খুব আঁধার থাকতেই খবরটা পাওয়া গেল। ফজরের নামাজ সেরে মসজিদ থেকে ফিরতেই পেটের ভেতর ভূটভাট, রাতে খয়রা মাছের ঝোল, সঙ্গে এক টুকরা কাগজি লেবু ছিল, খাবেন না খাবেন না করে শেষমেষ লোভ সামলাতে পারেননি, একথালা ভাত চেটেপুটে খেয়েও স্বস্তি হলো না, আহসানের মার আহ্লাদী হাতে ধরা কাসার গ্লাসের এক গ্লাস দুধও খেতে হলো, খেয়ে অবশ্যি মন্দ লাগেনি। জৈষ্ঠ মাসের প্যাচপ্যাচে গরমে যখন আম-কাঠাল নয়, মানুষ পর্যন্ত পাকবার দশা, তখন হঠাত কোত্থেকে যেন এক পশলা ঠাণ্ডা হাওয়া এসে গোটা আলীনগরের ঘুমন্ত শরীরকে ভিজিয়ে দিল। আকাশে চাঁদ নেই, তারাগুলোও তেমনভাবে জ্বলে না, সেই সময় জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস ঘরের ভেতরের শালিমারবাগের ছবি দেয়া ক্যালেন্ডারটা উড়িয়ে দিল। আহসানের মা’র ঘুম ভেঙে যায়।
শুনছ?
আহসানের মা’র কানের কাছে ক্যালেন্ডারের পাতা ফরফর করে। শুনতে প্যাছো?হাতের ধাক্কায় হকচকিয়ে উঠেই বাতাসের স্পর্শে শরীর জুড়িয়ে যায়। আহ! কতদিন পর এমন হাওয়া! যেন দোজকের অগ্নিকুণ্ডে বেহেশতের গোলাপ পানি ঢালা হয়েছে। বৃষ্টি হচ্ছে কোথাও। জানালর কাছে দাড়ালে ঠাহর করা যায় না। অন্ধকারের উঠোনে পেপে গাছের কবন্ধ ছবি, তার পেছনে ভূতের মতো কালো ছায়া ছাড়া আর কিছুই দৃষ্টিতে কুলোয় না। ঠাণ্ডা যখন বাতাসের গা, তবে অবশ্যই বৃষ্টি হচ্ছে কোথাও। কিন্তু কোথায়? মহানন্দার অর্ধেক শরীর এখন বালিয়াড়ির দখলে। পানি নেই। আধা মাইলটাক হেটে যা-ও বা পানির দেখা মেলে তা ঘোলাটে, গরুমোষ আর ছেলেপুলের দাপাদাপিতে থকথকে ডোবায় পরিণত হয়। পানি যদি থাকে তো চোখ মেলে দিলে দেখতে পাওয়া যায় দুরে। নীল গভীর পানির হাতছানি। কিন্তু সেটা ইন্ডিয়ার সীমানায়। বৃষ্টিটা বোধ হয় সেখাইনেই হচ্ছে। মেজাজটা বিষিয়ে যায়। ক্যালেন্ডারটা টেবিলে চাপা দিয়ে বাইরে বেরুতেই গায়ে ঠোক্কর লাগে। কে? না তো অখিলের ন্যাংটা ব্যাটা আবুবক্কর। কুকুরকুন্ডলী পাকিয়ে দাওয়ায় ঘুমোচ্ছে। আল্লাহ তা’লার কী অসীম কুদরত, অখিলের ফ্যামেলির কেউ বেচে নাই, কিন্তু এই ছোড়া, নাম যার আগে ছিল নিখিল, এখন আবু বকর, সে অত গন্ডগোল, গুলি আর আগুনের মাঝখানেও মারা যায়নি, বেচে ছিল। তারপর কেমন ক’রে ক’রে যেন ঢুকে গেল এই বাড়িতে। আহসানের মা’র আবার দয়ার শরীর, বলল, যখন আস্যা পড়্যাছে তখন থ্যাক, এতিম ছ্যালা, কুনঠে ফের যারে!
কিন্তু মালাউনের বাচ্চাকে আশ্রয় দিলে লোকে কী বলবে! বিশেষ করে পিস কমিটির মেম্বার যখন নিজেই! মসজিদের ইমাম সাহেব তখন বললেন, অরে তার চ্যাহা মোসলমান বানিয়ে লাও। তাহলে অরও একটা গতি হয়, তোমারও নেকি হয়। মুসলিম জাহানেও একজনা মোসলমান বাড়ে।’
শেষে গত শুক্রবারের আগের শুক্রবার কয়েকজন মুসল্লীর সামনে নিখিলের খতনা আর নাম বদলানোর মাধ্যমে সে এ বাড়িতে স্থায়ী বাসিন্দা হয়। আহসানের মার অবশ্যি একটু দোনামোনা ভাব ছিল, বলছিল, এটা কি ঠিক করলা আহসানের বাপ? যদি অর কুনু আত্বীয় স্বজন থ্যাকা থাকে ওপারে, যদি দ্যাশের অবস্থা অন্যরকম হয়্যা যায়, তখন? তখন কী হব্যে?
