[হাসান হাফিজুর রহমান—একাধারে কবি, সাংবাদিক ও সমালোচক। তিনি মুক্তিযুদ্ধের দলিল সম্পাদনার জন্য বিখ্যাত। ১৯৩২ সালে ১৪ জুন জামালপুর জেলায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, বিমুখ প্রান্তর, আর্ত শব্দাবলী, আধুনিক কবি ও কবিতা, মূল্যবোধের জন্যে, অন্তিম শরের মতো, যখন উদ্যত সঙ্গীন, শোকার্ত তরবারী, প্রতিবিম্ব ও আরো দুটি মৃত্যু। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছেন—পাকিস্তান লেখক সংঘ পুরস্কার (১৯৬৭), আদমজী পুরস্কার (১৯৬৭), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭১), সুফি মোতাহার হোসেন স্মারক পুরস্কার (১৯৭৬), অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮১), সওগাত সাহিত্য পুরস্কার ও নাসিরুদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৮২), মরোণোত্তর একুশে পদক (১৯৮৪), স্বাধীনতা পুরস্কার (২০০২)। ১৯৮৩ সালের ১ এপ্রিল এই মহান সাহিত্যিক মৃত্যুবরণ করেন। ‘আরো দুটি মৃত্যু’ তার দাঙ্গাবিরোধী গল্প। গল্পটির প্রাসঙ্গিকতা এখনো সমানভাবে বিদ্যমান। এখনো সমাজ-রাষ্ট্র থেকে এই সংকট মুছে যায়নি। আজ তার মৃত্যুবার্ষিকীতে গল্পটি পুনঃপ্রকাশিত হলো।]
নারায়ণগঞ্জ থেকে বাহাদুরাবাদ যাচ্ছে যে রাত্রির ট্রেনটা, এই যে স্টেশনে এসে থামলো, মাত্র দুমিনিট দাঁড়ায় এখানে। অন্ধকার রাত, কিছুই চোখে পড়ছে না। স্টেশন ঘরটার জানালা ও দরজায় যে আলোর আভাস ছিল, চোখের ওপর অকস্মাৎ ঝাপটা দিয়ে চলে গেছে ট্রেন থামতে না থামতেই। কামরাগুলোর আলোকিত গহ্বরকে চারিদিক থেকে মুড়ে দিয়েছে কালো রাত। বাইরে হাতটি মেলে ধরলেও চিহ্নিত করা যাবে না। ভীষণ শীত পড়েছে; যাত্রী কেউ উঠবে, কি উঠবে না কে দেখে! ভেতরে সব গুটিগুটি মেরে বসে আছি নিলিপ্ত হয়ে।
এমন সময় পাশের কামরা থেকে আওয়াজ শোনা গেল, এহানে জাগা নাই, এহানে জাগা নাই, আরে দেহ না? কথাগুলো শেষ হতে না হতেই ব্যস্ত সমস্ত থপ-থপ পায়ের আওযাজ, চুড়ির শব্দ। মানুষের হাঁপানোর সাথে সাথে কে যেন কামরা ছেড়ে সামনে এগোতে লাগলো। তারপর আমি যে কামরাতে বসে ছিলাম সেইটের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল যারা, ওরা চিৎকার করে উঠলো, এহানে জাগা নাই, এহানে জাগা নাই, আরে দেহ না। কিন্তু ততক্ষণে ঘণ্টি বাজিয়ে দিল স্টেশনের। গার্ডও চলার ইঙ্গিত জানালো হুইসেল বাজিয়ে। কেউ এবার অধৈর্য হয়েই যেন হাতল খুলে দরজাটা ভেতরের দিকে ঠেললো যত জোরে পারে। নিচে কিশোর কণ্ঠে ভয়ার্ত চিৎকারও শোনা গেল একটা, কাকীমা গো! শব্দটা সেই ভয়াবহ নিথর নিস্তব্ধতাকে মুচড়িয়ে দেবার মতো যে লোকটা উঠতে দেবে না বলে দরজাটা চেপে ছিল এতক্ষণ, সে এমনি বিমূঢ় হয়ে গেল যে তার হাতদুটো নিজের থেকেই সরে এলো, নিজেও পেছিয়ে গেলো দুপা। এরপর, প্রথমে একটি পুটলি ও টিনের সুটকেস ঠেলে দিয়ে ভেতরে উঠলো প্রৌঢ় একজন হিন্দু ভদ্রলোক। সাধারণ ধুতি কাপড় পরেছে, ঘিয়ে রঙের চাদর গায়ে জড়ানো। দাঁড়ানোর একটু জায়গা করে নিয়েই হাত বাড়িয়ে নিচের থেকে কিছু তোলার জন্যে এমন সযত্ন ভঙ্গিতে চেষ্টা করতে লাগলেন যেন ঠুনকো কাচের কিছু তুলছেন। কিন্তু যা তুললেন তা একজন মেয়েলোক। মধ্যবয়স্ক, প্রায় ত্রিশ। প্রথম দৃষ্টিতেই মনে হয় যে স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। উঠে পড়েই মেঝের ওপর মুখ থুবড়ে বসে হাঁপাতে লাগলো। এরপর ছোট একটি মেয়ে উঠলো, ন’দশ বছরের, দৌড়তে দৌড়তে। কেননা ট্রেন ততক্ষণে হুইসিল বাজিয়ে চলতে শুরু করে দিয়েছে ঝকঝক করে ।
