লোকটা আগুন নিয়ে খেলা দেখায়। মুখের ভেতর থেকে শূন্যে বাতাস ছুঁড়ে—আর তাতে লকলক করে আগুনের শিখা জ্বলে। মানুষ বিস্ময় নিয়ে লোকটার মুখের ভেতর থেকে আগুন বের করার খেলা দেখে। তাদের চোখের পাতা পড়ে না। চোখ টনটন করে, কিন্তু তারা চোখ সরায় না। বিন্দারহাট এখন আগুনের কবলে পড়া এক টুকরো দেশ।
এটাও ঠিক যে, বহুবছর পর এমন একটা খেলা দেখার সুযোগ পায় বিন্দারহাটের মানুষ। বিন্দারহাটে বাজার করতে আসা বসিরুদ্দিন বলে, ‘দেখছো লোকটার সাহস। মুখের সামনে আগুন নিয়ে খেলে। লোকটার কোনো ভয়ডর নাই। কোন সময় যে আগুন ধরবো। আর জ্বলিপুড়ি মরবো।’
কিন্তু বসিরুদ্দির এমন বিবেচনামূলক কথা শোনার মেজাজে নেই মানুষ। লোকটার এই খেলা তাদের মধ্যে নতুন এক বিস্ময়, ভাবনার জন্ম দিয়েছে। উদ্দীপনা তৈরি করেছে। তারা তখন টের পায়, আসলে খালি মাঠে কাজ করা, খাওয়া আর বউর লগে ঘুমানো— এটাই জীবন না, এর বাইরেও আরও কিছু আছে। না হলে লোকটা এমন একটা খেলা শিখলোই বা কেমন করে! কিংবা খেলা দেখাবেই বা কেন। সেও তো অন্য কোনো একটা কামকাজ করে দুনিয়ার বাসিন্দা থাকতে পারত।
লোকটা বিকাল হয় হয় সময়টিতে বিন্দারহাটে আসে। কাঁধে একটা ঝোলা। কেউই আলাদা করে লোকটাকে দেখেনি বা খেয়াল করেনি। খেয়াল করার মতও তেমন কিছু না। বিন্দারহাট তেমন বড় কোনো বাজার হয়তো না, আবার একেবারে ছোটও না। আশপাশের পাঁচ-সাতটা গ্রামের মানুষ আসে এই হাটে। আশপাশের বিভিন্ন হাট বা শহর থেকে আসে সবজি-আনাজের পাইকার। পাইকাররা হাটে আসা কৃষকদের কাছ থেকে লাউ, কুমড়া, শাক-সবজি কিনে নিয়ে দূর কোনো শহরে চলে যায়। অচেনা লোকটাকে দেখে কারও সে রকম একজন মনে হলেও হতে পারে। কিন্তু লোকটা যে দিকে সবজি-আনাজ নিয়ে কৃষকরা বসেছে, সেদিকে যায়নি—বরং তাদের উল্টোদিকে একটু খোলামতো জায়গা, যেখানে হাটের সবচেয়ে বড় কড়ই গাছের ছায়া পড়েছে। সেখানে গিয়ে বসে এবং কিছু ডালপালা কুড়িয়ে এনে স্থানটি ঝাড়ু দেয়। ঝরাপাতা, আগাছা খুটে-খুটে স্থানটি পরিষ্কার করে। বিন্দারহাটে অচেনা লোক আসে, এটা নতুন না। কিন্তু কেউ এসে বাজারের খোলা জায়গা ঝাড়ু দিচ্ছে, এটা নতুন ঘটনা। লোকটার এমন আচরণ অনেকেরই চোখে পড়ে। আর প্রথমে তারা দূরে দাঁড়িয়ে দেখে। তবে বেশিক্ষণ তারা দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। লোকটা তার ঝোলা থেকে একটা বাঁশি বের করে। সেই বাঁশিতে সে সুর তোলে। বাঁশির সুর শুনে একে একে অনেক লোক এসে লোকটাকে ঘেরাও করে ফেলে। লোকটা আনমনে বাঁশি বাজিয়ে চলে। আর তার হাবভাব এতটাই উদাস উদাস—কারও দিকেই সে গুরুত্ব দিয়ে তাকায় না। এতেও লোকটার প্রতি কেউ কেউ বাড়তি আকর্ষণ বোধ করে। কারও কারও হয়তো মনে হয়, দূর এত দেখি নয়া পাগল!
