সদর দরজার পিলার ঘেঁষে নামফলক ‘বায়তুন নূর…পশ্চিম সুন্দরপুর…। সদর দরজাটা হাট করে খোলা। বুবলি আশেপাশে কিছুক্ষণ কলিংবেল খোঁজে ভদ্রতা কিংবা অভ্যাসের খাতিরে। না পেয়ে গলার স্বর যতটা উচ্চতায় পৌঁছায় ততটাই তুলে ডাকে, কেউ আছেন? ভেতরে কেউ আছেন? তার আহ্বান ভেতরের শূন্য উঠোনে হুমড়ি খায়, প্রত্যুত্তরের উৎস পর্যন্ত পৌঁছায় না ঠিকমতো। প্রত্যুত্তর না পেয়ে দ্বিধা-সংকোচ সঙ্গী করে ভেতরে ঢুকেই যায় সে। আশ্চর্য গেটের পাশে শিউলিগাছটার পাতাগুলো শোনা গল্পের মতোই এখনো সবুজ-সতেজ। শুভ্র ফুলগুলোর মাথায় কমলা মুকুট। ঠিক বাবা যেমন গল্প বলেন, নিচটাও তেমনই লালমাটির প্রলেপে পালঙ্কের টানটান চাদরের মতোই নিকানো। চারদশকে আর অন্য অনেক কিছু বদলে গেলেও গাছের পাতাগুলোর রঙ বদলানো শিখে উঠতে পারেনি। ফুলগুলোও অবিকল। কার্তিকের শেষে গাছ থেকে ঝরে পড়ার রীতি মোটেও ভুলে যায়নি। ঠিক নিয়ম করে কমলা-সাদার অপূর্ব নকশা এঁকে রেখেছে লালমাটির চাদরে।
চারপাশে চোখটা একবার বুলিয়ে নেয় বুবলি। চারদিকে বাউন্ডারি দেয়াল দিয়ে ঘেরা একতলা বাড়িটা ভেতর থেকে তালা ঝোলানো। বারান্দায় ঝুলতে থাকা ভেজা লুঙ্গি আর গামছা সাক্ষ্য দেয়, বাড়িতে মানুষ রয়েছে। কিন্তু কোথাও কারও কোনো সাড়াশব্দ নেই। নিস্তবদ্ধ চুপচাপ একলা শুয়ে থাকা একটা দুপুর। সচরাচর যেমন হয়, অস্তাচলের প্রস্তুতি নিতে থাকা সূর্যের অবসন্ন রঙ মাখা হলদেটে দুপুর, কোথাও ব্যতিক্রম কিংবা অনভ্যস্ত চঞ্চলতা নেই, দুপুরটা একেবারে দুপুরের মতো।
সূর্যোদয়ে কর্মব্যস্ত মানুষের দিন নিয়মতন্ত্রের চাকায় গড়িয়ে মিশে যাওয়ার সময়টুকু পার হওয়ার পর, সূর্যটা মধ্যাকাশে ঠিক একটুখানি জিরিয়ে নেয় পশ্চিমে হেলে যাওয়ার আগে। সময়টা কেমন ঝিমিয়ে যায় তখন। নিশব্দ নিস্তব্ধ দুপুরগুলো হঠাৎ একটু কেঁপে ওঠে কাকের তীব্র কর্কশ স্বরে, নিশব্দ নিস্তদ্ধতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাওয়ার এই দুপুরগুলো সবসময় এরকমই হয়, সর্বত্র।
বুবলি সব সঙ্গে করে নিয়েই এসেছে। ব্যাগ থেকে ছুরি আর স্টেনলেস স্টিলের ঢাকনাঅলা বাটিটা বের করে পাশে রাখে। নিকানো লালমাটিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ফুলগুলো আস্তে করে ডিঙিয়ে গাছের নিচে উপুড় হয়ে বসে মাটি খুঁড়তে থাকে সে।
ঘর থেকে বাইরে এসে এ অভিনব দৃশ্যটি দেখে হঠাৎ চমকে যায় তৌহিদ। এ রকম প্যান্ট-শার্ট পরা মেয়ে মানুষ ইহজনমে প্রথম দর্শন তার। গ্রামে তো প্রশ্নই ওঠে না, শহরে এসেও এ পোশাকের মেয়ে দেখেছে বলে তার মনে পড়ে না। তবে নিশ্চিত হয়, হ্যাঁ এ নারী, নিঃসন্দেহে নারী। পেছন থেকে মাথার চুলগুলোর কাটিংও ছেলেদের মতো হলেও তার বসার ভঙ্গি শরীরের ভাঁজ তৌহিদকে সন্দেহের ঊর্ধ্বে নিশ্চিত