আমরা যেটায় বসে ছিলাম সেটা একটা ‘একুশ জন বসিবেক’ কামরা । ঠাসাঠাসি করে বসে, একজন অন্যজনের উপর ঢুলে পড়ে এবং তৎক্ষণাৎ ধাক্কা থেয়ে ঘুম ভাঙছিলাম আর ঘুমাচ্ছিলাম। দুজন বেপরোয়া লোক উপরে দেদার জায়গা নিয়েছে। আমি নিজে ঘুম তাড়ানোর চেষ্টা করছিলাম। কারণ, তন্দ্রার ঘোরে পাশের লোকটির শরীরের ওপর পর পর দুবার ঢুলে পড়ার জন্যে যে বিভীষিকাময় আপত্তি শুনেছি, আমার নিজের বেলাতে অন্য কাউকে যদিও তাই বলতাম, তবু হজম করতে পারি নি।
জেগে থাকতে থাকতে প্রথমে কথা বলার ইচ্ছে করছিল। কিন্তু চার পাশের লোকগুলোকে এমনি স্থবির মনে হলো যে প্রাণপণ বেগে ঘা দিলেও এদের একজনের ভেতর থেকে শব্দ রেরুবে না। ফাল্গুনের বিদায়ী শীতের ঠাণ্ডা তো আছেই, তাছাড়া এমনি ক্লান্তির স্তব্ধতা সারাটা ঠাঁই জুড়ে; যেন কথা বলতে গেলেই যতটুকু উষ্ণতা জমিয়ে নিয়েছে বুকের ভেতর এতক্ষণ ধরে, তাও শেষ হয়ে যাবে। এরপর আমাদের জমে যাওয়া ছাড়া কোন উপায়ই থাকবে না। সেজন্যেই শ্বাস প্রশ্বাসের উত্তাপটুকু এতো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয়ে উঠেছিলো, এবং সেটুকুই উপভোগ করা ছাড়া আমাদের আর কিছুই ছিল না। পরস্পরের অজ্ঞাতেই আমরা একে অন্যকে অনুভব করছিলাম শুধু।
এ স্তব্ধতা যে শুধু ক্লান্তির তা নয়,—আতঙ্কেরও।
আমি ঢাকা থেকে আসছি, সেজন্য এ অনুভূতিটা আমার কাছে অত্যন্ত স্পষ্ট। পরস্পরের প্রীতির ওপরেই যেমন সামাজিক সুস্থতার নির্ভর, তেমনি পরম্পরের আক্রোশের ভেতরেই সবচেয়ে বড়ো অশান্তি। এ অশান্তি যে কি, আমি জেনেছি ঢাকার দাঙ্গায়, কোলকাতার পরেই যা শুরু হয়েছিল। এমন ভয়ঙ্কর যন্ত্রণার অনুভূতিতেই কোনো দিন ক্লান্ত হইনি ; এই চল্লিশ বছরের জীবনে কখনও জানি নি। ঢাকায় গিয়েছিলুম মেয়েকে দেখতে, জামাই রেলওয়ে কলোনীর বাসিন্দা, সেখানেই ছিলাম। এই এলাকা দাঙ্গাকে রোধ করেছিল। সেই হয়েছে এক মুশকিল আমার জন্যে। খুন-উন্মত্তদের ভেতরে থেকে যদি আমারও সারা শরীর তেতে উঠতো, যদি চিন্তাবুদ্ধি উবে যেতো ধুয়োর মতো আগুনের হলকায়—তা’হলেও হয়তো এক সান্তনা ছিল! কিন্তু যে পরিবেশে আমি ছিলাম সেখানে থেকে এই পাশবিকতাকে ঘৃণা করা ছাড়া কোন উপায় ছিল না। যে সুস্থ প্রতিরোধের ভেতর আমি ছিলাম, সেখানে থেকে এই হিংস্রাতার ভয়াবহ পরিণতিকে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করা ছাড়া কোনো পথ ছিল না। এই ঘৃণা যে একবার অনুভব করেছে, তার অস্বস্তি যে কী, আমি জানি ।
জরুরি কাজ ছিল বটে, বাড়ি ফিরতে পারি নি। মাঘ-শেষের পড়ন্তশীতের দিন, অথচ এমনি হিম বাতাস ঝাপটা দিচ্ছিল যে আমার মনে হয়েছিল অন্ততঃ আমার জীবনের এতগুলো বছরের সজাগ অভিজ্ঞতায় এমনটি আর কখনো দেখিনি। আকাশে প্রান্তরে ছিল শীত আর আতঙ্ক, মানুষেব মুখে মুখে ছিল স্তব্ধতা আর আতঙ্ক । শান্তিকামী কলোনীর সারা ঠাঁই জুড়ে সে কি! প্রতিরোধ, দাঙ্গাকে রুখতে প্রাণান্ত হয়েছিল।
আত্মীয়তার এই শেষ রশ্মিটুকু যদি না দেখতাম তবে হয়তো পাগলই হয়ে যেতাম।