আমি কিছু ওষুধ বিক্রি করব
লোকটা হয়তো মানুষের ধৈর্য্য সম্পর্কে কিছুটা অবগত। তারা বেশিক্ষণ একদিকে মনযোগ ধরে রাখতে পারে না, যদি না তাদের সামনে নতুন কিছু তুলে ধরা সম্ভব হয়। লোকটা তখন বাঁশি বাজানো থামায়। সে তার ঝোলা থেকে একটা সেভেন আপের বোতল বের করে। সেই বোতল তার এক পাশে রাখে। এবার সে কথা বলতে শুরু করে, ‘ভাইসব। আমি কোনো জাদুকর নই। আপনাদের আমি জাদু দেখাতে আসিনি। কিংবা কোনো বাঁশিঅলাও নই, যে, আপনাদের অনেকক্ষণ বাঁশি বাজিয়ে শোনাবো। আমি স্বপ্নে বিন্দারহাট নামের একটি জায়গা দেখেছি। তারপর খোঁজ নিয়ে এখানে এসেছি। আমি কিছু ওষুধ বিক্রি করব। খুবই অল্প দামে। আমার বিশ্বাস আপনারা যদি বিশ্বাস নিয়ে তা খান বা ব্যবহার করেন, তাহলে উপকার পাবেন।’
লোকটা তার ঝোলা থেকে এবার কিছু ছোট কাঁচের বোতল ও টিনের কৌটা বের করে। সে বলে, ‘আমার এই বোতল ও কৌটার মধ্যে কিছু ওষুধ আছে। যা মানুষের তৈরি হলেও তা শুধু মানুষের বুদ্ধি বা জ্ঞান দিয়ে বানানো নয়। এই ওষুধ বানানোর নিয়মটা স্বপ্নে পাওয়া। এ পর্যন্ত বিশ্বাস নিয়ে যারা আমার ওষুধ কিনেছেন ও খেয়েছেন, কেউ এসে বলেননি তাদের অসুখ কমেনি।’
সে বলতে থাকে, সে এই এলাকার মানুষের সঙ্গে কোনো প্রতারণা করতে পারে না। এই বিন্দারহাট এলাকার সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক আছে। তার কোনো এক পূর্বপুরুষ এই বিন্দারহাট এলাকা থেকে কাজের সন্ধানে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। এরপর তিনি দূর এক শহরে আস্তানা গাড়েন। আর কখনো বিন্দারহাট এলাকায় ফিরে আসেননি। সে সেই পুরুষেরই একজন উত্তর প্রজন্ম। এটা তার শেকড়বাকড়ের জায়গা। এখানকার মানুষের সঙ্গে সে কোনো খারাপ আচরণ করতে পারে না। লোকটা হঠাৎ জোরে একটা চিৎকার দিয়ে বলে, ‘আল্লার কসম। আমি যদি মিথ্যা বলি, আমার জিব খসে পড়বে। আমার মুখের আগুন আমাকে পুড়িয়ে মারবে।’
আপনাদের যাদের বিছানায় পেশাব করার অভ্যাস আছে। স্বপ্নদোষ আছে। অনেকে স্ত্রীর কাছে বিছানায় লজ্জিত হন। হাঁপানি। কোমরে ব্যাথা। পিঠে ব্যথা। খাবারে অরুচি। কতরকমের অসুখ। অনেক ডাক্তার-কবিরাজের কাছে গেছেন। ওষুধ খেয়েছেন। কোনো সমাধান হয়নি। আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি। তাদের আলাদা আলাদা করে ওষুধ খাবার দরকার নেই। আমার একটা বোতল নেবেন। আমি যেসব অসুখ-বিসুখের কথা বললাম। ইনশাল্লাহ, তা ভালো হবেই।
