বিষয়টি কেমন গোলমেলে মনে হয় হরিপদ প্রামাণিকের। মিরপুর এগারোতে চৌদ্দশ স্কয়ার ফুটের ফ্ল্যাট। আটতলা ভবনের প্রতি তলায় তিন ইউনিট। তিন বেড, তিন বাথ, ড্রয়িং, ডাইনিং, এক চিলতে বারান্দা। তারই একটি তাদের দেয়া হবে চল্লিশ লাখ টাকায়। এর বাইরে শুধু রেজিস্ট্রেশনের টাকাটা দিতে হবে। টু গুড টু বি ট্রু। কিন্তু কামাল সাহেব তো তাই বললেন। হরিপদ বুঝতে পারে না হিসাবটা কোথায়? বর্তমান বাজারে এই ফ্ল্যাটের দাম হবে কমপক্ষে এককোটি টাকা। অথচ তাদের দেওয়া হবে চল্লিশ লাখ টাকায়!
কামাল সাহেব হরিপদ-কল্পনা দম্পতিকে তার অফিসে ডেকেছিলেন আজ বিকেলে। কামাল সাহেব—মানে কামাল খন্দকার, তন্দ্রা প্রপার্টিজের স্বত্বাধিকারী। ছোট ডেভলপার কোম্পানি। মালিক নিজেই এমডি। স্ত্রীর নামে ডেভেলপার কোম্পানি খুলেছেন। মিরপুর এগারোতে ‘তন্দ্রাবিলাস’ তাদের তৃতীয় প্রজেক্ট। প্রায় সব ফ্ল্যাটই বিক্রি হয়ে গেছে। যে তিনটি বাকি আছে তার একটিই অফার করা হয়েছে প্রামাণিকদের। একটিই শর্ত। টাকাটা কিস্তিতে দেওয়া যাবে না। একবারেই দিতে হবে। আর ফ্ল্যাটের দলিল হবে কল্পনা প্রামাণিকের নামে।
এখানেও একটু খটকা রয়ে যায়। দলিল কার নামে হবে সেটা তো তাদের পারিবারিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার। সেখানে বিক্রেতাপক্ষের বলার কী-ই বা আছে? কল্পনা অবশ্য বিক্রেতাপক্ষ বলতে নারাজ। উপহারদাতাপক্ষ বলা যেতে পারে।
সেভাবে হিসাব করলে আমাদের কাছেও মার্জিন রেখেছে। ব্যবসায়ী বলে
গতকাল বাসায় ফিরেই কল্পনা প্রামাণিক সুসংবাদটি দিয়েছিল। আগেও সে হরিপদকে কামাল খন্দকারের কথা বলেছে বার কয়েক। তার নতুন প্রজেক্টের জন্য ঋণের আবেদন করেছেন কল্পনাদের ব্যাংকে। এই আবেদনটা কল্পনাই দেখভাল করছে। সে কর্ণফুলী ব্যাংকের ধানমন্ডি শাখার একজন মাঝারি পর্যায়ের কর্মকর্তা। প্রজেক্ট প্রোফাইল কিভাবে জমা দিলে আর কীকী পরিবর্তন করলে ঋণটা সহজে পাওয়া যাবে, সে পথঘাটও সে কামাল সাহেবকে বাতলে দিচ্ছে। ঋণ অনুমোদনের পর কল্পনার সহযোগিতার জন্য কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তাকে কিছু একটা উপহার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি করেছিলেন আগেই। কিন্তু তাই বলে উপহারটা যে এতটাই মূল্যবান হবে, তা ছিল কল্পনা প্রামাণিকের কল্পনারও অতীত। অন্তত সে রকমই বললো হরিপদকে।
—বলো কী তুমি! লোনের ব্যাপারে হেল্প করেছ, সে জন্য এত বড় উপহার? এটা হয় নাকি?
—পুরোপুরি উপহার তো বলা যাবে না। ডিসকাউন্ট প্রাইস বলতে পারো।
—তাই বলে এক কোটি টাকার ফ্ল্যাট চল্লিশ লাখে?
—শোনো, হিসাবটা এত স্টেইট ফরোয়ার্ড না।
—মানে?
