এক.
তোতন ওর চশমাটা খুলে আমার অগোছালো টেবিলের ওপর রাখলো। এরপর দুই হাত দিয়ে মুখে কয়েকবার হাত বুলিয়ে আমার দিকে চেয়ে মিষ্টি করে হাসলো। ওর হাসিটা সত্যি খুব সুন্দর। চশমা পরতে পরতে চোখের নিচে কালো দাগ পড়েছে। তাই চশমা খুললে চেহারাটা অন্য রকম লাগে। তোতন টেবিলের ওপর থেকে চশমাটা নিয়ে পরে।
এরপর আবার বলা শুরু করে—জানো, সত্যি কথা হলো এই যে আজ পর্যন্ত আমি আমার মায়ের আসল নামটা জানি না? ছোট বেলায় কেউ যদি জিজ্ঞাসা করতো, বলো তো খোকা তোমার বাবার নাম কী? আমি চটপট উত্তর দিতাম মোকাম্মেল হাবিব। কিন্তু প্রশ্নকারীরা হয়তো অপেক্ষা করতো মূল মজাটার জন্য। তারা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে আবার প্রশ্ন করতো—এবার বলো তো খোকা, তোমার মায়ের নাম কী? সেখানেও আমি চটপটই উত্তর দিতাম, আম্মা। আমার উত্তর শুনে প্রশ্নকারীরা তো বটেই আম্মা নিজেও হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়তেন। পান টুকটুকে লাল ঠোঁটে আমাকে চুমু দিয়ে জড়িয়ে ধরতেন। এরপর কোলে নিয়ে অনবরত চুলে বিলি কাটতে কাটতেন।
সকাল বেলায় পরীবাগের রাস্তার ঝাড়ুদারদের ঝাড়ু বোলানো ধুলো, ছায়া ছায়া আমেজ, জগিং করতে করতে চলে যাওয়া লোকগুলোর অবয়ব এখনো আমার স্পষ্ট মনে আছে
আশ্চর্যজনক ঘটনা হলো বাবা, দাদা-দাদিকে কখনোই আম্মার নাম ধরে ডাকতে শুনিনি। তারা সবাই তাকে ডাকতেন তোতনের মা বলে। ধরো বাবা বাজার করে নিয়ে এসেছেন, ফ্যান ছেড়েই হাঁক দিতেন তোতনের মা আমাকে এক গ্লাস পানি দিয়ে যাও তো। কিংবা কখনো কখনো দাদা অথবা দাদিও হাঁক দিতেন, তোতনের মা পান দ্যাও, তোতনের মা কী রান্ধো? যদিও এ নিয়ে আম্মাকে কখনো আফসোস করতে দেখিনি। তিনি হয়তো ছেলের মা পরিচয়েই খুশি ছিলেন।
দুই.
তোতন আমার দিকে তাকিয়ে আবার মিষ্টি করে হাসলো। তবু ওর মুখে কিসের যেন একটা বিষাদ লেগে আছে, যা ওর মিষ্টি হাসিটাকে অর্থবহ হতে দেয় না। আমাকে প্রশ্ন করে, আচ্ছা, তোমার ঘরে সিগারেট ধরালে সমস্যা নেই তো? ছাই ফেলবো কোথায়?
তোতন অবশ্য আমার অনুমতির তোয়াক্কা না করেই সিগারেট ধরাতে শুরু করেছে। আমি নিঃশব্দে ভাঙা বাটিটা ছাই ফেলার জন্য ওর দিকে এগিয়ে দিলাম। তোতনের চেহারা এমনিতেই খুব মিষ্টি। সদ্য ধরানো সিগারেটের সাদা-নিলচে ধোঁয়ায় তাকে আরও সুন্দর লাগছিল। সিগারেটের প্রথম ছাইটুকু ঝেড়ে সে আবার শুরু করলো—তুমি কখনো সমাজ সংসারের স্তূপের নিচে কারও নিজস্ব পরিচয় চাপা পড়তে দেখেছো? আমার আম্মা তেমন একটা উদাহরণ হতে পারেন। আমি যখন স্কুলে মায়ের নাম লিখতাম, তখনো লিখতাম মিসেস হাবিব। সেখান থেকেও কখনো আম্মার আসল নামটা জানা হয়নি।
আম্মার সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের শুরুটা হয় সম্ভবত স্কুলে ভর্তি হওয়ার পরে। এর আগেও হয়তো ছিল কিন্তু স্পষ্ট কিছু মনে নেই। মনে আছে, আমরা তখন থাকতাম পরীবাগে। আম্মা প্রতিদিন সকালে আমাকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে স্কুলে যেতেন। সকাল বেলায় পরীবাগের রাস্তার ঝাড়ুদারদের ঝাড়ু বোলানো ধুলো, ছায়া ছায়া আমেজ, জগিং করতে করতে চলে যাওয়া লোকগুলোর অবয়ব এখনো আমার স্পষ্ট মনে আছে। আমার হাত ধরে যখন তিনি ওই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতেন, তখন তাকে কেমন যেন সুখী সুখী মনে হতো। তার হাঁটার ভঙ্গিটাই যেন খানিকটা পাল্টে যেতো। ঘরে দেখা আম্মার সঙ্গে বাইরের সেই মানুষটির কোনো মিল পেতাম না। অথচ জানো, স্কুলে যাওয়ার ওই সময়গুলোই ছিল আমার আর আম্মার জীবনের হয়তো সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সময়। আম্মা এমনিতে এতটা রাশভারী কখনোই ছিলেন না। তবে তাকে আবার গম্ভীরও বলা যাবে না। অথচ মাঝে মাঝে এমন সব মজা করতেন!
