আমি ও একটা গল্প: আকাশের ধারে বসেছিলাম আমি। তার কিছুক্ষণ আগে মাত্র বসেছিলাম নদীর ধারে। নদীর ধার থেকে উঠে এসে আকাশের ধারে বসার কিছুক্ষণের মধ্যেই নিচের দিকে চোখ গেলো আর দেখলাম, একটা গল্প মাতালের মতো হাসতে হাসতে চলে যাচ্ছে। গল্পটিকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এভাবে মানুষের অপমান নিয়ে কিভাবে তুমি হাসতে হাসতে সময়ের গা থেকে আরেক সময়ের গায়ে হেঁটে যেতে পার? গল্পটি বলল, সব গল্পই এমন। শুধু আমার কথা বলছ কেন? খর স্রোতা বর্ষার নদী তুমুল বেগ নিয়ে যেমন ধারাল জিহ্বা দিয়ে দুপাশের ঘরবাড়ি গাছ নিয়ে হো হো রবে হাসতে হাসতে নির্বিকারভাবে গিয়ে লোনা সাগরে পড়ে, তেমনই, সব গল্পই মানুষের চরম অপমান, দুঃখ, দুর্দশার কাহিনী বুকে ধরে থেকে হা হা রবে হাসতে থাকে, হাসতে আছে। কোনো গল্পই বয়ে যায় না নদীর মতো। মানুষই গল্পের ওপর দিয়ে, ভেতর দিয়ে, তল দিয়ে নিরন্তর বয়ে যায়। মানুষ বয়, গল্প বয় না, বয় বলে মনে হয়। আমি চুপ করে থাকি। আমার কোনো কথা সরে না মুখে। আমি গল্পের গায়ের দিকে তাকিয়ে আছি। আমি হাঁটছি না গল্প হাঁটছে বুঝতে পারছি না। আমি বসে আছি আকাশের ধারে। কিছুক্ষণ আগে নদীর ধারে বসেছিলাম। জগতে বর্ষাকাল গলে গলে পড়ছে।
একটা রাস্তা: রাস্তার পাশে বাড়িটা। যারা এ রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায় তারাকে এই বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে হয়। যারা এ বাড়িতে যায় তারাকে এই রাস্তা ধরেই আসতে হয়। সর্ব ডানের ঘরটির জানালা বন্ধ। রাস্তা খোলা আছে। লোকজন হাঁটছে। সাইকেল-রিকশা চলছে। কোনো মোটরযান চলে না। অবশ্য মাঝে মাঝে মোটরসাইকেল চলে। ঘরে ঢুকতে হলে দরজা ব্যবহার করার নিয়ম আছে। রাস্তায় ঢোকার জন্য কোনো দরজা নাই। রাস্তার জানালাও নাই। বন্ধও থাকে না। সুতরাং যখন তখন বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন এ রাস্তায় ঢুকতে পারে এবং বেরুতে পারে। ভালো। রাস্তা সর্বদা খোলা। সে হাঁটে। ঘরের জানালা বন্ধ থাকে প্রয়োজন মতো। খোলা থাকে প্রয়োজন মতো। ও ঘরে শে থাকে। এ ব্যাপারটা বিকেলের।
জানালা বন্ধ: প্রথম যেদিন বিকেল সময়ে এ রাস্তাটা দিয়ে সে হাঁটছিল তখন জানালাটা খোলা ছিল না। তখনই জানালাটা খোলা হতে পারে সেটাও সে ভাবেনি। বা খোলা হলেও জানালাটা এই একটা কারণেই চিরতরে বন্ধ হবে, তা-ও ভাবতে পারেনি। ভালো। সে রাস্তা থেকে নেমে জানালার সামনে গিয়ে বাঁকা হয়ে দাঁড়ায় আর নাক ঝাড়ে। এমন সময় জানালাটা খোলে। জানালার খোলার শব্দে জানালার দিকে তাকাতে যাবার ফলে, নাক ঝাড়ার ফলে যা বের