তিনটি ট্রাভেল কোম্পানির টিকেট কাউন্টার এখানে—একসাথে। ডলফিন-ঈগল-হানিফ। রুট ঢাকা-চট্টগ্রাম বা কাপ্তাই বা রাঙামাটি বা বান্দরবান। রাত দশটা থেকে এগারটা পর্যন্ত একের পর এক ছাড়বে নাইট কোচগুলো। দুটো মাত্র বাস ঝিমুচ্ছে অফিস লাগোয়া একফালি গ্রিলঘেরা স্কয়ারে। বাকি সবকটা আছে রাস্তায়। ঢাকায় এসে এখনো পৌঁছায়নি। কর্মীরা ঘন ঘন যোগাযোগ করছে মোবাইল ফোনে। অপেক্ষমাণ যাত্রীরা হতাশ, বিরক্ত। কোনোটা মাত্র কুমিল্লা। কোনো কোনোটা জ্যামে আটকা পড়ে আছে কাচপুর বা সায়েদাবাদ। ‘এই আর পাঁচ মিনিট’—শুনতে শুনতে যাত্রীরা অধৈর্য। বারবার ঘড়ি দেখে। খামাখাই রাস্তায় তাকায়।
ওয়েটিং রুমটি মাঝারি সাইজের। অফটাইমে এটাকেই অনেক বড় মনে হয়। পনের বিশটি প্লাস্টিক চেয়ার এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। লাল গোলাপি আর সাদা। এক এক রঙের চেয়ার এক এক কোম্পানীর। এখন রুমটা ভরে উঠেছে বাসযাত্রী আর অনেককে সি-অফ করতে আসা লোকজনে। রাতের শহর। মোটেও নিরাপদ নয়। প্রত্যেকের সঙ্গেই কিছু-না-কিছু লাগেজ। ঘর গিজগিজ করছে লাগেজে। স্তূপ হয়ে উঠেছে উঠেছে এখানে ওখানে। যার যার লাগেজের কাছে চেয়ার নিয়ে বসেছে যাত্রীরা। বেশিরভাগই দাঁড়িয়ে। চেয়ার পাওয়া যায়নি। চেয়ারপ্রাপ্ত লোকজনের অনেকের মুখেই আয়েশী ভাব। বিরাট ভাগ্যবান মনে হচ্ছে নিজেদের। গাড়ি কখন আসে বলা যায় না। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা! চেয়ারের দখল ছাড়া যাবে না। মহিলাদের কারো কারো বাথরুম প্রয়োজন হচ্ছে। চেয়ারে ব্যাগ অথবা ছোটখাট একটা কিছু বসিয়ে যাচ্ছে। নিদেনপক্ষে রুমাল। পুরুষদেরও ওঠার প্রয়োজন হচ্ছে। বাথরুম, সিগ্রেট কেনা, কাউন্টারে খোঁজ নেয়া—এসবের জন্য।
এরই মধ্যে ঝগড়া লেগে গেল। একজন তার পানির বোতল বসিয়ে টয়লেটে গেলেন। ইতোমধ্যে উপজাতি দুই যুবক এলো। বিরাট সংসার তাদের সাথে। দুটো বড় বাক্স, লেপতোশকের বোচকা, বইপত্রের ব্যাগ, বস্তায় হাঁড়িকুড়ি-থালাবাটি। একটি স্টোভ, একটি মোড়া বস্তার গলায় বাঁধা। একজন খালি চেয়ার মনে করে ধাম করে বসে পড়েছে বোতলের ওপর। প্লাস্টিকের বোতল। চাপ সইতে পারেনি। ফেটে গেছে। আসনলোভী যুবকের বিব্রতকর অবস্থা। প্যান্টের এমন সেনসিটিভ অংশ ভেজা! বোতলের মালিক-ভদ্রলোক টয়লেট থেকে বের হয়ে এসে একসাথে চেয়ার দখল এবং বোতলের অবস্থা দেখে রেগে আগুন। পনের টাকা দিয়ে কেনা একবোতল পানি! মাগনা তো নয়! এত বড় বোতল—দেখতে পায় না! অন্ধ নাকি?
