বাবা যখন যুদ্ধে যায়নি তখন আমাদের তিনটা মহিষ ছিল। মা মহিষটার একখানা স্বাস্থ্যবান বাছুর ছিল। আমার চেয়ে বেশ উঁচু। ধূসর আর কালোতে মেশানো সেই মহিষের বাচ্চাটার চোখে কাজল; কানের ডগায় যেন-বা নিশি ডাকছে; পিঠের ওপর কুমার-জলের পরশ। ভর দুপুরে আমি হাঁটতে থাকতাম মহিষবাছুরের সাথে। তাবিজ করেছিল আমাকে। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতাম ওর বুকের পশমে। অবাক কাঁপিয়ে নিয়ে কালো চামড়া, তাড়িয়ে দিতো নিশিপোকা। ওর মা ছিল আমারও মা। ও যত দিন ওর মায়ের দুধ খেয়েছে তার চেয়েও বেশি দিন ওর মায়ের দুধ খেয়েছি আমি।
সে ছিল আমার মহিষভাই, দুধভাই। মেজো কাকা ওর নাম দিয়েছিল হাড়িয়া। কেন এই নাম, জানি না। জানার চেষ্টাও করি নাই কোনোদিন। তবে একথা ঠিক হাড়িয়াসহ হাড়িয়ার বাবা আর হাড়িয়ার ধুমসো ভাইকে নিয়ে আমাদের বাবা মাঠে যেতো। তখনো আমরা ঠিক যুদ্ধ বুঝতাম না। সকাল-সন্ধ্যা হালচাষ শেষে বাবা নেমে যেতো কুমার নদের প্রশান্ত জলে; মহিষগুলোকে পয়পরিষ্কার করিয়ে সন্ধ্যার আগ দিয়ে মহিষের পেছন পেছন বাড়ি ফিরে আসতো। মহিষপরিবার আমাদের বাবাকে ভয়ানক যন্ত্রণা দিতো। সারাদিন মাঠে হাল ঠেলা শেষে বাবার শরীরে তখন আর কোনো সংগীত অথবা ক্রোধ অবশিষ্ট থাকতো না। অথচ মহিষেরা জল থেকে উঠতে চাইতো না। নাক উঁচু করে সমস্ত শরীর জলের নিচে ডুবিয়ে যেন-বা ধ্যানে বসতো ওরা। সেইদিন বাবা সন্ধ্যার বেশ কিছুটা আগ দিয়ে মহিষপরিবারসহ কুমারের তীরে দাঁড়িয়ে।
এই লেখাটির কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে যদি আপনি মনে করেন এখানে নির্দিষ্ট একটি চরিত্র থাকবে আর সেই চরিত্রের থাকবে একটি নির্দিষ্ট ধর্ম, নির্দিষ্ট ঠিকানা; চরিত্রটির থাকবে নির্দিষ্ট পিতা অথবা মাতা; অথবা আপনি যদি ভেবে থাকেন চরিত্রটি একটি বিশেষ সময়ের ভেতর আটকে থাকবে, তা হলে আপনি ভুল করবেন। মানবজীবন আমার অথবা আপনার একার নয়। এই জীবন আমাদের লাভ করতে হয়েছে সাড়ে চারশ কোটি বছরের ধারাবাহিকতায় ক্রমবিবর্তনের পথে লড়াই করে। সুতরাং আপনি যদি আপনাকে দেখতে চান তাহলে এই সাড়ে চারশ বছরের ভেতর থেকে বহুকে দেখুন; শুধু নিজেকে নয়।
