হুত হুতুমম্।
কি অশুভ ডাক! একঘেয়ে, বিচ্ছিরি! রাত বিরেতে এই অলুক্ষুনে পাখিগুলোর আর কাজ নেই যেন। যখন-তখন পুঁচকে-পাঁচকেদের পিলে চমকে দেয়। পরিও ভয় পায়। ভয় পেয়ে দিদিমার বুকের ভেতর একটু সেঁধিয়ে যায়। দিদিমা শূন্যে হাত ঝেড়ে পেঁচা তাড়ানোর ভঙ্গি করেন, হ্যাট, হ্যাট, যাহ্…!
আবারও নাকে ভারী নিঃশ্বাস পড়ে তার। ঘুমে বিভোর হন দিদিমা।
পাখিগুলো অলক্ষ্মী। রাত-বিরেতে ডাকলে অমঙ্গল হয়। বিচ্ছিরি মারকুটে চেহারা। পাটকিলে ছাই রঙের পালকে বিদঘুটে ছোপ ছোপ। হিংস্র শ্বাপদের মতো ধারালো নখ। চোখ দুটি জ্বলন্ত, ধকধকে পিঙ্গল। ভাবতেই গায়ে কাঁটা দেয় পরির। আসন্ন অমঙ্গল চিন্তায় কেঁপে উঠে সেঁটে আসে দিদিমার বুকে।
হুত হুতুমম্…,হুত হুতুমম্…
আবারও অলক্ষুণে ডাক। থেমে থেমে। এবার যেন আরও কাছে। পাখিটা বোধহয় নতুন এসেছে ওদের পাড়ায়। গত তিন রাত ধরে একটানা ডাকে। রাত বারোটার পর ডাকে। থেমে থেমে পাঁচ-সাত মিনিট পরপর। ডাকটা ধীরে-ধীরে টোলার বাগের গলি দিয়ে পাকা রাস্তার মোড়ের দিকে চলে যায়। তিন রাত ধরে ও একটা কিছু টের পেয়েছে। বারোটার পর রাতটা কেমন থমথমে হয়ে যায়। চুপচাপ। বাতাসে অদৃশ্য আতঙ্ক ওঁত পেতে থাকে যেন। শুধু নতুন পেঁচাটা একঘেয়ে ঘোঁত-ঘোঁত করে ডাকে। থেমে থেমে ডাকে। কান খাড়া করে শোনে পরি। হঠাৎই ওটার ঘোঁত-ঘোঁত শব্দ ওর কাছে করুণ ঠেকে।
হুত হুতুমম্…ম্
আরও একটু কাছে এবার। জানালাটার ওপাশে। বিছানায় শুয়ে শক্ত হয়ে থাকে পরি। ওটার টানা টানা ডাকের শেষে গলায় ঘড়-ঘড় শব্দ স্পষ্ট শোনা যায়। যেন পাল্লাটা সরালেই গোল-গোল জ্বলজ্বলে দুটি চোখ দেখা যাবে। হঠাৎ সুপারি গাছগুলোর মাথায় ঝুপ করে একটা শব্দ হয়। আর তখনই ডাকটা ধীরে ধীরে টোলার বাগের গলি দিয়ে পাকা রাস্তার মোড়ের দিকে চলে যায়। এতক্ষণে কিঞ্চিৎ সাহস ফিরে আসে পরির বুকে। উঠে বসে সে। আস্তে আস্তে জানলার পাল্লা খুলে। কেউ নেই। ঝাঁকড়া আম গাছের মাথায় নতুন পেঁচাটা খোঁজে পরি। পায় না। গলিটা খা-খা করে। ল্যাম্পপোস্টের তামাটে আলোয় ভৌতিক লাগে সবকিছু। গলির ওপাশে দুতলা বাড়িটায়ও কোনো সাড়াশব্দ নেই। মরা। টোলার বাগের এই বাড়িটা আগে এমন ছিল না। পূজাদের বাড়ি ওটা। সাত ভাইবোন বাড়িটা মাতিয়ে রাখত সবসময়। এখন প্রায় খালি। ওদের বৃদ্ধ চাকর বাড়িটা পাহারা দেয়। পূজারা আসাম চলে গেছে। গলিটা পাকা রাস্তার দিকে চলে গিয়ে একটা মোড় নিয়েছে সামনে। মোড়ের মাথায় ঝাঁকড়া একটা আম গাছ। ছায়া ছায়া। সেদিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ চমকে ওঠে পরি। পাশেই কোথাও স্টেনগানের ঝাঁঝরা আওয়াজ উঠে। ঠ্যাট্…ঠ্যাট্…ঠ্যাট্…। বাতাসে বারুদের ঝাঁঝালো গন্ধ। শব্দ করে পাল্লাটা টেনে দেয় পরি। দৌড়ে গিয়ে দিদিমার বুকে শুয়ে পড়ে কাঁপতে থাকে।
বেলা বারোটা। পরিদের মিরপুর রোডের বাড়িটাও আজকাল খা-খা করে। কেউ হাসে না। পরির বড় বোন তরিকে গ্রামের বাড়িতে পাঠানো হয়েছে। দাদারা সবাই মুক্তিবাহিনীতে নাম দিয়েছে। অনেকদিন হলো বাড়িতে আসে না কেউ। উঠোনের ডালিম গাছটার নিচে আনমনে এক্কাদোক্কার কোট কাটছিল পরি। এইসময় আবার শুনল ডাকটা: হুত-হুতুমম্!