টাকা দিতে না পারলে তালাক হবে। মেয়েটি কি দরিদ্র পিতার অপারগতা আর তার ফলে তার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে কাতর হয়ে কাঁদছে।
যুবকেরা নিজেদের ভাষায় নিজেদের মধ্যে কথা বলে। বাংলায় চলে বোতল ভাঙার ঝগড়া। চেয়ার তো যাত্রীদের সম্পত্তি নয়! উঠে গেলেও দখল রেখে যেতে হবে! বোতলটা খেয়াল করা হয়নি—তাই। নইলে বোতল সরিয়ে যুবকের বসাটাও অযৌক্তিক কিছু নয়। তুমুল ঝগড়া হয়। কাউন্টার থেকে উঠে আসে একজন। আপাতত চেয়ার খালি নেই। যুবকদের বস্তার গলায় বাঁধা মোড়া আছে একটা। ওটা খুলে একজন বসতে পারে। কাছাকাছি আর এক চেয়ারে আসীন এক প্রৌঢ়ের কৌতূহল বাড়ে। মোড়াটোড়া নিয়ে যাচ্ছে কেন? দেখে মনে হচ্ছে বাসা বদল! যুবকেরা জানায় বিশ্ববিদ্যালয় হলের ছাত্র তারা। শামসুন নাহার হলে পুলিশী হামলার জের-এ আপাতত ইউনির্ভাসিটি বন্ধ। সব হলেই এই সুবাদে বহিরাগতদের হল থেকে বহিষ্কার পর্ব চলছে। সেই অভিযানে পাহাড়ী যুবকদ্বয় উচ্ছেদ হয়েছে। ওরা লিগাল ছাত্র। হলে থাকার অনুমোদন আছে। তবুও তারা তা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। পাহাড়ী যুবকদ্বয় বোতলওয়ালাকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়—চেয়ারটিকে খালি ভেবেছিল তারা।
যাই হোক, বোতল ফাটানোর শাস্তি পেয়েছে যুবক। ভেজা প্যান্ট। মনে হচ্ছে পেশাব করে দিয়েছে। মালিক বেশ শান্তি পায় মনে। বুঝুক ঠেলা। থাকতে হবে ভেজা পাছায়। ব্যাটার বসার সাধ মিটে গেছে। যুবকটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিম্নাঙ্গের সামনে-পেছনের ভেজা দিকটা বারবার দেখে। কী করবে বুঝতে পারে না। বোতল মালিক পা দিয়ে চেয়ারটিকে দুটো ধাক্কা দিয়ে আর এক অবস্থানে গিয়ে বসে।
বৃষ্টি নেমেছে। বাইরে দাঁড়ানো লোকজন ভিতরে চলে এসেছে। এক ছেলে এক মেয়ে ও স্বামী-স্ত্রীসহ একটি পরিবার ঢুকলো। ভদ্রলোক চেয়ার খুঁজছেন। অন্ততঃপক্ষে স্ত্রীকে বসানো দরকার। এত লোকের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা—অস্বস্তিকর ব্যাপার। একজনকে অনুরোধ করলেন—ভাই মহিলা আছে, একটু উঠবেন? আসনধারী ভদ্রমহিলাকে দেখলেন। কুঞ্চিত ভ্রু। অনুনয় বিনয়ের চিহ্ন নেই ওতে।
আসনধারী টলে না। পা নাচাতে নাচাতে বলে—কেন, উঠব কেন?
—এটা কি বাস না ট্রেন যে মহিলা দাঁড়িয়ে যেতে পারবেন না! আপনারা চেয়ার পেলে কি আমার জন্য ছেড়ে দিতেন? হুঃ সম অধিকারের বেলায় নারী-পুরুষ সমান বলা হয়। আবার সুবিধার বেলায় সুযোগ পেলেই মহিলা? অবলা?
ভদ্র মহিলা স্বামীর উপর বিরক্ত। কী দরকার ছিল—এত কথা শুনবার?
