যেহেতু আজ বৃষ্টি হয়নি আর অফিস থেকে বেরুতেও দেরি হয়েছে, তাই অনেকটা হালকা চালেই ওঠা সম্ভব হয়েছে বন্ধু পরিবহনে। শাহজাদপুর বাস স্ট্যান্ডের টং দোকান থেকে প্রাণ ডাল ভাজার প্যাকেট কিনে নিয়ে অনেকটা আয়েশি ভঙ্গিতেই বাসে ওঠা গেলো। যদিও বাসের ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকার ভাগ্য বদলে দেওয়ার মতো বড় কোনো অঘটন শহরটাতে ঘটেনি বলে দাঁড়িয়েই থাকতে হলো। তবু যেহেতু বৃষ্টি হয়নি আর ভদ্রস্থ অফিসগুলো আগেই ছুটি হয়ে গেছে,তাই এখন পর্যন্ত কেউ পা মাড়িয়ে দেয়নি। এমনকি ভিড়টা এতটাই সহনীয় যে, আমি ডালভাজার প্যাকেটটা খুলে খাওয়া শুরু করার আশায় একটু পরপর নেড়েচেড়ে দেখছি। মাঝে মাঝে তাকিয়ে দেখছি চারপাশ। সবকিছুকেই ধীর ও মাধুর্যমণ্ডিত মনে হচ্ছে। এই মনে হওয়া অবশ্য বন্ধু পরিবহনের থেমে থাকার কারণেও হতে পারে। শাহজাদপুর থেকে ওঠার পর এটি বেশিদূর এগোয়নি। বাসের ড্রাইভার জানালা দিয়ে মুখ বের করে উদাস মনে বসে আছে। কন্ডাক্টর যাত্রী ডাকতে ডাকতে বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আনমনা হয়ে। মাঝে মাঝে বাসের দিকে একটা মমতা মাখানো দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে, আর তখনই একবার দু’বার করে যাত্রী ডাকছে,এই গুলিস্তান, গুলিস্তান বলে। অন্য সময় হলে গুলিস্তানের সঙ্গে পল্টন, কাকরাইল, মালিবাগ, মৌচাকের মতো আরও কিছু সঙ্গী-সাথী জুটে যেতো। কিন্তু আজ তার কিছুতেই যেন মন নেই। বাস স্ট্যান্ড থেকে দশগজ তফাতে যে ভিক্ষুক বসে থাকে একটা বেমানান গাম্ভীর্য নিয়ে প্রতিদিন, তাকেও এমনকি পেছন ফিরলে দেখা যায় এখনো। অর্থাৎ বাস একদমই এগোয়নি বলা যায়। কিন্তু এ নিয়ে যাত্রীদেরও কোনো ভাবন্তর দেখা যাচ্ছে না। সাধারণত এ রকম ক্ষেত্রে বাসের যাত্রীরা একে একে তাদের ক্ষোভ ঝাড়তে শুরু করে। কিন্তু আজ কেউ কিছু বলছে না। একজন মাঝবয়সী যাত্রী, যার শ্যাওলাধরা চুলের নিচে টাক দেখা যাচ্ছে, আর চোখদুটো সন্দেহে স্থির, সে-ই কেবল নিয়মরক্ষার জন্য মাঝে মাঝে ড্রইভারকে একটু আধটু তাগাদা দিচ্ছে। ড্রাইভারও নিয়মরক্ষা করেই তাতে কান দিচ্ছে না। কেবল প্রতিবার বলার পর সে মুখ ঘুরিয়ে তার বাম পাশের মহিলা আসনে বসে থাকা দশাশই লোকটার দিকে একবার করে আড়চোখে তাকাচ্ছে। ভাবটা এমন যেন সে লোক যদি বলে তবেই সে বাস ছোটাবে। কিন্তু সেই দশাশই লোকটা,যাকে লোক না বলে যুবক বললেই মানায় ভালো, যার কপালের তিনটি সেলাই তার সদ্য বিগত সংঘাত ও ক্ষমতার সমীকরণে নিজের অংশীদারিত্বের প্রমাণ বহন করছে একসঙ্গে,এমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে নির্লিপ্ত হয়ে আছে যে, তার গায়ে হাত বুলিয়ে কুশল জিজ্ঞাসার ইচ্ছা জাগে।
