গরম চায়ের হালকা ধোঁয়ার মতো কুসুম কুসুম শীত পেরিয়ে ফাল্গুনের শুরুর সন্ধ্যাতেই সেদিন শহর কাঁপিয়ে বৃষ্টি এলো। বিদ্যুতের তারে বসা কাকটার কাছে বৃষ্টির এই ধারাকে হয়তো মনে হচ্ছিল মাত্র এক দিনের জন্য পূন্য বঞ্চিত কোনো ধন্য রাজার চোখের জল। নয়তো ভিজতে ভিজতেই কেনো কাকটা উদাস হয়ে রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে থাকবে।
হেঁটে চলা মানুষগুলো তখন দৌড়াচ্ছে উদ্ভ্রান্তের মতো। ওরা বৃষ্টি থেকে বাঁচতে একটু আশ্রয় প্রত্যাশী। এর মধ্যেই মূল সড়ক ঘেঁষা চিকন গলিতে একতলা বাড়িটার ঘুপচি জানালা দিয়ে বৃষ্টি আর ওই কাকটাকে খেয়াল করছিল অবিনাশ বাগচি। অবিরত সেই বৃষ্টিকে অবিনাশের মনে হচ্ছিল একটা প্রশান্তিময় ঝর্ণা। যেন তার পাশ ঘেঁষে বসলেই ওই ঝর্ণার জল থেকে ছিটকে আসা রেণু লেপ্টে যাবে মুখে। সেই রেণু একটির উপর আরেকটি জমতে জমতে এক সময় পরিণত হবে পূর্ণাঙ্গ ফোঁটায়। সে ফোঁটা নাকের আগা বেয়ে নামতে থাকলে জিহ্বা দিয়ে তা চেটে নেওয়া যাবে। যতক্ষণে কাকটা বিদ্যুতের তার ছেড়ে উড়লো, ঠিত ততক্ষণে নিজের ঝোলাটা গুছিয়ে অবিনাশ বেড়িয়ে পড়ে ওই বাড়িটা থেকে। তার কুঁজো পেটমোটা বেটে খাট অবয়বকে মনে হয় যেন ভারবাহী গাধা। যেন এতক্ষণ ভার বাওয়া শেষে ওটা বাঁধা ছিল ওই তৃতীয় সারির পত্রিকা অফিসটার কোনো খুঁটির সঙ্গে। অবশেষে কেউ এসে তার বাঁধন খুলে দিয়েছে, তাই গাধাটা আজকের মতো মুক্তির আনন্দে হালকা দুলকি চালে ফিরে চলেছে তার ক্ষমাহীন আস্তাবলে।
তবু মাঝরাতের জোছনায় সে এক ভূত দেখা মানুষ হয়ে জেগে উঠবে প্রতিদিনের মতো। কে জানে এই দৃশ্যগুলো আর হয়তো নাও ঘটতে পারে।
বাইরে বেড়িয়েই তুমুল বৃষ্টিতে ভিজে যায় অবিনাশ। তার তামাটে হয়ে যাওয়া উদ্ভ্রান্ত চুল লেপ্টে যায় খুলির চামড়ায়। এভাবেই জল, কাদা আর বৃষ্টিতে মাখামাখি হয়ে এমন অদ্ভুত এক ফাল্গুনের প্রথম দিনে অবিনাশ এসে দাঁড়িয়েছিল ভেজা জনারণ্যে। ততক্ষণে আশপাশে দোকানগুলোতে জ্বলে উঠতে শুরু করেছে বাতি। বৃষ্টির এই রোমান্টিসিজমের সঙ্গে একেবারেই খাপ খায় না এমন কোনো একটা দোকানে কে যেন প্লেয়ারে গান ছেড়েছে অরুন্ধতী হোমের গলায়। তিনি কিন্নর কণ্ঠে গাইছেন, গেয়েই চলেছেন, মরণকে ডাকলাম, মরণ বললো যাচ্ছি। আমি নিজেরই মরণ যজ্ঞে, শেষ চিতাকে সাজাচ্ছি। ফাগুনকে ডাকলাম, ফাগুন বললো আসছি।
