তিনি দোতলায় ওঠার রেস্টল্যান্ডে বসে আছেন। তাঁর কোলে শিশুপুত্র রাসেল শুয়ে। নিবিড় এক শান্তির ঘুম যেন রাসেলের সর্বাঙ্গজুড়ে। তিনি শাহাদত আঙুলটি ঠোঁটে ধরে বেগম মুজিবকে চুপ থাকতে বলছেন। চোখ দিয়ে ইশারা-ইঙ্গিতে বোঝাতে চাচ্ছেন কথা না বলতে। কখনো কপট রাগ দেখাচ্ছেন। বোঝাতে চাচ্ছেন, একটুও শব্দ করো না, রাসেলের ঘুম ভেঙে যাবে। কিন্তু তিনি যতবারই আঙুলটি ঠোঁটের কাছে আনতে যাচ্ছেন, ততবারই হাতটি পড়ে যাচ্ছে। তাতে নৈঃশব্দ্যের কোনো ব্যাঘাত ঘটছে না। কিন্তু নিজের ওপর রেগে যাচ্ছেন তিনি বার বার।
বেগম মুজিব উদভ্রান্তের মতো তাঁর হাত চেপে ধরার চেষ্টা করছেন। বিশেষ করে তাঁর শাহাদত আঙুলটি, যা এখন টকটকে লাল দেখাচ্ছে। বেগম মুজিব ভাবছেন ওখানে এত রক্ত এলো কিভাবে। যে আঙুলটি স্বাধীনতার ডাকের সঙ্গে সম্পর্কিত, যে আঙুলটি সাতই র্মাচ এবং স্বাধীনতার সমার্থক হয়ে উঠেছিল সেটা রক্তাক্ত হয় কিভাবে! আঙুলটিকে আর আঙুলই মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে রক্তাক্ত দণ্ড।
বেগম মুজিব আরও একবার তাঁর হাতটি ধরার চেষ্টা করলেন। তিনি আবারও ঠোঁটে আঙুল দিয়ে নৈঃশব্দ্য বজায় রাখার ইঙ্গিত করলেন। বেগম মুজিব সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে হাতটি ধরে ফেললেন। তিনিও হাতটি সরিয়ে নিলেন তৎক্ষণাত। ওই এক ঝলক স্পর্শেই বেগম মুজিবের হাতে আগুনের উত্তাপ লেগে গেল। বেগম মুজিব তীক্ষ্ণ চোখে তাঁর হাতের দিকে তাকালেন। এবার আঙুলটিকে আর রক্তাক্ত মনে হলো না। মনে হলো আগুনের শিখা।
বেগম মুজিবের হাতে আগুনের উত্তাপ লাগলেও তিনি বিস্মিত হলেন না। সামান্য সিথর হলেন। তিনি তাঁকে আবার শান্ত করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কিছুতেই পারছেন না। এরই ভেতর গৃহভৃত্য রমা রেডিও নিয়ে এলো। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে এলো ক্লান্তভাবে, সর্বাঙ্গে তার বিধ্বস্থ ভাব। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে সে। তার পায়ের গোড়ালি বেয়ে রক্ত পড়ছে। দুই হাতেও রক্তের দাগ। রেডিওটি বেগম মুজিবের সামনে রেখে ধপাস করে বসে পড়ল সে। তখন বেগম মুজিবের একটি পরিচিত কণ্ঠ শোনা যেতে থাকলো রেডিওতে। ঘোষণা শোনা যাচ্ছে, ‘আমি মেজর ডালিম বলছি। শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। কারফিউ জারি করা হয়েছে।…বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।’ তিনি বিস্ময়-বিস্ফোরিত চোখে বেগম মুজিবের দিকে তাকালেন। বললেন, ‘ডালিম না তোমাকে মা বলে ডাকত!’
দুই.