এভাবে দাঁড়িয়ে ছিল বন্ধু পরিবহন, শাহজাদপুর বাস স্ট্যান্ড থেকে একটু এগিয়ে ফেলে আসা ঠিকানার পিছুটান নিয়ে। পাশ দিয়ে হঠাৎ হঠাৎ কোনো মানুষ গেলেও তারা কেউ যাত্রী নয়। একটা বিড়াল তার জন্মসূত্রে পাওয়া জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে ছিল আমারই দিকে জানলার ওপাশ থেকে। চারপাশের পরিবেশের এসব জমাট সংক্রমণে অথবা নিজেরই গহীনে গোপন আকাঙ্ক্ষায় আমারও ইচ্ছে করছে নেমে গিয়ে সেই অহেতুক বিড়ালটাকে তুলে আনি। তুলে এনে তাকে একটু আগে কেনা ডালভাজা খেতে দেই।
এসব যখন ভাবছি, তখন একটু দুলুনিতে টের পেলাম কেউ উঠেছে বাসটায়। তাকিয়ে দেখলাম একটু মোটা-খাটো এক তরুণ। উঠেই ড্রাইভারকে তাগাদা দিয়ে বললো, ‘ওই মিয়া এক জায়গায় আর কতক্ষণ দাঁড়াইবা? রাইত কত হইছে খবর আছে? বাড়াও বাড়াও, সামনে থেইকা তুইলো।’ এ কথায় সবাই সেই নিথর সংক্রমিত ধ্যান ভেঙে তার দিকে তাকালো। ড্রইভার জানলা দিয়ে মাথা বের করে চিৎকার দিয়ে বললো, ‘ওই কোবাদ, কো-বা-দ, বাইঞ্চোত ডাকস না কেন? গলাত কি ব্যাঙ ঢুকছেনি?’ কোবাদও যেন এই ঝাড়ির অপেক্ষাতেই ছিল। পূর্ণ উৎসাহ নিয়ে এবার ফাঁকা রাস্তায় কল্পিত যাত্রীদের উদ্দেশে ডাকতে থাকে, এই গুলিস্তান, পল্টন, কাকরাইল, মৌচাক…। এবারে একে একে যাত্রীরা সচেতন হয়ে ওঠে যেন। তারা নানাজন নানাদিক থেকে কথা বলতে শুরু করে। একটু আগের নির্জনতা একটা রূপকথা হয়ে যায় মুহূর্তেই। কেউ বলে, ‘এই হারামজাদাগো খাই খাই আর গেলো না।’ কেউ প্রায় গাড়িশূন্য রাস্তা দেখেও বলে, ‘গাড়ি ছাড়বি না কি নাইম্যা যামু?’ কেউ গালি দেয়, কেউ ফোড়ন কাটে। এসব দেখে-শুনে ড্রাইভার কোবাদকে আবার ডাকে, ‘এই কোবাদ হোন, দুইটা আনবি।’ কোবাদ তার কিছুক্ষণ পরেই দুইটা সিগারেট এনে তার ওস্তাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে খালি রাস্তায় আবারও যাত্রী ডাকতে চলে যায়। এই দেখে সেই মোটা-খাটো তরুণ আগের চাইতে একটু অধৈর্য কিন্তু মোলায়েম গলায় বলে, ‘ওই মামা কারে ডাকেন? লোক কই?’ এই শুনে পেছন থেকে আরেকজন বলে ওঠে, ‘অর কুটুমরে ডাকে বুঝছেন?’ ডান পাশের কোনা থেকে আরেকজন ফোড়ন কাটে, ‘লাগলে ক, আমরাও নাইমা ডাকি।’ এসব চলতেই থাকে। আর ড্রাইভার আরাম করে বসে সিগারেট টানে। তার এই মুহূর্তে কোনো ভাবনা নেই।
