হঠাৎ করেই আশ্চর্য এক দুপুর নেমে এসেছে শাহজাহান মিয়ার জীবনে। এই দুপুর তার সকাল, সন্ধ্যা আর রাতটাকেও বিবর্ণ করে তুলেছে। গলায় কাঁটা আটকে গেলে সহজে ঢোক গেলা যেমন যায় না, খেতে অসুবিধে হয়! অসহ্য অনুভূতিতে ছটফট ছটফট, কখন গলা থেকে কাঁটা নামবে? শাহজাহান মিয়ারও হয়েছে তাই, দুপুরটা গলায় কাঁটা হয়ে যেন দম আটকে রেখেছে। রোজ দুপুরেই কেন বুকে ব্যথা ওঠে, চিন্তায় চিন্তায় দিন ভালো কাটে না তার। রাতে ঠিকমতো ঘুমও হয় না। বিষয়টি এত দিন কাউকে না বললেও গেল শুক্রবার দুপুরে বুকে মাত্রারিক্ত ব্যথা টের পেয়ে তৎক্ষণাৎ স্ত্রীকে খুলে বলে সব। স্ত্রীর পরামর্শে তখনই তারা ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়। ডাক্তার হন্তদন্ত হয়ে অনেকগুলো টেস্ট করিয়েও কোনো অসুখ খুঁজে পায়নি, ভিজিট ১০০০ টাকা হালাল করতেই কি না কে জানে, প্রেসক্রিপশনে গ্যাস্ট্রিক, ব্যথা আর কিছু ঘুমের ওষুধ লিখে তাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। ক’দিন নিয়ম করে ওষুুধগুলো খেলেও ব্যথার কোনো উন্নতি হয়নি বুঝে যারপরনাই হতাশ শাহজাহান মিয়া। গাদা গাদা ওষুধ খেতে এখন আর ভালো লাগে না তার।
আজ দুপুরে খাওয়ার আগে সে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায়। শার্টের বোতামগুলো খুলে বুকের ওপর তর্জনী রাখে। ধীরে ধীরে খোঁজে কোথায় ব্যথা। না পেয়ে বুকের রানওয়েতে যেন বিমান উড্ডয়নের আগ মুহূর্তের গতিতে তর্জনী চালায়। হঠাৎ নজর পড়ে বুকের পা পাশে জোঁকের মতো কামড়ে ধরা বহুদিনের পুরনো কাটা দাগে। মুহূর্তেই মনে পড়ে ছোটবেলার সেই ঘটনার কথা। সেদিন কলাগাছের ভেলায় উঠতে গিয়ে চৌকা করে কাটা বাঁশের মাথায় লেগে ফেড়ে গিয়েছিল বুকের বাঁ পাশ, ‘তবে কি এত বছর আগের ব্যথা নতুন করে জাগান দিচ্ছে!’ বিড়বিড় করে বলে, ‘না! তা কী করে হয়!’ একাই হাসে। মনে পড়ে ছোটবেলার বন্ধুদের কথা।
অমনি ধপাস করে কীসের একটা বাড়ি লাগে শাহজাহান মিয়ার বুকে। ভেতরে দ্রিম দ্রিম শব্দ হচ্ছে টের পেয়ে আয়নায় কান পাতে।
বুকের ওপর এত বড় ফাড়া বন্ধুদের সাথে দুষ্টুমি করতে গিয়েই পেয়েছিল। তখন ৮৮-এর বন্যা। কলাগাছের ভেলায় চড়ে বন্ধুরা মিলে বিলে শাপলা তুলতে যাবে। কিবরিয়া, পলাশ উঠে গেছে। পেছনে তাকিয়ে দেখে জয়নাল, আসগর আসছে। ভেলায় জায়গা হবে না, তাই তাড়াহুড়া করে উঠতে যায় শাহজাহান মিয়া, অমনি গাছগুলোর মাঝ বরাবর ঢোকানো বাঁশের কি বেরিয়ে থাকা চৌকা মাথায় লেগে বুক ফেড়ে যায় তার। বাড়ি ফিরে পরনের লুঙ্গি দিয়ে কাটা জায়গাটুকু লুকিয়ে ঘরের এক কোণে চুপচাপ বসে থাকে, মা দেখলে বকা দেবেন সেই ভয়ে।