হয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়ার কথা ছিল, তা মাটিতে না পড়ে ঠোঁটে আর থুতনিতে লেপ্টে যায়। গাঢ় মোটা পোঁটা। জানালা সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায়। সে লক্ষ করে, শে সজোরে জানালা বন্ধ করেছে বেশ ঘৃণা মাখা মুখ নিয়ে। ভালো। সে লজ্জায় পড়ে যায়। তারা পরস্পর অপরিচিত ছিল। কেউ কারও মুখ কোনোদিন দেখেনি এর আগে। পোঁটা ঘটনা ঘটার পর থেকে জানালাটা দেয়াল হয়ে গেছে।
বন্ধ জানালার ফুটো: পোঁটা ঘটনার পরে, সে এই সময়েই বা কিছু মিনিট আগে পিছে করে এখান দিয়ে হেঁটে গেছে। জানালা আর খোলা পায়নি। ভালো। মনটা তার এ ব্যাপারটা নিয়ে লজ্জায় থাকে কিন্তু কয়েকদিন পরই ঠিক হয়ে যায়। সে তারপর থেকে এ জানালার কাছে দিয়ে যাবার সময় নিজ মনে হেসে ওঠে নিঃশব্দে আর জানালার দিকে তাকায়। হাসিটা প্রথমে বন্ধ জানালা কপাটে লেগে থেতলে যায় এবং আহত হয়ে বা নিহত হয়ে পড়ে যায় জানালার নিচের মাটিতে। সে হেসে দেওয়ার পরে হাসিটার কী হচ্ছে, ফিরেও দেখে না। তারপরের দিনও সে হাসে এবং হাসিটা বন্ধ জানালার দিকে যেতে গিয়ে আহত বা নিহত হওয়ার ভয়ে যায় না। হাসিটা পথ পরিবর্তন করে পাঁচিল টপকে বাড়িটিতে ঢুকে পড়ে। কিন্তু সে খেয়াল করে না ব্যাপারটা। ভালো।
শে যখন দেখে তাদের বাড়িতে একটা হাসি এসে তাকেই খুঁজছে তখন শে লজ্জা পায়। শে হাসিটিকে মনোযোগ দিয়ে দেখে এবং ভাবে, হাসিটি দেখতে খুব চমৎকার। তারপরেও প্রথম দিন শে হাসিটিকে তেমন পাত্তা দেয় না, ফেলে দেয়। পরের দিনেও হাসি আসে পাঁচিল টপকে। সে হাসিটিকে শুঁকে দেখে, গোলাপের মতো সুবাস। ছুঁয়ে দেখে, প্রজাপতির রঙিন পাখার মতো নরম। মুখে নিয়ে দেখে মধুর মতো মিষ্টি। সে হাসিটিকে চুমু খায়, যত্ন করে আদুরে রত্নের মতো বালিশের কাছে রেখে শুয়ে থাকে। হাসি প্রতিদিন আসছে দেখে, একটা বেশ বড় ধরনের কাচের বয়াম সংগ্রহ করে এবং প্রতিদিনের হাসি জমাতে থাকে খুব যত্ন করে। এভাবে বেশকিছু বয়াম ভরে ওঠে হাসিতে। হাসিভর্তি বয়ামের সংখ্যা দেখে শে সুখী হয়। ভালো। এরপর থেকে শেও হাসি পাঠাতে থাকে জানালায় থাকা একটি ফুটো দিয়ে।
পকেট ও বয়াম: সে প্রতিদিন এ রাস্তাটা দিয়ে হেঁটে যায় কাজের জন্যেই। আজকেও তেমনভাবেই হেঁটে যাচ্ছিল। হঠাৎ করে একখণ্ড মাখন যেন তার গায়ের ওপর পড়লো বলে মনে হলো। মাখনখণ্ড তার গায়ে পড়ার পর পিছলে মাটিতে পড়ে গেছে। সে তার গায়ে পড়া জিনিসটার দিকে তাকালো। সে জিনিসটি উঠিয়ে ভালো করে লক্ষ করে। দেখে, এটি একটি মধুময় হাসির টুকরো। ভালো। সে হাসিটিকে উঠিয়ে পকেটে ভরে রাখে। তারপর কাজ শেষে বাড়ি ফিরে অন্যমনস্কভাবেই