তুই বুলু ফিলিম দেহিছিস?
সিডা আবার কী?
দেহার ব্যবস্থা করবানি একবার, তোরে বাসা ভাড়া কইরে শহরে নিই আগে, তহন বুজবিনি সেডা কী।
সিডা পাওয়া যায় কোহানে?
যহন দেখপিনে, তহন বুজবিনি। এহন আমি যেমন কই শোন। তুই উপুড় হ দেহি।
না, দিনির ব্যালা আমার নজ্জা হরে।
আমার কাছে তোর আবার নজ্জা কী অ্যাঁ? তোর কাছেইবা আমার নজ্জা কী। আমরা দুজনে অলাম দুজনের ভালোবাসার মানুষ।
অ্যাঁ, এইসব কাম তো আর একলা একলা শেহো নাই। এই এক কথা আরও কয়জনারে শুনোই আইচো, কও দেহি?
তুই দেহি ভালোই বুজিস! আমি আরও তোরে বোকা ভাইবে বইসে আছি। তোর বেরেন তো খুবই ভালো।
বোজবো না, তিনদিনি এহেবারে ভাদ্দরের পানির মতো ভালোবাসা উতলোই পড়তিছে? শেষের কথাটি বলতে গিয়ে বেদানার মন বুঝি বালুর পাড়ের মতো ঝুপ করে ওঠে। কিন্তু চোখের নদী এখন সাঁতার কাটছে স্বপ্নের মোহনায়। এখন শুধু কথার পিঠে কথার পালা। পরিবেশ ঘোলা করতে সে চায় না।
অ্যা, ভালোবাসা অতি আবার সুমায় লাগে নাকি? তোরে দেইহে-ই তো আমার মাথায় আগুন ধইরে গেছে। তাই তো গুরুত্বপূর্ণ সব কাজকাম ফেইলে তোর সঙ্গে চইলে আলাম। আর এই যে আমরা একত্রি থাকতিছি এর নাম অলো গিয়া লিব-টুগেদার।
কী টুগেইদার?
ওয়া আমি তোরে পরে বুজোবানে। এহন তুই উপুড় অ কলাম!
না, ওই রহমডা রাতির জন্যি থাহুক।
না থাকপে ক্যা, রাতির জন্যি অন্যরহম আরও দেহাবানি।
তিনদিন ধইরে তো মেলাই দেহাচ্ছো। তুমার অতো রকমসকমের তে দাদা-দাদির আমলেরডাই ভালো…।
পাটখড়ির বেড়ায় কানের ঘষা লাগলেও খসখস করে শব্দ ওঠে। তবু কলমি ননদ আর তিনদিনের নতুন ননদাইয়ের কথার অংশবিশেষ শুধু নয়, পুরো অংশ প্রথম দিন থেকেই এমনি এমনি কানে ঢোকাতে কান ঠেসে রাখে পাশের রুমের বেড়াতে। দেখেও ফেলে কিছু অংশ। হঠাৎ ডালিম এসে পড়লে, সে যদি খেজুরপাতার পাটিটা বিছিয়ে বিশ্রাম নিতে কাৎ হয়। তো কলমি ক্রমাগত পরের বাকলের কাঁটা নিজের গায়ে তুলে স্বামী ডালিমের গায়ে হাত-পা জড়িয়ে সেঁটে পড়ে থাকে। যদি সে একটু তেতে ওঠে এই আশায়। দুই-একবার তার বোন আর তার বোনের স্বামী সম্পর্কে গরম মুখ খুলতে গিয়ে ধমক খেয়েছে—তুই আরেক বিটার এইসব কাব্বিসাব্বি দেহিছিস? স্বামীর ধমকে ঢোঁক গিয়ে দোষ কাটার জন্য যেই পেট থেকে নতুন প্রসঙ্গ টেনে তুলে আনবে কলমি, অমনি তার আগেই ডালিম আস্ত বাঁশ ফাঁড়ার চড়াৎ চড়াৎ শব্দের মতো আবার বলে ওঠে, পরের এইসব দেখলি কিন্তুক তালাক হয়ে যাতি হয়।