আরো অনেক কিছু মনে পড়ে শাহজাহান মিয়ার। বাড়ির পাশে প্রিয় কালী নদীতে গোসল করার আগে বালু খুঁড়ে খুঁড়ে গর্ত করা, গর্তের ভেতর পরনের জামাকাপড় খুলে রেখে আবার বালু দিয়ে ঢেকে রাখা। ন্যাংটো বন্ধুরা সবাই লে র ছাদে বসে অপেক্ষা করত কখন ল ছাড়বে আর নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়বে। তারপর সাঁতরে পাড়ে এসে ফের গর্ত খুঁড়ে জামাকাপড় তুলে ভেজা গা আর টকটকে লাল চোখে সোজা বাড়ির পথে হাঁটা।
একবার হলো কি, সবার হাফপ্যান্ট পাওয়া গেছে, শাহজাহান মিয়ারটা নেই। কে নিল! কে নিল! কেউ স্বীকার করে না। তাদের সর্বকনিষ্ঠ বন্ধু লালুকে টিপটিপ হাসতে দেখে বোঝে লালুই লুকিয়েছে। সেদিন হাফপ্যান্ট ফিরে পেতে লালুকে কত কী খাওয়াতে হয়েছিল। কটকটিও।
কটকটি নিয়েও কি কম স্মৃতি আছে! কখন কটকটিওয়ালা আসবে তার অপেক্ষায় পুরনো লোহালক্কড়, টিন, বাটিঘাটি, ছেঁড়া স্যান্ডেল যত্ন করে রেখে দিত। বাড়ির বাইরে টং টং বেল বাজছে শুনলেই জমিয়ে রাখা পুরনো সেই জিনিসপত্র নিয়ে দৌড়। বাইরে গিয়ে দেখত কাঁধে ঝোলানো পাতি ভরে কটকটি নিয়ে কটকটিওয়ালা হাজির। দুই রকমরে কটকটি থাকত পাতিতে। দুধ-চিনি মেশানো দেখতে লম্বা লাঠি কটকটি, আরেকটা গুড়ের, আহা! কী যে সুস্বাদু ছিল সেই কটকটি। বিড়বিড় করে বলে শাহজাহান মিয়া।
কত বছর হলো বন্ধু লালুকে দেখে না। একবার তারা বাড়ি থেকে পালিয়েছিল। শাহজাহান মিয়া তখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে, লালু প ম শ্রেণি। ময়মনসিংহের উদ্দেশে ভৈরব থেকে ছেড়ে আসা লোকাল ট্রেনে চড়ে দুজন পালিয়ে যায়। ট্রেনটা খুব ভোরে আসত, তাই মানুষের মুখে মুখে ভোরের ট্রেন নামটাই রটে গেল। সেদিন পালিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল ট্রেনে যেতে যেতে গান শুনবে। বৃহত্তর ময়মনসিংহে তখন মেরাজ বাউলের খুব নাম। বাউল চোখে দেখতেন না ঠিকই, মন দিয়ে বুঝতেন সব। ট্রেনের এ বগি ও বগি ঘুরে ঘুরে গান গাওয়াই ছিল তার পেশা। একটা করে গান গেয়ে কিছুক্ষণ গপ্প করতেন। যাত্রীদের অবাক করে অনায়াসে বলে দিতে পারতেন তাদের মনের কথা। শাহজাহান মিয়াকে একদিন বলেছিলেন, ‘তোর শরীরে পিরিতের বাতাস ভর করছে রে, বেটা। পিরিতে পড়া খুবই ভালা। পিরিতে পড়লে পরান পরিষ্কার থাহে।’
কথাটা শুনে সেদিন খুব লজ্জা পেয়েছিল শাহজাহান মিয়া। সত্যিই তখন সে প্রেমে পড়েছিল। স্কুলে তার এক ক্লাস ছোট মেয়েটির প্রেমে ভীষণ হাবুডুবু খাচ্ছিল। কিন্তু কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিল না বাউল কী করে তার মনের কথা জানে! মেয়েটি আর বাউলের কথা মনে পড়ে শাহজাহান মিয়ার মুখে মৃদু হাসি। আয়নার ভেতর হাসিমুখটায় দেখছে ইস্ত্রি করা ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি পরে দোতারা হাতে বাউল দাঁড়িয়ে। বলছে, ‘কিরে! বুকের মইধ্যে ব্যথা? তুই তো জবর সহজ-সরল মানুষ, তোর আবার ব্যথা হইল ক্যামনে?’
