আয়নায় ভালো করে নিজেকে দেখে নেয় আনিস। সাতসকালে সেভ করা তার রুটিনওয়ার্ক। বেসরকারি ব্যাংকের চাকরি, ফিটফাট থাকতে হয়। ইস্ত্রি করা জামার সঙ্গে সেভ করা মুখের মহামিলন না হলে করপোরেট মেজাজ আসে না। এসব মেজাজ-মর্জি বেশ রপ্ত করেছে আনিস। আনিসুর রহমানের পদবি অফিসার, বলতে গেলে স্মার্ট সেলারি হোল্ড করে সে।
সকাল দশটার মিনিট বিশেক আগে অফিসে ঢোকার নিয়ম থাকলেও বেরুবার নির্দিষ্ট টাইম নেই। কখনো সন্ধ্যা, কখনো গাঢ়-সন্ধ্যা, কখনো কম বয়েসী রাত। কিশোরী রাতে অফিস থেকে বের হওয়ার নজির যে নেই, তাও নয়। গত সাড়ে তিন বছরে এসব কায়দা-কৌশল আয়ত্ত করে নিয়েছে আনিস। একদা পরশহরের পোস্টিং, সদ্য ছাত্রত্ব শেষ করা আনিসের মনে পলে পলে জাগিয়ে দিতো নিজ এলাকার ভাষা আর লোকেদের সুরুত। নিজের বাড়িতে থেকে, মায়ের হাতের রান্না খেয়ে, ফুটফুটে বাচ্চাটির চাঁদমুখটা দেখে অফিসে যাওয়ার তাড়নায় কতবার একা একা কান্না করেছে বাসার কোণে, তার ইয়ত্তা নেই। উত্তুরে হাওয়াকে বলতো, যাও সখা, এই দুঃখনিনাদ পৌঁছে দিও তবে নোয়াখালীর চরে! স্মরণে আসে, ভার্সিটি লাইফে সবাই যখন বিসিএস আর জবগাইড নিয়ে ব্যস্ত, তখন আনিসের ব্যস্ততার ঘূর্ণন হতো শিউলিকে নিয়ে।
শিউলি তার টিউশনির ছাত্রী, পরে স্ত্রী। অনার্স থার্ড ইয়ারে শিউলিকে নিয়ে পালিয়ে অপরাধীর চেহারায় বাড়িতে হাজির হলে মা-ই সামলে নিয়েছিলেন আগুনে পরিবেশ। বাবার অবর্তমানে গার্ডিয়ান জ্ঞান করা চাচার সে কী ঝাঁজ! তাদের বংশে কলঙ্ক পড়েছে, ভাইপো পড়ালেখা শিখে বড় ডিগ্রি আনার বদলে বৌ নিয়ে এসেছে! বেরুলেই মুখের ওপর খামছে পড়ে প্রতিবেশীদের বিরূপ ঝামটা। শিউলির বাবা মেয়েজামাই হিসেবে টিউশনি করা বেকার ছেলেকে মেনে নেবে না জেনেও শিউলি ভরসা দেয়, আমাদের সব হবে একদিন, দেখে নিও! নিদানের আশ্রয় সেই শাশুড়িমাকে ছেড়ে তার বৌ শিউলি আসতে চায়নি দূর শহরে। তার ওপর সে প্রেগনেন্ট। মা চায়নি স্বামীর ভিটে ছেড়ে পরশহরের ভাড়া বাসায় যেতে।
সপ্তাহে দুদিন ছুটি কিন্তু যে দূরত্ব দুই শহরের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে দৈত্যের শরীর নিয়ে তা পেরুতে লেগে যায় প্রায় একদিন, ফিরতে চলে যায় আরেকটা দিন। প্রতি মাসে ছুটি পাওয়া সম্ভব না কোনোভাবেই; তার ভেতর সরকারি কোনো ছুটি যদি শুক্র কী শনিবারের পেটে ঢুকে যায়, মাথানষ্ট অবস্থা। সেই কাল পেছনে ফেলে হেড অফিসে তদবির আর ভাগ্যের জোরে আনিস এখন নিজের উপজেলার শাখায়। পরিচিত মুখ, নিজের চেনাজানা হাওয়ার ভেতর থেকে