সিগারেট টানা শেষ হলে ড্রাইভার গাড়ি চালানো শুরু করে। বাস চলতে শুরু করলেই আবারও আমার ডালভাজার প্যাকেট আর সেই বিড়ালটার কথা মনে পড়ে। আর আমি ইচ্ছে করেই জানলা দিয়ে প্যাকেটটা ফেলে দেই। এটা আমার পক্ষ থেকে বিড়ালটার প্রতি উপহার। যদিও জানি যে,সে কখনোই এটা খুলে খেতে পারবে না। তবু আমি ফেলে দেই। কিন্তু এটা ফেলার সঙ্গে-সঙ্গে আমি যে সিটটার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম, সেই সিটের জানলার ধারের বয়স্ক যাত্রীটা ‘এহ পড়ে গেলো’ বলে চিৎকার দিয়ে ওঠে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাস আবারও থেমে যায়। কিছুক্ষণ পর কন্ডাক্টর উঠে আমার ফেলে দেওয়া প্যাকেটটাই এনে লোকটার হাতে দিতে দিতে বিরক্ত স্বরে বলে, ‘ঠিকমতো ধইরা রাখতে পারেন না?’ লোকটা একটু আড়ষ্ট হয়ে চারদিকে তাকিয়ে ডালভাজার প্যাকেটটা তার ময়লা পাঞ্জাবির পকেটে ঢোকায়। আমি একটা শ্বাস ফেলি কেবল। এই অনাকাঙ্ক্ষিত বিরতির পর আবারও চলতে শুরু করে বন্ধু পরিবহন।
মধ্যবাড্ডায় কয়েকজন নেমে গেলে গোটাকয় সিট খালি হয়। থেকে দূরে দাঁড়ানো যাত্রীরাও কেমন করে যেন সেইসব খালি সিটে বসে পড়তে সমর্থ হয়। কিন্তু আমি পারি না। আমি এখনো বাসের সিট দখলের কৌশল পুরোপুরি আয়ত্ত করে উঠতে পারিনি, কখনো পারব বলেও মনে হয় না। এ নিয়ে একটু ভেবেই আমি যখন জানালা দিয়ে বাইরে আবারও মনোযোগ দিচ্ছি, তখনই পেছন থেকে কে একজন, ‘এই কামরুল, কামরুল..’ বলে ডাকতে থাকে। আমি ডাক শুনতে পাই কিন্তু বুঝতে পারি না। সংশয় মাখানো ডাকটা আমার ভালো লাগে। কিন্তু কিছুক্ষণের ভেতরেই আমি আমার পিঠে একটা হাতের স্পর্শ পাই। আমার এখন মনে পড়েছে, আমিই কামরুল। এবং বাসের ভেতরে কে আমাকে ডাকছে—এই ভাবনায় আমি কিছুটা বিস্মিতও। এ বিস্ময় আমার ভালো লাগতে থাকে। আমি তার দিকে তাকালাম। দেখলাম সেই মোটা-খাটো তরুণ,যে কিনা এই বন্ধু পরিবহনের নিস্তব্ধতা ভেঙেছিল। আমি তার দিকে তাকিয়েই আছি দেখে সে বললো, ‘তুই কামরুল না? আমাকে চিনিস নাই? আমি মিলন। বাড্ডার মিলন। মনে নাই?’ শেষ দিকে মিলনের কণ্ঠে সংশয় বাড়তে থাকে। আমি এবার তাকে নিষ্কৃতি দেওয়ার সীদ্ধান্ত নেই। আমি বলে উঠি, ‘বহুদিন পর তোকে দেখলাম। কী খবর তোর? এত মোটা হইছিস ক্যান?’ মিলন হাসে। আমাকে টেনে তার দখলিকৃত সিটটায় বসিয়ে দিতে চায়। আমি তার দিকে তাকিয়ে বলি, ‘তুই বোস, আমার দাঁড়াতে সমস্যা হচ্ছে না।’ মিলন বলে, ‘কী কস তুই? তিনবাঁক খাইয়া দাঁড়াইয়া আছস, তাও কস সমস্যা নাই। তুই এই বাসে ক্যান? তুই না এই বাসে উঠবি না কইছিলি?’
