ইটের মতো রঙিন সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে আজিমুদ্দিনও রাস্তায় নামে। সারারাত সিসায় মোড়ানো বাতাস চিরে চিরে রিকশা নিয়ে ছোটে। কখনো কাওরানবাজার থেকে মগবাজার, কখনো বা ঢাকা মেডিক্যাল থেকে ধানমন্ডিতে যাত্রী পৌঁছে দেয়। প্যাডেলে চাপ দিতে দিতে কত বিচিত্র মানুষকে যে চিনে নেয়, তার ইয়ত্তা নেই।
করোনা আসার পর থেকে মানুষ যেন সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে চায় না। একে অন্যের দিকে বাঘের তাড়াখাওয়া খরগোশের মতো ভয়ার্ত চোখে তাকায়। কারও বাড়িতে মরা-কান্নার রোল উঠলে সেদিকে কেউ সরাসরি তাকায় না। কেউ যেতে চায় না। বাড়িকে ভয়াল মনে হয়। আজিমুদ্দিনের এসব অজানা নয়। তবে, রিকশা চালাতে গিয়ে সেও প্রায় আঁৎকে ওঠে। তার রিকশায় যে যাত্রী ওঠে, আশঙ্কা হয় সে করোনা রোগী নয়তো! এসব ভাবে বটে, কিন্তু যাত্রী করোনা রোগী হলেই কী, আর না হলেই কী? রিকশায় তোলার সময় তো আর পরীক্ষা করা সম্ভব নয়। আজিমুদ্দিন নিজেকে বলে, রিকশাঅলা হয়েছি যখন, তখন যাত্রীর আবার বাছবিচার কিসের? সে নিজেকে বেশ্যার সঙ্গে তুলনা করে। মনকে বলে, বেশ্যা যেমন টাকা পেলে জেলের সঙ্গেও শুতে যায়, তেমনি জমিদারের সঙ্গেও বিছানায় যায়। রিকশাঅলাকেও যে টাকা দেবে, তাকেই গন্তব্যে পৌঁছে দিতে হবে।
সারারাত রিকশা চালিয়ে ভালোই আয় হয়েছে তার। ঢাকা শহরের ল্য্যাম্পপোস্টের আলো ও গগনচুম্বী ভবনের রঙবেরঙের আলোর দোর্দণ্ড প্রতাপে রাতের ঘনত্ব বোঝা যায় না। কুমারি সন্ধ্যার যে রূপযৌবন, মাঝবয়সী প্রৌঢ়া রাত্রিরও তাই। আবার পড়ন্ত যৌবনা ভোররাতেরও জৌলুসের কমতি নেই। আজিমুদ্দিনের চোখে নেশা লাগে—শালার ঢাকার রাত যেন যৌবনের মৌচাক। ঢিল ছুড়লেই মধু ঝরঝর করে ঝরবে।
হঠাৎ কোমরে গুঁজে রাখা মোবাইলফোনের রিংটোন বেজে ওঠে। আর তাতেই চোখের নেশা কেটে যায়। এত ভোরে কার কল? শঙ্কিত বুকে-কম্পিত হাতে মোবাইলফোন বের করে। দেখে বউ জমিলার কল। রিসিভ করতেই জমিলা হুহু করে কেঁদে ওঠে—আপনে কোথায়? জলদি আসেন। মাইয়াটা কেমুন জানি করতেছে। ফোনে জমিলাকে বলে, দ্রুত আলম ক্লিনিকে নাও। আমি আইতাছি।
বদলি রিকশা। দিনে এই রিকশা চালায় জাফর তালুকদার। রাতে আজিমুদ্দিন। আরেকটা ট্রিপের আশায় ঢাকা মেডিক্যালের দিকে যাচ্ছিল সে। জমিলার কল পেয়ে নিউমার্কেটের সামনে থেকে তেজগাঁও বস্তির দিকে রিকশা ঘোরায়। দ্রুত বস্তিতে ফিরতে হবে।
নাটোর থেকে এই বস্তিতে এসেছিল ২০২১ সালের শেষ ডিসেম্বরে। শীতের রাতে। আজিমুদ্দিন শুনেছিল খোদার রাজ্যে খোদার বান্দা না খেয়ে মরে না। কথাটা শুনেছে শিশুকালে। মনে আছে আজও। তাই করোনায় নাটোরে যখন মুদি দোকান চালানো কঠিন হয়ে উঠলো, তখন সে পাড়ি জমালো ঢাকায়। একা এলে হয়তো একবেলা আধপেটা খেয়ে, আরেক বেলা না খেয়েই দিন কাটাতে পারতো। কিন্তু সঙ্গে এসেছে বউ জমিলা আর একমাত্র মেয়ে রহিমা। তাদের মুখে তো ভাত তুলে দিতে হবে। ভাত কোথায় পাবে সে? দুদিন হয়ে গেলো কাওরানবাজার রেল বস্তিতে এসে পরিচিত রিকশাঅলার রকিব তালুকদারের ঝুপড়িতে উঠেছে। রকিবের হাতে আজিমুদ্দিন যে টাকা দিয়েছে, তাতে হয়তো দুদিন চলবে। এরপর কী করবে?
