কটা বাজে?—প্রশ্নটা করেই থেমে গেলো জয়নাল। মনে পড়লো, উত্তর দেওয়ার মতো কেউ নেই এই ঘরে। অথচ কদিন আগেও এমন ছিল না অবস্থা। তার বাসাটা মোটামুটি রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছিল বলা যায়। শ্বশুরকুলের তামাম আত্মীয়স্বজনে ঠাসা ছিল এই ঘর।
বরাবর থাকে। বাপের কুলের কাউকে অবশ্য তার বাসার ত্রিসীমানায় সচরাচর দেখা যায় না। মোহিনী পছন্দ করে না। আর জয়নালেরও, নিজের বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ তেমন একটা নেই-ই বলা যায়। মাঝে-সাঝে, কালে-ভদ্রে যদিবা কেউ ঢাকা শহরে আসে কোনো কাজে, ফোন যদি দেয় তাকে, ভয়ে বুক দুরুদুরু কাঁপে তার। যদি বাসায় আসতে চায় হঠাৎ! মোহিনীকে বড় ভয়। শ্বশুরকুলের লোকজন একদম সহ্য করতে পারে না মেয়েটা।
গাঁইয়া, অভদ্র, ম্যানারলেস ইত্যাদি তীর্যক বাক্যবাণে সে ফালাফালা করে ফেলে জয়নালকে, সঙ্গে হঠাৎ এসে পড়া সেইসব বেচারা গাঁইয়াদেরও। গাঁয়ে সবাই শেষপর্যন্ত বুঝে নিয়েছে, জয়নাল মোটামুটি বউয়ের আঁচলতলে ঠাঁই নেওয়া এক ছাগশাবক। তার দৌড় বড়জোর ওই ম্যা-ম্যা পর্যন্ত। মোহিনীকে এড়িয়ে করে নিজের আপনজনদের খোঁজখবর করার সাহস তার নেই একদম। তাই পারতপক্ষে তারা ছায়াও মাড়ায় না এই বাসার।
কষ্টে উঠে বসলো জয়নাল। হাতড়ে মোবাইলটা খুঁজতে চেষ্টা করলো। ঘরের অন্ধকারটা চোখ সওয়া হতে সময় নিলো খানিক। সময়টাকে অনন্তকাল মনে হলো। তবু পাওয়া গেলো ফোনটা অবশেষে। টি টেবিলের এক কোনায় মুখ অন্ধকার করে পড়ে আছে দামি মোবাইলটা। তুলতে গিয়ে ব্যথাটা টের পেলো আবার। ব্যথা। সমস্ত শরীরে যেন হাতুড়ি মেরেছে কেউ। রিং হচ্ছে। অনেকক্ষণ। হ্যালো বাবা!—মৌয়ের কণ্ঠ! আহা। মেয়েটা। উদ্বেগে অধীর, ব্যাকুল কণ্ঠ।
কেমন আছ বাবা?—মৌয়ের প্রশ্নের জবাবে কষ্টে শ্বাস টানলো জয়নাল। পৃথিবীতে অক্সিজেনের অভাব কি এতটাই চলছে তাহলে! মাথার ভেতরটা কেমন চাপ হয়ে আছে। ফুসফুস এক টুকরো বিশুদ্ধ হাওয়ার জন্য হাহাকার করছে।
শালা শুয়োরের বাচ্চারা! আবাল চোদারা! মনে মনে গাল পাড়ে জয়নাল।
ভালো আছি মা। তোমার মাকে ফোনটা দাও।—কথাগুলো বলতে দম বন্ধ হয়ে আসতে চায় জয়নালের। ফুসফুসের হাওয়াটুকু ফুরিয়ে আসে মুহূর্তেই। হা করে শ্বাস টানে সে। জল থেকে তুলে আনা মাছের মতো খাবি খায়। বোধগুলো কেমন জট পাকিয়ে যায় মাথার ভেতর। ওপাশে মোহিনীর কণ্ঠ শোনা যায় ততক্ষণে, হ্যালো, মৌ’র আব্বু? বলো!
