এক.
শীতের সন্ধ্যা। নুডুল, কফি আর বিস্কুট নিয়ে এলো রানু। ড্রয়িংরুম সুন্দর, পরিপাটি। দেয়ালে টানানো গ্যালাক্সি, সূর্যের ছবি, বিভিন্ন প্রকৃতির দৃশ্যর। কফির কাপটা ঠোঁটে লাগাতেই রানুর জিজ্ঞাসা—টিভি অন করবো?
-অনেকদিন টিভি দেখা হয় না। সত্যিে বলতে কি সময়ই মেলাতে পারি না। অফিসের কাজের চাপে চেপ্টা।
শাওনের কথা শুনে রানু আর্নেস্ট হেমিংওয়ের দ্যস ওল্ড ম্যা ন অ্যা ন্ড সি গল্পের কথা বলা শুরু করে দিলো।
—শাওন ভ্রূ কুঁচকে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। তোমার শরীর খারাপ? মন খারাপের মতো দেখাচ্ছে তোমায়।
-না। ক্লান্ত নাহ। আমি ভালো।
নিমিষেই শাওনের ভালো লাগার আবেশে নানা কথা বলতে ইচ্ছে করছে। অনেকদিন দেখা হয়নি রানুর। আসলে মনে মনে ভালো লাগলেও কখনো বুঝতে দেয়নি। কখনো বলা হয়নি।
শাওন চা খাচ্ছে। সন্ধ্যার ঢাকায় আকাশে আলো নেই। চায়ের কাপে প্রশান্তি ছুঁয়ে যায় আলতো করে। হৃদয়ের কোণে এক চিলতে অন্যরকম উচ্ছ্বাস উঁকি দেয়। রানু আবারও ড্রয়িংরুমে এসে পাশে বসে। চা, আড্ডায় সময় গড়ায়।
রানুর সঙ্গে শাওনের সম্পর্কটা ছিল ভারি অদ্ভুত। বড় বোন সম্পর্কের ক্যাটাগরিতে ফেলা যায় না। আবার বন্ধুত্বের ক্যাটাগরিতেও ফেলা যায় না। রানুর সঙ্গে পরিচয়ের পর থেকেই প্রতিদিন নানা চিন্তা মাথায় ভর করে। নানান বিষয়ে আলাপের পরিধি বাড়ে। সময় বাড়ে। আলাপ জমতে থাকে। বাইরে গরমের তীব্রতা কমে যায়। শাওন রানুর কাছে থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসে।
ঘুম আসছে না। বাসায় পোলাও, দেশি মুরগির মাংস রান্না করাই আছে। তবু বাসায় ঢোকার আগে রুটি আর সবজি খেয়ে এসেছে। ইদানিং মাংস খাওয়ার মোটেও রুচি নেই। সবজিই শাওনের বেশি পছন্দ। বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছে। রুমে ড্রিম লাইট জ্বলছে। জানালা দিয়ে আকাশে কয়েকটি তারা দেখা যাচ্ছে।
হালকা বাতাস বইছে। হালকা বাতাস এসে রানুর শরীরে পরশ দিয়ে যাচ্ছে। দুই চোখে সামান্য জল। নাহ! কেন জল বের হচ্ছে চোখ থেকে—নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে রানু।
রাত বাড়ে। চোখে ঘুম আসে না। মাথায় অজানা চাপ। বালিশের নিচে থেকে ডায়েরি আর শার্টের পকেট থেকে কলম নিয়ে শুয়ে শুয়ে ঘুমের পায়চারা করছিল শাওন। নাহ! ঘুম নেই। ডায়েরিতে কিছুটা লেখার চেষ্টা করছে। ‘জীবনের অনেক ব্যা প্তি আজও বুঝতে পারছি না। আর বুঝবোই বা কী করে।’ এই দুই বাক্যু লেখার পর থেমে যায় কলম। বাইরে অন্ধকার। জানালা দিয়ে সামান্যে ঠাণ্ডা বাতাস গায়ে লাগছে। শাওন আবারও লেখা শুরু করে—‘বদলে যাচ্ছে সময়। বদলাচ্ছে মানুষ। বদলে যাচ্ছে প্রকৃতি। কোথাও অজস্র অন্ধকার। কোথাও বর্ণালির আভা। চারদিকে বাতাস বয়ে চলে। একপক্ষীয় ভালোবাসায় ছিঁড়ে যায় স্বপ্নের বন্ধন।’
লাইট জ্বলছে। রাতের শেষ ভাগ। বাইরে নিস্তব্ধ। কোলাহল নেই। কিছুক্ষণ পরই সকাল হবে। জানালার গ্রিলে হঠাৎ দোয়েলের চেঁচামেচি। ঘুম ভেঙে যায় শাওনের। ব্লু টুথ স্পিকারে বাজছে ‘সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যাি আসে/ ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল/ পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন/ তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল/ সব পাখি ঘরে আসে—সব নদী?—ফুরায় এ-জীবনের সব লেন দেন/ থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।’
রাতে যখন ঘুম আসছিল না, তখন জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন কবিতার ক্যা সেট ছেড়ে দিয়েছিল। আবৃত্তি শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল খেয়ালই করেনি।
সকাল হয়েছে। শাওন বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে। প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার আগে এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাঁচ মিনিটি আকাশ দেখা তার অতীব প্রিয় কাজের একটি।
দুই.