আমি চুপ করে থাকি। অনুরোধ-উপরোধের ফাঁকে নদীপারের মতোই বেদখল হয়ে যায় মিলনের সিট। তবু মিলন বলে যেতে থাকে ভ্রূক্ষেপহীন। আমি মনে করার চেষ্টা করি, আমি কেন আগে এই বাসে চড়তে চাইতাম না। মিলন আমাকে সাহায্য করে। যে বাসে উঠে ঘাড় বাঁকিয়ে দাঁড়াতে হয়, আমি সে বাসে উঠব না বলে বলেছিলাম আগে। মিলনের সঙ্গে এই নিয়ে নাকি ঝগড়াও করেছিলাম। একদিন নাকি শুধু ঘাড় বাঁকিয়ে দাঁড়াতে হয় বলেই এই বাসকে প্রত্যাখ্যান করে, মিলনকে সঙ্গে নিয়ে হেঁটেই ফিরেছিলাম। হবে হয়তো। এখনো তো সময়ের তাড়া না থাকলে হাঁটি। এখন ঘাড় বা মাথার চেয়ে সময়ের দাম বেড়ে গেছে বলেই হয়তো মাথার কথা মনে পড়ে না। মিলনের এলোমেলো ধারাভাষ্যে আমার কিছু কথা মনে পড়তে থাকে, কিছু পড়ে না। অথচ ভুলে যাওয়া উচিত না। মিলনের ভাষ্যমতে এই বয়ান বড়জোর তিন চার বছর আগের। আমার আস্তে আস্তে মনে পড়ে, আগে বন্ধু পরিবহনে উঠলে আমার মাথা বাসের ছাদে ঠেকে যেতো, ঘাড়ে একটা বিকট ব্যথা শুরু হয়ে যেত। আমি ওপরে তাকিয়ে দেখি,কই আমার মাথাতো ছাদই ছোঁয়নি, বরং আরও এক দেড় ইঞ্চি জায়গা খালি আছে। মিলনের কথা আমার বিশ্বাস হতে চায় না। তবু তার কথার সূত্র ধরেই আমার বেশ কিছু বিষয় মনে পড়তে থাকে। কী আশ্চর্য, এও হয় না কি? আমার বিশ্বাস হতে চায় না যে, আগে কখনো এমন সময় ছিলো যখন আমি এ বাসে আঁটতাম না। আমি মিলনের দিকে তাকাই। বন্ধু পরিবহনের বাম পাশের একসারি সিটের সঙ্গে জোড় সিটগুলোর মধ্যে যে ফাঁকা জায়গা, তার চেয়ে মিলনের প্রস্থ নিশ্চিত বেশি। কিন্তু কী এক জাদুবলে মিলন এইটুকু ফাঁকা জায়গাতেও ঠিকঠাক এঁটে গেছে। সে সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছে। কন্ডাক্টর কোবাদ তার পাশ দিয়ে এই একটু আগেই পেছনে গিয়ে ভাড়া কেটে আবার দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো। আমি আস্তে আস্তে সবার দিকেই ভালো করে লক্ষ করি। আমার বিস্ময় বাড়তে থাকে। আমি নিজের ঘাড় এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে পরীক্ষা করার চেষ্টা করি, ঘাড় ব্যথা করছে কিনা। কিন্তু কোনো ব্যথা টের পাই না। আমার মনে হতে থাকে ঘাড় একটু ব্যথা করলেই যেন আমার ভালো লাগতো। কিন্তু আমাকে হতাশ করে দিয়েই তাতে কোনো ব্যথা এমনকি কোনো অস্বস্তিও হয় না। আমি মিলনের নানা কথা শুনতে শুনতে তারই পাশে দাঁড়িয়ে তার বলা কথার সূত্র ধরে এইসব ভাবনা ভাবতে থাকি। এমন অদ্ভুত রহস্য ও জিজ্ঞাসার সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার জন্য আমার হঠাৎ মিলনকে খুব আপন মনে হয়। এমন আপন সম্ভবত তাকে আমার আগে কখনো মনে হয়নি।
