আঁতকা রহমান চাচার নম্বর থেকে ফোন আসতে দেখে মনটা যে পরিমাণ আনন্দে ধেই ধেই করে উঠেছিল, কথা শেষে তা কপূর্রের মতো উবে গেছে। বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি আমি। কুশলাদি বলার পর শুধু ও-পক্ষের কথা শুনেছি, কথা ফিরিয়ে দেওয়ার মতো কিছু অবশিষ্ট ছিল না। আমার কঠিন চোখে জলের উপস্থিতি জানিয়ে দেয়, চাচার মন আর্দ্র হয়েছিল, তিনিও কেঁদেকেটে জেরবার।
ন্যাংটাকাল থেকে দেখে আসছি রহমান চাচাকে। আমাদের জ্ঞাতির মধ্যে তিনি পড়েন না কিন্তু পাড়াতো ভাই হিসেবে আব্বার সঙ্গে ছিল তার গলায় গলায় ভাব। বাজারে, আব্বার দোকানে রোজ বিকেলে দুই বন্ধু আড্ডা দিতেন, চা-সিগারেট খেতে খেতে সেরে নিতেন দরকারি আলাপ। চাউলের দোকান আব্বার। হকদার বেপারি হিসেবে দোকানে লেগে থাকতো ক্রেতার ভিড়। বাকিবাট্টা আর বিয়ে-শাদির গরমাগরম বাজার-সদাইয়ে আব্বার পকেট ভর্তির সঙ্গে বাড়তে থাকে সমীহের ভাব। সঞ্চয়প্রবণতা আব্বার ধাতে ছিল না, হাওয়া-দেওয়া লোকেরা খেয়ে দিত লাভালাভের গুড়। হায়! সুখের দিন আমাদের অতীত হয়ে যায় আব্বার অকাল ইন্তিকালে। জ্যাঠামিয়া ওয়ারেশি সম্পত্তি অন্য ভাইকে ঠকিয়ে সবটুকু নিজের করে নিলে দোকানে থিতু হতে যাওয়া বড়ভাই আমার বেউপায় হয়ে আব্বার দেওয়া পুঁজিপাতি ভেঙে পাড়ি জমায় মরুদেশে।
বাড়িতে থাকা আরও পাঁচটা মুখের দিকে তাকিয়ে চাটগাঁ শহরে শুরু করি আমি অন্য যুদ্ধ। নানা কিসিমের মানুষের সঙ্গে দেখা, নানা জাতের বুলির সঙ্গে জানাশোনা। পানিও টাকায় কিনতে হওয়া নগরে সদ্য-যুবককে কে দেয় আশ্রয়! গ্রামে হয়তো কিছু একটা করা যেতো পড়ালেখা বলবত রেখে, কিন্তু যাদের বাবা লোকজনকে দিয়েছে বেহিসেবে, তার সন্তান অন্যের জিম্মায় রোজগার করবে কেন? রহমান চাচা তখন জমি-জিরেত নিয়ে সম্পন্ন-কৃষক। দুই পুত্র তার পেট্রো রিয়েল পাঠায় বিদেশ থেকে।
এ-ঘাট, ও-ঘাট পেরিয়ে একদা পুরনো পত্রিকাপড়ুয়া আমি হয়ে উঠি শহরের হকার। অত কম পুঁজির খেয়েপরে চলার মতো আর কোন্ ব্যবসা আমি খুঁজে পাবো মামুখালুহীন এই শহরে? আজানের ধ্বনি মানুষকে জাগানোর আগে জেগে উঠি। বাইসাইকেলটা নিয়ে পৌঁছে যাই চেরাগিমোড়। ততক্ষণে মানুষের হাঁটাচলায় আটমোড়া ভাঙে ঘুমন্ত নগরীর। বিভিন্ন পদের পত্রিকা বুঝে নিয়ে এবার দরোজায় দরোজায় ছুটে যাবার পালা। হয়তো তারা ঘুমে, দরোজার ফাঁক গলে পত্রিকা ঢুকে যায় তাদের সকালকে মুখর করতে। এ-বড় মজার পেশা। সাইকেলের বেলে ক্রিং ক্রিং শব্দ তুলতে তুলতে আওড়িয়ে যাই আকর্ষণীয় কয়েকটা হেডলাইন! চলমান অনেকে থামিয়ে পত্রিকা নেয় তাতে, কেউবা না কিনলেও চোখ বড়সড় করে তাকায় আমার দিকে।