বিন্দারহাটে বাজার করতে আসা মানুষ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। লোকটা যেসব অসুখ-বিসুখের কথা বলছে, ভিড়ের অনেকেই তো এই রকম নানা সমস্যায় ভুগছেন। অনেকে ঠিকই তো চিকিৎসকের কাছ থেকে ওষুধপত্তর, কবিরাজের কাছ থেকে জরিবড়ি এনে খেয়েছেন। এতে কারও হয়তো কিছু লাভ হয়েছে, কারও কোনো লাভ হয়নি। কিন্তু এখন লোকটা যেভাবে কথা বলছে, তাতে তাকে অবিশ্বাস করারও কোনো কারণ তারা দেখে না। আর লোকটাকে কেউ চিনতে না পারলেও, বা তার পূর্বপুরুষটা কে—সে সম্পর্কে কোনো ধারণা না পেলেও তারা ধরেই নেয়, লোকটা তাদেরই কোনো নিকটজন। হতেও তো পারে, কেউ একজন এলাকা ছেড়ে চলে গিয়েছিল। কতজনই তো যাচ্ছে। এদের অনেকেই হয়তো ফিরে আসছে। সেই লোকটা ফিরে আসেনি। এমনও হতে পারে, তার কেউ আর এলাকায় ছিল না। তাই সে আর আসেনি। লোকটা যখন নিজে থেকেই এমন পরিচয় দিচ্ছে, সে তো আর আপন মানুষদের ধোঁকা দিতে পারে না।
লোকটা এবার বলে, ‘আছেন কেউ ওষুধ নিতে চান। আমি বেশিক্ষণ থাকবো না। আমাকে ফিরতে হবে। পরে আপনারা পস্তালেও আর আমাকে পাবেন না। আমার একবোতল ওষুধের দাম ফার্মেসিতে বা দোকানে পঞ্চাশ টাকা। আমি শুধু বিন্দারহাটের নাম শুনেছিলাম। কিন্তু স্বপ্নে বিন্দারহাট দেখে এসেছি বলে আজ অর্ধেক দামে ওষুধ বিক্রি করবো। নিবেন, পচিশ টাকা… পচিশ টাকা… পচিশ টাকা…।’
হঠাৎ করেই আবার একদিন চলে আসবো
এতক্ষণ যারা একটু দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিল, তারা দেখল দুদিক দিয়ে সুবিধা। এক ওষুধে যেহেতু অনেক রোগ সেরে যায়, তাই কে কোন রোগের জন্য নিচ্ছে তা কেউ টের পাবে না। আবার আরেকদিকে অর্ধেক দামে ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে। লোকটা বাজারে এসেছে বলেই কিনা এমন কম দাম। পরে কিনলে তো সেই পঞ্চাশ টাকা দিয়েই কিনতে হবে। অনেক জিনিস দরদাম করে কেনা যায়। কিন্তু ওষুধের দাম তো কমানো যায় না। দেখা গেল, লোকটা বৃত্তের লোকদের মধ্যে একটা চক্কর দিতে না দিতেই সবকটি বোতল শেষ হয়ে গেছে। লোকটা ঝোলার মধ্যে টাকাটা রাখতে রাখতে বলে, ‘যারা কিনতে পারেননি। তারা অপেক্ষা করুন। হঠাৎ করেই আবার একদিন চলে আসবো।’