এখন ফিরছি বাড়ি; না জানি সেখানে কি হয়েছে। যমুনাপারের বৃত্তান্ত মানুষগুলো যে হুজুগে মাতে ; আমি তো তা জানি, আপন ভাইকেও মানাতে পারি নে। এখন অবশ্য আবহাওয়া শান্ত হয়েছে অনেকটা । মানুষের স্বভাব শুভ বুদ্ধি ও চেতনার জন্যেই এ অবস্থা টিকতে পারে না। যদিও গুণ্ডা বদমায়েশের অত্যাচার একেবারে শেষ হয়নি, তবুও অনেক শান্তির আশ্বাস এসেছে মনে । এবং এই সুযোগেই যে এই হিন্দু ভদ্রলোকটা সঙ্গে আর দুজনকে নিয়ে, অনেকেরই মতো নিরাপদ জায়গায় চলে যাচ্ছেন তা আমি প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলুম।
লোকটা উঠেই একটিমাত্র কাজ করলো শুধু; জড়িয়ে বাঁধা বিছানাটা, হয়তো ওর ভেতর অনেক প্রয়োজনীয় জিনিসই আছে যাতে বেশ মোটাসোটা দেখাচ্ছে, মেঝেতে সমান করে রাখলো, হাত ধরে বসিয়ে দিলো মেয়েলোকটাকে সযত্নে! যেন পবিত্র কিছু রাখছে, এমনি সম্ভ্রমশীল, স্পর্শকেও যেন পবিত্র করে নিয়েছে। ছোট্ট মেয়েটি ওঁর শরীর ঘেঁষে বসলো বাকী জায়গাটায়। এরপর প্রৌঢ় ভদ্রলোকটি কোন দিকে না চেয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন ওদের পাশেই। এমন মনে হলো যে, কোন দিন কিছু দেখবেন না’ কোন কিছু দেখতেও চাইবেন না। যান্ত্রিক; মূক।
লোকটাকে দেখেই প্রথম অবধি আমার কেমন ঠেকছিল। অনুভূতিটা ঠিক যে কি বুঝতে পারি নি। অথচ একটা স্পষ্ট আকর্ষণ ছিল মনে, চোখই ফেরাতে পারছিলাম না ।
ভয় আর আতঙ্কে মুখটা তার চুপসে গেছে, ফ্যাকাশেও হয়েছে, বেশ একটু দুরে বসলেও আমার নজরে পড়লো। খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, আর একটু বড় হলেই মৌলবীদের মুখের মতো হয়ে উঠবে। কিন্তু লোকটা পরে এসেছে ধুতি ; তিনটি মানুষের ভেতরে কারুরই—ওরা যে হিন্দু এই ইঙ্গিতটি লুকিয়ে ঢেকে রাখবার এতটুকুও চেষ্টা নেই। অথচ ট্রেনটা নিরাপদ, এমন মনে করার কোন কারণ আছে বলে ভাবা যায় না । ট্রেনেও খুন খারাবি হয়েছে এবং হচ্ছে। একজন হিন্দুর পক্ষে বিপদটা এখানেও কম নয়। লোকটা একথা জানে বলেই মনে হলো। উট পাখি যেমন বালুতে মুখ লুকিয়ে বিপদ এড়াবার চেষ্টা করে, তেমনি আমাদের কারো দিকে একবার পর্যন্ত না তাকিয়ে ভয় আর আশঙ্কা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য প্রাণপণে নিজেকে শক্ত করে রাখছে ! সে জন্যেই আমার সহযাত্রীদের মুখের দিকে একবার করে চেয়ে চেয়ে না দেখে পারলাম না। প্রায় সবাই ঘুমিয়ে আছে, দু-চার জন যারা জেগে, তাদের চেহারাটাই কেমন স্তিমিত। চাইছে যখন ভেজা আর নিরীহ চোখে কি ম্লান দৃষ্টি ! ওদের সবাই এদেরকে লক্ষ্য করেছে সহজেই বোঝা যায়। লোকগুলোর দৃষ্টিতে এবং কয়েকটা দীর্ঘ শ্রান্ত শ্বাস প্রশ্বাসে এই প্রমাণ করছিল যে এই তিন জনের এমন দুরবস্থার জন্যে ওরা নিজেরাও কম অনুশোচনা ভোগ করছে না। কম অস্বস্তি নয় ।
সব মিলিয়ে কেমন একটা ক্লান্ত গুমোট ভাব।
আমি অনেক স্থানে যাতায়াত করেছি; রাজধানী ঢাকায় প্রায়ই তে। আসতে হয়। কিন্তু এ দুর্বিসহ মুহূর্তের স্পর্শ কোন দিন পাই নি। আমার মনে হচ্ছি, এটা দাঙ্গার আতঙ্কেরই ফল । চারদিকের অমানুষিকতাই মনগুলো এমন করে থুবড়ে ছেঁচড়ে দিয়েছে। এ বিষণ্ণতা অপরাধ বোধের ।
লোকটা যমুনার গাঢ় জলের মতো ঘোলা, দৃষ্টিহীন চোখ মেলে আছে। আর আমি উৎকণ্ঠিত।
সারাটা কামরার কেউই কি ওঁর সঙ্গে একটি কথাও বলবে না? সংকোচই কাটাতে পারছে না কেউ। না এর সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজনই সবার মিটে গেছে হঠাৎ? যেন এ এখন এক আলাদা জগতের মানুষ; যার সাথে আবার সহজ সম্বন্ধ করার জন্যে এমনই অনুভূতির প্রয়োজন যা আসবে কি যে এক আত্মমন্থন থেকে, যে ভাবতেই শিউরে উঠতে হয়!