হিসাব চুকিয়ে বাসায় আসতে ঘড়ি দুপুর দুটোর ঘরে আমন্ত্রণ নেয়। গোসল সেরে, খেয়েদেয়ে বিশ্রাম। বিকেলে ছুটে যাই কর্ণফুলীর তীরে, ঢুকে পড়ি কোন দলে। দুঃখ ভুলে ফুটবলের সঙ্গে পরীক্ষা করতে থাকি লাত্থি খাওয়া ভাগ্যকে। ওদিকে বড়ভাই জানায়, বড় কষ্টের কাজ ওখানে। গরমে রুহ বেরিয়ে যাওয়ার দশা, হাতে-পায়ে পড়ে গেছে ফোস্কা। বড়ভাই জিন্দেগি কাটিয়েছে সুখে। বিয়ের অনেক বছর পর পাওয়া আল্লাহর দানকে আব্বা না-পারে মাথায় রাখেন। ভালো কিছু না-হলে মুখেই রুচে না বড়ভাইয়ের! মাস চারেকের মধ্যে লাইনে-পড়া বড়ভাই ধারদেনার টাকা শোধ দিয়ে আশার আলো দেখায়; মনে মনে ভেবে বসেন অনুজকে ও-দেশে নিতে পারলে সংসারে আবারও নেমে আসবে সমৃদ্ধির আয়োজন।
কখন না-জানি ফোনের ও প্রান্তের লাইন কেটে যায়! বের হলে রহমান চাচাকে পথে নিশ্চয়ই পেতাম কিন্তু এই রোগা-দিনে কার সঙ্গে আলিঙ্গন করবো আমি, করোনা না কি চাচার? কোলাকুলির দূরত্ব কাটিয়ে আমার কাঁদতে ইচ্ছে করছে ভীষণ!
পৃথিবী অসুখের কালে টুপ করে বেড়ে যায় রহমান চাচার বয়স, যেমনি বেড়েছে লোকেদের চিন্তার ভাঁজ। একদিন শহরে বসেই ফেসবুকের ওয়ালে দেখি, চাচার ছোটছেলে রহিমুল্লাহ করোনার কুনজরে পরাপারের যাত্রী হয় প্রবাসে। তখনো গ্রামের লোকেরা চা-দোকানের গপসপ ভোলেনি, হাট-বাজারের মেলামেশা কমায়নি, সংক্ষেপ করেনি মজলিশের আয়তন। পুলিশ এসে পিঠালে তবে নামে দোকানের সাঁটার, আলাপে দেয় যতি। খবরটা পড়ে আমি নিজেও যেন একবার ঘুরে আসি মরার দেশে! কাঁধে দেখতে পাই মৃত্যুদূত। রহিমুল্লাহ ভাই বয়সে বছর তিনেক বড় হবে আমার। বিভূঁইয়ে গিয়ে গা-গতরে ঝিলিক মারে বৈদেশি চিকনাই; গায়ের ময়লাটে রঙ ঝাঁপ দেয় উজ্জ্বলতার দিকে। সেই রহিমুল্লাহ ভাইয়ের মৃত মুখের ছবি দেখে বিভীষিকা হয়ে ওঠে নিষ্ঠুর দরিয়ার মতো। আমাকে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন গ্রাহক সাফ সাফ বলে দিয়েছেন, সামনের মাস থেকে পত্রিকা দেয়া বন্ধ। পরিস্থিতি ভালো হলে তারা ফোন দেবেন, যেমনি ডেকে নেবেন কাজের বুয়াদের। মরিচালাগা দিনে বড়ভাই জানান, তিনি এখনো সহিসালামতে আছেন তবে কাজকামের বড় অভাব।