করে, সে নারী। অপরিচিত এই নারীর বসে বসে মাটি খোঁড়ার দৃশ্য দেখার প্রাথমিক চমক তার কৌতূহলে রূপ নেয় দ্রুত। কিভাবে মেয়েটির দৃষ্টি আকর্ষণ করবে, সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে গলায় কাশি এনে খকখক করার পুরনো পদ্ধতিই অবলম্বন করে সে। কাজ হয় যথারীতি। বুবলি ফিরে তাকায়, মাটি মাখানো ছুরি মাটিতে রেখে হাতজোড় করে মাথা ঘুরিয়ে বলে—নমস্কার। তৌহিদ নিশ্চিত হয়, এ নারী তার চৌদ্দ পুরুষের পরিচিত কেউ নয়। ভেতর থেকে কেউ একজন তৌহিদকে ডাকে—কার সঙ্গে কথা কইস তৌহিদ? বুবলির কাছে অস্পষ্ট শোনালেও, তৌহিদ ঠিক বুঝে নিয়ে প্রত্যুত্তর দেয়—চাচাজান একজন মেহমান, খাড়ান ঘরে নিয়া আসতেছি। বুবলিকে ঘরে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানায় তৌহিদ, নিশ্চয় নিশ্চয় বলে বুবলি বাটি ভর্তি করে মাটি তুলে স্টিলের বাটিটার ঢাকনা বন্ধ করে খুব যত্ন করে পলিথিনে মুড়ে সাইডব্যাগে ঢোকায়।
বড়ঘরের সামনের বারান্দায় বাঁশের পাল্লায় ঝুলে থাকা মাধবীলতার ঝোঁপ থেকে একটা বিছা টুপ করে সুজিতের পিঠে একগাদা হুল ফুটিয়ে দিয়ে মাটিতে পড়ে নির্বিকার অলস হেঁটে চলে যেতে থাকে। তীক্ষ্ণ হুলের তীব্র যন্ত্রণায় সুজিত একমাত্র গন্তব্য মা-মা করে চিৎকার করতে করতে রান্নাঘরে ঢোকে, আর পরিবারটির ভবিতব্য আমুল পাল্টে দেওয়া ঘটনাটার সাক্ষী হয়ে যায় সে। একটু আগেই কায়সার কাকাকে শিউলি গাছের নিচ থেকে চন্দন-চন্দন বলে ছোটকা’কে ডাকতে শুনেছে সে। ছোটকা’ বাড়ি নেই, কথাটা কায়সার কাকাকে জানাতেই ঘর থেকে বাইরে আসা তার। ঠিক তখনই বিছাটা হুল ফোঁটালো তার পিঠে। কিন্তু এর মধ্যে এত দ্রুত কাছারি ঘর, বড় ঘর, মাইজম ঘর পার হয়ে কায়সার কাকা কখন রান্নাঘরে ঢুকে পড়েছে, দেখতেই পায়নি সুজিত। অবশ্য এ নিয়ে ভাবনার সময় এখন নেই তার। গোল গলাকাটা স্যান্ডো গেঞ্জির ওপরে নীল আকাশের শরতের মেঘের মতো ভেসে থাকা ছোট্ট পিঠটা তখন বিছার হুলে লাল। মায়ের সঙ্গে বাসন্তী পিসি, বাসন্তী পিসির সঙ্গে কায়সার কাকাও খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ে সুজিতের পরিচর্যায়। মা ব্লেড খুঁজে গেঁথে যাওয়া লোমগুলো ছেঁচে ফেলার জন্য। পিসি গায়ের গেঞ্জিটা ভালো করে ঝেড়ে দেয়, কায়সার কাকা স্বাভাবিক স্বরে জানতে চায়—লবণডা কই বৌদি, তেলে-লবণে ঘষলে জ্বালাটা কমবে। মাইজম ঘর থেকে স্বর শুনে খেঁকিয়ে উঠে দাদু—রান্নাঘরে কেডা? বদমাইশডা? পিসি তাড়াতাড়ি একহাতে কায়সার কাকা বাবরি চুলের ঘাড়টা বেষ্টন করে অন্য হাতে কাকার মুখটা চেপে ধরে। কায়সার কাকার উচ্চতার তুলনায় বাসন্তী পিসি বেশ খাটো, কায়সার কাকা স্বেচ্ছায় পিসির হাতচাপার কাছে আত্মসমর্পণের জন্য খানিকটা নুয়ে যায় চুপ করে। দাদু পাশের