বর্তমান বাজার মূল্য হয়তো এককোটি টাকা হবে। কিন্তু ওরা তো অধিকাংশ ফ্ল্যাট বিক্রি করেছে কনস্ট্রাকশনের সময়। সবাই কিস্তিতে দাম দিয়েছে। কিন্তু এককালীন দাম ছিল পঁচাত্তর লাখ টাকা। ইউটিলিটিসহ আশি। আমাদের না হয় অর্ধেক দামে দিয়েছে। তুমি জানো নির্মাণ খরচ কত? ত্রিশ পঁয়ত্রিশ লাখের বেশি হবে না। সেভাবে হিসাব করলে আমাদের কাছেও মার্জিন রেখেছে। ব্যবসায়ী বলে কথা।
আমার কিন্তু খটকা লাগছে। টু গুড টু বি ট্রু।
—ন্যাকামি করো না। সব মানুষকে অকৃতজ্ঞ ভেবো না। কিছু কিছু মানুষের মধ্যে এখনো কৃতজ্ঞতাবোধ আছে। তুমি জানো, আমি যদি লেগে না থাকতাম, হেল্প না করতাম তাহলে লোনটা হতো না। আর এই লোন না পেলে উনারা এই প্রজেক্টটা করতেন কিভাবে? শুধু তাই নয়, কামাল সাহেব এরপর মোহাম্মদপুরে আরেকটা ডেভলপমেন্টে হাত দিয়েছেন। সেখানেও আমাকে লোনের ব্যাপারে হেল্প করতে হবে। এটা গিভ অ্যান্ড টেকের বিষয়।
—মানে, ঘুষ?
—ঘুষের কী দেখলে? এটা কি সরকারি অফিস? প্রাইভেট ব্যাংকে আবার ঘুষ কী? ফ্যাসিলিটেশন বলতে পারো। ব্র্যাঞ্চ মানেজারকে দিয়ে লোনটা করিয়ে দেবো।
—তুমি বললেই ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজার লোন সেংশন করে দেবেন? হেড অফিসকে ইনভলব করতে হবে না?
—সেই আস্থায়ই তো করছি। এত ছোট লোনে হেড অফিস ইনভলব হয় না। আর যদি ইনভলব করতেই হয়, করবো। সে ব্যবস্থাও করে রেখেছি।
—ঠিক আছে। চলো দেখি তোমার কামাল সাহেব কেন ডেকেছেন, কী বলেন।
কামাল খন্দকার কথা বলেন সোজা সাপটা। ভনিতা নেই। ‘তন্দ্রাবিলাসে’র জন্য ঋণপ্রাপ্তিতে সহযোগিতা করার এবং ভবিষ্যতের প্রজেক্টগুলোতে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতির জন্য তিনি কল্পনা প্রামাণিকের কাছে কৃতজ্ঞ। সেই কৃতজ্ঞতার নিদর্শন হিসাবেই এইটুকু করা। একেবারে বিনামূল্যে দিতে পারলে খুশি হতেন। কিন্তু ব্যবসায়িক কারণে সেটা সম্ভব নয়। তাই নামমাত্র মূল্য নিতে হচ্ছে। ২/সি ফ্ল্যাটটা প্রামাণিক দম্পতিকে দেওয়া হবে চল্লিশ লাখ টাকায়। তবে রেজিস্ট্রেশন তাদের নিজের। রাজি থাকলে আজই সেলস কনট্রাক্ট সাইন করা হবে। কনট্রাক্টে ক্রেতা হিসেবে শুধু কল্পনা প্রামাণিকের নাম রয়েছে। টাকাটা একসঙ্গে এক মাসের মধ্যে দিলেই হবে। টাকা দেওয়ার পর চাবি বুঝিয়ে দেওয়া হবে। আরেকটা কথা, তারা যে বিশেষ ডিসকাউন্টে ফ্ল্যাটটা পাচ্ছেন, তা কাউকে বলা যাবে না। মানুষ জানলে নানা জন নানা কথা বলবে।
কল্পনার চোখে-মুখে আনন্দের ঝিলিক ফুটে উঠলেও হরিপদ উচ্ছ্বসিত হতে পারে না। কামাল খন্দকারকে কল্পনা বারবার ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা জানালেও হরিপদকে বেশ নির্বিকারকে দেখাচ্ছে। মূল সমস্যা বুঝে উঠতে কামাল সাহেবের দেরি হয় না।
—দেখুন প্রামাণিক বাবু, আপনার সংকোচ আর দ্বিধার বিষয়টি আমি বুঝতে পারি। আপনার মিসেসের কারণে আমি ব্যবসাটা বড় করতে পারছি। সেই তুলনায় এটা এমন বেশি কিছু না। তবে আপনি কল্পনা ম্যাডামের স্বামী হলেও কোম্পানির এই সুযোগ পাওয়ায় আপনার যেহেতু সরাসরি কোনো ভূমিকা নেই, তাই কোম্পানির প্রথা অনুযায়ী সেই ফেভারটা আপনাকে করতে পারছি না, করতে হচ্ছে আপনার মিসেসকে। কাগজে-পত্রে উনার নামই থাকতে হচ্ছে। কিন্তু আসলে স্ত্রীর সম্পদ আর স্বামীর সম্পদ বলতে আলাদা কিছু আছে কি? হা হা হা…। আমরা তো আর আমেরিকা কানাডা হয়ে যাইনি, তাই না?