তবে ভিড়ের মধ্যে দুনোমুনো করা, বা লোকটার কথার মারপ্যাঁচকে অবিশ্বাস করার লোকজনেরও কমতি নেই। অনেকে ইচ্ছা করেই ওষুধ কেনেনি। হালিম মিয়া পাশে দাঁড়ানো ফজল আলিকে লক্ষ করে বলে, ‘এই একটা জীবনে কত মানুষই না দেখলাম। কতজনই তো এমন বাড়ানো কথা বলে। মিথ্যারে সত্য বানায়। মানুষরে ধোঁকা দেয়। তাদের কাজ হয়ে গেলে আর তাদের টিঁকিটারও খোঁজ পাই না। মানুষটারে কও পলিটিক্সে নামতে। খুব উন্নতি করবো। এমনকি মন্ত্রী-এমপিও অইতে পারবো। বানাই-বানাই কথা বলে মানুষরে ভালাই ঠকাইতে পারবো।’
অনেকের কানেই হালিম মিয়ার কথাটা ঢোকে। লোকটাও শুনলে শুনতে পারে। কিন্তু কেউ এ নিয়ে কোনো কথা বলে না। লোকটাও না শোনার ভান করে। তার দরকার ওষুধ বেচার, কে কী বলল—সেটা শুনে তার দরকার কী! বিন্দারহাট তখন পুরো জমে উঠেছে। হাটবার বলেই কি না, চারপাশের মানুষ যেন হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। কিলবিল করছে লোকজনে। আর সেই লোকজনের মাথার ওপর কেরোসিনের বোমার আলোর ওপর হাজার হাজার পোকা উড়ছে। আগুনের শিখার মধ্যে পড়ে পুড়ে ছারখার হচ্ছে।
এখন বলছে তার নাম মজিদ ম্যাজিশিয়ান
লোকটা এবার তার পুরোনো খেলায় ফিরে যায়। সে বলে, ‘ভাইসব, আমি মজিদ আলি, কেউ বলে মজিদ কবিরাজ, কেউ বলে মজিদ ম্যাজিশিয়ান।’ বিন্দারহাটের মানুষ এই প্রথম জানল, লোকটার নাম মজিদ আলি, মজিদ কবিরাজ বা ম্যাজিশিয়ান। তারা তখন মজিদের দিকে চোখ বড় করে তাকিয়ে থাকে। এবার মজিদ আলি তার পায়ের কাছে থাকা সেভেন আপের বোতলটা হাতে তুলে নেয় এবং পানি খাওয়ার মতো সেই বোতল থেকে তরল কিছু মুখে ঢালে। এরপরই সে মুখের ভেতর থেকে সেই তরল কিছু কুয়াশার মতো শূন্যে ছোড়ে। আর তখনই মানুষ চোখের পাতা না পেলে দেখতে পায়, মজিদ আলির মুখের সামনে লকলক করে আগুনের শিখা পোড়ে। লোকটার এই কেরামতি মানুষকে পুনরায় বিস্মিত করে। আর কারও কারও মধ্যে নতুন করে প্রশ্নের জন্ম দেয়। হালিম মিয়াই এক্ষেত্রে কথা বলছে (সম্ভবত সবখানে হালিম মিয়ার মতো দুই-একজন থাকে। যারা সবকিছুতেই কিছু মন্তব্য করে, সেটা ঘটনার পক্ষে যাক—কিংবা বিপক্ষে যাক)। সেই বলে, ‘বলি নাই, লোকটা হচ্ছে আস্ত ফটকা। ধড়িবাজ। ম্যাজিক দেখানো লোক। এই যে ওষুধ কিনছো। বাড়িতে যাইয়া দেখো বোতল না মাটির পুটলা! দেখছো, কইছিলাম না তারে পলিটিক্স করতে কইতে। এই তো একটু আগে কইলো সে জাদু দেখাতে আসে নাই। এখন বলছে তার নাম মজিদ ম্যাজিশিয়ান। কেমন মিনিটের মধ্যে কথাটা বদলাই ফেললো। দেখো, নয়া করে আবার বউয়ের কছে লজ্জায় পড়ো কি না!’