দান্তে তেরো শতকে ‘ভিটা নোভা’ লেখার পর নিজের ভেতর থেকে বহুকে দেখার তাড়নায় আতঙ্কগ্রস্ত। তিনি সময়ের ধারণাকে ভেঙে অতীত-বর্তমান এমনকি ভবিষ্যত পরিভ্রমণে লাভ করেছিলেন বহুস্বর। এই বহুস্বরের প্রকাশ ঘটাতে গিয়ে তাকে লিখতে হয়েছিল ‘লা ডিভাইনা কমেডি’। চিরায়তকে দেখার বাস্তবতা থেকে যে ধ্রুপদি চোখ তিনি অর্জন করেছিলেন সেই চোখের সন্ধানে যখন প্রচল পথে অগ্রসর হতে হয় তখন আমরা সন্দেহবাতিকে কেঁপে উঠি। আমরা ফিরে আসতে বাধ্য হই প্রচল থেকে অপ্রচল পথে। লেখার সীমানাকে প্রচল আঙ্গিকের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে ছেড়ে দিতে চাই মানবজীবনের সমান্তরালে, বিরামহীন।
বাস্তবতা তো আমার আপনার একার নয়। যৌথের সাধনায় অর্জিত এই বাস্তবতা। যৌথের পরম্পরায় পাওয়া যেতে পারে ‘সার্বিক’। যা সার্বিক তা হয়ে উঠতে পারে মানবিক। যদিও এখনও এটি একটি মনোসামাজিক স্বপ্ন মাত্র। তারপরও এ কথা ঠিক প্রাণিকূলে মানুষই একমাত্র জীব, যে কিনা স্বপ্ন দেখার যোগ্যতা রাখে এবং তা বাস্তবায়নে অগ্রসর হয়। মানুষই একমাত্র জীব, যে স্পর্শের ভাষা বুঝে নিতে জানে। মানুষই ভালোবাসতে জানে, ভালোবাসতে শেখায়। মানুষই কাঁদে এবং কাঁদায়।
নির্দিষ্ট ফরমেটে চিন্তাকে আটকে রাখা সম্ভব নয়। আর আমরা এই চিন্তাকে যখন লিখে রাখতে চাই তখন তা ফরমেটকে অস্বীকার করতে চায়। এই ফরমেটকে অস্বীকার করতে গিয়ে আমার অথবা আপনার কোনো নির্দিষ্ট পরিচয়, নাম, সাকিন অথবা ব্যক্তিচরিত্র থাকা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে হতে পারে পৃথিবীর তাবৎ পথের পথ-প্রদর্শকরা আমাদের পিতা। পৃথিবীর তাবৎ শান্তিকামী রমণী আমাদের মাতা। মায়াকাতর ফুলেরা আমাদের বোন। হরিণেরা আমাদের ভাই। পাহাড়ের চূড়া, সবুজ প্রান্তর, ভেড়ার পশমের ভাঁজে লুকিয়ে থাকা উষ্ণতা, বলছি আবার, এই পৃথিবী আমাদের মা। আমরা এই মায়ের সন্তান।
যারা এই বিষয়টিকে অতিকাল্পনিক বয়ান হিসেবে একটি নির্দিষ্ট সীমানায় আটকে রেখে তর্কে নেমেছেন শুধু তাদের নয় বরং সবাইকে বলছি, আসুন আমরা নিজের ভেতর থেকে বাইরে এসে পৃথিবীটাতে ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করি। যে পৃথিবী শুধু আমার অথবা আপনার নয়। যে পৃথিবী শুধু অতীত অথবা বর্তমানের নয়। যে পৃথিবী অনন্তের। এই অনন্তের পৃথিবীতে আমি অথবা আপনি ‘চিরায়ত যৌথ’ মাত্র। আমরা অর্জন করতে চাই যৌথের চেতনা। যৌথের চোখ।
রাতজাগা পোকাগুলো কেবলই ঘুরে ফিরে আগুনের উষ্ণতায় ফিরে আসে। হয়তো পুড়ে যেতে চায়। আগুনের আলোয় আলোকিত হতে চায়।