এই লজ্জা তার সামনে সইবে কী করে! তবু ফ্ল্যাটের বিষয় নিয়ে একেবারে চুপ করে থাকতেও মন সায়
—তা তো বটেই। আমি আসলে বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না এই যুগেও এমন হয়। মানুষের মধ্যে এতটা কৃতজ্ঞতা বোধ থাকে! আপনাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেই! আপনি এটুকু না করলে হয়তো কোনোদিন এমন একটা ফ্ল্যাট কিনতে পারতাম না। সারা জীবন ভাড়া বাসায়ই থাকতে হতো। আমাদের কি আর কোটি টাকার ফ্ল্যাট কেনার সাধ্য আছে? ভাগ্যিস, দু’জন সারা জীবনে এইটুকু টাকাই জমাতে পেরেছিলাম। না হয় আপনি দিতে চাইলেও তো আমরা নিতে পারতাম না। আপনি কিন্তু আমাদের ঋণী করে ফেললেন।
কথাগুলো বলে বটে, কিন্তু হরিপদ প্রামাণিকের দ্বিধা কাটে না। সে কি কোনো কিছু নিয়ে সন্দিহান, নাকি স্ত্রীর নামে ফ্ল্যাটের মালিকানায় তার অহংবোধে আঘাত লেগেছে, তা ঠিকমতো বোঝা যায় না। আবার এমনটাও হতে পারে যে মোটামুটি আদর্শবান জীবন যাপনে অভ্যস্ত একজন কলেজ শিক্ষকের কাছে এই উপহার নামক অনুদানটি নিতান্তই বিব্রতকর।
বাসায় ফিরে অনেক্ষন দু’জনের কথা হয় না। কলেজ থেকে ফিরে মেঘা দু’ একবার বাবা মায়ের সঙ্গে এটা-ওটা নিয়ে কথা বলে গেছে। মেয়েটা বাসায় থাকলে হরিপদ সাধারণত কোনো ব্যাপারে কোনো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে না। কারণ, কোনো কিছু নিয়ে দ্বিমত পোষণ করলে কল্পনার পরিমার্জিত পরিশীলিত মুখোশটি খুলে যায়। যা ইচ্ছে তা বলেই হরিপদকে আক্রমণ করে। তার আক্রমণের সবচেয়ে প্রিয় টার্গেট স্বামীর পুরুষত্বহীনতা। আর সেই আক্রমণটি সে মেয়ের উপস্থিতিতেই করতে বেশি ভালোবাসে। হরিপদ নিজের এই দুর্বলতাটির কথা অন্তত মেয়ের সামনে উত্থাপিত হোক, তা সইতে পারে না। মেয়ে বড় হয়েছে। এই লজ্জা তার সামনে সইবে কী করে! তবু ফ্ল্যাটের বিষয় নিয়ে একেবারে চুপ করে থাকতেও মন সায় দিচ্ছিল না।
—আমাদের কি কাজটা ঠিক হচ্ছে?
—কোন কাজ?
—ফ্ল্যাটটা নেওয়া?