ঘর থেকে চেঁচাতে থাকে—বদমাইশের ঘরে বদমাইশ। হারাডাদিন বাদাইম্যার মতো ঘুরে। বাদাইম্যার মাথাত চুলডি দ্যাখলে পায়ের রক্ত মাথাত উইঠ্যা যায়গা। বদমাইশরে রোজ কই চুলডি কাটত, হে হুনে না। আমি বাপের কথাত কাটত না। কাটবো হের রক্ষীবাহিনী বাপে ধইরা বেন্দা দিলে। হাঁফ ছেড়ে বাসন্তী পিসি কায়সার কাকার মুখটা ছেড়ে দেয়। তিনজনই মোটামুটি নিশ্চিন্ত হয়, দাদু ভেবেছে রান্নাঘরে ছোটকা। নিশ্চিন্ত হওয়ার স্বস্তি নিয়ে কায়সার কাকা বের হতে গেলেই একটা তীব্র বাঁশির সুর বড় রাস্তা পার হয়ে গলির নীরবতায় বুক চিরে শিউলি গাছের নিচ দিয়ে এসে রান্নাঘরে হানা দেয়। বাসন্তী পিসি কায়সার কাকার শার্ট টেনে ধরে পেছন থেকে। মা চট করে রান্নাঘরের বাতিটা নিভিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দেয়। সুজিত হুলের যন্ত্রণা ভুলে তটস্থ হয়ে মাকে জিজ্ঞেস করে—মা লক্ষীবাহিনী? মা হেসে দেয়—লক্ষীবাহিনী নয় রে রক্ষীবাহিনী। মায়ের ফিসফিস করা কণ্ঠে আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠা মিলেমিশে থাকে, ততোধিক উৎকণ্ঠায় বলে আবার—শোন, রান্নাঘরে যে তর কায়সার কাকা আছে, দাদুরে কিন্তু কইছ না। সেটা কি আর তাকে বলতে হবে, মনে মনে ভাবে সুজিত। কায়সার কাকার ছায়াটা দেখতে পারে না দাদু। দাদুর ধারণা ছোটকার বাবরি চুল, প্রতিদিন মিছিল মিটিংয়ে যাওয়া আর রক্ষীবাহিনীর দৌড় খেয়ে ভাড়ার ঘরে লুকিয়ে থাকার মতো বিগড়ে যাওয়া, সব কায়সার কাকার সঙ্গদোষে। সারাদিন বিড়বিড় করে দাদু—শেখের ব্যাটারে সময় দিবি না? রুশ-ভারতের দালাল কইয়া সকাল বিকাল গালি দিলেই হক্কলতা পানির মতো তরল হইয়া যাবে? বাসন্তী পিসি কায়সার কাকাকে কাঁসার বাটিতে করে নাড়কেল নাড়ু আর মুড়ি খেতে দেয়। মা গল্প জমায় দাদুর সঙ্গে, এই তো মাত্র, পাঁচ বছর হয়নি, আগরতলার শরণার্থী ক্যাম্পে কী পেট খারাপ সুজিতের—বাবা কইন, আর ভাবছি পোলাডা বাঁইচ্যা ফিরব? বাসন্তী পিসি সুজিতকে ডেকে নেন রান্নাঘরে, নাড়ু-মুড়ি খাওয়ার জন্য। এক বাটি থেকে মুঠো মুঠো মুড়ি খাবার সুখটা খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না, আবার বাঁশি বাজে, আতঙ্ক ঢুকে পড়ে আবার রান্নাঘর অবধি। ধুপ ধুপ জুতার আওয়াজ তোলে ছোটকা বাড়িতে ঢুকে কাছারি ঘরের দরজা দিয়ে আর কায়সার কাকা মুড়ির বাটিসমেত পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে লুকিয়ে থাকে পুকুরপাড়ের কলাগাছের ঝোঁপে।