:ধুর পাগল! সবুর কইরা খালি দ্যাখো, অবস্থা কী হয়! এ দ্যাশ কিছুতেই ওই মুজিবের বাচ্চাদের হাতে পড়বে না। তার আগেই সব টাইট দিয়্যা ফেলবে খানেরা। ঘুমন্ত ছোড়াকে ডিঙ্গাতে খারাপ লাগলেও করার কিছু নাই। পেশাবের বেগ এমনই যে, গোসলখানায় বদনার পানি নিতে না নিতেই ছরছর করে ঝরে মূত্রজল।
ঠাণ্ডা হাওয়া। আহা, মন প্রাণ সবই জুড়িয়ে যেতে থাকে। পেছন পেছন কখন আহসানের মা উঠে এসেছে। ঘুম ঘুম চোখ, লন্ঠনের লাল আলোয় মুখটা লালচে বরণ মাথার ঘোমটা হাওয়ায় উড়ে গেছে, এরকম এক মুহুর্তে তিনি আবিস্কার করলের আহসানের মার নাম ছিল ফরিদ্যা। মোসাম্মত ফরিদ্যা খাতুন। পিতা: মরহুম সৈয়দ আহমদ আলী, নিবাস: কালীচক। সেই কত যুগ আগের কথা। তারপর আহসান হবার পর ফরিদ্যা নামটা আর থাকে না। তেরো বছরের খুকিটি আহসানের মা বনে যায়।
ফরিদ্যা।
আহসানের মা চমকে ওঠে। বাপজানের মতো কন্ঠস্বর। বাপজান নাকি! কিন্তু তিনি তো মারা গেছেন আজ তিন বছর হলো। তার কবর আছে কালীচক হাইস্কুলের সামনে। একটা নিম গাছ পাশেই বেড়ে উঠে ছায়াবৃত করে রেখেছে তাকে। আহসানের বাপ তাকে পছন্দ করত না নামাজ কালাম পড়েন না বলে। অথচ কালীচক, কানসাট, শিবগঞ্জ সারা তল্লাটে তার বাপজানের কী কদর, কী সুনাম। আহসানের হাতেখড়ি হয় তো তার নানাজানের হাতেই। নানাজানের মতোই তার ব্রেন। ছেলেবেলায় রোজ দেড় সের করে দুধ আর এক সের করে রাধামোহনের হাতের রসগোল্লা খেত।
আহসানের মা চমকে উঠে নিরীক্ষণ করে দাড়িঅলা মানুষটাকে। বাপজানের তো দাড়ি ছিল না! নাকি মারা যাবার আগ দিয়ে দাড়ি ছেড়েছিল! কী জানি, আহসানের মার কিছুই মনে পড়ে না। আর মনে পড়বেই বা কী করে! বিয়ের পর কালীচক গেছে সে সর্বসাকুল্যে দশ এগারোবার। তা-ও ভাই-বোনের বিয়েসাদীতে। শেষেরবার গিয়েছিল বাপজানের ইন্তেকালের খবর পেয়ে; তখন বর্ষার মাস। গ্রামগুলো সব ভাসন্ত দ্বীপ হয়ে আছে। গরুর গাড়ি চলে না। রাস্তাঘাট সব নদীর সঙ্গে মিশে একাকার। নৌকা ভাড়া করা হলো। তো সেতু মাঝির জ্বর। কে চালাবে? ওর ব্যাটা লালুর স্বাস্থ্য ভালো, কিন্তু মাথায় বুদ্ধি কম। সে তিনচার বার নৌকা বন্যার তোড়ে ভাসিয়ে দিয়েছিল। যা হোক একরকম খাবি খেতে কাকভেজা হয়ে ভিজে যখন কালীচক পেৌছল তখন ঘোর সন্ধ্যে। বাপজানের মাটি হয়ে গেছে। সুতরাং বাপজানকে সে মৃত্যুর আগেই প্রায় বছরখানেক দ্যাখেনি। সে তবে কী করে জানবে বাপজানের মুখে দাড়ি ছিল কি না! মানুষ বদলাতে তো বেশি সময় লাগে না। এই যে রহমতুল্লাহ, আহসানের বাপ, তার মতন মুসল্লী ধম্যপ্রাণ মানুষ এ গ্রামে কজন আছে, কিন্তু খানসেনাদের আগমনে সে কি বদলে যায়নি! সে কি অখিলের ওই পেটোপড়া ব্যাটাটাকে মুসলমান বানায়নি!
ফরিদ্যা।
আহসানের মা এবার চমকাল না। লম্ব জোব্বা আর কুজো হয়ে দাড়িয়ে থাকা লোকটা আর কেউ নয়, রহমতুল্লাই। কিন্তু ডাকবার ধরন একটু অন্যরকম শোনাচ্ছে না কি! সেই আট দশ বছর আগের ডাকের মতো। রাতের প্রয়োজনে এরকম করে ডাক দিতো আহসানের বাপ। তখন কোলের মেয়ে লাইলীকে ফেলৈ উঠে যেতে হতই তার কাছে। কিন্তু এসব ব্যাপারতো শেষ হয়ে গেছে অনেক দিন। প্রতিমাসের মেয়েমানুষের যে কষ্ট, সেও ছেড়ে চলে গেছে বছর তিন হলো। এখন তাই শরীর ভারি হয়েছে আরও, পায়ের গোছায় পানি জমে থাকে বারো মাস, বাতের কষ্টও বেড়ে যায় পূর্নিমা আর অমাবস্যায়। তাহলে এত সুমিষ্ট ডাক কেন?
লোকটার চোখ ধকধক করছে ল্ঠনের আলোয়। আহসানের মা তাড়াতাড়ি মাথায় কাপড় তুলে দিল। এই খোলা উঠোনে জলজ বাতাসে মানুষটা ওকে চেপে ধরবে না তো! আর ধরলেই বা কী! নিজের পুরুষ বই তো কিছু নয়। কিন্তু তারপরও একরাশ লজ্জা ও সংশয় ওকে ছেকে ধরল। ছিঃ সব কিছুর একটা বয়েস আছে না!