আলমডাঙার আকাশে যৌথের চোখ। যৌথের আলো। আলোর প্রতিভা। সন্ধ্যাতারার শরীরী সংকেত। ঘঁষা খাওয়া চাঁদ ভাসছে নিথর। এক ঝাঁক রাতগন্ধ ডাকছে। শিশুকালকে ডাকছে। মাথার গভীরে জেগে উঠতে শুরু করেছে শিশির পোকাদের মিহি শব্দ। চালের ওপর রাতশিশির ঝরছে। কেউ সেই পার্থিব শিশির ঝরার শব্দ শুনতে পায় না। শুনতে পায় না শিশির পোকাদের ক্রন্দন। অন্ধকারের শরীরে আঁধার-কালো বাতাস ঝুলে আছে নিরিবিলি। এক টুকরো সন্ধ্যাতারা এক আকাশ সমান শূন্যতা বুকে নিয়ে কুমার নদের ওপারে খসে পড়তেই সাতটা সাদা ঘোড়া হ্রেষারবে উড়াল দেয়। পরিরানির পাখায় ভাসতে থাকি। চারধার মেঘ। পরিচিত মেঘেদের দেশ। পরিরানি আমাকে ছায়াপথের ওপর বসিয়ে একটা এক চোখওয়ালা তারা খসিয়ে আনতে সেই যে গেল, আর ফিরে এলো না।
আমরা ঘুমের ভেতর কাঁদছি। ফেলে আসা কৈশোরে শুকতারা হাতে পরিকন্যার চোখ ছুঁতে চেয়েছিলাম। বাজিতপুরের আকাশে এখন কোনো পরী নেই। কুমার নদ। প্রশান্ত। নীরব বাঁশঝাড়। ওপারে ঝাউবন। তিনটি সাদা বক উড়ছে। লম্বা গলা বাড়িয়ে ভূমি খুঁজছে। কাদাজলের ওপর স্বচ্ছ জল। শিরশির বয়ে চলেছে সেই জল। সেই জলের গায়ে গা এলিয়ে দলছুট পুঁটিমাছ ভেসে চলেছে। তিনজন বক পাখির একজন দেখতে পেয়েছে জলেভাসা পুঁটি। শুয়ে আছি রূপকথার ভেতর। শতাব্দীর ওপার থেকে জেগে ওঠা উপন্যাসের পাতায় শুয়ে আছি আমরা। কুমার নদের গভীর থেকে ক্রমশ ভেসে উঠতে শুরু করেছে জলে ভেসে যাওয়া মহিষের দীর্ঘশ্বাস। বাবা তখনো যুদ্ধে যায়নি। কোন যুদ্ধে, কবে, কেন গিয়েছিল বাবা? এতগুলো প্রশ্নের জবাব আমরা এখনো খুঁজছি। সবকিছু ঠিকঠাক বুঝতে শিখিনি আজও। তারপরও ছুঁতে চাই যৌথের বাস্তব। বস্তু-অতিরিক্ত ধারণা শূন্যতা মাত্র। শূন্যতার অর্থ অজ্ঞতা। অবিদ্যা। অবিদ্যাকে অস্বীকারের অর্থ, ক্রমশ মানুষ হয়ে ওঠা।
ক্রমশ মানুষ হয়ে উঠতে গিয়ে আমরা ফিরে যাই আমাদের ফেলে আসা অতীতে। আদতে এই ফিরে যাওয়ার তাড়না এক ধরনের বিপাকক্রিয়া, যা থেকে আমাদের মুক্তি নেই। এই ফিরে যাওয়ার ভেতর দিয়ে আমরা আমাদের জাস্টিফাই করি। যেমনটা করেছিলেন আহমদ রফিক উনিশশত সাতচল্লিশ সালের চোদ্দো আগস্ট তাঁর গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহুকুমার নবীনগর থানার শাহবাজপুরে ফিরে গিয়ে। তখন তাঁর বয়স আঠারো। তারপর আশি বছর পার করে তাঁকে ফিরে