চৈত্র কিংবা ভাদ্রের দুপুর অথবা মাঘ-ফাল্গুনের বিকেলও হতে পারে। যেকোনো ঋতুর যেকোনো মাসে হৈমপাশা গ্রামের আলপথ, হিজলতলা বা আকন্দ বাড়ির দহলিজের সামনের জোড়া আমগাছের ছায়ায় ব্যাঞ্জোর সুর বেজে উঠলে এলাকার বয়স্ক থেকে শিশু—সবাই বুঝত জগনু হাওলাদার এসেছে।
পেশাদার বাদক না হলেও জগনুকে ব্যাঞ্জো ছাড়া সচরাচর কেউ দেখেনি। প্রথাগত ব্যাঞ্জোর চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে জগনুর ব্যাঞ্জোর তেমন কোনো মিল না থাকলেও সে একে ব্যাঞ্জো বলেই গ্রামের সবার কাছে পরিচিত করেছিল। জগনুর বয়স তখন কত? উনিশ-বিশ বড়জোর বাইশ। পাশের গ্রামের আপগ্রেড স্কুলে এক-দু’ক্লাস পড়েছিল কি না, সে কথা বলার মতো এলাকায় আজ আর তেমন কেউ নেই।
সত্যি বলতে সে তথ্য জানার আগ্রহ এ তল্লাটে কারও ছিল বলেও মনে হয় না। বরং সবার কৌতূহলের বিষয় ছিল ওই ব্যাঞ্জো। একতারা নয়, দোতারা নয় কোথা থেকে অদ্ভুত এক যন্ত্র জুটিয়ে তাই নিয়ে পড়ে আছে। কৃষকরা হাল দেওয়ার ফাঁকে গাছতলায় জিরিয়ে নিতে নিতে নিজেরা বলাবলি করতো—পোলাডার ভিডায় কোনোদিন লক্ষ্মী ওডবে না। ওই বেঞ্জু বাজাইতে বাজাইতে ও লালন ফকির অইয়া যাইবে। এই রহম অইলে বাপের ভিডাও বান্দা দেওয়া লাগবে। বেইচ্যা হালানও অসম্ভব না।
ঠিক এভাবে না বললেও গ্রামের বউ ঝি থেকে শুরু করে পাশের বাড়ির কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শাফাত আলী আকন্দের ছেলেমেয়ে এমনকী শিক্ষক শাফাত আলী নিজেও জগনুর ভবিষ্যৎ নিয়ে এর চেয়ে বেশি উচ্চাশা পোষণ করতে পারতেন না।
জগনুর বাবা মাগন হাওলাদার আটটি ছেলেমেয়ের বাবা হয়ে বড়টির পূর্ণ যৌবনে পৌঁছা ও ছোটটির কৈশোর পেরোনো পর্যন্ত অপেক্ষা না করেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে। বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে সে যখন নিশ্চিত হয়েছিল, এটাই তার শেষ শয্যা তখন একদিন শাফাত আলী আকন্দকে ডেকে বলেছিল, শাফাত, বহো ভাই। তোমার লগে দুগ্গা কতা কই। মোর চাইরপাশে আজরাইল ঘোরতে আছে। কোন সোময় জান্ কবচ কইর্যায় হালায়।
শাফাত আলী তাকে থামিয়ে দিয়ে তাড়াহুড়ো করে বলেন, না, না ভাই, এসব কী বলো, তুমি ভালো হয়ে যাবা।
—মুই আর ভালো অমু না ভাই। শ্যাষ কাডালে হেইয়ার লাইগ্যাই তোমার লগে কয়ডা কতা কইতে ইচ্ছা করতে আছে। ল্যাহাপরা গেয়ান-বুদ্ধি কোনডায়ই তোমার হোমান অইতে পারি নাই। তুমি গেরামের মাতা। গেরামের হগলডি আপদ-বিপদে তোমার পরামিশ হোনে। তোমার বাপের জমি-জিরাতও আল্লায় বাঁচাইলে তোমার পোলা মাইয়া নাতি নাতকুরে খাইয়া কুলাইত পারবে না, মোর তো আল্লার মাল আষ্টজন।
