খবরটা প্রায় উড়ে এলো গ্রামে। বাতাসের বেগে পৌঁছে গেলো কুলির জীর্ণ কুটিরের ভাঙা দরজায়। শব্দ তুলল জোর। খবরটা হেঁটে আসুক কিংবা উড়ে, তাতে তার গুরুত্বে হেরফের হলো না কোনো। বরং কুলির ভাঙা দরজায় সে সজোরে আছড়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সারা গ্রাম ভেঙে পড়ল এসে কুলির উঠোনে। গ্রামে এমন ঘটনা কদাচিৎ ঘটে। এমন গাঁ তোলপাড় করা খবর খুব দ্রুত রটে। এমন খবরের দেখা সচরাচর মেলেও না গ্রামের পানসে জীবনের চৌহদ্দিতে। যেখানে প্রতিদিন নুনতা তার মালাইয়ের বাক্স ভরে বরফের ফাঁকে ফাঁকে মালাই নিয়ে গ্রামে ফেরে সাত-সকালে, দিনভর পায়ে হেঁটে সেই বাক্স পিঠে নিয়ে মালাই বিক্রি করে গ্রাম থেকে গ্রামে, হেঁড়ে গলায় হাঁক ছাড়ে, ‘এই মালাই নেবেন, মালাইইই’, সেখানে নুনতার পরিবর্তে এই ভোরে উড়ে আসা খবরটা যেন সারা গ্রামকে নাড়িয়ে দিয়ে গেলো পুরোপুরি।
গ্রামে পড়ে গেলো জব্বর হুড়োহুড়ি। কার আগে কে ছুটবে তার প্রতিযোগিতা শুরু হলো রীতিমতো। গ্রামের নিতান্তই ঢেউহীন, নিরুত্তাপ জীবনের গায়ে খবরটা দারুণ এক উত্তেজনা ছুড়ে দিল মুহূর্তেই, পানসে, নিরামিষ জীবনের শরীরে এঁকে দিল একপোঁচ আমিষের রেশ।
কুলি খবরটা শুনে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল প্রথমটায়। সে বিশ্বাসই করতে পারল না খবরটা। বরং উড়ে আসা খবরটাকে আরো বেগে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে সে বিকৃত, রাগী আর ভয়ার্ত গলায় চিৎকার করে উঠল জোরে, কী কয় আবাগির বেটারা সপ! আঁটকুড়ের দল! বাড়া সব! আমার বাড়িত্তে বাড়া যা কচ্চি!
পেঁচি খানিক দূরে দাঁড়িয়ে ঘটনাটা আঁচ করার চেষ্টা করল চুপচাপ। তার বোকা বোকা মুখ সারারাত নির্ভাবনায় ঘুমোনোর সুখে ফোলা আর কিম্ভুত, উস্কখুস্ক চুলে মাথাটা কাকের বাসা এক্ষণে। পেঁচি আর নুনতার শনে ছাওয়া পাশাপাশি ঘর। মাঝখানে কোনো আড়াল নেই। দুভাইয়ের সংসারে আড়াল করার তেমন কিছু নেইও আদতে। আছে শুধু অভাবের চোখ রাঙানি, নুন আনতে পানতা ফুরোনোর নিত্যকার চেনা কাহিনি, তাতে আড়াল নিতান্তই অনাবশ্যক আর বাহুল্য ঠাট। ওতে কিছু প্রয়োজন নেই তাদের। বাড়ির চৌহদ্দিতে শুধু কলাপাতার পলকা বেড়া, তাতে পাড়ার লোকেদের দৃষ্টি আর পথচলতি জনতার চোখ এড়িয়ে দিন পার করার এক নিষ্ফল প্রচেষ্টা আছে শুধু। পেঁচির ঘরের দাওয়ায় খড়ের বিছানায় পেঁচি আর নুনতার আশি পার হওয়া মা আকিরন বানু তখনো ঘোলা চোখে বসা, বড় বড় ছানিপড়া চোখ মেলে তিনি অবাক বিস্ময়ে বোঝার চেষ্টা করছেন হাওয়ায় উড়ে আসা খবরটার সত্যাসত্য। সূর্যটা তখনো আড়মোড়া ভেঙে ভালোমতো মাথা তোলেনি পূবের আকাশের তেরছা কোনে।
