হাজেরার শ্বাস উঠেছে।
শ্রাবণের ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকার রাত। সারা দিনের একটানা টিপটিপ বৃষ্টি শেষ বিকেলে দমকা হাওয়ার উসকানিতে দ্বিগুণ তীব্রতা পেয়েছে। ছলিম শেখ সেই সকাল থেকেই হাজেরার পাশে বসে আছে। কামারের হাপরের মতো হাজেরার পাঁজরসর্বস্ব বুক এক-একবার সশব্দে উঠছে আর নামছে। হাজেরার মাথার কাছে ম্লান কেরোসিন বাতিটি দমকা বাতাসে নিভে যাওয়ার উপক্রম। রাতের গভীরতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বৃষ্টি আর বাতাসের তোড় যেন বেড়েই চলেছে। ছলিম শেখের গায়ে তেল চিটচিটে কাঁথা দ্বিগুণ ওজনে যেন আধভেজা হয়ে লেপ্টে আছে। হাজেরার নির্মিলিত চোখের পাতায় তার ভ্রূক্ষেপহীন দৃষ্টি।
এই চেয়ে থাকা ছাড়া ছলিম শেখের আর কী-ই বা করার আছে! নাছিরপুরের গৌর কবিরাজের হলুদ বাটা হাজেরার বুকে মালিশ করে দিয়েছে, উজলপুরের মুন্সী পীরের মাদুলি বাহুতে বেঁধে দিয়েছে, খানজাহান আলীর মাজারে শিরনি মানত করেছে, গত দুই দিন যাবত হাজেরার পাশে বসে তার শুশ্রূষা করেছে। এর বাইরে কিছু করার আর কী-ই বা থাকতে পারে ছলিম শেখের?
সুদীর্ঘ চল্লিশটি বছরের দাম্পত্য; সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, মান-অভিমান, আগ্রহ-অবহেলা, জীবিকা-জৈবিকতার সাথী হাজেরা। চেখের সামনে মৃত্যুর হীমশীতল অজানা রাজ্যের পথে এক-পা দু-পা করে এগিয়ে যেতে দেখেও ছলিম শেখের কিছুই করার নেই। কিছুতেই সে ফেরাতে পারবে না হজেরাকে।
হাজেরার শেষ অনুরোধটা সে রাখতে পারবে তো? তার মৃত্যুর সময় মেয়ে দুটি যেন পাশে থাকে, এই অনুরোধ ছিল তার।
ছলিম শেখের বিস্ফারিত চোখের কোণে সহসাই ঝিলিক দিয়ে যায় একটা দৃশ্য। তাদের যৌথজীবনের শুরুর দিককার ঘটনা। ক্ষেতে মই দেওয়া শেষে গাই দুটোকে রাস্তার পাশে বেঁধে দিয়ে এসে হাজেরার কাছে ভাত চেয়েছে। আজ একটু আগেই এসেছে বৈকি, কিন্তু খিদেটাও যেন পেটের মধ্যে হাঙরের মতো কামড়াতে শুরু করেছে। হাজেরা গোবরের ঘুঁটে বানাচ্ছিল। ‘আসতিছি’ বলে আর আসার নাম নেই। এরই মধ্যে আরও দুবার ভাত চাওয়া হয়ে গেছে ছলিম শেখের। হাজেরার কোনো সাড়া নেই। ছলিম ঘরের পেছনের যে দিকটায় হাজেরা কাজ করছিল, সেখানে গিয়ে চিৎকার করে উঠলো।
‘ভাত চালাম না?’
