সে কি জানত, একদিন তাকে ইট-বালুর স্তূপে চাপা পড়ে মরতে হবে? তেমন হলে এই নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথাই ছিল না কেন? এমনকি তার ঘুমেরও সামান্য ব্যাঘাত ঘটেনি কোনোদিন। অসম্ভব ভালো ঘুমুতে পারে সে। অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হলো, এই ঘুমের আলাদা কোনো টাইম-টেবিল নেই। এমনও হয়, পশ্চিমের ভাঙা কাঠের দরজা খুলে সূর্যের লাল রঙ দেখতে-দেখতে সে ঘুমিয়ে পড়ল আর ভোর চারটায় উঠে মাথা চুলকাতে-চুলকাতে আকাশ দেখতে লাগল। এক নক্ষত্র থেকে অন্য নক্ষত্রে আঙুলের দাগ কেটে কেটে আঁকতে লাগল ভেড়া, বৃক্ষ কিংবা সচরাচর দেখা পাঁচ ঝিলিকঅলা অনুজ্জ্বল কোনো নক্ষত্র। কিংবা ভরদুপুরে একপেট ক্ষুধা নিয়েও সে ঘুমিয়ে পড়তে পারত। তার মতো অলস আর অদ্ভুত ব্যক্তি সমগ্র বৃষ্টিপুরে দ্বিতীয়টি ছিল না।
যদিও গাঁয়ের কোনো মানুষ তাকে স্বাভাবিক আখ্যা দেয়নি, তবে তার সাথে রহস্যময় কোনো অভিধাও লাগায়নি। আসলে ক্রমশ তারা এই মানুষটিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল।
ক্ষুধা লাগলেই সে একটা ঝোলা নিয়ে বেরিয়ে পড়ত; বেশ ভালোই ভিক্ষা পেত। সে কারো সাতেও নেই, পাঁচেও নেই—এটি বোধ হয় এর কারণ। এবং সে ছিল এই জটিলতাপূর্ণ পৃথিবীর একজন সহজ সুখী মানুষ।
বেশি ভিক্ষারও প্রয়োজন পড়ল না
সেবার গরম পড়ল খুব। সময়ের আগেই টসটস করে পাকতে শুরু করল আম-কাঁঠাল। বৃষ্টি হলো না একটানা দুমাস—তাপমাত্রা অতিক্রম করল অতীতের সমস্ত রেকর্ড। গ্রামের যুবক-যুবতীরা বাড়ি-বাড়ি চাল-ডাল তুলল আর গান গাইতে লাগল, ‘আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে, ছায়া দে রে তুই…’। সেই সময়টিতেও সে ছিল নির্বিকার। চারপাশের দেয়াল ভিজিয়ে জামাকাপড় খুলে উলঙ্গ হয়ে আরামসে ঘুমুতে লাগল সে।
সূর্য প্রখর থেকে প্রখরতর হতে লাগল। তার ওল্টানো বারোটি মুখের একটি আগে থেকেই খোলা ছিল, স্রষ্টা সম্ভবত আরও একটি মুখ খুলে দিলেন। এ অবস্থাতেও সুখী মানুষটির কিছুই গেল-আসলো না। সে ক্রমাগত দেয়াল ভেজাতে লাগল; তার ঘুম আরও দৃঢ় হলো। এখন সে আরও কম মাধুকরীতে বের হয়। ফলে তার ক্ষুধা কমে গেল। সুতরাং বেশি ভিক্ষারও প্রয়োজন পড়ল না।
সে সম্ভবত শুয়ে-শুয়ে শুধু মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। ওটি তা কাছে খুব ভয়ঙ্কর কিছু ছিল বলে মনে হয় না! কে জানে, সে হয়ত জানতই, একদিন এই কক্ষের ঘর ইট-বালুসমেত ভেঙে পড়বে; এবং তাতে তার কিচ্ছু যায়-আসে না। বরং সে বেশ আগ্রহ নিয়ে প্রস্তুত হতে লাগল মৃত্যুর ফেরেশতার জন্য, মৃত্যুর জন্য। সম্ভবত ঘুমই ছিল মৃত্যুর জন্য তার একমাত্র প্রস্তুতি।
দুই.