চমকে তাকাল পরি আকাশের দিকে। একটা একটা করে সবগুলো গাছের মাথায় নজর বোলাতে লাগল। নাহ্। কোথাও নেই। চারপাশে খুঁজতে গিয়ে হঠাৎ চোখ আটকে গেল ওর। লোকটা ওখানে বেড়ায় ঠেস দিয়ে বসে কী করছে! ময়লা কাপড়-চোপড়। অতবড় লোহার গেট পেরিয়ে আসলই বা কী করে! বুঝতে পারে না পরি। তবে এটা নিয়ে ওর মাথাব্যথা নেই। মনে যে শুধু পেঁচার ডাকটাই তোলপাড় করছে। লোকটার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল,
ডাকটা শুনেছ?
লোকটা শুধু মাথা ঝাঁকালো। পরি দেবদারু গাছটার দিকে মুখ তুলে বলল, ওই দিকে তাই না?
মুচকি হাসল লোকটা। বলল, উঁহু…।
অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো পরি, তবে কোথা থেকে এলো?
লোকটা তার বুকের দিকে ইশারা করে বলল, এখান থেকে।
সতর্ক হল পরি। লোকটাকে ভালো করে খেয়াল করল। কেমন যেন বোকাবোকা। কাঁচাপাকা দাঁড়ির আড়ালে সরল হাসি। তার দিকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে লোকটা বলল,
আমাকে এক গেলাস পানি দেও না বুবু।
কে তুমি?
আমি? আমি হরবোলা।
হরবোলা? কপালে কুঞ্চন তুলে পরি, এটা আবার কেমন নাম?
এটা নাম নয় বুবু। কিছুক্ষণ ভেবে লোকটা আবার বলল, ঠিক আছে, আমি তবে প্যাঁচা।
হেসে ফেলে পরি, তুমি পেঁচা হবে কেন?
হুত হুতুমম্।
এইবার চোখ কপালে ওঠে পরির। অন্য কোথাও তো নয়, লোকটার গোল ঠোঁটের ভেতর থেকেই উঠে এসেছে ডাকটা! চেঁচিয়ে উঠে পরি, উমা… তুমিই তবে পেঁচা!
আজ দুদিন ধরে পেঁচার আনাগোনা বেশি। সুপারি গাছের মাথায় ঝুপ ঝুপ আওয়াজ। পাকা রাস্তায় মচমচ শব্দ। নিশুতি রাত ক্রমে গাঢ় হলে বেড়ে যায় তাদের অভিসার। তারা অস্ত্র রেখে আসে ফকিরাপুলের কাছে। আর সেখান থেকে চালান হয়ে যায় বিভিন্ন ঘাঁটিতে। হরবোলার কাছে পরি শুনেছে, পূজাদের বাড়িতে নাকি অস্ত্র মজুদ আছে। সেখান থেকেই বিভিন্ন প্লাটুনে সাপ্লাই দেয় তারা। আজ সাপ্লাইয়ের শেষ দিন। পূজাদের পাশের বাড়িটা সন্দ্বীপদের। খালিই ছিল এতদিন। কয়েকদিন হলো কিছু বখাটে এসে জুটেছে। সারাদিন গানবাজনা করে করে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে পড়ে থাকে। পরি কিন্তু জানে ওরা কেউ বখাটে নয়। বড়দাকে গোপনে ওদের জন্য খাবার নিতে দেখেছে একদিন।
আজ একটা অপারেশন আছে। বড় ধরনের অপারেশন। হরবোলা বলেছে ফকিরাপুলটি উড়িয়ে দেওয়া হবে। সুইসাইড স্কোয়াডের একটি দল পায়ে ফ্রগফ্লিপার লাগিয়ে সাঁতরে নদী পার হবে। ফ্রগফ্লিপার হলো ব্যাঙের পায়ের মতো নকল পা। ডুবুরিরা পরে। তারপর গ্রেনেড আর বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া হবে পুলটি। গ্রেনেডগুলো সুইসাইড স্কোয়াডের প্রত্যেকের কোমরে বাঁধা থাকবে। বাকি আরও কয়েকটা দল দূর থেকে বোমা ছুড়বে। হরবোলার কাজ হলো যারা বোমা ছুড়বে তাদের সাহায্য করা। বোমা কিভাবে ছুড়তে হয়, সেটা জানে পরি। হরবোলা বলেছে।
হুত হুতুমম্।
জানলার ঠিক ওপাশে। উঠে গিয়ে পাল্লা খুলে পরি। সেই মুখ, কাঁচাপাকা দাড়ি।
বুবু, আজ যা একখান অপারেশন হবে না, তা কমু আর কি। খানসেনারা গুষ্ঠিসুদ্ধ পালাবে।
তাই নাকি! ফিসফিস করে পরি, জয় বাংলা হবে তো?
