খোলা উঠান।
উঠানের একপাশে চাটাই বিছিয়ে, পোকায় কাটা ডালগুলো মেলে দিয়ে, রোকসানা দাঁতে দাঁত পিষে নিজের মনে কয়টা গালি দেয়। অবশ্য সেই অকথ্য ভাষা রোকু ছাড়া আর কারও কানে পৌঁছায় না। এমনকি বুড়া দামড়াটাও আচঁ করতে পারে না, আর আঁচ করবে কি! সেই বোধের গায়ে যে ঠুলি পরে বসে আছেন তিনি। সারাদিন তক্কে-তক্কে থাকেন, কখন রোকসানা আসে। সামনে এলিয়ে চোখ দুটো তার সচল হয়ে ওঠে। চোখ যতই সচল হোক না কেন, মঈন শেখের বাড়ির পেছনে পরিত্যক্ত জমির মতো সেও এখন পরিত্যক্ত। সেটা বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই কারও। অবশ্য এখন আর কাউকে আগের মতো তাকলিফও দেন না তিনি। ঘরে তার নাতি ও দুই ছেলের বউ মিলিয়ে গোটা সাতেক মানুষ। সবাই মোটামুটি নিপট ভদ্র ও নির্বোধ।
রোজকার আনাজপাতি ও ঘরদোর নিয়েই তাদের নাভিশ্বাস। ডালে পোকা কেন, চালে ধান কেন, এত কেন’র মাঝে মঈন শেখকে নিয়ে কথা কওয়ার সময় নেই কারও। তাইতো, মাঝেমধ্যে তার মন চায় ঘরের মানুষগুলোরে আঙুল উঁচিয়ে দুই চারটা কথা কইতে, কিন্তু স্ত্রী বিয়োগের পরে তর্জনী ও মধ্যমা এখন বেকার সময় কাটায় তারই মতো। দায়িত্ব কমে আসায় সেই আঙুলগুলো এখন নাক খোঁচানোতেই সীমাবদ্ধ।
বাকি সময় বিশ্রামেই থাকেন নাতিদের টুকটাক চিমটি ফোঁড়ন কেটে।
সবাই ভাবে আহা, কি সুখ বালু মেম্বারের, ছেলেদের হাতে সংসারের জোয়াল ধরিয়ে উত্তরপাড়ার শেখ মিয়া এখন কত শান্তিতে দিন-পঞ্জিকা দেখেন। এককালে বালুর ব্যবসা করায় আগেপিছে লোকজন তাকে বালু মেম্বার ডাকেন এখনো, একটা সময় মেম্বার পদপ্রার্থী হওয়ার খায়েশে যে তার হয়নি, তাও স্পষ্ট করে বলেননি কখনো। তবে কেউ ডাকলে কখনো বাধা দেননি, মনে মনে খুশি হন এখনো, পাড়ার লোকজন মেম্বার ডাকলে সিনাটা টানটান হয়ে যায়, সেটা অবশ্য হঠাৎ হননি, তার এলাকায় প্রথম সিমেন্টের ডিলারের ব্যবসা শুরু তার হাত ধরে, সঙ্গে ইট, বালু রাখতেন দোকানে।
হয়তো মেম্বার হওয়ার জন্য মঈন শেখকে কেউ নিমরাজিও করিয়েছিলেন। নতুবা সবকিছু খুঁটিতে পুঁতে মঈন শেখ লোকের কথকতায় বালু মেম্বার হয়েছিলেন যা আজ এখনো লোকমুখে প্রচলিত ।
এই উপজেলার প্রথম ইটের বাড়িটা যে তারই।
তখন থেকে লোকজন বড্ড সমীহ করত মঈন শেখকে। এখনো করে, অবশ্য আগের মতো না। আগে লোকজন প্রতিবেলায় উটকো ঝামেলা নিয়ে হেলেদুলে এসে হাজির হতেন, তিনি বুক পেতে এগিয়ে যেতেন সমস্যার রফাদফা করতেন। বর্তমানে সেগুলোও উধাত্ত হত্তয়া। নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য এখন অবশ্য মঈন মিয়াই নিজ উদ্যোগ আশপাশের লোকজনের সঙ্গে গপ্প, চাক্কি-চাটামির আসর জমায়, মাঝেমধ্যে কূট-কূটচালি শলা-পরামর্শ করে। ফাঁকফোঁকরে হু-হু শব্দ করে চা খায়, কেউ চা পানি খাওয়ার দাওয়াত দিলে সুরমা আঁতর লাগিয়ে সেসব জায়গায় যায়। অবশ্য আগের মতো এখন কেউ আর তেমন ডাকেও না, সবাই বড় ছেলের কাছে যায়, ইট বালুর হিসেবের খাতা এখন যে তার জেষ্ঠ পুত্রের হাতে।