দেখতে হয়েছিল দেশবিভাগ। অনিবার্য তাড়নায় তাঁকে লিখতে হয়েছে, দেশবিভাগ: ফিরে দেখা। বিশ শতকের ওপর দাঁড়িয়ে অতুল সুরকে লিখতে হয়েছে, চোদ্দ শতকের বাঙালি। একুশ শতকের ঘোড়ায় সোয়ার হয়ে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতো আমাদের ভাবতে হচ্ছে, বাঙালির জাতীয়তাবাদ, দ্বি-জাতিতত্ত্বের সত্য-মিথ্যা অথবা রাষ্ট্রের মালিকানা নিয়ে। এই যে সময়ের মর্মার্থ উদ্ঘাটনের চেষ্টা, এই যে সভ্যতার সূচক-বিন্দুসমূহ বহুর ভেতর থেকে দেখার প্রচেষ্টা, এই প্রচেষ্টার নামই অহম। অহমের অপর নাম জীবন। জীবনের আরেক নাম মানুষ। মানুষ অর্থ, যৌথের চোখ। আসলে মানুষ নিজের জীবনকে যাপন করে না। যাপন করে অপরের জীবন। যাপন করে স্বপ্ন। আপনি তো নিজেকে যাপন করছেন। অথচ আপনি যদি অপরের সময়কে অপরের সঙ্গে যাপন করতে চান, তখন?
সেইদিন সন্ধ্যার বেশ কিছুটা আগ দিয়ে বাবা মহিষপরিবারসহ কুমারের তীরে দাঁড়িয়ে। নদের ঢালুতে আসতেই হাড়িয়া অপার্থিব চিৎকারে ছুটে গেল দূরে। আর তখন দুর্বোধ্য উচ্চারণে গোপালকৃষ্ণ গোখলে ঘোষণা করলেন, ‘হোয়াট বেঙ্গল থিংকস টুডে, ইন্ডিয়া থিংকস টুমরো।’ বাঙালি মহিষজাতি তখন নবজাগরণের তাৎপর্য উদ্ধারের পাশাপাশি জলের গভীরে দেখতে শুরু করেছে অশুভ দৈত্যের ছায়া। আমাদের নির্বোধ আহম্মক বাবা সেই অশুভ দৈত্য দেখতে পেলো না; অবলা পশুগুলোই শুধু বুঝতে পারলো কেমন সেই আতঙ্ক। গভীর কালো অন্ধকার জলের নিচে লুকিয়ে রয়েছে রাক্ষসরাজ। অথচ বাবা ছুটে গিয়ে লাঠির আঘাতে মহিষপরিবারকে জলে নামিয়ে দিতেই একটা ভয়ঙ্কর আলোড়ন তুলে মহিষভাই দুধভাই হাড়িয়া সেই যে জলের গভীরে তলিয়ে গেল, তারপর এক ঘণ্টা যায়, দু ঘণ্টা যায়, অন্ধকার ধেয়ে আসতে থাকে দূর-ব্রিটিশ বন্দর থেকে। আর এই ফাঁকে অন্ধকারের কবর থেকে মাথা উঁচু করে মধ্যপ্রদেশের চিফ কমিশনার স্যার অ্যান্ড্রু ফ্লেজার নীরব চিৎকারে কাঁপিয়ে দিলেন গোটা বঙ্গদেশ, বাংলাকে কেটে দুখণ্ড করে ফেলো। দুখণ্ড।
সন্ধ্যার আগ দিয়ে তখন আমাদের জেঠুমশাইগণ বিষ্যুদবারের হাট থেকে ফিরছিলেন। সেই হাটফেরত প্রদোষলগ্নে ব্রিটিশ ক্যানালের উত্তর সিথানে দেখা দিলো, আমাদের সেই জলেডোবা মহিষভাই দুধভাই হাড়িয়ার দেহের পেছন অংশ; অন্ধকার, ফোলা ফোলা থকথকে দৈত্যদংশিত। এই ঘটনারও অনেক অনেক দিন পর, যখন আমরা ভুলতে বসেছি হাড়িয়ার কথা তখন আমাদের