পাপড়ি চুয়ে আসা বৃষ্টির জলে অবিনাশ বাগচির চোখ তখন ঝাপসা। অদ্ভূত এই দিনটার কথা আর বৃষ্টির জল খেতে খেতে সে যখন একটু আনমনা, ঠিক তখন পেছন থেকে কে যেন হাত রাখে তার কাঁধে। একটা রহস্যময় কণ্ঠস্বর ওকে বলে, পেছনে তাকানোর চেষ্টা করো না। আমার হাতে একটা ধাতব অস্ত্র আছে। কথার নড়চড় হলেই ওটা আমি ব্যবহার করবো। অবিনাশ মনে মনে হাসে, ভাবে, তুমুল এই বর্ষার ধারায় অচেনা তস্কর শুধু ওকেই খুঁজে পেলো! সে তো এমন উল্লেখযোগ্য কেউ না, বরং ভিড়ের মধ্যে মিশে যাওয়া আট দশটা সাধারণ মানুষের চেয়েও হয়তো নগণ্য। তার চেহারা বেশভূষায় কোনো কালেই এমন জেল্লা ছিল না, যা দেখিয়ে সে কারো প্রশংসার দাবিদার হতে পারেবে। বরং বেঢপ ভুড়ি, মাথায় হালকা টাকের আভাস, ঘোর কৃষ্ণের চেয়ে সামান্য উজ্জ্বল মুখ, ছিটেফোটা গোঁফ আর মলিন বেশভূষার অবিনাশকে দেখলে লোকে বিরক্তই হয় বেশি। তার মৌনতা লোকের কাছে লাগে বিষসম, আর অগোছাল কথা বলার ভঙ্গি লাগে বোকার মতো। নেহায়েৎ হাতদুটো আর মাথার ভেতরে সামান্য বিদ্যা থাকায় সে পত্রিকা অফিসে বিজ্ঞাপন কেটে দুবেলা ভাত যোগাতে পারছে। এর বাইরে তার কখনো কোনো সম্পদ ছিল না আর কখনো পাওয়ারও আশা নেই। তার ঘামের গন্ধভরা ও লবণের আঁকিবুকি পড়ে যাওয়া শার্ট দেখেই তো আগন্তুকের বুঝে নেওয়া উচিত ছিল, সে ভুল মানুষকে বাছাই করেছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই এবার সত্যি ধাতব কিছু একটা দিয়ে পেছনের কণ্ঠস্বর তার পিঠে ধাক্কা দেয়। কয়েক হাত সামনে এগোলেই যে কালো গাড়িটা দেখা যাচ্ছে, তাতেই উঠতে হবে তোমাকে। কিন্তু আমাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আর কেনোই বা-অবিনাশ প্রশ্ন করলেও পেছনের লোকটা যেন এর উত্তর দেওয়া প্রয়োজন মনে করে না। যেন অবিনাশের প্রশ্নটা হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার মতো। কণ্ঠস্বরটা আবারো অবিনাশের পিঠে ধাক্কা দেয়। সে দেখে সত্যিই সামনে রাতের মতো একটা কালো গাড়ি দাঁড় করানো।
বৃষ্টির জল সেই গাড়িটিকেও ভিজিয়ে যাচ্ছে অবিরাম। ধাক্কা খেয়ে অবিনাশ গাড়ির দিকে আগায়, এক সময় উঠেও বসে। এ সময় কে যেন কালো একটা কাপড় দিয়ে অবিনাশের চোখ বেঁধে ফেলে, তারপর বাঁধা হয় হাত। অবিনাশের অবাক লাগে, বৃষ্টি হলেও রাস্তায় সে মুখের অভাব দেখেনি। তার মধ্যেই কিভাবে একজনকে এভাবে অস্ত্র ঠেকিয়ে গাড়িতে ওঠানো সম্ভব। নাকি এই কণ্ঠস্বর অন্য কেউ! বৃষ্টির মধ্যে অকস্মাৎ তার সন্ধানে হানা দেওয়া কারো দূত। কেনোই বা বেছে নেওয়া হয়েছে তাকে। অবিনাশের এসব ভাবনার মধ্যেই চলতে শুরু করে রাতের মতো গাড়িটা। কালো কাপড়ে বন্ধ চোখে অবনাশ দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পায় অচেনা সেই