তৌহিদ জানতে চায়—কিন্তু খাইবাইন তো দিদি? অবশ্যই অবশ্যই কেন নয়। উত্তরটা জানিয়ে বুবলি জানতে চায়, তৌহিদের পরিচয়। আমি এই বাড়িত আছি চাইর বছর—তৌহিদের উত্তরে স্পষ্টই পরিচয়টা বুঝে নেয় বুবলি। বোধ করি জলখাবারের প্রস্তুতি নিতেই ভেতরে ঢুকে যায় সে। একা ঘরে বুবলি সোফা ছেড়ে ফ্যানের নিচে রকিং চেয়ারটাতে বসে বাইরেটা স্পষ্ট দেখতে পায়। দেয়াল ঘেঁষে দুই/চারটা বিচ্ছিন্ন সুপারি গাছ বড় বিরক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, গাছগুলোর নিচে দীর্ঘক্ষণ না কাটা মধুক’পী ঘাস, অযত্নে অবহেলায় জটলা পাকিয়ে আছে। পুকুরটা ঠিক কোনদিকে ছিল, চারদিক তাকিয়ে চিহ্নিত করতে পারে না বুবলি। ট্রে ভর্তি করে কেক আর চা নিয়ে ঘরে ঢুকলে হঠাৎ বুবলির মনে পড়ে কেউ একজন ভেতর থেকে তাকে ডেকেছিল না? কই তার সঙ্গে তো দেখা হলো না এখনো! ভদ্রতার সীমা রেখে জানতে চায় সে, বাড়িতে কে কে থাকেন? কেউ থাকঅইন না—একগাদা হিসাব দিতে থাকে তৌহিদ, বড় ভাইয়া, মেজোভাইয়া, ছোটভাইয়া সবাই বাইরে বাইরে, কেউ ঢাকায়, কেই চিটাগাং, লন্ডন-আমেরিকায়ও কেউ কেউ। বুবলি হেসে ফেলে, সে যাকে খুঁজছে তার নাম এ তালিকায় নেই। স্পষ্ট করেই জানতে চায় এবার—তখন আপনাকে কেউ ভেতর থেকে ডাকলো। অ বড় চাচা—তৌহিদের হাবভাব সুস্পষ্ট বুঝিয়ে দেয় তার খুব আগ্রহ নেই এই বড় চাচা সম্পর্কে বলার। চা ঠাণ্ডা হইয়া যাইচ্ছে খাইন খাড়া…, বড় চাচার প্রসঙ্গ ঘোরানোর কৌশল হিসাবে চা খাবার তাড়া দেয় সে। বুবলি তার কৌশল ধরতে পেরে মনে মনে হাসে—উনার সঙ্গে দেখা করা যাবে একটু? ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছিল তৌহিদ। সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকা, প্যানে পায়খানা প্রস্রাব করা মানুষটাকে তুলে হুইল চেয়ারে বসিয়ে এ ঘর পর্যন্ত নিয়ে আসার ঝঞ্ঝাটটা কত কঠিন, তা সে ছাড়া আর কে বুঝবে? আজ চার-চারটা বছর এই লোকটির সঙ্গে। তৌহিদের বিরক্তি বুঝে নিজেকে নিবৃত্ত করে বুবলি, কী দরকার তাকে এতটা বিরক্ত করার? চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে তৌহিদকেই জিজ্ঞেস করে বুবলি—আচ্ছা পুকুরটা কোনদিকে ছিল আপনি জানেন? তৌহিদ আঙুল তুলে দেখিয়ে দেয় বাম দিকের হাইরাইজ বিল্ডিংগুলো। নিজে তো আর জলাশয়টা দেখেনি বুবলি। সবটাই বাবা আর পিসি ঠাম্মার মুখে শোনা গল্প। টলটলে জলে শাপলা ফোটা, পাড় ঘেঁষে বসে বসে ছিপ দিয়ে মাছ ধরা, সাঁতারে স্বচ্ছতোয়া জল এফোড়-ওফোড় করা। এখন এই সারিবাঁধা হাইরাইজ বিল্ডিংগুলোর বারান্দায় থমকে থাকা নিঝুম দুপুর, বন্ধ দরজার ভেতরে হয়তো কত নাগরিক গল্প, নাগরিক সব সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে আবশ্যিক অনুষঙ্গ জীবনের অস্থিরতা। বারান্দায় ঝুলে থাকা কাপড়ের সারি, কোণায় ঠেস দিয়ে রাখা ঝাড়, ঝুলে থাকা, দাঁড়িয়ে থাকা ফুলের টবগুলো কেউ কী জানে এই যে তাদের আশ্রয় হাইরাইজ বিল্ডিংগুলো; এর নিচে কোনো একদিন টলটলে এক দিঘি ছিল! দিঘির জলে মিশে ছিল কত স্মৃতি আর ইতিহাস!