ব্যাংকিং তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করে সে। মনের আনন্দে সেভিং ক্রিম ঘষতে ঘষতে আয়নায় নিজেকে পরখ করে আনিস। ফর্সা মুখটা রেজারের টানে পেয়ে বসেছে দুধে-হলুদ রঙ। হুররে…ভেতর থেকে উল্লাসে তেড়ে আসে হর্ষধ্বনি। পরক্ষণেই চুপষে যায় আনিস। সে স্পষ্ট খেয়াল করে, হুররে বলার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মুখ থেকে বেরিয়ে আসে হালকা থুথু। আয়নায় লেপ্টে থাকা থুথু হাত দিয়ে দেখে, শিউর হয় আনিস। পাশের রুম থেকে শিউলি হাঁক দেয়, কী হলো সকাল-সকাল? বোনাস-টোনাসের খবর পেলে নাকি? তব্ধা খেয়ে যায় আনিস। কোনোমতে ফ্রেশ হয়ে বেরোয় বাথরুম থেকে।
নিজের ডেস্কে বসার আগে সেকেন্ড স্যার ইশারা দেন। এক গাল হাসি দিয়ে দরদভরা গলায় স্যার বলেন, আনিস সকালে নাস্তা করেননি? মুখ এত শুকনো কেন? কোনোমতে ‘না’ শব্দটি উগরে দিয়ে নিজের চেয়ারে বসে আনিস।
অফিসে এসির কৃত্রিম বায়ুর মাঝে নিজের চেয়ারে বসেও অস্বস্তিবোধ বাড়তে থাকে আনিসুর রহমানের। খুঁতখুঁতে একটা আবহ নিজের ভেতর চোরাস্রোত হয়ে এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে দিচ্ছে তাকে। ততক্ষণে পিওন ইউনুস টেবিলে রেখে দেয় লাল চা। বরাবরের মতো হাসিমুখে সালাম দিতে গিয়ে থমকে যায় ইউনুস। প্রতিদিনের আনিস স্যার আজ যেন বাসা থেকে আসেননি, এসেছে স্যারের খোলস। সাহস করে মুখ খোলে ইউনুস।
-স্যারের শরীর কি খারাপ?
-না।
-না মানে, স্যারকে আজ কেমন যেন দেখাচ্ছে!
-কই, না তো!
-স্যার, কিছু কি লাগবে?
-না।
কথার পিঠে কথা দিয়ে যে স্যার কাস্টমারকে বাগে আনতে পারেন মুহূর্তে, সেই তিনি আজ ‘না-হ্যাঁ’র মধ্যে ঘুরছেন কেন? বোমা ঢাললেও স্যারের কথা বের না হওয়ার কারণ উদঘাটন করতে না পেরে বেউপায় ইউনুস ভাবে, বাসায় ম্যাডামের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে নিশ্চয়ই। চা খেতে ইচ্ছে হয় না আনিসের। অথচ অন্যদিন অফিস শুরুটা ইউনুসের হাতের বিখ্যাত লাল চা না হলে মুখটা বিস্বাদ যায় দিনমান। মাথা চুলকায়, নাক টিপে আনিস। ঠাস করে ভাবনায় আসে, তার মানে আমার কথার সঙ্গে…এতদিন খেয়াল করিনি কেন বিষয়টা? ভবনার রশি বেশি দূর বিস্তৃত না হতেই ইন্টারকমে ম্যানেজার স্যারের তলব। আনিস সাহেব, একটু চেম্বারে আসুন। আচ্ছা স্যার, বলে রিসিভার রাখতে কে যেন তার কানেকানে বলে দেয়, স্যার কি ব্যাপারটা ধরে ফেলেছেন! এসি চলছে নিজস্ব গতিতে; কাস্টমার টাইম শুরু হয়নি এখনো, ঘেমে একাকার আনিস।
-স্যার, আসবো?
-আসেন। কেমন আছেন?