তোতন তার হাতে ক্ষয়ে আসা সিগারেটটা ভাঙা বাটিটার মধ্যে টিপে নিভিয়ে ফেললো। এরপর আবারও বলা শুরু করলো, একদিন হয়েছে কী শোনো, আমি আর আম্মা বের হলাম স্কুলে যাবো। এদিকে গত রাতে বৃষ্টি হয়ে রাস্তায়ও গেছে পানি জমে। অথচ যাওয়ার মতো রিকশাও পাচ্ছিলাম না। ওই সময় আম্মা হঠাৎ কী বললো জানো? বললো, তোতন প্যান্ট গুটিয়ে নে, চল দুজনে পানির মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে আজ স্কুলে যাবো। আম্মার সাহস পেয়ে আমিও আসন্ন অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধে প্যান্ট গুটিয়ে জুতো খুলে হাতে নিলাম। আম্মা বললেন, জুতো খুলেছিস কেনরে গাধা, জুতো পর। দেখ, বৃষ্টির জমে যাওয়া জলে হাঁটতে হয় তোর মতো জুতো পরে। দেখবি ওটার মধ্যে যখন পানি ঢুকবে, তখন সুন্দর মচমচ শব্দ হবে। আহারে, তোর মতো আমারও যদি এক জোড়া জুতো থাকতো। আমি আর আম্মা সেই জলের মধ্যেই পা টেনে টেনে হাঁটতে হাঁটতে সেদিন স্কুলে গিয়েছিলাম। স্কুলে সেই ভেজা পা আর ভেজা জুতোয় মচমচ করেই কেটে গিয়েছিল দিনটা।
কিন্তু জানো, আমি ক্লাসে ঢুকে যাওয়ার পর আম্মা ঠিক কী করতেন, সেটা এখনো আমার কাছে রহস্য। তবে খুব জানতে ইচ্ছে করে সেই সময়টা কী করতেন তিনি! অবশ্য আমার ছুটির পর দেখতাম আম্মা ঠিকই দাঁড়িয়ে স্কুলের গেটে। এরপর আমি আর আম্মা সস্তা লাল আইসক্রিম খেতে খেতে বাসায় রওনা দিতাম। আইসক্রিমের রঙে আমাদের জিহ্বা, ঠোঁট লাল হয়ে যেতো। তখন আম্মাকে দেখলে খুব সুন্দর লাগতো। সেই সময় সেই সস্তা আইসক্রিমের রঙে আম্মার ঠোঁট দেখলে মনে হতো আম্মা যেন লিপস্টিক দিয়েছেন। সেদিন সেই দিনগুলোয় সস্তা ওই লাল আইসক্রিম খেয়ে যে মজা পেতাম, এখন অনেক দামি আইসক্রিম খেয়েও ওই মজা পাই না।
তোতন বের হওয়ার আগে বললো, জেনে রেখো, তোতনের আম্মা আজীবন কারও দাসত্ব করেনি। জীবনে একবার হলেও তিনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন
আম্মার কাছে কখনোই বেশি টাকা থাকতো না। তাই দামি আইসক্রিম কিনে খাওয়ারও অবশ্য সেই সামর্থ্য হতো না আমার। অবশ্য তাই বলে ভেবে নিও না যে, আমাদের টাকা পয়সার অভাব ছিল। আমার বাবা ছিলেন আম্মার ঠিক উল্টো। তিনি কন্ট্রাকটরি করতেন, তাই টাকা পয়সাও ছিল প্রচুর। তবে আম্মার হাতে কখনোই তা পৌঁছাতো না। তিনি বলতেন, বাড়ির মেয়েদের হাতে নাকি টাকা দিতে নাই।
যতদূর মনে পড়ে, আম্মার সঙ্গে তার সম্পর্কটা ছিল অনেকটা প্রভু-ভৃত্যের। আব্বার শত অন্যায়েও একটা জি হুজুর ভাব ধরে রাখতেন আম্মা। মাঝে মাঝে যখন গায়ে হাত তুলতেন, আম্মাকে দেখতাম সেগুলো যেন নিজের পাওনা মনে করেই যত্নে রেখে দিতেন শরীরে। আব্বার অনেক অন্যায়েও আম্মাকে টু শব্দ করতে দেখিনি। আচ্ছা, এটিকে তুমি কী বলবে, বোকামি, না কি!
