এক.
ছবিগুলার দিকে এক দিষ্টিতে তাকাইয়া থাকে আছিয়া। মনোযোগ দিয়া দ্যাখতাছে না, কিন্তু অনেকক্ষণ একটানা তাকাইয়া থাকার কারণে ছবিগুলা মাথায় ঢুইকা যাইতে থাকে তার। যেমুন—রূপের এই বড় ছবিডা। রূপ মানে রূপন্তী; আফার মাইয়া। আছিয়া ভাইবা পায় না মুসলমানি নাম না রাইখা এরা এইসব হিন্দু নাম ক্যান রাহে! তবে এইডা হাঁচা, নামের লগে চেহারা খুব মিল খাইছে হ্যার। কী যে আদুইরা! আল্লা রূফের বালতি উল্টাইয়া দিছে য্যান মাইয়াডার উপ্রে। তার দিকে চাইয়া ছবির মইদ্য থেইকাই ছলকাইয়া হাইসা উঠতাছে য্যান! আছিয়া মনে-মনে ছেপ দেয় ছবিডার গায়। কারও বদদোয়া না লাগুক মাইয়াডার উপ্রে।
পশ্চিমদিকের ওয়ালে লাগালাগি দুইডা ছবি। একটাত আফায় একলা। গেঞ্জি আর জিন্সের প্যান্ট পরা। কান্ধে ক্যাটক্যাইট্টা কমলা রঙের একখান ব্যাগ, এক্কেরে বস্তার লাহান। পাহাড়ে-টাহাড়ে কুনুখানে ঘুরতে গেছিল আফায়, হেই ছবিই বড় কইরা বান্ধাইয়া থুইছে পরে। লগের ছবিডাত শাড়ি-পরা আফার কোলে রূপ। দুই মাসেরও বেশি হইয়া গ্যাছে রূপন্তীরে দেহে নাই আছিয়া। এর মইদ্যে নিশ্চয়ই আরেট্টু বড় অইছে গায়গতরে। আফায় কি লগে কইরা এই রুমে আনব তারে? মনে অয় না। তারে ঘরে ঢুকানোর সময়ই কত কারবার; অষুধের পানি দিয়া গোছল করাইতে বাকি রাখছে খালি! করুনা আওনের পর থিকা নতুন এক সিস্টেম চালু অইছে সব জাগাত। একজনের লগে আরেকজনের ছোঁয়াছুঁয়ি নিষেধ। কেউ কারও গায়ে লাগতে চায় না। খালি সাবান দিয়া ‘হাত ধোও, হাত ধোও’ করে। মুখের মইদ্যে মাক্স লাগাইয়া রাহে সবসময়। না রাখলে নাকি পুলিশে ধইরা নিয়া যায়! কী আচানক কারবার!
খাইতে অইলে বড়শির থন পাইড়ায়ই খাইতে অইব, বড়শির কাঁডা ফাঁকি দিয়া। কেউ কেউ পারছে হয়তো, কিন্তু তাগো বস্তির কাউরে কহনও পারতে দেহে নাই আছিয়া।
অনেকক্ষণ ধইরা ড্রয়ংরুমে বইসা আছে হ্যায়। খুঁড়াইয়া খুঁড়াইয়া পুরা রুম দেহা শ্যাষ। কিচ্ছু বাকি নাই আর। ঘরখান অবশ্য আইজই পয়লা দেখতেছে না; গত একবছর পেরায় প্রত্যিদিনই দ্যাখছে। কিন্তু আইজকাই তার পরথম খিয়াল অইল অ্যাতোদিন এইডারে হ্যায় মন দিয়া দেহে নাই। যেমুন—এই ছবিগুলান। রূপন্তীর গোলাপি ডেরেসটা আইজ পরথম খিয়াল করছে আছিয়া। আফার গেঞ্জিপ্যান্ট-পরা ছবিডাত আগে নজর পড়লেও শাড়িডা আইজকাই দ্যাখছে পরথম।