মিলন সব কথা বলে শেষ করতে পারে না, তার আগেই মেরুল বাড্ডা চলে আসে। ফলে মিলনকে নেমে যেতে হয়। তার নেমে যাওয়ার সময় আমরা পরস্পরকে ‘অচিরেই দেখা হবে’ জাতীয় কথা বলে বিদায় জানাই, যদিও জানি সে সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ। তবু বলতে হয়। আমি এমনকি জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে ছোটবেলায় শিমুল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বাবার উদ্দেশে হাত দুলিয়ে টাটা দেওয়ার ভঙ্গিতে মিলনকেও টাটা দেই। ছোটবেলায় বাবা যখন বাড়ি থেকে ছুটি কাটিয়ে এই শহরে চলে আসতেন, তখন আমি এবং বাড়ির আরও অনেকে মিলে রাস্তার মাথার শিমুল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে হাত দুলিয়ে টাটা দিতাম। বাবার রিকশা যতক্ষণ দেখা যায় বা যায় না, ততক্ষণই দাঁড়িয়ে থাকতাম আমরা, আর হাত দোলাতে থাকতাম। বাবা যে রিকশায় যেতেন, তার পেছনের দুই চাকার মার্টগার্ডের ওপর দু’টি টিনের হাত স্প্রিংয়ে দুলেদুলে আমাদেরও টাটা দিতো। আমরা বিনিময় করতাম। কিন্তু মিলন কোনো বিনিময় করেনি। বরং সে আমাকে টাটা দিতে দেখে এতটাই অবাক হয় যে, আরেকটু হলে এই বিস্ময় নিয়ে সামনের খোলা ম্যানহোলে সে পড়ে যেতে পারতো।
সে যাই হোক, মিলন নেমে যাওয়ার পর থেকেই আমি জানলা দিয়ে উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে আছি। কী খুঁজছি আদৌ কিছু খুঁজছি কি না—বুঝে না উঠলেও আমি টের পাই—আমি যেন উপযুক্ত কোনো দোকান খুঁজছি। কিন্তু কেন—তার উত্তর আমার কাছে নেই। এভাবে খুঁজতে খুঁজতে আমি রামপুরা বাজারের কাছে এসে একসঙ্গে অনেকগুলো দোকান দেখে বাস থেকে নেমে যাই,যদিও আমার গন্তব্য কাকারাইল মোড়। তবু আমি নেমে যাই। অথবা বলা যায় অনেকটা নিয়ন্ত্রিতের মতো আমাকে নেমে যেতে হয়।
বাস থেকে নেমে আমি হোঁটে একটা পানের দোকানের সামনে দাঁড়াই। দোকানি আমার দিকে তাকালেই আমি বলে উঠি, ‘গজফিতা আছে?’ দোকানি বিস্মিত হয়ে আমার দিকে তাকায়। কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলে, ‘এইডা পানের দোকান।’ আমি তখন ধাতস্ত হয়ে বুঝে ওঠার চেষ্টা করি, আমি কেন গজফিতা কিনতে চাইছি। কিন্তু বুঝে উঠতে পারি না। যদিও ভেতর থেকে একটা অদম্য তাড়না আমাকে জানিয়ে দেয় যে, আজ আমাকে গজফিতা কিনতেই হবে। আমি অনেকটা বাতিকগ্রস্তের মতো বাজারের প্রতিটা দোকানে যেতে থাকি। মুদি দোকান, সেলুন, পান-তামাক, ফটোকপি ইত্যাদি বিভিন্ন দোকানের ধরন নির্বিশেষে গজফিতা খুঁজতে থাকি। এইভাবে দেখতে দেখতে আমি রামপুরা বাজারের প্রায় সব দোকান দেখা শেষ করি। কিন্তু কোথাও গজফিতা খুঁজে পাই না।