পেঁচি তার বোকাসোকা মাথায় বোঝার চেষ্টা করল পরিস্থিতি। মেইল ট্রেন ধরে প্রতি ভোরেই সে আর নুনতা কুষ্টিয়া শহর থেকে বাক্সভর্তি মালাই নিয়ে গাঁয়ে ফেরে, বরফকল থেকে বরফ নিয়ে বরফের ভাঁজে ভাঁজে মালাই সাজিয়ে এনে দুভাই গাঁয়ের দুদিকে হাঁটা দেয়, আশেপাশের গ্রামগুলোতে বিক্রি করে সারাদিন পরে ক্লান্ত, অবসন্ন পায়ে ঘরে ফেরে। তারপর যে যার ঘরে গিয়ে সন্ধ্যা নামতে না নামতেই খাওয়া-দাওয়া সেরে সুখে নাক ডাকায়। কেননা রাত থাকতেই তারা আবার হাঁটা দেয় খোকসা রেলস্টেশন বরাবর, রাত সাড়ে তিনটার ট্রেনে চেপে কুষ্টিয়া শহরের মালাই ফ্যাক্টরিতে গিয়ে নামে, ফিরতি ট্রেনে মালাই নিয়ে ফিরে আসে আবার।
কাল শরীরটা বড় একটা যুতে ছিল না পেঁচির, নুনতা তাই একাই রওনা দিয়েছিল রাতে। কিন্তু এই সাতসকালে উড়ে আসা খবরটা বিশ্বাস করতে ভারি কষ্ট হয় পেঁচির। নুন আনতে পান্তা ফুরানো সংসার তাদের দুভাইয়ের, তা বলে সুখের তেমন একটা অভাব ছিল না এতদিন। কিন্তু উড়ে আসা খবরটা যেন তাদের সেই সুখে ডাকাতি করতে হাজির হয় এসে। পেঁচি ফ্যালফ্যাল চোখে আকিরন বানুর ঘোলা চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে নিষ্পলক। মূক, বধির মনে হয় তাকে। ওদিকে সাত-সকালে বাড়িতে উড়ে আসা অপয়া খবরটাকে মিথ্যে প্রমাণ করতে আর গাঁয়ের লোকের হামলে পড়া বেহুদা ভিড়টাকে তাড়াতে কুলি তখন গলা তুলে একজন্মে শেখা যত গালিগালাজ ছিল তার ভাঁড়ারে, সেগুলো উজাড় করতে ব্যস্ত। আকিরনই থামান তাকে। গলার শ্লেষ্মা খানিকটা পরিষ্কার করে নিয়ে কুলিকে উদ্দেশ্য করে ধীরে ধীরে বলেন, তুই ইটু থাম লো বউ! ইটু দম ফেল ইবার! আমার ব্যাটার চিন্তেয় আমার আত-পাও সব প্যাটের বিন সেঁদো যাতেচে, আর তুই লাগিচিস মন্তর পইরবের!
শুনে এবার একটু থামে কুলি, একনাগাড়ে গলা সাধার শ্রমে হাঁপায় অগত্যা। ভিড়ের দিকে ঘোলা চোখ মেলে দিয়ে আকিরন আবার বলে, খবরডা আইনলে কিডা? কী অয়চে আমার ব্যাটা নুনতার কওদিনি তুমরা আমাক?
ভিড়ের ভেতর থেকে হুরমত আলী এগিয়ে আসে কয়েক পা, তার খালি গা ঘামে জবজব, লুঙ্গি হাঁটুর ওপর তোলা, খালি পায়ে একহাঁটু ধুলোর আস্তর। সে উত্তেজিত জরুরি গলায় বলে, আমার জামুই আয়চে সহালের টেনে কুষ্টেত্তে। সে দেহে আয়চে গটনাডা।
জনতা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। ভিড়ের ভেতর থেকে অধৈর্য গলায় একজন বলে ওঠে, অত বুনোতি না হরে আসল কতাটা কও না হ্যা? গটনাডা কী, সিডা কও আগে।
আকিরন তার হাঁপানি রোগকে বাগে আনার বৃথা চেষ্টা করেন, গলার ভেতর জমা শ্লেষ্মাটুকু পরিষ্কার করার চেষ্টা চালান জোর, অতঃপর হাঁপাতে হাঁপাতে বলেন, আমার ব্যাটার কী অয়চে ক তো হুরমত! আমার কলজেডা দো জ্বলে রে বাজান!