তালাকের প্রচণ্ড ভয় স্বামীর গায়ে ছড়ানো হাত-পা সরিয়ে আবার অন্য দিকে ফিরে ঘাপটি দিয়ে থাকে কলমি। কারণ মুখের ওপর বোনকে তিন তালাক বলে ফেলে চলে গেছে তার বোনের স্বামী। সেই ঘটনার দেন-দরবার এখনো শেষ হয়নি। তার ওপর তার নিজের বিয়েটা যদি নড়বড়ে হয়ে যায়। তবু ডালিম যখন তাকে সোহাগে ফেনিয়ে সরবত করে তোলে, তখন সাধ জেগে থাকে ননদ বেদানার মতো আসন পাল্টাপাল্টি করতে। কিন্তু এক মিনিটে ডালিমের সব ফস! তারপর আবার রগচটা ডালিম ওর বেড়ার ফাঁক গলিয়ে উঁকিঝুঁকির কথা টের পেলে হাড্ডিগুড্ডি একাকার করে দেবে। জানতে চাইবে, তুই এইসব শিখলি কারতে, অ্যাঁ? তাই কলমির এই ক’রাতের বেশিরভাগ সময় কেটে যায় না ঘুমিয়ে। কাঠির মতো চিকন শরীরের ডালিমের ক্ষীণ গরম নিঃশ্বাসে পেঁচিয়ে সে বুকের ওপর কল্পনা করে খিন্ন বেষ্টনীর ওপাশের তাগড়া লৌহপুরুষটিকে। অতৃপ্ত বাসনা তাকে মনে মনে বেদানার পাশে নিয়ে শোয়ায়। ঘুমন্ত স্বামীর পাশে কলমি ননদের সঙ্গে একই পুরুষের উত্তপ্ত শরীর ভাগাভাগিতে রপ্ত হয়ে ওঠে। অবশ্য বেদানা তখন আর তার ননদ থাকে না। যেন সম্পর্কশূন্য উদ্দাম দুটি রমণীর মাঝে একটি সবল পুরুষ মিলে, মোট তিনটি প্রাণী একাকী ভিন্ন কোনো গ্রহে আশ্রয় নিয়েছে। নেউল হয়ে সাপের সঙ্গে একসঙ্গে যৌবনে অনবদ্য আস্বাদিত হতে। দিনের আলোতে পৃথিবী এখন কলমির কাছে বড় বেশি রঙচটা। চারখানা রঙচটা টিনের থালা। দুটো হাঁড়ি। একটা আংটা ভাঙা কড়াই। মাটির কলস দুটি। দুটি টিনের মগ। খড়ের বিছানায় ঝুরঝুরে কিছু কাঁথা-বালিশ। ডালিমকে আর সে অবলম্বন হিসেবে ধরতে পারছে না। তার গুরুত্ব সংসারের ওই সব তৈজসপত্রেরও নিচে নেমে গেছে শুক্কুর আলিকে দেখার পর থেকে। জীবনকে বাঁধতে হবে শুধু সংসারের এইটুকু হাঁড়িকুড়িকে নিয়ামক জেনে? নিয়মগুলো বড় বেশি গোঁজামিলে ঠেকে কলমির। নিজের কপালের দু’পাশে রগ চেপে রাখে সে।
বেদানা এক পুষ্টাঙ্গ ষোড়শী। মাঝারি উচ্চতা। গায়ের রঙ তামাটে। তবু পাড়া ছাড়াও বাইরের গ্রামের সোনারঙ ছেলে-ছোকড়ার দল বেঁধে বেদানাদের বাড়ির আশেপাশে নিষ্ফলা গাছেরও আগডালে উঠে বসে থাকত। বেদানা এই উপলক্ষে তার সাধ্য মতো মূল্যে কেনা স্নো-পাউডার মেখে সাদা হয়ে থাকত। টানা চোখে গাঢ়ো কাজল। কমলার কোষের মতো ঠোঁটে টুকটুকে লিপস্টিক আর টারসেল বাঁধা হাঁড়ি খোঁপা দেখে যে কেউ বেদানাদের নাড়ার আগুনে গনগনে চুলোর লাগোয়া জীর্ণ, পর্ণকুটিরের কাছে এগিয়ে, কিছুক্ষণ না দাঁড়িয়ে আজও পারে না। সেজেগুজেই দরজার সামনে তোলা চুলোয় দু’বেলা সে আর তার ভাইয়ের সদ্য বিয়ে করা স্ত্রী রান্না চড়িয়ে হাতে হাতে কুটনো কোটা বাটনা বাটা সারে।