সাঁতার কেটে পুকুরের এপাড়-ওপাড় করে কায়সার কাকা আর ছোটকা। বাঁধানো ঘাটের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বেয়াড়া দাঁড়ানো ভেজা চুলগুলোকে গামছা দিয়ে শাসনের ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাসন্তী পিসি। সুজিতের দৃষ্টি সরাসরি মধ্যপুকুরে আর বাসন্তী পিসির আড়চোখ। দুজন টগবগে তরুণের সাঁতারের প্রতিযোগিতার দুরন্ত ঝাপটায় কেঁপে উঠছে পুরো পুকুর। সদ্য স্বাধীন দেশে স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণায় বিভ্রান্ত কিন্তু হাল না ছাড়া স্বপ্নবান তরুণ দুজন। সুজিত সেদিনের পর থেকে ঠিক জানে বাসন্তী পিসি কখন তাকে নিয়ে স্নান করাতে আসবে পুকুরে। কিন্তু ছোটকা জানতো না। আজ হঠাৎ বাসন্তী পিসির গায়ে দুই আঁজলা জল ছিটিয়ে ছোটকাকে তা বুঝিয়ে দেয় কায়সার কাকা। বাসন্তী পিসি দৌড়ে পালিয়ে যায় সুজিতের হাত ছেড়ে দিয়ে। সুজিতের সামনে ক্ষেপে ওঠে ছোটকা। প্রিয় বন্ধুর সমর্থনই প্রত্যাশা ছিলো কায়সার কাকার। কিন্তু বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় একদম চুপসে যায় সে। সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে উঠতে সুজিত শুনতে পায়, ছোটকার ক্ষুব্ধ স্বর পুকুরপাড়ের সিঁড়িতে আছড়ে পড়ে খানখান শব্দে। শান্ত হয় না। অনেকদূর গড়িয়ে যায়। দুজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মাঝে বাসন্তী পিসি এক যোজন যোজন দেয়াল তুলে দেয় সে দুপুরে।
সেই দূরত্ব কেমন আলোকবর্ষ দূরত্বে পরিণত হয়ে অসম্ভব গন্তব্যে হুমড়ি খায় সেদিন, যেদিন সুজিতের হাত থেকে কাগজের চিরকুটটা উদ্ধার করে ছোটকা। কায়সার কাকাদের পেয়ারা বাগানটা তাদের বাড়ির ঠিক পাশে। পুরো বর্গাকার জায়গাজুড়ে অনতিদীর্ঘ পেয়ারার গাছগুলোতে ঝুলে থাকা গোটা গোটা পেয়ারা। ভেতরটা আবির লাল আর ভারি মিষ্টি খেতে। এ বাড়ি ও বাড়ির উঠোনে সাথীদের সঙ্গে কোনো বিকেলে ফুটবল, কোনো বিকেলে দাঁড়িয়াবান্ধা খেলা শেষে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার আগে আগে প্রায়ই সবাই হানা দিত কায়সার কাকাদের পেয়ারা বাগানে। যদি পাহারাদারদের সতর্ক দৃষ্টি এড়িয়ে একটা দুটো পেয়ারা পাওয়া যায়! সুজিতের কারণে প্রায়ই ভাগ্যের শিকে ছিঁড়ে যেত তাদের। কায়সার কাকা একটা কাগজের খাম ধরিয়ে দিয়ে, কাউরে কিন্তু দেখাইবি না একবারে বাসন্তীর হাতে, বলে গোটাকয়েক পেয়ারা গুঁজে দিতো হাতে। সাথীরা সবাই ভাগ বাটোয়ারা করে খেতে খেতে বাড়ি ফিরতো। বাসন্তী পিসির হাতে খামখানা দিতেই বাসন্তী