়ে বসে থাকে এক কোণে। কখনো কখনো কেউ এগিয়ে আসে। অপেক্ষার ফাঁকে কানটা পরিষ্কার করে নেয়। কখনো কখনো হলের টিকেট বাবু রোস্তম ভাই এগিয়ে এসে হাঁক ছাড়ে-কইরে গোলাপ মিয়া, ময়লার চোটে কানটা খাইজ্জায়, একটু ত্যাল দিয়া পরিষ্কার করোতো। গোলাপ আনন্দের সঙ্গেই রোস্তম ভাইয়ের কানটা পরিষ্কার করে দেয়। যদিও রোস্তম কখনোই এর জন্য তাকে টাকা দেয়নি। তারপরও গোলাপ মিয়া তার কাজে অবহেলা করে না। শত হলেও রোস্তম ভাইয়ের মতো মানুষেরা হলের গেটে তাকে থাকতে দেয় বলেই তার পকেটে দুটো পয়সা আসে। এছাড়া কান পরিষ্কারের সময় রোস্তম আরামে চোখ বন্ধ করে মুখ দিয়ে নানা রকমের ভঙ্গি করে, সে দৃশ্য দেখতে বড় ভালো লাগে গোলাপের। মানুষের কান পরিষ্কারের এই বিদ্যা গোলাপ শিখেছিল তার ওস্তাদ কালু গাইনের কাছ থেকে। ঘন কৃষ্ণবর্ণের তেলতেলে শরীরটা নিয়ে কালু গাইন এসেছিল ভারতের বোম্বাই শহর থেকে। হিন্দি মেশানো ভাঙা ভাঙ বাংলায় কথা বলতেন। একদিন অনেক হাতে পায়ে ধরার পর গুপ্তবিদ্যাটা গোলাপ মিয়ারে বলেছিল কালু। তখন তার বয়স কতই বা হবে, বড় জোর তের থেকে চৌদ্দ। মোষের মতো তেল চকচকে কালু গাইনের সঙ্গে তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল বস্তির এক বড় ভাই। তারপর থেকেই কালু তার ওস্তাদ। কালুও তখন কিশোর গোলাপকে নিয়ে রাজমনি সিনেমা হলের গেট কিংবা রমনা পার্কে যেত কাস্টমারের সন্ধানে। রমনা পার্কের বেঞ্চিতে বসিয়ে কালু যখন একাগ্রতার সঙ্গে লোকগুলোর কানের ময়লা বের করে আনার কাজ করতো, তখন সেটা ছিলো একটা দেখার মতো বিষয়। কিশোর গোলাপ হা করে সেই বিদ্যা গোগ্রাসে গিলতো। কাজ করার ফাঁকে কালু গাইন কখনো কখনো গোলাপকে তার ফেলে আসা শহরের গল্প বলতো। বান্দ্রা, জুহু, সাউন, মালাবার, চৌপট্টি , অমিতজি, জিতেন্দ্র, ধরমজি, হেমা মালিনি আরো কত কী।আবার ককনো কখনো কালু পেশাগত আলাপও সেরে নিতো ছাত্রের সঙ্গে। বুঝেছিস বেটা, ইস কান হামরি এক বহৎ কঠিন আঙ্গ। ইসকি আন্দার মে কোনও বেথা লাগলে না, বহৎ দর্দ হবে। ইসি লিয়ে যাব তুম ইসকি আন্দার সোন ডাল দোগে, তাব বহৎ হোশিয়ার র্যাহনা। কালু গোলাপ মিয়াকে শিখিয়ে ছিলো কিভাবে আঘাত এড়িয়ে কর্ণকুহরে দিনের পরতে পরতে জমতে থাকা ক্লেদ, ক্লান্তি, পরচর্চা, পরনিন্দার মতো হলদেটে খৈলকে হাইড্রোজেন পারক্সাইডে গলিয়ে তা সাবধানতার সঙ্গে চিমটে দিয়ে বের করে নিতে হয়। আজ এই রাতে অনেকদিন পর ওস্তাদের