সুন্দরী মেয়ে মানেই কি অবিশ্বস্ত? এই যে মুনিয়াকে নিয়ে এত মুখরোচক কথা উঠছে, এর একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটা নয় যে, সে যথেষ্ট সুন্দরী? দেখতে যদি অতটা আকর্ষণীয় না হতো, তাকে নিয়ে কি এত কথা উঠতো? অবশ্য অসুন্দর হলে তো এত বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক মেয়েটির সঙ্গে সম্পর্কেই জড়াতো না। তবে একটা ব্যাপার ইলা লক্ষ করেছে, বেশিরভাগ মানুষের মাঝে এমন একটা মাইন্ড সেটআপ আছে যে, সুন্দরী মেয়েরা কখনোই ভালো চরিত্রের হতে পারে না। দেখতে ততটা সুন্দর নয়, এমন অনেক মেয়েকে দেখেছে সম্পর্কে অবিশ্বস্ত হতে বা একইসঙ্গে অনেকের সঙ্গে সম্পর্ক চালিয়ে যেতে। কিন্তু সেটা নিয়ে কারও তেমন জানার আগ্রহ নেই। জানাজানি হলেও রটনা রটানোর কোনো তাগিদ নেই। অথচ দেখতে ভালো এমন কোনো মেয়ের একটু পান থেকে চুন খসলেই হলো! একটা থেকে দুইটা প্রেমের ঘটনা চাউর হলেই আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে সহজে। যা নয়, তা-ও চাপিয়ে দিয়ে, বানিয়ে বানিয়ে, ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে রঙচঙে করে তোলা হয়।
সুন্দরী মেয়ে পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও মনে মনে ভাবে, আরে! এত সুন্দর মেয়ে কি আর ভালো হতে পারে? নিশ্চয় কোথাও কোনো খুঁত আছে! অর্থাৎ ‘ডাল ম্যা কুছ কালা থাকতেই হবে’। এক্ষেত্রে ঈর্ষাও একটা যুৎসই কারণ হতে পারে। বাইরের দেশগুলোতে অনেক ইন্টারেস্টিং বিষয় নিয়ে গবেষণা করে ওরা। এমন কোনো গবেষণা আছে কি না, যেখানে একই অপরাধ করে বা তুলনামূলক লঘু অপরাধ করে দেখতে ভালো নয় এমন মেয়েদের চেয়ে সুন্দরী মেয়েরাই বেশি নেতিবাচক সমালোচনার মুখে পড়ে! ব্যাপারটা দেখা দরকার। প্রতিবাদ করতে যাওয়া বা অধিকার আদায়ের বিষয় নিয়ে কথা বলতে যাওয়া ব্যক্তিটি মেয়ে হলে হালে পানি পায় নোংরা মানসিকতার লোকগুলো। সেইসঙ্গে দেখতে সুন্দরী হলে তো কথাই নেই! কেল্লা ফতে! বেশ কিছুদিনের বিনোদনের রসদ পেয়ে যায় যেন!
এবারের ঘটনাটা কিছুতে ছেড়ে দেবে না ইলা। চাকরি চলে গেলে যাক। এর আগে নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় ওর লেখা প্রতিবেদনটির ওপর অনবরত কাটাকুটি চলেছে বসের! ক্রোধে ফেটে পড়েছিল ইলা। তনুর মৃত্যুর ঘটনায় তো কিছু লেখা থেকে বিরত থাকতে বলেছিল কিছুটা ধমকের সুরেই। নিজেদের লোক দিয়ে পছন্দমতো সংবাদ লিখিয়ে নেন মালিকপক্ষ। তবে ইলা এখন আগের চেয়ে অনেক পরিপক্ব। এখন না লিখলে আর কখন লিখবে! ডেস্কে থাকা পত্রিকাগুলোর হেডলাইন পড়ে একইসঙ্গে বিমর্ষ আর ক্রোধান্বিত হয়ে পড়ে। প্রায় সব পত্রিকা মেয়েটির চরিত্রের ওপর আঙুল তুলেছে। যেন বা চরিত্র খারাপ হলে অনায়াসেই তাকে মারার অধিকার জন্মে যায়! কী অদ্ভুত মানসিকতা এইসব লোকের!