-জি স্যার, ভালো।
-আনিস সাহেব, আগামী বুধবার হাকিম সাহেবের ফেয়ারওয়েল। কী গিফট দিলে সুন্দর হয় বলেন তো।
-স্যার, মানে…
-নির্দ্বিধায় বলেন আপনি।
-আপনি যেটা বলেন স্যার।
-আনিস, আপনি স্মার্ট অফিসার। যুগের সঙ্গে কী ভালো যায় তা আপনাদের মতো ইয়াং এনারজেটিকরাই ভালো বোঝেন। ও হে, ফেয়ারওয়েল প্রোগ্রামটা বরাবরের মতো আপনিই উপস্থাপনা করবেন।
-স্যার
-আপনি পারবেন। আপনার ওপর আমাদের আস্থা আছে। ঠিকাছে, এখন ডেস্কে যান।
-ওকে স্যার।
ম্যানেজারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে আনিস বড় একটা শ্বাস নেয়। নিজেকে প্রমোদ দেয়, বাঁচা গেলো, স্যার তাহলে বুঝতে পারেননি। ভেতরের কেউ যেন বলে, এত ঘাবড়ে গেলে কি ব্যাংকারের চলে? নিজের ডেস্কে বসার আগে সেকেন্ড স্যার ইশারা দেন। এক গাল হাসি দিয়ে দরদভরা গলায় স্যার বলেন, আনিস সকালে নাস্তা করেননি? মুখ এত শুকনো কেন? কোনোমতে ‘না’ শব্দটি উগরে দিয়ে নিজের চেয়ারে বসে আনিস। সকাল থেকে এ-কেমন বিবমিষা বুঝে উঠতে পারে না সে।
নিজের উপজেলায় চাকরির মজা এ ছয় মাসে বেশ বুঝে গেছে আনিস। অ্যাকাউন্ট করতে এসে কোনো সমস্যা হলে অমনি আনিসের ডেস্কে এসে বলবে, ছার! আঁরে চিনছেননি? আঙ্গো বাড়ি আমিশাপাড়া, আপ্নের নানার বাড়ির হাশের বাড়ি। একটু কই দেন না ওই ছাররে, ছবি এক্কান বাঁই আছে, কাইল দিয়ামু ছার। হোলা টেয়া হাডাইবু বিদেশেত্তুন, অ্যাকাউন্টটা হবরে দরহার, এক্কানা কই দেন না ছার…
চেকের অঙ্কের দ্বিগুণ ক্ষতিপূরণ দিয়ে বাবাকে নিয়ে বের হবার আগে রহমান সাহেব আতকা বলে বসেন, আইচ্ছা বুড়ামিয়া, এত্তকিছু থাকার হরেও আপ্নে এইক্কা করেন ক্যা? অপরাধী দৃষ্টিতে একবার ম্যানেজারের দিকে, আরেকবার ছেলের দিকে তাকিয়ে অনেকটা পরিকল্পিত স্বরে বৃদ্ধ বলে, ভূতে হোন মারে আঁরে।
ক্যাশে পরিচিত কেউ টাকা দিতে গিয়ে যদি দেখে সামনে দীর্ঘ লাইন, আনিসের ডেস্কে এসে বলবে, স্যার, চিনছেন? আমি রাকিব ভাইয়ের ছোটভাই; আপনার স্কুলবন্ধু রাকিব ভাইয়ের ছোটভাই। দোকানে কেউ নাই, টাকাটা জলদি জমা দিতে পারলে ভালো হতো। এসব ক্যাচাল শুরুর দিকে বেশ উপভোগ করতো আনিস। এলাকার পরিচিত-আধাপরিচিত-অপরিচিত লোকদের এসব আবদার-অনুরোধ শুনে নিজের কামলা-জীবনকে অর্থবহ মনে হতো কখনো-সখনো। অফিসার পরিচয়ের সুগন্ধী তার আশেপাশে ঘুরতে থাকতো কর্মব্যস্ত সময়ে। এখন অবশ্য বিরক্ত লাগে। লোকদেরও কাণ্ডজ্ঞান নেই; গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজে যখন মগ্ন, হোক প্রপোজাল তৈরি বা বিনিয়োগ ফাইলের ব্যস্ততা, তখনই হাঁক দেবে, স্যার, আমি…
