অচেনা পরিবেশ। একজন হন্যে হয়ে খুঁজছিল। আমি কাদামাখা পথে হেঁটে যাচ্ছিলাম। সামনে একটা নদী ছিল নালার মতন। আর পেছনে লোকটি। আমি কোথায় যাবো, জানি না। নদীতে তখন কিছু মানুষ পাট ভেজাচ্ছিল। আবার কেউ কেউ (তারা নারী ছিল) বড় গোল বাঁশের ডালার মতো বস্তুতে চেপে পানিতে ভেসে যাচ্ছিল। পানির সামনে দাঁড়িয়েছিলাম জলতরঙ্গ কানে বাজছিল তখন। কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
কাউকে খুঁজছিলাম। পেছনের লোকটি আমাকে খুঁজছিল। লোকটি জানে সে আমাকে খুঁজছে, কিন্তু আমি জানি না, কাকে খুঁজছি। তখন পানিতে একটা সাপ সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছিল মাথা উঁচু করে। নদীর পানি ঘোলা ছিল। ঘামে ভিজে গেছে এমন একটা মহিলার বাঁশের ডালার মতন ওই বস্তুতে চেপে বসলাম। যেটাতে ভেসে ভেসে কোথায় যাবো, জানি না। হয়তো পানির স্রোত যেখানে মিলিয়ে গেছে অথবা যেখানে সবুজ দুর্বাঘাসের আড়ালে সাপ কুণ্ডুলি পাকিয়ে বসে আছে। আমি ভাসছি পানিতে।
আমাকেও বৈঠার মতন একটা লাঠি দেওয়া হয়েছে দ্রুত ভাসতে সহযোগিতার জন্য। এটা চালাতে পারি না ঠিকঠাক। তবু চেষ্টা করে যাচ্ছি। খানেক দুরে যেতেই আমার নাম ধরে কেউ ডাকছিল। ভীষণ মিষ্টি কণ্ঠ। এ কণ্ঠ অনেক শুনেছি। আমার কানে এরকম ডেকে যাওয়া বাজতে থাকে সব সময়। বুঝতে পারছিলাম না, কে ডাকছে। তার দিকে তাকিয়ে খুব করে তাকে চেনার চেষ্টা করলাম, চিনতে পারলাম না। আমার ক্ষীণ দৃষ্টি, ক্ষীণ স্মৃতি। একটা গন্ধ সেদিক থেকে ভেসে আসছিল। গন্ধটা মনে পড়লো। আমি সম্ভবত একেই খুঁজছিলাম! ওর কাছেই আমাকে নামিয়ে দেওয়া হলো। ঘামে ভেজা মহিলাকে পয়সা দেওয়ার জন্য পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেখি, টাকা নেই। আমার তখন খুব পেশাব চেপেছিল। দাঁড়িয়ে পেশাব করেছিলাম। ওর দিকে তাকালাম। যে আমাকে ডাকছিল। খুব কাছে গিয়ে তাকে দেখার চেষ্টা করতেই সে আমার কাধে হাত দিয়ে বসলো। আমি তার হাতে হাত ছোয়ালাম।
হ্যাঁ! আমি একেই খুঁজছিলাম। এরপর তার হাত ধরে একটা কাঠের তক্তার মতোন বস্তুতে চেপে পানিতে ভাসতে থাকলাম। কতক্ষণ ভাসলাম, তার ঠিক নেই। একটা শুকনো জায়গায় গিয়ে উঠে আমরা হাঁটতে লাগলাম। হাঁটতে হাঁটতে ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছিলাম বার বার। ওর মুখটা ঝাপসা! তার চেহারা মনে করতে কষ্ট হচ্ছিল।
সরু নদীতে জলের স্রোতটা বেশি ছিল। আমরা কোন দিকে ভেসে যাচ্ছি, জানি না। যমরাজ আমাদের পেছনে তাড়া করে বেড়াচ্ছে।
জায়গাটা বেশ শান্ত নিবিড় সবুজ। পাখি ডাকছিল অনেক। জঙ্গলের মতো এলাকা। খস খস শব্দ করে কী যেন একটা দৌড়ে পালালো। হয়তো শেয়াল হবে! একা একটি শেয়ালকে মানুষ দেখলে এভাবেই চোরের মতো পালিয়ে যেতে দেখেছি অনেকবার। আর কিছু দূর হাঁটার পর আমরা দু’জনে বুঝলাম আমাদের পায়ের নিচে, চারপাশে সারি সারি কবর। অনেকের কবরে তাদের জন্ম থেকে মৃত্যুর তারিখ লেখা ছিল। কেউ অল্প বয়সে মারা গেছেন। আবার কেউ প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বেঁচে ছিলেন।
চারপাশ ঘুরে বেড়ানোর পর আমাদের মনে হলো এখানে বসতি গড়া যাবে না। আমরা অন্যত্র যাওয়ার জন্য এগোচ্ছিলাম। তখন গজ কতকদূরে একজন দাঁড়িয়ে তৃপ্তির হাসি হাসতে শুরু করলো। আমি ওকে চিনতে পারলাম। যমরাজ! যিনি আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিলেন। আমি চিৎকার করে তার উদ্দেশে বললাম, আমি তখন থেকে পালাইনি। কাউকে হন্যে হয়ে খুঁজছিলাম। যেভাবে আপনি আমায় খুঁজছিলেন। আপনি আমাকে এবং আমি তাকে পেয়ে গেছি। আমাদের মাঝে শুধু কয়েক গজ দূরত্ব। আমরা দৌড়াবো না। হেঁটে চলবো। পারলে ধরে ফেলুন। আমরা পুনরায় কাঠের তক্তায় চেপে পানিতে ভাসতে লাগলাম।
সরু নদীতে জলের স্রোতটা বেশি ছিল। আমরা কোন দিকে ভেসে যাচ্ছি, জানি না। যমরাজ আমাদের পেছনে তাড়া করে বেড়াচ্ছে।