বইসা থাকতে থাকতে অধইর্য অইয়া যায় আছিয়া। আধা ঘণ্টা পার হইয়া গেছে, আফা তিন পারা দিয়া ভিত্রের ঘর থেইকা এই ঘরে আইতে পারতাছে না অহনও! এই মাসে এই পইর্যন্ত দুইবার আইসে হ্যায়। এইবার লইয়া তিনবার। আইজকাও যদি ফিরাইয়া দেয় তারে! ভাবতেই বুকের মইদ্যে ধড়ফড় শুরু অয় আছিয়ার। ধড়ফড়ানির অবশ্য মাফ নাই আল্লার তিরিশ দিন। গতকাইল থেইকা, গতপরশু থেইকা, গত মাস থেইকা, তারও আগের মাস থেইকা; বুদ্ধি হওনের পর থেইকাই কী জানি একটা গলার কাছে পোটলা বাইন্ধা থাহে, পানি খাইলে নামে না, কফ তুললে আহে না। কিছু একটা দিয়া যদি হেইডারে ভিত্রে ঠেইলা দেওন যাইতো, আর নয়তো বাইর কইরা দেওন যাইতো জন্মের লাইগ্যা; কইলজা বরফ কইরা দেয় এমন কিছু একটা যদি পাওন যাইতো, বাড়তি কিছু একটা; যেইটা হ্যায় কুনু সময়ই পায় নাই, জানেই না কেমনে পাইতে হয়।
মিছা কইলে গুনা অইব; আল্লায় এক্কেরে নিরাশ করে নাই। পুরাডা না পাইলেও কুনু কুনু সময় এক-আধলা পাইছে অবইশ্য। স্বাদ-গন্ধ না বুঝলেও কইলজায় কিছু একটা ধাক্কা দিছে মাঝে মইদ্যে; কয়েক ঘণ্টা এমনকি কয়েক মাসের লাইগ্যাও এক্কেবারে নিশ্চিন্তি না হোক, কিছুডা শান্তি পাইছিল দিলে। একবার আলমের বাপে ট্যাহা পাইছিল এত্তডি! রিকশার পা-দানিত পইড়া আছিল ব্যাগটা। ঘরে আইন্যা গুইন্যা দ্যাহে সত্তইর হাজার ট্যাহা। পরে ট্যাহার মালিকরে ফেরত দিতে গেলে হেই ব্যাডায় পাঁচ হাজার ট্যাহা পুরস্কার দিছিল আলমের বাপেরে। আরেকবার আলমের পাতলা পায়খানা ছুটলে হ্যারা পোলারে হাসপাতলে নিয়া গেছিল। হাসপাতলের ট্যাহা কই পাইব চিন্তা করে নাই দুই জনের কেউই! পরথমে বিরাট হুজ্জুতি বানলেও শেষ পইর্যন্ত বিলের ট্যাহা মাফ কইরা দিছিল ডাকতরেরা; এমনকি অষুধও দিয়া দিছিল খাওনের লাইগ্যা। আর শেষবার পাইছে গত মাসে; এই ঘরে বইয়াই। এইহানে আওনের আগে অবইশ্য ধড়ফড় শুরু অইছিল বুকডাত। আফায় যদি না কইরা দেয়! কে কারে মিনিমাগনা ট্যাহা দেয় এই আকালোত! কিন্তু আফায় দিছে। পুরা বেতনডাই বুঝাইয়া দিছে হাতে; এক ট্যাহাও কম দেয় নাই। অথচ হ্যায় এক দিনও আহে নাই কামে!
ট্যাহাডা পাইয়া কইলজা জুড়ানি একটা আরাম অইছিল তার। আলমের বাপের কাম নাই তহন; পুরা মাস ক্যামনে চলবো ভাইব্যা অস্থির অইয়া আছিল তারা। কী এক গরিব-মরা পচাব্যারাম লাগাইছে আল্লায়, পুরা বস্তির মইদ্যে আকাল শুরু অইয়া গেছে। কেউ কারে যে সাহাইয্য করবো হেই উপায়ও রাখে নাই খোদাতালা। নিজেরে তহন তার বড়শিত গাঁথা পুঁডিমাছ মনে অইতেছিল; মরণ অইতেছে না, কিন্তুক জান ধুঁকপুক করতাছে। এমন সময় আফায় ফেরেস্তা অইয়া আইছে তাগো জীবনে; গলার থন বড়শি খুইলা আবার পানিত ছাইড়া দিছে তারে। কিন্তু বড়শি ছাড়া কি খাওন আছে আল্লার দুইন্যাত! কোত্থাও নাই; না পানিত, না ডাঙাত। খাইতে অইলে বড়শির থন পাইড়ায়ই খাইতে অইব, বড়শির কাঁডা ফাঁকি দিয়া। কেউ কেউ পারছে হয়তো, কিন্তু তাগো বস্তির কাউরে কহনও পারতে দেহে নাই আছিয়া।
দুই.