ফরিদ্যা মাথায় কাপড় তুলে দাওয়ায় উঠে গেণে রহমতুল্লার চেতন ফিরে আসে।
নাউজুবিল্লাহ! তার মাথায় সাক্ষাত শয়তান ভর করেছিলো। নইলে এই অন্ধকারে খোলা হাওয়ায় কী করে তিনি নিজের বউকে অন্য মেয়েমানুষ মনে করেছিলেন। আর মনে করেই এই বাষট্টি বছর বয়সেও পেটের নিচের দিককার অংশ ফুলে ফূলে উঠছিল। তার মানে এখনও তার সমূহ শক্তি নি:শেষিত হয় নি! আর আহসানের মা’ও যেমন নিজের স্বামীল কাছে তোর কিসের লজ্ঝা? বয়স বেড়েছে বলে কি সাধ আহলাদ থাকবে না? স্বামীকে পরপরুষ মনে করে মাথায় ঘোমটা টেনে দিতে হবে-দাওয়ায় উঠে যেতে হবে! আসতাগফারুল্লাহ! আবার কুমতলব মনের ভেতর উকি মারছে। এবার তিনি উঠোনের পায়চারি বন্ধ করে উঠে এলেন ঘরে। জড়োসড়ো হয়ে আহসানের মা শুয়ে আছে। বেড়াল ছাড়া আর কী ভাবা যায় একে? শুতে গিয়ে জর্দার গন্ধ নাকে লাগল।
‘মেসার্স শুকুর এন্ড সন্স’-এর শাহজাদী পাতি। আগে মালদা হয়ে বেনারসী জর্দা আসত রহনপুর বাজারে। সেই বেনারসী জর্দা আনতেন আহসানের মা’র জন্যে। ফর্শা টুকটুকে মুখে পানের লাল রসে সেই গন্ধ মাখা মাখা হয়ে থাকত। কিন্তু এখন আর কেনেন না। বরং রাজশাহীর মেসার্স শুকুর এন্ড সন্স খারাপ কী বানায়! তো আহসানের মা এমন ভঙ্গীমায় শুয়ে জর্দার গন্ধ ছড়াচ্ছে যে, শরীল উথলে উঠতে চাচ্ছে হঠাত। হাত বাড়িয়ে দিতেই ঘুরে গেল তার শরীর।
ভীমরতি ধর্যাছে, না?
হিসহিসে গলা আহসানের মা’র। আরজন্মে কী সাপ ছিল ফরিদ্যা? নাকি এখন! ঠাণ্ডা বাতাস ততক্ষণে ম’রে এসেছে, পুরোরো গরম আবার যথাস্থানে ভাজ খেয়ে গেছে। আর তখনই গোলাগুলির শব্দ ভেসে এল জানালা দিয়ে। কোন দিকে? মুহুর্তেই ভয় ধরে গেলভ নদী পেরিয়ে এদিকে আসছে না তো বিচ্ছুর দল। চুন্নু, তার ভাতিজা, োপারে গেছে আজ মাস দেড়েক, সেখান থেকে সমানভাবে ব’লে পাঠাচ্ছে, রহমতুল্লাহ যেন সব কিছু ছেড়ে-ছুড়ে নদী পার হয়ে তার বড়মাকে নিয়ে চলে আসেন। ওসব পিস কমিটি টমিটির মধ্যে জড়িয়ে কাম নাই। গত পরশুও এমরান মাস্টার বলে গেছে. শুন্যাছেন কিছু?
:কিসের কথ কহিছো?
:চুনুর এক বন্ধু, নাম কুদ্দুস, মাদ্রাসার ছাত্র, থাকে বাঙ্গাবাড়ি। সে নাকি তার বহিনের বাড়ি থাইক্যা ফিরছিল, এমন সময় পথিমধ্যে চুন্নুর সঙ্গে দেখা। প্রথমে নাকি সে চিনতেই পারেনি যে, ওট্যা চুন্নু। চুন্নু কহিলে, হামার বড় বাপকে কহ্যা দিস, এমনিতেই যদি আসে তো অ্যালো, নাহিলে এক রাতে অর ঠ্যাং ভ্যাঙ্গা লিয়্যা আসব এপারে।
রহমতুল্লার রাগে পিত্তি জ্বলে যায়। এই সেদিনকার ছোড়া, রহনপুর কলেজে কেবল ভর্তি হযেছে, এরই মধ্যে সে রাজনীতির ফেরে পড়ে গেছে। ছাত্রলীগের সার্পোটর। দেশের অবস্থা উত্তপ্ত হতেই একরাতে মা ও ছোটবোনকে নিয়ে উধাও। সেজ ভাই আফাজউল্লাহ ভাগ্যিস আগে থাকতেই চোখ বুঝেছে। নইলে অমন ছেলের জন্য তাকে অনেক নাজেহজাল হতে হত। যেমন হতে হয়েছে সেতাব উদ্দিনকে। সেতাবউদ্দিনের মনোহরি দোকান ছিল মকরমপুরঘাটে। ভালোই চলত। খানসেনারাও কিছু বলে নাই। সেতাবউদ্দিন পরহেজগার মানুষ, নামাজ কাজা করে না কোনওদিন।কিন্তু তার ব্যাটা বসিরুদ্দিন, ইমারত চেৌধুরীর ধানকলের পাহারাদার। তার সাহস দ্যাখো! সে কিনা তর্ক করতে গেছে মেজর সাহেবের সঙ্গে! মেজর সাহেব কী এমন ভুল বলেছেন যে, তুই তর্ক করতে যাবি! উনি তো ঠিকই বলেছেন? সত্যিও তাই। নইলে শহীদ মিনারের নামে কী করে পুজা করিস, ওই রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে মাতামাতি করিস! কেন, আমাদের কি ইকবাল নাই? নজরুল নাই? দেশের এই অবস্থায় খান সেনারা এসে যদি টাইট না দিত, তো তোরা এতদিনে এদেশকে ঠিকই বেচে দিতি ইন্ডিয়ার কাছে। মেজর সাহেব বশিরুদ্দী আর তার বাপ সেতাবউদ্দিনকে একই সঙ্গে চালান করে দিলেন সদরে। এ নিয়ে মকরমপুরের লোকেরা একটু গুনগুন করেছিল। রহমতুল্লা ব’লে দিয়ে এসেছেন, তাও তো ভালো মেজর সাহেব বশিরুদ্দীর বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেননি কিংবা ঘরের ভেতর ঢোকেননি। ঢুকলে কি আর বশিরুদ্দীর কচি বউটা আস্ত থাকত।
গোলাগুলির শব্দে আবু বকর জেগে গেছে। কুত্তার মতো কুই কুই করছে দরজার ওপাশে। আহসানের মা দরজাটা খুলে দিল। ছোড়াটা ভয়ে কাপছে। আহসানের মা বলল, ভেতরে আয়। অ্যাস্যা আলমারির ওদিকটায় শুত। ভয় নাই। কিসের ভয় তোর?
