অন্যা জানে অনেক আগেই শাহেদ ফেসবুকে ওকে ব্লক করে দিয়েছে। তবু কোনসূত্রে ছবিটা তার সামনে চলে আসে। হাস্যোজ্জ্বল করতালি-মুখর দর্শক-ভক্তের মাঝে বিদিতা ওর মুখে জন্মদিনের কেক তুলে দিচ্ছে, আজ কি পঞ্চান্ন হলো? তাই হবে। বিদিতাকে অন্যা আগে না দেখলেও ফেসবুকের ছবিতে চোখ রেখে নিশ্চিত হয়েছে, এই প্রাণবন্ত নারী বিদিতা ছাড়া আর কেউ নয়। সে ছবিটা টেনে বড় করে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে—কিসের লোভে শিকারি আকৃষ্ট হয়েছে এই রমণীর প্রতি! দেখতে সুন্দর, শরীরের বাঁধনও ভালো। অবশ্য কেবল শরীর নয়, বিদিতার যে-খ্যাতি আর অর্থ আছে, তার কিছুই তো অন্যার নেই। একতরফা শাহেদকে দোষ দিয়ে নিজের বিচ্যুতি ঢাকা যাবে না, একথা স্বীকার করতে আপত্তি নেই তার।
অন্যার কোচিং সেন্টারটা বেশ জমে উঠেছিল, ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা দু-শ ছাড়িয়ে যাওয়ায় দুজন সহকারীর বেতন, বাড়িভাড়া প্রভৃতি খরচ-খরচা বাদ দিয়ে মাসে ৬০-৬৫ হাজার টাকা থাকতো হাতে। ফলে তার আস্থা জন্মেছিল, এই প্রতিষ্ঠানটি ঠিকমতো চালিয়ে নিতে পারলে আদৃতাকে মানুষ করবার জন্য কারও অনুগ্রহপ্রার্থী হতে হবে না। অথচ মাঝখানের নয়-দশটা মাসের ঝঞ্ঝা-বাতাস তাকে কালো এক অতল গহ্বরে টেনে নিতে চাইলো। সেই গহ্বরের গ্রাস এখনো তাড়া করে যাচ্ছে তাকে। অন্যা আজ বুঝতে পারছে না—দোষটা ভাগ্যকে দেবে, না কি নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষী সিদ্ধান্তকে। উচ্চাকাঙ্ক্ষাও হয়তো নয়, জীবন-যাপনের গ্লানিকে খানিকটা লঘু করার, কিংবা যোগ্যতা অনুযায়ী নিজেকে উপযুক্ত ও নিরাপদ জায়গায় স্থাপন করবার চেষ্টা নিশ্চয় দোষের কিছু হতে পারে না। সাদী মাহমুদ বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্যার বিভাগে তিন ক্লাস ওপরে পড়তো। ইদানীং তার কবিতা নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে দেশের বিভিন্ন পত্রিকায়। সাদীর পরামর্শেই প্রতি শুক্রবারে সাহিত্যের আড্ডা চালু হয় শহরের সুকান্ত সড়কে অন্যার ‘এডুকেয়ার কোচিং অ্যাকাডেমিতে’। বিকেল বেলা কবিতা-গল্পপাঠের আয়োজনে ধীরে-ধীরে লোক সমাগম বাড়তে শুরু করে। অন্যাও নিজের একটা গল্প পড়েছে বিগত আসরে। ও টের পায়, লেখালেখি ও পৃষ্ঠপোষকতার সূত্রে শহরে তার পরিচিতি বাড়ছে, বাহবা দিচ্ছে অনেকে। মন্দ কী—কিছু-না-কিছু নিয়ে তো মানুষকে বাঁচতে হয়, ভুলে থাকতে হয় দিন-যাপনের বিবিধ কদর্যতা আর গ্লানি।
আড্ডার পঞ্চম সপ্তাহে সাদী এলো নতুন ভাবনা নিয়ে।
-অন্যা, শুনেছ কবি শাহেদ কবির আমাদের শহরে আসছেন এ-মাসের ১১ তারিখে।
-তো?
-তাকে নিয়ে আমার দুটো পরিকল্পনা আছে, এর মধ্যে একটা দীর্ঘমেয়াদি।
-কী রকম?
-প্রথমত ১২ তারিখ শুক্রবারের পাঠচক্রে তিনি হবেন আমাদের প্রধান অতিথি।
-বলো কী, সাদী ভাই, অত বড় কবি আমার এই গরিবখানায়!
-আরে কবিদের বিশেষ অদিখ্যেতা থাকে না। তাছাড়া শাহেদ ভাইকে আমি খুব ভালোমতো জানি, শাহবাগে বহু আড্ডা দিয়েছি। অত নিরহঙ্কার কবি আমি আর পাইনি।
-ঠিক আছে, সবকিছু সামলাতে হবে কিন্তু তোমাকেই। আর দ্বিতীয় মানে দীর্ঘমেয়াদি ভাবনাটা কী?