নিজের বোকামোর জন্য নিজের ওপরই বিরক্ত সোমা। যেচে পরেই বিপদটা ঘাড়ে নিয়েছে সে। এখন বুঝতে পারছে না কীভাবে বিদায় করবে তাকে। এমন তো না যে করোনায় শুধু ও-ই ইফেক্টেড হয়েছে, সে নিজেও তো এই দুঃসময়ের শিকার। ঝোঁকের মাথায় কথা দিয়ে বসা একদম উচিত হয়নি তার। চাইলে অবশ্য এখন গিয়েও সোজাসুজি বলে দিতে পারে যে, সে বাধ্য নয়। কিংবা আরেকটু পোলাইটলি বলতে পারে সে, পারবে না এই মাসের বেতনটা দিতে। গতমাসে তাকে পুরো বেতনটা দেওয়া উচিত হয়নি আসলে, অর্ধেক দিলেই পারতো। তাইলে এই মাসে বাকি অর্ধেক বেতন দিয়ে কাভার করতে পারতো। মানও বাঁচতো, কুলও রক্ষা পেতো।
এমন লোভী মানুষদের টাকা দিয়ে মানবতা দেখানোর কোনো মানে নাই। সরাসরি গিয়ে ওর মুখের ওপর বলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সোমা।
গত আড়াই মাস ধরে আছিয়া কাজ করছে না তার বাসায়। সে-ই মানা করে দিয়েছিল করোনার ভয়ে। বাসায় ছোটো বাচ্চা, কোনও রিস্কে যেতে চায়নি সোমা। তখন মানবতার খাতিরে বলেছিল, না এলেও প্রতিমাসে বেতন পাবে আছিয়া; মাসের প্রথম সপ্তায় এসে যেন নিয়ে যায়। সত্যি বলতে কী. বলতে পেরে তখন আনন্দই পেয়েছিল সে। কিন্তু এখন দিতে গিয়ে টের পাচ্ছে মুহূর্তের আনন্দ কেমন কাঁটা হয়ে বিঁধছে গলার মধ্যে!
করোনার শুরুতে কারা কারা যেন বাড়ি ভাড়া মাফ করে দিলো, সরকার বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল তিন মাসের জন্য স্থগিত করে দিলো, আরও কত কত কাণ্ড! সোমার মধ্যেও একটা স্পিড এসে গিয়েছিল তখন, একটা ফোর্স কাজ করছিল। ভাবতে ভালো লাগছিল, সেও একজন সচেতন নাগরিক। অনেকে যদি অনেক কিছু পারছে, আর সে তার গৃহকর্মীর বেতন দিতে পারবে না! এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে, কী বোকামিটাই না করে বসেছে! অন্যদের শস্তা পাবলিসিটির বলি হচ্ছে এখন সে।
এমন তো না যে সোমার অঢেল আছে। তার নিজের আয় তিন ভাগের একভাগে এসে ঠেকেছে। অবস্থা যদি আগের মতো থাকতো, তাহলেও অনায়াসে দিয়ে দিতে পারতো, গায়ে লাগতো না তেমন! কিন্তু টিউশনের সব কটা ব্যাচ বন্ধ হয়ে গেলো। আম্মার খরচ দেওয়া বন্ধ করে দিলো মেজো ভাইয়া, বড় ভাইয়াও টাকা পাঠাতে গড়িমসি করছে এখন। এদিকে আম্মার ওষুধের পেছনেই বিরাট খরচ; নিত্যনতুন বাহানা আছেই—এই আকালে সে এখন পুকুরের শিং মাছ পায় কোথায়! অনলাইনে চাষের শিং মাছই চাচ্ছে এক হাজার টাকা কেজি। কিন্ডারগার্টেন স্কুল আর কয় টাকা বেতন দেয়! তাও আবার কত নাটক! অনলাইনে ক্লাস নাও, লেসন প্ল্যান বানিয়ে গ্রুপে আপ দাও, প্রশ্ন রেডি করে মেইল করো, হ্যানাত্যানা চৌদ্দ হাজার চাপ! এই অবস্থায় যে পরীক্ষা হবে না, এটা এখন আর ওপেনসিক্রেটও নাই, পুরোটাই ওপেন হয়ে গেছে, তারপরও নখরামি কমছে না একবিন্দু! টাকা যখন দেবে, তখন ঘানি টানিয়েই দেবে; তেল বের হোক বা না হোক! নিজের ওপরই বিষিয়ে ওঠে সোমার মন। আছিয়াকে বরং হিংসাই হয় তার। বিন্দুমাত্র পরিশ্রম ছাড়াই গোটা মাসের বেতন পেয়ে যাচ্ছে!