আমি, আমি মনে হয় মারা যাচ্ছি মোহিনী। তোমরা ভালো থেকো।
ফোন রেখে হা করে হাঁফায় জয়নাল। কাশির দমকে বন্ধ হয়ে আসতে চায় শ্বাস। মোহিনী ওপাশ থেকে ফোন দিচ্ছে। দিয়েই যাচ্ছে। দিক। ধরবে না জয়নাল। কারও ফোন ধরবে না সে আর। এই ক’দিনে সবাইকে চিনে নিয়েছে সে। ডাক্তার, হাসপাতাল, আত্মীয়, বন্ধু, স্বজন—সব শালা শুয়োরের বাচ্চাকে চেনা হয়ে গেছে তার। ঘেন্না ধরে গেছে বেঁচে থাকায়। এই তবে মানুষ! এই তবে মানবতা! অথচ সে? অপরাধটা কী তার? তার কি অধিকার নেই বেঁচে থাকার? অধিকার নেই অসুস্থতায়, অসহায়তায় একটু স্নেহস্পর্শ, ভালোবাসা পাওয়অর? রাষ্ট্রের কাছে তার কি অধিকার নেই ন্যূনতম চিকিৎসা সেবাটুকু পাওয়ার? তাহলে কেন রাষ্ট্র এতদিন ট্যাক্স নিয়েছে তার কষ্টার্জিত টাকায়, কেন ভ্যাট কেটেছে তার ঘাম ঝরানো পয়সায়? কেন? কে দেবে উত্তর? আর এই যে সে মরতে বসেছে এখন, মরার পর, শুয়োরের বাচ্চা মানুষগুলো তার কবরটা পর্যন্ত দিতে বাধা দেবে, জানাজা তো আরও বহুদূর! কেন রে? রোগটা কি সে ইচ্ছে করে বাঁধিয়েছে? প্রবাসীরা যখন দেশে ঢুকছিল বানের জলের মতো, তখন কোন বাল ফেলেছে তোদের জনদরদিরা, অ্যাঁ? আর এ রোগ যে তোদের হবে না, গোষ্ঠীসুদ্ধ তোরাও যে কুকুরের মতো মরে পরে থাকবি না রাস্তায়, তার কী নিশ্চয়তা আছে? তবে? সাবধানে না থেকে কেন রোগীদের তোরা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিস কুকুরের মতো? অসহায়, মৃত্যুপথযাত্রীদের বাঁচানোর চেষ্টা না করে কেন তাদের মৃত্যুটাকে ত্বরান্তিত করছিস আরও? কেন তাদের শেষ মুহূর্তটাকে করে তুলছিস বিভীষিকাময়? শালা শুয়োরের বাচ্চারা! আবাল চোদারা! মনে মনে গাল পাড়ে জয়নাল। অভিশাপ দেয় তার মানবজন্মকে। অভিশাপ দেয় তার চিরচেনা মানুষগুলোকে।
গত তিনদিনে জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট আর অসহ্য গা ব্যথায় কাহিল জয়নাল ফোন দেয়নি এমন পরিচিত কেউ বাকি নাই আর। মোহিনী মেয়ে মৌকে নিয়ে বাপের বাড়ি গেছে দিন পনেরো হলো। ফোনে জয়নালের শারীরিক অবস্থা আর রোগলক্ষণ শুনে সাফ বলে দিয়েছে, বাসা থেকে বের হবে না একদম। বাসায় থাকো। আমি মৌকে নিয়ে এখানেই কটা দিন থাকছি আপাতত, বুঝেছ? ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ট্রিটমেন্ট নাও, আমিও দেখছি কী করা যায়।
মোহিনী বারবার ফোন করে বলছে গরম জলে লেবু মিশিয়ে খেতে। শক্তি নেই শরীরে একবিন্দু।
মোহিনীরও দোষ নেই। রোগটা মারাত্মক সংক্রামক। সে যদি আসে এখানে, যদি সংক্রামিত হয় সে-ও, যদি মারা পড়ে দুজনেই, মৌকে কে দেখবে তখন? সুতরাং তার আসা চলবে না। তার বাঁচাটা জরুরি খুব, অন্তত জয়নালের চেয়ে, আর জয়নালকে তো ভরসাই নেই আর, খরচের খাতায়ই ধরা যায় তাকে। মোহিনী চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেনি। সম্ভব অসম্ভব সব জায়গায় ফোন দিয়েছে। কেউ আসেনি। না কোনো ডাক্তার, না আত্মীয়, না স্বজন, না পড়শী। সবাই সটকে পড়েছে নিরাপদ দূরত্বে। জয়নাল নিজেও চেষ্টা কম করেনি। কাজ হয়নি। এখন আর ফোনই ধরে না কেউ, এক মোহিনী ছাড়া। অথচ ঢাকা শহর গিজগিজ করছে তার শ্বশুরবাড়ির দিকের লোকজনে। যারা দিন নেই, রাত নেই, তার বাসায় এসে ঘাঁটি গাড়তো নিশ্চিন্তে, নির্ভাবনায়, সেসব লোকেরা ফোনটা পর্যন্ত ধরে না এখন! কেন রে! ভাইরাস কি ফোন রিসিভ করলেও ঢুকে যাবে তোদের পাছার ভেতর! শালারা সব খানকির বাচ্চা একেকটা! নিমকহারামের দল সব! —শ্বাসকষ্টে মাথা অবশ হয়ে আসে জয়নালের।
অবশ, ঝিম ধরে যায় শরীর। নিজের আপন বলতে যারা আছে, তাদের কাউকে ফোন দেয়নি জয়নাল। কোন মুখে ফোন দেবে সে! যাদের দুর্দিনে, দুঃসময়ে কোনোদিন কোনো কাজে লাগেনি জয়নাল, বাড়িয়ে দিতে পারেনি সহমর্মিতার হাত, আজ নিজের এই ঘোর দুর্বিপাকে কোন সাহসে সে সাহায্য চাইবে তাদের কাছে? কোন অধিকারে?
