বড় এক গামলায় গরুর নলিগুলো কচলাতে কচলাতে মজনু শাহর মনে হয়, জীবনটা আসলে খারাপ না। জীবনটা যেন গরুর নলি গরম পানিতে কচলানোর মতোই উষ্ণ আর প্রাত্যহিক। গরু শেষ করে খাসির নলিগুলোও পরিষ্কার করতে বসবে মজনু। কচলে কচলে নলিতে লেগে থাকা চর্বিগুলো তুলে ফেলা। পরিমাণের বেশি এক ছটাকও যদি চর্বি থেকে যায়, তাহলে নেহারির স্বাদ যাবে পাল্টে। অবশ্য নেহারির স্বাদ যে শুধু এর ওপরে নির্ভর করে, তা নয়। ওস্তাদের দেওয়া গোপন মশলার ফর্দ এখনো মজনু রান্নার সময় অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে। ওস্তাদ আওলাদ খাঁর নাম মনে পড়তেই মজনু নলিভর্তি পাতিলটাকে নিজের অজান্তেই সালাম করে। আল্লাহর পরে ওস্তাদের কথাই সত্য। এই যে তার রুটি-রুজি, নাম যশ, পঁচিশ বছরের পুরনো ‘মজনু শাহের শাহী নেহারির দোকান’ সবই আল্লাহর দান আর ওস্তাদের দোয়া। মাত্র ১০ বছর বয়সে মজনু যখন ঢাকায় এসেছিল গ্রাম থেকে, তখন রাজধানীর এত শান-শওকত ছিল না, ছিলে কলিজাওয়ালা বড় দিলের মানুষ। যেমন তার ওস্তাদ। ওই সময় মজনুর নাম ছিল পরিমল ঘোষ। পাকা হিন্দু বাড়ির ঘোষ বংশের ছেলে। গ্রামে দশ জনে বলতো, ঘোষের পোলার মন বসে না খালি পড়ালেখায়, মন বসে মিষ্টিতে। বাবা-কাকাদের মিষ্টি তৈরির ব্যবসা। কিন্তু পরিমল তো জানে, মিষ্টিও নয়, তার আসলে মন পড়ে থাকে খেলায়-মাঠে। এ নিয়ে কতে মার-বকাঝকা। অবশেষে একদিন বাড়ি ছেড়েই পালানো। ইস্টিশনে এসে সোজা রেলগাড়িতে। পথে খেলার সাথি মহিদুলের সঙ্গে অবশ্য দেখা হয়েছিল। মহিদুল জিজ্ঞেস করেছিল, কই যাস? হাঁটতে থাকা পরিমল মুখ ভেঙচে বলেছিল, মরতে।
ঢাকায় এসে পাক্বা দুই দিন রাস্তায় রাস্তায় কেটেছিল পরিমলের। অবশেষে একদিন ভাগ্যের ফেরেই পরিচয় হয় আওলাদ খাঁর সঙ্গে। বড়সড়ো দশাসই মানুষ আওলাদ খাঁ, বাড়ি চানখাঁরপুল। তিনি পরিমলকে নিয়ে এসেছিলেন সঙ্গে করে। তবে ভুড়িতে চিন্তিতভাবে সেদিন হাত বোলাতে বোলাতে আওলাদ খাঁ বললেন, আমি যে কাজ করি, তা তো তোকে দিয়ে হবে না। মালাউনের ব্যাটা তুই, কুনহান থন ভাইগা আইছস কে জানে! কী কইরা খাবিরে রাজধানীতে? এক কাজ কর মোছলমান হয়া যা। কলমা পড়, খৎনা দে, ট্যাকা পয়সা লাগলে হেইটা আমি কিছু দিমুনে। কলমা-খৎনা শব্দগুলো তখনো অচেনা কিশোর পরিমলের কাছে। কেবল মুসলমান জাতটাই তার পরিচিত। গ্রামের বাড়ির আশেপাশে, পাড়ায়, স্কুলে মুসলমানদেরই রাজত্ব। শুনেছে, দক্ষিণ পাড়ার অঘোর কায়স্থরা মুসলমানদের ডরে গাট্টি-বোচকা নিয়ে ভেগেছিল ভেগেছিল ইন্ডিয়া। কিন্তু পরিমল তো ডরের কিছু দেখেনি! মসজিদে মসজিদে সাদা টুপি পরে মুসলমানরা নামাজ পড়ে, সুর করে আজান দেয়—আল্লাহ হু আকবর, আল্লাহ হু আকবর। আর খেলার মাঠে বন্ধুরা সব মুসলমান। ঈদ এলে ওরা পরিমলকে বাসায় ডেকে নিয়ে