কথাটা মজিদ আলির কানেও যায়। কিন্তু সে এ সব কথার মধ্যে জড়াতে চায় না। সে তার আগুন জ্বালানোর খেলার ভেতর লোকজনকে আটকে রাখতে চাইছে। একটা রহস্যের জাল ছড়িয়ে চলছে মাকড়শার মতো। অনেকেই কেনাকাটার কথা ভুলে গিয়ে কড়ই গাছের নিচে, মজিদ আলিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকে। মজিদ আলিও তাই চাইছে, লোকজন যদি তার কাছ থেকে একবার ছুটে যায়। তাহলে তাদের আবার ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে। হয়তো তার মতো নতুন কোনো মজিদ আলির নতুন কোনো চমকের কাছে গিয়ে আটকে যাবে। মজিদ আলি বলে, ‘আমি জানি, আপনাদের মধ্যে অনেক আছেন। যারা আগে ওষুধের বোতল কিনতে পারেননি। কিন্তু না কেনা দলের জন্য একটা সুখবর আছে। আর সেটা হলো, আমার হাতে এই যে কৌটা দেখছেন (সে হাতের আঙুলে ধরে লাল রঙের কৌটাটি সবাইকে দেখায়)। এই কৌটার শক্তিও বোতলের ওষুধের চেয়ে কম না। পার্থক্য হলো, আগেরটা খাইতে হবে। আর কৌটার মলম লাগাতে হবে।… আল্লার কসম, চ্যালেঞ্জ দিয়া বলতে পারি, আপনি এই মলম ব্যবহার করে অবশ্যই, অবশ্যই সুফল পাবেন।’…
লোকটা এবার বলে, কৌটাটির গায়ে লেখা দাম হচ্ছে বিশ টাকা। কিন্তু বিন্দারহাটে যেহেতু সে স্বপ্ন দেখে এসেছে, তাই আজ কৌটা সে মাত্র দশ টাকাতেই বিক্রি করবে। তার এই মূল্য বলাটা জাদুর মতো কাজ করে। দেখা গেল, ভিড়ের লোকজন যারা আগে বোতল কেনেনি। তারা টপাটপ শার্ট, পাঞ্জাবি, লুঙ্গি বা পেন্টের পকেটে হাত ঢোকাচ্ছে। আর লোকটা দশ টাকা, দশ টাকা বলতে বলতে ঝোলা থেকে কৌটা বের করে দিচ্ছে, আর মানুষের হাত থেকে চিলের মতো ছোঁ মেরে দশ টাকা নিয়ে ঝুলাতে ভরে রাখছে। দেখতে দেখতে কৌটাও শেষ হয়ে যায়। কৌটা বিক্রি শেষ হলে সে তার জিনিসপত্তর গোছগাছ করতে থাকে। কিন্তু জিনিসপত্তর গোছগাছ করলেও সে চলে যায় না।
সে সবাইকে লক্ষ করে বলে, ‘আমি মজিদ আলি এক জায়গায় দু’বার যাই না। তাই আপনারা ইচ্ছা করলে আগুন জ্বালানোর ম্যাজিকটা শিখে রাখতে পারেন। তবে সাবধান। যদি সঠিকভাবে আগুন জ্বালাতে না পারেন, তাহলে নিজেই জ্বলেপুড়ে শেষ হয়ে যাবেন।’
আর তাতে কোনো টাকাপয়সাও লাগছে না
মজিদ আলি সেভেনআপের বোতল থেকে মুখে তরল জিনিসটি ভরে নেয়। এরপর সে আগের মতোই ওপরে ছোড়ে, আর তাতেই ফসফস করে আগুন জ্বলে ওঠে। লোকজন নিবিড়ভাবে লক্ষ করে কী করে সে আগুন ধরায়, না কি তার মুখ থেকেই আগুন বের হয়। সে বলে, ‘এটা এমনকিছু কঠিন কাজ না। একটু যদি লক্ষ করেন, তাইলেই আপনেরা বুঝতে পারবেন। আমি সাধারণত কাউকে এই খেলার আসল কেরামতিটা দেখাই না। আপনাদের বলি নাই, এই বিন্দারহাটের সঙ্গে আমার নাড়ির সম্পর্ক আছে! নিজের মানুষকে এক-দুটা মজার খেলা শিখাতে তো পারিই। এজন্যেই এ খেলাটা শেখানোর চেষ্টা। আর তাতে কোনো টাকাপয়সাও লাগছে না।’