বেজন্মার বাচ্চা! প্রচণ্ড আক্রোশে ডেস্ক ঠেলতে ঠেলতে উঠে পড়ে ইলা! দলা করা থুথু ছোড়ে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে। ওই শুয়োরের বাচ্চার মুখে থুথুটা মেরেছে ভেবে শান্তি পায় মনে মনে। ল্যাপটপে দ্রুত স্ক্র্ল করতে করতে মেজাজটা খিঁচড়ে যায় তার। অপরাধীর কোনো ছবি নাই। ভিক্টিমের ছবির ছড়াছড়ি অনলাইনে। সুন্দরমুখের জয় সর্বত্র, এমনকি নোংরামিতেও! কী বিশ্রী ভাষায় মেয়েটার চরিত্রের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করা হয়েছে! ভাবলেই গা ঘিনঘিন করে ওঠে। মানসিক বিকৃতি কোন পর্যায়ে গেলে একজন ভিক্টিম, যার মৃত্যু হয়েছে তাকে নিয়ে এমন কথাবার্তা বলা যায়! ভেবে পায় না ইলা!
দৃঢ়হাতে মুঠো পাকিয়ে বের করে আনে কাগজটা। রেজাউর রহমানের টেবিলের ওপর দরখাস্তটা রেখে লম্বা লম্বা পা ফেলে বেরিয়ে যায় ইলা।
পিয়ন এসে সালাম দিলো ইলাকে, স্যার ডাকছেন। ঘর্মাক্ত হাতের চেটো ফতুয়ার দুইপাশে ঘষে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো ইলা। কঠিন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে গেলে হাতের তালু ঘামে ইলার। ভারী দরজাটা ঠেলে বসের রুমে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ইলার কেন যেন মনে হলো বাইরের লালবাতির সুইচটা অন করা হলো। তার মানে, গুরুত্বপুর্ণ ইস্যু নিয়ে কথা বলবেন স্যার। ইশারায় ইলাকে বসতে বলে ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলেন বস। হাতের চেটোর দিকে দেখলো ইলা। নাহ! একদম ঘামছে না সে! খুব শান্ত মনে হচ্ছে নিজেকে! যেকোনো সিদ্ধান্ত ঠাণ্ডামাথায় নিতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত এখন। প্রায় দুই, তিন মিনিট ফোনে কথা বলে রিভলভিং চেয়ার ঘুরিয়ে সরাসরি ইলার দিকে একটু ঝুঁকে তাকালেন দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংবাদপত্র ‘দেশের খবর’ পত্রিকার সম্পাদক রেজাউর রহমান।
-কেমন আছ ইলা?
-ভালো আছি বস!
-এ মাসের বেতন অ্যাকাউন্টে ঢুকেছে?
-জি, বস।
-সাংবাদিক জগতে তুমি যথেষ্ট সম্ভাবনাময়ী ইলা! আই অ্যাপ্রেশিয়েট ইওর স্পিরিট! ইউ আর ডুয়িং ভেরি ওয়েল!
-ধন্যবাদ। আর কিছু কি বলবেন? মুনিয়ার রিপোর্টটা হাফডান করে রেখেছি তো। আজকের মধ্যেই শেষ করতে হবে কিনা!
-রিপোর্টটি করার প্রয়োজন নেই ইলা। গেট রিল্যাক্স! আমাকে তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী ভাবতে পারো।
-কী বলছেন? জানেন, নিউজটি টুইস্ট করে কী বাজে বাজে রিপোর্ট বেরুচ্ছে প্রতিদিন! আমাদের কি কোনো দায়িত্ব নেই?
-দায়িত্বের বিষয়টা আমার ওপর ছেড়ে দাও। তোমাকে সেটা নিয়ে ভাবতে হবে না। তুমি বরং ঈদফ্যাশনের পেইজটা দেখো এইবেলা। ঈদ তো এসেই গেলো প্রায়।
ফতুয়ার কাটার ফাঁক দিয়ে জিন্সের পকেটে হাত ঢুকিয়ে কাগজটা স্পর্শ করে ইলা। দৃঢ়হাতে মুঠো পাকিয়ে বের করে আনে কাগজটা। রেজাউর রহমানের টেবিলের ওপর দরখাস্তটা রেখে লম্বা লম্বা পা ফেলে বেরিয়ে যায় ইলা।