—এসব কথা এখন থাক না মাগন। তাকে আবার থামিয়ে দেন শাফাত আলী।
—না ভাই, কইতে দেও মোরে।
বলে আবার শুরু করে মাগন, ক্ষ্যাত-কোলার কতা নতুন কইর্যাই কি কমু বেবাকই তুমি জানো, বাপে জেডুক থুইয়া গেছিল কইতে গ্যালে হেডুকই আছে। হেইয়ার অরদেক আবার বরগা দিয়া থুইছি। টাইন্যাটুইন্যা সংসার চলে। মইর্যার গেলে মোর গুরাগারাগুলারে এট্টু দেইক্কো ভাই। তুমি ভস্সা দিলে মুই ইট্টু শান্তি পাই।
—আচ্ছা ঠিক আছে।
মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে হৈমপাশা এবং আশপাশের গ্রামের অনেকের সঙ্গে দেখা হলেও তার প্রায় সমবয়সী মাগন হাওলাদারের ছেলে লতিফের সঙ্গে তার দেখা হয়নি। অন্য মুক্তিযোদ্ধারাও দেখেছেন বলে মনে করতে পারেননি।
বলে মাগনকে শান্ত করেন শাফাত আলী। আবগে আপ্লুত মাগন অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলে—হিতানে মোউওত লইয়া আইজগো এট্টা সত্য কতা কই ভাই, তোমার হোমান অইতে পারি নাই দেইক্কা হারা জীবন তোমারে রিষ করছি। তোমার খেতি করবার লাইগ্যা চেষ্টাও কোম করি নাই। তয় তুমি ভাই ফেরেছতা। কোন দিন মুক কালা কইর্যাা কতা কও নায়। মোরে মাপ কইর্যা্ দিও ভাই। এটুকু বলে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছিল।
মৃত্যুশয্যায় ছেলেমেয়ের গার্জেনশিপের মৌখিক দায়িত্ব দেয়ায় শাফাত আকন্দ ভেতর থেকে দায় অনুভব করতেন। মাগনের বড় ছেলে লতিফের পড়ালেখার খোঁজ রাখা কিংবা পিতৃহীনতার সুযোগ নিয়ে ওদের জমি বেহাত হওয়া থেকে রক্ষা করা ইত্যাদি কাজ আন্তরিকতার সঙ্গেই করতেন তিনি। কিন্তু সময়ে বোঝা গেল পড়ালেখার চেয়ে লতিফের অন্যদিকে ঝোঁক বেশি এবং প্রতিবেশী চাচার দায়িত্বশীলতাকে শ্রদ্ধা করার মতো যথেষ্ট শিক্ষা তার নেই। শাফাত আকন্দের এ উপলব্ধি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজেকে গুটিয়ে নেন। মাগনের স্ত্রী গুলজান ছেলেমেয়ে নিয়ে সমস্যায় পড়ে সাহায্য চাইতে এলে সাধ্যমতো করতেন তিনি। তবে নিজ থেকে আর এগোননি। তার ছেলেমেয়েরা তখন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, মাগনের ছেলেমেয়েরা শাফাত আকন্দের ছেলেমেয়েদের প্রায় সমবয়সী হলেও পড়ালেখায় তাদের ধারেকাছে পৌঁছাতে পারেনি। ও বাড়ির সাংস্কৃতিক আবহই ছিল আশপাশের আর দশটা বাড়ি থেকে আলাদা। অক্ষমতার যে ঈর্ষা মাগন হাওলাদারকে পুড়িয়েছে, উত্তরাধিকার সূত্রে তা সঞ্চারিত হয়েছে তার ছেলেমেয়েদের মধ্যেও। যদিও বাইরে থেকে তা বোঝা যেত খুব কম সময়েই।
দুই.