হুরমত আদ্যোপান্ত বলে যায়। দাঁড়ি, কমাসহ বয়ান করে ঘটনা। ভিড়ের মধ্যে পিনপতন নীরবতা নামে তখন। হুরমতের বর্ণনার মাহাত্ম্যে শিউরে ওঠে সবাই পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে। ঘটনা সামান্যই। ট্রেন প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল, তখন মালাইয়ের বাক্স মাথায় নিয়ে দৌড়ে স্টেশনে এসে ট্রেনে ওঠার চেষ্টা করেছিল নুনতা। চলন্ত ট্রেনে উঠতে গিয়ে টাল সামলাতে পারেনি সে। বেকায়দায় পড়ে গিয়ে তার দুপা হাঁটুর সামান্য ওপর থেকে কাটা পড়েছে। ট্রেনে জানালার পাশেই বসে ছিল হুরমত আলীর জামাই। সে নুনতাকে আগে থেকেই চিনত, জানালা দিয়ে সে এই পুরো দৃশ্যটা অবলোকন করেছে একটা ঘোরের মধ্যে থেকে, চিৎকার করেছে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে, আর ঘটনাটা দেখে শিউরে উঠেছে ঘটনাস্থলে উপস্থিত সকলেই। কিন্তু ট্রেন ততক্ষণে ‘কিছুই জানি না’ ভঙ্গিতে স্টেশন থেকে বেরিয়ে গেছে হুইসেল বাজিয়ে, কারোরই কিছু করার ছিল না ট্রেনের মধ্যে বসে, শুধু কাহিনিটাতে রঙ চড়িয়ে বর্ণনা করা আর এমন আরো আরো কাহিনি নিয়ে জমিয়ে গল্প ফেঁদে বাকি পথটা পার করেছে ট্রেনের যাত্রীরা। হুরমতের জামাই সেই কোন ভোরে বাড়িতে এসে বলেছে তাদের কাছে নুনতার এমন নির্মম পরিণতির কথা, কিন্তু তখনো অন্ধকার কাটেনি, সূর্যটা তখনো পূবের আকাশে আলতো পায়ে হাঁটেনি, কুয়াশায় ঢাকা পুরো গ্রাম, ফলে গল্পটা ছড়াতে হুরমতের সময় লেগেছে খানিক।
আকিরন ঘটনা শুনে মূর্ছা গেলো। কুলি গলা ছেড়ে কেঁদে উঠে লুটিয়ে পড়ল উঠোনকোণে। বাচ্চারা জড়াজড়ি করে কাঁদতে থাকল উচ্চস্বরে। পেঁচি তখনো ভিড় থেকে খানিকটা দূরে হতবুদ্ধি হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে। জীবনের খোলা ময়দানে ছড়িয়ে থাকা নানা রহস্যময় বাঁক-প্রতিবাঁক, গলি-চোরাগলি, স্রোত-চোরাস্রোত তাকে বরাবরই বাকরুদ্ধ করে দেয়, তার স্বল্পবুদ্ধিতে সে থৈ পায় না এইসব কঠিন পরিস্থিতির, হারিয়ে ফেলে নিজের ওপর সামান্যতমও নিয়ন্ত্রণ। নুনতার সঙ্গে সে-ও কেন গেলো না কাল রাতে, ভেবে সে নিজেকে ক্ষমা করতে পারে না কিছুতেই। হু হু করে কেঁদে ওঠে সে আকুল হয়ে।
ভিড়ের মধ্যে উত্তেজনা কিছুটা থিতিয়ে গেলো আকিরন বানুর জ্ঞান ফেরে। স্বামীর এমন আকস্মিক দুর্গতির খবরে কুলি তখনো ধুলোর মধ্যে গড়াগড়ি দিয়ে বিলাপ করে চলেছে। নুনতা ছাড়া তার সংসার অচল। নুনতার এমন দুর্ঘটনা মানে কুলির সংসারের চাকাও পুরোপুরি অচল হয়ে যাওয়া। শোকের চেয়ে তাই শঙ্কা তার মনে প্রকট হয়ে ওঠে আরো। তার শোকপ্রকাশের ধরন-ধারনও তাই ক্রমশই বিকট হয়ে ওঠে ঢের।
হাউমাউ কাঁদে। সমস্ত গ্রাম উপুড় হয়ে পড়ে মালাইয়ের বাক্সের ওপর। শিউরে উঠে তারা কয়েক হাত দূরে ছিটকে সরে যায় অগত্যা।