বিরান প্রান্তরে একলা পথ হারানো মৃত ঘোড়ার মতো পড়ে আছে এই এক কক্ষের হলুদ বাড়ি। এ বাড়ির ইতিহাস গ্রামের দুয়েকজন প্রাচীন বৃদ্ধই শুধু জানে। অন্যরা তেমন কোনো আগ্রহ দেখায়নি বলেই বোধ হয় তাদের কাউকে বলা হয়নি। সবাই ভাবে, এই বিরান প্রান্তরে একটা হলুদ বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে—থাকুক না! বাড়ির মধ্যে অকস্মাৎ আবির্ভূত হওয়া একজন মানুষ শুয়ে থাকে—থাকুক না! কার কী ক্ষতি তাতে? পৃথিবীতে একজন মানুষ আছে, এবং সে কারও ক্ষতি করছে না—তারচে উপকারী কোনো মানুষ থাকা সম্ভবই নয়!
তিন.
আচমকা কার মাথায় চিন্তাটা এলো—কে জানে। কেউ একজন হুট করে চাইল অলস মানুষটিকে বিয়ে দেওয়া হোক, বেচারা একা-একা শুয়ে থাকে! কে না জানে, শোয়ার জন্যই মানুষ সবচে বেশি সঙ্গীর প্রয়োজন বোধ করে! দুচারদিনের মাঝেই সংক্রামক ব্যাধির মতো সারাগ্রামে ছড়িয়ে পড়ল এই খবর।
একটা মুখ তারা চালাচ্ছে, আরেকটা মুখও কি চালাতে পারবে না? দুবছর পর দুয়েকটা শিশু এলে তা চালানোও খুব কষ্টের হবে না। তবু একটা ভালো মানুষ এখন না-হয় সুখী মানুষ হোক।
এখনো তারা যথারীতি ভিক্ষা দিয়ে গেল
কিভাবে কিভাবে যেন তারা মোটামুটি উপযোগী একটা মেয়ে জোগাড় করে ফেলল এবং পাঁচশ এক টাকা দেনমোহরে তাদের বিয়ে হয়ে গেলো। দেনমোহর নগদ দিয়ে দেওয়া হলো নববধূর হাতে! গ্রামবাসী নিজেরা নিজেরাই দিল। অনেকদিন বাদে বড় কোনো উৎসবে সবাই নিখাদ আনন্দ করল। প্রত্যেকে অল্প-অল্প করে কিছু ব্যবহার্য জিনিস এবং অর্থকড়ি উপহার দিল অলস মানুষের বিয়েতে। এতেও লোকটির কোনো বিকার দেখা গেলো না। সে পড়ে পড়ে ঘুমুতে লাগল। তার স্ত্রীও তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঘুমুতে লাগল। সম্ভবত তারও এসবে কিছুই যায়-আসে না। গ্রামবাসী তৃপ্ত হলো এই ভেবে যে, দুচার গ্রাম ঘুরে তারা তবে সম্পূর্ণ উপযুক্ত মেয়েই জোগাড় করেছে সরল মানুষটির জন্য। সে নিশ্চয়ই আরও বেশি সুখী মানুষে পরিণত হবে এবার!
বড় আনন্দে আছে তারা দুজন। একদিন সে আর একদিন তার স্ত্রী ভিক্ষাবৃত্তিতে বের হয়। তারা কী করছে না করছে এ নিয়ে গাঁয়ের লোকের কখনোই খুব মাথাব্যথা ছিল না, এখনো তারা যথারীতি ভিক্ষা দিয়ে গেল।
সেই যে অসহ্য গরম পড়েছিল কাঁটায়-কাঁটায় তার ঠিক দুবছর পরে তাদের প্রথম সন্তান জন্ম নিল। এই ছেলে শিশুটি স্রেফ তাদের মৈথুনের সাক্ষীই হতে পারত—কিন্তু এই ঘটনাটি গ্রামবাসীকে অন্য কিছু শিক্ষা দিল। বাচ্চা হওয়ার দুদিন বাদেই তারা দেখল লোকটি ভিক্ষাবৃত্তিতে নেমেছে। কিন্তু কখনোই যা হয়নি এই প্রথম সেটি ঘটল। মানুষটি দ্বিতীয় দিনও ভিক্ষায় নামল। তৃতীয় দিনও ভিক্ষায় নামতে দেখে সবাই বিস্মিত হলো। এত ঘন ঘন তাকে কখনোই দেখা যায়নি।
পরপর সাতদিন সে ঝোলা পরিপূর্ণ করে নিয়ে হলুদ বাড়িটিতে ফিরে গেল। একটি সাধারণ শিশু কতবড় পরিবর্তন আনতে পারে গ্রামের লোকজন এই প্রথম অনুভব করল। এবং এটিই তার প্রতি গ্রামবাসীর অনুভব করা প্রথম তুমুল বিস্ময়। সবাই দেখল অষ্টম দিনেও অলস মানুষটি ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বেরিয়েছে।
চার.