রান্নার কাজটা বেশিরভাগ সময় বেদানাকেই সারতে হয়। কারণ তার ছোটভাইকে সঙ্গে নিয়ে মা ভিক্ষে করতে বেরিয়ে যায় সাত সকালে। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। কিন্তু এই সেদিনও, বিয়ের আগে বড় ভাই ডালিম সময় মতো ঘরে এসে খাবার না পেলে সে বেদানার খবর করে সারতো সারাবাড়ি। এখন বউ আসায় কিছুটা রক্ষা পেয়েছে। সংসারের কাজকর্মের কম-বেশি ভাগ নিয়ে বেদানার কোনো উচ্চবাচ্য নেই। তার দিন এত ফুরফুরে কাটে কীভাবে, বেদানা নিজেরও টের পায় না। দু’কলসি পানি আনতে পুকুর ঘাটে গেলে তাতেই পাড়ার ঝি-বউদের টিকাটিপ্পনি। কিন্তু বেদানা অতো কিছু গায়ে মাখার বুদ্ধি রাখে না। বুদ্ধিতে সে একটু ভোঁতাই সবার চোখে। না হলে নওশাদই-বা বিনা শর্তে অবলীলায় তার অমন শরীরটি চেয়ে পায় কিভাবে? নওশাদকে কখনো বলতে হয়নি—তোকে আমি বিয়ে করে কুলবধূ বানাবো বেদানা। তুই আমার জানের জান।
বেদানা জানে মিঞাবাড়ির বারো ক্লাস পড়–য়া ছেলে নওশাদ আলী কোনোদিন তাকে বিয়ে করবে না। তবু সে সময় করে তক্কেতক্কে থেকে নওশাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করে করে আসে। নাকি নিজেরটাই পূর্ণ হয় ষোলআনার ওপর আঠারো আনা, তা বেদানাই জানে। কোনো কোনো পুকুরের ঢাল, অথবা কোনো ঝোপ গ্রামবাসীর কেচ্ছার উৎসস্থল হয়ে গেছে, বেদানা আর নওশাদকে নিয়ে।
নওশাদ মুখের কাছ থেকে মুখ, বুকের কাছ থেকে বুক ছাড়িয়ে নিয়ে উঠতে উঠতে একবারে নিজের কোমর বরাবর বেদানার কোমরে অবধি এসে, প্রতিবার বলে—তোর জন্যি আমার কী অলো দেখছিস? হাঁটু ছুঁলে গেছে মাটির ঘষায়।’ বেদানা এতেই গলতে শুরু করে। লেপ-তোষক, তুলতুলে বালিশের বিছানা না পেলেও সে মনে করে—এই লীলা তার অবলীলায় চলতে বাধা সৃষ্টি করে, এত সাহস কার? মিঞাবাড়ির চেয়ে দাপট আর কোনো বাড়ির আছে নাকি? আর নওশাদ হচ্ছে বাড়ির সবচেয়ে বড় ছেলে। চার বোনের সে একটাই ভাই। একটি মাত্র ছেলে দেখে মা-বাবা তাকে চোখের সামনে দেখতে চেয়ে কোথাও যেতে দেয়নি। না হলে ওর সহপাঠীরা শহরে গিয়ে বড় বড় চাকরি করছে। নওশাদের চেহারা বা মেধায়ও সে কারো থেকে খাটো না।