আজিমুদ্দিন কপাল চাপড়ায়, হায় আল্লাহ এ কোন অকূল পাথারে পড়লো সে? তার করার মতো কোনো কাজ ঢাকায় নেই। নাটোরে তো মুদি দোকান ছিল। করোনায় বেচাবিক্রি কমে গেলো। কী করবে—দিশা না পেয়ে ঢাকায় এসেছে। আর কমলাপুর রেলস্টেশনে নামতেই জাফর তালুকদারের সঙ্গে দেখা। এলাকার মানুষ। এলাকার বললে দূরে ঠেলে দেওয়া হয়, প্রতিবেশী। এককালের হরিহর আত্মা। আজিমুদ্দিনকে দেখা মাত্রই এগিয়ে এলো, এই করোনার মধ্যে ঢাকায় আইলেন যে? আজিমুদ্দিন কোনো জবাব দিতে পারে না। মুখ খোলে জমিলা—কী করুম ভাই? দেশে তো কাজকাম কিচ্ছু নাই। ঢাকায় আইছি, পেটের জ্বালায়। জাফর তালুকদার রিকশাঅলা হলে কী হবে, তার ভেতর ভদ্রলোকের মতো শিষ্টাচারে আছে কিছু কিছু। বলে, আইয়াই যখন পড়ছেন, চিন্তা কী? আল্লায় একটা ব্যবস্থা কইরা দিবোই। কথা ক’টি বলতে বলতে আড়চোখে আজিমুদ্দিনের কিশোরী মেয়ে রহিমার দিকে তাকায় তালুকদার। রহিমা সেই দৃষ্টিতে কী দেখে, খোদা জানে। সে চরম বিরক্তিতে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে তেজগাঁও বস্তিতে জাফর তালুকদারের ঝুপড়িতে আসে তারা। ঝুপড়িতে জাফর তালুকদার তার বউ বিজলীকে নিয়ে থাকে। আজিমুদ্দিন বুঝতে পারে না, স্বামী-স্ত্রী দুজনের জন্য একটা ঝুপড়িতে চার রুম লাগবে কেন। কিন্তু মনের কোণে জেগে ওঠা প্রশ্নকে ভ্রূণহত্যার মতোই গলাটিপে মেরে ফেলে। বুক ঠেলে গলা গলিয়ে ঠোঁটে আসতে দেয় না। তার এই প্রশ্নহীন কৌতূহল তিন জনের মাথা গোঁজার ব্যবস্থাটা সহজ করে দেয়। থাকার জায়গা মিললো যখন, তখন রোজগারের একটা উপায়ও দরকার। আশ্রয়দাতা জাফর তালুকদারই এগিয়ে এলো, শোনেন আজিমুদ্দিন ভাই। আমি তো রিকশা চালাই। দিনের বেলা। আপনি এই রিকশা-ই রাতের বেলা চালাতে পারেন। রিকশার মালিককে প্রতিদিন ২০০ টাকা দিবেন। বাকি টাকা আপনার। প্রস্তাবটা মনে ধরে আজিমুদ্দিনের। দিনের বেলা জাফর তালুকদার রিকশা চালায়, আর রাতে চালায় আজিমুদ্দিন।
তবে ঢাকায় এসে দুবেলা খাবার জোটাতে পারলেও মেয়েটাকে স্কুলে ভর্তি করাতে পারেনি আজিমুদ্দিন। ঢাকায় নাকি একেকটা স্কুলে ছেলে-মেয়েকে ভর্তি করাতে গেলে ছয় সাত লাখ থেকে দশ বারো লাখ টাকা ডোনেশন দিতে হয়। এতটাকা আজিমুদ্দিন কোথায় পাবে? নাটোরে ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিল রহিমা। এতদিনে ক্লাস নাইনে ওঠার কথা। কিন্তু করোনা শত শত মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়ার পাশাপাশি রহিমাদের মতো হতদরিদ্র কিশোরীদের পড়াশোনার নিশ্চয়তাও কেড়ে নিয়েছে। আজিমুদ্দিন মনে মনে ঠিক করেছে, ঢাকা শহরে পুরো ২০২৩ সাল পর্যন্ত রিকশা চালাবে। কিছু টাকা জমাবে। এরপর জন্মভিটায় ফিরে যাবে। রহিমাকে