আগন্তুক গাড়ির জানালা খুলে দিয়েছে। বৃষ্টি শেষ হয়ে বাইরের ভেজা ভেজা বাতাস এসে লাগছে তার মুখে। অবিনাশের মনে হয়, বাড়িতে বউ আর ছেলেটা নিশ্চই তার জন্য অপেক্ষা করবে। কাঁসার থালায় বউ নিশ্চই সাঁজিয়ে রাখবে শিউলি ফুলের মতো সাদা ভাত, একটুকু নুন আর কোনো একটা তরকারি। আটপৌরে এই পুরাতন গলদঘরণ গল্প শেষে রোজকার বিছানায় আবার শুরু হবে নতুন গল্প। বধূ শুয়ে থাকবে পাশে, শিশুটিও। তবু মাঝরাতের জোছনায় সে এক ভূত দেখা মানুষ হয়ে জেগে উঠবে প্রতিদিনের মতো। কে জানে এই দৃশ্যগুলো আর হয়তো নাও ঘটতে পারে।
এভাবে কতক্ষণ চলে গেছে জানা নেই। গাড়ি এক সময় মসৃন রাস্তা ছেড়ে চড়াই উৎরোইয়ের পথ ধরে। অবিনাশও ঘুম ঘুম আমেজে পড়ে থাকে কতক্ষণ।
অবিনাশ ভাবে লোকটাকে আরো কিছু কথা জিজ্ঞেস করবে। পরমুহূর্তে মনে হয় থাক, কী দরকার। জীবনে একবারের জন্য হলেও কেউ না হয় তাকে কোথাও নিয়ে যাক। বন্ধ চোখে সে জানতে চেষ্টা করে অন্ধকারকে। যেন অবোধ্য একটা রহস্য তাকে একটু একটু করে ডাকে। যেন সে ডুবে যাওয়ার ইচ্ছা পোষন করেছে অতলে। অবিনাশের মনে হয়, এত জানারই বা কী প্রয়োজন। অন্ধকারটা থাক না অন্ধকারের মতোই। জানিবার গাঢ় বেদনার, অবিরাম অবিরাম ভার সে আর বইতে চায় না।
গাড়িতে ওঠার পর প্রথমবারের মতো অচেনা কণ্ঠস্বরটা শোনা যায়, অবিনাশ, তুমি কী ভাবছো আমি জানি। তুমি ভাবছো সেই গাঢ় বেদনার কথা, যে ব্যাথায় রক্তফেনা মাখা মুখে মড়কের ইঁদুরের মতো ঘাড় গুঁজে আঁধার ঘুঁজির বুকে ঘুমায় তোমার মতো মানুষেরা। আমি কী বলছি, তা নিশ্চই বুঝতে পারছো। খুব বেশি বোঝার দরকারও নেই। ধরে নাও এটা তোমার সেই কল্পনা যা তুমি আজ থেকে আট বছর আগে এক ফাল্গুনের রাতের আঁধারে হঠাৎ ভেবেছিলে। সম্পূর্ণ নিরর্থক একা হয়েও তুমি ভেবেছিলে কোনো এক নারীর কথা, যে তোমার পাশে শুয়ে ছিল। ভেবেছিলে এমন এক শিশুর কথাও যে তার ঘুমন্ত কচি হাত দিয়ে স্পর্শ করে রেখেছিল তোমার ঘামে ভেজা শরীর।
অবিনাশ জিহ্বা দিয়ে তার ঠোঁট চেটে নিয়ে বলে, আমি কী ভেবেছি, তুমি জানলে কিভাবে? কণ্ঠস্বরটা হাসে, বলে, তোমার মতো অপ্রয়োজনীয় মানুষদের আর কীই-বা ভাবার আছে। সব হার মানা জীবনের গল্পই এক। চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে অশ্বত্থের কাছে এক গাছা দড়ি হাতে চলে যাওয়া একা-একা। তারপর সেই একই পুনরাবৃত্তি, ঠিক যেমন তারও আট বছর আগে কারও জীবনে ঘটেছিল।