নওশাদ প্রায় প্রতিদিন বেদানার সবটুকু পেয়ে গেলেও, এদিক-সেদিক যাওয়া-আসার পথে বেদানার খুচরো-খাচরার লোভে ঘোরে উঠতি বয়সি অন্যেরাও। যারা তার জন্য বাড়ির আশপাশের মগডালে উঠে বসে থাকে, তারা সুযোগ পেলেই বেদানার চাঁদের মতো যুগল স্তম্ভে খাবলা বসিয়ে দেয়। এতে বেদনা অগ্নিমূর্তি ধারণ করে পাড়া মাথায় করে গালাগালে। এইসব কা- নিয়ে ঢিঢি পড়ে গেলে বাড়ির অন্য দু-চার ঘরের দুর্বল-নিরীহ মানুষেরা ক্ষিপ্র হয়ে ওঠে। বেদানার একার দুরাচারের দুর্মম অভিযোগে তাদের সবাইকে একসঙ্গে গ্রাম ছাড়া করতে চাইলো যখন, তখন ডালিম পিঠেপিঠি বোনটির চুলের মুঠি ধরে টেনে কার একখানা পাঁচনি এনে এমনভাবে পিটানো শুরু করে দিলো, কারো আর ঠেকানোর জো থাকলো না।
কোনো বিলাপ নেই, শুধু লাগাতার ওয়োও…ও…ও ছাড়া। এমনিতেও বেদানা প্রতিবাদী স্বভাবের নয়। একেবারে চুপসানো গোছের মেয়ে। জীবনের সবদিকে একটু করে সচ্ছলতা থাকলে এমন মেয়েদের বুঝি থলথলে, লক্ষ্মী বউ হতে সময় লাগে না। স্বামীর খেয়ে পরে দেওরদেরও যারা সন্তুষ্ট রাখতে পারে টিকাটিপ্পনিতে।
ডালিম পাঁচনিখানা কোমরে গুঁজে ক’দিন চলাফেরাও করেছে। বলেছে, যেই খানকির বাচ্চা ওয়ার দিকি নজর দেবে, তারে আমি এইহান গোয়া দিয়া ডুহই দেবো। তাগে সগলির মা-বুনরে ইবার আমি টাইনে বাইর করবো। মিঞাবাড়ি, ভূঁঞাবাড়ি, চৌধুরীবাড়ি সব এক কইরে দেবো…। ভাইয়ের তর্জনে-গর্জনে এইভাবে ক’দিন বেদানার কাটতে না কাটতে পাশের বাড়ির একজনের স্ত্রী মারা গেলো সূতিকা রোগে। এতে বেদানার মা-ভাইসহ বাড়ির মুরব্বি শ্রেণীর ক’জন বর্তে গেলো। পঞ্চাশের কোব্বাত আলীর সঙ্গে যাকে বলে সেধেই বিয়ে দিয়ে দিলো। তবে মোহরানার টাকাটা একটু বেশিই ধরে নিয়েছিলো তারা। কিন্তু দুই হাজার টাকা উসুল দেখিয়ে বরপক্ষ নগদ রাখলো মাত্র এক হাজার। আধাবয়সির অধিক মানুষটা নাকে, কানে কোনো গহনা তুলে না দিতে পারলেও এক হালি ছেলেমেয়ের মধ্যে কন্যার বয়সি বেদানার এত্তসব জানার পরও আদিখ্যেতার কমতি রাখেনি। কিন্তু অভাবের সংসার বেদানাকে ধরে রাখতে পারলো না। না আধাবয়সী কোব্বাত আলীকে দিয়ে তার রাতের ঘুম পূর্ণ হচ্ছিলো না সবরকমের কথাই সমান রটতে থাকলো।
তারপরও বেদানার ওরকম আরও দুটি আধাখাস্তা বিয়ে হয়েছিলো। কিন্তু নওশাদই যেন তার মাথা খেয়ে রেখেছে। ওর মতো করে সে কাউকেই পায় না। ওর শরীরের টগবগে কাব্য যেন ওই নওশাদ ছাড়া আর কেউই হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না। ওর ওইটুকু ছাড়া ঘর-সংসার, দুনিয়াদারি বড় অহেতুক ঠেকে বেদানার কাছে। অতৃপ্ত শরীর নিয়ে হাঁড়ি ঠেলার ধকল সে মানতে রাজি নয়। শেষবার ছয়মাস বয়সী বিয়ের স্বামীর বাড়িতে বসে নওশাদের শারীরিক পারঙ্গমতার বর্ণনা পুঁথি পড়ার মতো যখন গাইতে শুরু করলো, সবাই তাকে খবিশে ধরেছে বলে বাপের বাড়ি ঠেলে পাঠিয়ে দিয়ে বাঁচলো।