মেজর মহিউদ্দিন, নূর ও ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা তিন সিঁড়ি নিচে বাধ্যগত ছাত্রের মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। হুদার চোখে স্পষ্ট ভেসে উঠল প্রথম গুলিটা লাগলো শাহাদাত আঙুলে। সেটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গেই। বিচ্ছিন্ন হয়ে দেয়ালের সঙ্গে বাড়ি খেল প্রথমে। তারপর পড়ে গেল মেঝেতে।
মহিউদ্দিন আবারও দেয়ালে চোখ রাখল। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে রক্তের দাগ। নিচের দিকে দাগটি সরু হয়ে হয়ে দেয়ালের রঙের সঙ্গে মিশে গেছে। মেঝেতেও রক্তের ছাপ। দুই রক্তের ছাপ তো একইসঙ্গে মিথ্যা হতে পারে না। দেখার ভুল হলে এক জায়গায় হতে পারে। দুই জায়গায় হতে পারে না। কারণ একটার সাথে আরেকটার যোগসূত্র রয়েছে। তবুও হুদা সন্দেহমুক্ত হতে পারল না। কোথাও কি ভুল হয়ে গেছে? কোথাও কি ভুল হয়ে যাচ্ছে? কোথাও কি ভুল হয়ে যাবে? যদি হয়? তাহলে?
হুদা আবারও দেয়ালে রক্তের ছাপের দিকে তাকালো। আশ্চর্য! রক্ত কোথায়? রক্তের ছাপ কোথায়? এত সবুজ কোত্থেকে এলো? যেখানে রক্তের দাগ দেখা গেলো একটু আগেও, সেখানে বাংলাদেশের মানচিত্র গেঁথে দিলো কে? তাহলে কি তার আঙুল ব্যর্থ হয়েছে? ব্যর্থ হয়ে বঙ্গবন্ধুর আঙুলটিকে তার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি? হুদা এবার মেঝের দিকে তাকালো। আশ্চর্য এখানেও তো একটু আগে রক্তের দাগ ছিল। সেগুলো গেলো কোথায়? সেখানেও তো সবুজের সমারোহ। শুধু মাঝখানে নিঁখুত একটু বৃত্তাকার অংশ লাল। তাহলে কি সত্যি সত্যি কোথাও ভুল হয়ে গেছে? তাহলে কি সত্যি সত্যি কোথাও ভুল হয়ে যাচ্ছে? তাহলে কি সত্যি সত্যি কোথাও ভুল হয়ে যাবে? যদি হয়! তখন?
মহিউদ্দিন ভাবছে এতগুলো গুলি করলাম। বুকের ডান দিকটা তো ঝাঁঝরা করে দিলাম। মহিউদ্দিন চেতনা শাণিত করে আবারও বঙ্গবন্ধুর দিকে তাকলো। হ্যাঁ সত্যিই তো কথা বলছেন তিনি। কিন্তু গুলি করার পরই তো তাকে দেখা গেলো মাটিতে লুটিয়ে পড়তে। তার শাদা বুকটা মেখে গেলো লাল রক্তে। ঠোঁটের কোণায়ও যেন রক্ত দেখা গিয়েছিল। মহিউদ্দিন চেতনা আরও শাণিত করে তার ঠোঁটের দিকে তাকালো। সত্যিই তো বঙ্গবন্ধু কথা বলছেন! কিন্তু তার মুখ থেকে আগুনের হলকা বের হচ্ছে কেন? মহিউদ্দিন তার সম্বিতকে আরও সচেতন করতে চেষ্টা করল। তখনই আগুনের একটা হলকা এসে তার চোখ মুখ জ্বালিয়ে দিলো।
নূর আড়চোখে সিঁড়ির দিকে তাকলো। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে রক্তাক্ত শেখ মুজিব। নিহত শেখ মুজিব। নিথর শেখ মুজিব। নিথর দেহের নিচে রক্তের একটি ধারা। সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে নিচের দিকে যাচ্ছেনন। কিন্তু দোতলার রেস্টল্যান্ডে বসে থেকে যিনি কথা বলছেন, তিনিও শেখ মুজিব। রাসেলকে কোলে নিয়ে কথা বলছেন, তোরা আমার ছোট ভাই নাসেরকে মেরে ফেললি! তোরা কামালকেও মেরে ফেললি! তোরা যেন রাসেলকে কিছু বলিস না। বজলুল হুদা দেখল শেখ মুজিবের শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া শাহাদত আঙুলটি একটু একটু নড়ছে। এক সামান্য আঙুলের তো এতক্ষণ নড়াচড়া করার কথা না! এছাড়া কিছুক্ষণ আগেও ওটাকে নিথর দেখা গেছে। এখন কী এমন হলো যে নড়াচড়া করতে থাকবে! বজলুল হুদা পুরো দৃশ্য মনে করার চেষ্টা করল। তখনই দেখল আঙুলটি লাফাতে লাফাতে তার দিকে এগিয়ে আসছে। বেগম মুজিব চিৎকার দিয়ে কাঁদছেন, তোমার গায়ে এত রক্ত কেন?