গাড়িটা কোথাও না থেমে এক গতিতে ছুটে চলেছে, যেন পণ করেছে খুব দ্রুত পৌঁছে যেতে হবে গন্তব্যে। চোখ বাঁধা অবিনাশ অনেকক্ষণ গাড়িতে বসে আছে মৌন হয়ে। সে টের পায় তার পাশের আগন্তুকও ঠাঁয় বসে আছে মুর্তির মতো। অনেকক্ষণ সে অবিনাশের সাথে কোনো কথা বলেনি। খোলা জানালায় হু হু করে আসা বাতাস কেবল কানাকানি করেছে নিজেদের মধ্যে। এভাবে কতক্ষণ চলে গেছে জানা নেই। গাড়ি এক সময় মসৃন রাস্তা ছেড়ে চড়াই উৎরোইয়ের পথ ধরে। অবিনাশও ঘুম ঘুম আমেজে পড়ে থাকে কতক্ষণ।
কথাগুলো বলতে বলতে লোকটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, তারপর মৃদু স্পর্শে অবিনাশের হাত ধরে একটু দূরের সেই গাছটার দিকে এগোয়
একসময় চাকা থেমে যায়, আগন্তুক কথা বলে ওঠে, এবার নামতে পারো অবিনাশ, আচ্ছা দাঁড়াও আমি না হয় তোমার বাঁধা চোখ খুলেই দিচ্ছি। কারও স্পর্শে চোখের ওপর থেকে কালো কাপড়টা সড়ে যেতেই একটা নরম মন্দা আলো এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অবিনাশ দেখে সামনে এক বিরাট সবুজ চরাচর। যতদূর চোখ যায় ততদূর কেবল মৃদু দুলতে থাকা ঘাস লতা। তার ওপাড়েও হয়তো কিছু আছে, কিন্তু তা অগোচরেই রয়ে যায়। চোখে পড়ে কেবল দিগন্তে মিশে যাওয়া ভরাট আকাশ। সেই ভরাট আকাশে এখন অস্তরাগ। যেন তথাগত তার অনির্বান নিঃসঙ্গতা অকৃপন ঢেলে দিয়েছেন, এমনই নিঃসীম।
অবিনাশ দেখে, তার পাশে দাঁড়িয়ে ওই আগন্তুকও বৃষ্টি পরবর্তী সেই নিঃসীম অস্তরাগের দিকে চেয়ে আছে। অবিনাশের মনে হয়, লোকটা যেন ঠিক তারই প্রতিচ্ছবি। যেন সে দাঁড়িয়ে আছে আয়নার সামনে। তার সঙ্গে লোকটার পার্থক্য কেবল বেশভূষায়। অবিনাশ বুঝে পায় না মানুষটা কে, কেনো তাকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। দেখতে একইরকম হলেও লোকটা যে তার মতো নিতান্তই অবোধ হারাধন নয়, তা গাম্ভিযেই বেশ বোঝা যায়। ওর চেহারার মধ্যে কোথাও যেন একটা বিরাটাকার নিঃস্তব্ধতা আছে। লোকটা বলে, অবিনাশ তুমি মৃত্যু ভালোবাস, নাকি জীবন? অদ্ভূত সুন্দর এই জীবন্ত পরিবেশে দাঁড়িয়ে আচমকা তার দিকে এমন প্রশ্ন ধেয়ে আসবে অবিনাশ ভাবেনি। তাই সে আমতা আমতা করতে থাকে। জীবন নাকি মৃত্যু, কী অদ্ভূত প্রশ্ন। অবশ্যই মানুষ মাত্র জীবনকেই ভালোবাসে। যে বারবার মরতে চায়, সেও হয়তো নিশ্বাসের শেষ বাতাসটুকু গ্রহণের আগে জীবনের জন্য আফসোস করে।