-সে-কথা উনি এলে, মানে এখান থেকে ঘুরে যাওয়ার পর বলবো।
সাদী যেমন বলেছিল, তার চেয়ে বিনয়ী লোকটা। আড্ডায় এমনভাবে মিশে গেলেন, বুঝতেই দিলেন না তিনি এদেশের খ্যাতিমান একজন সাহিত্যিক। ভরাট কণ্ঠে নিজের দুটি কবিতা আবৃত্তি করলেন, সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনলো। আড্ডা শেষে অনেকেই তার সঙ্গে ছবিটবি তুললো। তিনজন গুণগ্রাহী নব্যলেখক তাদের লেখা বই কবির হাতে তুলে দিতে পেরে ধন্য হলো। স্থানীয় এক এনজিওর মালিক রাতে প্রধান অতিথিসহ ২০-২২ জনকে আহারের জন্য নিয়ে গেলেন শহরের সবচেয়ে ভালো রেস্টুরেন্ট। খাবার টেবিলে কবির মুখোমুখি বসে অন্যার মনে হলো ৫৩-৫৪ বছর বয়সী লোকটা বেশ সুদর্শন, সবকিছুতে একটা আভিজাত্য আর পরিপাট্যের ছাপ।
বিদিতার নাম বছরখানেক আগে অন্যা প্রথম শুনেছিল শাহেদের মুখেই। পেইন্টিং কম্পিটিশানে বিদিতা খান নামক বাংলাদেশি এক নারী পর্তুগাল থেকে কী-একটা পুরস্কার এনেছে, তা নিয়ে শিল্পীপাড়ায় বেশ আলোচনা হচ্ছে। ভদ্রমহিলা ইউরোপে স্থায়ী হওয়ার সুযোগ পেয়েও নাকি দেশে থাকার প্রত্যয় জানিয়েছে—একেই বলে দেশপ্রেম, ইত্যাদি। বিদিতা-শাহেদের বিয়ের পর ওরা হানিমুনে ইটালি গিয়েছিল সে খবরও জানতে পারে অন্যা। তবে আজই প্রথম এই আলোচিত নারীর চেহারা দেখছে সে, যদিও সামনা-সামনি নয়, ফেসবুকে। গুগল ঘেঁটে জানা গেলো, বিদিতা নাকি আগে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে লিভ-টুগেদার করেছে; ইউরোপে, এমনকি দেশেও। প্রচলিত রীতিপ্রথায় তার অনাস্থা, ওর পেইন্টিংয়েও জরাজীর্ণ বিশ্বাস গুঁড়িয়ে দিয়ে নতুন সমাজ নির্মাণের প্রত্যয় ফুটে ওঠে। তাহলে বিয়েই-বা করতে গেলো কেন? থাকলেই হতো একসঙ্গে—তাতে সমাজকে চোখে আঙুল দিয়ে কিছু শিক্ষা দেওয়া যেতো। সম্ভবত শাহেদের যুক্তিতেই প্রচলিত বিয়ের পথে গেছে সে। কবি চায়নি নিজেকে বেশি বিতর্কিত করতে। সাদী বলছিল অন্যার বিষয়টি নাকি দু-একটি পত্রিকায় এসেছে এরই মধ্যে। কাজেই কবি বেশ সাবধান এখন। জনপ্রিয় হতে চাইলে, রাষ্ট্রীয় পুরস্কার-স্বীকৃতির প্রত্যাশী হলে সব কূলই রক্ষা করতে হয়।
এ-কথায় বাপের কলিজায় বোধহয় জ্বলুনি ধরে যায়, সে উত্তর দেয়, এখন তো বলে বেড়াতে পারবে সৎমা ঘরে জায়গা দেয়নি, ঠিক আছে ওই সুখ নিয়েই তুমি থাকো গে। মানুষের কাছে যা-খুশি বলে বেড়াও গে!
কবি ঢাকায় ফিরে যাওয়ার পরের সপ্তাহে সাহিত্য আড্ডার শেষে অন্যা সাদী মাহমুদকে বললো, এবার বলো, কবি শাহেদকে নিয়ে তোমার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাটা কী।
-তোমার বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে রেজাল্ট তো খুব ভালো ছিল।
-তাতে কী হলো?
-তুমি পিএইচডি করবে। আগে এমফিলে এডমিশান নাও, পরে পিএইচডিতে চলে যাবে।
-না, না আমি মেয়েটাকে নিয়ে, কোচিং সেন্টার সামলে ওসব আর পারবো না।
-পারবে। আমি আছি তোমার পাশে। প্রফেসর আজমল গনির সাথে আমি কথা বলেছি, তিনিই তোমার গাইড হবেন। তুমি গল্প লেখো জেনে গনি স্যার আরও আগ্রহ প্রকাশ করলেন।
-আমার আসলে নতুন কোনো চাওয়া নেই। জীবনটাকে একভাবে পার করতে পারলেই হয়। বলতে পারো কেবল মেয়েটার জন্যই বাঁচা।
-আচ্ছা, মেয়ের দিকে তাকিয়ে তো তোমার এই বাঁচাটাকে আর একটু সুন্দর, অর্থবহ আর সম্মানজনক করা যায়। তাতে কিন্তু আদৃতার সুন্দর জীবনের সম্ভাবনাও বেড়ে যায়—তুমি ব্যাপারটা এইভাবে দেখো। তুমি যখন মেয়েকে বিয়ে দেবে লোকে বলবে পাত্রীর মা পিএইচডি।
-তাতে কি তেমন কিছু এসে যায়—আচ্ছা তবু আমাকে দুটো দিন ভাবতে দাও।
-ভাবাভাবির কিছু নেই। তোমার গবেষণার বিষয়বস্তু শুনলে না?