—না নিয়ে করবোটা কী? তুমি অন্য ফ্ল্যাট কিনে দেবে? আমাদের ব্যাংক ব্যালেন্স কত? আর ঢাকায় একটা ফ্ল্যাটের দাম কত তোমার হিসাব আছে? দু’ দিন পর মেয়ের বিয়ে দিতে হবে সেই খেয়াল আছে? তোমার মুরোদ আমি জানি না?
হরিপদ বুঝতে পারে আলোচনা এখন তার পুরুষত্বের দিকে মোড় নেবে। সে আর কথা বাড়ায় না।
পরশু আমাকে একটা ইন্টারনাল ইনভেস্টিগেশনে সিলেট যেতে হচ্ছে। আর বলো না, ওরা কি আর সাধে বোনাস
দুই.
ব্যাংকে কল্পনা প্রামাণিকের পারফরমেন্স ইদানিং বেশ ভালো হচ্ছে। ছয় মাসের ব্যবধানে মোটা অঙ্কের দু’টি বোনাসও পেয়েছে। তার মাধ্যেম নাকি কর্ণফুলী ব্যাংকের ব্যবসার প্রচুর প্রসার হচ্ছে। এমডি স্যারসহ হেড অফিসের সবাই খুশি। আশা করছে আগামী দফায় ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজার হয়ে যাবে। ফ্ল্যাট তো হয়েই যাচ্ছে। তখন একটা গাড়িও মেইন্টেইন করতে পারবে। মেঘা যারপরনাই খুশি হলেও হরিপদ প্রমাদ গোনে। স্ত্রীর কল্যাণে নামমাত্র মূল্যে পাওয়া ফ্ল্যাট নিয়েই সে অস্বস্তিতে আছে। আবার যদি স্ত্রীর গাড়িতেও চড়তে হয়! শারীরিক পুরুষত্বহীনতার ওপর যোগ হবে সামাজিক পুরুষত্বহীনতার সংকটও।
—কী ব্যাপার! তুমি মনে হয় খুশি হচ্ছ না? বউয়ের উন্নতি মানে তো তোমারই উন্নতি।
—তাই তো! কেন খুশি হবো না!
—পরশু আমাকে একটা ইন্টারনাল ইনভেস্টিগেশনে সিলেট যেতে হচ্ছে। আর বলো না, ওরা কি আর সাধে বোনাস দেয়! যেটুকু দেয়, তা আবার কড়ায় গণ্ডায় আদায় করে নেয়।
—বুঝলাম না।
—আমাদের আম্বরখানা ব্র্যাঞ্চে একটা বড় জালিয়াতি হয়েছে। ভুয়া ক্লায়েন্টের নামে লোন সেংশন করিয়ে সাড়ে চার কোটি টাকা গায়েব করা হয়েছে। হেড অফিসের সন্দেহ ওখানকার ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজারসহ কয়েকজন জড়িত আছে। তিন সদস্যের একটা এইনভেস্টিগেশন টিম করেছে। আমাকেও রেখেছে। যত্ত সব! এই সব কাজ আমার ভালো লাগে না। কিন্তু হেড অফিসকে তো চটানো যাবে না। সকালের ফ্লাইটে যাবো। সারাদিন কাজ সেরে পরদিন সকালের ফ্লাইটে ফিরে আসবো।
—তাই? আর কে কে আছে টিমে? তোমাদের ব্র্যাঞ্চের কেউ?
