এক.
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের লালনমঞ্চে এক সাধুকে প্রায়ই একাকী বসে হুঁকোয় দম দিতে দেখা যায়। একদিন খুব আগ্রহ ভরে তার সঙ্গে কথা বলতে গেলাম। কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই সে আমাকে পাশে বসতে ইশারা করলো। আমি বেশ খুশি মনে বসে পড়লাম। বহুক্ষণ সে কোন কথা বললো না, আর আমিও বহুক্ষণ তার অন্তর্মুখিতায় ব্যাঘাত ঘটালাম না।
একসময় তার জমাট আর পেশল ভাবনা খানিকটা শিথিল হয়েছে টের পেয়ে বলে উঠলাম, এদিক দিয়ে নিয়মিত আসা-যাওয়া করি। আপনাকে প্রায়ই দেখি, ভালো লাগে আমার।
বৃদ্ধ বলে, সব মানুষের না হলেও প্রায় মানুষেরই আয়না দেখতে ভালো লাগে। কেউ যত কুৎসিতই হোক, আয়নার সামনে নিজ চেহারার একটা বিশেষত্ব তার কাছে ধরা পড়বেই। তখন সে তাকে ফিরে ফিরে দেখবে।
এই বলে সাধু থামলো। আর আমিও তার এমন হেঁয়ালিতে যেন খানিকটা পুলকিত হলাম। বুঝি এমন কিছুই শুনতে চেয়েছিলাম।
তার বাড়ি কোথায়—বলতে চাইলো না। কবে ঘর ছেড়েছে, সে কথাও না। পরিবারের কথা উহ্য রাখলো। বললো, আমি যখন কথার ভাণ্ড শূন্য রাখি, আপনি তখন সেই শূ্ন্য ভাণ্ড নিজেই এসে পূর্ণ করেন। যখন, নাম কী তা বললাম না, ধাম কোথায় বললাম না—আপনার মনে একটা রহস্য যেন তৈরি হলো। আপনি একটা নাম খুঁজলেন, লাগসই একটা নাম। আপনি একটা ধাম কল্পনা করে নিলেন, মানানসই এক ধাম, আধা অন্ধকার, আধা আলো; আধা চাঁদে জাগা আধা কালো। মন এতে করে একটা কাজ পেলো। কেজো মন ভালো। আমি যদি সব বলি, মনটা কাজ পাবে না। নিষ্কর্ম মন অবিদ্যায় আক্রান্ত হয়। অবিদ্যা ভালো না।
কেবল গুরুর প্রশ্নে তুলনামূলক সরল এক উত্তর মিললো। বললো, আমার গুরু মরুৎ সাঁই। আমি হাওয়ায় হাওয়ায় খবর পাই। হঠাৎ স্বর নামিয়ে ধীর একটা প্রশ্ন করলো। শুনে আমি চমকে উঠি।
গীতা নামের মেয়েটাকে আপনি ঠিক কতটা ভালোবাসেন, বলতে পারবেন? কাছাকাছি কোনো উত্তর? আছে? কোনো উত্তর?
খুব তুচ্ছ কারণে একদিন আপনাদের
সম্পর্কটা ভেঙে যাবে
সাধুকে যতবার দেখেছি আমি, তার ভেতর সিংহভাগ সময়ই আমার সঙ্গে গীতা ছিল বটে। কিন্তু এমন প্রশ্ন আমি একেবারেই আশা করিনি। এছাড়া, গীতার নামই বা জানলো কী করে এই লোক? গীতা কি গোপনে এর কাছে এসে থাকবে? কোথায় কোনো রহস্য খেলা করছে, আর যথাসময়ে তার জটও খুলবে, এই ভেবে আমি তার প্রশ্নের উত্তর দিলাম—আমার প্রাণকে যেমন!
বুড়ো বলে, দারুণ বলেছেন। কোনো অত্যুক্তি করেননি। বলেননি প্রাণের চেয়ে বেশি। বলেছেন প্রাণের মতো। বেশ বেশ।
আমি চুপ করে থাকলাম। মনে হলো যেন সাধুর কথা ঠিক ফুরোয়নি। শিগগিরই সে রেশ টানবে আরও। হুঁকোয় পর পর দুটো বড় টান দিয়ে একরাশ নীল ধোঁয়া ছাড়লো বৃদ্ধ। এরপর গম্ভীর গলায় বললো, আপনাদের আমি অনেকদিন হলো লক্ষ করছি, ঠিক আমাকে যেমন আপনি। কী মনে হয়েছে জানেন? মনে হয়েছে, আপনাদের প্রেমটা বড় প্রেম। ভালো। এমন আর দেখা যায় না।
শুনে গোপনে আমি পুলকিত হলাম, কারণ মনের গভীরে আমিও তাই জানি। আমার পুলকটা অবশ্য প্রকাশ পেতে দিতে চাইনি। কারণ বৃদ্ধের দিক থেকে রহস্যের জট ছাড়ানোর কোনো টান ছিল না বিধায় আমি অজানা কোনো প্রতিযোগিতায় যেন জিততে চাইছিলাম। কিন্তু আমার মৃদু দন্তবিকাশ ঠেকাতে পারলাম না।
বৃদ্ধ বললো, যে সম্পর্ক যত বড়, তা ভাঙার কারণ হয় ততই তুচ্ছ। খুব তুচ্ছ কারণে একদিন আপনাদের সম্পর্কটা ভেঙে যাবে।
বুড়োর কথা শুনে তখনই রাগে আমার মাথা ঝিমিয়ে উঠলো। ইচ্ছে হলো হুঁকোটা কেড়ে নিয়ে ধাঁ করে তার পাকা দীর্ঘ চুলে ভরা মাথাটার ওপর নিখুঁত বসিয়ে দেই। মুণ্ডুটা ফাঁক হয়ে যাক। বহুকষ্টে নিজেকে শান্ত রেখে বলি, আপনাকে জ্ঞানী লোক ভেবেছিলাম। এখন দেখছি একেবারে যাচ্ছেতাই আপনার বুদ্ধি, আপনার জ্ঞান।
বৃদ্ধ আমাকে ফেটে পড়তে দেখে হো হো করে হেসে উঠে কণ্ঠের সংযম হারিয়ে নিজেও একরকম চড়া গলায় বলে উঠলো, আমিও, আমিও ঠিক এমন করেই বলে উঠেছিলাম!