হৈমপাশা গ্রামের আলপথে জগনুর ব্যাঞ্জো বাজিয়ে ঘোরাঘুরির বেশ ক’বছর আগে পশ্চিম পাকিস্তানিদের থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের যুদ্ধ শুরু হয়। করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার পাট চুকিয়ে শাফাত আকন্দের বড় ছেলে ইরতিজা আলী আকন্দ উনিশ শ’ একাত্তরের ফেব্রুয়ারি মাসে হৈমপাশায় ফেরেন। একা নন সস্ত্রীক। সহপাঠীকে বিয়ে করার খবর বাড়িতে আগেই জানিয়ে রেখেছিলেন।
তবু বাড়িতে যেদিন পা রাখেন সেদিন শাফাত আলীর মুখ খানিক থমথমেই ছিল। হানিমুনে যাওয়ার খরচ চাইতে হবে বাবার কাছেই। নইলে পাঞ্জাব কিংবা আজাদ কাশ্মিরে দিন পনেরো কাটিয়েই গ্রামে ফিরতেন ইবতিজা। পকেটের অবস্থা একেবারেই মর্মান্তিক হওয়ায় গ্রামে ফেরাকেই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করেছেন। স্নেহান্ধ বাবা বেশি দিন মুখ ঘুরিয়ে থাকতে পারবেন না সে বিশ্বাস তার ছিল। আর মা? মায়ের ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলেন। ছেলের সাত খুন তার কাছে মাফ। ইরতিজার মনে হয় তার মায়ের মতো মা পৃথিবী তোলপাড় করে দ্বিতীয় জন খুঁজে পাওয়া যাবে না। নতুন বউয়ের মুখ দেখে মা খুশি না হয়ে পারবেই না। সত্যি তাই। মা আর ভাইবোনদের উচ্ছ্বাসে বাড়িময় আনন্দের জলতরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে।
তবে দিনক্ষণ চূড়ান্ত হওয়ার পরও হানিমুনে তাদের আর যাওয়া হয়নি। তার বদলে ইবতিজা গিয়েছিলেন যুদ্ধে। নতুন বউ নিয়ে ভাইবোন-আত্মীয়স্বজনের উচ্ছ্বাসের ফাঁকে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে পঁচিশে মার্চ। মায়ের কান্নাভেজা চোখ আর বাবার করুণ নীরবতা সিদ্ধান্ত নিতে কিছুটা দেরি করিয়ে দিলেও শেষ পর্যন্ত সব পিছুটান ঝেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ইরতিজা। স্ত্রী বাধা দেয়নি বরং বলেছিল মন টানলে অবশ্যই তোমার যাওয়া উচিত।
মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে হৈমপাশা এবং আশপাশের গ্রামের অনেকের সঙ্গে দেখা হলেও তার প্রায় সমবয়সী মাগন হাওলাদারের ছেলে লতিফের সঙ্গে তার দেখা হয়নি। অন্য মুক্তিযোদ্ধারাও দেখেছেন বলে মনে করতে পারেননি।
তিন.
না, যুদ্ধে শহীদ হননি বিজয়ী হয়েই ফিরেছিলেন ইরতিজা আলী। অনেক স্বপ্ন নিয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন থানা সদর কলেজে। পাশাপাশি চলে উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতি।
যুদ্ধের সময় লতিফ হাওলাদার কোথায় ছিল তা নিয়ে কেউ তেমন মাথা না ঘামালেও যুদ্ধ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা ঘরে ফিরতে শুরু করলে লতিফের মা-ভাইবোনরা আশা করেছিল লতিফও একদিন কাক ভোরে দরজায় কড়া নেড়ে সবার ঘুম ভাঙাবে। কিন্তু মাসের পর মাস যায়। শেষে বছরও। তার বেঁচে থাকা নিয়ে পরিজনদের মনে সংশয় যখন ঘনীভূত তখন হঠাৎ একদিন ভরদুপুরে হৈমপাশায় দেখা যায় তাকে।
শাফাতের বাড়ি দেখাশোনা করার দায়িত্বে থাকা ইরতিজার গ্রাম সম্পর্কের গরিব চাচাত ভাই খলিল শুধু বলেছিল—দাদা, গাছগুলান কাইড্ডা হালাইতে আছেন ইত্তি দাদা গো এট্টু জিগাইলেনও না?
