আটটি আঙুল পড়ে আছে শহরের পাশেই একটা ছোট ঝোঁপের ভেতর। ছড়ানো-ছিটানো আটটি আঙুল। কোনটা যে কোন হাতের, বোঝা যাচ্ছে না। একটা অনামিকার পাশে একটা তর্জনি শুয়ে আছে পরস্পরের দিকে মুখ করে, অনেকটাই ছুঁয়ে থাকা স্বামী-স্ত্রীর মতো। এক জায়গায় একটা মধ্যমাকে প্রায় নিঃসঙ্গভাবে পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে, অনেকটা ভোটে হেরে যাওয়া নেতার মতো। দু’হাত দূরে এক জায়গায় পাশাপাশি দুটা কনিষ্ঠা শুয়ে আছে অনেকটা যমজ বোনের মতো বা ভাইয়ের মতো বা ভাইবোনের মতো। কয়েক ইঞ্চি পর একটা অনামিকাকে দেখা যাচ্ছে দাঁড়িয়ে আছে, কোনো একটা ঘুঘুরার খালে সামান্য ঢুকে আছে, সুন্দরবনের শ্বাসমূলের মতো দেখাচ্ছে। আরও একটু দূরে একটা তর্জনীর পেটে মাথা দিয়ে একটা মধ্যামা শুয়ে আছে, যেন আয়েসি ভঙ্গিতে। এ আট আঙুলের মধ্যে কোনো বৃদ্ধাঙুল নেই। আঙুলগুলোর বয়স কত হতে পারে বলে মনে হয়?—এক পুলিশ কর্মকর্তা বললো বা বলার চেষ্টা করলো বা আন্দাজ করতে চাইলো নিজেই। একজন বললো, আঙুলগুলোর বয়স চৌদ্দ বা ষোলো হতে পারে। আশে-পাশে তারা লাশ খোঁজার চেষ্টা করলো।
কোনো এক লোক থানাকে ফোন করেছিল এ আঙুলগুলোর ব্যাপারে। সেই খবর পেয়েই তারা এসেছে। পুলিশের একজন জিজ্ঞাসা করলো, যিনি ফোন করেছিলেন, তিনি কি এখানে আছেন? একজন মাঝবয়সী লোক এসে দাঁড়ালো লোকজনের ভিড় থেকে বেরিয়ে। কোনো প্রশ্ন ছাড়াই লোকটা জানায়, আমাকে কোনো এক আট দশ বছরের শিশু বলেছিল, প্রথম এ আঙুলগুলোর কথা। কথাটা বলার পর সে ভিড়ের চারপাশে বাচ্চাটাকে তাকিয়ে খুঁজলো। সে জিজ্ঞাসা করলো, বাচ্চাটা আছে নাকি এখানে? শিশুটি ভিড় ঠেলে সামনে এসে বলে, আমি এই ঝোঁপের ওইপাশে ফাঁকা জায়গাতে খেলছিলাম একা একা। একটু পরে আমার মুতা চাপায়। আমি দৌড়ে এসে ঝোঁপের এদিকটাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুততে শুরু করার পর খেয়াল করি এবং ততক্ষণে দু’একটা আঙুলে কিছু কিছু মুতের ছিটাও পড়ে। যখন আমি দেখতে পেয়েছিলাম, তখন মুত থামানোর উপায় ছিল না কিন্তু আমি নুনুর মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেই। সবাই স্তব্ধ হয়ে তার কথা শুনছিল। তার বলা শেষ হলে সবার শ্বাস-প্রশ্বাস আবার স্বাভাবিক হতে শুরু করে। পুলিশ আটটি আঙুলের ছবি তুললো স্পটেই আর আঙুলগুলো তারা পলিথিনে ঢুকিয়ে থানার পথে চলে গেলো। দুটি বৃদ্ধাঙুলের একটি এক পুলিশের বুটের ফাঁকে আঁটকে গেছে, ব্যাপারটা কেউ দেখতে পাইনি। অন্য বুড়ো আঙুলটিকে আর কোনোদিনই খুঁজে পাওয়া যায়নি। ওটা মনে হয় অদৃশ্য হয়ে গেছে। ওটা মনে হয় সব মানুষের ভেতরে ঢুকে গেছে। বৃদ্ধাঙুলটা সবাইকে বৃদ্ধাঙুল দেখিয়ে সত্যি সত্যি যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে। আর এ আঙুলগুলো যে শরীরে ছিল, সে শরীরের অন্যান্য অংশও খুঁজে পায়নি পুলিশ।
এক.