মানুষটি এই প্রথম কোনো ধরনের অস্থিরতা অনুভব করছে। কদিন ধরে আবার বৃষ্টি বন্ধ। সেই পুরনো দিনের মতো আবার যদি গরম পড়ে তাহলে কী হবে—এই চিন্তা তাকে রীতিমতো নাস্তানাবুদ করে ফেলল। নিজের ভেতরের পরিবর্তনগুলো সে এমনিতেই টের পাচ্ছিল, কিন্তু নিজেকে কখনোই এতটা অসহায় ও করুণ মনে হয়নি তার। এই প্রথম অসহায়ত্ব অনুভব করে শিউরে উঠতে বাধ্য হলো সে।
একজন ভালো ডাক্তার প্রয়োজন এই মুহূর্তে
খোলা প্রান্তরে সরাসরি সূর্যের আলো আসে। সমস্যা হলো সেই আলো সঙ্গে করে নিয়ে নামে বস্তা বস্তা তাপ। আগে হলে দেয়াল ভিজিয়ে চোখ বুঁজে পড়ে থাকত ঘরের এক কোণে। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়াল তার শিশুসন্তান। গরমে প্রচণ্ড কাঁদতে লাগল—সমস্ত প্রান্তর আর হলুদ বাড়ি কাঁপিয়ে। প্রাগৈতিহাসিক ভাঙা তালপাতা দিয়ে ক্রমাগত বাতাস করতে লাগল তার স্ত্রী। তাতে কতটা হয়, আর কতক্ষণই বা বাতাস চালিয়ে যাওয়া যায়! স্বামী-স্ত্রী পালা করে সন্তানকে বাতাস করতে লাগল। কিন্তু নতুন আরেক সমস্যা দেখা দিল। বাচ্চার সারাগায়ে র্যাশ উঠল—একপশলা বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পর রাতের আকাশে দেখা নক্ষত্রগুরোর মতো। গরমে পিঠ ঘেমে ঘেমে ঠাণ্ডাজনিত সমস্যা দেখা গেল। ক্রমশ বাড়তে লাগল জ্বর। শিশুটির মুখ স্তনে নিয়ে তার স্ত্রী কেঁপে উঠল—স্তন যেন গলে যাচ্ছে—এমন জ্বর! এই প্রথম তাদের দুজনকে একসঙ্গে দেখা গেল গাঁয়ের রাস্তায়। একজন ভালো ডাক্তার প্রয়োজন এই মুহূর্তে।
ডাক্তারের কাছ থেকে ওষুধ নিয়ে ফিরে আসতে আসতে রাত হয়ে এলো। রাতে শোয়ার সময় বিস্ময়করভাবে এই হলুদ বাড়ি নিয়ে আতঙ্ক অনুভব করল সে—যদি কোনো অবস্থায় এই আলগা ঘর ভেঙে পড়ে! যদি তাদের শরীরের ওপরেই ভেঙে পড়ে হলুদ রঙচটা দেয়াল! তারা দুজন মরে গেলে কারুরই কিছু যাবে আসবে না, কিন্তু এই শিশু যদি মরে যায়? এখনো এই পৃথিবীর কিছুই দেখা হলো না তাদের সন্তানের। তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিল সে—এই বাড়িতে আর না! কাল সকালেই অন্য কোথাও উঠবে। কাল থেকে আর ভিক্ষা নয়, কাজ খুঁজতে বের হবে সে।
পাঁচ.
ভাঙা হলুদ বাড়িটির আশেপাশে অনেকে জড়ো হয়েছে। সবাই বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। রক্তাক্ত দুই পুরুষ-রমণীর মাঝখানে হাত-পা ছুড়ে কাঁদছে একটি দেবশিশু। অদ্ভুত এই দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য এক জনমে সবার হয় না।