পিসি কেমন একটা অচেনা রঙে রঙিন হয়ে একঝাঁক চালে ঝর্ণার মতো নেমে আসা চুল পিঠ থেকে তুলে দুহাতে পেঁচিয়ে, খামটা নিয়ে লুকিয়ে যেত বড়ঘরের পেছনে বারান্দায় কোনায়। যার পেছনে আর যাওয়ার জায়গা নেই। টলটলে জলের দিঘিটার একটা প্রান্ত এখানে এসে থেমে গেছে। এখানে এসে থেকে গেছে পুকুরের অবিরাম সব স্রোত। ভর সন্ধ্যায় সাঁতরানোর ঢেউও তখন আর ধাক্কা খায় না এখানে, সন্ধ্যাকে আহ্বান করে ঝিঁ ঝিঁ পোকারা ডেকে ওঠে নিঝুমতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে। সুজিত লক্ষ করে, অচেনা রঙে হওয়া বাসন্তী পিসি কেমন কাগজখানা মুঠোতে ধরে উদাস হয়ে যায় একটু পরই। তার দু গাল বেয়ে অশ্রুর ধারা কিছু শুকিয়ে কিছু বড় মমতায় টপটপ নেমে যায় দিঘির জলে, মিশে যায়।
সেদিন বাড়ি ঢুকতেই ছোটকা চোখ রাঙায়-তোর হাতে কী?—বলে একটানে খামটা টেনে নেয়। একবার খামটা খুলে কাগজটায় চোখ বুলিয়ে তীব্র রোষময় আগুনমাখা দৃষ্টি সুজিতের দিকে ছুড়ে দিয়ে ঘরে ঢুকে কিছু বুঝে ওঠার আগেই থাপ্পড় লাগায় বাসন্তী পিসির দুই গালে। ঘটনাটা এখানে থেমে গেলে হতো। কিন্তু আগপাছ বিবেচনা না করে ছোটকা ঢুকে যায় কায়সার কাকার বাড়িতে। আর কায়সার কাকাকে সামনে পেয়েই এলোমেলো ঘুষিতে মাটিতে শুইয়ে দেয় একেবারে। হয়তো ঘটনা আরও দূর গড়াত, কায়সার কাকার ছোটভাই আসগর এসে বাধা না দিলে।
আসগরের জীবনে কোন বাসন্তী নেই, দুরন্ত পানিতে সাঁতার কাটা আর মাছ ধরা আবেগী দুপুর নেই। তার প্রাজ্ঞ দৃষ্টিতে ঘটনাটা পরম ধৃষ্টতা ঠেকে। কড়ির সীমান্তরেখায় দাঁড়িয়ে হুশিয়ারি দেয় সে—মালোয়ানের বাচ্চা, কত্ত বড় সাহস তর, বাড়িত ঢুইক্যা আমার ভাইরে মাইরা যাস। আমি এর শেষ দেইখ্যা ছাড়ুম। ঘরের ভেতর মার আঁচল ধরে ডুকরে কাঁদে বাসন্তী পিসি। আর দাদু আতঙ্কে কাঁপে বছর ত্রিশেক আগের এমনই এক সন্ধ্যা স্মরণে এনে। লাঠিসোটা, দা-বটি নিয়ে সেদিন তার বাড়ি ঘেরাও দিয়েছিল কেউ-পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলে। কায়সার কাকার বাপ-চাচারা বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে সেদিন বাঁচিয়েছিল তাদের।
তৌহিদ অনেকক্ষণ অবদমন করে ছিল কৌতূহলটা। ভেতরে ভেতরে অনেক হিসাব-নিকাশ করেও উত্তর খুঁজে না পেয়ে প্রশ্নটা করেই ফেলে—মাটি নিলেন আপা ডিব্বা ভইরা? ফেসবুকের কল্যাণে বুবলি জানে এদেশের বড় বোনদের আপা বলেই ডাকে ওরা। বলে—হ্যাঁ, মাটি নিলাম। বাবা আর পিসি ঠাম্মার জন্যে। তৌহিদের কৌতূহল এবার তুঙ্গস্পর্শ করে—এত জিনিস থাকতে মাডি ক্যান আপা? তৌহিদ আর বুবলির শিক্ষা