এতক্ষণে আমার কাছে স্পষ্ট হলো, লোকটার জন্যে একটা নিবিড় করুণাও অনুভব করছি মনে মনে।
সঙ্গে সঙ্গে এও মনে হলো, লোকটা অত্যন্ত সরল; জীবনের ভয় আছে, ফাঁকি ঝুঁকি নেই। অথচ এমনি প্রাণের তাগিদে বেরিয়ে আসতে হয়েছে যে এই রাত্রি বেলাতে ট্রেনকেও নিরাপদ মনে করতে হয়েছে।
ভাবলাম একবার ডাক দিই; ভাবলাম একবার কাছে এনে বসাই ।
পর মুহূর্তেই সমস্ত কামরাটার দিকে চেয়ে গলা দিয়ে আর শব্দই বেরিয়ে আসতে চাইলো না। মনে হলো এখন যদি একটি মাত্র কথাও বলি, তবে তা ভারী কাচ ভেঙে চুরমার হাওয়ার মতো শব্দে খান খান করে ফেলবে এই দুঃসহ নিস্তব্ধতাকে । সেই আওয়াজ অনন্তকাল ধরে কুরে কুরে বাজতেই থাকবে, কোনদিন থামবে না। আর সেই তিনটি মানুষও ভয়াবহ আতঙ্কে ও শঙ্কায় শুধু কাঁপবেই, কাঁপতেই থাকবে; যতক্ষণ পর্যন্ত না বিবর্ণ নীল হয়ে মরে যায়।
যমুনার সেই উত্তাল ঢেউগুলো যেন খলখল করে উঠলো বুকের ভেতর। কেমন একটা ভয়ে চুপ করে গেলাম।
মানুষের বন্য আক্রোশ ওদের তাড়া করে ফিরছে।
মুখটি ঘুরিয়ে নিয়ে ঘাড গুঁজে রইলাম কতকক্ষণ নিচের দিকে চেয়ে । তারপর লাইটের চারদিকে ঘুর্ণমান পতঙ্গগুলোর অধৈর্য পাখা ঝাপটানো দেখলাম। আমাদেব কামরার তিনটি সার। আমি বসেছিলাম জানালার কাছের একসারে। মধ্যের সারের লোকগুলোরই অসুবিধা বেশি। ওদের হেলান দেয়ার সুবিধে আমাদের মতো নয় ; তাছাড়া হাওয়াও তো পায় না গরমে। ঠিক যেন মাঝের জমি, নালার পানি পায় সবচেয়ে কম। ওদের একজনের লালা গড়িয়ে পড়ছিল চোয়াল বেয়ে। ঘুমকাতুরে আর একজনের দাড়ির অগ্রভাগটা গাড়ির ঝাঁকুনির সঙ্গে সঙ্গে যেয়ে লাগছিল আর একজনের ঘাড়ে। সে লোকটাও ঘুমে—সুড়সুড়ি লাগা জায়গাটা বারবার চুলকিয়ে নিচ্ছিল ঘুমের ঘোরেই।
অন্যসময় হলে হাসতাম হয়তো। কিন্তু এখন কেমন মায়া লাগলো তিনজনের ওপরেই। ঘাড় ফিরিয়ে আবার চাইলাম সেই হিন্দু লোকটার দিকে। লোকটা এখন আমার উল্টো দিকের থাকে রাখা বেডিংয়ের সাথে ঝুলানো একটি লোটার ওপরে চোখ রেখেছে। তৃষ্ণায় নিম্প্রভ চোখ দুটো যেন জ্বলছে। কয়েকবার শুকনো ঢোকও গিললো বলে মনে হলো। মনের জড়তাকে এক মুহূর্তে ঝেড়ে ফেলে হাত নেড়ে হঠাৎ ডাকলাম তাকে। লোকটা অপ্রস্তুতের মতোই সামনে এসে দাড়াল ধীরে ধীরে। আসবে কি আসবে না এই ইতস্ততটুকু করার সাহস পর্যন্ত নেই। ঠোঁট নেড়ে বললোও যেন কি ! কিছুক্ষণ অসাড় কন্ঠে সাড়া জাগাতে চাইলাম আমি নিজেও । পরে সহসা পাশে অনেকটা জায়গা করে দিয়ে বলে উঠলাম, বসেন। আমার পাশের লোকটাও সমর্থন করে বলে উঠলো হ্যাঁ, হ্যাঁ, বসেন। অন্তত শরীরের গরমে আর একটু চাঙ্গা হওয়া যাবে, আমাদের শীতের কাপড় যা আছে তা ত হু…
এদিকে রাতও শেষ হয়ে আসছে। আমরা অনেকগুলো স্টেশন পার হয়ে এসেছি ইতোমধ্যে। লোকটা অসলো। উপায়ান্তর নেই বলেই বোধ হয়। কিন্তু উসখুস করতে থাকলে কেমন। বারবার তার সাথের অসুস্থ্য স্ত্রীলোকটার দিকে তাকাতেই লাগলো। উৎকণ্ঠায় একটা শিখার মতো দপদপ করে উঠছে, আবার নেতিয়ে যাচ্ছে ওর পাশ থেকে চলে আসার জন্যেই কি অস্বস্তিটা হঠাৎ বেড়ে গেছে ? ভাবলাম, হয়তো বা আমাদের সান্নিধ্যে এসে সে কিছুতেই সহজ হতে পারছে না।
লোকটা গলা উঁচু করে বসেছিল। কণ্ঠনালীর বাকা জায়গাটায় আলোর চিকচিকে ছাট এসে পড়ছে। হঠাৎ চোখ পড়লো আমার তার ওপর। ওই সামান্য জায়গাটুকু—জোরে টান দিলেই হয়তো, একটু ছুরির আঁচড় লাগালেই তো শেষ হয়ে যেতে পারে লোকটা ! এত ক্ষীণ প্রাণ মানুষ, এতো সংক্ষিপ্ত।
একেই নিশ্চিহ্ন করার জন্যে কি বিভীষিকাময় পরিকল্পনা, এতো হিংসা। লোকটাকে যেন মুঠির ভেতর অনুভব করতে পারছি। সম্পূর্ণ আয়ত্বে আমার সে । এতো ছোট, ভীরু কপোতের মতো একটা মানুষ !