ফুলছড়ি! কোথায় তুই, বাবু পায়খানা করেছে পরিষ্কার করে দে। ফুলছড়ি টয়লেটে ছিল। পেটটা তখনো ঠিকমতো হালকা হয়নি, কিন্তু বাবুর মায়ের ডাক শুনে তাড়াতাড়ি পানি খরচ করে বের হয়ে যায়—কী ভাবী? জবাবে ভাবীর কণ্ঠ ঝনঝন করে ওঠে—এই ছুঁড়ি, কোথায় ছিলি এতক্ষণ? কোনো রকমে ঢোক গিলে ফুলছড়ি বলে, পায়খানায়। বাবুর মায়ের আর কিছু বলার নেই কিন্তু রাগটা একটুও কমে না। রাগ করে বকার আর কিছু দেখতে না পেয়ে তার গলাটা দ্বিগুণ ভলিউমে জেঁকে ওঠে, বাবু পায়খানা করেছে পরিষ্কার কর। আমি বাইরে গেলাম ফিরতে দেরি হবে। সবকিছু ঠিকঠাক রাখবি। বাবুকে ঘুমিয়ে দিবি। বাবুর বাবা এলে খেতে দিবি। পটলের ভাজিটা কড়া করবি।
কাজে লেগে পড়ে ফুলছড়ি। ফুলছড়ি নামটা কেন রেখেছিল, সে জানে না কিন্তু এটা জানে, নামটা যে রেখেছিল সে একটা অপরাধ করেছে। এ নামের অধিকার তার নেই। সে মনে মনে তার অধিকারভুক্ত হতে পারে এমন নাম ঠিক করার চেষ্টা করে। সে তার নামের ছড়ি থেকে ফুল বিয়োগ করে দেয়। গু-মুতছড়ি, ঝাঁটাছড়ি, কাঁটাছড়ি, থালাছড়ি, দুর্ভাগিছড়ি, ছুঁড়িছড়ি—এভাবে সে অনেক ইতর শব্দের শেষে ছড়ি যোগ দিয়ে বিভিন্ন নাম মনে মনে দিতে থাকে নিজেকে।
দুই.
বাবুর বাবা এসে ডাকলো—ফুলছড়ি কোথায় রে?
ফুলছড়ি বাথরুম থেকে বের হয়ে আসে—এই তো ভাইয়া।
তোর ভাবী কই?
ভাবী বাইরে গেছে, বলেছে আপনাকে খেতে দিতে। আপনি বসুন টেবিলে।
ভেজা চুলে তোয়ালে জড়িয়ে ফুলছড়ি বাবুর বাবাকে খেতে দেয়। বাবুর বাবা ভাত খেতে বসে। বাবুর বাবা ভাত খায়। বাবুর বাবা ভাত খেতে থাকে। বাবুর বাবা ভাত খাচ্ছে। বাবুর বাবা ভাত খাওয়া শেষ করে না অনেকক্ষণ। বাবুর বাবা কি ভাত খাওয়া শেষ করবে না?
তিন.
ফুলছড়ির টেবিল চেয়ারে ভাত খাওয়া বারণ। বারণ করেছে বাবুর মা। ফুলছড়ি খেতে বসেছে মেঝেতে। যখন তার হাত, তার হাতের আঙুল ভাত মাখে তরকারি দিয়ে, তখন তার মনে পড়ে, হাতের আঙুলে বাবুর গু লেগে আছে, মাছের আঁশ লেগে আছে, থালার এঁটো লেগে আছে। যদিও সে সাবান দিয়ে ধুয়েছে, কিন্তু সাবান দিয়ে বাবুর গু লাগার অনুভূতি, মাছের আঁশের, থালার এঁটোর অনুভূতি যায় না। সে এসব ভাবতে ভাবতে আঙুল দিয়ে ভাত-তরকারি মাখাতে থাকে। বাবুর বাবা বললো, ফুলছড়ি আমি ভাত খাব।
ভাইয়া আপনি এখনই না ভাত খেলেন?