‘আমি কি জানি! বাউল, কেন আমার বুকের ভেতর চিনচিন ব্যথা করে? একদিন যেমন করে বলছিলে স্কুলে এক ক্লাস ছোট মেয়েটা আমার পরানের ধুকপুক, তেমন করে আজকেও বলে দাও দেখি বুকের ভেতর চিনচিন ব্যথা কেন করে?’
শাহজাহান মিয়া শুনতে পায় তার স্ত্রী ডাকছে, ‘কই, আসো, টেবিলে খাবার দিয়েছি। তাড়াতাড়ি খেতে আসো।’
‘আসছি’ বলে আবার বাউলের কাছে ফিরে আসে,‘এত দিন পর আবার কোত্থেকে এলে, বাউল? মনে আছে! তোমার গান শুনব বলে বন্ধু লালুকে নিয়া একদিন ভোরের ট্রেনে চড়ে বসলাম? ইঞ্জিনের পাশের কামরায় তুমি গলা ছেড়ে একটার পর একটা গান গাইছ আর গানে মজে গিয়ে আমরা কিশোরগঞ্জ ছাড়িয়ে নীলগঞ্জ চলে গেলাম? সেদিন ভোরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে কত রাত করে বাড়ি ফিরেছিলাম জানো! আমার ওই এক ক্লাস ছোট মেয়েটির কপালের কালো টিপের মতো ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে বাড়ি ফিরে দেখি আব্বা লাঠি হাতে বসে আছেন। আমাকে দেখেই তেড়ে এসে বুকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো কেঁদে বলেন, কই হারাইয়া গেছিলা, বাজান?’
বাবার কথা মনে পড়ে গলা ভিজে ওঠে শাহজাহান মিয়ার। মানুষটা কখনো ফুলের টোকাও দেয়নি তার শরীরে। বাজান বাজান বলে আদরে একেবারে ভাসিয়ে দিতেন। কত দিন হলো বাবাকে দেখে না। অনেক বছর হলো গ্রামেও যায় না সে। শেষবার গিয়েছিল স্কুল থেকে তার ম্যাট্রিক পরীক্ষার সনদ তুলতে। তাও ২০ বছর আগে। গ্রামের সব পাঠ চুকিয়ে এখন ঢাকাতেই থিতু। ভাবে, একবার বাড়ি যাবে। লালুর খোঁজ করবে। কালী নদীতে গোসল করবে। বাউল বেঁচে থাকলে তাকে সঙ্গে নিয়ে আবার তারা গান করবে। আবার বন্ধুরা মিলে পোস্ট অফিসের সামনে গিয়ে ফুলবানুর পথ আটকে দাঁড়াবে, অমনি ধপাস করে কীসের একটা বাড়ি লাগে শাহজাহান মিয়ার বুকে। ভেতরে দ্রিম দ্রিম শব্দ হচ্ছে টের পেয়ে আয়নায় কান পাতে। পাশাপাশি বুক আর কান মিলেমিশে একাকার হলেও বুঝতে পারে না হঠাৎ এমন অস্বস্তিকর, অসহ্য ব্যথা কেন! তবে কি ফুলবানুই…!
সাথে সাথেই স্ত্রীর মোবাইলে কল, হ্যালো, বলছি একটা খুব জরুরি কাজে এক্ষুনি আমায় গ্রামে যেতে হচ্ছে। ফিরতে দু’দিন দেরি হবে।
৩০ বছর আগের কতগুলো দুপুরের কথা মনে পড়ে তার, সেই দিনগুলোর কৃতকর্মের অপরাধবোধই কি আজকের এই ব্যথা! নিশ্চিত হতে শাহজাহান মিয়া মনো বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
দুই.
সেই সময়ের সামান্য ঘটনা শুনে ডাক্তার জিজ্ঞেস করেন, ফুলবানু এখনো বেঁচে আছেন?
আমি ঠিক জানি না।
এই ৩০ বছর সব কিছু ভুলে ছিলেন?
হ্যাঁ। ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। এসএসসি পাস করে ঢাকায় চলে আসি লেখাপড়া করতে। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে এখানেই থেকে যাই। ব্যবসা-বাণিজ্য করছি।
এত বছরে একবারও ফুলবানুর কথা মনে পড়েনি?
তেমনভাবে মনে পড়েনি কখনো।
এর মধ্যে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন?
শেষ ২০ বছর আগে গিয়েছি।
আপনার বাবা-মা…
বেঁচে নেই।
আপনি বিবাহিত নিশ্চয়?