‘শুনিছি তো। দুডে-তিনডে ঘুঁটে আছে, শেষ করে আসতিছি।’
হাজেরার নির্বিকার ভঙ্গি দেখে ছলিমের মাথায় খুন চড়ে গেলো; সোওয়ামির কথায় সে গুরুত্বই দিলো না! মহিলারা এভাবেই আস্তে আস্তে সোয়ামির অবাধ্য হতে শেখে। ছলিম শেখ হুঙ্কার দিয়ে ওঠে, ‘তোর ঘুঁটে বানানি শেষ কত্তি অবে না। আমিই তোরে শেষ কত্তিছি।’
সেদিন দুপুরের আগক্ষণে ঘটনার আকস্মিকতা আর অনিবার্য উত্তেজনায় ছলিম প্রলয়পর্বের যেখানে এসে ইস্তফা দিলো, হাজেরার শুরু হলো ঠিক সেখান থেকেই।
ফাঁকা মাঠের মধ্যে লম্বালম্বি আল। সেই আলের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে হাজেরা। অনেক পেছনে ছলিম। হাজেরা যে সত্যি সত্যি বাপের বাড়ি রওনা দেবে এ কথা সে ভবতেই পারেনি। ছলিম ডাকছে, ‘বউ…, বউ…’। বাতাসের উজানে তার ডাক হজেরার কানে পৌঁছানোর কথা না, তা ছলিমের জন্য সহজেই অনুমেয়। তবু ছলিম ডেকে যাচ্ছে, বউ…বউ…। ‘বউ’ শব্দটির পুনরাবৃত্তি শেষ পর্যন্ত ছলিমের লজ্জার উদ্রেক করে। ছলিম এবার ডাকতে শুরু করে ‘হাজেরা’। ততক্ষণে হাজেরাকে প্রায় ধরে ফেলেছে ছলিম।
সন্ধ্যায় অনেক স্নেহে ছলিমের পাতে কলমি শাকের ঝোল তুলে দেয় হাজেরা। অনুতাপের সুরে হাজেরাকে উদ্দেশে ছলিম বলে ওঠে, ‘খিদে নাগলি আমার মাতা ঠিক থায়ে না, বউ।’ হাজেরা আঁচলের নিচে লজ্জাবনত মুখে হেসে ওঠে। বড় প্রাঞ্জল, ক্ষমাশীল সে হাসি।
সেদিন যেভাবেই হোক ছলিম অনেক অনুনয় করে হাজেরার মান ভাঙিয়ে ফিরিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছিল। কিন্তু আজ মৃত্যুপথযাত্রী, চেতনাহীনা, হাজেরার পাশে বসে এই একটি কথাই শুধু ছলিম শেখ ভাবছে, কোনো অনুনয়েই হয়তো আজ হাজেরাকে ফেরানো যাবে না। সবকিছু ছাপিয়ে আরও একটা অনিশ্চয়তা তাকে ব্যগ্র করে তুলছে। হাজেরার শেষ অনুরোধটা সে রাখতে পারবে তো? তার মৃত্যুর সময় মেয়ে দুটি যেন পাশে থাকে, এই অনুরোধ ছিল তার।
সাহস করে ছলিম তাকে পরিপূর্ণ ভাবে বেষ্টন করে ধরে কয়েক দিনের বিয়ে সংক্রান্ত কাজে মন ও শ্রম দেওয়ার ক্লান্তিতে খুব দ্রুত ঘুমিয়ে পড়েছিল।
গ্রামের একপ্রান্তে রাশিকৃত বাঁশ আর ঘন সন্নিবেশিত গাছগাছালির মধ্যে ছলিমের দোচালা ঘর। গ্রামের কেউই এপথে হাঁটে না। তার ওপর একটানা বৃষ্টিতে এই দুদিনে এদিকে এমন কেউই আসেনি যাকে দিয়ে সে তার মেয়ে দুটির বাড়িতে খবর পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারে। ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই তার। ছদর মাঝি সামনের শীর্ণকায় খাল পথে প্রতিদিন খেপ নিয়ে যাত্রাপুর হাটে যায়। তাকে বলে দিলে আটটার মধ্যেই দুই মেয়ের বাড়িতে খবর পৌঁছে যাবে। কিন্তু ততখানি সময় ছলিম পাবে তো?