মহিউদ্দিন খুব ধন্দে পড়ে গেছে ইতোমধ্যে। গুলি করার সময় তার আঙুলটি কেঁপে উঠেছিল কি? মনে পড়ে না। চোখে একটু ঝাপসা লেগেছিল। কেন জানি দেখা গেলো এক মুজিবের শরীর থেকে আরেক মুজিব বের হয়ে এলো। আঙুল কোনো ভুল করতে চায়নি। তাইতো লক্ষ করা হলো দুটোকেই। কে আসল কে নকল বোঝা মুশকিল। এখন দেখি এক শেখ মুজিব কথা বলছেন।
তিন.
বজলুল হুদা, মেজর নূর ও মহিউদ্দিন একসঙ্গে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগলো। তখনই কয়েকটি গোলার বিকট আওয়াজ শোনা গেলো। তারা একইসঙ্গে শুনতে পেলো হাজারো পাখির কিচিরমিচির। তারা একইসঙ্গে অনুভব করল হাজারো পাখির পাখা ঝাপটানি। যেন ধানমন্ডির গাছে গাছে থাকা সব পাখিরা একসঙ্গে তাদের আক্রমণ করে বসেছে। তাদের পাখার বাতাসে বজলুল হুদা যেন ভেসে যেতে থাকল। মেজর নূরের শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেল। মহিউদ্দিন আর এগুতেই পারল না। দেখা গেলো তারা মাত্র একটা ধাপ ওপরে উঠতে পেরেছে। এইসব বাধা অতিক্রম করতে যখন তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ছে, তখনই উষ্ণ এক রক্তের ধারা তাদের চোখ মুখ ভিজিয়ে দিলো। তারা বিষয়টি বুঝে ওঠার চেষ্টা করতে না-করতেই আরেকটি ঢেউ এসে তাদের বিহ্বল করে তুলল। তারপর আরও একটি রক্তের ঢেউ। তারা রক্তের ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে দেখতে পেল একটু আগে যে-লোকটাকে তারা ব্রাশ ফায়ারে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে, সে-লোকটি উঠে দাঁড়াচ্ছে। তার চোখ ফেটে অশ্রু নয় গলগল করে রক্ত ঝরছে। তারা স্পষ্ট শুনতে পেল লোকটা বলছেন, আমি বাঙালি, আমি মুসলমান, আমি মানুষ…। তোরা একবার আমার সামনে এসে দাঁড়া।
হুদা আবারও ধন্দে পড়ে যায়। একটু আগেই তো লোকটা একই কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, তোমাদের কিছু বলার থাকলে ওপরে এসে আমাকে বলো। হুদা বলেছিল, আমরা আপনাকে নিতে এসেছি। আমাদের সাথে আপনাকে যেতে হবে।
লোকটা তখন বলেছিলেন, কোথায় যাব? কেন যাব? না, আমি যাব না। হুদার রাগ তখন সপ্তমে উঠে যায়। লোকটার গলায় রিভলভার ঠেকালো হুদা। তখন লোকটা বললেন, ঠিক আছে, আমি একটু চেঞ্জ হয়ে আসি। তাঁর পরনে লুঙ্গি। হুদারা তখন সময় নষ্ট করতে রাজি নয়। এ পোশাকেও আপনি বঙ্গবন্ধু, চেঞ্জ করলেও বঙ্গবন্ধুই থাকবেন। পোশাক বদলানোর দরকার নেই।
তিনি রাজি হলেন। বললেন, দাঁড়াও, আমার পাইপ আর তামাক নিয়ে আসি। তিনি ঘরে গেলেন এবং পাইপ নিয়ে এলেন। সিঁড়ি দিয়ে মাঝামাঝি জায়গায় এলেন। কেউ একজন একটা গামছা দিয়ে তাঁর চোখ বাঁধার চেষ্টা করলো। তিনি এক ঝটকায় তাকে সরিয়ে দিলেন। হুদা সিঁড়িতে বসে পড়ল। মহিউদ্দিন হুদার পেছন থেকে তাঁর ওপর ব্রাশ ফায়ার শুরু করল।
রক্তের প্রবল ঘূর্ণির ভেতরে পড়ে তারা দিশেহারা হয়ে গেল। স্রোতের এত তীব্র টান! রক্তের নোনা গন্ধ। দম বন্ধ হওয়া অবস্থা। জীবন যায় যায়। তখন আবার এক দরাজ কণ্ঠ ভেসে এলো, আমি চলে গেলাম সাভারে। স্মৃতিসৌধের কাছে।
চার.