বাজিতপুরের পেছনে কুমার নদের দক্ষিণ সিথানে আমাদের সেই দুধভাইয়ের সম্মুখ অংশ কালো জলের গভীর থেকে উঁকি দিতে শুরু করেছে। ততদিনে কুমারের জল গভীর কৃষ্ণকায়। আমরা ভয়ে অন্ধকারের ভেতর নামি না। আমরা অবিশ্বাসে ঘৃণায় সেই জলের শরীর ছুঁয়ে দেখি না। আর এই সুযোগে সাহেবদের রেকর্ডে টাইপ হতে থাকলো, ডাকাতির বিবরণ, স্বদেশি ডাকাতরা সংগ্রহ করেছে সাত লক্ষ মুদ্রা। আমাদের বাপচাচা জেঠুমশাইরা তখন রামচরণ মশাইয়ের গ্রামোফোনে শুনতে থাকেন, একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি; আসি আসি পড়বো ফাঁসি।
এই গানের অনেক আগেই ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয়ে যায়। কলকাতার প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডের পরিবর্তে আইনবিদ কেনেডির স্ত্রী-কন্যার গাড়িতে নিজেদের তৈরি বোমা ছুড়ে মারার সময়ে ক্ষুদিরামের সঙ্গে থাকা প্রফুল্ল চাকী ধরা পড়ে। লড়াকু প্রফুল্ল চাকী অন্ধকার দৈত্যকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজের দেহকে প্রাণহীন অমীমাংসিত সংকেতে ছুড়ে মারে গোটা ব্রিটিশ-ভারতের আকাশে। অথচ আজ এতদিন পর, কেনো বুঝতে পারছি না সেই আত্মাহুতির অর্থ! কী সেই সংকেত?
এই যে রক্তপাত, এই রক্তপাতের সঙ্গে আমাদের বাপদাদার ধানচাষের মর্মার্থ অথবা আমাদের মহিষভাই দুধভাইয়ের সঙ্গে জলের গভীরে লুকিয়ে থাকা রাক্ষসের লড়াই কতটা দীর্ঘ হতে থাকবে, এই প্রশ্ন কেউ তোলে না। ততদিনে যেখানে আমাদের মহিষভাই দুধভাইয়ের খণ্ডিত পেছনদেহ ভেসে উঠেছিল সেই স্থানটির নাম হয়ে গিয়েছে মহিষবাথান। অথচ কেউ কোনোদিন শোনেনি সেখানে কখনো কোনো মহিষের খামার ছিল কি না। আমাদের পুরোনো পিতাগণ যখন জীবিত ছিলেন তখনো শোনা যায়নি কোনো মহিষবাথানের গল্প। বরং আমাদের গাঁয়ে যে মহিষপরিবারগুলো ছিল তারা ছিল আমাদের মা, আমাদের বাবা আর আমাদের মহিষভাই মহিষবোন, দুধভাই দুধবোন।
তখন ছিল আমাদের চারচালার মাটির ঘর। দাদিমার একমাত্র পুত্র আমার বাবা। তারও আগে আমার বাবা যখন দাদিমার পেটে, তিন মাসের; তখন আমার দাদার হয়েছিল কালাজ্বর। আগস্ট বিপ্লব তখনো শুরু হয়নি। জিন্নার সাম্প্রদায়িক জাহাজে একে একে সবাই জায়গা করে নিতে শুরু করেছে। সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, কামরুদ্দিন আহমদ, যুবক শেখ মুজিবুর রহমান কেউ বাদ যায় না। আসাম পূর্ববঙ্গ আর পশ্চিমবঙ্গ অনেক আগেই দুটুকরো। পূর্ববঙ্গ এবং পাঞ্জাবের ওপর মুসলিম লীগের ধর্মের জাদু ক্রমশ ধুলো ওড়াতে শুরু করেছে। যদিও উনিশশত সাতচল্লিশের প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগ মুসলমান আসনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে ব্যর্থ হয়েছে। তারপরও আমাদের সেই বাজিতপুরের দ্বিখণ্ডিত মহিষের কালো চামড়া কেটে কায়েদে আজম জিন্না পোশাক পালটিয়ে অসাম্প্রদায়িক কৃষক প্রজা পার্টির বাঘের পেছনে গেঁথে থাকলো। বাংলায় তখন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নিয়ন্ত্রণে প্রগ্রেসিভ কোয়ালিশন ফ্রন্টের সরকার। ঠাকুরদা যখন কালাজ্বরে মারা গেলেন জিন্নার মুসলিম লীগ তখন ঠাকুরদার শ্মশানভস্ম পায়ে ঠেলে কালাজ্বরের বিপরীতে, কংগ্রেসের বিপরীতে ব্রিটিশ রাজের ‘ভাগ করো শাসন করো’ ফরমুলায় জল ঢালতে শুরু করেছে।
অনেক দিন আগে, তখন আলমডাঙ্গার একমাত্র রাস্তাটা পাকা হয়নি। খোয়া বিছানো। বটতলাকে ঘিরে প্রতি বিকেলেই মেলা বসতো। বুড়ো পাকন গাছের গুড়িতে প্রতি সকালে বাজিতপুরের বউয়েরা খালি পায়ে হেঁটে এসে সিঁদুর দিয়ে যেতো। কুমারী ইউনিয়নের রায়বাড়ির বৃদ্ধা নর্তকী তখনো বেঁচে ছিল। কুমার নদের ওপর কেবলই ব্রিজ বাঁধবার আয়োজন। বসে আছি কুমারের উঁচু পার ঘেঁষে। দু-একটা করে আকাশের তারা খসে পড়ছে। কুয়াশারা ঝাঁক বেঁধে উড়ে এসে সবকিছু ভিজিয়ে দেয়। চাঁদটা ঝাপসা হয়ে আড়াল নিতে থাকে। চোখের পাপড়িতে বাতাস এসে চুমু খায়। পায়ের পাতায় ভেজা ঘাসেরা কেঁপে কেঁপে ওঠে।
এই সেই বাঁশবাগান যার নিচে শুয়ে ছিলেন আমার দাদিঠাকুরণ। এই সেই বাঁশঝাড় যার নিচে শুয়ে রয়েছি আমি। শুয়ে রয়েছে আমার শিশুকাল। এই সেই বাঁশবাগান যেখানে পরিকন্যাদের মিহি কথার মৃদু-শীতল হাওয়া আমার চোখেমুখে মায়া ছড়িয়ে দিচ্ছে। কেমন এক সম্মোহনী জাদুর ছোঁয়ায় তাকিয়ে রয়েছি ঝাঁকঝাঁক মায়াপরির দিকে। বাবলা গাছগুলো দাঁড়িয়ে থাকে, পাহারা দেয়, যাতে দিনের আলো এসে রাতের মায়াকে তাড়িয়ে না দেয়। গঙ্গাদের বাড়ির লজ্জা পাওয়া ছোট্ট প্রদীপটা অধৈর্য বুকে চেপে নিবে যায়।