আবারও ভর্তি করাবে স্কুলে। সেই স্বপ্ন বুকে নিয়ে এক বাবা তার শরীরের সমস্ত রক্তকে জল করে সারারাত রিকশার প্যাডেল ঘুরিয়ে মহানগরীর এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত চষে বেড়ায়। তার কষ্ট জমিলা যেমন বোঝে, তেমনি রহিমাও। তাই ভোরের দিকে যখন বস্তিতে ফেরে, তখন তারা দুজনেই আজিমুদ্দিনের খাওয়া-দাওয়া ও ঘুম-বিশ্রামের ব্যাপারে যত্নশীল হয়ে ওঠে। মাঝেমধ্যে মেয়ের মুখের তাকিয়ে আনমনা হয়ে যায়। জমিলা কারণ জানতে চাইলেও সে কোনো জবাব দিতে পারে না। দুপুর গড়িয়ে বিড়ালপায়ে বিকাল নামলে আজিমুদ্দিনের ঘুম ভাঙে প্রতিদিন প্রায় একই সময়।
আজ যেমন লোকটা অকারণে তার গায়ে হাত তুললো, আবার টাকা না দিয়েই চলে গেলো। রাত শেষ হয়ে আসে, আজিমুদ্দিন আকাশের দিকে তাকায়, খোদা রহম করো।
এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন রহিমা অসুস্থ হয়ে পড়ে। গায়ে জ্বর। জমিলার চিন্তার অন্ত নেই। আজিমুদ্দিনকেও সেই চিন্তার সরু সাপ আস্তে আস্তে ছোবল হানে। সেই ছোবলের বিষে শিবের মতো আজিমুদ্দিনের শরীরও ধীরে ধীরে নীল হতে থাকে। নীলকণ্ঠ আজিমুদ্দিনের বুকের যন্ত্রণা সংসারে কে বুঝবে? বোঝার কেউ নেই। জমিলা বুঝবে, এমন আশা তার নেই। স্ত্রীকে সে ভালোবাসে, জমিলাও তাকে ভালোবাসে। সেই ভালোবাসায় খাদ আছে কি না, আজিমুদ্দিন বুঝতে পারে না। কিন্তু নিজেকে আজকাল রোবট মনে হয়। তার কেবলই খেটে যাওয়া, অন্তহীন সেই খাটুনির পথ। তাকে কেবলই সংসারে অর্থের জোগান দিতে হয়। যেন নগরীরর মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাংকের এটিএম বুথ। যার-ই যখন ইচ্ছা হবে, তখনই কার্ড পাঞ্চ করবে। অমনি সেই বুথ থেকে চহিদামাফিক টাকা ঝুর ঝুর করে বের হতে থাকবে। কাউকে নিরাশ করা যাবে না।
করোনা আসার পর মা-বাবা-ভাই-বোনদের টাকার চাহিদা যেন বেড়েছে। তারাও মাসের আগা-মাথায় টাকার জন্য ফোন করে। আজিমুদ্দিন কাউকে ‘না’ করতে পারে না। খোদার দুনিয়ায় পুরো বংশে সে-ই যেন ‘খাজা বাবা’ হয়ে বসে আছে। কেউ ফেরে না খালি হাতে তার ‘দরবার হতে’। সেই খাজা বাবা আজিমুদ্দিনের মেয়েটা আজ কয়দিন অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে, কই কেউ তো একটিবার খোঁজ নিলো না। কেউ তো জানতে চাইলো না, রহিমা সুস্থ আছে কি না। বরং গ্রাম থেকে, মফস্বল শহর থেকে যে-ই ফোন করে, সে-ই টাকা চায়। সেই টাকা আজিমুদ্দিন কোত্থেকে দেবে, সেই ভাবনা কারও নেই। যেন সংসারের সমস্ত চিন্তার ভার একা ধূর্জটি আজিমুদ্দিনেরই। এসব ভাবতে ভাবতেই রহিমাকে হাসপাতালে নেওয়ার কথা বার কয়েক ভেবেছে। কিন্তু জাফর তালুকদারকে বলতেই পরামর্শ দিলো, না ভাই, এখন হাসপাতালে নিয়ে লাভ নাই। কারণ হাসপাতালগুলো হটস্পট হয়েই আছে। ডাক্তাররা বলেছেন, যতটা সম্ভব বাসাবাড়িতে রেখেই চিকিৎসা করাতে।