: মেলেটারির। আবুবকর ভয়ে কুকড়ে যেতে থাকে।
:এখন তো তোর ভয় নাই। মেলেটারিরা কেবল হেন্দু মারে। তুই তো এখন মোসলমান। তোর নাম আবুবকর। তাহিলে আর কিসের ডর?
ছেলেটা মনে হয় বুকে বল পেল। ত্যানাকানি জড়িয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু আহসানের মা এপাশ ওপাশ করতে লাগল। পাশের বাড়িটা আফাজউল্লাহর। ফাকা পড়ে আছে। মানুষ নাই, জন নাই। একটা পাখিও এসে বসে না তার চালায়। রাস্তার উল্টো দিকে ইয়াসিন আলীর বাড়ি। ইয়াসিন পাবনা এডোয়ার্ড কলেজে চাকরি করে। এখানে থাকে ওর মা আর বউ বাচ্চা। ছুটিছাটায় আসে। কোনও সাতে পাচে নাই। চুনু মাঝে মাঝেউ ওর পেছনে লাগত। ‘কী ইয়াসিন ভাই, খালি খাচ্ছেন আর মোটা হচ্ছেন। এছাড়া কী আর কুনু কাম নাই?’
:আর কী কাম আছে কহ।
:ক্রানে দ্যাশের ল্যাগ্যা কিছু চিন্তা করেন না?
:সেটা তো ভাববা তোমরা। হামরা আর কী। প্যাট ভর্যা খাওয়া প্যালেই হয়।
চুনু আফসোস করত, আল্লা যে ক্যানে আপনাকে অন্য কিছু বানায়নি ইয়াসিন ভাই! কলেজের টিচার হয়্যাও যদি চোখ বুজ্যা থাকেন তাহিলে কী কর্যা হামরা আগাব কহেন!
একমাত্র আহসানের পেছনেই ছেলেটা লাগত না। আহসান এই আলীনগর গ্রামের তিন নম্বর ফাস ক্লাশ ফাস্ট। প্রত্যেক পরীক্ষায়। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান নিজের হাতে তাকে সোনার মেডেল দিয়েছে। যেন-তেন সোনা না। পাকা দেড় ভরি ওজনের। আহসানের মা যত্ন করে তুলে রেখেছে আলমারিতে। আহসানের বেটা কী বেটী যাই হোক, মুখ দেখানির সময় মেডেলটা দিয়ে দেবে। কিন্তু সেই সৌভাগ্য কী হবে আর?
দেশের যে অবস্থা! আহসান খবর পাঠিয়েছে তার এক ছাত্রের হাতে, সে আর লুতফা নবাবগঞ্জে আটকা পড়েছে। মহানন্দার পারাপার বন্ধ। তাই আসতে পারছে না। আবার ফিরে যে যাবে ভার্সিটিতে, তারও ভরসা পাচ্ছে না। রহমতুল্লাহ শুনে বড় অসন্তষ্ট। ওখানকার সাইকোলজির টিচার মতিউর রহমান তার বেশ জানাশোনা। খুবই সুপুরুষ। বিয়ে করেছে রহনপুর লাইনের রেল ড্রাইভাবের মেয়েয়েকে। সে থাকতে আর চিন্তা কিসের! তার ওপর এই যে পিস কমিটির মেম্বারগিরি- তা কি কেবল নিজের জন্য, সন্তানসন্ততি, আত্বীয়-স্বজন সবাইকে শেল্টার দেবার জন্য কি নয়! এই যে আফাজুল্লার এত বড় বাড়ি খালি পড়ে আছে, তার নজর না থাকলে কবে এই বাড়ি লুটপাট হয়ে যেতো না!