তিনি উঠে দাঁড়ালেন। কোলে তাঁর শিশুপুত্র রাসেল। রাসেলের বুকে রক্ত। ঠোঁটের কোণেও। বেগম মুজিব দুই হাত বাড়ালেন রাসেলকে কোলে নেওয়ার জন্য। বললেন, রাসেলকে আমার কোলে দাও। তিনি বললেন, না। রাসেল আমার কাছে থাকবে। আমাকে দেখিয়ে কামাল একদিন হাসুকে বলেছিল তোমার আব্বাকে আব্বা বলে ডাকি! আমি রাসেলের কণ্ঠে এ কথা শুনতে চাই না।
বেগম মুজিব কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন। তিনি তাঁকে থামিয়ে দিলেন। বলতে লাগলেন, রেনু, তুমি কি ত্রিশ বছর আগের চিঠিটির মতো করে আজও বলবে তুমি শুধু আমার স্বামী এইটাই তোমার একমাত্র পরিচয় নয়। দেশের একজন সেবক তুমি, এইটাও তোমার একটা পরিচয়। দেশের কাজই তোমার সবচেয়ে বড় কাজ। বেগম মুজিব কিছু বলছেন না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন।
তিনি থামলেন। তারপর ধীর পায়ে একটু এগিয়ে গিয়ে বেগম মুজিবের চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তাহলে এত রক্ত কেন? বলো তো এই রক্ত কার? রাসেলের ঠোঁটের কোণ থেকে রক্ত মুছে নিয়ে বেগম মুজিবের চোখের সামনে ধরলেন। রাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, বলো তো এ রক্ত কার? তারপর চিৎকার দিয়ে বললেন, লিডার, একদিন আপনি বলেছিলেন, মুজিব, শি ইজ এ ভেরি প্রেশাস গিফট টু ইউ ফ্রম গড। আপনি দেখে যান হাউ প্রেশাস শি ইজ!
তিনি শিশুপুত্র রাসেলকে বেগম মুজিবের কোলে দিলেন। বেগম মুজিব রাসেলকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে মুখটা রাসেলের মুখের ওপর রাখলেন। শিশুর মতো বুকে জড়িয়ে ধরলেন পরম উদ্বিগ্নতায়। যেন কোনো পাগল তার যক্ষের ধনকে হাত ছাড়া করতে চায় না। তিনি দোতলার রেস্টল্যান্ডে আবার পড়ে গেলেন। তখন হাজারো মাইন বিস্ফোরণের শব্দে প্রকম্পিত হয়ে উঠলো চারপাশ। সেই শব্দের ভেতর থেকে উঠে এলো হাজারো কণ্ঠে আরও কয়েকটি শব্দ, জয় বাংলা…।
তিনি আবার উঠে দাঁড়ালেন। দেখলেন একটু দূরে বজলুল হুদা, নূর ও মহিউদ্দিন দাঁড়িয়ে আছে মাথা নিচু করে। তিনি দেয়ালে রক্তের দাগের দিকে তাকালেন। তারপর বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া আঙুলের দিকে। তারপর সে আঙুল থেকে বয়ে যাওয়া রক্তের ধারার দিকে তাকালেন। তিনি তার ডান হাতখানি চোখের সামনে ধরলেন। গুনে দেখলেন পাঁচটি আঙুল। তারপর আবার মেঝেয় পড়ে থাকা আঙুলের দিকে তাকালেন। দেখলেন সে আঙুল ক্রমশ বড় হচ্ছে। বড় হতে হতে ছাদ ফেঁড়ে আকাশে উঠে যাচ্ছে।
তিনি দেখলেন ক্রমশ বড় হতে থাকা সে-আঙুলটি হয়ে যাচ্ছে এক আশ্চর্য স্মৃতি সৌধ।