তিন দিন হলো বিস্কুট আর জল খেয়ে কাটছে। মোহিনী বারবার ফোন করে বলছে গরম জলে লেবু মিশিয়ে খেতে। শক্তি নেই শরীরে একবিন্দু। কী করে গরম জলে লেবু মিশিয়ে খাবে সে! কী একটা হটলাইন নাম্বার দিল মোহিনী। বললো, ফোন দিতে। ফোন দিলো জয়নাল। ব্যস্ত ব্যস্ত ব্যস্ত। অবশেষে লাইন পেলো।
তুমুল শ্বাসকষ্ট চেপে ওপাশের করা প্রশ্নের উত্তর দিলো জয়নাল।
—আপনি সম্প্রতি কি বিদেশ থেকে এসেছেন?
—জি না।
—এমন কারও সংস্পর্শে এসেছেন, যিনি সম্প্রতি বিদেশ থেকে এসেছেন?
—জি না। তেমন কারও সংস্পর্শে আসার আশঙ্কা কম।
—আপনি বাসায় থাকুন। আপনার টেস্টের প্রয়োজন নেই।
বেকুব হয়ে জয়নাল এতক্ষণের জেরায় খরচ হয়ে যাওয়া অক্সিজেনের ঘাটতিটুকু পূরণের আপ্রাণ চেষ্টায় হা করে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করলো অনেকক্ষণ। শুয়োরের বাচ্চার জীবন! কষ্টে শব্দগুলো বাতাসে উড়িয়ে দিলো জয়নাল।
মায়ের ফিসফিসানি কানে এলো জয়নালের। নিশ্চিন্তে চোখ বুঁজলো সে। দূরে, কোথাও সাইরেন বাজলো। সম্ভবত অ্যাম্বুলেন্সের।
জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট আর শরীরে অসহ্য ব্যথা নিয়ে প্রায় সংজ্ঞাহীন জয়নালের হঠাৎ মনে হলো দরজায় মৃদু শব্দ করছে কেউ। মৃদু কিন্তু স্পষ্ট। কে? এত রাতে কে হতে পারে?
হামাগুড়ি দিয়ে দরজার কাছে গেল জয়নাল। দরজা খুললো খুব কষ্টে। সিঁড়িঘরের আলোয় দেখলেঅ আচমকা হাজির হওয়া আগন্তুককে। দরজা খোলা পেয়ে ঢুকে পড়লো ভেতরে। পরিশ্রমে হাঁপাতে হাঁপাতে সেখানেই শুয়ে পড়লো জয়নাল। আগন্তুক তার পাশে। জিব বের করে হাঁপাচ্ছে সে-ও।
অফিস যাওয়ার পথে প্রায়ই কুকুরটাকে পাড়ার দোকান থেকে পাউরুটি কিনে খেতে দেয় জয়নাল। জয়নালের এই কদিনের অনুপস্থিতিতে কুকুরটা খোঁজ নিতে এসেছে। দেখতে এসেছে তার হাল-হকিকত। অজান্তেই চোখ দিয়ে জল গড়াল জয়নালের। অথচ মানুষগুলো…! ভেবে ঘেন্নায় বমি পেলো তার। বমি করলো সেখানেই। কুকুরটা চেটেপুটে সাফ করে ফেললো তখনই। পায়ের কাছে শুয়ে কুঁইকুঁই শব্দ করলো কতক্ষণ, চেটে দিলো জয়নালের পা। জয়নাল তখন সংজ্ঞাহীন।
ভোরের দিকে চোখ খুললো জয়নাল। বিছানায় শুয়ে আছে সে। মাথার কাছে মা। কুকুরটা ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে আছে তার দিকে দূরে, মেঝেতে বসে।
তোর কিচ্ছু হবে না বাজান! আমার কলিজা তুই! কার এত ক্ষমতা আমার কাছ থেকে তোকে কেড়ে নেয়! মনে সাহস রাখ বাজান! এই যুদ্ধে জিততেই হবে আমাদের।—মায়ের ফিসফিসানি কানে এলো জয়নালের। নিশ্চিন্তে চোখ বুঁজলো সে। দূরে, কোথাও সাইরেন বাজলো। সম্ভবত অ্যাম্বুলেন্সের।