সারারাত চলল এরকম গোলাগুলি। একবার রহনপুরের দিকে মনে হয়, আরেকবার মনে হয়, না মকনমপুরের দিকেই বোধহয়। আহসানের মা বড়ই বুদ্ধিহীন। এরই মধ্যে ইনিয়ে-বিনিয়ে কাদতে আরম্ভ করেছে। তা, কী জন্য কান্না? না তো, কান্না আহসানের জন্য, লাইলীর জন্য। আহসান আর বউ মাহতাব সরকারের বাড়িতে না হয় ভালোই আছে। মাহতাব সরকারের জিপ আছে। রহনপুর অব্দি মাঝে মাঝেই আসে। সেটাতে হয়তো সুযোগ মতো চলে আসতে পারবে। কিন্তু লাইলী! লাইলী আছে ভোলাহাটে। জামাই সাব-রেজিস্টার।পয়সাপতি মন্দ না। তার ওপরে বাপ-মার একমাত্র সন্তান। ১০০ বিঘা জমি, আমবাগানও আছে তিন তিনটা। মেয়েকে বিয়ের দিন নগদ বিশ ভরি সোনা দিয়ে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু মুশকিল হলো ভোলাহাট এখন মুক্তিবাহিনীর দখলে। জামাইয়ের আমবাগানে নাকি তাদের ক্যাম্প। লাইলীদের অবস্থা তাহলে না জানি কেমন, কে জানে! চুনু হারামজাদার আবার বন্ধু হয় আমজাদ। সেদিক থেকে একটু শান্তি, কিন্তু তারপরও বলা যায় না কী হয়।
আহসানের মা হঠাত ফোসফোস করে, তোমার গেনে হামার বেটাবেটির যদি কিছু হয়, তাহিলে কিন্তু বল্যা দিচ্ছি তোমার রক্ষা নাই।
রহমতুল্লাহ একটু বিচলিত হন। এ কী! আহসানের মা’র কন্ঠস্বর যেন বদলে যাচ্ছে। আর বদলাবেই না কেন! কোনও বংশের দেখতে হবে তো! বিশ্বসবাড়ির মেয়ে। কিছু করুক আর নাই করুক, তবু তেজ তাদের থাকবেই। ফরিদ্যার দাদা ছিলেন বৃটিশ আমলের নামকরা ডাক্তার। তবে তার খ্যাতি ছিল স্বদেশী করতেন বলে। ও বাড়ির এখন তার বুক চিতানো মুগুর ভাজা ছবি ঝুলছে। আর ওর বাপজান মানে শ্বশুরসাহেব দিলদরিয়া লোক ছিলেন। কিন্তু একটু ঘাড় ত্যাড়ামি ছিল তার। আহসানের বিয়ে তিনি দিতে চেয়েছিলেন বগুড়ার এক গায়িকার সঙ্গে। নাদেরা বেগম। ভালো ভাওয়াইয়া গায় নাকি। বংশও ভালো। কিন্তু রহমতুল্লা গানবাজনা করা মেয়ে পছন্দ করেননি। কেমন যেন হিন্দুয়ানি ব্যাপার। তার ওপার শোনা গেছে মেয়েনাকি কপালে টিপ দেয়, আবার ফাংশান টাংশানও করে। শুনেই বাতিল। কিন্তু আহসানের নানা তা সহজভাবে নেননি। বিয়েতে আসতেও চাননি। এবং বিয়ের আগেই তিনি ইন্তেকাল করেন।
আহসানের বউ লুতফা মজিদ খান সাহেবের মেয়ে। মজিদ খানের বাড়িতে আবার বাঙ্গলার চল নাই। সবাই উর্দুভাষী। এবং লুতফা বাঙলা বলে না, ব’লে আহসানের মা বউ পছন্দ করে না। কিন্তু মেয়েটা ভালোই। আদব কায়দা জানে। কিন্তু দোষের মধ্যে একটাই, পায়ে মেহেদী মাখে। তৌবা, তৌবা। অত্যন্ত গুনাহর কাজ। কিন্তু কে বোঝাবে তাকে! আহসানকে বলা হয়েছে, তবু সে পায়ে মেহেদীর নকশা কাটবেই।
ফজরের আজানের সময় গোলাগুলি থামল। রহমতুল্লাহ নামাজ পড়তে গিয়ে দ্যাখেন, লোকজন নাই। ইমাম সাহেব আর তিনি। কী ব্যাপার! সবাই গোলাগুলির শব্দে ঢুকে আছে ট্রেঞ্জে। ক’দিন আগেই মেজর সাহেবের হুকুম মতো পরিখা কাটা হয়েছে বাড়িতে বাড়িতে। কিছু কিছু জায়গায় বালুর বস্তাও মজুদ। ইমাম সাহেবইখবরটা দিলেন। রহমপুর ব্রিজ ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছে নাকি ওই বিচ্ছুর দল। ব্রিজের পাশেই কাজল ক্যাস্প। অত মেলেটারি, তাছাড়া রাজাকার আল বদরদের পাহারা তো আছেই। এরমধ্যেই কেমন করে সেধেল ওই মুজিবের বাচ্চা মুজিব! ইমাম সাহেব বললেন, চারজন মুক্তির লাশ পাওয়া গেছে কাছেপিঠে। খানসেনারাও খতম হয়েছে বেশ ক’জন।
রহমতুল্লার পেটে তখনই ভুটভাট শুরু হলো। খাও ব্যাটা খয়রা মাছের ঝোল আর লেবু! এখন কোথায় চেয়ারম্যানের কাছে দেৌড়াতে হবে, তা না গিয়ে এখন পায়খানায় বসো। তবে পায়খানাটা ডুমুর গাছের তলায় ব’লে জমে বেশ। পাখপাখালির ডাক আর গুয়ের গন্ধ মিলে খারাপ না কাটে না। মুক্তিবাহিনীতে জয়েন করার পর এক রাতে চুনু এসেছিল শাসাতে। তিনি তখন আহসানের মাকে ইশারা করে চলে এসেছিলেন পায়খানায়। হারামজাদা ছোড়া ঠিকই টের পেয়েছিল। এর বড়মার সঙ্গে এমন জোরে জোরে কথা বলছিল যাতে রহমতুল্লার কানে যায়। বলছিলো, বড়মা, ওনাকে বল্যা দিবেন য্যানে ঠিকমত থাকেন। নাহিলে কিন্তু খারাপ হয়্যা যাবে কহ্যা দিনু।
হু। খারাপ হয়ে যাবে বললেই হলো। মুখে বড় বড় খালি কতা। তোদের আছেটা কী শুনি। কী নিয়া যুদ্ধ করবি। খানসেনাদের মতন তোদের কুনু শিক্ষাদীক্ষা আছে! না আছে শরীলের তাগত। যতই ইন্ডিয়া লিয়া লাফা, পাকিস্তানী সৈন্যের কাছে সব ঠাণ্ডা। ইদারার কাছে মবিন আর নজরুল দাড়িয়ে ছিল। পিঠে রাইফেল।
: কী ব্যাপার?