যেখানে ডাক্তারই রোগীকে হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেয় না, সেখানে স্বজনের কী করার আছে? তাই ঘরেই চিকিৎসা চলে। সেই যাত্রা রহিমা অনেক ভুগে-টুগে মরতে মরতেও বেঁচে ওঠে। বেঁচে ওঠে, মাকে বলে, মা আমার পরান কিন্তু কই মাছের মতো। অত সহজে মরুম না। মা তার হাসে। বলে, পাগলি মেয়ে। কী কস? তুই মরবি ক্যান? অসুস্থ রহিমার খোঁজ-খবর নেওয়ার ছলে জাফর তালুকদার তখন প্রায় আজিমুদ্দিনের ঘরে আসতো। আর মন কেমন করা চোখে রহিমার দিকে তাকিয়ে থাকতো। যেন জাফর তালুকদারের সেই চোখ দুটি অজগরের সাপের মতো হিস হিস করতো। রহিমার মনে হতো এই বুঝি অজগরটা তাকে গিলে খাবে। সে ভয়ে খরগোশের ছানার মতো সেঁটিয়ে যেতো। বিষয়টা জমিলার চোখ এড়াতো না। সে আজিমুদ্দিনের কনুইতে গুঁতো মারে—আপনে ভাইকে নিয়ে সামনের রুমে বসেন। যান। অসুস্থ মেয়ে মানুষের সামনে এভাবে পর পুরুষের ভিড় করা ঠিক না। জমিলার কথার মর্ম বোঝে না আজিমুদ্দিন। রোগী দেখতে আসা ঝুপড়ি মালিকের প্রতি এমন আচরণে বিস্মিত সে। মনে মনে হিসাব মেলানোর চেষ্টা করে। কিন্তু হিসাব মেলাতে পারে না। মনে নানা রকম সন্দেহ দেখা দেয়, একবার ভাবে জাফর তালুকদার কি জমিলার দিকে কুদৃষ্টি দিয়েছে? যদি দেয়, তাহলে তার রক্ষা নেই। সে ভাবে, রহিমার দিকে খারাপ নজরে তাকাবে না তালুকদার। রহিমা তো তালুকদারেরও মেয়ের মতো। তাহলে মেয়ের বয়সী রহিমার দিকে সে কেন খারাপ নজরে তাকাবে? এসবই তার ভাবনার মধ্যে থাকে। মুখে আনে না।
তখন কিশোরী সন্ধ্যা, সূর্য ডুবেছে মাত্র। পশ্চিম আকাশে কামরাঙা তরুণীর লাবণ্যমাখা লালচে আভা ছড়িয়ে পড়েছে। পশ্চিম আকাশ যখন এমন বেহায়া-লজ্জাহীনার মতো সাজে, আজিমুদ্দিনের মনটা তখন উতল-বিতল করে। সে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না—কী করবে। মাঝে-মাঝে পুরনো দিনের সিনেমার গান ধরে। গুন গুন করে। আরোহী থাকলে সে আবেগে লাগাম টানে। কারণ সে জানে সব আরোহীর মন-মেজাজ-রুচি সমান নয়। কেউ গান পছন্দ করে, কেউ ঘৃণা করে। এই ২০২৩ সালে এসেও স্বাধীন বাংলাদেশে সংস্কৃতিচর্চা যে এখনো বাধামুক্ত হতে পারেনি, একথা অনেক সংস্কৃতিবানের চেয়েও ভালো করে জানে আজিমুদ্দিন। সেদিন শাহবাগ থেকে যাচ্ছিল চানখাঁরপুল। রিকশায় নবদম্পতি। দেখে বেশ উচ্চশিক্ষিতই মনে হলো। তারও মন বেশ ফুরফুরে। টিএসসি পার হতেই সে গুনগুনিয়ে গান ধরে। আর অমনি পেছন থেকে পুরুষ যাত্রীটি খেঁকিয়ে ওঠে—ওই ব্যাটা! মাইয়া মানুষ রিকশায় উঠলে অমনি গান শোনানোর খায়েস জাগে? হঠাৎ হায়েনার মতো আক্রমণে আজিমুদ্দিন ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়, স্যার কী যে বলেন? আমি তো এমনি…তার কথা শেষ হয় না। পুরুষ যাত্রীটি কষে থাপ্পড় বসায় তার বাম কানে। সঙ্গে গালি, শুয়োরের বাচ্চা। ফকিন্নির বাচ্চা। গান চোদাও? রিকশা টান।