সময় যে কাউকে ছেড়ে দেয় না, তা ষাটোর্ধ্ব মঈন শেখকে দেখলেই বোঝা যায়। প্রকৃতি কড়ায়-গণ্ডায় সব হিসাব-নিকাষ বুঝিয়ে দেয় বা নেয়, সেটা ভালোবাসা কিংবা অবহেলা, যাই হোক না কেন। মঈন শেখের বরাতে দ্বিতীয়টা। সকাল থেকে ছেলের বউদের ডেকে বলেছেন, আজ দুপুরে কবুতরের গোশত দিয়ে চারটা ভাত খাবেন, বউ দুটা শুনেও না শোনার ভান করে ডালের পোকার কিলবিলানি নিয়ে ব্যস্ত। সঙ্গে রোকসানাও। সকালে একটু নিমস্বরে রোকসানাকে বলেছিলেন,
রোকু গায়ে ব্যথা, একটু মালিশ করে দিবি…
কথা শোনামাত্র ভাতারখাকি মাগীটা দাঁত কটমট করে চলে গেলো। কেউ কথা শোনে না। প্রায় সময় ঘরেই বসে থাকেন , টিভি দেখেন, ছোট নাতির কার্টুন দেখে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়েন,অনেক সময় ভং ধরেন, ছেলের বউদের সঙ্গে আহ্লাদও করেন, তারপরও কারও মন পায় না মঈন শেখ।
এখন প্রায় সময় নানান গৃহস্থবাড়িতে বিয়ের বা বড় কোন আয়োজনে রোকসানা ডাক আসে কাজকর্মের। গায়ে গতরে অন্য নারীদের তুলনায় একটু বাড়ন্ত হওয়ায়, সবকাজ রোকসানার কাছে ছাতু হয়ে যায়। যতকিছুই করুক না কেন মেয়েটা, মানুষের ভালোবাসা পায়না।
এই সময়টা বড়ই কষ্টের। দিনটা তাও কেটে যায়। কিন্তু রাত, শলা-পরামর্শ বা গপ্প করার মতো কেউ পাশে থাকে না, বেকার শুয়ে থাকেন, এপাশ ওপাশ করেন, নারকেলের শলকা দিয়ে দাঁতের ভেতরে লুকানো খাবারগুলো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করেন। তারপরে শুরু হয় কাশি, যেনতেন কাশি নয়, যেন মরণ কাশি, সবকিছু উল্টে আসতে চায়, সেই ভয়ে দিনে তুলসী আদা চিবিয়ে ছাতু করেন যেন রাত হলে কাশিটা একটু কম আসে, কিন্তু কাশি মঈন শেখকে নিঃসঙ্গ রাখতে চায় না যেন, শুতে গেলেই পা টিপে টিপে হাজিরা দেয়, প্রথম এক দুই বার হালকা বেগে, শেষ তো কাশির ধমকে পেটের বায়ু সব বের হয়ে আসে, সেটুকু হলেও বেঁচে যেতেন, কিন্তু সমস্যা যে তার আরও গুরুগত, ছোট অঙ্গটা বড় হয় ইদানীং । বুড়ো বয়সে বিপত্নীক মানুষের এর থেকে বড় বিপদ আর হয় না। ওদিকে তার ঘরটা একেবারে উন্মুক্ত। এমনটা অবশ্য আগে ছিল না, স্ত্রীর মৃত্যু পরে নিজের গরজে ঘরটা ছেড়ে দিয়েছিলেন। একা মানুষ বড় ঘর নিয়ে কী করবেন। তখন ছোট ছেলেটাও সদ্য বিয়ে করেছিল। তাই সবার কথা চিন্তা করে খোলামেলা বসার ঘরের এই কর্নারে খাট পেতে