কি যে কও বুবু, তোমার প্যাঁচা যুদ্ধ করব আর জয় বাংলা হব না, সেইটা হয় ক্যামনে।
মনে মনে হাসে পরি, সত্যিই তুমি আমার প্যাঁচা, আমার হরবোলা
সেই দিনের পর থেকে প্রায়ই আসতো হরবোলা। পরি একবার বায়না ধরে বলেছিল,
আমাকে ডাকটা শিখিয়ে দাও না। হরবোলা বলেছিল,
শিখাব বুবু শিখাব। তার আগে বাংলা জয় হোক। তোমাকে আমি প্যাঁচার ডাক, কুটুমের ডাক, ঘুঘুর ডাক সব ডাকই শিখাব।
জয় বাংলা কিভাবে হবে?
কেন, আমরা যুদ্ধ করব। পাকবাহিনী তাড়িয়ে দিলেই জয় বাংলা হবে।
চোখ বড় বড় করে পরি বলেছিল, তুমি যুদ্ধ করো!
সন্দ্বীপদের বাড়ির ছেলেরাই সুইসাইড স্কোয়াডে নাম লিখিয়েছে। তাদের মধ্যে যে দু’জনকে বাছাই করা হয়েছে ওরা এসে নিঃশব্দে হরবোলার পেছনে দাঁড়ালো। হরবোলা ফিসফিস করে বলল,
যাই বুবু, ওরা এসে গেছে।
বিড়ালের মতো নিঃশব্দে ওরা টোলার বাগের মোড়ের দিকে এগিয়ে গেল। ঝাঁকড়া আম গাছটার নিচ দিয়ে ধীরে-ধীরে মিলিয়ে গেল। শুধু বাতাসে রাত দ্বিপ্রহরের ডাকটা ভেসে এলো, হুত হুতুমম্…ম্।
আবার সুনসান নীরবতা। খা-খা পথ। কিছুক্ষণ ল্যাম্পপোস্ট আলোকিত পথের দিকে চেয়ে থেকে ফিরে এলো পরি। এক বুক আতঙ্ক আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে সেঁধিয়ে গেল দিদিমার ঘুমন্ত বুকে। একসময় মাটি কাঁপিয়ে আওয়াজ উঠল। মানুষের চিৎকার, চেঁচামেচি ছাপিয়ে উঠে এলো বারুদের গন্ধ। বুকের ভেতর ঢিবঢিব আওয়াজ নিয়ে সে রাতে আর ঘুমুতে পারল না পরি।
পরদিন সুবহে সাদিকের আগেই সঙ্গীদের নিয়ে হাসিমুখে বাড়ি ফিরল বড়দা। পরি জানত বড়দা এই অপারেশনের কমান্ডার ছিল।
কেমন হলো অপারেশন?
বাবার এই প্রশ্নের জবাবে বড়দা বলল, সাকসেসফুল।
কোনো ক্ষয়ক্ষতি… আই মিন কেউ আহত হয়নি তো?
উদ্বিগ্ন কণ্ঠ বাবার।
না বাবা তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি…। শুধু একজন পেঁচা শহীদ হয়েছেন।
পেঁচা…!
দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা পরির ছোট্ট বুকটা ভেঙে খানখান হয়ে গেল। গলার ভেতর সহস্র কান্না দলা পাকিয়ে মুহূর্তের মধ্যেই তাকে বিমুঢ় করে দিয়ে গেল।
১৯৭২ সাল। এপ্রিলের শেষ দিক। প্রচণ্ড গরম একটা রাত। দিদিমার কাছে শুয়ে আছে পরি। বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় ঘেমে নেয়ে অস্থির। ঘুম আসছে না। দিদিমার হাত পাখার বাতাসের সঙ্গে জানালা দিয়েও ফুরফুরে বাতাস আসছে মাঝে মাঝে। রাত্রি হয়তো দ্বিপ্রহর। এই সময়-
হুত হুতুমম্…
ধক করে উঠল পরির বুকটা। হরবোলার কাঁচাপাকা দাড়িওয়ালা মুখটা মুহূর্তেই ছবির মতো ভেসে উঠল চোখে। সম্মোহনের মতো ছুটে গিয়ে জানলার পাশে দাঁড়ালো পরি। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় পথটা খা-খা নীরব। শুধু ঝাঁকড়া আম গাছটার ডালে বসে রয়েছে বিরাট পেঁচাটা। পাটকিলে ছাই রং। কটকটে জ্বলন্ত চোখ। সেদিকে তাকিয়ে পরির মুখ থেকে আনমনে বেরিয়ে এলো-
হরবলা…!
মন্তব্য