বিষয়টা হজম করতে পারে না আজিমুদ্দিন। কিন্তু আরোহীর সঙ্গে মারামারি করবে? একজন দরিদ্র রিকশাঅলা বিত্তশালীর গায়ে হাত তুলবে? সমাজ মেনে নেবে? সে নিজে মার খেয়েছে, আশপাশের দুই চার জন তার প্রতি সহানুভূতি দেখাবে। আরোহীর মতো সে-ও যদি একই আচরণ করে, তবে সমাজ তার বিরুদ্ধেই ক্ষেপবে। তাই সে চুপ থাকে। তার চুপ থাকা দেখে আরোহী ক্ষেপে যায়, কী রে ব্যাটা রিকশা টান দে। আজিমুদ্দিন এবার বলে, স্যার আমি আর যামু না। আপনে অন্য রিকশা নিয়ে যান। আরোহী ঘুষি পাকিয়ে তেড়ে আসে। ঘুষি দেবে, এর আগেই তার স্ত্রীলোকটি ধরে ফেলে, কী করছ এসব? রিকশাঅলার গায়ে হাত তুলছ? ছিঃ। স্ত্রীর ধিক্কারে পুরুষ আরোহী থামে। আজিমুদ্দিনের মনে হয়, লোকটি ঘুষি দিলে তবু ভালো হতো। কিন্তু লোকটির স্ত্রী তাকে আরও বেশি অপমান করলো। রিকশাঅলা বলে তাকে অচ্ছ্যুৎ বলে গেলো! তার ভাবনায় ছেদ পড়ে, অন্য রিকশাঅলাদের হট্টোগোলে। পুরুষ যাত্রীটি গিয়েছিল আরেক রিকশাঅলার কাছে। সেই রিকশাঅলা বললো, না স্যার যামু না। আপনি টাকার গরম দেখান। একটু আগে এক রিকশা ড্রাইভারের গায়ে হাত তুলেছেন। লোকটি এবার তেড়ে যায় প্রতিবাদী রিকশাঅলার দিকে। অমনি চারদিক থেকে ঘিরে ধরে বাকি রিকশাঅলারা। আজিমুদ্দিন পাশ থেকে দেখে। ভাবে, এবার প্রতিশোধ নিলে কেমন হয়। আবার ভাবে, কী দরকার। নিজের ভেতর হিস হিস করে ওঠা হিংস্র সাপটাকে থামায় সে। নিজেকে বলে, লোকটা এমনিতেই ভর্তা হবে এখন। এরপরই প্যাডেলে চাপ মেরে টান দেয় নিউমার্কেটের দিকে। ততক্ষণে আকাশের লাল আভাটুকু মুছে গেছে। এখন শহরের ল্যাম্পপোস্টের বাতি আর ভবনের আলো ছাড়া কিছুই দেখা যায় না।
আজিমুদ্দিনের মেজাজ খিঁচড়ে আছে। তবু যাত্রীদের সঙ্গে সে খারাপ ব্যবহার করে না। নিজেকে বোঝায়, আমি খারাপ ব্যবহার করলে লোকে আমাকে খারাপ বলবে। লগে আমার পরিবারকে খারাপ বলবে, আমার এলাকাকে খারাপ বলবে। একজনের খারাপ ব্যবহারের দোষ পুরো জেলার ওপর পড়বে। না, মানুষ যতই দুর্ব্যবহার করুক, আমি করুম না। এই আত্মশাসন-আত্মনিয়ন্ত্রণে আজিমুদ্দিন একজন রিকশাচালক হয়েও ঋষি বনে যায়। নিজেকে মাঝেমাঝে বাহবা দেয়—ওহে আজিমুদ্দিন, এভাবে রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে সমাজে তোমার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে কতক্ষণ! আবার নিজেকে বোঝায়, মানুষ ভালো কাজ কি খ্যাতির জন্য করে? তাহলে আমি ক্যান খ্যাতির কথা ভাবছি!