এরপর আবার উদ্যানের সব গাছ কাঁপিয়ে যেন হাসতে থাকলো। আমি দ্রুত সরে এলাম। ঘৃণায় মুখটা তেতো হয়ে থাকলো পরবর্তী অনেকটা সময়। কিছুতেই রাগ পড়লো না।
দুই.
দুই বছর কেটে গেলো।
বুড়োর সঙ্গে সেই উদ্ভট কথোপকথনের প্রায় একবছরের মাথায় গীতার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা সত্যিই ভেঙে গিয়েছিল। এতই তুচ্ছ কারণে আমরা পরস্পরকে কথায় রক্তাক্ত করার খেলায় মেতে উঠেছিলাম যে, কারও কাছে তা বলার কথা ভাবতেও চমকে উঠতে হয়।
কাঁটা—সামান্য একটা চুলের কাঁটা নিয়ে আমাদের বচসার শুরু। টুকটুকে লাল সেই কাঁটাটা আমিই একদিন তাকে উপহার দিয়েছিলাম।
গীতার সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর দীর্ঘ সময় আমি বিপর্যস্ত আর অপরাধী হয়ে ছিলাম। পরবর্তী একবছরে আর একটিবারও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঘাস আমি মাড়াইনি। ওখানে যে অনেক স্মৃতি আমাদের!
আমি হচ্ছি গিয়ে তুমি
একদিন কী মনে হতেই আবার উদ্যানে ঢুকে পড়লাম। দূর থেকে দেখতে পেলাম লালনমঞ্চে সেই সাধু একই ভঙ্গিতে বসে হুঁকোয় দম দিয়ে যাচ্ছে। আমি ধীর পায়ে কাছে এগিয়ে গেলাম। বুড়ো আমাকে চিনতে পারলো। তামাকসেবীদের স্মৃতিশক্তি নাকি শেষ বয়েসেও অটুট থাকে, শুনেছি, সত্যমিথ্যা জানি না। উপরন্তু সে আবার সাধু। সাধুরা অক্ষয়স্মৃতির অধিকারী হয়। আমি তার কাছে গিয়ে পাশে বসে পড়লাম চুপচাপ। আমার কেবলই মনে হতে থাকলো, এ লোকটার ওপর আমার সাংঘাতিক রাগ করা উচিত, কিন্তু তারপরও কেন-যেন আমি তার ওপর রাগটা করে উঠতে পারি না। একবার মনে হয়, বুড়োই আমার আজকের এমন পরিণতির জন্য দায়ী। পরমুহূর্তে মনে হয়—কে জানে, সে হয়তো আমাকে সাবধান করতে চেয়েছিল!
নাও। তাহলে তামাক খাও—তার কথার জলছিটেয় আমার ঘোর কাটলো। আমি তার হাত থেকে হুঁকোটা নিয়ে নিলাম। সে বাধা দিলো না। তার মতো গুড়ুক করে টান দিতে গিয়ে কাশতে কাশতে চোখে অন্ধকার দেখলাম। মুহূর্তে গাল বেয়ে চোখের জল গড়াতে থাকলো।
হঠাৎ আমার মনে একটি প্রশ্ন ফেনিয়ে উঠলো। আমার জানা দরকার, সত্যিই কে এই লোক। বলেছিল, মানুষ নাকি তার আয়না দেখতে ভালোবাসে। সে কি আমার আয়না? কিন্তু এটা কেমন কথা হলো?
বৃদ্ধের মনের কান খুব পরিষ্কার। আমার প্রশ্নটি বোধয় সে শুনতে পেলো। বললো, আমি হচ্ছি গিয়ে তুমি। বিশ্বাস করা না-করা তোমার ব্যাপার। সেই প্রথম দিনই তোমাকে অন্যভাবে কথাটা বলেছিলাম।
অজান্তেই সাধুর হুঁকোয় পর পর দু’বার টান দিয়ে টের পেলাম, আমার ভেতর কী যেন বদলে গেছে। কাশির সেই দমকটা আর এলো না। যেন বহুদিন ধরেই এভাবে তামাক টানা আমার অভ্যাস। চারপাশে তাকিয়ে সাধুকে কোথাও আর দেখা গেলো না। মনে হলো, এটাই তো স্বাভাবিক।