রিকশায় যাত্রী তোলার পর থেকেই মনটা খচ-খচ করছে জামালুদ্দীনের। নিউমার্কেট থেকে রায়ের বাজার একশ টাকা ভাড়া চাইলো। তবু লোকটা উঠে গেলো! নিশ্চয়ই লোকটার তাড়া ছিল। আরও বেশি ভাড়া চাইলেও লোকটা দিতো।
নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য আফসোস হতে লাগলো। সে ধীরলয়ে প্যাডেল ঘোরাতে ঘোরাতে কী করে যাত্রীর কাছ থেকে বাড়তি টাকা আদায় করা যায়, ভাবতে লাগলো।
রিকশায় চড়ে মারুফ বারবার মোবাইলে সময় দেখছে। সে একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করে। প্রতিদিন রাত দশটার আগে বাসায় ফেরা হয় না। তার বউ নূরজাহান প্রেগন্যান্ট। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। বাসায় এগারো-বারো বছর বয়সী কাজের মেয়েটা ছাড়া আর কেউ নেই। এতদিন নূরজাহানের মা ছিলেন। ডাক্তার বলেছে ডেলিভারির সময় আরও পরে। তিনি তাই গতকালই দুদিনের জন্য গ্রামের বাড়ি গেছেন। ওখানে নূরজাহানের ছোট ভাই-বোন ও বাবা আছেন।
স্ত্রীর হঠাৎ অসুস্থতার খবর পেয়ে মারুফ আর দেরি করেনি। ছুটি নিয়ে দ্রুত অফিস থেকে বেরিয়ে পড়েছে। তীব্র যানজট। তাই নিউমার্কেটের কাছে বাস থেকে নেমেই রিকশা নিয়েছে। ঝিগাতলা হয়ে দ্রুত রায়েরবাজার পৌঁছে যাবে।
কিন্তু রিকশাঅলার চালানোর ভঙ্গি দেখে তার অস্থিরতা বাড়তে থাকে।
ভাই একটু তাড়াতাড়ি চালান। সিগন্যালটা পার হয়ে যান। নইলে তো আটকে পড়বেন।
তবে, মনে মনে সে যে মারুফকে নিয়ে সন্ধ্যার পর একটু বের হতে চায়, একটু ছাদে বসতে চায়, একটু কাছের পার্কটাতে যেতে চায়, সেটা সেও বোঝে
মারুফের কথায় জামালুদ্দিন কোনো সাড়া দেয় না। সে আপন গতিতে চলতে থাকে। মারুফ আবারও তাড়া দিতেই জামালুদ্দীন খেঁকিয়ে ওঠে, এত তাড়া থাকলে রিকশায় উঠছেন ক্যান? পেলেনে গেলেই পারতেন। আমি মানুষ, মোটরগাড়ি না।
রিকশাঅলার ঝাড়ি শুনে হতভম্ব হয়ে যায় মারুফ। যাহ্ বাবা! আমি এমনকী বললাম। অবাক হয়ে চুপ করে থাকে।
জামালুদ্দীন মনে মনে ভাবতে থাকে, বেশি ভাড়া নেওয়ার কৌশল। এবং পেয়েও যায়। ঝিগাতলা দিয়ে না ঢুকে যানজটটাকে কাজে লাগিয়ে রিকশাটা কোনোভাবে মোড় পেরিয়ে যেতে পারলেই পনেরো নম্বর ছাড়া রায়ের বাজার যাওয়ার আর সহজ পথ নেই। আর সেই পথটা বেশি। এই যুক্তি দিয়ে বেশি ভাড়া আদায় করা কঠিন কিছু না। আর মারুফকে দেখে হাবাগোবা সাধারণ মানুষ বলেই মনে হচ্ছে। জামালুদ্দীনও নিজের বুদ্ধিটাকে কাজে লাগায়। ঝিগাতলার মোড়ে আসার আগেই সে কৌশলে ডানে চলে যায়। ফলে যানজটের জন্য আর ঝিগাতলায় ঢুকতে পারে না। জাপান-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল পেরোনোর পর মারুফ রাগি গলায় প্রশ্ন করে, এদিকে আসলা ক্যান? তোমাকে না বললাম ঝিগাতলা হয়ে যেতে?