একটা ঝটকা বাতাসে হাজেরার সিথানের বাতিটি নিভে গেলো। চারিদিকে অথৈ অন্ধকার। ছলিমের মনের মধ্যে একটা অজানা আশঙ্কা দোল দিয়ে গেল। কাঁপাকাঁপা হাতে কিছুক্ষণ ম্যাচটি খুঁজল। বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজটা আরও বেড়েছে। তবে বৃষ্টির ফোঁটা আগের মতো বড় নেই বলেই মনে হচ্ছে। হাজেরা অদ্ভুত ভয়ানক একটা শব্দ করছে, গরর-গরর। প্রথম ঘষায় আলো জ্বলল না। ভিজে আবহাওয়ায় ম্যাচকাঠির বারুদ ‘মজে’ গেছে। কয়েকবার চেষ্টার পর বাতি ধরাল ছলিম। বাতির আলোয় হাজেরার রোগজীর্ণ মুখখানি স্পষ্ট হয়ে উঠল। আহা, সেই মুখ! প্রথম যেদিন ছলিম হাজেরার মুখ দেখেছিল সে খুব আনন্দের মুহূর্ত। কিছুটা লজ্জা, কিছুটা প্রেম আর কিছুটা কৌতূহলের দৃষ্টিতে ছলিমের চোখে হাজেরার সুবিন্যস্ত চুলের প্রচ্ছদপটে চন্দন, কুঙ্কুম, সুর্মা চর্চিত মুখখানা এক কথায় ‘হুর’ বলে মনে হচ্ছিল। সে দৃশ্য এখনো ভোলেনি ছলিম। খুব বেশি ধুমধাম করে যে সে হাজেরাকে বিয়ে করেছিল, তা-ও না। অবশ্য এসব ক্ষেত্রে বাইরে ধুমধাম না থাকলেও অন্তরে সে ধুম মুখর হয়ে ওঠে। কিছুতেই তা চাপা থাকে না। হজেরা তার জীবনের প্রথম ও একমাত্র নারী যাকে সে ছুঁয়ে দেখেছিল। সম্পূর্ণ অধিকার নিয়ে চুমু খেয়েছিল। সেদিন লজ্জার রক্তিম হাসিটা পৃথিবীর সবচেয়ে দামি প্রসাধন হয়ে লেপ্টে ছিল হাজেরার মুখে। হাজেরার বয়স তখন সতের।
সবকিছু অক্ষরে অক্ষরে মনে পড়ে যায় ছলিমের। প্রথমে সে ঘরে ঢুকল। হাজেরা জরির ঘোমটা পরে মাথা নিচু করে বসে আছে। ছলিম হাজেরার পাশে গিয়ে বসল। তার মধ্যে শুধু সংকোচ আর অস্বস্তি। স্ত্রী হলেও অপরিচিত, অজানা একটা মেয়ে হাজেরা। তার সঙ্গে কথা শুরু করতে অনেক সময় লেগে গিয়েছিল। বেশ রাতে তারা পাশাপাশি শুয়ে পড়েছিল। সাহস করে ছলিম তাকে পরিপূর্ণ ভাবে বেষ্টন করে ধরে কয়েক দিনের বিয়ে সংক্রান্ত কাজে মন ও শ্রম দেওয়ার ক্লান্তিতে খুব দ্রুত ঘুমিয়ে পড়েছিল।
যখন ঘুম ভাঙল, তখন শেষরাত। ঘন বাঁশের জটলা এড়িয়ে পশ্চিম দিকের বেড়ার ফাঁক হতে ভাঙা চাঁদের আলো ঘরে ঢুকে আবছা আলোকিত করেছে। ছলিমের খেয়াল হলো এতক্ষণ সে হাজেরাকে জড়িয়ে ধরে শুয়েছিল। হাজেরা তখনো ঘুমায়নি। ছলিমের বেষ্টিত বাহুর মধ্যে ঘুমের ভান করে ছিল। হাজেরার শরীর থেকে বিয়ের শাড়ি আলাদা করে ফেলল ছলিম। হাজেরা বাঁধা দিলো না। ক্ষয়িষ্ণু চাঁদের ম্লান আলোয় হাজেরার উন্মোচিত শরীরের ফর্সা ত্বক দেখে ছলিমের গা দিয়ে ঘাম ছুটে এল। সে তখন থরথর করে কাঁপছে। মনিহারি দোকানের সস্তায় কেনা কুঙ্কুমের তীব্র ঘ্রাণ সত্ত্বেও ছলিমের