গাঁয়ের মুরুব্বীগোছের লোকেরা অবশেষে নুনতার এই বিপদের খবরে আলোচনায় বসেন। পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করে সকলেই দুঃখিত, হতবাক। এহেন পরিস্থিতিতে কী করা যায় তা নিয়ে আলোচনায় বসেন তারা। নিতান্তই দরিদ্র, প্রান্তিক পরিবারটির এই ঘোর দুর্দিনে কীভাবে তাদের পাশে দাঁড়ানো যায়, তা নিয়ে শলাপরামর্শ চলে অনেকক্ষণ। শেষে গ্রামের শিক্ষিত, চৌকস একটি ছেলেকে পেঁচির সঙ্গে কুষ্টিয়া শহরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। তারা প্রথমে যাবে কুষ্টিয়া রেলস্টেশনে, সেখানকার মানুষের মুখ থেকে ঘটনার সত্যতা যাচাই করে যাবে সদর হাসপাতালে। গিয়ে খোঁজ করবে নুনতার। অতঃপর দুপুরের ট্রেনেই পেঁচি আর গ্রামের উল্লিখিত ছেলেটা রওনা হয়ে যায় কুষ্টিয়া শহরের উদ্দেশে। প্রায় পুরো গাঁয়ের লোক ভেঙে পড়ে তাদের বিদায় জানাতে।
তারপর অপেক্ষা আর অপেক্ষা। গ্রামশুদ্ধ লোকের কৌতূহল আর দুঃশ্চিন্তা। কুলির দুরুদুরু বুক, মনে ক্ষীণ আশা, নিশ্চয়ই খবর আসবে সব মিথ্যে, নুনতার কিচ্ছু হয়নি, নিশ্চয়ই সে মালাইয়ের বাক্স মাথায় নিয়ে ‘এই মালাই নেবেন মালাইইই’ বলতে বলতে গাঁয়ের পথ ধরে হাঁক ছাড়তে ছাড়তে বাড়িতে ফিরবে ধুলো পায়ে। সে গামছা আর লুঙ্গি হাতে দৌড়ে যাবে তার কাছে, ছোট মেয়েটা খেলা ফেলে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরবে বাপকে, ঘেমো গায়ে মালাইয়ের বাক্স কোনোমতে মাথা থেকে নিচে নামিয়েই মেয়েকে কোলে তুলে নেবে নুনতা, চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে তুলবে মেয়ের মুখ। নিত্যকার স্বাভাবিক এই ছবিটিই আজ ভীষণ দুর্লভ মনে হয় কুলির কাছে, ছবিটি মনে হয় এই জীবনে নয়, বরং অন্য কোনো জীবনে দেখেছে সে, অন্য কোনো জন্মে দৃশ্যায়িত হতে দেখেছে সে এমন অপার্থিব আনন্দময় কোনো ঘটনা। অথচ নিত্যকার এই দৃশ্যটিই ভারি পানসে ছিল তার কাছে, ছিল নিতান্তই সাদামাটা, অতি সাধারণ। জীবন কত সহজেই তার চিরাচরিত দৃশ্যগুলি মুছে ফেলে তার পিঠ থেকে, এঁকে দেয় নতুনতর দৃশ্যাবলী, ভেবে কুলির ভেতরের শোক উথলে ওঠে আরো। বারবার কোলের সন্তানটিকে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে সে, কোলের সন্তানটি মায়ের এই অসংলগ্ন আচরণে বিরক্ত হয়ে কোল থেকে ছেঁচড়ে নেমে পড়ে, আকিরন বানুর কোলের মধ্যে গিয়ে মুখ লুকোয়, এমন থমথমে পরিস্থিতি আর জনতার গমগমে উপস্থিতিতে ভড়কে যায় সে, এসবের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটার সুযোগ ঘটেনি জন্মের পর থেকে।