ভাবতে ভাবতে মনের ভেতর আরেকটা অকল্যাণের কাঁটা খচখচ করে। ঘরে মেয়েটা কদিন ধরে অসুস্থ। কাজে বের হওয়ার সময় দেখে এসেছে, জলেভেজা মুরগির বাচ্চার মতো মেয়েটা ঠকঠক করে কাঁপছিল। জাফর তালুকদারকে বলতেই সে ক্লিনিকে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। বলেছিল, ভাই, রহিমাকে আলম ক্লিনিকে নিয়ে যান। ওই ক্লিনিকের মালিক আলম তালুকদারের বাড়ি আমাদের এলাকায়। নাটোরে। টাকা-পয়সা বেশি নিবো না। জবাবে আজিমুদ্দিন বলেছে, দেখি আজ রাতটা। কাল নিয়ে ভর্তি করামু।
মাথার ভেতর হাজারো চিন্তার জট। যেন সে আজ ধূর্জটি। চিন্তার নটরাজ তার মগজের ভেতরই আজ তাণ্ডব নৃত্য চালাচ্ছে। তাকে স্থির থাকতে দিচ্ছে না। জমানো টাকা-কড়িও তেমন নেই। মেয়েকে হাসপাতালে ভর্তি করালে কত খরচ হতে পারে, আন্দাজ করার চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। আবার ভাবে, আগে ভর্তি করাই, পরে দেখা যাবে। দরকার হলে নাটোরের বাড়িঘর বেইচ্যা দিমু। আগে মাইয়ার চিকিৎসা। পরে বাঁইচ্যা থাকলে সব অইবো।
খোদার কাছে আজিমুদ্দিন অত বেশি কিছু চায়নি। চেয়েছে দুই বেলা দুই মুঠো ভাত। আর সংসারে শান্তি। কিন্তু তার সংসারের শান্তি খোদা কত দেবে, যেখানে খোদারই এমন কোটি কোটি সংসারে অশান্তি ঝড় চলছে! আজিমুদ্দিন এসব বোঝে না যে তা নয়। কিন্তু মনকে বোঝাতে পারে না। সে বোঝে শান্তির মূলে টাকা, সেই টাকার জন্যই সারারাত তাকে ঘানি টানতে হয়। কত মানুষের লাথি খেতে হয়, কত মানুষের থাপ্পড়। আজ যেমন লোকটা অকারণে তার গায়ে হাত তুললো, আবার টাকা না দিয়েই চলে গেলো। রাত শেষ হয়ে আসে, আজিমুদ্দিন আকাশের দিকে তাকায়, খোদা রহম করো।
মাথার ভেতর ঘন ঘন বেজে চলে, ‘আমার বাপের কী দোষ?’ এই প্রশ্নের যন্ত্রণা তাকে অকস্মাৎ নিশ্চল পাথরের মূর্তিতে পরিণত করে দেয়।
আজিমুদ্দিন খোদার কাছে রহম চেয়েছে, কিন্তু আকাশ থেকে কোনো দয়ার বার্তা এলো না, তার বদলে এলো বউয়ের ফোন। দ্রুত ছুটতে থাকে আলম ক্লিনিকের দিকে। তেজগাঁও বস্তি থেকে বেশি দূরে নয় আলম ক্লিনিক। ফার্মগেটেই। সকালের আলো ফোটার আগেই শ্রমজীবী মানুষেরা পিঁপড়ার মতো বের হয়েছে। কেউ কেউ রাস্তার পাশে মাটি কাটার কোদাল- টুকরি নিয়ে বসে আছে,। কয়েক ঘণ্টার দীর্ঘ মাহফিলের জিকিরক্লান্ত মুসল্লির মতো তাদের চোখে ঘুমের ঢুলুঢুলু ভাব। কেউ কেউ ঘানিটানা গরুর মতো ধীরে সবজির ভ্যান ঠেলে যাচ্ছে। কেউ কেউ দল বেঁধে যাচ্ছে কর্মস্থলে। গার্মেন্টসকর্মীরা সারিধরে দাঁড়িয়ে আছে বাসে ওঠার অপেক্ষায়। এসব মানুষকে পেছনে ফেলে ছুটে চলছে আজিমুদ্দিনের রিকশা।