নাকে হাজেরার শরীর থেকে নাম না জানা ফুলের বিস্মৃত অথচ ঘোরলাগা ঘ্রাণ আসছিল। ছলিমের লোলদৃষ্টি হাজেরার পা হতে লেহন করে করে মুখের কাছে এসে থেমে গেল। চোখ বুঁজে সারা দেহ কাঁপিয়ে ঘন আর তপ্ত নিঃশ্বাস ছড়াচ্ছিল হাজেরা আর স্পর্শ বিহ্বল ছলিমের হাত হাজেরার সারা শরীর মথিত করছিল। এক অভূতপূর্ব উত্তেজনায় ছলিম শিহরিত হয়ে উঠলো।
যে অঙ্গসৌষ্ঠব, যে লাবণ্য আর যৌবনের লালিত্য জীবনের প্রথম রাতে হাজেরা তাকে উপহার দিয়েছিল, তা আজ অতীত। তার সর্বস্ব শুধু এক হাড় জিরজিরে শরীর। অতীতের সুখস্মৃতিমন্থন শেষে বর্তমানের কিনারে এসে দাঁড়াতেই ছলিমের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। কুঞ্চিত কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে একফোঁটা গরম অশ্রু।
ছলিম মন্ত্রচালিতের মতো মালিশের কৌটাটা একপাশে সরিয়ে রাখলো।
ছলিম হাজেরার আর্তির কাছে নিজের অসহায়ত্ব নিয়ে আজ দুপুরেও একবার কেঁদেছিল। হাঁপাতে হাঁপাতে হাজেরা একটি কথাই শুধু বলছিল তখন, ‘কিছু ভালো ঠ্যায়ে না। ভালো ঠেয়ার কোনো ওষোধ আছে?’
নদীর ধারে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হলো না ছলিমকে। ছলাৎ ছলাৎ শব্দে কিছুটা কৌতূহলী হয়ে দেখলো একটা ছিপছিপে নৌকা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। এখন বৃষ্টি নেই, কিন্তু কালো মেঘে আকাশ গম্ভীর হয়ে আছে। ছলিম হাঁক দিলো, ‘ছদর, ও ছদর।’
বৈঠা সঞ্চালনে বিরতি হলে প্রতু্যুত্তর এলো, ‘হ, কেডা?’
-আমি ছলিম।
-ব্যান রাত্তিরি (ভোরে) নদীর ঘাটে ক্যান, খবর কী?
-হাজেরার অবস্থা খারাপ! উঠে যাবে মনে অয়। মাইয়ে দুইডেরে খবরডা দিয়ো। হাজেরার ইচ্চে, শেষ দেহা দ্যাকপে।
-শুনে মনডা খারাপ অয়ে গেলো। তুমি বাড়ি যাও। খবর পৌঁছোয়ে দেবানি।
ছলিম ফিরে আসছে। মনে একধরনের দ্বিধাময় আনন্দ। মেয়ে দুটোকে সে হাজেরার মৃত্যুর আগেই খবর দিতে পেরেছে। বিকেল নাগাদ মেয়েরা বাড়িতে পৌঁছে যাবে। মায়ের রোগশয্যার পাশে তারা দু-দণ্ড অশ্রু বিসর্জন করবে, মায়ের বিশীর্ণ খসখসে শরীরে শীতল পরশ বোলাবে। হাজেরার কথা রাখতে এতটুকু ছাড়া তার আর কিছুই করার ছিল না তার।
বাড়ির কাছে আসতেই আর এক পশলা বৃষ্টি নামলো। একটু দৌড় দিয়েই তাকে ঘরে উঠতে হলো। চারিদিকে ততক্ষণে আবার অন্ধকার ঘিরে আসছে। ভোরের দিকে হাজেরা গৌর কবিরাজের মালিশটা আরেকবার মেখে দিতে বলেছিল। কৌটা নিয়ে হাজেরার পাশে গিয়ে বসল ছলিম, হাত রাখল শরীরে। একি! হাজেরার সারা শরীর বরফের মতো শীতল!
ছলিম মন্ত্রচালিতের মতো মালিশের কৌটাটা একপাশে সরিয়ে রাখলো।