‘যানবাহনের ব্যসবাক্য কী বলো তো?’ আমার হঠাৎ গীতা ম্যাডামের কথা মনে পড়ে। আমাদের ব্যাকরণ পড়াতেন। আমি যেন এখনো ক্লাসের পেছনের কোনার ব্যঞ্চটায় বসে নিজের মাথা লুকানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু ম্যাডাম আমাকে দেখে ফেলেছেন। আমি আর লুকাতে না পেরে সরল স্বীকারোক্তি করলাম, ‘পারি না ম্যাডাম’। ‘যান চালিত বাহন—মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমান—মনে থাকবে?’ আমি মাথা ঝাঁকাই। এ মাথা ঝাঁকানোতেই আমার মনে পড়ে আমি স্কুলে নই, বরং ডিআইটি রোডের দু’ধারের রাস্তায় হেঁটে গজফিতা খুঁজছি। কিন্তু আমার একটু আগের ভাবনাটাও ফেলে দিতে পারি না। আমার মনে হতে থাকে বিরাট একটি ফাঁকি রয়ে গেছে। গীতা ম্যাডাম ‘যানবাহনের’ সঠিক সমাস নির্ণয় করতে পারেননি। আমি নিশ্চিতির মতো বুঝে যাই, এটি কোনোভাবেই মধ্যপদলোপী নয় এমনকি কর্মধারয়ও নয়, যানবাহন আদতে ষষ্ঠী তৎপুরুষ। আমার মনে হতে থাকে, যন্ত্র চালিত নয় বরং যন্ত্রের বাহনই যানবাহন। যে যন্ত্র যুগ যুগ ধরে নির্মাণ হয়ে আসছে। যে যন্ত্র মানুষ হলেই প্রকল্প ভেঙে যায় খানখান করে। আমার এক ধরনের তৃপ্তি বোধ হতে থাকে। বিরাট রহস্য ভেদ করেছি এমন তুষ্টি নিয়ে আমি সামনে তাকাই। দেখি লাফানো কাতল নিয়ে বসে থাকা মাছবিক্রেতা আমার দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে আছে। আমি তার বিরক্তি কমাতেই ধাতস্ত হই এবং মুখে এক চিলতে হাসি টেনে জিজ্ঞেস করি গজফিতার হদিস।
এভাবে ভাবতে ভাবতে খুঁজতে খুঁজতে আমি হাঁটতেই থাকি। পাশ দিয়ে সুপ্রভাত, বন্ধু পরিবহন হর্ন বাজিয়ে চলে যায়। আমার তাতে কোনো ভ্রূক্ষেপ হয় না। আমি হেঁটে হেঁটে দোকান দেখলেই থেমে যাই। যদিও এই রাতে খোলা দোকানের সংখ্যা নিতান্তই কম। তবু যে ক’টা খোলা আছে, আমি তাতেই ঢুঁ মারতে থাকি। এইভাবে চৌধুরীপাড়া, মালিবাগ রেলগেট, মৌচাক, মালিবাগ, শান্তিনগর হয়ে আমি এক সময় কাকরাইল পৌঁছে যাই। কিন্তু কোথাও গজফিতা পাই না। এমনকি সেই সবজি বিক্রেতার কাছেও গজফিতার খোঁজ করি, যে তার পাশে বসে থাকা ভিক্ষুকের কাছে ভিক্ষাপ্রাপ্তির কারণ হিসেবে নিজেকে জাহির করছিল ‘আমার রাশি দেখছস?’ বলে, অথচ যার টুকরির সবজিগুলো তার মতোই ছিল অপুষ্ট ও রোগাক্রান্ত। পথে নানা লোক নানা কথা বলে আমাকে। কেউ কেউ বিশ্রী রকমের রশিকতাও করে। কিন্তু কোথাও গজফিতার খোঁজ মেলে না। আমি যখন প্রায় নিশ্চিত হয়ে যাই যে, গজফিতা আমি আর পাচ্ছি না, তখন দূরে আমারই বাসার গলির কাছে যে টেইলার্সের দোকানটা রয়েছে, তা বন্ধ করতে দেখি। আমি কখনো এই দোকানে যাইনি। দোকানদারকে আমি চিনিও না, যদিও রোজ যাওয়া-আসার পথে তাকে দেখি। আমি একরকম ছুটতে ছুটতেই দোকানটার কাছে চলে আসি। ততক্ষণে দোকানদার,যার বাঁ চোখের নিচে বড় কালসিটে দাগ, দোকানের শার্টার ফেলে দিয়েছে এবং তাতে তালা মারার চেষ্টা করছে। আমি তার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে ভূমিকা ছাড়াই বললাম, ‘ভাই আপনার কাছে কি গজফিতা হবে?’ সে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো, ‘হবে, কিন্তু কী করবেন?’ আমি শুধু বললাম, ‘দরকার আছে, খুব।’ লোকটা আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে, আমার কথাতেই নাকি প্রতিবেশী হওয়ার কারণে সৌজন্যবশত দোকানের শার্টার আবার তুললো। ভেতরের আলো জ্বালিয়ে ড্রয়ারের তালা খুলে লাল রংয়ের গজফিতাটা বের করে আমার হাতে দিলো। আমি ফিতাটা আবার তার হাতে দিয়ে বললাম, ‘আমার উচ্চতাটা একটু মেপে দেনতো ভাই।’ লোকটা নিস্পৃহের মতোই অনেকটা আমার উচ্চতা মাপলো। তারপর আমার দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, ‘আগে কত ছিল?’ ‘আধ ইঞ্চ কম ছয় ফুট’, আমি উত্তর দিলাম। লোকটা তখন হেসে বলল, ‘কমে নাই। চিন্তা কইরেন না। ঠিক হইয়া যাইবো।’ আমি তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম।
এরপর লোকটার সঙ্গে দোকান বন্ধ করলাম। দু’জন মিলে শার্টার বন্ধ করে তালা মেরে যে যার পথে চলে যাব, এমন সময় আমি লোকটাকে ডেকে জানতে চাইলাম, ‘ভাই একটা কথা, আপনি কমে নাই বললেন কেন?’ লোকটা হেসে বলল, ‘এ রকম হয়, এই যেমন আমারও পা দুইটা ছোট হয় নাই, হাঁটু দুইটাও ঠিক আছে। সেই রকম আপনেরও কিছু হয় নাই, খালি নিজেরে মনে পইড়া গেছে। নিজেরে মনে রাখতে নাই।’ এই বলে লোকটা তার পথের দিকে পা বাড়ায়। যাওয়ার আগে তার সেই লাল রংয়ের গজফিতাটা আমার হাতে দিয়ে যায়। বলে, ‘রাখেন, অন্তত আজ রাইতে লাগবো। পরে দিয়েন। আমার কাজ চালানোর মতো আছে।’ আমি সেই লাল গজফিতা হাতে নিজের গলির মুখে দাঁড়িয়ে তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকি। ভাবী, আমার কি আসলেই নিজেকে মনে পড়েছে? কিসে মনে পড়লো? বন্ধু পরিবহন না কি মিলন,কে মনে করালো? নিজেকে মনে পড়া মানে কী? গজফিতাটাইবা এমন লাল কেন?