কথা মনে করে গোলাপের বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে। কেমন যে আছে ওস্তাদ, কত বয়স হয়েছে কে জানে! বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার গণ্ডগোলে যখন এদেশে মালাউন খতমের রব উঠেছিল, তখন ওস্তাদ তার ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে প্রাণভয়ে বোম্বাই ফিরেছে। বুড়িটা মনে হয় এতক্ষণে ঘুমিয়ে গেছে। সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না, কেবল পোয়াতি বউটা কেমন কু কু শব্দ করছে। গোলাপ এগিয়ে এসে বউয়ের গতরে হাত রাখে। গা গরম কিনা দেখতে কপালে বুকে হাত ছোঁয়ায়। ঘুমের মধ্যেও বউটার বুক ধুকধুক করে। সে আলগোছে বউটার ফুলে থাকা পেটে কান রাখে। কেমন একটা গুড়গুড় আওয়াজ। কী হবে এবার? আবারও মেয়ে, নাকি ছেলে। সেদিনও কথা প্রসঙ্গে এ কথা তুলেছিল গোলাপ। বউ তার মুখ ঝামটা দিয়ে ওঠে। মাইয়া হইলেই বা ক্ষতি কী? মাইয়ারাই এখনকার দিনে লক্ষ্মী। পরে গোলাপেরও মনে হয়েছে, আসলেও তাই। যে যুগ পড়ছে, এখন পোলাগুলা সব ব্যস্ত নানান পদের নানা জিনিস নিয়ে। কয়জনেই বা আগের মতো বুড়া বয়সে বাপ-মায়ের হাতের লাঠি হয়। তারচায়া মাইয়ারা এখনো মা-বাপের প্রতি মায়া করে। শিক্ষা-দীক্ষা পাইলে অনেকদূর আগায়াও যায়। হোক বউ, যা খুশি হোক, আমি শুধু আবার আমার কানে সন্তানের পয়লা কান্দন শুনতে চাই। গোলাপ ঘুমন্ত বউটার পেটটা অনাবৃত করে। সেখানে হাত বুলায়। গোলাপের মনে হয় যেন ওটা ঠিক গোল একটা পৃথিবী। ভালোবাসা নক্ষত্রের বোতাম লাগিয়ে উপুর হয়ে আছে তার বাদামি রঙা আকাশ। ভেতরে এক সমুদ্র সায়রে ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে তার বীজ। ঠিক এমনি সময় পাশে শোয়া বুড়িটা গলা খাকড়ি দেয়। গোলাপ চমকে বউয়ের গতর থেকে হাতটা সরিয়ে নিয়ে বিড়বিড় করে কাকে যেন গালি দেয়-খানকির বেটি।
সেদিন বাইরে প্রচণ্ড ঝাঁঝাল রোদে সব যেন কেমন স্তব্ধ হয়ে গেছে। টাউনের পরিস্থিতি ভালো না। এই হরতাল, এই অবরোধ, দাঙ্গা, হাঙ্গামা, মারামারি, বোমাবাজি, তাই রাস্তাঘাটও ফাঁকা। শুধু রাজমনি সিনেমা হলের সামনে দোকানের ছায়ায় বসে কিছু পুলিশ বিরক্তিভরে হাই তুলছে। সকালেই চৌরাস্তায় পরপর সাতটি ককটেল ফুটে এক রিকশাওয়ালা মারাত্মকভাবে জখম হয়েছে। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও এই গরমের মধ্যে পুলিশকে থাকতেই হচ্ছে। দশাশই শরীরের ইন্সপেক্টার আলী হামজাও গরমে দরদর করে ঘামছেন। তিনি তার ফর্সা মুখটা বারবার মুছছেন রুমাল দিয়ে। হলের এদিকটাতে প্রায়ই তার ডিউটি পড়ায় গোলাপ মিয়াকে ভালোই চেনেন তিনি। আজ দেখতে দেখতে দুটো শো হয়ে গেলো। কিন্তু হলে দর্শকের যেন খরা লেগেছে। এক দুইজন যাও বা আছে, তাদের হয়তো কাজ নেই বলেই একটু নিরিবিলিতে সময় কাটাতে হলের ভেতরে ঢুকেছে। তাই গোলাপ মিয়ারও কাস্টমার নেই। এদিকে বউটার যে কোনও দিন ব্যাথা উঠতে পারে। অথচ এই সময়ে গোলাপ খোরাকির খরচটা তুলতেই হিমশিম খাচ্ছে। যদিও আল্লাহর ওপর তার অগাধ ভরসা, তিনি গোলাপের মতো গরিব মানুষেরে ডোবাবেন না। ইন্সপেক্টর আলী হামজা গোলাপের দিকে এগিয়ে যান। কি গোলাপ মিয়া, ব্যবসা খারাপ মনে হয়? গোলাপ তখন মন খারাপ করে দেওয়ালে লাগানো সিনেমার পোস্টারটা আবার ভালো করে দেখছিল। আলী হামজার ডাক শুনেই সে চমকে উঠে উত্তর দেয়-হ স্যার। ইন্সপেক্টর তার প্যান্টটা ভুড়ির ওপর টেনেটুনে ঠিক করে নিয়ে টিকেট চেকারের বেঞ্চিটাতে বসে হাঁক দেয়-দেও গোলাপ মিয়া, কানটা পরিষ্কার কইরা দেও। বাইনচোদগুলার ঠুশঠাশ শুনতে শুনতে কানে তবদা লেগে গেছে। গোলাপ খুশি মনেই তার কাঁটা, চিমিটি তুলো বের করে। স্যার, কানটায় আগে একটু অলিভঅয়েল দেই। তেল খায়া ময়লাগুলা একটু নরম হইলেই বাইর কইরা ফলান যাইব। আলী হামজা আবার নিজের মুখটা মুছে নিয়ে বলে, দেও যা ভালো হয়। গোলাপ তার কাঁটার আগায় তুলো জড়িয়ে তা অলিভঅয়েলের কৌটায় ডুবিয়ে নেয়। তারপর ছোট একটা টর্চ দিয়ে খুব ভালো করে আলী হামজার কানের ভেতরটা দেখে নিয়ে তেলে ভেজানো তুলো তাতে ঢোকায়। আলস্য আর ক্লান্তির কোলে ধরা দেওয়া আলী হামজা নিজের সবুজাভ উর্দির ভেতর থেকে আরামপ্রিয় মানুষটাকে বের করে আনে। কানের ভেতরে গোলাপ মিয়ার তুলো চিমটা কাঁটার নড়াচড়া তাকে অদ্ভুত সুড়সুড়িময় আরাম দেয়। তিনি মুখ বাঁকান, কখনো কপাল কুঁচকান, ঠোঁটে অস্ফুট শব্দ করেন, কখনো বা আরামে চোখ মুদেন। এভাবেই গোলাপের সঙ্গে কথা চলে তার-এখন কাজ করে প্রতিদিন কত পাসরে?
কাজ করতে করতেই গোলাপ উত্তর দেয়-পাই স্যার। কোনদিন দুইশ, কোনদিন তিনশ ট্যাকা। লোকজনের ভিড়ের ওপর নির্ভর করে।
তা পুলিশরে মাঝে মইধ্যে পান বিড়ি খাওয়াসতো?
গোলাপ লজ্জা পায়, মুচকি হাসে। খাওয়াই স্যার, গরীব মানুষ স্বামর্থে যদ্দুর কুলায়। বুঝেনই তো, দিনকালের মতো ব্যবসাও খারাপ।
তা তোর বউ পালাপান কেমন আছে?