নিজের একটা ব্যবস্থা করে ফেলেন। একদিকে ভালোই হয় তার জন্য, ছেলের বউ দুইটা চোখের সামনে ঘুরঘুর করে। কিছু খাওয়ার আগে চক্ষুলজ্জায় কারণে তাকে একটু সাধে, শাশুড়ি না থাকায় বউ দুটো যে তার বেজায় আনন্দে সংসার করছে, হাসির ভাঁজে সুখ দেখে বোঝা যায়। কিন্তু যখন রোকসানা তার আশপাশে হাঁটাহাঁটি করে, বিভ্রমটা মাথা চাড়া দেয়,বিপদে পড়ে যান আরও।
দুই ছেলেকে বলেছেন, আলাদা ঘরের কথা। ছেলেরা বলে, বাবা তুমি চোখের সামনে আছো এটাই তো ভালো, আমাদের শান্তি, ছেলেদের শান্তির জন্য মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন। নিজের শান্তি দেশান্তরি। হাঁপানির খসখসানির শব্দে বউ মায়েরা বিরক্ত। তখন তার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে আমাকে একটা আলাদা ঘর দাও, সেখানে বসে একটু আরাম করে কাশি,পাদি, বাকিটা আর মুখে আনেন না। কিন্তু বলা হয় না, একবার শ্বাসটান উঠলে শরীরের শান্তি লোটাকম্বল গুছিয়ে অন্যমুখী হয়। তাই মৌনব্রত পালন করেন নিয়মিত। মইন শেখের মাঝেমধ্যে ফজিলার ওপরে বেশ রাগ হয়। বেটপ নারী সারাজীবন কোনদিক দিয়ে শান্তি দিলো না, না শরীরে না মনে। ভেবেছিলেন বৃদ্ধ বয়সে অন্তত সেবা করে সঙ্গী হবে। কিন্তু সেখানেও স্বামীকে নিরাশ করেছেন। বেহেশত লাভের আশায় বিশ্ব সংসারে মায়া ছেড়েছেন সাত বছর হলো। ফজিলার মৃত্যুর পরে দু-চারজন তার স্ত্রীর গুণের বর্ণনা করতে আসতেন।
তখন তার ইচ্ছে করত, বেটা তুই কি জানিস আমার ফজিলার সম্পর্কে। ফজিলার ফজিলতের খুতবা শোনাতে এসেছিস! শেষবয়সে যখন স্ত্রীর সেবায় শরীরে শান্তি করবেন ভেবেছিলেন,সেই বয়সে টুপ করে মরে গেলো। আফসোস করে কিছু বলতে পারে না পাছে যদি গিবত হয়ে যায়। এত ভাবনার মাঝে লোটাকম্বল গুটিয়ে কবরে এক পা দিয়ে বসে থাকা মঈন শেখ হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেয় শাদির। শাদির কথা শুনে ছেলে দুটো গর্জে ওঠে, এই বয়সে বিয়ে করলে লোকে ওদের বাবার চরিত্র নিয়ে বাজে কথা বলবে। মঈন শেখ হাসে, আর মনে মনে বলে, তোর মা বেঁচে থাকতেই কত বেটির আগে পিছে হাত বুলালাম, বেকুব মহিলা কিছুই বুঝতে পারলো না। এখন তাকে নীতির কথা শোনায়। মায়ের মতোই বেকুব দুটা।
পাত্রী মনে মনে ঠিকও করেছেন তিনি, পাত্রী দুই কুড়ি পার হওয়া রোকসানা। মেয়ের চোখে দুটো মনোহারা, গায়ের চাপ রঙ চাপ পড়ে যায় কোমরের বাঁকে, সামনে পেছনে দুদিকে ভরপুর, কাজে কর্মঠ রোকসানার একটাই সমস্যা বাঁজা। মঈন শেখের এমন নারীই দরকার। সেবাযত্ন সঙ্গে রাতবিরাতের সুখ দুটোই এখন তার চাই। পাড়ায় রোকুর আলাদা নামডাক আছে, মাঝবয়সীরা রোকু বলতে পাগল, আর উঠতিগুলো রোকসানা খালার সঙ্গে যেচে যেচে কথা কইতে চায়। সবই জানে মঈন শেখ, কিন্তু ছেলেদের কিভাবে বলবে বিয়ের কথা। বিয়ে কথাটা বলা যায় কিন্ত পাত্রীর নাম শুনলে যে তেড়ে আসবে সবাই। এলাকায় রোকসানা যে আলাদা একটা নাম আছে, অপয়া।