এর মধ্যেই জমানো টাকায় হাত দিতে হয়েছে তাকে, একটা ডিপিএস ভেঙে ফেলেছে। বাকিগুলোও কয়দিন চালাতে পারবে আল্লা মালুম। অথচ ডিপিএসগুলো চালু করার পেছনে কত স্বপ্ন ছিল! টাকাটা রেখে দেবে মেয়ের জন্য। বড় হয়ে কোনো না কোনো কাজে লাগাবে। যদিও এমন কোনো বড় অঙ্ক হবে না; তারপরও বিদেশ পড়তে চাইলে কিংবা অন্য কোনো কিছুতে কাজে লাগাতে চাইলে পারবে। ভাগ্যিস, ডিপিএসগুলো করেছিল, নতুবা মেহনতের সব টাকা সংসারের ভোগে লাগতো। ফাহিম থেকে কাবিনের টাকাগুলো আদায় না করাটা চরম গাধামো হয়েছে! পালিয়ে বিয়ে করার দরুণ সেটার পরিমাণ তেমন হ্যান্ডসাম কিছু ছিল না যদিও, তা-ও এই দুর্দিনে কাজে তো লাগতো। ভালোমানুষি দেখানোর মজা এখন সুদে-আসলে ভোগ করছে সোমা।
বাসায় অল্পকিছু টাকা এখনো আছে। আম্মার জন্য ওষুধ, রূপন্তীর জন্য ড্রাইফুড আর কিছু সব্জি আনতে দিয়েছে অনলাইনে; ওগুলোর হিসাব ছাড়লে বাদবাকি টাকা বাঁচিয়ে রেখেছে এখনো। ব্যাংকে যাবে যাবে করেও যাওয়া হচ্ছে না। এখন করোনার যা অবস্থা, ভয়ই লাগছে বাসা থেকে বের হতে। তাছাড়া খবর নিয়ে জেনেছে ব্যাংকে নাকি ভীষণ ভিড়। কেউ কোনো প্রটেকশনের তোয়াক্কা করছে না। স্টুপিডের দল! নিজেরা মরবে, অন্যদেরও মারবে!