যশোরে চাকরি শুরু করার সময়, একেবারে অনভিজ্ঞ আনিসের মনে হতো, এখানকার লোকেরা বুঝি কথা বলে অনাবিষ্কৃত ভাষায়! না বোঝা যায় তাদের আঞ্চলিক ভাষার টান, না বোঝা যায় শরীরভাষ্য। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুবাদে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা তার বোধগম্য, বলতেও পারে কাজ চালানোর মতো। নিজের নোয়াখাইল্যা ভাষা তো আছেই, ছায়ার মতো; মায়া দিয়ে জড়িয়ে রাখে নিশিদিন। কাস্টমারদের গ্যাদারিং, সারাক্ষণ চাপের ভেতর থেকে আনিস নিজেকে সপে দেয় ব্যাংকারের অমোঘ নিয়তি। খুব মিস করতো তখন নিজের এলাকার লোকদের, মায়ের মুখের ভাষাকে। এমনকি নোয়াখালী জেলার কথা কেউ কখনো ভুল করে তুললে বা কোনো কাস্টমার নোয়াখালীর কোনো শাখায় টাকা পাঠালে কান খাড়া করে রাখতো আনিস। ভিনশহরের ওই কাস্টমারের প্রতি তার জমে যেতো আলাদা কিসিমের ভাব-সাব। এখন নিজের এলাকায় এসে মালুম হয়, সবই এক! পেশাজীবীর কোনো চোখ নেই চাকরির বিধি ছাড়া। চাকরিজীবীর কোনো কাজ নেই বসের হুকুমত ছাড়া। ঠাহর করে, ম্যানেজারের চেম্বারে চেয়ারগুলো খালি নেই, দাঁড়িয়ে আছে অনেকানেক লোক। চেহারা কালো করে স্যারের বিপরীত পাশে বসে আছে এক বৃদ্ধ, তাকে কেন্দ্র করেই যত হাঙ্গামা। স্যারের পাশে বসা লোকটি সমানে চিল্লায়, হালা, ব্যাংকে আই কিল্লায় বাটপারি গরোছ? ম্যালাদিন ধরি তোরে টোকায়ের আঁই। আইজগা তোর শয়তানি ছাড়াই হালায়ুম। এলাকার সন্তান হিসেবে আনিসের ডাক পড়ে চেম্বারে। ম্যানেজার স্যার, বৃদ্ধের দিকে আঙুল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেন, চেনেন উনাকে? না সূচক জবাব দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আনিস। স্যারের চোখ বলছে, উত্তরে তিনি সন্তুষ্ট নন। স্যার কেন, সকাল থেকে দুপুরতক যত কাস্টমার সে ডিল করেছে কিংবা টুকটাক কথা বলেছে কলিগদের সঙ্গে, কেউই খুশি হতে পারেননি আজ। আন্তরিকতা দিয়ে আনিস যতই বলতে যায় প্রয়োজনীয় কথা, ভেতর থেকে জিহ্বাটা সাড়া দেয় না। কেউ যেন মুখটা তার বন্ধ করে রাখছে সদর দরজায় বড় তালা ঝুলিয়ে দেওয়ার মতো করে। চেম্বারে দাঁড়িয়ে আনিস দর্শক হয়ে দেখতে থাকে হঠাৎ পাওয়া বিনোদনপর্ব। উঁচাগলার লোকটি, নাম আব্দুর রহমান, সাকিন নান্দিয়াপাড়া, প্রায় সাত মাস আগে চেক নিয়ে এসেছিলেন ব্যাংকে। সামনে দীর্ঘ লাইন। চৈত্রের গরম তখন বাঁধ মানে না এসির বয়ার। এই ফাঁকে, আব্দুর রহমানের পকেটে রাখা চেক