এক.
অফিসে যাওয়ার জন্য পনেরো নম্বর বাস স্টপে প্রত্যেক সকালে যখন বাসের জন্য অপেক্ষা করি, তখন নিয়মিত তিনজন ভিক্ষুক সামনে এসে হাত পাতে। তাদের একজনের হাত ভাঙা, একজন হাঁটতে পারে না, রাস্তায় বসে ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে আসে। তার পা দুটো বাঁশের কঞ্চির মতো শুকনো। দেখলে গা শিউরে ওঠে। আর সর্বশেষ জন বৃদ্ধ। লোকটি বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছে। হাতে মোটা লাঠি, চোখে চশমা, পরনে আসমানি রঙের পাঞ্জাবি। লোকটি এমন নিশ্চিত ভঙ্গিতে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়, যেন আমি তার জন্যই অপেক্ষা করছি।
আমিও দুই টাকার বদলে তার জন্য একটা পাঁচটাকা বরাদ্দ রাখি।
বৃদ্ধ ভিক্ষুকটিকে দেখলে আমার বন্ধু রওনকের বাবার কথা মনে পড়ে। ভদ্রলোকের বয়স সত্তরের বেশি না, অথচ তিনি এখন বিছানা থেকেই নড়তেই পারেন না। ছেলে-মেয়েরা পালা করে যত্ন-আত্তি করে। ডাক্তার হসপিটাল চেক আপে কোনো কিছুরই ত্রুটি নেই। অথচ ভদ্রলোক প্রায় নির্জীব। আমি বৃদ্ধ ভিক্ষুকটিকে দেখি। জীবনের তাগিদে তাকে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হয়। নিশ্চয়ই তারও ক্লান্তি লাগে, শুয়ে থাকতে ইচ্ছা করে।
এক বর্ষার দিন, অনেক বৃষ্টি, সঙ্গে কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস, ছাতা মাথায় বাসের জন্য অপেক্ষা করছি, ওই সময় সেই অতিবৃদ্ধ ভিক্ষুক এসে সামনে দাঁড়ালো। এক টুকরো পলিথিনে গা মাথা জড়ানো। অন্যদিনের চেয়ে তাকে আরও বেশি কুঁজো ও জড়োসড়ো লাগছিল। তার চশমার ঘোলা কাঁচ বৃষ্টির জলে ভিজে আরও ঘোলা হয়েছিল। কেন যেন মনে হলো, লোকটি ঠাণ্ডায় কাঁপছে।
আমি একটা একশ টাকার নোট বের করে তার হাতে দিয়ে বললাম, এই টাকাটা নিয়ে সোজা বাড়ি চলে যান। এতে আপনার আজকের খাওয়া হয়ে যাবে। টাকাটা হাতে নিয়ে বৃদ্ধ বোধহয় কেঁদে দিলো। হয়তো কিছু বলতে চাইলো, কিন্তু বাস চলে আসায় আমার আর কিছু শোনা হলো না।
সেই দিনের বৃষ্টিতে ভিজে জ্বরে পড়ে আমিও দিন সাতেক ছুটি কাটালাম। তারপর যথা নিয়মে অফিস বাসা। বৃদ্ধ ভিক্ষুকটির কথা মনেই ছিলো না কিংবা হয়তো ছিল। প্রতিদিনকার জীবনযাপনে আমরা যে সব কাজে, আচরণে অভ্যস্ত, তা আমাদের মনে থাকে না। কাজেই বৃদ্ধ হয়তো নিয়ম করেই আসছিল, ভিক্ষে নিয়ে যাচ্ছিল, বিশেষ কোনো ঘটনা ঘটেনি। তাই, আমার মস্তিষ্ক তাকে সংরক্ষণ করেনি।
অফিস থেকে ফেরার পথে প্রায়ই আমি ধানমন্ডি দুই নম্বর রোডে নেমে পড়ি। সীমান্ত মার্কেটের উল্টো পাশ দিয়ে লেক পাড় ধরে হেঁটে বাসায় ফিরি। এটি করি মূলত শরীর চর্চা তো করা হয় না, শরীর ক্রমশই মেদের প্রলেপে ভারী হচ্ছে, অন্তত কিছুটা শরীর চর্চার অংশ হিসেবে।