দূরতম মেঘের দেশ থেকে এক দিন একটা চিঠি ভেসে আসে। গঙ্গাদির চিঠি। আমি তখন নর্থব্যাঙ্গল ইউনিভার্সিটির ছাত্র। গঙ্গাদিরা কুচবিহারের মাথাভাঙায় থাকে। চিঠির অক্ষরগুলো শরীরী চিৎকারে কেবলই ডাকতে থাকে আমাকে। তারপর এতদিন পর মাঝ বয়সে এসে বুঝলাম কান্নার সৌন্দর্য তুলনাহীন। গোপনচারী কান্নাগুলো যদি দেখে ফেলে আপনজন। মনে হয় ছুঁয়ে দেবো। অথচ অক্ষম আমি। ভাষা দেবার কী দুর্মর আকাক্সক্ষা। আজ এতগুলো বছর পর কেনও ফিরে এলাম দাদাঠাকুরণের পোড়া ভিটেয়? রাতজাগা পোকাগুলো কেবলই ঘুরে ফিরে আগুনের উষ্ণতায় ফিরে আসে। হয়তো পুড়ে যেতে চায়। আগুনের আলোয় আলোকিত হতে চায়।
উনিশশত সাতচল্লিশটি কবুতর বাপদাদার ভিটে ছেড়ে উড়াল দেয়। উড়তেই থাকে। তারপর থেকে আর একটাও সবুজ বৃক্ষ পায় না দুদণ্ড বিশ্রাম নেওয়ার স্বপ্নে।
গঙ্গার কেবলই মনে হতে থাকে জীবনটা ভীষণ ভালো লাগার। দরজার সামনে দাঁড়াতেই মনে হল, হাঁটবে। তারপর গঙ্গা হাঁটতে থাকে। বাবলা গাছের নিচে, ভেজা ঘাস আর হলুদ নিম পাতার শরীরের ওপর গঙ্গা হাঁটছে। সব কেমন যেন একেবারে নির্জন। কেমন একটা ঘুম ঘুম আমেজ। অথচ কড়কড়ে রোদ। তবুও মনে হয় পেলব পিচ্ছিল। চকচকে তরতাজা আকাশ। মাথার গভীরে পুরোনো ছবিগুলো কেবলই নড়েচড়ে ওঠে। কৈশোরের পায়রা ডাকছে কোথাও।
বিশাল গাঢ় আকাশ। আকাশের শরীরী শরীরে মেঘেদের গায়ে লেখা আছে, নিজেকে অন্যের ভেতর বিম্বিত দেখার আনন্দ ভিন্ন রকম। পড়তে থাকি মেঘেদের শরীরে ভেসে ওঠা সেই মায়াবী লেখা। তারপর আকাশের মেঘগুলো ক্রমাগত একটা শাদা হাতির দেহে পালটে যেতে থাকলে মেঘেদের গতিশীল দেহের ভেতর কুমার নদের সাথে মাথাভাঙা আর ভৈরব মিলেমিশে একাকার। নদীগুলোকে ঘিরে সারবাঁধা মাটির ঢিবি। ঢিবিগুলোকে মনে হচ্ছে যেন এক একটা চলমান পাহাড়। হয়তো কোনও এক ভবিষ্যত প্রত্নবিদ খনন কাজ শেষে পেয়ে যাবেন আমাদের ঠাকুরদার বাজিতপুর। ভিটেপাহাড়ের পেছনে এক জোড়া সার্কাসের ক্লাউন কেবলই নাচতে থাকে। আকাশের পর্দায় সাদাকালো সিনেমা দেখছি।
মহিষের গাড়িতে চেপে তারাপিসির সাথে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম। আলমডাঙা টকিজ সিনেমা হল। তখন সিনেমা বলতে শাদাকালো সিনেমা। আজ আকাশের পর্দায় মেঘেদের শরীরে নিজেই একটা শাদাকালো সিনেমার গল্প বুনে চলেছি। সিনেমার গল্পের ভেতর গঙ্গা আমাকে পিছে ফেলে হেঁটে যাচ্ছে। স্তব্ধ দাঁড়িয়ে রয়েছি একা। গঙ্গা নিজেকে ছুঁয়ে দেখে। সেই পার্থিব ছুঁয়ে দেখার ভাষা খুব গোপনে আমার ভেতর বেড়ে উঠতে থাকে। এক ঝাঁক বাতাস ঢুকে পড়ে সমস্ত দেহে। দেহের কপাট কাঁপিয়ে মেঘেরা কেবলই ছিঁড়ে যেতে থাকে। ভেসে আসতে থাকে পাগলা কানাইয়ের কণ্ঠ, আমার এই দেহ-নদী চলতে ভারি, বাঁধলে নদীর বাঁধ মানে না, আমার এই দেহ-নদী।