যুদ্ধের পর তার হঠাৎ পরিবর্তনটা সবার চোখে পড়ে। বড় দুলাভাই ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার ছিল বলে অথবা অজানা অন্য কোন কারণে রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে এলাকায় তৎপর দেখা যায় তাকে। ভীষণ ব্যস্ত তখন সে। রিলিফের চাল চিনি কম্বলের আশায় গ্রামের গরিবদের ছোটখাটো একটা দল প্রায় ছায়ার মতো লেপ্টে থাকে তার সঙ্গে। এদের চাপই যেন তাকে রাজনৈতিক নেতায় পরিণত করে। একদিকে চাল চিনি কম্বলের ওম অন্যদিকে ক্ষুধাতুর মানুষের নিঃশ্বাসের ওম—এ দুই তাপে সে কেবল বাড়তে থাকে। জনগণের চাপ সামাল দিতে বাড়ির সদরের দিকে কাছারি ঘর বানিয়েছে সে। শাফাত আলী আকন্দের দহলিজ এখন প্রায় ফাঁকাই থাকে। গ্রামের শিক্ষিত বিচক্ষণ ও সৎ বলে পরিচিত শাফাত আলীর প্রতি সাধারণের সম্মান ও শ্রদ্ধা আগের মতোই আছে। সময় অসময়ে তার পরামর্শ নিতেও আসে তারা। কিন্তু লতিফ কী করে যেন বড়সড় একটা দল নিজের পেছনে জুটিয়ে নিয়েছে। চাল চিনি কম্বলের গন্ধে মশগুল তারা। ওই গন্ধ আর নগদ টাকার জোড়ে রাতারাতি রাজনৈতিক নেতা বনে যায় লতিফ।
চার.
স্বাধীনতার পর বদলে যাওয়া দৃশ্যপটের সঙ্গে বদলে যায় হৈমপাশা গ্রাম। বছরের পর বছর লতিফের দাপট ক্রমশ বাড়ে। তার সমর্থিত রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতায় হৈমপাশাসহ আশপাশের আরও দুই-চার গ্রামে তার এবং তার অনুচরদের একক আধিপত্য।
সেবার ভোটের আগে ঢাকার এক সংস্কৃতিমনা রাজনৈতিক নেতা গ্রামের দুঃখী মানুষদের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে জগনুকে দেখে ফেলেন। তার মধ্যে তিনি সুপ্ত প্রতিভার সন্ধান পেয়েছিলেন। এলাকার প্রভাবশালী নেতা লতিফ হাওলাদারের ভাই হিসেবে পরিচিতি তো ছিলই। নেতা তাকে ভিজিটিং কার্ড দিয়ে ঢাকায় তার সঙ্গে দেখা করতে বলেন। জগনু গিয়েছিল। তিন দিন পর গ্রামে ফিরে এসে নির্বাচনে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিলে অনেকেই অবাক হয়েছিল। তবে হাজার হোক লতিফ মাতব্বরের ভাই বলে কথা! নির্বাচন তো করতেই পারে। কিন্তু কোন্ দল? লতিফের প্রতিদ্বন্দ্বী দল। অনেকে ভেতরে ভেতরে অবাক হলেও মুখে কিছু প্রকাশ করেনি। ভাইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বি ভাই! তাও জগনু! যে সারাক্ষণ ব্যাঞ্জো নিয়ে ঘোরে!
জোর ক্যাম্পেইন হয়েছিল। ব্যাঞ্জোবাদক জগনু প্রচারণার এত টাকা কোথায় পেয়েছিল তার সঠিক তথ্য জানা না গেলেও ঢাকার সেই লিডারের দুজন প্রতিনিধিকে হৈমপাশা গ্রামে তখন প্রায় নিয়মিত দেখা যেত। নির্বাচনের ঠিক দু’দিন আগে গোয়ালঘরের পেছনের তেঁতুলতলার ডোবায় লতিফের লাশ ভেসে উঠতে দেখে অনেক দিনের পোষা কুকুরটা ডুকরে উঠেছিল শুধু। লোকজন ভিড় করে দেখতে এসেছিল। পুলিশের বড় মাঝারি ছোট সব মাপের কর্তাই এসেছিলেন। লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছে, ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট তৈরি করেছে। কিন্তু কিছুতেই খুন-রহস্যের কিনারা করতে পারেনি। নির্ধারিত দিনে নির্বাচন হয়। জনতার দেয়া ফুলের মালা গলায় পরে জগনু হাওলাদার বিজয়ীর বেশে এলাকা প্রদিক্ষণ করেন।
পাঁচ.