পায়েস খেতে দেয়। আবার দুর্গাপূজা এলেই দশভূজার কপালে যখন কুমারেরা ত্রিনেত্র ছোঁয়াতে ব্যস্ত কিংবা লক্ষ্মীপূজার ধান-দুর্বা তুলছে সিঁদুর পড়া মেয়েরা তখন পরিমলের ওই সব মুসললমান বন্ধুরাই কেমন ক্ষেপে উঠতো। ওরা পরিমলের পেছনে পেছনে ছড়া কেটে ক্ষেপাতো—হিন্দু হিন্দু তুলশী পাতা, হিন্দুরা খায় গরুর মাথা। কোরবানির গরুর কাল্পনিক রক্তাক্ত মাথা চোখের সামনে ভেসে উঠলে কেঁদে-কেটে পরিমল আশ্রয় নিতো অনিমা পিসিমার বাড়িতে। অনিমা পিসি তার পাকা চুলে তেল দিতে দিতে বলতো-কান্দিস নারে ছোড়া, ওগো মুখ আছে কইতে দে না। তুই কইতে পারোস না, মুসলমান মুসলমান চুচড়া পাতা, মানুষ খাইবো মানুষের মাথা।
সেইসব স্মৃতি-বিস্মৃতি আর ক্ষোভ থেকেই কি না, কিশোর পরিমল সেদিন মাথা ঝাঁকিয়েছিল আওলাদ খাঁর কথায়। পরেরদিন পাড়ার হুজুরের কাছে পাক সাফ হয়ে—লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ পড়ে পরিমল হয়ে যায় মজনু অর্থাৎ আওলাদ খাঁর পোষ্যপুত্র মজনু খাঁ। সুবিধাজনক এক সময়ে লিঙ্গের মাথাটিও কাটা পড়ে অতীতের হিন্দুয়ানি স্মৃতির মতো। তারপর থেকে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত আওলাদ খাঁ মজনুকে একটু একটু করে শিখিয়েছেন মানুষকে হাড্ডি খাওয়ানোর এই জটিল রসায়ন। গরুর মোটা নলি থেকে খাশির পায়ার নেহারির আজব গুণ আর স্বাদ তন্ত্র-মন্ত্রের মতো আওলাদ খাঁ গেঁথে দিয়েছিলেন তার মাথায়। আজ তার দোয়ায় আল্লা মজনুর এই ব্যবসায় বরকত দিয়েছেন। ওস্তাদ আওলাদ খাঁ মারা যাওয়ার পর কিছু টাকা পয়সা ধার করে প্রথম নিজের নেহারির দোকান দিয়েছিল সে। মাঝে নিজের নামের সঙ্গে শাহ জুড়ে দিয়ে বাদশাহী কায়দায় দোকানের নাম দিয়েছে ‘মজনু শাহের শাহী নেহারি’। সেই থেকে আজ এই রমরমা অবস্থা। গুলশান পার্ক সংলগ্ন এলাকায় তার দোকান লোকে এক নামে চেনে। সময় যত এগিয়েছে দোকানের পরিসর বেড়েছে তত। প্রথমে একটি ঠেলা গাড়িতে শুরু হলেও মজনু শাহের শাহী নেহারি এখন বিরাট দোকান। শুধু নেহারিই নয়, দোকানের চারপাশে এখন সারাদিন ম ম করে-বটি কাবাব, জালি কাবা, গুর্দা কাবাব, কলিজা ভাজি, মগজ ভাজির গন্ধ। তবে এখনো এখানকার সবচেয়ে বিখ্যাত খাবার হলো মজনু শাহের নিজ হাতে বানানো শাহী নেহারি। ছোট থেকে বড়, বুড়ো থেকে জোয়ান, খেকো থেকে নির্লিপ্ত পর্যন্ত হাড্ডি চুষে চুষে ধন্য ধন্য করে প্রতিদিন। তাইতো খদ্দেরদের ভিড় লেগে থাকে সবসময়। সকালে আসে স্কুল-কলেজগামী ছাত্র-ছাত্রীরা, মধ্যভাগে স্কুল কলেজ পালানো ছাত্র-ছাত্রীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছেলে মেয়ে এসেও আড্ডা জমায় নিয়মিত। দুপুরে আসে চাকুরে ক্ষুধার্তরা। রাস্তাঘাটে বিভিন্ন কাজে ব্যাস্ত মানুষগুলোও কম যায় না। ওরা রসময় মজ্জার লোভে