হ্যাঁ।
কত দিন হলো বিয়ে করেছেন?
১৫ বছর।
ছেলে-মেয়ে?
একটিমাত্র মেয়ে আমাদের। পরি নাম।
বাহ্! খুব সুন্দর নাম।
ধন্যবাদ।
বলছিলেন ব্যথাটা দুপুরে খাওয়ার পরপরই হয়।
হ্যাঁ।
ফুলবানুর সাথে দুপুরে কোনো ঘটনা আছে?
প্রতিদিনের ঘটনাই দুপুরের। দুপুরে খেয়ে কখনো ঘুমাতাম না। কখন দুইটা বাজবে অপেক্ষা করতাম। স্কুল না থাকলে মা নিজের হাতে আমায় খাইয়ে শুইয়ে দিতেন, তাও ঘুমাতাম না। একটু পর পর দেয়ালঘড়ি দেখতাম। আমার দাদার কেনা পুরনো দেয়ালঘড়িতে ঢং ঢং করে দুটো শব্দ হলেই বুঝতাম দুইটা বেজে গেছে, অমনি শোয়া থেকে উঠে দৌড়।
দৌড়ে কোথায় যেতেন?
পোস্ট অফিসের সামনে। দুইটার সময় ওই পথ দিয়ে ফুলবানু আসতেন।
কোথা থেকে আসতেন?
তা তো জানি না। তার এক হাতে ঝাড়ু থাকত, অন্য হাতে পাতি।
পাতি!
হ্যাঁ। রাস্তাঘাট ঝাড়ু দিয়ে গাছের শুকনো পাতা জমিয়ে পাতি ভরে সেগুলো নিয়ে আসতেন। পাশাপাশি লাকড়িও কুড়াতেন। শুনেছি সকাল থেকে ঘুরে ঘুরে কিছু শুকনো পাতা আর লাকড়ি পেলেই কেবল চুলোয় হাঁড়ি বসত তার। মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরে সামান্য চাল, ডাল জুটলেও লাকড়ি কেনার মুরোদ ছিল না মোটেও।
ফুলবানুর স্বামী-সন্তান…
দুই ছেলে। একজনও রোজগার করত না। ফুলবানুর স্বামী ছেলে দুটোকে ছোট রেখেই ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যান। প্রবল অভাব-অনটনে বড় হওয়া ছেলে দুটো নেশাপানি করে যেখানে-সেখানে পড়ে থাকত। কোনো কোনো দিন বাড়িতে রাত কাটাতে এলেও মায়ের ভালোমন্দ জানতেও চাইত না তাদের কেউই। ছেলেদের আশা না করে ফুলবানু তাই ভিক্ষা করেই নিজের ভরণ-পোষণ করতেন। সকালে খালি পেঠে বাড়ি থেকে বেরিয়ে দুপুর অবধি ঘুরে যা কিছু পেতেন তাই নিয়ে আবার বাড়ির পথে রওনা হতেন। রোজ দুপুরে তাকে পোস্ট অফিসের সামনে পেতাম। সেখানে তার পথ আটকে দাঁড়াতাম।
পোস্ট অফিসের সামনেই কেন?
কারণ পোস্ট অফিস পার হয়েই ঝোপঝাড় ঘেরা নির্জন ছিল জায়গাটা। জরুরি দরকার না হলে মানুষজন খুব একটা আসত না ওদিকে।
আপনি একাই ফুলবানুর পথ আটকে দাঁড়াতেন?
না, বন্ধুরাও থাকত। সবাই মিলেই…
ঠিক আছে, বুঝতে পেরেছি।
কী বুঝতে পেরেছেন, ডাক্তার?
আচ্ছা! ফুলবানু কখনো নালিশ করেনি কারো কাছে? মানে আপনাদের পরিবারের কাউকে, কিংবা গ্রামের মেম্বার-চেয়ারম্যানের কাছে?
না, কখনো নালিশ করেননি। তবে গালিগালাজ করতেন।
কী গালিগালাজ করতেন?
গোলামের ঘরের গোলাম, পুংডার দল। তোরা জ্বইলাপুইড়া আংলার হইয়া যাইবিÑএ রকম আরো আছে। আমার কী মনে হয় জানেন, ডাক্তার?
কী মনে হয়?
ফুলবানুর সেই অভিশাপেই জ্বলেপুড়ে মরছি।
না, ব্যাপারটা সে রকম কিছু নয়।
তাহলে কী রকম?