অবিনাশ তার প্রতিচ্ছবির মতো পাথর চোয়াল ওই ব্যক্তির কথার জবাব দেয় না, কেবল চোখের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে- মৃত্যু, হ্যাঁ মৃত্যু। লোকটা হাসে, বলে, আমিও জানতাম তোমার উত্তর মৃত্যুই হবে। কারণ আমিও একই জিনিস বেছে নিতাম। আর তোমার আর আমার মাঝে তো পার্থক্য খুব সামান্যই। কখনো কখনো আমরা এক এবং অভিন্ন। অবিনাশ বুঝতে পারে না, লোকটা আসলে কী বলতে চাইছে। এটা কি কোনো ইঙ্গিত, লোকটা কি তাকে মেরে ফেলতে চায়। ওর মনের কথা বুঝতে পেরেই কিনা প্রতিচ্ছবির মতো লোকটা হা হা করে হাসে। সে বলে, শোন অবিনাশ তুমি যা ভাবছো, জেনো আমিও তাই ভাবছি। ওইদিকে দেখো, ঘনিষ্ঠ আকাশ, যেন কোনো বিকীর্ণ জীবন, অধিকার করে আছে ইহাদের মন; দুরন্ত শিশুর হাতে ফড়িঙের ঘন শিহরণ মরণের সঙ্গে লড়িয়াছে।
কিন্তু কে তুমি, আর আমরা এখানে কেনো এসেছি? লোকটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অবিনাশ তার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়। সে হয়তো ভেবেছিল প্রশ্নটা একটা বলের মতোই লুফে নেবে লোকটা, কিন্তু দেখলো লোকটা তার প্রতি কোনো আগ্রহই দেখাল না। অবিনাশ আবার প্রশ্ন করে, আমাকে কোথায় নিয়ে এলে? ততক্ষণে প্রকৃতি অন্ধকারের প্রস্তুতি নিচ্ছে। দিগন্ত বিস্তৃত ঘাসের মাঠে যেন আলগোছে হামাগুড়ি দিয়ে নামছে ঈষৎ আঁধার ছায়া। অবিনাশ আবারও প্রশ্ন করে, কোথায় নিয়ে এসেছ আমাকে, কেন?
আমরা এসেছি একজন প্রগাঢ় পিতামহীর কাছে। ওই যে ডান দিকে দূরে অশ্বত্থ গাছটা দেখছো, সেখানে একটা কোটরে তার বাস। যেখানে চাঁদ ডুবে গেলে উটের গ্রীবার মতো নিঃস্তব্ধতা এসে ভর করে। তুমি তো গোটা জীবনব্যাপী নিঃস্তব্ধতার সন্ধান করে এসেছ। আমি নিয়ে এসেছি তোমাকে তার কাছে। কথাগুলো বলতে বলতে লোকটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, তারপর মৃদু স্পর্শে অবিনাশের হাত ধরে একটু দূরের সেই গাছটার দিকে এগোয়। মৃদু বাতাসে তখন অশ্বত্থের পাতাগুলো দুলছে। একটা মাটির ঢিবির ওপর যেন দিগন্তের পাহারাদার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাছটা।
হা হা, এই অন্ধ প্যাঁচাটিও বোধয় আমাকে সেই বার্তা দিলো। অথবা তোমাকেও
অন্ধকারেই অবিনাশ দেখতে পায় নিঃসঙ্গ ওই অশ্বত্থের ডালে এক জুবুথুবু প্রৌঢ়ের মতো বসে আছে পেঁচা। যেন অন্ধকারের থুরথুরে সমাচার জানাতে জানাতে ওটা এক্ষুণি বলবে, চমৎকার, ধরা যাক দু’একটা ইঁদুর এবার। অবিনাশের ক্লান্ত লাগে, সে গাছের নিচে মাটির ঢিবিটার ওপর বসে পড়ে। ওর দেখাদেখি লোকটাও পাশে বসে। নিজে একটা সিগারেট ধরিয়ে আরেকটা এগিয়ে দেয় অবিনাশের দিকে। অবিনাশ সিগারেটটা ধরিয়ে ঘাঢ় একটা ধোঁয়া ছাড়ে আকাশে। অন্ধকারের মাঝে সাদা সেই ধোঁয়া কুয়াশার মতো পাক খেতে খেতে ছড়িয়ে পড়ে। তারা দু’জন আর জুবুথুবু প্যাঁচাটা ছাড়া আর কোনো জনপ্রাণীর চিহ্ন আশাপাশে নেই। লোকটা