স্ত্রীর বিরক্তিটুকু হজম করেন ভদ্রলোক—আসনধারীকে উদ্দেশ্য করে বলেন—লাগবে না ভাই। আপনি বসে থাকেন। যতক্ষণ খুশি।
হানিফ বান্দর চৌদ্দ বাইশ। হানিফ বান্দরবন চৌদ্দ বাইশের প্যাসেঞ্জার কে-কে আছেন… আসনধারী তড়াক করে লাফিয়ে ওঠেন। ব্যাগ ব্যাগেজ নিয়ে বের হয়ে যেতে যেতে মহিলাকে বলেন—ন্যান, এখন বসেন।
—স্বামী ভদ্রলোক সুযোগ ছাড়েন না। বলেন,
—কেন, চেয়ার ছাড়ছেন যে বড়? বসে থাকেন! আপনার দখল করা চেয়ার। আপনার সম্পত্তি!
বান্দরবানের আর উত্তর দেবার সময় নেই।
বান্দরবানের বাসের জন্য অপেক্ষমাণ যাত্রী ক’জন চলে গেলেও কোন চেয়ার আর খালি হয় না—ঐ একটি ছাড়া।
এবার স্বামী ভদ্রলোকটি লাল রঙের চেয়ারটিকে সুবিধামত জায়গায় এনে স্ত্রীকে বসতে বলেন।
কিন্তু তার স্ত্রীর বসার কোন লক্ষণ নেই। সে তাকিয়ে আছে কোণের দিকে জড়সড় দাঁড়ানো, এক দেড় বছরের শিশু-কোলে একজন তরুণীর দিকে, বাচ্চাটি ঘুমিয়ে। দরিদ্র তরুণী। মলিন শাড়ি। ব্লাউজের হাতা ছেঁড়া। বাহুতে তাবিজের ঝোলা। নাকে রুপার নাকফুল। শ্যামল মুখে ফুলটি একটি অন্যরকম মায়া ছড়িয়ে রেখেছে।
স্ত্রী স্বামীকে বললেন—চেয়ারের জায়গায় চেয়ার থাকুক। ঐ দেখ, ঘুমন্ত বাচ্চা কোলে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। ওর একটু বসা দরকার।
—মূর্খ! তুমি না বসলে মনে করেছ এ চেয়ার খালি থাকবে? বা ঐ মেয়ে এখানে এসে বসবে? তার আগেই অন্য কেউ দখল করে নেবে না?
—দখল করুক। ঘড়ি দেখে স্ত্রী। আর পাঁচ দশ মিনিট পরে তো সবারই অন্ততঃপক্ষে নয় দশ ঘণ্টা বাসে বসে থাকতে হবে। এখনকার পাঁচমিনিট না বসলেই বা কী ক্ষতি, আর বসলেই বা কী এমন লাভ?
স্বামী ভদ্রলোক চুপসে যান। কথা ঠিক। কিন্তু যার জন্য করলাম চুরি সে-ই বলে চোর! এত লোকের মধ্যে বউ এর কাছে প্রেসটিজ পাংচার!
মেয়েটি বাপের প্রেসটিজ ইস্যু বোঝে। সে মাকে বলে,
—তুমি আপাতত বস। আমি ঐ মহিলাকে বলে আসি। নইলে অন্য কেউ দখল করে নেবে। আব্বু ঠিকই বলেছে।
মেয়ে যায় শিশু-কোলে তরুণীর কাছে।
কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়া নারী চেয়ারটিকে একটু সরিয়ে নিয়ে বসে। হাতের পলি ব্যাগের পোটলাটা পায়ের কাছে রাখে। ঘুমন্ত সন্তানকে আর একটু আরাম দিতে কাঁধের উপর মাথাটা ঠিকঠাক করে বসায়। দূর থেকেই দাঁড়িয়ে থাকা মা-মেয়ের জন্য কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি পাঠায়।
কাছাকাছি বসে থাকা দুজন যুবকের মনে দোলা লাগে। তারা সাদা দুটি চেয়ার ছেড়ে দেয়। মা-মেয়েকে বলে, বসেন আপনারা। আমাদের গাড়ি এসেছে। আপনারা কোথায় যাবেন—রাঙামাটি?