কায়দা করে মেরে দিয়ে বৃদ্ধ অন্য লাইনে দাঁড়িয়ে দ্রুত ক্যাশ করে নেয় চেকটা। কাউন্টারে গিয়ে পকেটে হাত দিয়ে চিল্লাপাল্লা করে পুরো ব্যাংক যখন মাথায় তোলেন আব্দুর রহমান। ততক্ষণে বৃদ্ধ পগারপার! ম্যানেজার চেম্বারে বসিয়ে ঠাণ্ডা শরবত খাইয়ে বলেছিলেন, দেখুন রহমান সাহেব, চেকটি হেফাজতে রাখার দায়িত্ব আপনার; তবু আমার ব্রাঞ্চেই যেহেতু অঘটনটি ঘটেছে, তাই আমি সর্বাত্মক চেষ্টা করবো শনাক্ত করতে। সিকিউরিটি গার্ডকে ধমক দিয়ে স্যার বলেছিলেন, কী করেন আপনারা? এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেলো আর আপনারা…সিসিটিভির ফুটেজ দেখে বৃদ্ধের চেহারা মুখস্ত করে রাখে গার্ড শহীদউল্লাহ। সেই শহীদউল্লাহই সাত মাস আগে মুখস্ত করা চেহারার বৃদ্ধকে আজ নাগালে পেয়ে ধরে আনে চেম্বারে। যথারীতি খবর দেওয়া হয় আব্দুর রহমানকে।
বৃদ্ধ কাচুমাচু ভঙ্গিতে যা বলে, তাতে আনিসসহ শ্রোতৃমণ্ডলী অবাক না শুধু চূড়ান্তভাবে বেকুব বনে যায়। মেয়ে তার ইউরোপপ্রবাসী, এক ছেলে সরকারি আমলা, আরেক ছেলে লক্ষ্মীর নদীতে ভর করে বওটা উড়ায় চৌমুহনী বাজারে বড় আড়ৎ নিয়ে। অভাবের চিহ্ন নেই ছিটেফোঁটা কিন্তু খাসলতের দোষে বৃদ্ধ ছাড়তে পারেননি পুরানা রোগের মতো পড়ে থাকা বদ-অভ্যাস। এর-ওর পকেট মারার মতো জগন্য অভ্যেস বৃদ্ধের রক্তে; দূরে কোথাও গেলে হাত পাততেও নেই তার সামান্যতম লজ্জা। এক গাল ভেংচি দিয়ে রহমান সাহেব বলেন, তা এতাইন যহন বুড়ার হেডম, হোলারে কল দিলেই হারে! অবশ্য আরও আগে স্যার ফোন দিয়েছেন বৃদ্ধের ছেলেকে। খানিক বাদেই চৌমুহনী থেকে সে সোজা চলে আসে ব্যাংকে। বাবার অপরাধের জন্য ক্ষমা চেয়ে মুচলেকা দেয়, সান্ত্বনা দেয় রহমান সাহেবকে। চেকের অঙ্কের দ্বিগুণ ক্ষতিপূরণ দিয়ে বাবাকে নিয়ে বের হবার আগে রহমান সাহেব আতকা বলে বসেন, আইচ্ছা বুড়ামিয়া, এত্তকিছু থাকার হরেও আপ্নে এইক্কা করেন ক্যা? অপরাধী দৃষ্টিতে একবার ম্যানেজারের দিকে, আরেকবার ছেলের দিকে তাকিয়ে অনেকটা পরিকল্পিত স্বরে বৃদ্ধ বলে, ভূতে হোন মারে আঁরে। ঘটনার এমন পরিণতি দেখে আনিস ভেবে পায় না, সে হাসবে, না নীরবতা পালন করবে। মনটা তবু হালকা হয় তার। কত বিচিত্র মানুষ নিয়ে তার পেশাগত জীবন! কত রকম তাদের চেহারা-সুরুত! পরক্ষণে কে যেন কানের কাছে চুপিচুপি বলে, বিকেলে ফেয়ারওয়েলের উপস্থাপনা?
কান্নার ভেতরেও সে স্পষ্ট খেয়াল করে, তার মুখ থেকে গোঙানির সঙ্গে বেরিয়ে পড়ছে থুথুর ছাঁট; আয়নায় ভেসে থাকা তার চেহারার প্রতিবিম্বই থুথুদের গন্তব্য!