এক সন্ধ্যায়, মনে হয় সেটা কোনো ফেব্রুয়ারির সন্ধ্যা, বাতাস কেমন মন ভোলানো, ভালোবাসার অমৃত স্পর্শ দিয়ে বয়ে যায়। অকারণে সুখ সুখ একটা অনুভূতি আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। আমি লেকের পাশের বাঁধানো রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ঝরা পাতার শব্দ শুনতে শুনতে তারুণ্যের আড্ডার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ সেই বৃদ্ধ ভিক্ষুকটিকে দেখতে পাই।
টুকটাক কাজ করে কিছুদিন। একদিন গাড়িচাপা পড়ে আহত হলে লোকজন ঢাকা মেডিক্যালে রেখে যায়।
আবছা আলো-আঁধারির রাস্তা ধরে হাতের মোটা লাঠিটায় ঠুক ঠুক শব্দ করতে করতে সে হাঁটছিল, দ্বিধান্বিত পদক্ষেপে, হয়তো দেখতে কষ্ট হচ্ছিল কিংবা হাঁটতেও। আমার পাশ দিয়ে সে চলে যাচ্ছিল। আমি থামালাম। কখনো কখনো আমাদের মন অকারণেই কোমল হয়ে ওঠে, মহৎ হওয়ার একটা মৃদু আকাঙ্ক্ষা উঁকি দেয় কিংবা বুকের খুব ভেতর থেকে কাউকে কিছু দেওয়ার শান্তি পাওয়ার তাড়না জাগে। পূর্ব-পরিকল্পনা ছাড়াই কিছু কাজ করে ফেলি। সঙ্গে এক বাক্স ফখরুদ্দীন বিরিয়ানি ছিল, বাসায় একা আজ। তাই রাতের খাবার হিসেবে নিয়েছিলাম। আমি কিছু ভাবনা-চিন্তা না করেই সেটা তার হাতে দিয়ে বলি, নেন খাইয়েন। সে তক্ষুনি, সেই আবছা অন্ধকারে, লেকের পাড়ে, একটা শিরিষ গাছের নিচে খেতে বসে গেলো।
প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত, সারাদিন কিছুই পেটে পড়েনি। কয়েক গ্রাস খাওয়ার পর সে জানালো, ফোকলা মুখে লাজুক হেসে।আমার চোখে জল এসে গেলো।জিজ্ঞেস করলাম, আপনার নাম কী? এই শহরে কেউ তার নাম জানতে চাইছে, বিষয়টা যেন তার ঠিক বিশ্বাস হলো না। অবাক কণ্ঠে বললো, জি?
আমি বললাম, নাম কী আপনার?
হোসেন আলী।
থাকেন কই?
ঈদগাহ্ মসজিদে।
দুই.
কয়েক বছর চলে গেছে। কোনো বিশেষ বর্ণিল ঘটনা ছাড়াই। একঘেয়ে, বর্ণহীন। অফিস যাই, আসি। বাস স্টপে দাঁড়িয়ে বাসের অপেক্ষারত সঙ্গীদের সঙ্গে গল্প করি।
আমার বড় সন্তান পরীক্ষায় বেশ ভালো ফল করলে বাসায় বেশ বড়সড় খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করা হলো। আত্মীয় বন্ধুপূর্ণ সে অনুষ্ঠানে হঠাৎ আমার মা আমাকে ডেকে বললেন, ছেলের মঙ্গল হবে গরিব-দুঃখীর মাঝে কিছু দান-খয়রাত করো। মায়ের কথা মনে ধরলো।
তখন আমার বৃদ্ধ হোসেন আলীর কথা মনে পড়লো। লোকটি দরিদ্র এবং সামান্য ভিক্ষুক। তার পরনের পাঞ্জাবিটিতে অনেক ছেঁড়া অংশ সেলাই করা এবং তালি মারা৷ তা সত্ত্বেও সেটি সব সময় পরিষ্কার থাকে।
সিদ্ধান্ত নিলাম আমি বৃদ্ধকে কিছু টাকা ও একটা পাঞ্জাবি দেবো।
তখন খেয়াল করলাম বৃদ্ধ আর আসছে না। একদিন, দুই দিন করে সপ্তাহ গড়ালে কেন যেন বৃদ্ধের প্রতি একটা টান অনুভব করলাম। আমি জানি, সে ঈদগাহ্ মসজিদে থাকে, এক সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফেরার পথে আমি মসজিদে গেলাম। তখন কোনো নামাজের ওয়াক্ত নয়, তাই মুসল্লির ভিড় ছিল না। দুই-এক জন ভেতর থেকে বের হচ্ছিল কিংবা ভেতরে যাচ্ছিল।