হাড্ডির ভেতরের শেষ অংশটুকুতে পৌঁছানোর চেষ্টা করে জিহ্বার আগা। বিকেলে গুর্দা কাবাব খেতে খেতে হাসি শোনা যায় প্রেমিক-প্রেমিকার। পরোটার টুকরোয় মগজ ভাজি জড়িয়ে চিবোতে চিবোতে ঠাট্টা ফাজলামি করে পাড়ার উঠতি মাস্তানেরা। আর সন্ধ্যায় দোকানে ভিড় জমে পরিবার নিয়ে আসা, অন্ধকারে মুখ ঢেকে আসা লোকজনের। ওরা নেহারির ঝোল মুখে দিয়ে আহা-উহু করে। চুষে চুষে হাড়ের প্রতিটি বাঁকের শেষ কণা খেয়ে নেয়। কেউ কেউ দাঁতের জোরে মট করে ভেঙে ফেলে হাড্ডি। তারপর বড় বড় চোখে সাফল্য উদযাপন করে সুরুৎ করে টেনে নেয় রসটুকু। প্রতিদিন খদ্দেরের এই ভিড়টা দেখতে বড় ভালো লাগে মজনু খাঁর। ওস্তাদ আওলাদ খাঁ বলতেন—শোনো, কাস্টমার হলো লক্ষ্মী। তাগোরে কখনো আজেবাজে জিনিস খাওয়াবি না। আর তাছাড়া আমার মন্ত্র দিয়া গেলাম তোরে। তুই এর মান রাখিস। মজনু ওস্তাদের মান রেখেছে। তার কথা মেনেই এখনো সে প্রতি সকালে লোক দিয়ে বাজার থেকে কিনে আনে সদ্য জবাই করা গরু-খাশির টাটকা নলি, মাথা, কলিজা, গুর্দা। তারপর নিজ হাতে নলিগুলো পরিষ্কার করে, গোপন মশলার ফর্দ বাটতে বসে সে। এরপর একসময় বিসমিল্লাহ বলে আগুনের চুলায় ডেকচি ওঠে।
মজনু খাঁর একটাই ছেলে। নিজে পাঁচ ক্লাস পর্যন্ত পড়লে কী হবে, ছেলেকে সে পড়াশোনা করিয়েছে অনেক দূর। ছেলে তার এখন সাহেবদের মতোন ফটফট করে ইংরেজি বলে। রাত জেগে কম্পিউটার নামের যন্ত্রে কী সব কাজ করে। ছোটবেলা শখ করে মজনু মাঝে মাঝে ছেলেকে দোকানে নিয়ে আসতো। মশলা কোটার সময় ছেলে বায়না ধরতো সেও করবে বলে। শখের বসে ছেলে তখন বাবার সঙ্গে পিঁয়াজ কাটতে কাটতে চোখের জল ফেলতো, আদা কুচি করতে গিয়ে আঙুল কাটতো, হামানদিস্তায় মশলা ছেঁচতে গিয়ে ব্যথা পেতো। তবু বাপ-ব্যাটার নেহারির সুখ যেনে যেতো না। ছেলেকে শুনিয়ে শুনিয়ে সে সময় মজনু ছড়া কাটতো—‘দিন দিন ভিটামিন, মাথায় বাড়ে ব্রেন। হাড্ডি শক্ত মর্দ পুরুষ চালায় গাড়ি ট্রেন। ট্রেন চালায় প্লেন চালায় কল-কারখানা মিল, আমার বাপের এলেম বড় কলিজাওয়ালা দিল।’ বাপ আমার বড় হয়ে ট্রেন-গাড়ি-মিল চালাবে নারে? মজনু খাঁর ছেলে এখন বড় হয়েছে। প্রস্থে না হলেও দৈর্ঘ্যে বাপকে ছাড়িয়ে সে বেড়ে উঠেছে বিঘৎখানেক। এখন আর তেমন সে আসে না এই দোকানে। কতে ধরনের কাস্টমার, ছেলে-মেয়ে-কাচ্চা-বাচ্চা! এতে পড়াশোনা করে শেষে না জানি বাপের হাড্ডি মাংসের দোকানের ব্যাপারি হতে হয়। অবশ্য কাস্টমারদের কাছে ছেলের বড় হওয়া, শিক্ষিত হওয়ার গল্প করতে ভালো লাগে মজনুর। মাঝে মাঝে কোথা থেকে যেন স্যুট টাই পরা সাহেবরা আসে দোকানে নেহারি খেতে। তাদের মধ্যে একজন আবার বাঙালি। সে ইংরেজিতে সাহেবদের খাবারের বর্ণনা দেয়। একবার এক সাহেব মজনু খাঁর নেহারি খেয়ে আনন্দে আত্মহারা। তিনি