প্রায় পঁচিশ বছর পর দেশে ফিরে ইরতিজা আলীর মনে হয় দেশের জিওগ্রাফিই বুঝি বদলে গেছে। এয়ারপোর্ট থেকে ধানমণ্ডি যাওয়ার পথ চেনাই যায় ন। দু’ধারের দৃশ্য এতটা বদলে গেছে ভাবতে পারেননি। পরিবর্তনের আসল চেহারা দেখলেন গ্রামে গিয়ে। বাবার শখের নকশা করা টিনের দোতলার ছাদের চূড়ায় কারুকাজ করা জোড়া ময়ূর ছিল এ গ্রামের ল্যান্ডমার্ক।
নীলগিড়া ইউনিয়ন থেকে মাইল দুই এগোলেই জোড়া ময়ূরের পেখম চোখে পড়ত। এখন কোথায় ময়ূর আর কোথায় বাড়ি! গ্রামের দিগন্ত বদলে দিয়েছে জগনু হাওলাদারের আধুনিক স্থাপত্যের দোতলা তিনতলার একাধিক বিন্যাস। সবার সব ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা প্রমাণ করে জগনুর ভিটায় এখন লক্ষ্মীর সাড়ম্বর অধিবাস। যারা ভিটেমাটি বন্ধক দেয়ার ‘কুচিন্তা’ করেছিল তাদের মধ্যে যারা মরে গেছে তারা বেঁচে থাকলে দেখত, সব ফর্মুলা সবার বেলা খাটেনা। আর যারা বেঁচে আছে তারা হাল দেয়ার ফাঁকে যেমন গাছের ছায়ায় বসে জিরিয়ে নিত তেমনি টিকে থাকার আশায় এখন জগনুর ছায়া খোঁজে। সেই জগনু যে হৈমপাশা গ্রামের সবুজ ধানক্ষেতের আল পেরিয়ে দিগন্তের দিকে হেঁটে যেত। যাকে দেখে কৃষকরা বলত ও একদিন লালন হবে।
এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পুরস্কার বিতরণী থেকে শুরু করে গ্রামে যে কোন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির আসনটি এখন অনিবার্যভাবে জগনু হাওলাদারের জন্য বরাদ্দ। পার্টির কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গ্রামের মানুষদের তার প্রতি সমীহ যোগায়। এলাকার মানুষের ধর্মকর্মের সুবিধার জন্য বাড়ির পশ্চিম সীমানায় বিশাল মসজিদ বানিয়েছে জগনু। যারা নামাজ পড়তে আসে তাদের অনেকেই জানে মসজিদের ভিত্তি নির্মাণের সময় শাফাত আকন্দের বিশাল ফলের বাগানের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশের গাছ কাটা পড়েছিল। কেউ প্রতিবাদ করতে আসেনি। শাফাতের বাড়ি দেখাশোনা করার দায়িত্বে থাকা ইরতিজার গ্রাম সম্পর্কের গরিব চাচাত ভাই খলিল শুধু বলেছিল—দাদা, গাছগুলান কাইড্ডা হালাইতে আছেন ইত্তি দাদা গো এট্টু জিগাইলেনও না?
যদিও মনে মনে জানতেন সে শক্তি খলিলের নেই। এর পরেরবার এসে হয়তো দেখবেন বসতভিটার দলিল-পর্চাও জগনুর হাতে।
চোখ পাকিয়ে তেড়ে এসেছিল জগনু—ইত্তি দাদাগো জিগামু মানে? হ্যাগো পামু কই। আর হ্যাগো ধারে জিগাইন্যা লাগবে কির লাইগ্যা? মোর ইচ্ছা অইছে কাটছি। মোর জাগার গাছ মুই কাটছি তোর বাপের কি?
বিস্মিত খলিল মিন মিন করে আবার বলে,
—আমনের জাগা মানে? গেরামের হক্কলডে জানে এইডা শাফাত কাকার বাগান, আমনের অইলো কবেইত্যা? শাফাত কাকার কবরের সামনে খাড়াইয়া এতবড় মিথ্যাকথা কইতে পারলেন?