প্রবেশ পথে আধাপাকা দাঁড়ি গোঁফের এক মধ্যবয়সী হুজুর টাইপ ভদ্রলোককে দেখলাম, খুব মন দিয়ে মেঝের টাইলসে কিছু দেখছেন। সালাম দিতেই তিনি মোটামুটি চমকে উঠলেন। নিজের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়ে আমি তার কাছে বৃদ্ধ ভিক্ষুকের কথা জানতে চাইলাম। মওলানা সাহেব প্রথমে বুঝতেই পারলেন না, কার কথা বলছি। বললেন, মসজিদ চত্বরে অনেক ভিক্ষুক রাত কাটায়। অনেক ভিক্ষুক আসা-যাওয়া করে। নির্দিষ্ট করে কাউকে মনে রাখা কঠিন।
আমি তবু তাকে নানাভাবে বৃদ্ধ ভিক্ষুকের বর্ণনা দিতে থাকলে অবশেষে তিনি চিনতে পারলেন। আর আমার তখন বৃদ্ধ ভিক্ষুকের নামটাও মনে পড়লো, হোসেন আলী। মওলানা সাহেব বললেন, সে তো অসুস্থ। হসপিটালে ভর্তি।
মনটা ভারাক্রান্ত হলো কিছুটা। সেবাযত্নের মধ্যে থেকেও রওনকের বাবা গত বছর চলে গেলেন। এই বৃদ্ধ ভিক্ষুক তো ঠিকমতো খাবারই পায় না। হয়তো এবার সেও চলে যাবে।
তিন.
একসময় কৃষিকাজ করতো হোসেন আলী। নিজের জমিজমা ছিল। দুই ছেলে এক মেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে জমজমাট সংসার কিন্তু সুখ তার রইলো না। বড় ছেলেকে জমি জমা বিক্রি করে বিদেশ পাঠিয়েছিল। কিন্তু ছেলে ওখানে রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। বেচারার দুর্ভোগ তখনই শুরু। পরের জমিতে কাজ করতে হয় জীবিকার জন্য। ওই জমি চাষ করতে গিয়ে সাপের কামড়ে ছোট ছেলেটাও মারা যায়। বসতভিটা বিক্রি করে মেয়ে বিয়ে দিয়ে স্বামী-স্ত্রী দুজনে লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ করে দিন-যাপন করতে থাকে। একসময় তার স্ত্রীও তাকে ছেড়ে চলে যায়। মেয়ের জামাইটি ভালো ছিল বড়। শ্বশুরকে সে নিজের বাড়ি নিয়ে যায়। ওখানে চার পাঁচ বছর ভালোই কাটে। তারপর তার মেয়েটিও একদিন একটি কন্যা সন্তান রেখে মারা যায়। জীবনের প্রয়োজনে মেয়ে জামাই আর একটি বিয়ে করলে জামাই বাড়িতে থাকার পাট চুকে যায় তার। কিন্তু ততদিনে বার্ধক্য ধরেছে তাকে। মেয়ে-জামাইও অত সচ্ছল ছিল না। অভাব অনটন ছিল। কাজেই প্রয়োজনীয় খাদ্যের অভাবে দুর্বলতা এসেছে শরীরে, কাজ-কর্মের শক্তি কমে গেছে।
ওই সময় পেটের দায়ে ঢাকায় চলে আসে হোসেন আলী। টুকটাক কাজ করে কিছুদিন। একদিন গাড়িচাপা পড়ে আহত হলে লোকজন ঢাকা মেডিক্যালে রেখে যায়। ঢাকা মেডিক্যালে তার মেয়ের ঘরের নাতজামাইয়ের সঙ্গে দেখা হলে নাতনি নিজে এসে নানাজানকে রায়ের বাজার নিজের বাসায় নিয়ে যায়। বৃদ্ধের নাতনির নাম রোজী। ওই সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। তার স্বামী আফসার রায়েরবাজারেই একটা দরজি দোকানে কাজ করে।
মায়া, মমতা, আত্মার টান—এসব কিছুই আসলে অর্থের কাছে পরাজিত। নাতনির তিনটে সন্তান। নাতজামাই দরজি বেচারা পাঁচ জনের সংসার টানতেই হিমশিম খায়, বৃদ্ধ নানা শ্বশুরের প্রতি তার অন্তরে মায়া আছে কিন্তু ভরণপোষণের ক্ষমতা নেই। এ নিয়ে রোজীর সঙ্গে প্রায়ই অশান্তি। বিষয়টি বৃদ্ধ হোসেন আলীর কান এড়ায় না।