কুষ্টিয়া শহর বড় কাছে নয়। যাতায়াত ব্যবস্থাও নিতান্তই সেকেলে। কতকদূর পায়ে হেঁটে, কতকদূর ভ্যানে গিয়ে অতঃপর ট্রেনে চড়তে হয়, সে ট্রেনও নির্দিষ্ট সময়ে আসেই না বলতে গেলো, ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে তবে দেখা মেলে ট্রেনের, তাতে গাদাগাদি ভিড়, সেই ভিড় ঠেলে ট্রেনে ওঠা সহজ নয় খুব। কাজেই পেঁচির অপেক্ষায় গ্রামের লোককে উদগ্রীব অপেক্ষায় থাকতে হয়। অপেক্ষায় থাকতে হয় কুলি আর আকিরন বানুকেও। তাদের একটাই প্রার্থনা, যেন খবরটা মিথ্যে হয়, যেন নুনতাকে অক্ষত অবস্থায় সঙ্গে নিয়ে ফিরে আসে পেঁচি আর গাঁয়ের চৌকস ছেলেটা। কুলি ওযু করে জায়নামাযে বসে একমনে আল্লাহকে ডাকে। তার কোলের ছেলেটা অদূরে বসে দুধের জন্য ট্যাঁ ট্যাঁ কাঁদে। আকিরন তার খড়ের গদির বিছানায় কখনো শুয়ে, কখনো বসে ছেলের জন্য বিলাপ করেন, শব্দ করে আল্লাহকে ডাকেন, দোয়া-দরুদ পড়েন। অতি বিনীত স্বরে আল্লাহর কাছে নুনতাকে সহি-সালামতে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেওয়ার মিনতি করেন আকিরন। গাঁয়ের লোকেরা নুনতা আর পেঁচির পরিবারের খাবারের ব্যবস্থা করে সে বেলা।
অবশেষে সূর্য ক্লান্ত হয়ে পাটে গড়িয়ে যায়, হালকা অন্ধকারের পর্দা নামতে থাকে গ্রামজুড়ে। কুয়াশাও তার পাতলা চাদর বিছিয়ে দেয় শ্যামল গ্রামটির ক্রমশ ধূসর হয়ে আসা শরীরের ভাঁজে ভাঁজে। সারাদিনে গ্রামের লোকের ভীড়ে নুনতার বাড়ি সরগরম ছিল ভারি, সন্ধ্যার আভাসে তা খানিকটা ঝিমিয়ে আসে। সহসা গাঁয়ের দক্ষিণপ্রান্তের রাস্তার বাঁক থেকে পেঁচির পলকা শরীর আবছায়া উঁকি দিতে দেখা যায়। তার ধূলোমাখা খালি পা, গায়ে কোনো এক আদ্যিকালে কেনা ছেঁড়া জামা, পরনে হাঁটু পর্যন্ত গুটোনো ময়লা লুঙ্গি আর মাথায় নুনতার মালাইয়ের বাক্স। এসব নিয়েই সে গ্রামের দক্ষিণপ্রান্ত দিয়ে আবির্ভূত হয় কোনো এক পৌরাণিক কালের জঠর থেকে। কিন্তু সে একা। গাঁয়ের সেই চৌকস ছেলেটার কিংবা নুনতার চিহ্নমাত্রও তার আশেপাশে নেই। গাঁসুদ্ধ লোক হৈ হৈ করে ওঠে। দৌড়ে যায় তার কাছে। কী খবর? কী হয়েছে আদতে? চিৎকার করে, উত্তেজনায় অধীর হয়ে পেঁচিকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে চলে গ্রামসুদ্ধ জনতা। পেঁচি কোনো উত্তর দেয় না। সামান্যও রা করে না। মূক, বধির হয়ে সে পথ পাড়ি দেয়, যন্ত্রচালিতের মতো হাঁটে, অতঃপর বাড়ির আঙিনায় মালাইয়ের বাক্সটা নামিয়ে রেখে কাটা কলাগাছের মতো মাটিতে আছড়ে পড়ে ‘ও বাই রে’ বলে গড়াগড়ি দেয়।
বাড়িজুড়ে কান্নার রোল পড়ে যায়। কে কাকে সান্ত্বনা দেবে উপস্থিত ভিড়ের মধ্যে সে নিয়ে তোড়জোড় শুরু হয়। খবর সত্যি। হাঁটুর ওপর থেকে সদ্য দুই পা হারানো নুনতা হাসপাতালের বিছানায় অজ্ঞান পড়ে আছে, তার পাশে আপাতত গাঁয়ের চৌকস ছেলেটাকে রেখে ফিরে এসেছে পেঁচি। বলতে বলতে দৌড়ে গিয়ে মালাইয়ের বাক্সের ঢাকনা তুলে দেয় সে। হাউমাউ কাঁদে। সমস্ত গ্রাম উপুড় হয়ে পড়ে মালাইয়ের বাক্সের ওপর। শিউরে উঠে তারা কয়েক হাত দূরে ছিটকে সরে যায় অগত্যা।
বাক্সের মধ্যে ট্রেনে কাটা পড়া একজোড়া ফুলে ওঠা, রক্তাক্ত, খেটে খাওয়া ঘেয়ো পা, জনতার দিকে অপলক তাকিয়ে তারা ভেঙচি কাটছে তখন।