বুকটা শির শির করে উঠলো। লোকটাকে কি আমি মুচড়িয়ে দিতে পারি? এক্ষুনি?
বুকের উত্তাল ঢেউটি জোরে বাক নিয়ে নামলো। সঙ্গে সঙ্গে কেমন অদ্ভুত একটা স্নেহে ঝিমিয়ে এলাম। নিস্তেজ, তৃপ্ত অবসাদে ।
ইচ্ছে হলো সারাটা রাত গল্প করে কাটিয়ে দিই। নিয়ে যাই একে আমাদের বাড়ী। কোথায় যাবে কষ্ট করে আর নিরাপত্তার খোঁজে, আমি ওকে আগলাবো।
লোকটার দিকে চেয়ে জোরে একটা নিশ্বাস ফেললাম।
মেহনতী মানুষ আমরা, প্রাচুর্য না থাকলেও দুটো তিনটে মানুষকে যে ভাব বলে মনে করবো, এতো ছোট হয়ে যাইনি । কিন্তু গ্রামের কথা ভাবতেই প্রথমেই মনে হলো, এদের নিয়ে যাব বাড়ীতে, আমরা সব একসাথে বসতি করব, এমন সময় আর নেই। আবাব কবে তা আসবে, তাও জানিনে। গ্রামের কথা মনে হতেই আরো চিন্তা এলো বানের পানির মতো হু হু করে । কি হয়েছে, কেমন আছে, কেমন চলছে—সংসারের মধ্যে জড়িয়ে গেছি আমরা— চিন্তা একবার শুরু হলে একেবারে অতলে ডুবে যেতে হয়।
কিন্তু সব ফেলে পাশের লোকটার দিকেই যে খেয়াল দেয়া প্রয়োজন, তাই মনে হলো । নেড়েচেড়ে বসলাম জুতোটা খুলে। ভাইয়ের ছেলের জুতো পরে এসেছিলাম, আঁটসাট হওয়াতে পা গেছে কেটে । টাটাচ্ছিল। পা তুলে নিলাম ওপরে। শরীরটা একটু প্রসারিত হলো। সঙ্গে সঙ্গে লোকটা এমন সংকুচিত, একটি সরল রেখার মতো শীর্ণ হয়ে জায়গা দিতে চাইলো যে, লজ্জায় শিউরে উঠলাম।
এখনো কি সে ভয় করছে আমাকে । ভয়?
পা নামিয়ে নিলাম তাড়াতাড়ি করে । ওর পিপাসার কথাটাও মনে হলো তখনি। অনেকক্ষণ থেকেই খচ খচ করছিল। হঠাৎ প্রশ্ন করে উঠলাম, পানি খাবেন ?
মাথা নেড়ে বলল, না।
কথাটা শেষ হতে না হতেই সারাটা শরীরও কেঁপে উঠলো তার থরথর করে। ঘাড় ফিরিয়ে স্থির, নিস্পন্দ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইল সেই মেয়েটার দিকে। এবার অবাক হলাম আমি । মেয়েটাকে ঘিরে ওর অস্বস্তিকে লক্ষ্য করেছি। কিন্তু কাঁপছে কেন এ ? এতো ? কিন্তু ওর দৃষ্টিকে অনুসরণ করে যা দেখলাম তাতে অবাক হলাম আরো । গাড়িটা যতোবার কেঁপে উঠছিল, মেয়েটারও সারা শরীরে ঝাঁকি দিয়ে অদ্ভুত বেদনায় কুঁকড়ে দিচ্ছিল মাংস পিণ্ডগুলো। প্রত্যেক কাঁপুনির সাথেই এমনি করে সে শিহরিত হচ্ছিল। যেন মৃত্যুর দাঁত থেকে নিজকে ছিনিয়ে নিচ্ছে বার বার।
ইচ্ছে হলো জিজ্ঞেস করি, ব্যাপারটা কী ।
কিন্তু লোকটা নিজেই এবার মুখ ফিরিয়ে বলল, আর্ত, অথবা চাপ, ফিসফিসে স্বরে,—প্রসব!