:শুনছেন তো?
: হু।
:চেয়ারম্যান ড্যাকাছে আপনাকে। মেজর সাহেব নাকি খুবই খেপা গেছেন। যেখানে যত ছেল্যাপিল্যা প্যাছেন, সবকে ধর্যা লিয়্যা আসছেন। ভালোই তো। যেমন জয়বাংলা জয়বাংলা করবি ব্যাটারা, এখন বুঝ। এখন তোদের কেচাতে আসবে? তোদের কুন মুজিব বাপ?
কিন্তু মুখে কিছু না বলে পাঞ্জাবি পাল্টাতে গেলেন। একটু আতর মাখলে হত না! পাঞ্জাবিতে পুরনো খামের সোদাটে গন্ধ। সামনে হাটবারে একটা পাঞ্জাবির অর্ডার দিতে হবে। কিন্তু বানাবেটাকে? এখানকার দুটো খলিফা, দুটোই ওপারেভ গোপালের হাত ছিল ভালো, কিন্তু নবকৃষ্ণ সবসময় বানী কম করে ধরত। রহনপুরে ইদ্রস খলিফা আছে বটে, তবে তার যে ডাট, সামান্য ক’টা উর্দু জানে জানে বলে এখন তার দোকান রমরমা। চব্বিশ ঘন্টা নুরজাহানের ‘দামাদ্দাম মাস্তকালান্দার’ বাজছে। পুরোনো পরিচিতদের পাত্তাই দেয় না। এমন কী তিনি যে পিস কমিটির মেম্বার, মেজর সাহেবের সঙ্গে যথেষ্ট খাতির, তবুও না।
মবিন তাড়া দিল। হলো চাচা, তাড়াতাড়ি করেন। রহমতুল্লাহ ভাবলেন টুপিটা নেবেন কিনা। জোহরের ওয়াক্ত যদি ওখানেই হয়ে যায়! আহসানের মা টুপিটা এগিয়ে দিল। বলল, সাবধানে যাইয়ো।
রাস্তাঘাট ফাকা ফাকা। অন্যান্য দিন অন্তত বাড়িঘরগুলোর উঠোনে ছেলেপুলেদের হইচই লাফালাফি দেখা যায়। আজ পুরো নি:শব্দ। কোথাও কোনও শব্দ নেই। যাতা কিংবা ঢেকির শব্দ, ক্যাচোড় ক্যাচ ঘানি টানার একঘেয়ে শব্দের মৃত্যু ঘটেছে যেন। বড় রাস্তা ছেড়ে শর্টকার্ট পথ ধরতে হলে ট্রেন লাইনে উঠতে হবে।
নজরুল বলল, উঠতে পারবেন তো?
রহমতুল্লাহ মাথা নাড়িয়ে উঠতে গিয়ে দ্যাখেন অনেক চড়াই। আকন্দ আর ধুতুরা ঝোপে ঢাকা উচু লাইনের ডান দিকে রহনপুর, বা দিক সোজা বর্ডারে চলে গেছে। সাতচল্লিশের আগে এদিক দিয়ে নিয়মিত ট্রেন চলাচল করত। পাকিস্তান হবার পর সব বন্ধ। কিন্তু এখন ট্রেন লাইন পাতা আছে। বৃটিশদের স্বাক্ষর বহন করছে এটা। লাইনের দু’পাশে আখ ক্ষেত ঘন হয়ে ছড়িয়ে আছে বহুদুর। মবির বলল, কিছু জানেন চাচা?
: কী?
: ক্যাল অপারেশনে যে চুনু ছিল তার কথা?
: না তো?
রহমতুল্লাহ বিস্মিত হন। চুনু ছিল কাল? বুকের ভেতর একরাশ সংশয় ঘনীভূত হতে থাকে। তাদের চুনু। যে সতেরোও পার হয়নি এখন। যার মুখে এখনও হয়তো কচি গন্ধ পাওয়া যাবে। ছেলেবেলায় তাকে আহসানের দেখাদেখি আব্বা বলে ডাকত।
হাটবারে আব্দার ধরত খোরমা আনার জন্য সেই চুনু! মাথাটা কেমন যেন তেতে ওঠে। চুনু বেচে আছে তো!
পাথরের এক টুকরার হোচট থেতেই ধাতস্থ হয়ে যান তিনি। ছি: এসব চিন্তা কেন করছেন। চুনু হারামজাদার যা খুশি হোক, তাতে তার কী। বড় বাড় বেড়েছে ছোড়াটার। একটা শিক্ষা হওয়া দরকার তার। বলে কিনা ঠ্যাং ভেঙ্গে নাকি ওপারে লিয়ে যাবে তাকে। কত বড় দুঃসাহস!
চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে রহনপুর স্টেশন দশ মিনিটের রাস্তা। দোতলা বাড়ি। এবার তিনতলা ওঠানোর ইচ্ছা আছে। তার ওপর হরদেবের রাইস মিল, ফ্লাওয়ার মিল সবই এখন তার এখতিয়ারে। অথচ কতই বা বয়স হবে ওর। আহসানের চে’ তিন চার বছরের বড় হবে। ও বাপ গাজী শামসুদ্দিন চিল চটের বস্তার সাপ্লাইয়ার। চেয়ারম্যানের বাড়িতে লোক গিজ গিজ করছে। রহমতুল্লাহকে দেখে মজনু এগিয়ে এল।
:চাচা এদিকে আসেন।
এ ঘরটা মজনুর ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহৃত হয় বোঝা যাচ্ছে। দেয়ালে বাঘের ছাল টাঙ্গানো। আরেকদিকে গাজী শামসুদ্দিনের কিস্তিটুপি পরা ফটো।
:চাচা একটা ঝামেলা হয়্যা গেছে।
ঝামেলা হয়ে গেছে মাসে! কিসের ঝামেলা। মজনু তো এমন তোতো করার ছেলে না। তাহলে এমন ইতস্তত করছেকেন! তবে কি চুনু মারা গেছে!
রহমতুল্লাহ বললেন, কী হয়্যাছে বলো তো বাপ।
:মানে ক্যালকা, বুঝলেন সারা রাত তো বুঝতেই পারছেন কী রকম অবস্থা গেছে এদিকে। মেজর সাহেব তো আজ সকাল থ্যাক্যা পারলে গোটা রহনপুরের মানুষকে খুচ্যা ম্যারা ফ্যালেন। আর এমন সময়তে কিনা…!
:কী মজনু? কী?
:মানে ত্যামন কিছু না চাচা। মানে আজ ভোরে এই গন্ডগোল ঝামেলার ভেতরে আহসান আর তার বহু আ্যাস্যা হাজির……হাজির ঠিক না। মানে জিপে কর্যা আসছিল..পথিমধ্যে মেজর সাহেবের লোকরা তাদের লিয় আনে…।
: তারপর? রহমতুল্লাহ বুঝতে পারছিলেন স্তরের পর স্ত উত্তেজনা তার মাথায় জমে উঠছে। বুকের ভেতর এক ধরণের চাপ অনুভব করছেন তিনি। আহসান! আহসান তো আসবেই। ক’দিন আর মাহতাব সরকারের বাড়িতে থাকা যায় ভার্সিটিও খুলে গেছে। তিনি নিজেও ভেবে রেখেছেন এবার ছেলে, ছেলে-বউর সঙ্গে কয়েকটা দিন কাটিয়ে আসবেন রাজশাহীতে। আর মতিউর রহমানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতও করে আসবেন। হাজার হলেও দিনকাল সুবিধার নয়।
তারপর? রহমতুল্লাহ আবার প্রশ্ন করলে মজনু বলল, তারপর মানে….আহসান আর বউমা এখন কলেজ ক্যাম্পে…..মেজর সাহেব, বুছতেই তো পারছেন চাচা…..তার ওপর আহসান ভার্সিটির টিচার। হামি অবশ্যি কহ্যাছি যে আপনার ব্যাটা..তাও মেজর সাহেব..বুঝতেই তো পারছেন….!
রহমতুল্লাহর চোখের সামনের দেয়ালটা একটু দুলে উঠল যেন। তিনি কি কিছু শুনতে পাচ্ছেন? মজনু তুমি কী কহিছো বাপ হামি কিছুই বুঝতে পারছি না। আহসানকে ক্যানে অরা ক্যাম্পে লিয়্যা যাবে? ও কি হামার ব্যাটা লয়! ও কি মোসলমান লয়! ও কি আরবি পড়তে জানে না! লুতফার সঙ্গে সঙ্গে সেও তো ভালো উর্দু কহিতে পারে। তারপরও ক্যানে অদের ক্যাম্পে লিয়া যাবে!
মজনু তার কাধে হাত রাখল। চিন্তা করিয়েন না চাচা। আজকার দিন যাক। মেজর সাহেবের রাগ কমুক। নিশ্চয় ছাড়িয়া আনা যাবে অদেরকে।
:কিন্তু আহসানকে ধরবে ক্যানে। ও তো মালাউনের বাচ্চা লয় কিংবা চুনু হারামজাদার মতন কুনিদিন মিিটং মিছিল শহীদ মিনার কর্যা বেড়ায়নি। আর লুতফা ও তো মজিদ খান সাহেবের বেটি। সাচ্চা বিহারীর বাচ্চা। মেজর সাহেব কি বিহারী চিনে না!
মজনু এসময় একটু রহস্যময় হাসি হাসল। চাচা, হামি যখন গেনু তখন দেখনু আপনার ব্যাটার বহু মেজর সাহেবের সঙ্গে চা খাচ্ছে। হামাকে দ্যাখা চিনতে পারল না।
: আর আহসান?