আলম ক্লিনিকে ঢুকেই ফ্লোরে বউ-মেয়েকে দেখে আজিমুদ্দিনের মাথায় রক্ত ওঠে। অ্যাডভান্সড দিতে পারেনি বলে সিটের ব্যবস্থা হয়নি। রিসিপশন থেকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে অ্যাডভান্স না করলে সিট পাওয়া যাবে না। তাই রহিমাকে ফ্লোরেই কাঁধা বালিশ বিছিয়ে শুইয়ে দেয় জমিলা। আজিমুদ্দিন এই নার্স ওই নার্স, এই ডাক্তার ওই ডাক্তারের কাছে দৌড়াতে থাকে। কিন্তু সিট মেলে না। টাকা ছাড়া বয়-নার্স—কেউই সিটের ব্যবস্থা করে দিতে রাজি হলো না। আর তখনই মনে হলো জাফর তালুকদারকে ফোন দিতে হবে। সে তো রিকশা নিয়ে বের হবে এখন। কিন্তু রিকশা বস্তিতে নেই, আছে আলম ক্লিনিকে।
ফোন পেয়ে জাফর তালুকদার এলে সিটের কথা তোলে আজিমুদ্দিন। জাফর তালুকদার বলে, মালিক খুব ভালো মানুষ। আপনাকে আগে বলেছি না? এই ক্লিনিকের মালিক ডা. আলম তালুকদার আমাগো নাটোরের মানুষ। তার কাছে গেলে ব্যবস্থা একটা হবে। এখন বলেন, মেয়েকে কোনো ডাক্তার দেখতে আসছে? নাকি না দেখাইয়া খালি সিটের জন্য মরতেছেন? কথা শুনে যেন জমিলা-আজিমুদ্দিন দুজনেরই হুশ হয়। তখনই জমিলা জানায়—এখন পর্যন্ত কোনো ডাক্তার দেখতে আসেনি।
সারারাত নির্ঘুম আর রিকশা চালানোর ক্লান্তি শরীরে ভর করেছে আজিমুদ্দিনের। টাকা জোগাড় করা দরকার। জমিলাকে বলে, ঘরে যে ক’ টাকা আছে, নিয়ে আসি।
-আচ্ছা যান। তাড়াতাড়ি আসবেন।
-তুমি রহিমার দিকে খেয়াল রাইখো। আলম ডাক্তার আইলে তারে আনতে পারো কি না দেখবা।
-আচ্ছা। আপনে এখন তাড়াতাড়ি যান।
আজিমুদ্দিন বস্তিতে ফেরে। সারারাতের ক্লান্তিতে শরীর আর চলে না। খাটের কোনায় বসে ঝিমোয়। কখন ঘুমিয়ে পড়ে বুঝতে পারে না। ঘুম ভাঙে জমিলার ফোনে, আপনে কই। তাড়াতাড়ি আসেন। মাইয়া জানি কেমন করতেছে।
বউয়ের ফোন পেয়ে ধড়মড় করে উঠে বসে আজিমুদ্দিন। প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে হাজির হয় আলম ক্লিনিকে। মেয়ের কাছে যেতেই জমিলা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে, মাইয়া তো আর নাই। কোনো ডাক্তার দেখতে আইলো না। কোনো নার্সও একটু খবর নিলো না। ওরে আল্লাহরে, তুমি আমার মাইয়ারে তুলে নিয়া গেলা। আমারে ক্যান রাখি গেলা? জমিলার বিলাপে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে আজিমুদ্দিন। সোজা ঢুকে পড়ে ক্লিনিকের মালিক আলম তালুকদারের রুমে। তাকে দেখেই আলম তালুকদার চিৎকার করে ওঠে, এই সিস্টার! এই ব্যাটা এখানে কী করে ঢুকলো?