উঁহু। কাপ্তাই।
উত্তর দেয় মা। যুবক মেয়ের দিকে চোখ রেখে বলে—
ও, এগারটার বাস? মিনিমাম সাড়ে এগারটা বাজবে। আজ বাস লেট।
মহিলা ঘড়ি দেখে।
সাদা চেয়ার দুটো মা ও মেয়েকে কোলে নেয়।
বাথরুমের কোণের দিকে আর একটা চেয়ার খালি হয়। মেয়ে তার ভাইকে ডাকে।
—ভাইয়া, ঐ যে একটা খালি। বসবে?
ভাই নাক সিটকায়।
—বাথরুমের গন্ধ খাব? তুই বস গিয়ে।
—এখানে জায়গা আছে। চেয়ারটা নিয়ে আস।
—হুঁ! পাঁচমিনিটের মামলা। এখন আমি চেয়ার টানাটানি করি!
একজন গ্রাম্য বৃদ্ধ সে চেয়ারটা পান। তিনি কতক্ষণ পিঠ না লাগিয়ে কুঁজো ভঙ্গিতে বসেন। চারদিকে তাকান। তারপর কুণ্ঠিত ভঙ্গি ধীরে ধীরে সহজ করে পিঠ ছেড়ে দেন চেয়ার-ব্যাকে। পাঞ্জাবির পকেট থেকে পানের কৌটা বের করেন। খিলি মুখে দেন। আঙুলের ডগায় চুন। জিভে মাখিয়ে আঙুলের বাকি চুন চেয়ারের হাতলে মুছে নেন। চারদিকে চোখ বুলান। পাশের একজনকে বলেন—কয়ডা বাজে? রাঙামাটির বাস কখন ছাড়ব?
চট্টগ্রামের বাস ছেড়ে দিলে বিশ বাইশ বছরের এক যুবক আসে। সে লাল চেয়ারগুলো একপাশে একের পর এক স্তূপ করে রাখে। ঈগলের চেয়ার। ঈগলের লাস্ট বাস আজকের মত ছেড়ে গেছে। লাল চেয়ারের দায়িত্ব শেষ। তিনটি লাল চেয়ারে এখনো তিনজন বসা। যুবকটি তাদের কাছে ঘাড় ধরে তিনটি সাদা চেয়ার টেনে নেয়।
—এটাতে বসেন। লাল দেন। ডিউটি শেষ করি।
বসে থাকা কাপ্তাইয়ের মেয়ে মজা পায়। মাকে বোঝায়—চেয়ারগুলো ভিন্ন ভিন্ন রঙের হওয়ার মধ্যে যে একটা হিসাব আছে! শেষ লালটিতে শিশু-কোলে তরুণী মা। ছেলেটি সাদা চেয়ার কাছে নিয়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কপালের দুই পাশের শিরা টিপে ধরে ফুলে ফুলে নিঃশব্দে কাঁদছে মেয়েটি। দুই গাল ভেসে যাচ্ছে চোখের পানিতে। আঁচলের কোণ টেনে টেনে চোখ মোছে। আবার গাল ভেসে যায়। নাক দিয়ে বের হয়ে আসা আঠালো পানি বুড়ো আঙুলের তর্জনীতে টিপে বের করে এনে চেয়ারের হাতলে মোছে।
ছেলেটি বিব্রত ভঙ্গিতে সাদা চেয়ারটি সামনে রেখে কিছু না বলেই চলে যায়।
সাদা প্লাস্টিক চেয়ারও হতভম্ব হয়ে বসে থাকে।
কাতর হয়ে ওঠে সাদা।
আহা, এমন করে কাঁদছে কেন মেয়েটি?
লাল, লাল কি টের পাচ্ছে না?
ফুলে ফুলে কাঁদছে মেয়েটি। প্রচণ্ড আবেগে, দুঃখে শরীর কেঁপে উঠছে।
লাল কি টের পাচ্ছে শরীরের এই কম্পন? লাল কি বুঝতে পারছে?
হ্যাঁ, লালও টের পাচ্ছে। মেয়েটি তার অশ্রু আর সিকনি ভেজা হাত তো বারবার লালের হাতেই মুছছে!
মেয়েটির শরীরের উষ্ণতা, ময়লা পুরোনো কাপড়ের চিমসে গন্ধ, কাঁধের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে-পড়া শিশুটির নিশ্চিন্ত নিঃশ্বাসের ছন্দ, মুখ থেকে গড়িয়ে পড়া টলটলে লালার ফোঁটা—সব লাল টের পায়।
লালও কাতর হয়ে ওঠে।
মেয়েটি কাঁদছে কেন এমন করে?