দুপুরের চাঁদ। নিষ্প্রভ। সূর্যের আলোর আড়ালে রংহীন। মেঘ কেটে রোদ উঠেছে। অনেক দিন পর আশ্বিনের আকাশ ঝলমল। মাঠ পাড়ি দিয়ে রাস্তায় উঠতে গিয়ে দেখি দূরের পোড়ো বাড়িটার পাচিল ঘেঁষে ছড়িয়ে আছে আকাশ। ঝকঝকে। ফুলকপির মতো এক গোছা সাদা বিষণ্নতা, গাঢ় নীলের পটভূমিতে সাদা মেঘ; শান্ত ধীর মঠের চূড়ার মতো তাকিয়ে আছে। কেবলই তাকায়। পা আটকে গেছে ঘাসের নিশ্বাসে। অকস্মাৎ মনে উঁকি দেয় পরিচিত অনুভূতি। বনবাদাড় মাঠ ডোবা, কোথায় সে! কত পথ চলে গেছে কত দেশ দেশান্তর। শুধুই তাকিয়ে থাকি।
মাথার ভেতর গঙ্গা আর দুর্গার ছবিটা পরিষ্কার করার চেষ্টা করি। খানিক পর যেন গঙ্গাকে ছুঁয়ে দেই। বুঝতে পারি না কত যুগ ধরে আমি এখানে বসে আছি। দূরে কুমার নদের ওপারে বাবলা বন। শৈশবের সেই বাবলা বনের সবটুকুই এখন ইটের ভাটা। উঁচু লম্বা চিমনিটা দিয়ে গলগল করে কালো ধোঁয়া বেরুচ্ছে। অন্ধকার আকাশটা আরও গভীর অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। বুকের ভেতরে যেন আকাশের সমস্ত অন্ধকার আর কালো ধোঁয়া ঢুকে যাচ্ছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। উঠে দাঁড়াই। চারধার কাঁটাতার। শৃঙ্খলাবদ্ধ। বিএসএফ। বিজেপি। উদ্দেশ্যঘন।
আমার কোনো উদ্দেশ্য নেই। ছিল না কোনোদিন। সেই অমাবস্যা রাতে একটা বিশাল আক্রোশ নিয়ে ফিরে এসেছিলাম দুর্গার কাছে। তারপর থেকে চারধার শুধু জাদুকরেরা মহিষভাই দুধভাইয়ের হাড়হাড্ডি নিয়ে ঘুরে বেড়াতে শুরু করলো। জাদুর কাঠির ভয়ে জেঠুমশাই গোপনে পোড়াদহ, নাটোর, রংপুর, তিস্তা, তুষভান্ডার, বুড়িমারি, চ্যাংরাবান্ধা পার হয়ে মাথাভাঙা, চালসা, হাতিডোবা অতিক্রম করে জলপাইগুড়িতে পালিয়ে যাবার আয়োজন করতে থাকেন। শেখপাড়ার ছেলেগুলো সন্ধ্যাপুজোয় আমাদের বাগানের সারসার একতলা দোতলা তিনতলা চারতলা পাঁচতলা এমনকি ছয়তলা কবুতরের বাসাগুলো জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে চলে গেলো। উনিশশত সাতচল্লিশটি কবুতর বাপদাদার ভিটে ছেড়ে উড়াল দেয়। উড়তেই থাকে। তারপর থেকে আর একটাও সবুজ বৃক্ষ পায় না দুদণ্ড বিশ্রাম নেওয়ার স্বপ্নে।