প্রতিদিন সন্ধ্যাো নামে। সন্ধ্যাি হলেই বিষণ্নতা ভর করে রানুর। ফাপুর ফাপুর লাগে। আজ আরেকটু পরেই সন্ধ্যাশ হবে। তিন বছর আগের জীবন আর এই সময়—ভাবলেই হাহাকার করে ওঠে বুকটা। বেডরুমের দেয়ালে সমুদ্রের একটি ওয়ালমেট। ওয়ালমেটে সমুদ্রের পানির ঢেউয়ের ওপর লেখা জীবনানন্দ দাশের কবিতা, ‘এসেছে সন্ধ্যারর কাক ঘরে ফিরে; দাঁড়ায়ে রয়েছি জীর্ণমঠ/ মাঠের আঁধার পথে শিশু কাঁদে/ লালপেড়ে পুরনো শাড়ির ছবিটি মুছিয়া যায় ধীরে ধীরে/ কে এসেছে আমার নিকট?’
নাহ! কেউ আসেনি রানুর কাছে। কেউ আসে না। হয়তো কেউ আসবে না। কতদিন বেলকনিতে দাঁড়িয়ে নতুন জীবনের হিসাব মেলানোর চেষ্টার এখনো কোনো কূলকিনারা হয়নি। সন্ধ্যা হলেই অন্ধকারের ঘুম নামে চোখে। যমুনা নদীর পারে সেই সব সন্ধ্যার বিমর্ষ চোখ লাল হয়ে যায়। অজানা এক ঘোর মাথায় ঘোরে। কী করবে ভেবে পায় না রানু। মোবাইল নিয়ে ফেসবুকে কিছুক্ষণ ঢুঁ মারে। আবার কিছুটা সময় ভাইবার, হোয়াটস অ্যা পে নোটফিকেশন দেখার চেষ্টা। মাথায় নানান ভাবনা চক্কর দেয়। এই কঠিন সময়ে জীবন থেমে যাবে না যাবে না? আরে ধুর কী ভাবছি। এসব ভেবে কী হবে। জীবন যেভাবে যাচ্ছে যাক না।
একটা সিদ্ধান্তই পাল্টে দিয়েছে রানুর জীবনের বাস্তবতা। হঠাৎ ফোনটা বেসুরো সুরে বাজছে। ইদানীং ফোন এলেও ধরতে ইচ্ছে করে না। প্রতিদিনের রবীন্দ্র সংগীতের রেওয়াজও অনিয়মিত হয়ে গেছে। চাকরি, বাইরের অনুষ্ঠান—না, কোথাও যাওয়া হচ্ছে না। সন্ধ্যার ঠিক আগ মুহূর্তে দাঁড়ায় খোলা বারান্দায়। আকাশে তখন মেঘ উড়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে মেঘের ওড়াউড়ি দেখে রানু। অথছ কয়েক বছর আগেও কোনো একদিন এরকম সন্ধ্যায় কী অদ্ভুত এক আনন্দে ভরে উঠেছিল মন। বাইরে অন্ধকার গাঢ় হচ্ছে। হালকা বাতাস বইছে। হালকা বাতাস এসে রানুর শরীরে পরশ দিয়ে যাচ্ছে। দুই চোখে সামান্য জল। নাহ! কেন জল বের হচ্ছে চোখ থেকে—নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে রানু।
সন্ধ্যা পেরিয়ে অন্ধকার তখন। রানু কিচেন রুমে এসে গ্রিন টি বানিয়ে কাপে ভরে ড্রয়িংরুমে গিয়ে টিভিটা অন করে। বাইরে তখন ঝরঝর বৃষ্টি ঝরে চলেছে।
ফেলে আসা অতীতের সন্ধ্যাগুলোর স্মৃতি মনে পড়ে। এই তো কয়েক মাস আগে যখন ভোলা যাচ্ছিল, সকালবেলা সূর্য উঠার কী চমৎকার দৃশ্য। চারপাশ অথৈই পানি। জাহাজে সারারাত জার্নির পর সকালের সূর্য উঠার মুহূর্ত, অসম্ভব সুন্দর স্মৃতি ভাবতে ভাবতে শাওনের খুব মনে পড়ে। বারান্দা থেকে ড্রইং রুমে এসে একগ্লাস পানি খায়। মোবাইলটা অন করে হোয়াটসঅ্যাপে শাওনকে ফোন দেয়। অনেকক্ষণ রিং হলেও রিসিভ করে না শাওন।
তিন.