আর রুচির দূরত্ব প্রায় এক পৃথিবী। তবু এই প্রশ্নটা দুই জনের ভেতরে এক আর অভিন্ন অর্থহীনতা নিয়ে থমকে থাকে। চাকরির খাতিরে কত ইউরোপ-আমেরিকা করে বেড়ায় সে, বাবা, পিসি ঠাম্মার জন্য হাল ফ্যাশনের ব্যাগ, কার্ডিগান, পারফিউম কতো কিছু নিয়ে ফিরে। আর বাংলাদেশ আসবে শুনেই তাদের দুজনের এক আব্দার। রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র ঘণ্টা দুয়েকের পথ হয়তোবা। তাদের ভিটেয় যেতে হবে। আর সে ভিটের মাটি নিয়ে আসতে হবে। কে জানে কি করবে দুজন এ মাটি দিয়ে কী সব অকেজো আবেগ!
এত কথা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই তৌহিদকে। দুজনেই হাসে একসঙ্গে তাদের অনুধাবন অযোগ্য এক আবেগের আতিশয্যে। কী মনে করে কে জানে, কিছুক্ষণের মধ্যেই তৌহিদ ভেতর থেকে হুইল চেয়ার ঠেলে তার বড় কাকাকে নিয়ে আসে বুবলির সামনে। বুবলি তাঁকে দেখে বড়ই হতাশ হয়। ইচ্ছে ছিল বয়স্ক এই মানুষটাকে জিজ্ঞেস করে অন্তত এটুকু জেনে যাবে সে কেন তার পিতৃপুরুষরা উদ্বাস্তু হতে বাধ্য হয়েছিল, একটা স্বাধীন দেশ থেকে? কিন্তু এ লোকের দৃষ্টি বলে দিচ্ছে তাকে কিচ্ছু জিজ্ঞেস করে কিছু লাভ নেই। লোকটির বামপাশ সম্পূর্ণ অকার্যকর। অকার্যকর মস্তিষ্কটাও। চোখের উদভ্রান্ত দৃষ্টিতে অবুঝ শিশুর সারল্য। তার কাছে জানতে চাওয়া না চাওয়া সমান। তৌহিদকেই জিজ্ঞেস করে বুবলি-উনার নামটা? কায়সার নানা, তৌহিদ জানায়। একলাফে উঠে দাঁড়ায় বুবলি। তার পায়ের কাছে হাঁটুগেড়ে বসে, বুঝি বাবা আর পিসি ঠাম্মার আবেগ এবার ইথারে ভেসে ভেসে তার হৃৎপিণ্ডে ধাক্কা দেয় হঠাৎ। চোখ অশ্রুতে ভরে ওঠে তার। কায়সার নানার পায়ে হাত দিয়ে মাথায় ছোঁয়ায় সে। কোনো ভাবান্তর নেই লোকটির। বাবা আর পিসি ঠাম্মার কাছে গল্প শোনা বাবরি চুলের টগবগে তরুণটির সঙ্গে কোনো মিল নেই অথর্ব নিষ্ক্রিয় বৃদ্ধ মানুষটির। কিচ্ছু মেলে না শোনা গল্পের সঙ্গে। তবু বাবা আর পিসির অশ্রু সে দীর্ঘদিন দেখেছে কাছ থেকে, আজ তার বোধ হয় কিছুটা দুঃখ লাঘব করে সে তাদের হয়ে এই মানুষটির কাছে, এই মাটির কাছে। পরিচয় দেয় বুবলি—নানা, আমার নাম বুবলি, আমার বাবার নাম সুজিত। পিসি ঠাম্মার নাম বাসন্তী। কোনো বিকার নেই লোকটির। নির্বাক নিরর্থক দৃষ্টি মেলে সে তাকিয়ে থাকে অজানা গন্তব্যে। বুবলির ইচ্ছে ছিল ভিটায় এসে ম্যাসেঞ্জারে ভিডিও কল দিয়ে সবকিছু দেখাবে বাবা-পিসিকে। কিন্তু কায়সার নানাকে দেখে ইচ্ছেগুলো মরে যায় তার। কী লাভ তাদের স্মৃতি আর স্বপ্নে, কল্পনা আর সত্তায় বেঁচে থাকা এক টগবগে তরুণকে হত্যা করে?