বলছি আপনি একবার গ্রামে যাবেন? ঘুরে আসুন না! ফুলবানুর খোঁজ-খবর নিলেন। গ্রাম থেকে ফিরে আসার পর না হয় আমরা আবার বসব, আরো কথা বলব।
ডাক্তারের কথাটা শাহজাহান মিয়ার মনে ধরে। মৃদু হেসে সে চেয়ার ছেড়ে ওঠে। চেম্বার থেকে বেরিয়ে তরতর করে হাঁটে গাড়ির দিকে। স্টিয়ারিংয়ে বসে সিদ্ধান্ত নেয় গ্রামে যাবে। আজ, এখনই। ফুলবানুকে খুঁজে বের করবে। ৩০ বছর আগের ঘটনার জন্য ক্ষমা চাইবে তার কাছে। ফুলবানু ক্ষমা করলেই কেবল বুকের ব্যথাটা কমবে বলে মনে হয় শাহজাহান মিয়ার। সাথে সাথেই স্ত্রীর মোবাইলে কল, হ্যালো, বলছি একটা খুব জরুরি কাজে এক্ষুনি আমায় গ্রামে যেতে হচ্ছে। ফিরতে দু’দিন দেরি হবে।
তিন.
গ্রামে এসে শাহজাহান মিয়ার বিস্ময়ের শেষ নেই। কোথায় তার সেই গ্রাম! এ যে মিনি শহর। পোস্ট অফিস আর আগের পোস্ট অফিস নেই। পোস্ট অফিস পেরিয়ে সেই নির্জন জায়গায় এখন সারি সারি মোবাইল অ্যাকসেসরিজ আর রেডিমেড কাপড়ের দোকান। মানুষের ভিড়ে কোলাহলের অন্ত নেই। ছোটবেলায় বাড়িতে যে ঘরটিতে শাহজাহান মিয়া থাকত, সেই ঘরের জানালা দিয়ে পোস্ট অফিস দেখা যেত। জানালায় বসে কত দেখেছে সে ছেলে-বুড়োরা ডাকবাক্সে চিঠি ফেলছে। এখন পোস্ট অফিসের চারদিকে দেয়াল। তাদের সেই বাড়িও আর নেই। বাপের ভিটেবাড়িটি বিক্রির সময় ছিল টিন আর কাঠের তৈরি। টিনের চালের ওপর আমগাছের ডালে বসে শাহজাহান মিয়া আম পেড়ে খেত। কোথায় তার সেই আমগাছ! এখন এখানে বিরাট দালান। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছোটবেলার স্মৃতি রোমন্থন করে শাহজাহান মিয়া। মা-বাবার কথা ভাবে। এখানে এই দালানের জায়গাটিতেই তার মায়ের মুরগির খোঁয়াড় ছিল।
হঠাৎ দ্রুত ব্রেক কষে গাড়িটা থামায় শাহজাহান মিয়া। টের পায় বেলা গড়িয়ে দুপুর হতেই ব্যথাটা বাড়ছে আর কুঁকড়ে উঠছে সে।
প্রতিদিন সন্ধ্যায় সে বাইরে থেকে মুরগি ধাওয়ায়ে এনে খোঁয়াড়ে ভরত। এসব ভাবতে ভাবতেই লালুদের বাড়িতে আসে। এসে শোনে লালু নেই। অনেক বছর হলো সৌদি আরব চলে গেছে। গ্রামে থেকে অনেক কিছু করার চেষ্টা করেছিল লালু, পারেনি। অগত্যা সংসার বাঁচাতে তাকে বিদেশে পাড়ি দিতে হয়। লালুর মা-বাবা এখনো বেঁচে আছেন। শাহজাহান মিয়াকে দেখে আবেগাপ্লুত হন তারা। লালুর বড় ছেলে রুহুল বাবাকে ভিডিও কল দিয়ে শাহজাহান মিয়াকে দেখায়। এত বছর পর বন্ধু শাহজাহান মিয়াকে দেখে লালু কেঁদে ফেলে। তাকে হাউমাউ করে কাঁদতে দেখে শাহজাহান মিয়ার চোখও জলে ভরে ওঠে। ফুলবানুর কথা জানতে চাইলে লালুর বাবা বলেন, ফুলবানু বাঁইচা নাই। বয়সের ভারে কাবু হইয়া পাঁচ বছর আগেই মইরা গেছে। মরার আগে অনেক কষ্ট করছে বেচারি, না খাইয়া থাকছে, মানুষের অনাদর, অবহেলা আর বিনা চিকিৎসায় ধুঁইকা ধুঁইকাই মরল।
ফুলবানুর দুই ছেলের কেউই মাকে দেখভাল করেনি, চাচা?