মেয়েটির কান্নায় ফুলে ফুলে ওঠা শরীরটি লাল ভাল করে দেখে।
সে শুধু মেয়েটির ঘোমটা-ঢাকা খোঁপা-উঁচু-হয়ে-ওঠা মাথার পিছন দিক, শিশুটির মাথার একাংশ, মেয়েটির গোড়ালি-ফাটা কালো দুটো পায়ের পাতা, ময়লা নখ, শাড়ির ঝুলন্ত পাড় থেকে বের-হয়ে-আসা সুতো—এসব দেখতে পায়।
আন্দাজ করা যায়—মেয়েটির আপনজন কেউ মারা গেছে। খবর পেয়ে সেখানে যাচ্ছে। শোকে এমন আকুল হয়ে কাঁদছে সে।
কে মারা যেতে পারে! বাবা-মা? স্বামীও হতে পারে! ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজন, কি আর একটি সন্তানও হতে পারে!
সাদা মেয়েটির পুরো অবয়ব দেখে। হতদরিদ্র নিঃস্ব চেহারা। তবু তরুণী মুখে লাবণ্য আছে। বাচ্চাটির চেহারা দেখা যাচ্ছে না। কারা সাথে যাচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না। পায়ের কাছে ছোট একটি পলিথিন ব্যাগ।
মেয়েটি কি সর্বস্ব খুইয়েছে?
টাকা পয়সা যা ছিল, দুর্বৃত্তরা কেড়ে নিয়েছে? ও কি ধর্ষিত হয়েছে? হাতের নখ খয়াটে। তেল হলুদের দাগ। নখের ভেতর ময়লা। বাসাবাড়িতে কাজ করে মেয়েটি? বাড়ির কর্তা, যোয়ান ছেলে অথবা বস্তিতে ফেরার পথে বখাট যুবক—এরা কেউ কি মেয়েটিকে লাঞ্ছিত করেছে? হতে পারে। সে কারণে হয়তো স্বামী তাকে ত্যাগ করেছে। অথবা যৌতুক চেয়ে বিদেশে যাওয়া কিংবা ব্যবসার নাম করে মোটা অংকের টাকা চেয়েছে। টাকা দিতে না পারলে তালাক হবে। মেয়েটি কি দরিদ্র পিতার অপারগতা আর তার ফলে তার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে কাতর হয়ে কাঁদছে।
তিনটি স্তূপ থেকে প্লাস্টিকের চেয়ার ক’টি টিউব লাইটের আলোয় ভেসে-যাওয়া খালি-হয়ে-যাওয়া ওয়েটিং রুমটিতে পরস্পরের দিকে চেয়ে থাকে।
অপেক্ষমাণ যাত্রীদের অনেকেরই চোখ পড়েছে ক্রন্দনরতা মেয়েটির দিকে। সবাই তাকিয়ে থাকে। তাদের হাত পা চোখ সব প্লাস্টিকের তৈরি মনে হয়। শক্ত। প্রাণহীন।
বসে থাকা মা আর মেয়ে নড়ে।
মেয়েকে মা বলে—কী মনে হচ্ছে বল তো? ও এত কাঁদছে কেন?
—আমি কী করে জানব? আমি কি ওর সঙ্গের কেউ নাকি? আমি তো তোমার সঙ্গেই আছি।
ভেঙে পড়েছে ক্রন্দনরতা। ঘুমন্ত শিশুর পিঠে হাত রেখে অঝোরে কাঁদে।
কী করে চেপে রাখছে শব্দ? নিঃশব্দ কান্নার শব্দই যেন তীব্র হয়ে ওঠে।
সাদা থেকে মা উঠে আসে। মেয়েটির মাথায় আলতো হাত—
—কী হয়েছে আপনার? কাঁদছেন কেন?
চোখ খোলে মেয়েটি। উত্তর দেয় না। সান্ত্বনার হস্তস্পর্শ পেয়ে আরো কাতর হয়। শব্দ চাপতে পারে না। হু-হু করে ভেঙে পড়ে।
—কোথায় যাবেন? কাপ্তাই?
মেয়েটি দুদিকে মাথা নাড়ায়। ক্রন্দন থামে না।
—রাঙামাটি?
উপরে নিচে মাথা নাড়ে। ক্রন্দন থামে না।
—তাহলে কাঁদছেন কেন? কেউ অসুস্থ? বাবা-মা?
ডানে বাঁয়ে মাথা নড়ে। ক্রন্দন থামে না।
—অন্য আপনজন কেউ মারা গেছেন?
দুদিকে মাথা নড়ে। ক্রন্দন থেমে নেই।
হানিফ। ষোল পঁচানব্বই। রাঙামাটি। রাঙামাটি-হানিফ-ষোল পঁচানব্বই…
বাথরুমের কোণের চেয়ারটি পান-মুখে-বৃদ্ধ উঠে আসেন।
মেয়েটির কাঁধে হাত রাখেন—ল মোহসেনা। গাড়ি আইছে। ওঠ।
দাঁড়িয়ে থাকা মহিলা বৃদ্ধকে দেখে। বৃদ্ধকে মনে করে নেয় মেয়েটির পিতা।
—কী হয়েছে আপনার মেয়ের? কাঁদছে কেন এত? কিছুই তো বলছে না।
বৃদ্ধ পলিথিন ব্যাগ হাতে নিতে নিতে উদাস স্বরে বলেন,
—আমার ভাস্তি। কপাল ভাঙছে। মাইয়া অইছে তাই জামাই ভাতকাপড় দেয় না। সতীনের ঘর। আগের ঘরেও তিন মাইয়া। তাই হেই বউ থুইয়া জামাই আবার বিয়া করল। অহন এই বউও মাইয়া জন্ম দিছে। অপরাধ। তাই জামাই এরে দেহে না। বাসাবাড়িতে কাম করতে চায়—বাচ্চাসহ কেউ রাহে না। বাড়িতে লইয়া যাইতাছি। বাপ নাই। অর মার কাছে বাচ্চা থুইয়া আসব। এই বাচ্চার জন্য কান্দে মা, বাচ্চাও তো একটা মাইয়া—তার জন্য কাইন্দা লাভ আছে? হের কান্দা কানব হে নিজে।
চলে যায় ওরা।
দুই-তিন মিনিট পর কাপ্তাইয়ের বাসও আসে। সাদা থেকে মা আর মেয়ে উঠে দাঁড়ায়। ওরা ক্রন্দসী তরুণীর ছেড়ে যাওয়া লাল চেয়ারটির দিকে এক পলক তাকিয়ে দুজন দুজনের দিকে তাকায়। বাকি দুজন—বাবা আর ছেলে—এসে তাড়া দেয়, কী ব্যাপার? দুজনে কী দেখছ? বাস এসে গেছে, চল তাড়াতাড়ি!
সবাই বাসে উঠে গেলে ঘর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা খালি চেয়ারগুলো পরস্পরের দিকে তাকায়—শেষমেষ মা আর মেয়ে ওভাবে পরস্পরের দিকে তাকিয়েছিল কেন?
সাদা আর গোলাপি চেয়ারের তদারকদার চলে আসে।
পটাপট ওগুলো একজন আর একজনের কোলে বসতে বসতে উঁচু হয়ে ওঠে।
শেষ লালটি লাল স্তূপে সর্বোচ্চ স্থানটি পায়। তার এক হাতলে তখনও ক্রন্দসী মেয়েটির অশ্রু আর সিকনি লেগে আছে।
গোলাপি স্তূপের মাঝামাঝি পড়েছে বৃদ্ধের পান খাওয়া আঙুলের মুছে রাখা লালচে-চুন-মাখা চেয়ার।
মা আর মেয়ের সাদা দুটো—একটার কোলে আর একটা।
তিনটি স্তূপ থেকে প্লাস্টিকের চেয়ার ক’টি টিউব লাইটের আলোয় ভেসে-যাওয়া খালি-হয়ে-যাওয়া ওয়েটিং রুমটিতে পরস্পরের দিকে চেয়ে থাকে।