কথাটা প্রথমে বলকিয়ে বলকিয়ে সেই ভয়াবহ নিস্তব্ধতাকে দুমড়াতে লাগলো। তারপর থমথম করে বাঁজতে থাকলো। অবশেষে সমগ্র নিস্তব্ধতাটাই যেন কথাটার ভেতর স্থির হয়ে, পাথরের ওপর খোদাই করা অক্ষর যেমন থাকে, তেমনি স্থবির হয়ে গিয়ে সমস্ত কামরাটা ভরাট করে ফেললো। মেয়েটা যে আসন্ন-প্রসবা, তা আমার প্রথমেই লক্ষ্য করা উচিত ছিল। গ্রামে একটা সুনাম আছে, সবার টুকিটাকি খোঁজও রাখি বলে। কিন্তু এটা এমনি অসম্ভব যে আমার ধারণাতেও আসার সুযোগ পায় নি। কেননা একজন প্রসব-উন্মুখ মেয়েকে পথ হাটিয়ে আনা, গাড়ির ঝাঁকুনিতে অন্য কোথায়ও নিয়ে যাওয়া স্বাভাবিক কথা নয়। এদের সম্পর্কে অন্ততঃ এতটুকু কল্পনাতেও আসেনি আমার । কিন্তু এখন ভাবতেই সারা দেহ রাগে শির শির করে উঠলো। কেমন, মানুষ! লোকটাকে ধিক্কার দেব মনে করলাম, মনে করলাম অভিসম্পাত করব। সেজন্যেই মুখ ফেরালাম। কিন্তু তখনি মনে হলো এ ছাড়া হয়তো এদের আর কোন উপায় ছিল না। মৃত্যু এদের সব দিকে ঘিরে আছে। যে মুখটাতে অভিসম্পাতের বিষ ছড়াবো ভেবেছিলাম, সেখানে চাইতেই দেখি সেই ম্লান চোখ দুটো ছল ছল করছে! কান্নাকে প্রাণপণে ঠেঁকিয়ে রাখলে যেমন হয়, তেমনি।
ছোট মেয়েটা ঘুমুচ্ছে। আর ও মেয়েটা সমস্ত বেদনাকে সংযমে রাখার জন্যে এখন এমনি তীব্র আবেগে শরীর চেপে রাখছে যে একটি নিঃশব্দ গর্জনই যেন প্রত্যেক অঙ্গ প্রত্যঙ্গ থেকে গুমরিয়ে উঠছে। কাঁপছে, কুঁচকাচ্ছে; মাথাটা হাঁটুর ভেতর সেঁধিয়ে দিতে চাচ্ছে। অথচ রা পর্যন্ত করছে না। কি যে দুঃসহ এই জনান্তিকে লক্ষ্য করা। বিহ্বল করে ফেলে সমগ্র চেতনাকে । নিরুপায় বিহ্বল ৷
এতক্ষণে ঘেমে উঠেছি আমি ।
আরো, আরো কতকাল সে অমনি নিংশব্দে গুমরাতে থাকবে ।
মেয়েটা সেখানে থাকতে পারলো না আর। বেদনা এখন সারা দেহে সংক্রমিত হয়ে পেশীগুলো উৎক্ষিপ্ত করছে। অবশেষে হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে পায়খানার ভেতর চলে গেল, নিজেকে প্রাণান্ত চেষ্টায় ছ্যাচড়িয়ে টানতে টানতে ।
এবার লোকটা নিশ্চয়ই চিৎকার করে উঠবে ? বুক ফাটিয়ে দেবে চৌচির করে, নয়তো দুহাতে ওকে চেপে ধরবে যেয়ে উচ্ছৃঙ্খলের মতো। কিন্তু সে কিছুই করলো না। আরো শক্ত হয়ে বসে রইল নিজের জায়গাটাতেই।
এ অবস্থায় কি করা যায় ভেবেই পেলাম না, কি সাহায্য করা যেতে পারে ধারণাতেই আসলে না। লোকটা কি সংজ্ঞালুপ্ত হয়েছে? বজ্রাহত মানুষ যেমন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, একটু স্পর্শ পেলেই হুড়মুড়িয়ে পড়ে যায় মাটিতে, এও তেমনি ;–স্থির হয়ে আছে, একটু স্পর্শ পেলেই ভেঙে পড়বে কি ?