তবে তার মনটা আনচান করে রোকসানার জন্য। রোকসানা পাশের বাড়ির দূরসম্পর্কের ভাতিজি সামনে এসে মুখ ঘুরিয়ে যখন হেঁটে যায়, পশ্চাদদেশের ঢেউ খেলানো মোচড়ের দিক থেকে চোখ সরাতে পারেন না তিনি, ছেলে দুটোর যে তার মতো মনফুরৎ ভাব আসে যে রোকুকে দেখলে, আচঁ করতে পারেন। কিন্তু ছোটবেলার মতো চোখ রাঙিয়ে কিছু বলতে পারেন না, গালে তলে আর পেটের আশপাশে মাংস জমা হয়েছে রোকসানার। ওদিকে রোকসানার কাক্কু বুলি শুনলে আবেগগুলোর আর ধোপে টেকে না। মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে। মনে মনে গাল দেয় হুটহাট এটা-ওটা চাইতে আসা রোকসানাকে। আমি তোর কোনদিকের কাক্কুরে বেহুদা নারী, তোর বাপ আমাকে ভাই ডাকে তাই বলে তোরও কাক্কু ডাকতে হবে! মনকে বোঝাতে পারে না, মুখেও লাজলজ্জা ভয়ে কইতে পারে না। ভেতরেটা তড়পায়। মুখ ফুটে একদিন একজনকে মনে কষ্টগুলো বলে ফেলেন আচমকা। যা তুবড়ি মতো ফেটে পড়ে, দুই ছেলে চোখ তাগড়ায়, কথা বাগড়ায়, মঈন শেখ লাজের দুই কান কেটে সিদ্ধান্তে অটল হয়ে যান, মুখ যখন ফুটেছে, বিয়ের ফুল তার ফোটাতেই হবে। এই একাকিত্বের সওয়াল জবাব চান তিনি। দরকার হলে সহায়সম্পদ সব রোকসানার নামে লিখে দেবেন, তারপরও রাতজাগা ভোরে একজন সঙ্গী চান ।
ওদিকে পাড়া রটে যায় চাচা ভাতিজির প্রেমের বয়ান। অনেকে বেশ রসালো করে পান চিবিয়ে বলে বেড়ায়, রোকসানাকে সবাই ভাতারখাকি মাগী ডাকে তা আগেই বলেছিলাম, মাত্র পনেরো বয়সে বিয়ে হয়ে সতেরো বছর বয়সে বাপের বাড়িতে ফেরত আসে রোকু। ভাইয়ের সংসারে পাঁচ বয়স কষ্ট-শিষ্ঠ কাটিয়ে আবারও স্বামী জোটে মেয়েটার কপালে, তখন ফজিলা বেশ সাহায্য করেছিল এতিম মেয়েটার বিয়েতে। কিন্তু সেই সংসারও টেকে না। হঠাৎ বাজ পড়ে অপঘাতে মৃত্যু হয় রোকসানার দ্বিতীয় স্বামীর দেড় বছরে মাথায়। তারপরে আর কে বাঁচা মেয়েটাকে, চব্বিশ বছর বয়সে অপয়ার তকমাটাকে মাথার তাজ বানিয়ে বাপের বাড়ি এসে থিতু হয়, ভাইয়ের সংসারে। সারাবেলা লাথি উষ্ঠা খেয়ে চল্লিশ বছর পার করেছে। এখন প্রায় সময় নানান গৃহস্থবাড়িতে বিয়ের বা বড় কোন আয়োজনে রোকসানা ডাক আসে কাজকর্মের। গায়ে গতরে অন্য নারীদের তুলনায় একটু বাড়ন্ত হওয়ায়, সবকাজ রোকসানার কাছে ছাতু হয়ে যায়। যতকিছুই করুক না কেন মেয়েটা, মানুষের ভালোবাসা পায় না।