তার কোমর থেকে একটা চকচকে পিস্তল করে সামনে রাখে। অবিনাশ পিস্তলটা দেখে, যদিও তার মধ্যে তেমন কোনো ভাবান্তর হয় না। কেবল সে আবারও জিজ্ঞেস করে, আমাকে কেন নিয়ে এসেছ? প্রতিচ্ছবির মতো লোকটা আবার পিস্তলটা হাতে নিয়ে দূরে তাক করে, যেন এক্ষুণি গুলি করে দেবে। কিন্তু না, গুলি চলে না বরং তার কথাই যেন বাতাসকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিতে চায়।
অবিনাশ তোমাকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে একটা বিশেষ কাজে। কাজটা সহজ বলতে পারো, আবার কঠিনও। তবে আমার মনে হয় তুমি তুমি খুব সহজেই কাজটা করতে পারবে। অবিনাশ প্রশ্ন করে, কাজটা কী? এবারও পিস্তলটার আদ্যপ্রান্ত দেখতে দেখতে লোকটা বলে, আজ সারারাত আমি তোমার সঙ্গে গল্প করবো। তারপর ওই যে আধখাওয়া বুড়ি চাঁদটা যখন যাবে বেনোজলে ভেসে, তখন আমার কপালের ঠিক মাঝ বরাবর তুমি একটা গুলি করবে। ভেবে দেখো, একটা অকস্মাৎ গুলির শব্দ রাতের নির্জনতা ভেঙে দিয়ে যখন আমার মৃত্যুর ফরমান নিয়ে ছুটবে, ততক্ষণে একটা জ্বলজ্যান্ত জীবন নিভে গেছে। কপালের মাঝ বরাবর হওয়া ফুটোটা থেকে ঘাসের ডগা হয়ে চুইয়ে নামবে জীবনের আদি সত্য লাল রক্ত। তোমার সেই কল্পনার সঙ্গে মিলছে না দৃশ্যটা?
কিন্তু কেন মরতে চাও তুমি, আর কেনোই বা এর জন্য আমাকে বেছে নিলে? অবিনাশ প্রশ্নের ফিরতি বলটা প্রতিচ্ছবির মতো লোকটার কোর্টে ফিরিয়ে দেয়। ঠিক তখন অশ্বথের ডালে বসা প্যাঁচাটা এক অতিলৌকিক কণ্ঠে ডেকে ওঠে। সে ডাক এই খোলা প্রান্তরে কেমন একটা কম্পন সৃষ্টি করে। লোকটা অবিনাশের কাঁধে হাত রাখে, কেনিয়ার কিকুয়ু জাতি কী বিশ্বাস করে জানো? ওরা বিশ্বাস করে প্যাঁচা মৃত্যুর আগমনের কথা জানিয়ে দেয়। যদি কেউ একটি প্যাঁচা দেখে কিংবা তার আওয়াজ শোনে তাহলে সে মৃত্যুমুখে পতিত হবে। হা হা, এই অন্ধ প্যাঁচাটিও বোধয় আমাকে সেই বার্তা দিলো। অথবা তোমাকেও।
কারণ আমরা দু’জনেই ভেবেছি মৃত্যুর কথা। আমাদের দু’জনেরই অন্তর্গত রক্তের ভেতরে আছে সেই বিপন্ন বিস্ময়, যা জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে আমাদের ক্লান্ত করেছে। এই হতভাগা চেহারা আর জীবন নিয়ে তুমি প্রতিনিয়ত চেষ্টা করেছ বেঁচে থাকার, কিন্তু মৃত্যুর শখে মরেছ তার চেয়েও বেশি। বিবাহিত জীবনের সাধ থেকে শুরু করে কোথাও তো এতটুকু খাদ রাখনি। সময়ের উর্ধত্মনে উঠে এসে বধূ জানতে দিয়েছে তার মননের মধু। তবুও হাড়হাভাতের গ্লানি বেদনার শীতে তোমার জীবন কোনোদিন কেঁপে ওঠে নাই। কেনো অবিনাশ, কেনো বলতে পারো?