আছিয়ার টাকাটা বাদ দিলে আগামী পনেরো দিন হেলতে দুলতে পার হয়ে যাবে। বাজার সদাই সবই করা আছে। আর বড় ভাইয়া টাকা পাঠালে পুরো মাসটাই কাভার দেওয়া যাবে ইনশাল্লাহ। আছিয়া কি বুঝতে পারছে না—ওর বেতন দেওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই তার। আগের মাসে কেন যে আগ বাড়িয়ে দিতে গেলো! মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে সোমার। এইমাসে তার আগ্রহ নেই বুঝতে পেরে নিজেই এসেছে দুই দিন, কচুশাক দেওয়ার উছিলায়। আছিয়াদের বস্তির ওদিকটায় দারুণ সব কচু গাছ, আম্মাই আবিষ্কার করেছিল এক ভোরে, হাঁটতে গিয়ে। কড়া রোদ পায় বলে ওগুলোয় নাকি গলা ধরার চান্স নেই। পরে আম্মা কচি আগা নিয়ে আহ্লাদ করলে আছিয়া নিজেই এনেছে দু-একবার। কিন্তু এবার পরপর দুই দফায় কচুর আগা দিতে আসার উদ্দেশ্য সোমা কেন আম্মারও বুঝি বুঝতে বাকি নেই। কোনোমতে বিদায় করেছে সেই দুই বার; বলেছে, ‘কচু শাক বিলানোর দরকার কী! প্রচুর আয়রন। তোমরাই নিয়মিত খাও। এখন সবার আগে শরীরটাকে ফিট রাখতে হবে’। বেতনের কথা না তুলেই বিদায় দিয়েছে তাকে। এতেই আছিয়ার বোঝার উচিত ছিল—এই মাসের টাকাটা সে দিতে চাচ্ছে না। মেয়েটা ভালোই বেহায়া আছে কিন্তু! আরে বাবা, তোরও তো বিচার করা উচিত; চাকরি করিস নাই, তারপরও গত মাসের পুরো বেতন দিয়েছি, তার আগের মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত কাজ করলেও বেতন পুরোটাই পেয়েছিস। এই মাসে দেনোমনো করছি, মানে দিব না। বুঝেও আসলে না বোঝার ভান করছে মেয়েটা। লোভ ছাড়তে পারছে না টাকাটার; ভিখারির মতো এসে বসে আছে। এমন লোভী মানুষদের টাকা দিয়ে মানবতা দেখানোর কোনো মানে নাই। সরাসরি গিয়ে ওর মুখের ওপর বলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সোমা।
তিন.
দুই মাস অইয়া গেলো আলমের বাপ বইসা আছে বাড়িত। হ্যায় বাইর অইতে চাইলেও সদাগর রিশকা দিব না কইয়া দিছে। থানার থন নাকি নোটিশ আইছে! কোনো রিশকাগাড়ি বাইর করন যাইব না রাস্তাত। পরে দুই দিন লেবু লইয়া বইছিল ফুটপাতে। লাভ অয় নাই তেমুন। গরমে লেবু ফোতাইয়া ত্যানা-ত্যানা। শ্যাষে আছিয়াই মানা করছে বাইরে যাইতে। সরকার কইছে চোইদ্দ দিন ঘরে থাকলে সব ঠিক অইয়া যাইব। তিন মাস গেলো গা, অহনও হেই চোইদ্দ দিন শ্যাষ অইতাছে না। আল্লায় জানে আর কতদিন গেলে শ্যাষ অইবো! ভাবতেই বুক ধড়ফড় কইরা ওডে। ঘরে একদানা খানা নাই। কাইলকা তাও রিলিফের চাইল আর শেষ কয় দানা মসুর ডাইল আছিল। পাঁচডা মানুষ তা-ই খাইয়া চলছে। পোলা-মাইয়া দুইডা ট্যাঁ-ট্যাঁ করতাছে হপ্তা ধইরা, ডিম খাইব। ডিমের দাম বলে কমছে, তা-ও হেই দাম আছিয়া লাগুল পায় না। আফার কথায় এগারো লম্বর বাসার কামডা ছাড়া উচিত অয় নাই। তিন কাম দেড়হাজার ট্যাহা। তাও একবছর আগের কতা; অহন নিচ্চিত দুই হাজার অইতো। আফায় বুঝাইছিল বাড়ি বাড়ি কাম না কইরা এক বাড়িত হারাদিন ধইরা করলে পরিশ্রম কম হয়। বেতনও অবশ্য বাড়াইয়া ধরছিল আফায়। না মানার কোনো কারণই আছিল না। এই বাড়িত কইতে গেলে কামই নাই তেমুন। আসল কাম রূপন্তীর লগে লগে থাকন। হেরে খানাদানা করানি, হাগামুতা পরিষ্কার করানি; এইসব। সকাল সাতটা থেইকা বিকাল পাঁচটা পইর্যন্ত, বেতন পাঁচ হাজার ট্যাহা। আছিয়া খুশিমনে রাজি অইছিল। আফার মাইয়াডা ভীষণ লক্ষ্মী; তাগো শরমিনের মতোন না। কুনো ডিস্টাপ নাই; কান্দন কাটন নাই। তাছাড়া খালাম্মাও ফাঁকেফুঁকে নাতনিরে সময় দিতো।
আফারে শরমের কথা কইলেও আসলে শরম না; ডরে ধরছিল তারে। যদি পরের মাস থেইক্যা আফায় তারে ঘুরাইয়া দেয়! পাঁচ হাজার ট্যাহা বহুত ট্যাহা।
রূপের কথা মনে পড়ায় আবারও কইলজাডা মোচড় দিয়া ওডে। খালাম্মাই বরং জ্বালাইতো বেশি। হাত টিপো, ঠ্যাং টিপো, ঘেড্ডি মালিশ কইরা দেও। বুইড়া মাইনষের যন্ত্রণা অনেক! এগারো লম্বর বাসার চাকরির লাইগা আফসুস অয় এহন। দুইডা কাম একলগে থাকলে একটাত-তন বেতন না পাইলেও কুনুমতে চালানি যাইতো। আছিয়া খোঁজ নিয়া হুনছে, এগারো লম্বরে এহন জমিলা ঢুকছে। করুনা শুরুর পরথম পরথম যাইতে অয় নাই, পুরাই নাকি পাইছে বেতন। গত মাসেত্থন হপ্তায় একদিন গিয়া কাম কইরা আহে, বেতন আটকায় নাই, পুরাডাই দিয়া দিছে। আফায় কি এইমাসে তারে বেতন দিতো না! বুক কাঁপে আছিয়ার। বস্তির ঘুপচি ঘরে খিদা লইয়া আক কইরা থাকা মুখগুলার কথা মনে অয় তার। ইশ! আফায় যদি তারে হপ্তাত দুই একদিন আইতে কইয়া আধা বেতন দিতো, তাও তো চলতো। আফা গো, এই মাসটা কুনুমতে চালাইয়া দ্যান। অর্ধেক হইলেও দ্যান! মরিয়া অইয়া ওডে আছিয়া। নিজের এমন ফকিন্নি দশায় তার শরমও লাগে, হে আল্লা! পেড দিতে তো কিপ্টামি করো নাই। পেডের খাওন দিতে এত ওনাফানা করো ক্যারে! ট্যানশনে তার গলা হুগাইয়া যায়, ইয়া মাবুদ! এইবারের লাইগ্যা পুলসিরাতটা পার কইরা দেও। আছিয়ার ডাক আল্লাহ পর্যন্ত যাওনের নেক বান্দা হ্যায় কি না, হেইডা লইয়া ভাববার দশাও বুঝি তার নাই, আলমের বাপের কথা মনে পইড়া যায় তার, বিয়ানে রিলিফ টোহাইতে বাইর অইছে ব্যাডায়, আর হ্যায় ঘরের কামকুম শ্যাষ কইরা এইহানে আইছে। ‘আল্লা; আইজকা দুই জনেরে হাতেই কিছু না কিছু তুইল্যা দিয়ো! আল্লায় নিচ্চয়ই দিব। আশায় বুক বানতেই ভালা লাগে।
এইহান থেইকা ট্যাহাডা পাইলে একবস্তা চাইল কিন্যা লইবো সবার পরথম। আর ডাইল, ডিম আর আলু। এক মাস যাইব গা ইনশাল্লা। এরমইদ্যে করুনা উডলে উডলো, নাইলে আফার প্রস্তাব মাইন্যা নিব হ্যায়। কিন্তু আইজকা যদি ট্যাহা না দেয় আফায়! চিন্তা করতেও ডর লাগতেছে তার। মনে মনে আল্লারে ডাকে আবার, হে আল্লা; আইজকার লাইগা রহম কইরো একবার। আধার দিবার নাম কইরা জীবনের লাইগা বরশিত গাঁইথ্যা থুইছো, এইবার একবার মুখ তুইলা চাও আল্লা। বাসাত পোলা-মাইয়া দুইডা পথ চাইয়া আছে আব্বা-আম্মার লাইগ্যা। আর পরীক্ষা নিয়ো না খোদা। আর নাইলে সবগুলারে এক লগে মাইরা ফেলাও ঘুমের মইদ্যে।
এর আগেও অভাব দ্যাখছে হ্যায় অনেকবার। একবেলা খাইয়া পার করছে দিনের পর দিন। না খাইয়াও দিন গ্যাছে কুনু কুনু সময়। হেইগুলা গেরামের গল্প। অভাব থাকলেও পাতাপুতা পাওয়া গেছে জঙ্গলে; চাইয়া মাইগ্যা চাইল জোগাড় অইছে দিন শ্যাষে। হেইখানে অভাব গিরস্তের বিলাইয়ের মতো; ধরে ছাড়ে, ছাড়ে ধরে, উসিলা খুঁজে খেলনের। এইহানে খিদার দাঁতে বাঘের শক্তি, এক টানে গোশত ছিঁইড়া আনে।
গেলো মাসে ট্যাহাডা নেওনের সময় হ্যায় আফারে কইছিল, আফা একদম পরিষ্কার অইয়া আমু নে, এইখানে আইসা আবার গোসল দিয়া দিমু দরকার অইলে। তবু রাহেন। কাম ছাড়া ট্যাহা লইতে শরম করে আফা। আফারে শরমের কথা কইলেও আসলে শরম না; ডরে ধরছিল তারে। যদি পরের মাস থেইক্যা আফায় তারে ঘুরাইয়া দেয়! পাঁচ হাজার ট্যাহা বহুত ট্যাহা। কাম ছাড়া ক্যান দিব! ডরই অহন সত্যি অইতাছে। আইজকার আগে দুইবার ফেরত দিছে তারে; আইজকা অহনও আইতাছে না। এইগুলা ট্যাহা না দিবার লক্ষণ। যদি না দেয় আইজকা আফার পায়ে পইড়া যাওন ছাড়া গতি নাই।
চার.
তিন মিনিটের ব্যবধানে এখন আবার খারাপ লাগা শুরু হয়েছে সোমার। যাচ্ছি-যাচ্ছি করেও সামনের রুমে যেতে অস্বস্তি লাগছে। বেচারিকে না করতে মন সায় দিচ্ছে না। বছর হয়ে এলো চাকরি করেছে আছিয়া, কিন্তু আগে কখনো এমন মরিয়া মনে হয়নি তাকে। কোনো মাসে বেতন দিতে দেরি করলেও টাকার জন্য তাগাদা দেয়নি সে। রূপের যত্নআত্তি কিংবা অন্য কাজেও প্রভাব পড়েনি তার। এর আগে পরপর দুই-তিনটে বুয়ার নাকানিচোবানির পর আছিয়াতেই স্বস্তি মিলেছিল কোনোরকম, ওর কাজে অভ্যস্তই হয়ে গিয়েছিল সোমা। এখন স্কুলের চাপ, বাচ্চার চাপ, আম্মার চাপ আর ঘরের সমস্ত কাজ একসঙ্গে ঘাড়ে পড়ায় হিমশিম খাচ্ছে সে। কখন তার দিন শুরু হয়, আর শেষ হয় কখন, নিজেই বুঝতে পারে না ইদানীং। জীবনটা উল্টেপাল্টে গেছে যেন তার; কিছুতেই তাল সামলাতে পারছে না। সোমার হতাশ লাগে।
বিশ মিনিট যখন বসতে পেরেছে, আরও পাঁচ-দশ মিনিট বসতে অসুবিধা হবে না নিশ্চয় আছিয়ার।
আছিয়াকে কি প্রস্তাবটা দিয়ে দেখবে আরেকবার? পলকে খুশির ঝলকানি লাগে সোমার মনে। পরমুহূর্তেই আবার নিরাশ হয়; মনে হয় না রাজি হবে। ওর নিজের মেয়েটাই এখনো ছোট। রূপন্তীর বয়েসীই হবে হয়তো; কিংবা দু-চার মাসের বড়। এছাড়া ওর হাজব্যান্ড থাকতে দেবে না ওকে! আজব এই জামাইগুলা! ভাত দেওয়ার মুরোদ নাই কিল মারার গোঁসাই! আছিয়া তার প্রস্তাবে রাজি হলে রূপের চাইতে বেশি খুশি কেউ হতো না। সোমার চেয়ে আছিয়ার হাতেই রূপ অনেক বেশি নিরাপদ ছিল। দারুণ যত্ন নিতো সে মেয়েটার। এখনো কথায় কথায় খালা-খালা করে রূপ। একটু বকা দিলে কান্নাকাটি শুরু করে আছিয়ার জন্য। কী যে মায়া লাগে তখন!
আছিয়া বরং ওকে উল্টো প্রস্তাব দিয়েছে—সাফসুতরো হয়ে আগের মতো এসে কাজ করে দিয়ে যাবে প্রতিদিন। রাজি হয়নি সে। এসব ফ্যামেলিতে সচেতনতার কোনো বালাই নেই। শেষে কোত্থেকে কী হয়ে যায়, কে জানে! নিজেকে কোনোভাবে সান্ত্বনা দিতে পারবে না সে তখন। এমনিতেই তার ‘ওসিডি’ আছে। মাথার মধ্যে সবসময় বিভিন্ন সন্দেহ ঘুরতে শুরু করে; সব ঠিকঠাক আছে কি না। তার মনে আছে, প্রথম প্রথম ঘরে থাকলে সে একটু পর পর আছিয়াকে এসে দেখে যেতো। রূপকে ভালোমতো টেককেয়ার করছে কি না, বাসন-কোসন ঠিকভাবে পরিষ্কার করেছে কি না, রূপের গোসলের জলে সুদল দিয়েছে কি না, কাপড় ধোয়ার সময় ফেব্রিক সফটেনার ব্যবহার করেছে কি না; এমনকি রূপের জন্য সেদ্ধ করা দেশি ডিমগুলোও শুঁকে দেখতো; যদি অবহেলায় ওকে নষ্ট ডিম খাইয়ে দেয়! তার এই খুঁতখুঁতে স্বভাবের জন্য কোনো কাজের বুয়াই বেশিদিন টিকতে পারেনি। আছিয়া ব্যতিক্রম। ও দ্রুত আয়ত্তে করে নিয়েছিল তার পাগলাটে আচরণগুলো। সেও স্বস্তি ফিরে পেয়েছিল আছিয়ার হাতে ঘরের কাজসহ মেয়েকে সঁপে দিতে পেরে।
নিজের শুচিবাইয়ের কারণে আছিয়ার এনে দেওয়া কচু শাকও ফেলে দিয়েছে সে প্রথমবার। রিস্ক নিতে চায়নি; কোথায় কোথায় করোনা লেগে আছে, আল্লাহ মালুম। পরেরবার অবশ্য একদিন ড্রয়িংরুমে ফেলে রেখে পরদিন ভিনেগার-পানিতে আধাঘণ্টা ভিজিয়ে তারপর রান্না করেছে। মেয়েটা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে তাকে খুশি রাখার। অন্য বুয়াদের মতো ধূর্তামি করেনি, মুখেমুখে তর্কও করেনি তেমন। মেয়েটাকে ফিরিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে না। আরও কিছুক্ষণ ভাবে সোমা। এরপর জোরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে আছিয়াকে কী বলবে, সিদ্ধান্ত নেয়। মনেমনে একবার ঝালাই করে, বেতন নিতে চাইলে আগামীকাল থেকে তোমাকে বাসায় থাকতে হবে। যতদিন করোনা শেষ না হয় ততদিন এই বাসা থেকে বের হতে পারবে না। প্রয়োজনে বাচ্চাদুটোকে ওর জামাই বাসার নিচে নিয়ে আসবে। সে ওপর থেকে কথা বলবে যতক্ষণ খুশি। যদি প্রস্তাবে রাজি থাকে, তবে গত মাসের বেতন পাবে, নতুবা পাবে না; সোজা হিসাব। হুট করে সমাধান পেয়ে যাওয়ায় শান্তি লাগে তার। আসলেই তো! ও যদি তার প্রতি সমীহ না দেখায়, তাহলে তার এত দয়া দেখানোর কী গরজ পড়েছে!
হুট করে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো সচরাচর ভালো হয় না, কিন্তু এটা মনে হয় বেশ কাজের হয়েছে। তারপরও আরও মিনিট দশেক ভাবার সময় নেবে সে। আম্মার সঙ্গেও একবার আলাপ করে নিতে হবে। বিশ মিনিট যখন বসতে পেরেছে, আরও পাঁচ-দশ মিনিট বসতে অসুবিধা হবে না নিশ্চয় আছিয়ার।