বেশ কবার আগুন জ্বালানোর কায়দাটা সে দেখালো, কিন্তু আসল রহস্যটা কারও পক্ষেই স্পষ্ট করে জানা হলো না। তা না হোক—বিন্দারহাটে তখন উৎসাহী লোকদের মধ্যে মুখ থেকে আগুন জ্বালানোর কায়দা শেখার মানুষের সংখ্যা অনেক। মানুষের ব্যস্ততার কোনো এক ফাঁকে মজিদ আলিও তার ভাড়া করা অটোরিকশা করে বিন্দারহাট ছেড়ে উধাও হয়ে গেছে। বাজার তখনও জমজমাট। কিন্তু অনেকেরেই চোখে পড়ে—বাজারের এখানে-সেখানে আগুনের শিখা হঠাৎ ঝলসে উঠছে। যারা কড়ই গাছের নিচে আসেনি, বা এখানে কী হয়েছে, সে সম্পর্কে কিছুই জানে না, তারা বুঝতে পারে না—বাজারের মধ্যে এখন কী ঘটছে। কিন্তু যখন বিন্দারহাট গ্রামের মনসুর উদ্দিন বাজার থেকে ম্যাংগো জুসের একটি খালি বোতলে কেরোসিন কিনে মুখে পুরে, সেই কেরোসিনে গ্যাস লাইটার থেকে আগুন ধরানোর চেষ্টা করে। মুখ থেকে বেরিয়ে যাওয়া উড়ন্ত কেরোসিন তার গায়ে এসে পড়ে। আর কোনোকিছু বোঝার আগেই তার গায়ের শার্টে আগুন ধরে যায়, সে শরীর থেকে ঝটপট শার্টের বোতাম ছিঁড়ে খুলে এবং তা দূরে ছুঁড়ে ফেলে। শার্টটি মাটিতে পড়ে পুড়তে থাকে। আগুনে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানের চামড়া তেতে যায়, পুড়ে যায়। সে পোড়া শরীর নিয়ে ছটফট করে। কে একজন বাজারের টিউবওয়েল থেকে ঠাণ্ডা পানি এনে তার পোড়া অংশে ঢালতে থাকে। এতে তার বেশ আরামবোধ হয়। এরই মধ্যে তাকে ঘিরে ধরেছে পুরো বাজারের মানুষ। বিন্দারহাট এত বড় বাজার নয় যে, একটি প্রান্ত থেকে চিৎকার দিলে অন্য প্রান্তের মানুষ শুনতে পারবে না।
মনসুর উদ্দিনের শরীরের শার্টে যখন আগুন ধরে যায়, সে কত জোরে চিৎকার দিয়েছে, তা নিজেও জানে না। বিপদে পড়ে ও বাঁচার আকুতিতে তার চিৎকার এত প্রচণ্ড ছিল যে, বাজারের হইচই ছাপিয়ে সেই চিৎকারটি সকলের কানে আচড়ে পড়েছে। যে যেদিকে ছিল—তার শার্টপোড়া আগুনের কাছে ছুটে এসে দেখে মনসুর উদ্দিন মাটিতে বসে ছটফট করছে। আর তখনই যারা কড়ই গাছের নিচে যায়নি, তারা জানতে পারে এতক্ষণ তারা বাজারের নানা স্থানে যে আগুন উড়তে দেখেছিল, সেটা আসলে সেই ওষুধ বিক্রেতা বা ক্যানভাসার, অথবা বাজিকরের শেখানো আগুনের খেলা ছিল। মনসুর উদ্দিন সে রকম আগুন জ্বালানোর চর্চা করতে গিয়েই এমন বিপদে পড়েছে। তখন সবাই এটাও জানতে পারে যে, লোকটার কাছ থেকে অনেকেই বিভিন্ন রোগের জন্য ওষুধের বোতল বা কৌটা কিনেছে।
এখানেও হালিম মিয়ার গলা শোনা যায় সবার আগে, ‘কোনোকিছু বোঝার আগেই ফালাফালি। এটা একটা শিখার বিষয় অইল? একদিনে সবাই জাদুকর অইবো। ভালোমন্দ যাচাইবাছাই নাই। আগুন দেখলা আর পোকার মতো পাগল হয়ে ঝাঁপ দিলা। একটা কথা অইল!’