সবিস্তারে লিখে নিয়ে গেছেন নেহারি বানানোর ফর্মুলা। যাওয়ার সময় বাঙালি লোকটি বলেছিল, মজনু সাহেব, সত্যি আপনার হাতে জাদু আছে। বিদেশি সাহেবরা বিশ্বাসই করতে পারছেন না যে, গরু-ছাগলের পায়ের হাড্ডি দিয়ে এমন স্বাদের খাবার তৈরি করা যায়। গর্বে মজনু খাঁর বুক ভরে ওঠে। সবই ওস্তাদের দোয়া। বাসায় সেদিন বউ ছেলের কাছে সে এই গল্প করেছিল। কিন্তু তারা তেমন উচ্ছাস দেখায়নি। বরং ছেলে ভোঁতা মুখ করে বলেছিল—আব্বা, দোকানটা এবার উন্নত করো, কর্মচারী রাখো। এসব হাড্ডির ব্যবসা বাদ দাও। বরং ভালো একটা রেস্টুরেন্ট বানানো গেলে তাতে হার্ড ফুডের পাশাপাশি গ্রিল, হটডগ, শর্মা-টর্মা বিক্রি করা যাবে। ফেসবুকে বিষয়টা কয়েকজনের কাছে শেয়ারও করেছি। তারা আগ্রহ দেখিয়েছে, উৎসাহও দিয়েছে। মজনু খাঁ ছেলের কথা বুঝতে পারে না। ছোট ছোট শব্দগুলো অচেনা। রাতে বিছানায় বউ বলে, ছেলে যখন চায় না, ব্যবসাটা বাদ দেন। আমারে বলে, কত মানুষের সঙ্গে ওর উঠবোস করতে হয়। একটা মান সম্মান আছে না! খালি টাকা পয়সাই তো জীবনে সব নয়। আপনেরে যেন একটু বোঝাই। মজনু খাঁর মনে হয়, ঠিকই তো ছেলে আমার কত মানুষের সঙ্গে মেশে। হয়তো বুঝে শুনেই বলে এ কথা। পরক্ষণেই আবার মনে হয়, আরে বোকারা আমি দোকানে না গেলে হবে! নিজে এখনো ডেকচিটা চুলায় দেই বইলাই তো শহরজোড়া নাম। ছেলের সন্তুষ্টি আসে না। মজনু খাঁ তাকে কিভাবে বোঝায় সেই কথা! কেনে ছেলের এত আপত্তি এই দোকানে? পঁচিশ বছর ধরে তো এই দোকানের রুটি-রুজি দিয়েই আজকের মজনু খাঁর এই অবস্থা। আল্লাহ দিলে টাকা-পয়সাও কম হয়নি। মজনু শাহের শাহী নেহারির কথা দশ এলাকার মানুষ একনামে চেনে। আর এই দোকানের টাকা দিয়েই তো এত শিক্ষিত, এত লেখাপাড়া করেছিসরে বাপ। ঘরের মানুষের এমন ঘোর আপত্তি সত্যিই যেন মজনুর কাছে প্রবল দেওয়ালের মতো ঠেকে। যে দেওয়াল গরু-খাশির হাড্ডির চাইতে শক্ত। ভাঙার দাঁত ফোটানো যায় না তাতে। ছেলে বাপের কথা বোঝে না। মজনুর নেহারি নিয়ে গাল ফোলায়। কখনো কখনো সমান খেদে বলে, বন্ধু-বান্ধব সমাজের কাছে আমি মুখ দেখাতে পারি না। কারও বাবা ডাক্তার, কারও ইঞ্জিনিয়ার, কেউ চাকরিজীবী, কেউ ব্যবসায়ী। আর আমার বাবা হাড্ডির বাবুর্চি। ছেলের কথা শুনে চমকে উঠেছিল সেদিন মজনু। এই তাহলে খেদ! মজনু শাহের শাহী নেহারি জন্য সমাজে বাপের পরিচয় দিতে লজ্জা হয় ছেলের! তাহলে এই যে এত নাম-সুনাম তার নেহারির, তাতে কী লাভ? সাহেবদের কথার জাদুমাখা সার্টিফিকেট, গুর্দা কাবাব খেয়ে ছেলে-মেয়েদের প্রশংসার বান, হাড্ডি চুষতে চুষতে সাদা বানিয়ে ফেলা লোকের চেহারা, খবরের কাগজের ছবি সবই তো মিথ্যা। মজনু খাঁ, মনে মনে ওস্তাদকে ডাকে। ওস্তাদ, নেহারির হাড্ডি স্বাদ করা তো শিখাইলেন, নিজের বুকের হাড্ডি শক্ত