রিকশাঅলা বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে দ্বিগুণ দৃপ্তকণ্ঠে বললো, আপনে কি চোখে জ্যাম দেখেন না? নিজের মনে চাইলো আর রিকশা এদিক ওদিক ইচ্ছামতো ঘুরাইলাম। এত সহজ নাকি! সারজেনে ধরলে জরিমানা কে দেবে? আপনে? কথাগুলো বলে জামালুদ্দীন আবার রিকশা টানতে শুরু করে।
ঢাকা শহর মসজিদের শহর হিসাবে বিখ্যাত। ঢাকা শহর বিখ্যাত বিশ্বে বসবাসের জন্য সবচে’ খারাপ শহর হিসাবেও। শীগগিরই হয়তো ঢাকা শহর বিখ্যাত হবে যানজটে প্রথম হয়ে! মনে মনে ভাবে মারুফ। সত্যি বলতে কী, ঢাকার যানজট ক্রমশ বেড়েই চলছে। আধঘণ্টার পথ পার হতে দেড় ঘণ্টা কিংবা তার চেয়েও বেশি সময় লাগে। অফিস ছুটি হয় পাঁচটায় কিন্তু ঢাকায় বদলি হয়ে আসার পর, কোনোদিন আটটার আগে বাসায় ফেরার কথা মনে করতে পারে না মারুফ।
প্রথম দিকে আফসোস হতো। নূরজাহান বাসায় থাকে। তাকে সপ্তাহের ছয়দিনই কোনো সময় দেওয়া হয় না। বাসায় মা থাকেন অবশ্য। কিন্তু মায়ের দেওয়া সময় আর স্বামীর দেওয়া সময়ে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। নূরজাহান অবশ্য মুখে কিছু বলে না। তবে, মনে মনে সে যে মারুফকে নিয়ে সন্ধ্যার পর একটু বের হতে চায়, একটু ছাদে বসতে চায়, একটু কাছের পার্কটাতে যেতে চায়, সেটা সেও বোঝে। তবে, বুঝেও না বোঝার ভান করে। কারণ, সে জানে চাকরিটা আগে বাঁচাতে হবে।
জামালুদ্দীন যানজটের কবলে আটকে আছে। চারের-এ পার হওয়ার পর বাস, গাড়ি, লেগুনা, ভ্যান, রিকশা, সিএনজি সব ঠাসাঠাসি করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। আকাশ থেকে দেখলে সম্ভবত স্ট্যাচুর মতো মনে হবে। রিকশায় বসে মারুফের মনে হচ্ছে, এই জট ছাড়তে বুঝি অনন্তকাল পার হবে।
পুতুলের মতো তারা আপন-আপন কাজ করছে। রাস্তায় জ্যামে কারও কোনো দৃষ্টি নেই
এরইমধ্যে একাধিক অ্যাম্বুলেন্স পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের ইমার্জেন্সি সাইরেন তীব্র স্বরে বলছে পথটা ছাড়ো, ভেতরে মুমূর্ষু রোগীটারে বাঁচার চেষ্টাটা তো অন্তত করতে দাও। সাইরেন বেজেই চলছে। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও কেউই অ্যাম্বুলেন্সগুলোকে আগে যেতে দিতে পারছে না। অ্যাম্বুলেন্সগুলো রোগী ও স্বজনদের হয়ে আর্তনাদ করেই চলছে।বিভিন্ন গাড়ির অধৈর্য চালকেরা অস্থিরভাবে হর্ন বাজাচ্ছে। কিন্তু যানজট ক্রমশ জটিল হচ্ছে। সবাই সবার আগে যেতে চায়, কেউ কাউকে ছাড় দিতে চায় না।
মারুফ স্বগতোক্তির মতো জামালুদ্দীনকে বলে, আরও অনেক দেরি হবে মনে হয়, কী বলেন?