ওদিকে বিয়ে পাগল বুড়ো,ছেলেদের চোখ এড়িয়ে একদিন সকালে চোখে সুরমা গায়ে আতর মেখে বেরিয়ে পড়েন নিরুদ্দেশে। নির্বোধ ছেলে দুটোর টনক নাড়াতে হয়ত। শুরু হয় খোঁজাখুঁজি। এই পাড়া সেই পাড়ায় কথাটা ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগে না। ওদিকে চাচার কাছ থেকে বিয়ে প্রস্তাব পেয়ে রোকসানা বাকরূদ্ধ হয়ে যায়। আর ওদিকে লোকমুখে রসে রসালো হয়ে ওঠে, বিয়ে পাগল বুড়ো নিরুদ্দেশ, পাত্রী উদাসী, এই কথাটি।
এই সমাজে শুধু হবে শুদ্ধতম মানুষের আবাস। তাই তো আজ নিশ্চিন্ন করতে হবে এই অপয়া নারীকে। রোকসানা লুকানোর জায়গা খোঁজে, ভয়ে দাঁতে দাঁত লেগে আসে। দূরদূরান্ত থেকে লাঠিসোঁটা হাতে মানুষ আসে থাকে দলে দলে।
বিয়ে পাগল বুড়ো নিরুদ্দেশ; এই আখ্যানে বিভিন্ন দোকানের সামনে, দেয়ালের গায়ে, বৈদ্যুতিক খুঁটিসহ হেন কোনো জায়গা নেই যেখানে মঈন শেখের ছবিসহ পোস্ট আঠা দিয়ে সাঁটানো হয় না। রাতারাতি পরিচিত বালু মেম্বার নামখানা ঢেকে যায় ‘বিয়ে পাগল বুড়ো’ মুখে মুখে চলতে ফিরতে চালু হয়ে যায়। বিয়ের কনে রোকসানা পড়ে মহাবিপাকে। বাঁজা তকমা নিয়ে বাপের ঘরে ফিরে আসা রোকসানার ঠেলাঠেলির জীবন। রোদের মাঝে বৃষ্টির মতো কথাটা ঝরে পড়ে হাওয়ায় ভেসে ভেসে যখন ভাইয়ের বউদের কাছে পৌঁছায়, তখন সে জ্বালায় ঘরে থাকা দায় হয়ে পড়ে ওর। পাড়ায় রটে যায়, বুড়োকে প্রেমের ডেউয়া গিলিয়ে সম্পত্তির হাতড়ানো ফাঁদ এঁটেছে রোকসানা। তারপরে সেটা সমাজবিজ্ঞানের পাঠ্য থেকে গার্হস্থ্য বিজ্ঞান ব্যবহারিক ক্লাস হয়ে ওঠে। পাড়ায় ছিঃ ছিঃ পড়ে যায় আরো। সাতদিন পরো,বিয়ে পাগল বুড়োকে রীতিমতো কোমরের দড়ি দিয়ে বেঁধে ঘরে ফিরিয়ে আনা হয়। বসানো হয় বিচার সালিশ। ‘সালিশ মানি, তালগাছটা আমার’, সেই হিসেবে মেনে রোকসানাকে মঈন শেখের সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি করায় পাড়ার সবাইকে বালু মেম্বার। একেবারে পাকাকথা হয়ে যায়। বেজে ওঠে বিয়ের বাদ্য সানাই। মঈন শেখের দুই ছেলে বাবার বিয়ের আগে সম্পত্তির বিলি-বণ্টন করিয়ে নেয় বউদের জ্বালায়। তখন রোকসানার ভাইরাও ছেড়ে দেয় না বিয়ে পাগল বুড়োকে, পাঁচ বিঘা ধানি-জমি লিখে দিতে রাজি হয় বালু মেম্বার। কিন্তু সবার মনে মনে একটা কাঁটা খোঁচাখুঁচি করে, রোকসানা অপয়া।