ভেবেছিলাম সমবেদনা জানাব,—চুপ করে গেলাম।
ভেবেছিলাম নানা রকম গল্প করে মনটা সরিয়ে নেব তার গাঢ় উদ্বিগ্নতা থেকে, —গলা দিয়ে কথাই বেরুল না।
মনে হলো আমারও পিপাসা, ভীষণ ।
রাত্রি শেষ হয়ে আসছে। আর একটা ষ্ট্রেশনের পরেই ঘাট। যমুনা বিধৌত বাহাদুরাবাদ। ঘাটেই নামতে হবে আমাকে । বাড়ি সেখানেই তো। ইতিমধ্যে এই কামরার অধিকাংশ যাত্রীরাই নেমে গেছে। গুটি কয়েক যারা ছিলাম, খুব সম্ভব আমি বাদে সকলেই নদী পার হয়ে যাবে। এখন জেগে উঠছে। আয়েশের হাই তুললো কেউ কেউ জোরে জোরে। অস্ফুটকণ্ঠে দু-একটা ঠুনকো কথাও বললো আলগোছে। সেই প্রসব বেদনাকাতর দীর্ণপ্রাণ মহিলাটির গোঙানির আওয়াজও শোনা যাচ্ছে নাকি ? এতক্ষণে জাগছে সব শ্লথ-ভাবে । এখন কেমন করছে সে পায়খানা ঘরটার ভেতর ? বিছানাপত্তর বাঁধতে লাগলো অনেকে । বন্ধ জানালাগুলো নামিয়ে দিলো। বাইরের আবছা আলোয় লাইটের দগদগে লাল মুখটা নিম্প্রভ হয়ে গেলো। নিম্প্রভ মুখ । সকালের হাওয়ায় অনেকটা চাঙ্গা হয়ে উঠলাম, লোকটাও এবারে কিছু জোর পাবে মনে হয়তো ।
অনেক সংকোচ কাটিয়েই দমকা হাওয়ার মতো হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলাম, একবার দেখা যায় না, তাঁর কি হলো… উচিত…
কিন্তু এ কথা শোনামাত্রই এক অকস্মাৎ লজ্জায় লোকটা এমনই বিমূঢ় হয়ে গেল যে, মনে হলো, তার সমস্ত শরীরটাই আগুনের হলকার মতো জলে উঠেছে, শিরা উপশিরা দপ-দপ করছে। স্পষ্ট দেখতে পেলাম তার ঠোঁট দুটো থর থর করে কাঁপছে। বুড়ো মানুষের এমন করে ঠোঁট কাপতে আর কখনও দেখি নি আমি। অন্ততঃ এই চল্লিশ বছরের অভিজ্ঞতায় যতদূর জানি—এই বয়সের মানুষ সাধারণত ভেতরের দুর্বলতাটা কিছুতেই জানাতে চায় না। কিন্তু লোকটা সংযম হারাচ্ছে। –
এত লজ্জা আর সংকোচই বা কিসের বুঝতেই পারলাম না।
কিছু জিজ্ঞেস করে যে উত্তর পাবো, লোকটা তেমন অবস্থায় আছে— তাও মনে হলো না ।
প্রায় এক ঘণ্টারও ওপরে হয়ে গেল মেয়েটা সেই যে পায়খানার ভেতরে ঢুকেছে, কি যে হলো তার । এই লোকটাব মতোই আমার নিজেরও চুপ করে থাকা ছাড়া কি উপায় আছে! ব্যাপারটা আমার আওতার বাইরে বলেই হয়তো, হয়তো এমন নিক্রিয়তা অসহ্য ঠেকছিল সে জন্যেই, এক অদ্ভুত উস্মায় মনটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছিল বার বার।
যা হচ্ছে, মোটেই কাম্য নয়। এখনি কিছু করতে হবে।
কিন্তু লোকটাকেই তাড়া দেব, না আমি নিজে কিছু করব ; ব্যাপারটা আদতে কেন এমন হচ্ছে, তাই জিজ্ঞেস করব, না অতিসম্পাত দেব বুড়োকে– কিছুই ঠিক করতে পারলাম না। দপ দপ করতে থাকলো রগগুলো । অবশেষে আরো স্তব্ধ হয়ে যেয়ে অস্বস্তিকে শান্ত করতে চাইলাম।
কান পেতে রইলাম আকাঙ্ক্ষায় উৎকীর্ণ হয়ে– হয়তো নবজাত শিশুর কোমল কান্নায় এই ভয়াবহ ফসিলের মতো স্তদ্ধতা এক আর্ত নারীকণ্ঠের তীক্ষ্ণ, তীব্র প্রতিবাদে দুমড়িয়ে যাবে এই স্থবিরতা। এই প্রাণান্তকর গাম্ভীর্যের অবসান হবে নবজাত সৃষ্টির কলকণ্ঠে । তাই হোক, তাই হোক ।
কিন্তু কিছুই হলো না।
দাঁতে দাঁত চেপে ফিরে তাকালাম লোকটার দিকে। এই শীতেও আমার কপালে জমে উঠেছে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম। ঘূর্ণায়, বিরক্তিতে কাঁপছে ঘাড়ের রগ। কঠিন দৃষ্টিটি ফেরালাম উদ্ধত করে ; কিন্তু সে শীর্ণ প্রৌঢ় মুখে তখন গড়িয়ে পড়ছে পানি, কোঠরাগত চোখ বেয়ে বেয়ে ।
অবশেষে এক ভারী নিঃশ্বাস ফেলে বুকটাকে শান্ত করতে চাইলাম।