-ও বাবা, সেটাও তুমি ঠিক করে রেখেছ?
-সেটাই তো আসল কথা, যার ইঙ্গিত আগেই দেওয়া ছিল—গবেষণার শিরোনাম: ‘শাহেদ কবিরের কাব্য: জীবনভাবনা ও শিল্পরূপ।’
-তাহলে পিএইচডির থিসিসটা বরং তুমিই লিখে দিও, আমার আর কিছু করতে হবে না।
-না, না, ঠাট্টা নয়, কলেজে চাকরি তোমারও হবে, আগে রেজিস্ট্রেশনটা করো।
সাদী মাহমুদ নাছোড়বান্দা, তাছাড়া অন্যার ভেতরেও যে একটা সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা ছিল না, এমন নয়। এমএ পরীক্ষায় পঞ্চম স্থান পেয়েছিল সে, অথচ এখন এক কোচিং স্কুলের পরিচালক মাত্র। সরকারি চাকরির বয়স পেরিয়েছে বেশ আগেই। কষ্ট করে পিএইচডিটা অর্জন করতে পারলে একটা কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক পদ একেবারে আকাশ-কুসুম থাকবে না। সাদীর এই পাগলামির জন্য মনে-মনে অন্যা তাকে ধন্যবাদ দেয়।
অনলাইনে অর্ডার দিয়ে অন্যা শাহেদ কবিরের কাব্যসমগ্রের দুটি খণ্ড এবং এর বাইরে নতুন প্রকাশিত তিনটি কাব্যগ্রন্থও সংগ্রহ করে ফেললো। কবিতাগুলো পড়ে তার সত্যি-সত্যিই বেশ আগ্রহ জন্মে গেলো। ভদ্রলোক যেমন প্রগতিবাদী, তেমনি নারীর প্রতি তার কবিতায় বিশেষ সম্মান ও সমীহ; মেয়েদের সমান অধিকারের কথাও তিনি বলতে চান। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হওয়ায় তার কবিতায় বিশ্বসাহিত্য পরিভ্রমণের ছাপ বেশ স্পষ্ট। সাদী মাহমুদকে অন্যা তাই বললো, ভাই, আমি শেষ পর্যন্ত ডিসিশানটা নিয়েই ফেললাম।
-কী?
-গবেষণাটা আমি করছি। তবে পরিকল্পনা সাজাতে গিয়ে মনে হলো সিনপসিস লেখার আগেই কবির একটা দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেওয়া দরকার। তার অনুমতি নিয়ে পুরোটা অডিও রেকর্ড রাখবো। পরে কাজে লাগবে।
-খুব ভালো কথা, আমি জানি তুমি সিরিয়াসলি করলে এটা খুব ভালো একটা কাজ হবে। আর শাহেদ ভাই এ-বছর যদি একুশে পদকটা পেয়ে যান তোমার গবেষণার গুরুত্ব অনেক বেড়ে যাবে। সাংবাদিকরা তোমার পেছনেও ছুটতে শুরু করবে। শাহেদ ভাই সরকারের নেক নজরে, শুনছি আগামী বছর তাকে সাহিত্য একাডেমির মহাপরিচালক পদে বসানো হবে।
-আচ্ছা, কাঁঠাল আগে পাকুক, তারপর গোঁফে তেল মাখা যাবে। তাছাড়া অতকিছুর পরোয়া অন্যা যে করে না, সেটা এতদিনে তোমার বোঝা উচিতৎ।
-শোনো, শাহেদ ভাই দু সপ্তাহের জন্য নেপাল গেছেন। তিনি ফিরলেই আমি সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেবো। ফেসবুকে আমার সাথে যোগাযোগ আছে। আমার মনে হয় তুমি আগামী মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঢাকা যাওয়ার একটা পরিকল্পনা করতে পারো।
অন্যা অ্যাপয়েন্টমেন্ট অনুযায়ী সকাল সাড়ে দশটায় পৌঁছে গেলো শাহেদ কবিরের মোহাম্মদপুরের বাসায়। তিনি ছাড়া সেখানে থাকে তার ভক্ত এক তরুণ কবি, তাকে শাহেদ কবিরের পিএস-ও বলা যায়।
শাহেদ জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা প্রথমে একটা কথা বলো তো—গবেষণার জন্য তুমি আমার কবিতা কেন বেছে নিলে?
-আমি নিজে কিছু গল্প লিখি। কবিতা যতখানি বুঝি, তাতে আমার মনে হয়েছে আপনার কবিতা সমসাময়িক অন্য কবিদের থেকে আলাদা। আপনার ভাষা আর জীবনবোধও আমাকে বিশেষ টানে। সাদী মাহমুদের ইনসিস্ট করবার বিষয়টি কৌশলগত কারণে চেপে যেতে হয়। অন্যা জানে সবকিছুতে অত সরল আর খোলামেলা হওয়ার ফল সবসময় ভালো হয় না। কারণ চারপাশটা আসলে অত সরল নয়।
-আমার কবিতা টানে, আর আমি? কবির ক্লিনশেভড ফরসা চেহারায় রহস্যময় মৃদু হাসি।
শাহেদের এই প্রশ্নে অন্যা মোটেও অপ্রস্তুত হয় না, কারণ এর আগেও কয়েকজন সাহিত্যিকের সঙ্গে আলাপের সুযোগ হয়েছে তার। কবির এই প্রশ্ন নিছক রসিকতা-ই তা সে জানে। এইটুকু রসবোধ না-থাকলে কবি কেন? এক নীরস পুরুষের সঙ্গে পাঁচ-পাঁচটি বছর থাকার কুৎসিত অভিজ্ঞতা আজও দুঃস্বপ্নের মতো তার চেতনায় আর অবচেতনে শেকড় গেঁড়ে আছে।
অন্যার যখন আইএ পরীক্ষার রেজাল্ট বেরুলো, তখন বাবা তাকে বিয়ে দিয়ে দেয় মাদ্রাসার এক শিক্ষকের সঙ্গে। বিয়ের আড়াই বছর পর ও যখন অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষা দেবে, তার ১৫ দিন আগে জন্মে কন্যা আদৃতা। যতই দিন যেতে থাকে স্বামী গফুর তরফদার পর্দা, শাস্ত্র, রীতিপ্রথা প্রভৃতি বিষয়ে কঠোর হতে থাকে। কালো বোরখা তো ছিলোই, সেই সঙ্গে হাতেপায়ে কালো মোজার নির্দেশ আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো পুরুষ সহপাঠীর সঙ্গে তার কথা বলা নিষিদ্ধ করে সে। এমনকি ক্যাম্পাসে সে তার পেছনে গোয়েন্দা পর্যন্ত লাগিয়ে রেখেছিল। অথচ এই লোকটাই বিয়ের আগে তাকে কথা দিয়েছিল তার পড়াশোনা, স্বাধীন-চিন্তা কোনোকিছুতে বাধা দেবে না। এর মধ্যে একটি পুত্র সন্তানের আকাঙ্ক্ষায় গফুর তরফদার অন্যাকে আবার গর্ভধারণের জন্য এক প্রকার জোরাজুরি করতে থাকে। অন্যা বুঝতে পারে গফুর যদি সফল হয়, তাহলে এই অন্ধকার বন্দিশালাটাকে চিরস্থায়ী করে ফেলতে পারবে। মুক্তিপ্রত্যাশী অন্যা বেড়ানোর কথা বলে চলে আসে বাপের বাড়ি। অনার্স পরীক্ষা শেষ হলে গফুর স্ত্রীকে নিতে এলে নিরুপায় বিক্ষুব্ধ অন্যা বাপকে বললো, আমার পক্ষে এই লোকের সাথে থাকা আর সম্ভব না।
মেয়ের মতিগতি অনেক দিন থেকেই সলেমান শেখের মোটেই ভালো লাগছিল না। এমন কথার জন্য সে যেন প্রস্তুতই ছিল। তাই সে দ্রুতই জবাব দিয়ে দেয়, ঠিক আছে, তুমি যা-খুশি করতে পারো, তবে তুমি কিংবা তোমার মেয়ে কারও কোনো-রকম দায়িত্ব আমি নিতে পারবো না। সবচেয়ে ভালো হয় ভবিষ্যতে তুমি যদি পিতা হিসেবে আমার পরিচয় না দাও। আসলে তোমার মতো মেয়েকে লেখাপড়া শেখানোটাই ছিল আমার চরম ভুল। কেন গফুরের সাথে আর যারা চাকরি করে তাদের বউয়েরা সংসার করছে না?
-আব্বা, আমি কারও সাথে তুলনা করতে চাই না। আপনি যেভাবে বললেন, আমি কখনো আপনার গলগ্রহ হতে আসবো না। আর আপনার মান-সম্মানের হানি ঘটে, এমন কোনো কাজও করবো না।
-মান-সম্মানের কি আর খুব বেশি কিছু বাকি থাকছে?
অন্যা কথা না বাড়িয়ে দুদিনের প্রস্তুতি নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় বাবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। বাবার কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় অন্তত একটি বাক্য না বলে পারেনি, আমার মা যদি বেঁচে থাকতো, তাহলে এভাবে আপনি পারতেন মেয়েকে ঘর থেকে বের করে দিতে?
এ-কথায় বাপের কলিজায় বোধহয় জ্বলুনি ধরে যায়, সে উত্তর দেয়, এখন তো বলে বেড়াতে পারবে সৎমা ঘরে জায়গা দেয়নি, ঠিক আছে ওই সুখ নিয়েই তুমি থাকো গে। মানুষের কাছে যা-খুশি বলে বেড়াও গে!
রিকশাওয়ালা তেল-চিটচিটে গামছায় ঘাম মুছতে-মুছতে এক ‘আজব এক মেয়েমানুষের’ হেঁটে চলার বিরল ভঙ্গিমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
অন্যা সেই মুহূর্তে মনস্থ করেছিল দরকার হয় মা-মেয়ে ট্রেনের নিচে মাথা দিয়ে মরবে তবু পিতৃগৃহের দরজায় এই জীবনে আসবে না কখনো। না, আত্মবিনাশের পথে যায়নি সে, বিশেষত নিষ্পাপ একটি শিশুর জীবনকে বিপন্ন করে তোলার মতো মতিভ্রম এখনো তার হয়নি। প্রতি মুহূর্তে নিজেকে প্রবোধ দিয়েছে এই বলে—জীবনটা তো সংগ্রামই, বিনা যুদ্ধে হার মানার কোনো অর্থ হয় না। একটা ছোট পরিবারের বাসায় এক কামরা সাবলেট নিয়ে শুরু হলো অন্যার নতুন জীবন। গলার সোনার চেইনটা বেচে প্রথম তিন মাস অন্নের জোগান হয়েছিল। একদিক দিয়ে ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলতে হয়—এরপর থেকে ব্যাচ ধরে ছাত্র পড়িয়ে দিব্যি মা-মেয়ের সংসার চলে যেতে থাকে। ব্যাচ পড়ানোর তৃতীয় মাসে তার মাথায় আসে কোচিং সেন্টার দাঁড় করানোর ভাবনা। তাতে ব্যস্ততা, শ্রম ও অর্থযোগ সবই বাড়তে থাকে।
গবেষণার কাজ করতে গিয়ে দু-মাস পর মনে হলো শাহেদ কবিরের কাছ থেকে আরও অনেক কথা জানার আছে। তাঁর শৈশব থেকে আজ পর্যন্ত ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে কবিতায় বিম্বিত জীবনদর্শনের সম্পর্কটিও আবিষ্কার করা দরকার, নইলে লেখাটি গভীরতা পাবে না। এবার আর সাদীকে প্রয়োজন হলো না, অন্যা নিজেই যোগাযোগ করে আবারও উপস্থিত হলো কবির বাড়িতে। এ-দফায় কথাবার্তা আরও ইনফরমাল, খোলামেলা।
-শাহেদ ভাই আপনার ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবন সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করতে পারি?
-কবিতার আলোচনায় সেটা কি খুব জরুরি?
-সে তো বটেই। আপনি নিজেও সেটা জানেন। রবীন্দ্রনাথ কিংবা নজরুলের কাব্য আলোচনায় আমরা কিন্তু তাঁদের জীবন ও সাহিত্য পাশাপাশি রেখে পাঠ করি, তাতে বুঝতে সুবিধে হয়, বিশ্লেষণটাও যথাযথ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
-তোমার যুক্তি মানছি। কিন্তু আমি তো আর তাদের মতো বড় কবি নই। যা-ই হোক, বলো তোমার প্রশ্ন।
-আপনার বাড়িতে নিজের পরিবারের কাউকে তো দেখি না।
-আমার একটি ছেলে, সে স্কলারশিপ নিয়ে কানাডায় কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গ্রাজুয়েশন করছে।
-ছেলের মা?
-তাঁর সাথে সম্পর্কচ্ছেদ হয়েছে এগারো বছর আগে।
-এই এগারো বছর এভাবেই চলছে? আর কোনো নারীর সাথে বিশেষ সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি?
-তেমন হলে লোকে জানতো। আমি তো এদেশেই আছি।
-আচ্ছা, আপনার দাম্পত্য জীবনের অভিজ্ঞতায় বেশ তিক্ততাও আছে বলে অনুমান করি, অথচ আপনার অনেক কবিতাই স্পষ্টভাবে নারীবাদী, সেটা কিভাবে সম্ভব হলো?