অথচ প্রতিচ্ছবির মতো লোকটা এখন একটা অস্ত্র কিভাবে তার হাতে তুলে দিয়েছে। অবিনাশ খেয়াল করলো,
অবিনাশের বিপন্ন লাগে। সে কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না। শুধু বলেন, আমি জানি না। বিশ্বাস করো আমি কিভাবে বেঁচে আছি আমি জানি না। নারীর হৃদয়, শিশু, প্রেম, ফুলের মতো সাদা ভাত কোনো কিছুই এখন আমার আমাকে কেনো যে টানে না, জানি না। হয়তো সংসারে কিছু মানুষ থেকেই যায়, যার সব সুখ আছে তবু সে আত্মহত্যার সুখ পরীক্ষা করে দেখতে আগ্রহী।
ঠিকই ধরেছ, আমি তেমনই একজন। তাইতো তোমাকে এখানে নিয়ে আসা। তোমার মতো আমিও বহু চেষ্টা করেছি আত্মহত্যা করতে, কিন্তু পারিনি। তাই মৃত্যুর স্বাদ পরীক্ষায় আমি তোমার দ্বারস্থ। রক্ত ক্লেদ বসা থেকে রৌদ্রে ফের উড়ে যাওয়া মাছি, সোনালি রোদের ঢেউয়ে উড়ন্ত কীটের খেলা, দূরন্ত শিশুর হাতে ফরিঙয়ের ঘন শিহরণ অনেক দেখা হলো। এবার আমি অন্য কিছু দেখতে আগ্রহী। কথাগুলো বলার সময় লোকটার মুখে অদ্ভুত এক উত্তেজনা দেখা যায়। অবিনাশ কেবল সেদিকে চেয়ে থাকে, কিছু বলে না। লোকটা সেই পিস্তল হাতে এদিক ওদিকে হাঁটে। এক সময় এগিয়ে এসে পিস্তলটা বাড়িয়ে দেয় অবিনাশের দিকে।
অবিনাশ আগে কখনো পিস্তল দেখেনি। সে ওটা হাতে নিয়ে ভাবে, মৃত্যুর কারিগরেরা কী নিপুণ দক্ষতায় এই অস্ত্র বানিয়েছে। যার আছে এক নিমেষে প্রাণ হরণের অদ্ভুত জাদু। হ্যাঁ যেভাবেই হোক একবার সে একটা পিস্তল হাতে পেতে চেয়েছিল। দিনটা ঠিক কতো দিন আগে, আট বছর! মনে নেই, শুধু একটু মনে আছে প্রচণ্ড গরমের সেই মধ্যরাতে বরফের মতো ঘামতে ঘামতে সে বিছানায় উঠে বসেছিল। অদ্ভুত একটা আতঙ্ক আর বিপন্নতা বোধ সেদিন তাকে ঘিরে ধরে ধরেছিল আষ্ঠেপৃষ্ঠে।
সত্যিকার অর্থে ওইদিনই তার মনে হয়েছিল এর চেয়ে মৃত্যুটা কম সুন্দর কিছু নয়। সক্রেটিসের যেমন মনে হয়েছিল, হয় মৃত্যু একটি স্বপ্নহীন চিরস্থায়ী ঘুম, নয় নতুন আরেকটি জীবনের শুরু। অবিনাশের মনে হলো, একটা আগ্নেয়াস্ত্রই তাকে সেই চিরস্থায়ী স্বপ্নহীন ঘুম এনে দিতে পারে। তারপর কতদিন সে মনে মনে একটা অস্ত্র কামনা করেছে, কিন্তু পায়নি। অথচ প্রতিচ্ছবির মতো লোকটা এখন একটা অস্ত্র কিভাবে তার হাতে তুলে দিয়েছে। অবিনাশ খেয়াল করলো, ভারী এই অস্ত্রটা হাতে নিয়ে তার নিজের ভেতরও বেশ উত্তেজনা কাজ করছে।
লোকটা ওকে বললো, ভয় পেয়ো না। এর ভেতরে দুটি গুলি আছে। একটি যদি মিসও হয়ে যায়, তবে আরেকটি গুলি রইলো। খুব নিরিখ করে ট্রিগারে টান দেবে কিন্তু। তুমি গুলি করার আগে আমি চোখ বুজে জীবনের সবচেয়ে সুখের কোনো স্মৃতি ভাববো।