: অকে দেখিনি। তবে ওখ্যানেই আছে। হয়তো ল্যাবরেটরি রুমে র্যাখ্যাছে। হাজার হলেও ভার্সিটির টিচার। বুঝেন না, মেজর সাহেবের খুব রাগ ওদের ওপরভ মজনু বাপ হামার….. হামি কী করব এ্যাখন কহো? পিস কমিটির মেম্বার হনুই বা কারয়ে গেনে। লিজের ব্যাটা, ব্যাটার বহুকে অরা ধর্যা রাখবে! অহসানের মা, ও যদি শুনে..ঠিক মর্যা যাবে। মজনু, হামি যাব। হামাকে একবার ল্যিা চলো ওখানে….।
:কিন্তু এখন ওখানে কী কর্যা যাবেন? ঘাটটাটি সব বন্ধ। মাঝিটাঝি সব পালালছে। যে কয়টা নৌকা আছে সেগালা সব আর্মির দখলে। আর তাছাড়া এখন য্যায়া মেজর সাহেবকে পাবেন না। উনি খুবই ব্যস্ত।
:কিন্তু…!
মজনু এবার বিরক্ত হলো। বলল, তাছাড়া আপনি কি ভ্যাবছেন মেজর সাহেবের কানে যায়নি যে, চুনু আপনার ভাতিজা? বলেন, কানে কি যায়নি?
রহমতুল্লাহ আর কোনও কথা বলতে পারেন না। মজনু চলে গেলে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকেন। পেটের ভেতর চিনচিনে ব্যাথাটা জানান দেয় থেকে থেকে। এখন কী করবেন তিনি? কাকে ধরবেন? কার কাছে দৌড়াবেন? আহসান, মানিক হামার। তুই ক্যামন আছিস বাপ? বুকের বা পাশটায় ভূমিকম্প অনুভূত হতে থাকে। ঘেমে যাচ্ছেন তিনি। শিগগির বাড়ি ফেরা দরকার। কিন্তু দরজাটা কোথায়? দেয়ালের বাঘের ছালটা নড়ে উঠল।
গাজী শামসুদ্দিনও যেন একটা মুচকি হাসি দিলেন ছাগল দাড়ির ভেতর থেকে। কে? ওখানে কে? ফাকা জায়গাটা, যেখানে ফ্যাকাশে আলোর পর্দা ঝুলছে, সেখানে কে যেন দাড়িয়েছে। ছায়ার মতো। রহমতুল্লাহ ঠাহর করতে পারছেন না, কে হতে পারে। মজনু নইক! কিন্তু মজনুর হাতে ক ওটা।
মজনু, মজনু। ফিস ফিস করে ডাকতে চেষ্টা করলেন তিনি। কোনও জবাব নাই। সুতরাং মজনু নয়। মজনু বেটে খ্যাটো, স্বাস্থ্যবান। আর এর ছায়া লম্বাকৃতি, কে?
মবিন নয়। নজরুলও নয়। এ অন্য একজন। মুখের কাছটায় অচেনা ছাপ। কিন্তু একটু চেনা চেনাও। রহমতুল্লাহ কেপে উঠলেন। চুনু নয়তো কিংবা তার সঙ্গী কেউ! না বোধহয়। তাহলে! তাহলে ঠিক বশিরুদ্দী। বশিরুদ্দীর বাপ সেতাব উদ্দিন। পরহেজগার মানুষ ছিল। কিন্তু তারাই বা এখানে আসবে কী করে! রহনপুর কলাবাগানে মেজর সাহেব নিজের হাতে কবর খুড়িয়ে নিয়েছেন তাদের। তারপর গুলি। তারা তো আসতে পারে না। তাহলে! তাহলে কি কুতুবুলের বড় ছেলেটা ওখানে দাড়িয়ে! কুতুবুল! কুতুবুল আলম। ভালো গম্ভীরা গায়। রেডিওতে যায় প্রতি তিন মাস অন্তর। খালি গায়ে, কেবল মাত্র পরণে লুঙি।গ আর কোমরে গামছা জড়িয়ে হতের লাঠি নাচিয়ে দিব্বি আসর জমিয়ে ফেলে। সে পালিয়েছে ইন্ডিয়ায়। কিন্তু তার বউ বাচ্চা, কিশোর ছেলেটা পালাতে পারেনি। বোয়ালিয়ায় ছিল। সব শেষ। আহসানের মা’র খালাতো বোন হতো বউটা। বেশ সুন্দর পানপাতা মুখ ছিল। ছেলেটাও মায়ের মতো হয়েছিল। বোয়ালিয়া অপারেশনের আগে তিনি আভাস পেয়েছিলেন কিন্তু ব’লে পাঠাননি কিছু। কুতুবুলের নিজের যেমন কোনও দায়িত্ব নাই, তেমন বুঝুক। দুনিয়া অত সস্তা না। তুমি ইন্ডিয়ায় বস্যা গান বাধবা, গালাগলি করবা, আর তোমার পরিবার পরিজনকে বাচিয়ে রাখার দায়িত্ব হামার গে! ছায়াটা আরেকটু সামনে এগিয়ে এলে রহমতুল্লাহ শিউরে উঠলেন। ছায়ামানুষটা মজনু নয়। কুতুবুলের ছেলেটাও নয়। ছায়ামানুষটা অকিল। নিশ্চয়ই অখিল। অকিলচন্দ্র। আবু বকরের বাপ। মুসলমান তো নয়। ঠিকমত দাহ না হলে ওদের তো আবার ভুত হবার কথা। সে তাহলে ঠিক ভুত হয়েই এসেছে। নইল মানুষ কখনও ছায়ার মতো হয়?
রহমতুল্লাহ ভয় পেলেন। প্রচন্ড আতঙ্কে তার শরীরের কলকব্জাগুলো যেন সব ভেঙ্গে পড়তে লাগল একটা দুটো ক’রে। তিনি পালাতে চাইলেন, সেই ছায়ার গ্রাস থেকে পালাতে চাইলেন কোথাও। কিন্তু কোথায় পালাবেন?