—সেটাও গোপন রাখা হয়েছে। আমাদের টিকিট থাকবে এয়ারপোর্টে। কারা এই টিমে আছে আগে থেকে জানাবে না। এয়ারপোর্ট গিয়ে তিন ব্র্যাঞ্চের তিন জনের দেখা হবে। কেউ যেন আগাম ইনফরমেশন না দিতে পারে বা সমন্বয় না করতে পারে, সে জন্য এই ব্যবস্থা। ব্যাটা এমডি খুবই ঝানু মাল। দেখলে মনে হয় ভাজা মাছ উলটে খেতে পারে না। যাক। তুমি ভেবো না। আমি মেঘাকে সব দেখিয়ে দিয়ে যাবো আর মালতীকে বলবো, দুই দিনের খাওয়া-দাওয়া রান্না করে ফ্রিজে রেখে দিতে।
হরিপদ কোনো মন্তব্য করে না। তার মন্তব্যে খুব একটা কিছু যায় আসেও না। কর্ণফুলী ব্যাংকের এমডি লুতফুজ্জামান সাহেবের সঙ্গে তার একবার দেখা হয়েছে। ভদ্রলোককে দেখে সত্যি মনে হয় ভাজা মাছ উলটে খেতে পারেন না। তবে ঝানু মাল না হলে কি আর ব্যাংকের এমডি হতে পারে? কল্পনা পড়েছে সেই ঝানু মালের হাতে। অফিসের কাজে পাঠাচ্ছেন। যেতে তো হবেই।
মা ঠিকমতো পৌঁছেছে কিনা, অফিসের কাজ ঠিকমতো হচ্ছে কিনা, এসব জানার জন্য। কল্পনা তখন লুতফুজ্জামানকে
কল্পনার সিলেটে যাওয়ার দিন হরিপদ’র ক্লাশ অফ। বিকেলে এক ব্যাচ ছাত্র আসবে বাসায় কোচিং করতে। সকালটায় ফ্রি আছে। সে স্ত্রীকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিতে চাইলো। কল্পনা জানালো তার দরকার হবে না। প্রথমে ব্যাংকে যেতে হবে। সেখান থেকে ব্যাংকের গাড়ি এয়ারপোর্ট পৌঁছে দেবে।
তথাস্তু!
এয়ারপোর্টে তিন সদস্যের কোনো টিম আসলে থাকার কথা নয়। কল্পনার সঙ্গে সিলেটে যাচ্ছেন এমডি লুতফুজ্জামান। বিষয়টি কোনো ইন্টারনাল ইনভেস্টিগেশনের নয়। নিতান্তই আচমকা প্লেজার ট্রিপ। লুতফুজ্জামান বেশ ক’দিন আগেই ব্যবস্থা করে রেখেছেন। কল্পনা অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে নিজের কিছু কাজের কথা বলে। বাসায় বলতে হয়েছে ইন্টারনাল ইনভেস্টিগেশনের কথা। এ সব প্লেজার ভেঞ্চারের ঝুঁকি অনেক। নানা জায়গায় নানা গল্প ফাঁদতে হয়। ওপরে ওঠার সিঁড়ি ডিঙাতে গেলে অবশ্য এইটুকু ঝুঁকি নিতেই হবে। এমডি সাহেবকে খুশি করে এর মধ্যেই কামাল খন্দকারসহ দু’জনের কাজ বাগিয়ে দিয়েছে। এমডি যখন ঋণ অনুমোদন করার জন্য ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজারকে নির্দেশ দেন, তখন তো ঋণ অনুমোদন একেবারেই পান্তাভাত। একজনের কাছে নামমাত্র দামে ফ্ল্যাট আদায় করেছে। অন্যজন কথা দিয়েছে মেঘাকে বিদেশে পড়ানোর খরচ দেবে। এ সংবাদ অবশ্য এখনো হরিপদ কিংবা মেঘাকে জানানো হয়নি। মেয়েটা আগে ইন্টারমেডিয়েট পাস তো করুক! বিনিময়টা খুব কঠিন কিছু নয়। হরিপদ তার শরীর তৃপ্ত করতে পারেন না। লুতফুজ্জামান কালেভদ্রে সেই কাজটা করে দেন। বোনাস হিসেবে ক্লায়েন্টদের কাজ বাগিয়ে নেওয়ার বিষয়টি তো থাকছেই। কইয়ের তেলে কই ভাজা।
তন্দ্রা প্রপার্টিজের ঋণের ব্যাপারটিও সেভাবেই ম্যানেজ করা হয়েছে। সেখানে অবশ্য কিছু বাড়তি প্রণোদনাও আছে। লোন অ্যাপ্লিকেশন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে কামাল খন্দকারের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠতাও হয়েছে। লোনটি অ্যাপ্রুভ করিয়ে দেওয়ার জন্য কামাল দুই লাখ টাকা অফার করেছিলেন। কল্পনার চোখ ছিল আরও ওপরে। কিন্তু কামাল সোজা কথার মানুষ। জানিয়ে দিয়েছেন, প্রয়োজনে তার বহুগুণ দেবেন। শর্ত একটাই মাঝেমধ্যে শু’তে হবে তার সঙ্গে। কল্পনা ভাবে, দু’জনের সঙ্গে শোয়া আর তিন জনের সঙ্গে শোয়ার মধ্যে কী-ই বা তফাত! সেই থেকে কামালের সঙ্গেও শোয়া হয়।
বিকেলে মেঘা ফোন করে। মা ঠিকমতো পৌঁছেছে কিনা, অফিসের কাজ ঠিকমতো হচ্ছে কিনা, এসব জানার জন্য। কল্পনা তখন লুতফুজ্জামানকে তার নাভীমূল থেকে উপত্যকার গভীরে নামিয়ে দিয়েছে। সে ফোন ধরে না। ফোনটা বেজে বেজে মিসড কল হয়ে যায়।
মেঘার ফোনে কল্পনার মনোসংযোগে চিড় ধরে। জরুরি কিছু না হলে তো এত রাতে
তিন.