আমিও তোমার মতো বুড়ো হবো, বুড়ি চাঁদটারে আমি করে দেবো কালীদহে বেনোজলে পার
কিন্তু আমি তোমাকে হত্যা করবোই তা কিভাবে নিশ্চিত হলে? নাও তো করতে পারি। এমনও তো হতে পারে অস্ত্রটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তোমাকে রেখে আমি পালিয়ে গেলাম দূরে। অবিনাশ এমনভাবে কথাগুলো বললো, যেন সে আসলেই কোনো বিরুদ্ধ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। কিন্তু তবু লোকটার মধ্যে কোনো ভাবান্তর হয় না। তার পাথরের মতো মুখে ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফোটে। তুমি পালাতে পারবে না অবিনাশ, এখানে এই অন্ধকার রাতে বিরান শূন্যভূমিতে অশ্বথের নিচে দাঁড়িয়ে আমাকে হত্যাই তোমার নিয়তি। আমি জানি তুমি সেই নিয়তিকেই মেনে নেবে।
এবার অবিনাশ পাল্টা হেসে ওঠে। জীবনের এই স্বাদ, সুপক্ব যবের ঘ্রাণ, সোনালি ফুলের স্নিগ্ধ ঝাঁকে জোনাকির ভিড়, হেমন্তের বিকেল তোমার অসহ্য বোধ হলো! তাহলে কোথায় হৃদয় জুড়াবে তোমার, মর্গে? গুমোটে থ্যাঁতা ইঁদুরের মতো রক্তমাখা ঠোঁটে? ঠিকই ধরেছ তুমি, নিজের প্রতিচ্ছবির মতো তোমাকে আমি গুলিটা অবশ্যই করবো। এই পিস্তলে দুটো গুলি আছে না, বাহ বেশ ভালো।
লোকটা আর অবিনাশ এই প্রথম পরস্পরের দিকে চোখ রেখে মুখোমুখি দাঁড়ায়। হঠাৎ তারা দু’জনই ফেটে পড়ে অট্টহাসিতে। অবিনাশের মনে হয়, আজ বহু বছর পর সে এভাবে প্রাণখুলে হাসলো। যেন বহু বছর পর এই হাসির সঙ্গে তার ভেতরের কত শত ভাবনা, ক্রোধ, ক্ষেদ, ভয়, পরাজয় বেড়িয়ে আসছে হু হু করে। অবিনাশের বুক হালকা করে দিয়ে তারা বাতাসে মিশে যেতে যেতে বলছে, গেলাম তবে। ওদের হাসির শব্দে অশ্বথের শাখায় বসা প্রৌঢ় প্যাঁচাটা গোল গোল চোখে তাকায়। অবিনাশ আর তার প্রতিচ্ছবি তবু হাসি থামাতে পারে না। এভাবে ওদের কতক্ষণ কাটে জানা নেই। শুধু এক সময় অবিনাশ টের পায় পিস্তলটা সে তাক করে আছে বিপরীত জনের দিকে।
একটা প্রচণ্ড গুলির শব্দে চারপাশ কেঁপে যায়, তারপর আরেকটা। পেঁচাটা দিকশূন্য ভয়ে উড়তে গিয়েও ছটফট করে মাটিতে পড়ে যায়। শুধু রাতের নিস্তব্ধতায় রেশ থেকে যায় হাসি আর গুলির শব্দের। তাদের মিলিত নিনাদ অবিনাশের স্বরে বাতাসে গান করে চলে, চমৎকার, হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার? আমিও তোমার মতো বুড়ো হবো, বুড়ি চাঁদটারে আমি করে দেবো কালীদহে বেনোজলে পার; আমরা দু-জনে মিলে শূন্য করে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার।