সোহাগ দীর্ঘক্ষণ বসেছিল সোফায়; হাতে মোবাইলটা নিয়ে গেম খেলছিল। আজ তার ডান্স ক্লাসে মা যেতে দেয়নি।ক্রিয়েটিভ ডান্সের সঙ্গে সঙ্গে হিন্দি সিনেমার নাচও শেখায় পাড়ার নাচের স্কুলগুলো। কী অশালীন সব শরীর দোলানো; আগে যা কেবল রাজ রাজড়া জমিদারেরা দেখতে পেত পয়সা দিয়ে। বাইজি নাচিয়ে এখন সিনেমার সিরিয়ালের দৌলতে ‘দো ঘুট মুঝে ভি পিলা দে সারাবি দেখ ফিরে হোতা হ্যায় কেয়া’। ‘কাটা লাগা’ সারা সমাজটায়। কোনো রুচি নেই, সংস্কার নেই।অবাধে টিভিতে,রেডিওতে,পাড়ায় পাড়ায় মাচা বেঁধে, ফিল্ম ফেস্টিভাল,নাট্য উৎসব, স্বাধীনতা দিবস;আবার জন্মদিন, বিবাহ বার্ষিকী, পৈতে,কিংবা সৎসঙ্গ ধর্মীয় উৎসব, এমনকি ক্রিকেট ম্যাচেও এ কী সংস্কৃতি চলছে! মদের বোতল খুলে বারে বসে মদ্যপায়ীরা যা উপভোগ করতে পছন্দ করেন। কি ভয়ঙ্কর!
শান্তনু এসে টিভিটা খুলতেই বহু-পরিচিত রেপ,ধর্ষণ, বলাৎকার শব্দ গুলো কানে আসতে থাকে সুদেষ্ণার।লম্বা সোফার এক কোণায় বসে সুদেষ্ণা উল বুনছিল;তার লজ্জা লাগে সোহাগের সামনে বসে এ সব শব্দ গুলো শুনতে।বিরক্তি প্রকাশ করে বলে,
রাত দিন খবর ছাড়া আর কিছু দেখতে পারো না।অন্য কোনো চ্যানেল চালাওনা।
খবরে তখনো বলে চলেছে: গৃহ মন্ত্রণালয়ের অধীন ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর সাম্প্রতিক অপরাধের পরিসংখ্যান অনুসারে ভারতীয় পুলিশ দুই হাজার এগারো সালে ৪২০৬টি বলাৎকারের ঘটনা নথিভুক্ত করে বলাৎকার কে ভারতের সবচেয়ে বড় অপরাধ বলে চিহ্নিত করেছে। দুই’হাজার এগারোর রিপোর্ট অনুসারে;মধ্য প্রদেশে ভারতের সবচেয়ে বেশি ধর্ষণকাণ্ড ৩৪০৬টি সংঘটিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে ২৩৬৩টি মামলা দুই হাজার এগারোয় নথিভুক্ত করার মাধ্যমে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।
এ রাজ্যের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী কুড়ি দফা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন ধর্ষণের শিকার নারীদের জন্য; তবে সুদেষ্ণার মনে হয় একজন মেয়ের পক্ষে তার শ্লীলতাহানির প্রমাণ দেওয়া এখনো আমাদের সমাজে বড় কঠিন কাজ; লজ্জারও।
পরিসংখ্যান থেকে কান সরিয়ে শান্তনু বলে, কী দেখব তোমার ওই প্যানপ্যানানি বাংলা সিরিয়াল। সত্য যুগে শুরু হয়েছিল; এখন ত্রেতা দ্বাপর গিয়ে কলি; শালা শেষ হওয়ার নাম নেই।
সুদেষ্ণা বলে, মুখের ভাষাটা ঠিক করো। মেয়ে বড় হচ্ছে; যখন-তখন যা তা খবর ওর সামনে দেখতে তোমার লজ্জা করে না?
শান্তনু গলা চড়ায়, তোমার ওই বস্তাপচা সিরিয়ালগুলোতে থাকে না অবসিন কিছু? পরকীয়া ভালোবাসা। প্রতিটি সিরিয়ালের বিষয় এক; অবৈধ প্রেম। এক একজনের দুটো তিনটে করে বিয়ে হচ্ছে আবার কেটেও যাচ্ছে। শরৎ-চন্দ, শক্তি-সামন্ত, অঞ্জন চৌধুরী, স্বপন সাহার উত্তরসূরিদের ক্রমশ নিম্নগামী সংস্কৃতি। পাবলিক খায় ভালো। ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে; কনডম, মেয়েদের সমস্যা, প্রেগনেন্সি টেস্ট, মদ, সাবান, শ্যাম্পু, তেলের রগরগে বিজ্ঞাপন।
শান্তনু এক্সাইটেড হয়ে গেলে সুদেষ্ণা বেশী কথা বলে না আজকাল; ওর হার্টের অবস্থাটা ভালো নয়। শুধু বলে, ওগুলোত খবরের ফাঁকেও থাকে।
শান্তনু বলে, থাকে বটে তবে একটা খবরও থাকে সস্তার বস্তাপচা গল্প নয়।
সুদেষ্ণা জানে খবরের চ্যানেল গুলোও সাধারণ ঘটনা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বিক্রি করে। কিন্তু সে মুখ খোলে না। রিমোট টিপে টিভি বন্ধ করে সোহাগের কাছে সরে বসে শান্তনু। এরপর তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, এ বছর হায়ার সেকেন্ডারি দেবে; সোহাগ আর ছোট নেই। আজকাল শান্তনুর মেয়েকে নিয়ে আদিখ্যেতা সুদেষ্ণার একদম ভালো লাগে না। সে নিজের রাগ নিজের মধ্যে মেরে; কমলা আর নীল উলের গোলা দুটোকে হাতের কাঁটা দিয়ে বিদ্ধ করে সোফার কোণায় সজোরে নিক্ষেপ করে; চলে যায় রান্নাঘরে।
সুদেষ্ণার দাদুর কথা মনে পড়ে। রেডিওতে ‘একটুকু ছোঁয়া লাগে; একটুকু কথা শুনি’—এই রবীন্দ্র সঙ্গীতটা বাজলেই তিনি রেডিও বন্ধ করে দিতেন। বলতেন দিদিভাই এসব লজ্জার গান শুনতে নেই। ‘লজ্জা’ শব্দের সেদিনের অর্থ বুঝত না সুদেষ্ণা; আজ বুঝেছে ‘অশ্লীল’। সুদেষ্ণার আরও মনে হয় দাদু বেঁচে থাকলে আজকাল যে গান হয়, শুনলে কানে তুলা গুঁজে থাকতেন, বলতেন এসব তো লেটো গান কেওড়া বাগদীদের সংস্কৃতি। সংস্কার ধর্মের মতো মানুষকে সামাজিক জীব বানিয়ে রাখতে প্রয়োজন আছে; এই মধ্যবয়সে এসে বুঝেছে সুদেষ্ণা। সে তার শিক্ষা, রুচি, সংস্কার কতটা দিতে পেরেছে তার মেয়েকে। সুদেষ্ণা ছোটবেলায় ফ্রক পরেছে। ক্লাস নাইন থেকে স্কুলে পরে গেছে শাড়ি। সোহাগের কনভেন্ট স্কুল চিরকাল ইউনিফর্ম হাঁটুর ওপর পর্যন্ত খোলা ছোট শট স্কার্ট। সুদেষ্ণা রাতে নাইটি ব্যবহার করাটাকে অপছন্দ করে। রাতে বিছানায় নিজের ঘরে সুদেষ্ণা সোহাগকে জানালার পর্দার আড়াল থেকে দেখেছে; শুধু অন্তর্বাসে ল্যাপটপ মুখের কাছে নিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে। মেয়ে বড় হচ্ছে। তারও একটা ব্যক্তিগত জীবন আছে; এ কথা শান্তনু প্রায়শই বলে। সুদেষ্ণা কিছুতেই মানত না; সেদিনের রাত পেরুতেই সুদেষ্ণার কাছে সোহাগ বড় হয়ে গিয়েছিল। এখন আর প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো কথা বলে না সুদেষ্ণা। উপযাচক হয়ে জ্ঞান দেয় না। হাসি মশকরাও করে না। মনের নৈতিক-অনৈতিক টানাপড়েনে; মেয়ে কী করছে—উঁকি মেরে দেখাটাও ছেড়ে দিয়েছে সুদেষ্ণা। তবু মেয়েকে নিয়ে তার দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। কত রাত সে জেগে কাটায় ঘুণাক্ষরেও টের পায় না শান্তনু। আজকালের সংস্কৃতি বড়ই খারাপ। মেয়ের ফেসবুকে কয়েক হাজার ছেলে বন্ধুর ছবি দেখেছে সুদেষ্ণা। নিরালায় একা একা মাথা ঘামিয়েছে সেটা ভালো না খারাপ, এইসব ভার্চুয়াল প্রেম কতটা বাস্তবায়িত হয়? আরাধনা ছবির রাজেশ খান্নার এক সময় প্রেমে পড়েছিল সুদেষ্ণা; মনে মনে প্রায় ঠিক করে ফেলেছিল তাকেই বিয়ে করবে। ডিম্পলের সঙ্গে রাজেশ খান্নার বিয়ের খবরটায় মনে বেশ কষ্ট পেয়েছিল। তবে মেয়েকে দেখে দেখেই সুদেষ্ণা ইমেইল করা গুগল সার্চ শিখেছে। অবসরে সে সাহিত্য পড়ে নতুন ফুলের ছবি দেখে। ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকা ভাইকে ইমেইল করে ভাইয়ের দশ বছরের ছেলে মনটির সঙ্গে করে চ্যাট। সুদেষ্ণা দেখেছে তার আইডির স্প্যাম বক্স ভরে থাকতে উস্কানিমূলক খারাপ খারাপ অরুচিকর মেলে; কত অ্যাডাল্ট চ্যাট পর্নগ্রাফিক সাইড চোখ মেলে রয়েছে এই প্রযুক্তিটার মস্তিষ্কে। তবে তথ্য-প্রযুক্তির এত সহজ পথ তাদের সময় ছিল না। ঠারে-ঠারে সুদেষ্ণা মেয়েকে বুঝিয়েছে; এর ভালো দিকটা নিতে, খারাপ দিকটা ভয়ঙ্কর। মোবাইল আর ইন্টারনেট এখন এত সহজলভ্য, সবার কাছেই পৌঁছে গিয়েছে। ডিজিটাল বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে ডিজিটাল অপসংস্কৃতি মানুষের শিরায় শিরায় ঢুকে চলেছে।
ফলে এদেশের পাঁচ বছরের শিশু কন্যা থেকে আশি বছরের বৃদ্ধা কেউ-ই যৌন শিকারের হয়রানি থেকে মুক্তি পাচ্ছে না। মানুষের কামনা-বাসনা উস্কিয়ে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ফায়দা লুটছে কিছু লোক। রেপ হচ্ছে প্রতি মিনিটে একজন করে। ধর্ষণকারীর শাস্তির দাবি উঠছে; সংবিধান সংস্করণের দাবি উঠেছে; মোমবাতি মিছিল হচ্ছে। কিন্তু কেউ বলছে না; আমাদের ঐতিহ্য, কৃষ্টি সংস্কৃতি আরও আঁকড়িয়ে ধরতে হবে; শিক্ষিত রুচিশীল সমাজ গড়তে হবে; সংস্করণ শুরু করতে হবে নিজেকে দিয়েই।
চা-টা যখন উথলানোর জন্য ফুসে ফুসে উঠছিল; গ্যাস কমাতে গিয়ে সুদেষ্ণা তার মেয়ের চিৎকার শুনতে পেয়ে চা ছেড়ে ছুটে আসে ড্রয়িং রুমে। চমকে ওঠে; সোফার ওপর সোহাগকে কুঁকড়ে থাকতে দেখে। তার ওপর ঝুঁকে রয়েছে শান্তনু। সুদেষ্ণা ‘জানোয়ার…ইতর’ বলে গালিগালাজ করে; সোফার কোনা থেকে নীল উলের গোলাটা ছুড়ে মারে শান্তনুকে।
শান্তনু সিদে হয়ে দাঁড়ায়।
আর তখনই সোহাগের গা থেকে একটা আরশোলা উড়ে এসে বসে সুদেষ্ণার গায়ে।
সোহাগ খিলখিল করে হেসে ওঠে!
সুদেষ্ণা জানে সোহাগ আরশোলাকে ভয় পায় ।
শান্তনুর ফর্সা কান দুটো তখন আরশোলার মতো লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছে।
এই ঠাণ্ডা থেকে মেয়েকে বাঁচাতে সুদেষ্ণার নির্মীয়মাণ মাফলারের নীল উলের বুনট খুলে গিয়েছে সবটাই। মেঝেতে উলের গোলাটা সুবর্ণ গোলকের মতো এখনো গড়িয়ে চলেছে। আরশোলাটা কোথায় গেল কারোই তখন খেয়াল ছিল না।
বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্যোতনায় কী করবে কিছুই বুঝে উঠতে না পেরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে সুদেষ্ণা। তার মনে হয়, সে একটা মানসিক রোগীতে পরিণত হয়েছে।