—আচ্ছা, তুমি এমন কিপটে কেন?
—আমি কিপটে? কোটি টাকার ফ্ল্যাট দিয়ে দিলাম চল্লিশ লাখে, তাও বলছ কিপটে?
—খুবলে খুবলে তো কম খাচ্ছো না। দিন দিন চাহিদা বাড়ছে তোমার। এখন বলছো প্রতি সপ্তাহে চাও। আমার চাহিদার খেয়াল রাখো? তুমি তো চাইলেই ফ্ল্যাটটা ফ্রি দিতে পারো।
—তুমি দেখি মহা বোকা। ফ্রি দিলে লোকে না হয় না জানলো, তোমার বর সন্দেহ করতো না? বিশেষ করে ফ্ল্যাটটা যখন তোমার একক নামে হচ্ছে।
—তুমি চাইলেই দিতে পারো সোনা, প্লিজ!
—প্ল্যান একটা আছে। সময়ে বলবো।
—প্লিজ, এখনই বলো।
—তুমি আমাকে এভাবেই কো-অপারেট করতে থাকো। আমি তোমার অ্যাকাউন্টে আস্তে আস্তে চল্লিশ লাখ দিয়ে দেবো কিস্তিতে। মোহাম্মদপুরের প্রজেক্টটা দাঁড়াতে দাও। চল্লিশ লাখ টাকাও তোমার হবে, ফ্ল্যাটও তোমার। প্রামাণিক বাবু না জানলেই হলো। শুধু আমার দিকে খেয়াল রেখো সোনা।
কল্পনার শীৎকার হোটেল রুমের চার দেয়ালে অনুরণিত হতে থাকে। টু গুড টু বি ট্রু!
চার.
তন্দ্রাবিলাসের ফ্ল্যাটে ওঠার পর দু’জনের দূরত্ব আরও বাড়ে। ঘুমের মধ্যে উচ্চস্বরে নাক ডাকার অপরাধে হরিপদ’র শয্যা হয় গেস্ট রুমে। নিজের শয্যায় হরিপদকে দরকার নেই কল্পনার। সে কখনো লুতফুফজ্জামানে কখনো কামাল খন্দকারে তৃপ্ত। হরিপদ তার সাইনবোর্ড মাত্র। লুতফুজ্জামানের কল্যাণে এর মধ্যেই মিরপুর ব্র্যাঞ্চে ম্যানেজার হিসেবে বদলি হয়ে এসেছে। কামাল খন্দকারের সঙ্গে সম্পর্ক ঢেকে রাখতে পারলেও এমডি সাহেবের বিশেষ আনুকূল্য টের পেয়ে ব্যাংকে কারও কারও মধ্যে ফুসুর ফাসুর শুরু হয়েছে এরই মধ্যে।
তার মধ্যেই ঘটলো ব্যাপারটি। হরিপদ আত্মহত্যা করে ভোর রাতে। বেডরুমে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ফাঁস দিয়ে। কল্পনা তখন কক্সবাজারের হোটেল সিগালে। তার শরীর নিয়ে লুতফুজ্জামান সেই ভোর রাতে ‘ইন্টারনাল ইনভেস্টিগেশনে’ ব্যস্ত। মেঘার ফোনে কল্পনার মনোসংযোগে চিড় ধরে। জরুরি কিছু না হলে তো এত রাতে ফোন করার কথা নয়!
ফোনের অন্যপ্রান্তে মেঘা কোনো কথা বলতে পারে না। চিৎকার দিয়ে মূর্ছা যায়।