তার টেবিলের ওপর হাসির টুকরোটি রেখে দেয়। পরদিন, আবার সেখান দিয়ে হাঁটার সময় বুঝতে পারে আবার একটা হাসির টুকরো তার পকেটে এসে ঢুকেছে। সে হাসিটি হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখে এবং গতকালের হাসিটির কথা মনে পড়ে। এরপর প্রতিদিন এমন হতে থাকলে সেও বেশকিছু বয়াম কিনে আনে আর প্রতিদিন প্রাপ্ত হাসি ভরে রাখে। ভালো। তার কাছে প্রচুর হাসি জমা হয়েছে দেখে, সে বেশ সুখী হয়ে ওঠে।
হাসির বয়ামের পাহাড়: শে আর সে একসময় মিলিত হয় আর তাদের উভয়ের মিলিত হাসির বয়াম দেখে নিজেরা অবাক হয়ে ওঠে। এটা একটা হাসির পাহাড়—তারা তাদের বলে। ভালো। তারা তাদের হাসির বয়ামগুলোকে একটা ঘরে নিয়ে আসে। একটা তার হাসির বয়াম তারপাশে একটা ওর হাসির বয়াম, এভাবে হাসির বয়ামগুলোকে সাজায় তারা। একজনের হাতের আঙুলের ফাঁকে আর একজনের আঙুল ঢুকিয়ে যে বন্ডিং তৈরি হয়, তেমন একটা বন্ড তৈরি হয় হাসির বয়ামগুলোর মধ্যে।
হাসির বয়ামের হাসি: মাত্র কয়েকবছর পর, এক গভীর রাত। সে বিছানা থেকে উঠে। বিষণ্নতা ছেয়ে আছে তাকে। বাথরুমে যাওয়ার সময় ওর মনে হলো, হাসির ঘরটাতে তারপর থেকে আর একদিনও যাওয়া হয়নি। হাসির ঘরে তালা দেওয়া। সে বারান্দায় ঝোলানো চাবির গোছা থেকে হাসির ঘরের চাবি হাতে নেয়। হাসির ঘরের তালায় জং ধরে গেছে। সহজে খুলতে চায় না। বেশ জোরাজুরি করে তালাটা খুলে ভেতরে ঢুকে। বয়ামগুলোর খুব কাছাকাছি দাঁড়ায়। দেখে, বয়ামের ভেতরে থাকা সব হাসিতে পোকা লেগে গেছে আর হাসিগুলো কান্নায় পরিণত হয়েছে। ভালো। হাসির ঘরে আবার তালা দিয়ে সে বিষণ্ন শ্বাস ফেলে চলে আসে। এসে বিছানায় শোয়। দুজনের মাঝখানে দুজনের দীর্ঘশ্বাস পাশবালিশ হয়ে আছে, বাঁধবালিশ হয়ে আছে। দীর্ঘশ্বাসের পাশবালিশ, মাঝবালিশ হয়ে, তৃতীয়জন হয়ে শুয়ে আছে।
সে শুয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর শে ওঠে। এক ধরনের মলিনতা সারামুখে। বাথরুমে যাওয়ার সময় তারও হঠাৎ করেই মনে পড়ে হাসির ঘরটির কথা। হাসির ঘরে তালা দেওয়া। শে জানে না, এর মধ্যেই সে একবার এ ঘরে এসে ঘুরে গেছে। শে হাসির ঘরটির তালা খুলে ঢুকে আর দেখে, হাসির বয়ামগুলোর ভেতর থরে থরে পচা মাংস সাজানো রয়েছে। মাংসগুলোতে মোটা মোটা পোকা থকথক করছে। বের হওয়ার সময় সে হাসির বয়ামগুলোর হাসি শুনতে পায়। ঠাট্টার হাসি। শে হাসির ঘর থেকে বের হয়ে এসে শুয়ে পড়ে। দুজনের দীর্ঘশ্বাসে দীর্ঘশ্বাসে ঘর ভরে গেছে।
গল্পটি হাসতে হাসতে আবার বলল: তাদের এসব শুয়ে পড়া আসলে নুয়ে পড়া। এসব শুয়ে থাকা আসলে এক ধরনের নুয়ে থাকা। ভালো। সবাই বলুন, ভালো।