শাওনের আজ মন ভালো নেই। তিন বছর আগে যখন মা পৃথিবীতে থেকে বিদায় নেন এরপর থেকেই কখনোই মন ভালো থাকেনি। সব সময় শূন্যতা। ক্ষিধে পেলেও ভাত খাবার তাড়া দেওয়ার কেউ নেই। এখন আর কেউ উদাস থাকলেও মায়ের সেই শাসন করার নেই। মাঝে মাঝে রানু ফোন করে খোঁজখবর নেয়। তবে এটা নতুন নয়। যখন থেকে রানুর সঙ্গে পরিচয়, এরপর থেকেই শাওনের বিভিন্ন বিষয়ে প্রায়ই খোঁজখবর নেয়। আবারও রানুর ফোন
-হ্যালো, হ্যালো, শুনতে পাচ্ছ?
-জি, তোমার খবর?
-ফোন রিসিভ করছো না কেন?
-না এমনি! কি যেন ভাবছিলাম।
-কি যে করোনা তুমি। বাসায় চলে আসো।
-ওকে। সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পায়চারি করে বের হলো শাওন।
শহরে আজ গাড়ি তেমন নেই। দুই একটা রিকশা চলছে। শাওন হাঁটছে। ছোট্ট শহর ড্রিম ভ্যালি। এই শহরের বাড়িঘরগুলো ছোট ছোট। উঁচু কোনও দালান নেই। সব বাড়ি দুই তলা। রাস্তার দু্ই পাশে কিছু দূর পরপর সাইনবোর্ড। এসব বোর্ডে তুলিতে আঁকা ছবি। কোনো ছবি আকাশের, আবার কোনো ছবি পাহাড় কিংবা সমুদ্রের। চলতে ফিরতে ছবিগুলোর দিকে তাকালেই মন বিমূর্ত হয়ে যায়। একবার এক সন্ধ্যায় শাওন দাঁড়িয়ে সমুদ্রের ছবি দেখতেছিল। দেখতে দেখতে এতই আনমনা হয়ে গিয়েছিল যে, পেছন থেকে একজন তরুণী এসে তাকে গালে চুমু দিয়ে যায়, অথচ সে খেয়ালই করেনি কী ঘটনা ঘটে গেছে। এই স্মৃতি মনে হলে এখনো শাওন নিজেই নিজেকে পাগল ভাবে। আধ ঘণ্টা হাঁটাহাঁটির পর রানুর বাসায় না গিয়ে ফিরে এলো নিজের বাসায়। বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে রঙ চা বানিয়ে এককাপ চা খেতে খেতে কানে এয়ার ফোন লাগিয়ে জীবনানন্দ দাশের কবিতা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে গেলো।
চার.
আজকের সন্ধ্যাটা অন্যরকম। আয়নায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ নিজেকে দেখছে রানু। কেমন যেন ধূসর, বিবর্ণ হয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে। মনে হয় ভয়ানক দুঃস্বপ্ন আসছে। আয়নার সামনে থেকে নিজেকে সরিয়ে বেলকনিতে চলে আসে। বাইরে আকাশ নীল। ওড়না দিয়ে মুখটা মুছল রানু। কয়েকটি সাদা বক উড়ে যাচ্ছে। নিজেকে সামলিয়ে বলছে—‘আরে না, কী এসব আবল-তাবল ভাবছি। হয়তো আমি একা কিন্তু তাতে কী? পৃথিবীর হাজারও নারী একা একা পথ চলছে। সব প্রতিকূল মাড়িয়ে সামলে নিচ্ছে সবকিছু। হয়তে আমিও একাই চলবো। ’
হঠাৎ শাওনের কথা মনে পড়ে যায়। কিন্তু ওকে ফোন আর দেওয়া আর হলো না। দম বন্ধ হয়ে আসছে। মনকে শক্ত করে নেয় রানু। বাইরে তখন বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টির শীতল পরশ এসে গায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যা পেরিয়ে অন্ধকার তখন। রানু কিচেন রুমে এসে গ্রিন টি বানিয়ে কাপে ভরে ড্রয়িংরুমে গিয়ে টিভিটা অন করে। বাইরে তখন ঝরঝর বৃষ্টি ঝরে চলেছে।