বিকেলে যথারীতি অনুষ্ঠান শুরু করতে গিয়ে আনিস খেয়াল করে তার পা কাঁপছে। শব্দের প্রক্ষেপণ হয়ে যাচ্ছে এলোমেলো। সম্বোধন আর আহ্বানের বিস্তর ফারাকে নিজের কাছে অচেনা ঠেকে তার নিজের স্বর। ইশারায় মাওলা সাহেবকে দায়িত্ব দিয়ে আনিস দ্রুত চলে যায় ওয়াশরুমে। কলের পানিতে কুলি করে, মুখ ভেজায়। দেয়ালের আয়না সাক্ষ্য দেয়, তার মুখ অদ্ভূত লাল হয়ে গেছে। জোর করে হাসতে চায় সে, পারে না। উপর্যুপরি চেষ্টায় সফল হয়ে হাসি আসতেই আয়নায় লেপটে যায় থুথুচিহ্ন। এবার সত্যিই ভয় পেয়ে যায় আনিস। অনুষ্ঠান উপস্থাপনা সাময়িক বিষয়, কাস্টমারের সাথে কথা বলতে গিয়ে যদি এরকম থুথু বেরোয়? চেম্বারে বা মিটিংয়ে কথা বলতে গিয়ে যদি কারও ঠোঁটে-মুখে পড়ে থুথুর ফোঁটা? এরকমটি কী আগেও হয়নি! চোখ বন্ধ করে মাথায় লাইনের পানি ছেড়ে দেয় আনিস।
আশ্চর্য, টেপের ঠাণ্ডা জলের সঙ্গে আনিসের চোখের গরম জল মিলিয়ে যাচ্ছে সমানে। নিঃশব্দ যন্ত্রণা গলায় বিঁধে থাকা মাছের কাঁটার মতো খুটে খুটে আনিসের ভেতরের মানুষটিকে। টাইয়ের নট আলগা করে দেয় আনিস। দিনের খতিয়ান মেলায় নিজের সঙ্গে। সারাদিন ‘হ্যাঁ-না’ শব্দ দিয়েই কাজ সেরেছে সে। নিজের অভিমত দিতে যাবে, অমনি মনে হয়, মুখ দিয়ে কথার আগে বেরিয়ে আসবে থুথুর ছিঁটে। বাড়িতে গিয়ে স্ত্রীর কাছে কিংবা অফিসের প্রিয় কলিগদের সঙ্গে বিষয়টি শেয়ার করবে, সেই জোও নেই। তারা হাসাহাসি করবে, মজা নেবে। জহুরি হয়ে বলবে, ওসব আপনার মনের ভুল! আহ্, স্কুল লাইফের বন্ধুরা থাকলে বলা যেতো প্রাণ খুলে। ন্যাংটাকালের বন্ধুরা চট করে বাতলে দিতো সমাধানের তরিকা। তারা এখন কে কোথাই, সে খবর নেওয়ার ফুরসত হয় না। ক্যারিয়ার, পরিবার আর নিজের বর্তমান নিয়ে ব্যস্ত একেকজন পুরানা বন্ধু। নিজেকে খুব একা লাগে আজ আনিসের। জীবনের জার্নিতে কোনো এক সময় মানুষ একদম একা হয়ে যায় নিজের কাছে; আজ সে-দিন বলেই ভ্রম হয় আনিসের। অদৃশ্য বেদনার ভার নিয়ে আনিস আয়নায় নিজেকে পরখ করে এবার চমকে ওঠে! সারা মুখ লালে লাল, অজস্র বিদ্রূপ তাতে খেলা করছে অবলীলায়।
আজ বাবা বেঁচে থাকলে মাথায় মমতার হাত বুলিয়ে বলতেন, ওসব চোখের ভুল রে বাবা। সবারই হয় এমন। এসব নিয়ে ভাবতে নেই, এসব ভ্রমকে পাত্তা দিতে নেই। বাবার চেহারা হাজিরা দিতেই বাচ্চাদের মতো ঢুকরে কেঁদে ওঠে আনিস। টেপের জল পতনের শব্দ আর আনিসের কান্নার শব্দের অপূর্ব মিলনে ওয়াশরুম জেগে থাকে কর্মক্লান্ত ভর সন্ধ্যায়। বেচারা হাকিম সাহেব কী ভাববেন, কে জানে! একই অফিসে থেকেও অনেকের সাথে ফর্মাল সম্পর্কের বাইরে যেতে পারেনি আনিস অথবা তারাও।
আব্দুল হাকিম, মানে আনিসুর রহমানের হাকিম ভাইয়ের ফেয়ারওয়েল এতক্ষণে প্রায় শেষের দিকে। হাকিম ভাই অমায়িক মানুষ, বলতে গেলে অফিসের সবচে সহযোগিতাপরায়ণ অফিসার। আজ তিন বছরের মাথায় অন্যত্র বদলিতে তার ফেয়ারওয়েল আনিসের নেতৃত্ব হওয়ার কথা, অন্যদের আবেগে ভাসিয়ে নেওয়ার কথা। বিক্ষিপ্ত ভাবনাদের বাগানে ডুবে গিয়ে আর থামতে পারে না আনিস। কান্নার ভেতরেও সে স্পষ্ট খেয়াল করে, তার মুখ থেকে গোঙানির সঙ্গে বেরিয়ে পড়ছে থুতুর ছাঁট; আয়নায় ভেসে থাকা তার চেহারার প্রতিবিম্বই থুতুদের গন্তব্য!