করনের উপায় কী? ওস্তাদ সমাধান দেয় না। মজনু ছেলের দিকে এগিয়ে যায়, তার কাঁধে হাত রাখে। জীবনে তো অন্য কোনো কাজ শিখি নাইরে বাপ, জানি খালি হাড্ডি রানতে। ছেলে মুখ কুঁচকায়, বোঝে না এসব বাবার পাগলামি না অন্ধ আবেগ। চলাফেরা করার মতো টাকা তাদের হয়েছে। আর কদিন পরেই সেও ভালো একটা চাকরি করবে। তাহলে এখনো প্রতি সকালে কেন কষ্ট করে যাওয়ার দরকার ওই দোকানে! শুধু তাই নয়, দোকানে গিয়ে কতগুলো রক্ত-চর্বিওয়ালা গরু খাশির পায়ের হাড্ডি, মগজ, কলিজা, গুর্দা নাড়াচাড়া! বাবাকে কোথাও যে বড় গলায় পরিচয় করিয়ে দেবে, সে উপায় আছে? আর এসবে স্ট্যাটাস থাকে, যতসব রাবিশ। আব্বা, তুমি জানো না, এসব করতে করতে তোমার গা থেকে এখন সবসময় ভুরভুর করে চর্বির গন্ধ আসে। বমি পায় কাছে এলেই। মজনু খাঁ কী বলবে বুঝতে পারে না। চোখের সামনে ঝাপসা লাগে, মাথায় ভেসে ওঠে টগবগে ফুটন্ত জল ভর্তি পাতিল। তাতে সে যেন ঢালছে আধা গোলাপী মাংস লাগানো নলি। তাতে দিতে হবে পরিমাণ মতো হলুদ, মরিচ, পেঁয়াজ কুচি, গরম মশলা।
কল্পনার পেঁয়াজের ঝাঁজে না কি ছেলের কথা শুনেই যেন মজনু খাঁর চোখে জল আসে সে বুঝতে পারে না। বহুদিন কাঁদা হয়নি। ওস্তাদ আওলাদ খাঁ যেদিন মারা গেলেন, সেদিনই শেষ। এরপর থেকে আর কখনো তার চোখ থেকে জল ঝরেনি। সে চোখের জল মুছে ফেলে। বাবার চোখের জলে সন্তানের অমঙ্গল। তাই আজ অনেকদিন পর মজনু শাহ ভেবেছিল সকালে দোকানে যাবে না। কিন্তু সকাল গড়িয়ে বিকাল হতেই অদৃশ্য এক মাংসল সুরুয়ার সুবাস তাকে ঘর তেকে টেনে বের করে এনেছে। আহা, আজ হয়তো দোকানে নেহারি হয়নি। গত পঁচিশ বছরে এই প্রথম এমন ঘটনা ঘটলো। সময়টা তখন কনে দেখা সন্ধ্যা। মজনু খাঁর দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায়। সাদাকালো সাইনবোর্ডে কালো হরফে লেখা-মজনু শাহের শাহী নেহারি। চারপাশের চেয়ারে জটলা পাকানো মানুষের দল। একপাশে এক মধ্য বয়সী লোক কাঁটা চামচে কলিজা বিঁধিয়ে কামড় বসাচ্ছে। কলিজার স্বাদের আয়েশেই হয়তো লোকটার চোখ বুজে আসে। অন্যপাশে কয়েকটি তরুণ পরোটা ছিঁড়ে মগজ ভাজি পেঁচিয়ে তুলে নিচ্ছে গালে। একটু সামনে সাহেবি কায়দায় শার্ট-প্যান্ট পরা এক লোক গরুর মাথার হাড্ডির ফাঁপা অংশ জিহ্বা ঢুকিয়ে কখনো চাটছে, কখনো টান দিচ্ছে সুরুৎ করে। মজনু খাঁ, বুকে হাত রাখে। পাঁজরের হাড়গুলো কেন টনটন করছে এত! চোখের সামনে লাল রক্তের মতো পর্দা দোলে এখন। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, তবু নাকের সামনে তার ঝাপটা মেরে যায় হলুদ পিঁয়াজ রসুন গরম মশলার সুরুয়ার গন্ধ। ওই তো সাদাকালো সাইনবোর্ড জ্বলজ্বল করছে—মজনু শাহর শাহী নেহারি। কিন্তু তারপরও যেন দুনিয়াসুদ্ধ মানুষ হেসে ওঠে। সে হাসি চলতেই থাকে, চলতেই থাকে।