আছে স্যার, ভালোই। মাইয়াটারে আগামী বছর ইসকুলে দিমু ইনশাল্লাহ। এই বছর টাকার যোগাড় ছিলো না। এইদিকে বউটা আবার পোয়াতি। কয়েকদিনের মইধ্যেই হয়তো ডেলিভারি হইবো। এই গণ্ডগোলে মানুষজন বাইর হয় না বাসা থেইকা, তাই কাস্টমারও নাই। খোরাকি জোগাড় করাই মুশকিল। কী যে সমস্যার মধ্যে আছি স্যার।
কী করবি, সরকারও শালা মানুষ না, ওই বাইনচোদরাও না। দেখস না গরমের মইধ্যে এই খানে বইসা বইসা ঘামতেছি। আমার আবার প্রেসারের সমস্যা আছে, এসি ছাড়া থাকতে পারি না। একসময় এক সেপাই এসে আলী হামজাকে ওয়্যারলেস ধরিয়ে দেয়। তিনি কান পরিষ্কার থামিয়ে কার সঙ্গে যেন কথা বলেন। তাকে খানিকটা চিন্তিত মনে হয়। আলী হামজা ওয়্যারলেস নামিয়ে মানিব্যাগ থেকে একশ টাকার একটা নোট বের করে গোলাপকে দেন। গোলাপ জিহবায় কামড় দেয়-ছি ছি, স্যার আপনের কাছ থেইকা ট্যাকা নিমু। আপনারা হইলেন আমাগো মা-বাপ। আলী হামজা ধমকে ওঠেন-ধর হারামজাদা, টাকা দিতেছি ভালো লাগে না? কইলি না বউ অসুস্থ।
গোলাপ কাচুমাচু করে, লজ্জা পায়। তারপর সংকোচের সঙ্গেই টাকাটা হাতে নেয়। সত্যি টাকাটা তার আজ বড় দরকার ছিলো। সকাল থেকে কোনো কাস্টমার ছিলো না, আল্লা বাঁচাইছে। আলী হামজা হঠাৎ করেই কেনো যেন গোলাপের কাঁধে হাত রাখেন-আজ বাসায় চলে যা। এখানে থাকিস না, গ্যাঞ্জাম হতে পারে। শুয়রের পাল নাকি মিছিল বের করেছে। কথাগুলো বলেই তিনি চলে যান। আর গোলাপ তার হাতে থাকা নোটটা নেড়েচেড়ে দেখে। সত্যিই আজ তার দ্রুত বাসায় ফিরে যেতে মন চায়। মাতৃগর্ভের সমুদ্র সায়রে ভাসতে থাকা কোথাকার এক মিহি সুর তার কর্ণকুহরে ডেকে চলে-বাবা, বাবা। গোলাপ ঠিক করে বাসায় ফিরে সে আজ আবার কান পাতবে বউটার গর্ভে। মিলিয়ে দেখবে কী শোনা যায়, কেনও শোনা যায় ওই মিহি কণ্ঠের ডাক। এদিকে পুলিশগুলো সব উঠে দাঁড়িয়েছে। তাদের মধ্যে কিসের যেন তাড়া। হঠাৎ করেই সবুজাভ ইউনিফর্ম পড়া মানুষগুলো যেন পাল্টে যেতে থাকে। তারা দ্রুততার সঙ্গে নিজেদের আর্মগার্ডগুলো পড়ে নেয়, হাতিয়ারগুলো নেড়েচেড়ে দেখে। গোলাপ মিয়ার মনে হলো, বড় ধরনের গ্যাঞ্জামই হবে আজ। এই জীবনেতো মারামারি সে তো আর কম দেখেনি। কখন কী হয়ে যায়, গোলাপ তার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে পথে নামে। রোদের ঝাঁজ এদিকে আরও বেড়েছে। গরম হল্কা বাতাস যেন নরকের অস্বস্তি নিয়ে পেঁচিয়ে ধরে চারদিক। গোলাপ মিয়া সেই অস্বস্তিময় নরক গরমেও কী এক অজানা স্বস্তি নিয়ে হাঁটতে থাকে নিউপল্টনের দিকে। জায়গাটা ভালো না, দ্রুত এদিকটা পার হয়ে যেতে হবে। হঠাৎ গোলাপ মিয়া