না, বড় ছেলে আব্বাস মিয়া বউ নিয়া আলাদা থাকত, ছোড ছেলে হানিফ ফুলবানুর সাথে থাকলেও মারে দুই চোক্ষে দেখতে পারত না। হানিফের বউয়েরও চোক্ষের বিষ আছিল ফুলবানু।
কেন চাচা, পেঠের ছেলে মাকে দেখতে পারত না কেন?
কইত হের মা নাকি অপয়া, নষ্ট মেয়েছেলে আছিল।
শাহজাহান মিয়ার বুকের ভেতরটায় ছ্যাৎ করে ওঠে। একটা অসহ্য ব্যথা ঠেলে ঠেলে তার বুকের পাঁজরগুলো যেন ভেঙে ভেঙে দিচ্ছে। জীবনে কোনো দিন এত তীব্র যন্ত্রণা হয়নি তার। এ বড় নিষ্ঠুর যন্ত্রণা। সহ্য করতে না পেরে ছোট্ট শিশুর মতো হাউমাউ করে কাঁদে সে। ৩০ বছর আগের ফুলবানুর সেই জীর্ণশীর্ণ চেহারা ভেসে ওঠে চোখে, ফুলবানু এক হাতে ঝাড়ু, অন্য হাতে পাতি কোলে নিয়ে হেঁটে আসছে আর বন্ধুদের সাথে নিয়ে ফুলবানুর পথ আগলে তার পিছে পিছে দল বেঁধে তারা ‘সংগ্রাম সংগ্রাম’ বলে হল্লা করছে। শুনে ফুলবানু সমানে গাল দিচ্ছে, শুয়োরের পাল, গোলামের ঘরের গোলাম, তোরা মইরা নাশ হইয়া যাইবি, জ্বইলা যাইবি, পুইড়া যাইবি।
শাহজাহান মিয়ার মুখে গালি শুনে লালুর বাবা জিজ্ঞেস করেন, কী হইছে বাবা, কারে জ্বইলা যাইবি, পুইড়া যাইবি কইতাছ? ফুলবানুর দুই পোলারে? তাগো গালিগালাজ কইরা কী হইব, অভিশাপ দিয়াও লাভ নাই। বউ-বাচ্চা নিয়া তারা ভালোই আছে।
না গো চাচা, ভালো নাই। বুকের ভেতর টনটন ব্যথা। বহুত খতরনাত এই ব্যথা। মারে না, কিন্তু বারবার মইরা যাইতে হয়। সংগ্রামের ৫০ বছর পরে এই ব্যথা আমাকে অনেক কিছুই চেনাল। অনেক দেরি হয়ে গেছে গো চাচা, অনেক দেরি, এই বলে শাহজাহান মিয়া কিছু একটা ভাবে।
কি মিয়া! কী ভাবতাছ?
কিছু না, চাচা।
৪.
ঢাকায় ফেরার পথেও ফুলবানু পিছু ছাড়ছে না শাহজাহান মিয়ার। ফুলবানুকে ঘিরে কত কী মনে পড়ছে তার। অনেক পরে সে জেনেছে সংগ্রামের সময় স্থানীয় দোসররা ফুলবানুকে হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। টানা তিন মাস তারা ফুলবানুকে ক্যাম্পে আটকে রেখে ধর্ষণ করে। দেশ স্বাধীন হলে ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়ে সেখান থেকে ছাড়া পায় ফুলবানু। স্বাধীন দেশে একদল কিশোর ফুলবানকে ক্ষ্যাপাতে তার পথ আটকে বলতো, সংগ্রাম সংগ্রাম। সংগ্রামের সময় নিজের ভয়াবহ স্মৃতির কথা মনে করে ফুলবানু তখন ক্ষিপ্র হয়ে গালাগাল করতেন, ধ্বংস হইয়া যাবি, জ্বইলা যাবি, পুইড়া যাবি।
হঠাৎ দ্রুত ব্রেক কষে গাড়িটা থামায় শাহজাহান মিয়া। টের পায় বেলা গড়িয়ে দুপুর হতেই ব্যথাটা বাড়ছে আর কুঁকড়ে উঠছে সে।