ইতোমধ্যে ঘাটে এসে ঢুকলো ট্রেন। দুপাশে সার দেয়া কুলির ভেতরে থামলো অবশেষে। যাত্রীরা সব হুডমুডিয়ে নামতে লাগলো। এতক্ষণের স্তব্ধমানুষগুলো সহসা নতুন এক বেগ পেয়ে ছটফটিয়ে অসম্ভব ধৈর্যহীনতায় চারদিকে ভাঙতে থাকলো । এও এক নতুন বিষণ্ণতার গর্জন যেন। এ স্তব্ধতার আওয়াজ আছে, আরো ভয়ংকর। আবছা অন্ধকারে মানুষগুলো আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেতে লাগলো। কামরায় কেউ রইলো না আর। মনে করলাম লোকটা এবারে উঠবে। কিন্তু সে নড়লোও না ।
আমিও দাঁড়াতে পারছিলাম না কেন, জানি নে । ঘুমকাতুরে ছোটমেয়েটা যাত্রীদের দাপাদাপিতে জেগে উঠেছিল। চোখ মুছলো, হাই তুললো। তারপর আশে পাশে কোথাও কাকীমাকে না দেখে উদ্বিগ্ন হতে থাকলো। অস্ফুট কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলো, কাকী, কাকীমাগো । বুডো লোকটার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টি তুলে সে চিৎকার করলো। কিন্তু সম্বোধন করে জিজ্ঞেস করতে পারলো না কিছুই। দুর্বোধ্য লোকটা তেমনি রইল যেমন ছিল ; স্তব্ধ, নিথর, নিম্প্রাণ।
সেখান থেকে কোন উত্তর আসবে না জেনে আমিই চেঁচিয়ে উঠলাম প্রাণপণে। কিন্তু পরক্ষণেই টের পেলাম গলা থেকে আওয়াজই বেরুচ্ছে না এতটুকু শুধু হাতটা নেড়ে নেড়ে ইশারা করছি মেয়েটাকে । তারপর শব্দ যখন বেরিয়ে আসলো নিজের কাছেই কেমন বেসুরো ঠেকল, ওই পায়খানাটায় দেখ, খুলে দেখ …শিগগির…ওই, ওই খান…
মেয়েটা হতভম্ভের মতো দেখলো আমাকে। ছুটে গেলো সেদিকে। দরজা খুলল। তরিৎপৃষ্টের মতো দাঁড়িয়ে রইল কতক্ষণ। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়লো ভেতরে বিকট চিৎকার করে, কামীমাগো । অনবরত সে চিৎকার করতে লাগলো। জেঠা মশাই গো…আসনা গো…কী হলো গো…কাকী…
ভয়ে আমি দাঁড়িয়ে পড়েছি। সমস্ত লোম সোজা হয়ে উঠেছে। শির শির করছে।
লোকটার দিকে তাকালাম, সে আরো স্থির হয়ে গেছে। এতক্ষণ নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ হচ্ছিল, বুক উঠছিল নামছিল—এখন তাও বন্ধ। তারপর পাগলের মতো দু’হাতে ঝাঁকাতে লাগলাম তাঁকে।
পিতৃস্থানীয় জেঠামশাই ছোট ভাইয়ের স্ত্রীর অমন বীভৎস মৃতদেহ দেখবেন না, বুঝতে পারলাম এতক্ষণে । ছোট মেয়েটা কাঁদতেই থাকবে কুরে কুরে, আমারও যে বলার কিছু নেই—তাও মনে হলো । আমরা তিনটি প্রানির উৎকণ্ঠা যে কি, কে বুঝবে! কে বুঝবে!
ভাবলাম একবার দেখি, অবস্থাটা কি। কিন্তু যে আজন্ম সংস্কার আর নিরুপায় বিহ্বলতা সেই প্রৌঢ় লোকটাকে অমন করে ফেলেছে তাই আমাকেও স্থবির করলো। অসহ্য নিষ্ক্রীয়তায় চোখদুটো বন্ধ হয়ে এলো । তীব্রতম আবেগের মুহুর্তেই মানুষ বুঝি এমন করে বন্ধা হয়ে যায়।
চোখ দুটো বন্ধ হয়ে গেলো, সামনে নিরন্ধ্র অন্ধকার ।
অন্ধকার, যেখানে স্পষ্ট একটি নারীদেহ ভেসে উঠেছে। রক্তাক্ত দেহ, মুখ হাঁ হয়ে আছে। পেট অত্যন্ত উঁচু। চোখ উল্টে গেছে বিকৃত হয়ে অসম্ভব বেদনাকে সহ্য করার অস্বাভাবিক চেষ্টায়। একটি মা। একটি মাতৃত্ব আকাঙ্ক্ষী নারী, জীবনের জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যুঝেছে। তার ফুলে-ওঠা পেটের ভেতর আছে একটি শিশু, একটু আগেও জীবিত ছিল যে । জন্মাতে পারলে অনেক কিছুই হয়তো করতে পরেতো ; সুখী আগামী পৃথিবীর বুকে শ্বাস টানতে পারতো অন্তত । এ জন্মকে রুখলো কে ?
তখনি কি এক যন্ত্রণায় সারা বুকটা কুঁকড়িয়ে উঠলো আমার। আর কি ঘৃণা, ধ্বংসের জন্যে ঘৃণা, অসহ্য।
প্রৌঢ় লোকটার মুখ আমি মনে করতে পারিনে আর ; কিন্তু তার স্তব্ধতাটি এখনও আমার বুকের ভেতর জড়িয়ে আছে।
আরো দুটি মৃত্যু (১৯৭০) থেকে গৃহীত