আলম তালুকদারের গর্জনে ক্লিনিকের নার্স-বয়-সিকিউরিটি জড়ো হয় তার রুমের সামনে। কয়েকজন আজিমুদ্দিনকে কিল ঘুষি মেরে নিচে নামানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তার দেহ তখন দুর্যোধনের মতো কঠোর তপস্যায় বজ্রে রূপ নিয়েছে। কারও কিল-ঘুষিতেই তার যেন কিছুই হচ্ছে না। গুলি খাওয়া চিতার মতো প্রচণ্ড হুঙ্কারে ঝাঁপিয়ে পড়ে আলম তালুকদারের ওপর, তোর হাসপাতালে মাইয়াকে আনলাম। তুই একবারও দেখলি না। তোর কোনো ডাক্তার-নার্সও দেখলো না। আমার মাইয়া বিনা চিকিৎসায় মরে গেলো। কুত্তার বাচ্চা, তুই খুনি। তুই-ই আমার মাইয়ারে খুন করছস।
আলম তালুকদার ক্লিনিকের স্টাফদের নিয়ে এবার আজিমুদ্দিনকে রশি দিয়ে বেঁধে ফেলে। একজন দ্রুত কল দেয় থানায়। জমিলা কিছু বুঝতে উঠতে পারে না। সে আলম তালুকদারের পায়ে পড়ে—আমার স্বামীরে ছাইড়া দ্যান। হে কী দোষ করছে? আপ্নেরা তারে মারলেন। আবার বাইন্ধাও রাখছেন ক্যান? ও রে আল্লাহরে আমরা কার কাছে যামু? এই জুলুমের কি বিচার অইতো না? জমিলা এভাবে আষাঢ় মাসের বাদলধারার মতো কতক্ষণ কাঁদে, হিসাব নেই। হঠাৎ দেখে একজন দারোগা এসেছে, সঙ্গে দুইজন কনস্টেবল। তারা আজিমুদ্দিনকে হাতকড়া পরিয়ে কলুর বলদের মতো টানতে থাকে। আজিমুদ্দিন গোঁ ধরে—আমার মাইয়ারে এই ডাক্তার খুন করছে। আর আপ্নেরা আমারেই অ্যারেস্ট করছেন? এইডা কেমুন বিচার আপ্নেগো? প্রশ্ন শুনে হঠাৎ আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মতো মাথায় রক্ত চড়ে দারোগার। কষে একটা থাপ্পড় বসায় আজিমুদ্দিনের বাম গালে। পাথরের মতো ভারী সেই কঠিন হাতের থাপ্পড়ে তার মাথা ভনভন করে ওঠে। ও বাবা গো বলে প্রাণপণে চিৎকার দেয়। স্বামীর মরণচিৎকারে জমিলা বিহ্বল হয়ে পড়ে। জমিলা এবার আলম তালুকদারের পা ছেড়ে দারোগার পায়ে পড়ে—স্যার আমার স্বামীরে ছাইড়া দেন। দারোগা অনেক চেষ্টা করেও পা ছাড়াতে পারে না। যেন নৌকার গুণ টানার কাছি দিয়ে তার দুই খানা পা বেঁধে রেখেছ কোনো পাকা মাঝি-মাল্লার দল। পা ছাড়াতে না পেরে, তার রাগ ত্রিগুণ বাড়ে। সজোরে লাথি দেয় জমিলাকে। জমিলা দারোগার হাতির থামের মতো পায়ের আঘাতে ছিটকে পড়ে দেয়ালে। আর তখন গগনবিদীর্ণ করে সে আর্তনাদ করে ওঠে—ও আল্লাহ রে। সেই চিৎকার যেন দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলে দারোগার কানে হাতুড়ি পেটায়।
দারোগা এবার পেছন ফিরে তাকায়। দেখে জমিলার মাথা ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। যেন কুরুক্ষেত্রের নিহত বীরদের রক্তের স্রোত অলকানন্দার পানিতে মিশে যাচ্ছে। তখনই চোখ যায় সাদা কাপড়ে ঢাকা রহিমার দিকে। দারোগা যেন স্পষ্ট দেখে, রহিমার মুখের ওপর থেকে সাদা কাপড় সরে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। দেখে তার চোখ বিস্ফারিত হতে থাকে। আর তখনই যেন রহিমা বলে ওঠে, স্যার গো আমার বাপের কী দোষ? শব্দ কটি দারোগা আকাশবাণীর মতো শোনে বটে, কিন্তু নিজের কানকেই তার বিশ্বাস হয় না। আবার চোখকেও সন্দেহ হয়। দীর্ঘ চাকরি জীবনে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি কখনো তাকে হতে হয়নি। তার মুখে কথা ফোটে না, হা করে তাকিয়ে থাকে রহিমার দিকে। মাথার ভেতর করুণ বেহালার মতো ঘন ঘন বেজে চলে, ‘আমার বাপের কী দোষ?’ এই প্রশ্নের যন্ত্রণা তাকে অকস্মাৎ নিশ্চল পাথরের মূর্তিতে পরিণত করে দেয়। আর তখনই হাতের মুঠোয় ধরে রাখা আজিমুদ্দিনের হ্যান্ডকাপ শিথিল হয়ে আসে। কী এক অমোঘ তাপে দারোগার পা যেন পারদের মতো মেঝেতে গলতে থাকে, সে আর সামনে এগোতে পারে না।