-কোনো একজন বা দুজন মানুষকে দিয়ে পুরো মানবজাতিকে মূল্যায়ন করা উচিত নয়। আমি বিষয়টাকে সামগ্রিকভাবে দেখার পক্ষপাতী। আমি তো বিশ্বাস করি মানবসভ্যতায় পুরুষের চেয়ে নারীর সেক্রিফাইস-ই বেশি। এই যে সন্তান-ধারণ, জন্মদান ও লালন-পালন—এই আত্মবিসর্জনের সাথে পুরুষের কোনো দায়িত্বেরই তুলনা হতে পারে না।
শাহেদ কবির এই কথা যখন বলছেন, তখন পশ্চিমের জানালা দিয়ে শেষ বিকেলের এক ফালি তেরসা রোদ এসে পড়ছিল তার মুখের একপাশে। তখন আলোকিত কবিকে দেখে অন্যার মনে হলো সে যেন কোনো মহাপুরুষের সামনে বসে আছে। কী-এক মুগ্ধতার আবেশ ভর করে তার মনজুড়ে।
এক মুহূর্ত বাদে প্রসঙ্গ পালটে, দু-মাস আগের একটি বিষয় তুলে বলে, আপনি না বলেছিলেন, আপনার কবিতা আমার ভালো লাগে, আর আপনাকে কেমন লাগে সেই প্রশ্নের উত্তর সেদিন কিন্তু দেইনি।
-আজ দিতে চাও?
-হ্যাঁ, আমার সমগ্র জীবনে দেখা আপনি অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরুষ মানুষ। অথচ অবাক লাগে আপনার মতো মানুষের সংসারটা স্থায়ী হলো না। অন্যার কণ্ঠে তখন সামান্য জড়তা, যা হয়তো কবির কানেও তা ধরা পড়ে।
তোমার দেখার মধ্যেও ভুল থাকতে পারে। তাছাড়া তুমি আমাকে দেখছ একজন কবি হিসেবে, ঘরের মানুষের কাছে সেটা কিন্তু গৌণ কিংবা কখনো-কখনো কোনো বিবেচ্য বিষয়ই হয় না। আচ্ছা তোমার সম্পর্কে আমাকে যদি কিছু বলো!
-আমিও একজন পোড়খাওয়া মানুষ। আট বছরের মেয়েকে নিয়ে আমার সংসার।
-তোমার স্বামী?
-ছেড়ে এসেছি বেশ আগেই।
-কেন। বনিবনা হয়নি?
-কোনো সুযোগ ছিল না, বিয়েটা হয়েছিল বাবার চাপে আমার আঠারো হওয়ার আগেই। লোকটার অবস্থান ছিল আমার ভাবনার সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে। অথচ তারই সন্তান আজ আমার একমাত্র দায় ও অবলম্বন। ব্যাপারটা রীতিমতো একটা পরিহাস। প্রকৃতি বোধ হয় এভাবে মানুষকে নিয়ে খেলতে পছন্দ করে।
-সাধারণ মানুষ দোষ দেয় ভাগ্যকে। তুমি শব্দটা বলছ প্রকৃতি। বাহ বেশ! তোমার জীবনদৃষ্টিও কিন্তু আমাকে টানছে বেশ। শুনেছি তুমি গল্প লেখো। তোমার একটা গল্প আমি পড়তে চাই।
সেই কথোপকথনের উপসংহারে এসে সিদ্ধান্ত হলো—শামীমা হোসেন অন্যাকে কবি শাহেদ কবির এখনই কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করবেন। আজ রাত থেকে অন্যার নতুন ঠিকানা হবে কবির এই ফ্ল্যাট। আগামী পরশু অন্যা গিয়ে মেয়েকে নিয়ে আসবে ঢাকায়। শাহেদ অন্যাকে কোনো স্কুল কিংবা পত্রিকা অফিসে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেবে, কাজেই কোচিং সেন্টারের আর প্রয়োজন নেই।
এরপর মাত্র নয়টি মাস—এই নয় মাসে অন্যার জীবনের শিক্ষা তিলে-তিলে পূর্ণতা পেয়েছে। সাহিত্যসূত্রে জানাশোনা। অথচ এক ছাদের নিচে যাওয়ার পর থেকে নিমেষেই যেন কবিতা, গল্প, গবেষণা-পিএইচডি এসব প্রসঙ্গ উধাও হয়ে যায়। সময়ের তলানিতে জমতে থাকে কেবল বিস্বাদ আর তিক্ততা। সে ঠিক করেছিল শাহেদ নামটি তাঁর জীবন থেকে চিরতরে মুছে ফেলবে। ও কোথায় আছে কার সঙ্গে কিভাবে, জীবিত না মৃত—কোনো বিষয়ে সামান্যতম কৌতূহল দেখাবে না কোনোদিন। অথচ কেন যে আবার ওর ছবিটা সামনে চলে এলো! একত্র বসবাসের প্রথম দু-তিন দিন সপ্তাহ বেশ ভালোই ছিল, তারপর থেকে ও অন্যার বিষয়ে নিস্পৃহ হয়ে যায়। অন্যার শরীরের দিকে বেশিদিন হয়তো মনোযোগ ধরে রাখতে পারেনি কবির। এক মাস না-যেতেই অন্যার মেয়ে আদৃতাকে এক মুহূর্তের জন্য সহ্য করতে পারত না সে। একদিন শাহেদের সঙ্গে অন্যার কী নিয়ে কথা কাটাকাটির মধ্যে আদৃতা বেডরুমে ঢুকে পড়ে বলে, মা খিদে লেগেছে, ভাত দাও। অন্যা জানে আদৃতা সহজে খিদেয় কাতর হওয়ার মতো মেয়ে নয়, সে আসলে ভাতের কথা বলে মাকে রক্ষা করতে এসেছিল। তখন শাহেদ ‘যাও এখান থেকে, সব সময় বড়দের মধ্যে আসবে না বলেছি’ বলে আদৃতার গালে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। সেদিন অবশ্য এই বিষয় নিয়ে অন্যা কোনো প্রতিবাদ করেনি।
কোচিং সেন্টার বন্ধ করে দেওয়ায় অন্যার হাতটা শূন্য হয়ে আসে। বিয়ের একমাস পেরিয়ে গেলেও শাহেদ প্রতিশ্রুত প্রসঙ্গে কোনো কথা বলে না দেখে অন্যাকেই বলতে হলো, আমার চাকরির বিষয়ে কী করলে?