তারপরও সবাই মিলে সেই মহা সন্ধিক্ষণের তারিখ ও সময় নির্ধারণ করেন পরবর্তী সপ্তাহের বাদ-জুম্মা। বিয়ে দিন যত ঘনিয়ে আসতে থাকে অজানা এক ক্লেশের মিহি স্রোত কলকল করে মঈন শেখের সারাবুকে ছোটাছুটি করে ,ফজিলার কথা মনে পড়ে, ফজিলার হাসি, গভীররাতে পা ব্যাথায় টনটন করলে ফুঁ-দেওয়া তেলের মালিশ, শীতের সকালে গরম পানির ভাঁপ, স্মৃতিগুলো আষ্টে-পিষ্টে জড়িয়ে ধরে তাকে। এক একটা দিন পেছনে গিয়ে বাদ-জুম্মার দিনটি যতই সামনে ঘনিয়ে আসে, বুড়োর মুখের হাসি হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছিল যেন। ওদিকে রোকসানাও সচেতন নারীর মতো ঠেলাঠেলি জীবনকে পায়ে মুড়িয়ে মনকে বোঝায়, ট্যাকাই সব। যার যত ট্যাকা তার তত সন্মান। বুড়োর সঙ্গে বিয়ের কথা পাকাপোক্ত হবার পড়েই রোকুর পরিবারের সবার সেই আগেকার আদর লেহাজের অমূল বদলে যায়, সবার চোখ মঈন মিয়ার সম্পদের দিকে চকচক করে। যা শেখের ছেলে ও বউদেরও চোখ এড়ায় না।
বিয়ে আগের রাতে, হঠাৎ মঈন মিয়ার আচমকা ঘুম ভেঙে যায়। লাফিয়ে ওঠেন, ফজিলা…ফজিলা…বলে চিৎকার করতে করতে। মধ্যরাতে ছুটে আসেন বড় পুত্র ও পুত্রবধূ দুজনেই। আপন মানুষদের চোখের সামনে দেখে কিছুটা অবাক হয়ে যান মঈন শেখ, চোখের দৃষ্টি স্থির হয়ে যায় কিছুসময়ের জন্য। স্থির চোখের মাঝে আতঙ্ক ঘোরাফেরা করে,কিছু একটা খোঁজেন আশপাশে। কিছু সময় পরে দুই ছেলে এসে পাশে বসলে ছেলে দুটোর হাত জোড়া নিজের বুকের সঙ্গে লেপ্টে রাখেন যক্ষের ধনের মতো। যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে। খড়খড়ে মেজাজের লোকটার হঠাৎ এমন আচরণে সবাই একটু নয়, বেশ অবাকই হয়। আড়ালে ‘করলা চাচা’ বলে টিপ্পনী কেটে হাসাহাসি করা তার ছোট ছেলের বউটিও ঘুম ক্যাচলে পাশে এসে বসে থাকেন।
সকলে নিজেদের ভেতরে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বোঝের চেষ্টা করেন ঘটনা কী! তবে কেউ মুখ ফুটে কিছু জিজ্ঞেস করে না মঈন শেখকে, কী হয়েছে? মঈন শেখও মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকেন, তবে তার বলতে ইচ্ছে করে, বিয়ে আয়োজন বন্ধ করো, আমি বিয়ে করবো না,তার ফজিলা যে মর্মযন্ত্রণায় আছে এই বিয়ের আয়োজন দেখে। ফজিলার কষ্ট দেখলে তারও যে কষ্ট লাগে। সবার সামনে যতই গালমন্দ করুক না কেন, মঈন শেখ মনপ্রাণে ভালোবাসেন তার বেটপ নারীকে এখনও। ফজিলা মায়ার বান কাটাতে পারেন না তিনি। সে মায়ার বান কাটিয়ে কোথাও যাবার আর সময় পায় না মঈন শেখ। রাত গড়িয়ে ভোরে আলো ফোটার আগেই তার চোখের মনি স্থির হয়ে যায়। পড়ে নিথর দেহখানি বড় পুত্রের কোলে পড়ে থাকে। ওদিকে সকাল হতে হতে লোকজন জড়ো হতে থাকে রোকসানার বাড়ির সামনে। সমাজের পুরুষদের দূরে রাখতে হবে এই রাক্ষুসে নারীর ছায়া থেকে। এই সমাজে শুধু হবে শুদ্ধতম মানুষের আবাস। তাই তো আজ নিশ্চিন্ন করতে হবে এই অপয়া নারীকে। রোকসানা লুকানোর জায়গা খোঁজে, ভয়ে দাঁতে দাঁত লেগে আসে। দূরদূরান্ত থেকে লাঠিসোঁটা হাতে মানুষ আসে থাকে দলে দলে।
এক, দুই, একশ, হাজার…