জামালুদ্দীন উত্তর দেয় না।
মারুফ বাসায় ফোন দেয়। কেউ রিসিভ করে না। একবার, দুইবার, তিনবার। ফোন দীর্ঘ সময় বেজে বেজে কেটে যায়।
মারুফের উৎকণ্ঠা বেড়ে চলে।
সে রিকশা থেকে নেমে পড়ার চিন্তা করে।
কিন্তু রাস্তার পাশে পরিখার মতো করে কাটা। সম্ভবত ‘উন্নয়ন কাজ চলিতেছে’।
সারা বছরই রাস্তার উন্নয়ন কাজ চলে। সারা বছরই পথ চলায় ভোগান্তি। রিকশা থেকে নেমে পড়লেও হাঁটা সম্ভব হবে না। অগত্যা সে বসে বসে চারপাশে দৃষ্টি বোলায়।
আশে পাশে মার্কেট, ফুড কোর্ট, দোকানপাট আলোয় ঝলমল করছে। লোকজন দোকানে ঢুকছে-বের হচ্ছে। চারিদিকে যত মানুষ দেখা যায়, সব যেন পুতুল। পুতুলের মতো তারা আপন-আপন কাজ করছে। রাস্তায় জ্যামে কারও কোনো দৃষ্টি নেই। যেন এভাবে গাড়ি রিকশা-ভ্যান-বাস-সিএনজি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকাটাই নিয়ম, স্বভাবিক।
মারুফ আকাশের দিকে তাকায়। মাথার ওপর আকাশটায় যানজটের কোনো লক্ষণ নেই। মসৃণ কালো ওড়নার মতো শুয়ে আছে বিশাল আকাশ। নিরুদ্বেগ। ভাবলেশহীন দৃষ্টি তার যানজটের ওপর। একটা অতিথি পাখির ঝাঁক পশ্চিম থেকে পূব দিকে উড়ে যাচ্ছে। পাখিদের অবাধ উড়ে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মারুফের হঠাৎ নিজেকে ভীষণ হাল্কা মনে হয়। সে খেয়াল করে সে শূন্যে উঠে যাচ্ছে। ওপরে। আকাশের দিকে। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে যানজট কেবলই দূরে সরে যাচ্ছে দৃষ্টি সীমানায় কেবল বিন্দুতে পরিণত হচ্ছে।
এবার মারুফ অবাক বিস্ময়ে পিঠের পাশে দুটো ডানা আবিষ্কার করে। ডানা দুটোকে নিজের ইচ্ছেমতো চালিত করতে পারছে সে, এখন যেখানে খুশি চলে যেতে পারে! নূরজাহানের কথা মনে হতেই তাড়াতাড়ি বাসার দিকে উড়তে শুরু করে। কিন্তু একটা উঁচু ভবনে ধাক্কা খেয়ে নিচে পড়ে যায়।
পাশ কেটে যাওয়ার সময় দুই-একজন রিকশাঅলা হাসতে হাসতে মৃদু মন্তব্য ছুড়ে দিচ্ছে
চকিতে মারুফ বুঝতে পারে তন্দ্রা এসেছিল। যানজট কেটেছে। এবার সবাই আপন গন্তব্যে পৌঁছতে তীব্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। সে ডানা নিয়ে চিন্তা করতে থাকে। প্রয়োজন আবিষ্কারের জনক। বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের ডানা আবিষ্কারে মনোযোগ দেওয়া উচিত।
জামালুদ্দীন দীর্ঘ জটে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত। তার মুখের ভাষা অত্যন্ত অশ্লীল। সে সমস্ত যান বাহনের ড্রাইভার, পথচারী, মোটরবাইকার থেকে শুরু করে ফুটপাতের হকার, ট্রাফিক পুলিশ পর্যন্ত অনির্দিষ্ট প্রত্যেককে বিড়বিড় করে গালি দিতে দিতে প্যাডেল ঘোরায়। অশ্লীল অশ্রাব্য সেসব শব্দ ঢাকার অশুদ্ধ বাতাসকে আরও দূষিত করছে। পাশ কেটে যাওয়ার সময় দুই-একজন রিকশাঅলা হাসতে হাসতে মৃদু মন্তব্য ছুড়ে দিচ্ছে। জামালুদ্দীনের কণ্ঠস্বর তখন খানিক চড়ে উঠছে।
ঘড়ি দেখলো মারুফ। পৌনে এক ঘণ্টা চলে গেছে নিউমার্কেট থেকে চারের-এ পার হতে। যাই হোক, রাস্তায় প্রচুর যানবাহন থাকলেও এ মুহূর্তে যানজট নেই। ফুরফুরে গতিতে রিকশা এগিয়ে চলছে। সাঁ সাঁ গতিতে চলে যাচ্ছে মোটরবাইক, লেগুনা, বাস, প্রাইভেটকার।
সম্প্রতি ঢাকায় ফুড ডেলিভারি অ্যাপসের প্রচলন ভীষণ বেড়েছে। ঘরে বসে পছন্দের খাবার অর্ডার করছে লোকজন। আর সে খাবার দ্রুত পৌঁছে দিতে তীব্র গতিতে সাইকেল চালিয়ে ছুটে যাচ্ছে ডেলিভারি ম্যান। দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, এ নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। এরকম একটা সাইকেলের সঙ্গে রিকশার চাকা লেগে গেলো। সাইকেলঅলা টানছে, জামালুদ্দীনও টানছে। কিন্তু চাকা দুটো আলাদা হচ্ছে না। ছোটখাটো একটা জট বেঁধে গেলো। এতক্ষণ ব্যস্ত হয় আপন গন্তব্যে ছুটতে থাকা লোকজনের মাঝেরও অনেকে তামাশা দেখতে দাঁড়িয়ে পড়লো!