তার কথার সঙ্গে আরও অনেকেই গলা মেলালো। অনেকেই মনসুর উদ্দিনকে দোষারূপ করলো, যারা মজিদ আলির কাছ থেকে ওষুধ কিনেছে—তারাও আছে দোষারোপ করার দলে। মনসুর উদ্দিনের শরীরের বিভিন্ন জায়গা আগুনে তেতে গেছে। ঘটনাটা দ্রুত বিন্দারহাট ছাড়িয়ে আশপাশের গ্রামেও ততক্ষণে পৌঁছেছে। মনসুর উদ্দিনের বাড়ির লোকজন হাটে ছুটে এসেছে। রাত বলে বউ আসতে পারেনি। কিন্তু সেও বাড়িতে ঢোকার মুখে রাস্তায় কূপি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সে যাকে দেখছে তাকেই বলছে, ‘মানুষটার কী অইছে! দেখছেন! ভালা আছে তো!’…
এমনিতে কাজের বেলা ঢেড়শ
যারা দেখে এসেছে, তারা তাকে আশ্বস্ত করছে এই বলে, ‘তেমন কিছু অয় নাই। কিন্তু একটা বড় ফাড়া গেছে। সারা শরীর পুড়ে যাইতে পারতো।’ ময়মুনা বেগম ক্ষতিটা সামান্য হওয়ায় ভয়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে এখন ক্ষোভে পুড়ছে।—‘তাইন জাদুকর হবেন। মুরদ দেখানোর আর জায়গা পান নাই। এমনিতে কাজের বেলা ঢেড়শ।’
পাশেই দাঁড়ানো ময়মুনা বেগমের ভাসুরের বউ সফিনা খাতুন খিলখিল করে হাসে, ‘আর ঢেড়শ থাকবো নাগো। শুনছি বিন্দারহাটের সব মরদমানুষ বুলে এবার জোয়ানকি দেখাইতে ওষুধের বোতল কিনছে। এবার মেয়েমানুষগুলার খবর আছে!’ সফিনা খাতুনের হাসি যেন আর থামতে চাইছে না। রাতের নির্জনতা তাতে খানখান হয়ে ভেঙে পড়ে।
বেশ কয়েকজনের সঙ্গে বাড়ি ফিরে মনসুর উদ্দিন। আগুন জ্বালানোর ঘটনায় সে বেশ আলোচিত হয়ে গেছে এরই মধ্যে। ময়মুনা বেগম কূপি উচিয়ে একদৌঁড়ে তার কাছে ছুটে আসে। মনুসর উদ্দিনের খালি গা, কাঁধের ওপর আধপোড়া শার্টটা ঝুলে আছে। সফিনা খাতুন বলে, ‘আর ডর নাইরে জাল। তর জাদুকর আইছে। এখন আগুনের খেলা দেখাইবো।’
ময়মুনা বেগম দেখে, মনসুর উদ্দিনের হাতের মুঠোয় তখনও ধরা রয়েছে ওষুধের কৌটা। শুধু মনসুর উদ্দিনের হাতের মুঠোতেই নয়। তার সঙ্গে যারা আছে, তাদের অনেকের হাতেই হয় ওষুধের কৌটা, নয় ওষুধের বোতল। যেন তাদের হাতের মুঠোতে এখন তাদের প্রাণভোমরা। মুঠো একটু দুর্বল হলে বা ঢিলা হলে হাতের মুঠো থেকে ভোমরাটি বেরিয়ে যাবে। কূপির আলোয় সবার মুখের দিকে চোখ ফেলে সফিনা খাতুন। যেন নতুন কোনো সাফল্যে তাদের রোদে তাতানো ও রোদপোড়া মুখগুলো কেমন ঝলঝল করছে। মুখে আঁচল চেপে আবারও খিলখিল করে হাসতে থাকে সফিনা খাতুন। তার হাসি ছড়িয়ে পড়ে রাতের বুকে। আর হাসির মধ্যে বিন্দারহাটের উপস্থিত পুরুষগুলোকে কেমন বোকা বোকা লাগে।