আরও জীর্ণশীর্ণ, পরনে সাদা পাঞ্জাবি, বেশ ময়লা। হোসেন আলী বেঁচে আছে।
অতঃপর রোজ সকালে ‘একটু ঘুইরা আসি’ বলে হোসেন আলী বাসা থেকে বের হয়ে ভিক্ষে করতে শুরু করে। দিনান্তে কোনোদিন দুশো, কোনো দিন তিনশ টাকা পায়। ওই টাকা দিয়ে কোনোদিন মুরগি, কোনোদিন দুধ বা ফল কিনে বাসায় যায়। রোজী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, নানাজান এ টাকা কই পাইলা? হোসেন আলী মিথ্যে বলে, কোনো দিন বলে, দোকানে কাজ করেছে, কোনোদিন বলে মিস্ত্রীর সাথে জোগালি করেছে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। নাতজামাই জেনে যায়, তার পরিচিত কে একজন বলেছে, নানাজানকে দিয়ে ভিক্ষে করিয়ে অর্থ উপার্জন করায় সে।
এ নিয়ে অশান্তি। কান্নাকাটি। রাগারাগি। রোজীর জামাই স্পষ্টতই বলে দেয়, আমার বাড়ির ডাল-ভাত সহ্য হইলে থাকেন, নইলে যান।
হোসেন আলীর বয়স হয়েছে। ক্ষুধার কষ্ট সহ্য করতে পারে না। সে নাতনির বাড়ি থেকে বের হয়ে আসে। প্রথম কয়দিন ফুটপাতে থাকে। তারপর মসজিদের বারান্দায় থাকতে শুরু করে। মসজিদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে মওলানা সাহেবের কাছে হোসেন আলীর গল্প শুনে আমার মনটা আর্দ্র হয়ে ওঠে।
সিদ্ধান্ত নেই কাল তাকে দেখতে হসপিটালে যাবো। যদিও অতবড় জায়গায় একজন মানুষকে খুঁজে পাওয়া ভীষণ কঠিন।
চার.
আমরা অনেক কিছু ভাবি। কিন্তু করা হয় না। নানা কাজে জড়িয়ে পড়ে আমারও হোসেন আলীকে দেখতে হসপিটালে যাওয়া হলো না।
এর মধ্যেই বাসা বদলে মোহাম্মদপুর চলে এলাম। বাসের অপেক্ষা করি আল্লা করিম মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে। ওখানে নানা কিসিমের ভিক্ষুক চোখে পড়ে, খুব বৃদ্ধ, চলাচলে অক্ষম প্রায় এমন কাউকে দেখলে আমার হোসেন আলীর কথা মনে পড়ে। কেমন আছে এই শতায়ুর কাছাকাছি আত্মীয় পরিজনহীন দরিদ্র হোসেন আলী?
একদিন পনেরো নম্বর বাস স্টপ থেকে বাসে ওঠেন এমন একজন সহকর্মীকে আমি হঠাৎ জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, একটা খুব বয়স্ক ভিক্ষুক আসতো না, সে কি আসে? সহকর্মীটি অবাক হয়ে বললো, কে? কার কথা বলছেন? বললাম, ওই যে একদম থুত্থুরে বুড়ো ভিক্ষুক ছিল একটা। সহকর্মীটি বললেন, এমন তো রোজ কতই দেখি। কার কথা বলছেন, বুঝতে পারছি না। আমি লজ্জা পেলাম। বুঝলাম বড্ড বোকামি হয়ে গেছে, একটা ভিক্ষুক আসে কি না কে-ই বা খেয়াল করে!
পাঁচ.
হোসেন আলীর কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। গত সপ্তাহে কলা বাগানে এক আত্মীয়র বাসা থেকে ফিরছিলাম। শেষ শীতের বিকেল। নরম রোদে বেশ মিষ্টি। লাজ ফার্মার সামনে সিগন্যালে বসে আছি। হঠাৎ রাস্তার উল্টোপাড়ে দেখলাম হোসেন আলী দাঁড়িয়ে আছে। আরও জীর্ণশীর্ণ, পরনে সাদা পাঞ্জাবি, বেশ ময়লা। হোসেন আলী বেঁচে আছে।