মারুফের আর দেরি সহ্য হচ্ছে না। বাসায় অবিরত কল দিয়েই চলেছে। কেউ ফোন ধরছে না। সেই সাড়ে চারটায় বাসার কাজের মেয়ে মেরিনা ফোন দিয়েছিল নূরজাহানের শরীর খারাপ বলে। এখন প্রায় আটটা বাজে।
তারপরই চোখে পড়ে সামনের রাস্তাজুড়ে যানবাহন জড়িয়ে-পেঁচিয়ে ভয়ঙ্কর জ্যাম লেগে গেছে
স্ত্রীর শরীরিক অবস্থার কথা ভেবে মারুফের টেনশন সীমা ছাড়ায়। আর বসে থাকা সম্ভব নয়। সে রিকশা থেকে নেমে পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বের করে রিকশাঅলার হাতে দিয়ে হাঁটতে শুরু করে।
কিন্তু দুপা এগোবার আগেই রিকশাঅলার কণ্ঠে তাকে ফিরতে হয়। জামালুদ্দীন এতক্ষণ রিকশা চালিয়ে পঞ্চাশ টাকা নিতে রাজি হয় না। মারুফ অবাক হয়ে বলে, ঝিগাতলা বাসস্টপেজ থেকে কেয়ারিপ্লাজা পর্যন্ত বড়জোর তিরিশ টাকা। আমি তো আপনাকে পঞ্চাশ দিচ্ছি। কিন্তু জামালুদ্দীন বচসা শুরু করে।
কিন্তু জামালুদ্দীন বচসা শুরু করে।
মারুফের হাতে যুক্তি দেখাবার সময় নেই। রিকসাওয়ালার সঙ্গে তর্ক করতেও ইচ্ছে হয় না। সে টাকা দিয়ে সরে আসে। কিন্তু রিকশাঅলার আচরণের কারণে একটা বিরক্তি তাকে ঘিরে ধরে। সেই বিরক্তিটা সঙ্গে নিয়ে গলির ভেতর প্রবেশ করে বিস্মিত হয়। যতদূর চোখ যায় একদম ফাঁকা। কোনো যানবাহন নেই। পাশেই একটা সিএনজি দাঁড়িয়ে ছিল। মারুফ তাতেই চড়ে বসে। ড্রাইভারকে বলে, তাড়াতাড়ি চালাবেন। যত দ্রুত পারেন। এরপরই সে নূরজাহানের মোবাইলফোনে আবারও কল দেয়। সেটা অবিরাম বেজে চলে। কিন্তু কেউ রিসিভ করে না।
সিএনজিচালক মারুফের কথামতো স্পিড বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু ঝড়ের গতিতে তিন চার মিনিট চলার পরই সিএনজি থেমে যায়। মারুফ উৎকণ্ঠি। বলে, কী হলো? তারপরই চোখে পড়ে সামনের রাস্তাজুড়ে যানবাহন জড়িয়ে-পেঁচিয়ে ভয়ঙ্কর জ্যাম লেগে গেছে। ডানে, বাঁয়ে, পেছনে নড়ার কোনো সুযোগ নেই। সিএনজিচালক স্বগতোক্তি করে, এই জ্যাম আধঘণ্টার আগে ছুটবে না।
নুরজাহানের কথা ভেবে মারুফের হৃদপিণ্ডটা ধুপ-ধুপ করে লাফাতে থাকে, সে নেমে যাবে, না সিএনজিতে বসেই থাকবে, সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।