-ঢাকা শহরে চাকরি কি অত সহজ, তোমার মতো বহু এমএ পাস এ শহরে রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।
-চাকরির কথাটা তো তুমিই বলেছিলে। ওখানে কোচিং সেন্টার থেকে আমার প্রতি মাসে ষাট-সত্তর হাজার আসতো। আমার নিজেরও তো একটা খরচ আছে!
-কোচিং থেকে সত্তর হাজার, ওই গ্রামে? গলাবাজি করার জায়গা পাও না? তুমি তো আমাকে বিয়ে করেছ তোমার আর তোমার মেয়ের অন্নবস্ত্র সংস্থানের জন্য। চিন্তা নেই, সে ব্যবস্থা আমি প্রতিমাসে করে দেবো।
-এখন প্রসঙ্গ এড়িয়ে বাজে কথা বলছ কেন? তখন তুমিই না বলেছিলে, তোমার অনেক পরিচিতি, অনেক প্রভাব—একটা চাকরি কোনো ব্যাপারই না!
-এবার বুঝেছি, তোমার লোভের মাত্রাটা আর বিস্তৃত আর সর্বগ্রাসী।
-চুপ করো শাহেদ, তুমি না এদেশের একজন নামকরা কবি, কবিতায় কত নীতি আর আদর্শের বাণী কপচাও—আর এই তার ব্যবহার। তোমার আগের বউটা কেন চলে গেছে তা বেশ বুঝতে পারছি।
-আচ্ছা এই কথা, মানছি আমি খুব খারাপ—তুই যদি ভালো হবি তো ভাতারের ঘর ছেড়ে এলি কেন?
শাহেদের রক্তিম চোখ আর অশ্রাব্য শব্দ-চয়নে এবার একেবারে হতভম্ব-বাকরুদ্ধ হয়ে যায় অন্যা। তর্ক করবার মতো শক্তি থাকে না শরীরে। হাত-পা হিম হয়ে আসে। এই মানুষটার প্রথম দেখা চেহারার সঙ্গে একবিন্দুও মেলে না আজকের রূপ।
রাজধানী-বাসের নবম মাসের মাথায় অন্যা নিজের শহরে ফিরে এসে সাদী মাহমুদের সহযোগিতায় আবারও কোচিং সেন্টারটা দাঁড় করানো চেষ্টা করল। শাহেদকে চূড়ান্তভাবে যখন ছেড়ে আসে, তখন ওরা দুজনই জানতো অন্যা তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এতবড় নারীবাদী কবি অথচ সে-বিষয়ে শাহেদ টু শব্দটি করে না দেখে অন্যার ভিতরটা চরম বিষিয়ে ওঠে, নিজের প্রতি ঘৃণা হয় ওই লোকটার শয্যাসঙ্গিনী হওয়ায়। মনে হয় ওর সামনেই যদি জরায়ুর ভেতরকার দলা মাংসপিণ্ডটা বমি করে উগরে দিয়ে আসতে পারতো, তাহলে খুব ভালো হতো। একথা ভাবতে-ভাবতে ব্যাঙাচির মতো লালচে একটি মানব-ভ্রূণকে অন্যা তড়পাতে দেখে মোজাইক করা মেঝের ওপর। মনে হয় শরীরটা যেন টলকাচ্ছে, নিজেকে সামলে নিতে বেসিনের কাছে গিয়ে চোখেমুখে পানির ঝাপটা দেয়।
ফিরে আসার পর সত্যিকার অর্থে সাদীই ছিল অন্যার একমাত্র সমব্যথী। ওকে সবকিছু ভেঙেচুরে বললে সে গভীর মনোযোগ দিয়ে অন্যার কথা শোনে। তার আঙুল স্পর্শ করে বলে, বাচ্চাটাকে তুমি মেরো না অন্যা। ওর পিতৃত্বের দায়িত্ব আমার, দরকার হয় আজই আমি তোমাকে বিয়ে করবো।
অন্যা খানিকক্ষণ সাদীর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। দৃষ্টিতে লোভ নয়, স্নেহই দেখতে পায় সে। এই কোমলতা দেখে তবু ভেতরটা কেন যেন তার আরও কঠিন হয়ে ওঠে। বুকের ভেতর বিক্ষোভবাষ্প ঘুরপাক খেতে থাকায় ভারী আর শুষ্ক কণ্ঠে বলে, দেখো সাদী ভাই, তোমার এই ন্যাকা উদারতা আমার একটুও সহ্য হচ্ছে না। প্লিজ থামো।