মাটির বারান্দায় চাটাই বিছিয়ে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার ‘ছাত্রসখা’ পড়ছিল সুজিত। মা আর পিসি দুজনেই বসে ছিল পাশে ভাবাক্রান্ত বিষণ্ন। ছোটকা কাল রাতে বাড়ি ফিরেনি। সারারাত উৎকণ্ঠায় কেটেছে সবার, যদিও ঘুমে তলিয়ে যাওয়ায় টের পায়নি কিছুই। টের পেতে দেওয়া হয়নি দাদুকেও। সকালে মা, বাসন্তী পিসি বাবা—সবার চোখের কোলে রাতজাগা গভীর ক্লান্তি। বাবা আবার বেরিয়েছে ছোটকার খোঁজে। এমন সময় প্রতিবেশী সমীরের উঠোন পেরিয়ে তটস্থ দৌড় থামায় মা—কী অইছে রে সমীর? কাকিমা গো দেশ আবার পাকিস্তান অইয়া গেছেগা। শেখ মুজিবরে মাইরা ফালাইছে। ওই দোকানে সবাই আলাপ করতাছে। কস কী? এক ঝটকায় সমীরকে ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে ঘরে ঢুকে রেডিও অন করে মা, শোনা যায় এক নিষ্ঠুর ভরাট কণ্ঠ—আমি…বলছি…। ঠিক তখনই বাড়ির পেছনে চালতা গাছের তলে শোনা যায়, বাবার চিৎকার—বা-স-ন্তীরে সবশেষ। সবাই দৌড়ে গিয়ে আবিষ্কার করে চালতা গাছের ডালে চন্দনের ঝুলন্ত মৃতদেহ আর গাছের নিচে সংজ্ঞাহীন বাবা।
বুবলির ফিরতে হবে। ড্রাইভার রাস্তায় দাঁড়িয়ে। মোবাইলে একটা ফোন করে তাকে, গাড়ি রেডি করার জন্য। তৌহিদের কাছে বিদায় নেয়। বিদায় নেয় কায়সার নানার কাছেও। চলে যাওয়ার সময় হঠাৎ ডান হাতে টেনে ধরেন কায়সার নানা। থমকে যায় বুবলি। তৌহিদকে ইশারায় কী যেন দেখায় বালিশের পাশে। তৌহিদ নিমিষেই বুঝে যায়। দৌড়ে নিয়ে আসে, কায়সার নানার পুনঃইশারায় জিনিসটি বুবলির হাতে দেয় তৌহিদ। একখানা কাঁসার বাটি। তৌহিদ বৃত্তান্ত বলে, পুকুরটা ভরাট করার সময় পানি সেচলে অন্য অনেক জিনিসের সঙ্গে এই বাটিটাও পাওয়া যায়। বাটিটি পাওয়ার পর কায়সার নানা আর হাতছাড়া করেননি এটি। তিনি এবার ইশারা করেন বুবলিকে এটি নিয়ে যাওয়ার জন্য। বুবলি বাটিটি উল্টে দেখে, তাতে তার পিতামহের নামাঙ্কিত ‘যদুবিহারী’। চট করে একটা আতঙ্কিত সন্ধ্যা একবাটি মুড়ি আর নারকেলের নাড়ুর গল্প তার সামনে দিয়ে মন্থর পায়ে হেঁটে যায়।