—খলিল্যা তোর সাহস কোলম দিন দিন বাড়তে আছে। মোর মুহে মুহে তক্কো করো? মুই কইতে আছি মোর জাগা। এহেনে মুই মরছিদ বানামু। গ্রামের মাইনষে পাঁচ ওক্তো আল্লারে ডাকপে। তুইকি আল্লারেও ডরাও না!
আল্লাহর ভয়ে হোক আর জগনুর ভয়ে, এবার চুপসে যায় খলিল। তার সমর্থনে কেউ এগিয়ে আসে না।
নিজেদের জমির ওপর মসজিদ বানানো নিয়ে ইরতিজাও কথা বলেছিলেন জগনুর সঙ্গে। জগনু ভাবলেশহীন বলেছিল,
—ইত্তি দাদা, এই জমির দলিল পর্চা দ্যাকতে চাইলে দ্যাকতে পারেন, মালিকানা আমার নামেই।
স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া ইরতিজার করার কিছুই ছিল না। তার মনে পড়ে ছোটবেলায় লতিফ আর জগনু এ বাগানে তাদের সঙ্গে অনেক খেলেছে। একবার জামগাছের মগডালে উঠে জগনু আর নামতে পারে না। ওখানে বসেই চিৎকার-চেঁচামেচি। শেষে বাবা কোত্থেকে বিশাল এক মই এনে জগনুকে নামিয়েছিলেন। সে সব কথা কি জগনুর মনে আছে? জিজ্ঞেস করতে রুচি হয় না। ওই তো পাশেই মা-বাবার জোড়া কবর। অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ইরতিজার বুক চিরে।
বিশ-পঁচিশ বছর ধরে তারা তিন ভাই বিদেশে। দু’বোন নিজেরদের চাকরি, সংসার নিয়ে ব্যস্ত। শূন্য বাড়িতে তাদেরও আসা হয় না। ইরতিজা স্কলারশিপ নিয়ে ইউএসএ চলে গিয়েছিলেন। প্রথমে ভেবেছিলেন পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেবেন। যুদ্ধ করে যে দেশ পেয়েছেন তার জন্য কাজ করবেন। সত্যি বলতে, দেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়েই দেশ ছেড়েছিলেন তিনি। নিজেকে অধিকতর যোগ্য করে শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা ঢেলে দেবেন প্রিয় জন্মভূমিকে গড়ে তুলতে। কিন্তু দেশ যে এতো দ্রুত রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের দিকে বাঁক নেবে তা তার ভাবনার অতীত ছিল। দেশ নিয়ে হতাশা নাকি ওখানকার নিশ্চিন্ত জীবনের মোহ, কোনটার প্রভাব বেশি ছিল জানেন না ইরতিজা। তবে দেশে আর ফেরা হয়নি। মাঝে মাঝে দেশ ছেড়ে যাওয়ার অপরাধবোধে ভোগেন। স্মৃতিকাতর হন। কিন্তু বাস্তবতা এগোয় তার নিজের গতিতে। মা-বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে দু’বার এসেছিলেন দেশে। বাকি দুই ভাইয়ের অবস্থাও একই। একজন কানাডার অন্যজন অস্ট্রেলিয়ার সিটিজেনশিপ নিয়ে ওখানেই স্থায়ী। বাবারা ছিলেন তিন ভাইবোন। দু’বোন-এক ভাই। চাচা নেই, ফুফাত ভাইয়েরা মামাবাড়ির ব্যাপারে নাক গলাতে আগ্রহী নয়। বিশেষ করে জগনু হাওলাদারের দাপটের কথা তাদের জানা আছে। গায়ে পড়ে শত্রুতায় জড়াতে চায় না। ইরতিজা আলী যে ক’দিন বাড়িতে ছিলেন খলিল দেখাশোনা করেছে। যাওয়ার সময় খলিলকে বলেছিলেন,
—বাপের ভিটাটা যেন থাকে, দেখিস খলিল।
যদিও মনে মনে জানতেন সে শক্তি খলিলের নেই। এর পরেরবার এসে হয়তো দেখবেন বসতভিটার দলিল-পর্চাও জগনুর হাতে।