বাড়িতে বেকার বসে থাকার বয়স দেড় বছরের কাছাকাছি। তেমন একটা বের হই না বাড়ি থেকে। বের যে হবো, আমার নিজেরই তো মাস্কে লাগে চরম অস্বস্তি! গ্রামেমাস্ক পরা আর সামাজিক দূরত্বের বালাই নেই। বিয়ে-শাদি, মেজবানির আয়োজন চলতে থাকে সমানে। মাস্ক পরা লোকেদের দেখে আমার বেশ আগের স্মৃতি তরতরা হয়ে হাজিরা দেয়। আমাদের ছিল দুধেল গাভী। আব্বা পরিবারে পুষ্টির জোগান দিতে দুধের গাভী পালতেন বড়ভাইয়ের জন্মেরও আগ থেকে। প্রতি বছর গাভী ডাক দিলে আমি আর বড়ভাই গাভী নিয়ে যেতাম উপজেলা সদরের প্রাণিসম্পদ অফিসে। বিল ভরা ধান মানুষের, গাভী যদি মুখ দেয় কোথাও! আঁতকা ছাড়া পাওয়া গাভী দুই ভাইয়ের দুই হাতে শক্ত করে ধরে রাখা রশির একটু আলগা ভাব টের পেলেই লম্বা দৌড়। গাড়ির বেদরকারি হর্ন যেন উসকে দেয় গাভীকে। বাড়ি থেকে বের হবার আগেই মা বিসমিল্লাহ বলে গাভীর মুখে বেঁধে দিতেন ‘হোর’। মাস্ক কি তবে পশুজাতির অভিশাপ! খবরে ভেসে আসে মৃত্যুর সংখ্যা। লোকজন একটুক্ষণ চুপ থাকে, এরপরেই গাভীর ‘হোর’ খুলে দেওয়ার মতো অবস্থা!
ছোটকাল থেকে দেখে আসছি আব্বা, রহমান চাচা আর কালু চাচা মিলে ভাগে কোরবানি দেন মহাআনন্দে। ছোটদের বড়-হওয়ার প্রতিযোগিতা চলতো মাংস কাটার হিসাবে। রহমান চাচা তো চিল্লায়ে পাড়া মাথায় তোলার জো, লায়েক ছেলে, এখনো গোস্ত কাটতে জানে না! কোরবানি মানেই আনন্দ, পাড়া-পড়শী, আত্মীয়-স্বজনদের। কালু চাচা ছাগল কোরবানি দেওয়ার নাম করে সরে গেছেন ইজ্জত বাঁচিয়ে। শুনেছি তাদের এবার কোরবানি দেবেন না। আজ রহমান চাচা ফোনে বললেন, এবার তিনি ভাগে নেই! আমাদের পরিবারের হয়ে যে কথা রহমান চাচাকে বলার জন্য কদিন ধরে মা বলছিলেন আমাকে, তা-ই মুখ ফুটে বলে দিলেন রহমান চাচা? চাচার কথা শুনে ঝিম মেরে থাকি আমি। কখন না-জানি ফোনের ও প্রান্তের লাইন কেটে যায়! বের হলে রহমান চাচাকে পথে নিশ্চয়ই পেতাম কিন্তু এই রোগা-দিনে কার সঙ্গে আলিঙ্গন করবো আমি, করোনা না কি চাচার? কোলাকুলির দূরত্ব কাটিয়ে আমার কাঁদতে ইচ্ছে করছে ভীষণ!
আরও পড়ুন
বইয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব-৩॥ আনোয়ার পারভেজ হালিম