এখন তোর ভাত খাব।
একটা গ্রাস তুলে যখন ফুলছড়ি নিজের মুখে দিতে যাচ্ছিল, তখন বাবুর বাবা এসে ফুলছড়ির হাত ধরে ফুলছড়ির মুঠের ভাত নিজের মুখে ঢুকিয়ে নেয়। ফুলছড়ির হাতের তালুতে লেগে থাকা ভাত জিভের আঠাতে লাগিয়ে ভেতরে টেনে নেয়। আঙুল চুষে চুষে আঙুলের ভাত খেয়ে নেয়। আঙুলে আর কোনো ভাত লেগে নেই। আঙুল চুষে চুষে আঙুলের ভেতরের ভাত খেতে থাকে। ভাত শেষ হয়ে গেলেও অনেকক্ষণ ধরে ফুলছড়ির ভাত খেতে থাকে বাবুর বাবা। ভাত খাওয়া শেষ হলে বাবুর বাবা বলে, ফুলছড়ি তোর ভাত খেয়েছি, তোর ভাবীকে বলিস না যেন। বিস্মিত ফুলছড়ি হ্যাঁ বা না কিছুই বলে না।
এরপর থেকে বাবুর বাবা প্রতিদিন সকাল, বিকাল, দুপুর রাত যখন ইচ্ছে হয়, যখন বাবুর মা থাকে না, ফুলছড়ির ভাত খায়।
চার.
এটা আর একটা জঙ্গল। এ জায়গাটা ঘন জঙ্গল। এখানে একটা লাশ পচছে। দুর্গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে আছে। এখান থেকে দুর্গন্ধ বাতাসে ভেসে লোকালয়ে যেতে যেতে দুর্গন্ধ অগন্ধ হয়ে বিশুদ্ধ বাতাস হয়ে যাচ্ছে। লোকালয়ের মানুষ নির্গন্ধ বাতাস টেনে নিয়ে কাজ করে, স্নান সারে, ঘুমায় বা হেঁটে বেড়ায়। অথচ এখানে একটা লাশ পচছে। লাশের হাতে কোনো আঙুল নেই। লাশের শরীর শহরে কাকগুলো ঠোকর মারছে। সাদা সাদা পোকা ধরেছে। রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে শুকিয়ে গেছে। শেয়ালেরা একেক কামড়ে অনেকটুকু মাংস নিতে পারছে। বেলা বাড়ছে। লাশটার কিছু অংশ নেই হয়ে গেছে। বেলা বাড়ছে। উরুর একটা হাড় নিয়ে একটা শেয়াল চলে গেলো দূরে, ভাবটা এমন, তোদের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া নিয়ে হুড়োহুড়ি করতে পারব না, আমি ভদ্র শেয়াল। বেলা বাড়ছে, নিঃশেষ হচ্ছে লাশটা। লাশের দুর্গন্ধ লোকালয়ে যাওয়ার আগেই দুর্গন্ধ নির্গন্ধ হয়ে যাচ্ছে। লোকালয়ে মানুষ দাঁত ব্রাশ করছে, এয়ার ফ্রেশনার দিচ্ছে রুমে, অফিসে যাচ্ছে, সুগন্ধী সাবান মেখে গোসল করছে, সঙ্গম করছে, জন্ম নিচ্ছে। আর এখানে একটা লাশ পচছে, ধীরে ধীরে নাই হচ্ছে। বেলা বাড়তে বাড়তে বেলার বাড়া শেষ হয়েছে। বেলা ডুবছে। একটা হাত কাঁধ থেকে খুলে নিয়ে একটা কুকুর চলে গেলো অন্যদিকে, হাতটাতে আঙুল নাই। বেলা ডুবছে। পিঠের নিচের অনেক অংশ পোকারা হজম করতে পেরেছে। পোকারা খেয়াল করে, লাশের পেটের ভেতর আর একটা লাশ আছে। পোকাদের উৎসাহ বেশ বেড়ে গেলো ব্যাপারটা বুঝতে পেরে। বেলা ডুবছে। খুব বেশি বাকি নেই সূর্যটা ডুবতে। লোকালয় জানতেই পারলো না, একটা লাশ পড়ে থাকতে থাকতে নাই হয়ে গেলো।