দেখে উল্টো দিক থেকে একটা মিছিল এগিয়ে আসছে। দূর থেকে তাদের স্লোগানের শব্দ গরম বাতাসকে যেন ফুটো করে দেয়। তীব্র রোদে পিচপোড়া রাস্তায় অনেক পায়ের আগমনী আওয়াজ। আর এ পাড়ে পুলিশরাও পথে নেমেছে। যেন গণগণে এক মরুভূমির মাঝে একপাশে সবুজাভ জিঘাংসা আর অন্যপাশ থেকে আসছে তীব্র ধুসর ধুলিঝড়। তার মাঝখানে খড়কুটো হয়ে উড়ে যাওয়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে গোলাপ। বড় ধরনের মারামারি বোধয় আজ বেধেই গেলো। গোলাপ পা চালায়, কিন্তু মিছিলটা যেন পাল্লা দিয়ে আরও এগিয়ে আসে। হঠাৎই শোরগোল ওঠে, মিছিল থেকে পুলিশের দিকে বৃষ্টির মতো ইট, পাথর ছুটে আসে। পুলিশও এবার হা রে রে রে করে ছুটে আসে বন্দুক আর লাঠি নিয়ে। গুলির শব্দ হয় বাতাসে। ভাঙা ইটের টুকরো ছত্রছান হয়ে পরে রাস্তায়। আশপাশের বিল্ডিংগুলোর কাঁচে ঢিল পড়ে। এরমধ্যে দিয়েই গোলাপ মিয়া দৌড়ায়। যে কোনও মূল্যে মাথা বাঁচিয়ে মিছিলটাকে পার হয়ে যেতে হবে। বাতাসে ফাঁপা স্লোগান, চিৎকার, গুলির শব্দ, সাইরেন এক হয়ে যায়। হঠাৎ কাছেপিঠে কোথাও গুড়ুম গুড়ুম ককটেল ফাটে। আবার এক পশলা রাবার বুলেট ছুটে আসে চারদিক। ততক্ষণে গোলাপ মিয়া রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে।
হাসপাতালের বেডে গোলাপ মিয়া যখন আবছা চোখ খোলে তখন তার মাথায় প্রচণ্ড ব্যাথা। ককটেল ফাটানোর অভিযোগে তাকে ধরে এনেছে পুলিশ। পুরোপুরি ছোড়ার আগেই ককটেল ফেটে সে মারাত্মক আহত হয়েছে। গোলাপের হাত পা অসাড় লাগে। চারদিকে লাইটের সাদা আলোয় তখন চোখ ধাঁধানো ধবলীমা। গোলাপ মিয়া বুঝতে পারে, তার মাথায়, পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা। কিন্তু একটা হাত বেডের স্ট্যান্ডের সঙ্গে হাতকড়া দিয়ে লাগানো। সে কাঁধ ঝাঁকানোর চেষ্টা করে। তার হাতে হাতকড়া কেনো, সে কী করেছে, তার কান পরিষ্কারের বাক্সটাই বা গেলো কই! ওটা হারালেতো সর্বনাশ হয়ে যাবে। সবাই কেনো বোবা হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে! ওইতো তার বুড়ি মা আর ছোট্ট মেয়েটা নিঃশব্দে কাঁদছে। সে মাথা নাড়ে, কিন্তু ঘাড় কান মাথায় যেন ব্যাথার দেবতা ছুরি বসায়। গোলাপ মিয়া মুখ বিকৃত করে ফেলে। তার বাম কানের ভেতর থেকে এক ফোটা রক্ত ঝরে পড়ে। ছোট্ট মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু গোলাপের কর্ণকুহর তখন ফেটে যাওয়া ঢাক। তাতে আর বাদ্য বৃষ্টি হয় না, কেবল শব্দগুলো অতীত হয়েই থাকে। নইলে গোলাপ শুনতে পেতো-তার মেয়েটা কাঁদছে আর বাবাকে বলছে, তাদের একটা ভাই হয়েছে।