সাদী এ-কথার মানে কী বুঝলো কে জানে। এবার নিজের উষ্ণ দুহাতে সাদী অন্যার ডান হাতটা আলতো করে চেপে ধরে অনুনয়ের সুরে বললো, তোমার এই অবস্থার জন্য তো আমিও অনেকটা দায়ী। শাহেদ কবিরকে আমিই প্রথম ডেকেছিলাম তোমার ঘরে।
নিজের হাত মুক্ত করে নিয়ে অন্যা বলে, সেই প্রায়শ্চিত্ত করে মহৎ সাজতে চাও, না? তার কোনো দরকার নেই; শাহেদের সাথে পরিচয়টা তোমার সূত্রে হলেও সিদ্ধান্তটা কিন্তু আমি এককভাবেই নিয়েছিলাম।
-সে-সব কিছু আসল কথা নয়। এতদিনে তোমাকে একটা সত্যি কথা বলি। আমি বোধ হয় ভেতরে-ভেতরে তোমার অনুরক্ত ছিলাম অনেক আগে থেকেই।
-আমাকে আর হাসিও না, সে মুডে আমি নেই।
অন্যা তাকিয়ে দেখে কোচিং সেন্টারের সামনের রাস্তাটা বৈশাখের খরতাপে রীতিমত কাঁপতে শুরু করেছে। আর তার মাঝখানে একটা মানবভ্রূণ ভীষণ তড়পাচ্ছে। চোখ কচলে দেখে একটা নয় অজস্র ভ্রূণ সাঁতার কাটছে তপ্ত সড়কজুড়ে। তখন ভাবে, অহেতুক সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। পেটের ভেতরকার আপদটা ধুয়েমুছে আজই পবিত্র হতে হবে।
-প্লিজ, আমি তোমাকে ভালোবাসি অন্যা।
হঠাৎ অন্যমনস্ক অন্যার ধ্যান ভাঙে। সাদীর এ-কথায় তার মাথায় রক্ত আরও চড়ে যায়। ‘শাট আপ, জাস্ট শাট ইউর মাউথ!’ বলতে বলতে অন্যা সাদীর গালে একটা চড় কষে দেয়। আর কম্পিত কণ্ঠে বলে, তুমি আর কখনো আমার সামনে আসবে না।
পাশেই দাঁড়ানো মধ্যবয়সী একজন রিকশাওয়ালা দৃশ্যটা দেখে অপ্রস্তুত হয়ে যায়। কিন্তু অন্যা ঘাড় ঘুরিয়ে অনেকটা স্বাভাবিক গলায় বলে, ‘এই রিকশা যাবে?’
-কোথায় যাবেন আপা?
-সদর হাসপাতালের সামনে নিউ লাইফ ক্লিনিক।
-ওঠেন আপা।
রিকশা চলতে শুরু করলে বিশ্রি একটা গন্ধ এসে ধাক্কা মারে অন্যার নাকে। বুঝে নেয় এটা চালকের ঘামের গন্ধ। হঠাৎ মনে হয় শাহেদ ঘামলেও তো ঠিক এমনই গন্ধ হতো। আশ্চর্য—অথচ দুজন দুই প্রান্তের মানুষ, শাহেদ সব সময় পরিচ্ছন্ন পোশাকে থাকতো—সাদা তার প্রিয় রঙ! অন্যার গা গুলাতে থাকে। মনে হয় এখনই বমি করে পিচের তপ্ত কালো রাস্তা ভাসিয়ে দেবে। তখন তার নাকে আরও এক পুরুষ-শরীরের গন্ধ আঘাত করে। মস্তিষ্ক মনে করিয়ে দেয় গফুর তরফদারের শরীর থেকেও এদেরই কাছাকাছি, কিংবা আরও তীব্রতর ইঁদুরপচার মতো একটি দুর্গন্ধ আসতো।
যাত্রীর ‘ওয়াক্ ওয়াক্’ আওয়াজ শুনে রিকশাচালক ব্রেক কষে বলে, কী হয়েছে আপা?
নাকেমুখে টিস্যুপেপার চেপে অন্যা রিকশাচালকের হাতে কুড়ি টাকার একটা নোট তুলে দিতে দিতে বলে, আমাকে নামিয়ে দিন।
-হাসপাতাল তো আরও সামনে।
-জানি, বাকি পথ হেঁটে যাবো। বলে পা বাড়ায় অন্যা।
রিকশাওয়ালা তেল-চিটচিটে গামছায় ঘাম মুছতে-মুছতে এক ‘আজব এক মেয়েমানুষের’ হেঁটে চলার বিরল ভঙ্গিমার দিকে তাকিয়ে থাকে।