মাঝে মাঝে আমার কাছেও রাগ লাগে জানো। একদিন হয়েছে কী, দেখি আম্মার হাতের মধ্যে গোল গোল পোড়া ক্ষত। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই আম্মাকে দেখি হেসে কুটিকুটি। আমাকে বললেন, দেখ তোতন, পুড়ে যাওয়া চামড়ার চারদিকে কী সুন্দর লাল আভা। ঠিক সন্ধ্যা হওয়ার আগে আকাশে যেমন রঙ থাকে। তুই খেয়াল করেছিস কখনো? তখন সেই ছোট্ট তোতন বোঝিনি আম্মার হাতে সেটা কিসের চিহ্ন ছিল, এখন বুঝি।
আমি দেখলাম, তোতনের চোখের তারাটা যেন নিমেষে ঝিলিক দিয়ে উঠলো। সেটার মধ্যে যেন ঠাণ্ড আগুন। জ্বলেই যেন নিজের উপস্তিতি জানান দিলো একবার।
তোতন আবার বলা শুরু করে, আম্মা আমার নাম নিয়েও খুব মজা করতেন জানো? একদিন বললেন, হ্যাঁ রে তোতন তুই যখন বড় হয়ে বিয়ে করবি, তোর তো ছেলে মেয়ে হবে। তখন কেউ যদি তোর ছেলেকে জিজ্ঞেস করে, বলো তো খোকা তোমার বাবার নাম কী, তখন তোর ছেলে কী বলবে? আমি বুঝতে পারলাম না কেন এই অবান্তর প্রশ্ন। চটপট উত্তর দিলাম, কেন বলবে বাবার নাম তোতন, মোহাম্মদ তোতন হোসেন। উত্তর শুনে আম্মার সে কী হাসি, হাসতে হাসতে চোখে পানি চলে এলো তার, এত বড় দামড়া এক ব্যাটার নাম তোতন! তোর ছেলের নাম রাখিস ঘোতন। এসব বলেই আম্মা আরও হাসতে লাগলেন। আমার নাতির নাম হবে ঘোতন, তোতন-ঘোতন বাপ-ব্যাটা।
আম্মার মধ্যে এই রকম কিছু পাগলামি ছিল। মনে পড়ে, একদিন আমরা পাশের বাসা থেকে মা-ছেলে মিলে বেলুম্ব ফল চুরি করেছিলাম। এরপর দুপুরে লবণ মেখে সেটা যে কী মজা করে খেয়েছি। আচ্ছা, তুমি বেলুম্ব চেনো তো? তোতন অবশ্য আমার উত্তরের অপেক্ষা করে না। সে বলে চলে, চিরল চিরল পাতা আর সবুজ রঙের সেই অল্প লম্বা ফল। আর কখনোই খাওয়া হয়নি আমার। আমি দেখলাম তোতনের চোখে যেন জল চিকচিক করছে। অবশ্য তা সে আড়ালও করছে না। সে হাত দিয়ে চোখের জল মুছে নিলো।
আম্মা মারা গেছেন আজ অনেক বছর। তখন আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি। কিভাবে মারা গেছেন, তা কি শুনতে চাও? আমি ঠিক কী বলবো, তা নিয়ে ইতস্তত বোধ করতে লাগলাম। তোতনই আমাকে আবার বাঁচালো। থাক শুনতে হবে না। আমার আম্মা তার নিজের মতো করেই মাথা উঁচু করেছিলেন অন্তত একটি বারের জন্য হলেও। আমি শুধু লাশটা দেখেছিলাম। শুধু মনে আছে তার গলায় কারও আঙুলের ছাপের মতো রক্ত জমাট বাঁধা ছিল। যেমনটা সেই সন্ধ্যার আগে আকাশে আভা ছড়িয়ে পড়ে। দাদা অবশ্য বলেছিলেন, মা হার্ট অ্যাটাক করেছিলেন। যদিও আমি তা বিশ্বাস করি না। কারণ আমি তার প্রভুর মুখে সেদিন এই প্রথম একটি তাজা ক্ষত দেখেছিলাম। থাক সেসব কথা, আজ উঠি।
আমি হঠাৎ হকচকিয়ে গেলাম। তোতন এমন অকস্মাৎ উঠি বললো, আমি আসলে ভাবতে পারিনি। কী বলবো, বুঝে পাচ্ছিলাম না। আমি যন্ত্রের মতো এগিয়ে গেলাম দরজা খুলে দেওয়ার জন্য। তোতন বের হওয়ার আগে বললো, জেনে রেখো, তোতনের আম্মা আজীবন কারও দাসত্ব করেনি। জীবনে একবার হলেও তিনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।