বারবার ঘর ভাঙা বেদানার এবার ছাড়া কুকুরের মতো দশা। লজ্জা-শরমের আগামাথা, আর মিঞাবাড়ির ইজ্জত খাওয়া বেদানার খিস্তিতে এবার গতর পোড়ার ভয়ে তার সামনে আর কেউ কিছু বলে না। চতুর্দিকে খ্যাতিমান বাড়ির ছেলে নওশাদের বদনাম ছড়িয়ে পড়েছে শুধু বেদানার কারণে। কিন্তু এ বিষয়ে বেদানার সঙ্গে নওশাদের কোনো উচ্চবাচ্য হয়, এমনটি কেউ শোনেনি। নওশাদের দু-চারজন বন্ধুবান্ধব তাকে এ বিষয়ে বোঝাতে চেয়ে বেয়াকুফ বনেছে। এতে সহজেই বোঝা যায়, বেদানার জন্য নওশাদেরও বুকের কোনো একটা কর্নার বড় নরম। তাই দু’জনের মিলনে বিপত্তি যতই থাক, মানুষ মুখে মুখে গল্পে অসাধ্যটুকুরও সরস অধ্যায় হয়ে ওঠে।
মাত্র ক’দিন কলমি একা একা তিন বেলা চুলোয় আগুনে ঝলসে, ডালিমকে বলা শুরু করেছে, এবাবে আর কদ্দিন? তুমার বুন বিয়ে বইসে রানী অইয়ে গেছে। বিটারে নিয়ে, সারাদিন ঘরের ঝাপ বন্দ হইরে রাহে। আর তিনবেলা ঝুপুরঝুপুর হইরে এট্টু নাইয়ে, চাইরডে খাইয়ে আবার শুরু হরে।
শুরু হরে? কী শুরু হরে?
তুমি বোজো না? যহন ঘরে আসো, তুমার কানে কিচ্ছু ডোহে না। আমি এতো রানতি বাড়তি, পানি আনতি পারবো না। এই আমার শ্যাষ কতা!
কিন্তু মাত্র ক’দিন আগের ঘটনা ছিলো এরকম—বেদনার চোখের নিচে কালি দেখেই হোক, আর কাজের মানুষের আকালেই হোক, চৌধুরী বাড়ির ছোট বউ গ্রামে বেড়াতে এসে বেদানাকে দেখে, আগবাড়িয়ে কাছে ডাকলো। বললো, এহন ভালো হয়ে যা বেদানা। তুই ভালো মানষির মাইয়া। তোর বাপ কত ভালো মানুষ ছেলো। কারো সোনা পইড়ে থাকলিও ধরিনি।
আমি কি কারো কিছু ধরিচি নাকি চাচি, তুমি যে আমারে কতা শুনোচ্চো? শেয়ালের মতো খেঁকিয়ে ওঠে বেদানা।
না, ধরাধরির কতা না। তয়, কী সব শুনি…। তুই যদি ভালো অয়ে যাস, তা অলি তোরে আমারা নিয়ি যাই। তুই খুলনায় আমাগে কাছে গিয়ে থাকপি। আমি দুইদিনির জন্যি আইচি। তোর আতের কাজকামও পরিষ্কার। ছোটবেলায় কত দৌড়াই গিয়ে গিয়ে আমাগো বাড়ির কাজ করে দিতি, মনে আছে? তুই ভালো অইয়ে গেলি, তোরে আমরাই দেইহে-শুইনে আবার ভালো বিয়ে দিয়ে দিবানি!
বেদানা খুলনা যেতে রাজি হলো। নওশাদ এখন তাকে আর আগের মতো গুরুত্ব দেয় না। ক’দিন পুরনো নিয়মে ওয়াক্ত মতো নির্দিষ্ট ঝোপে, পুকুরের ঢালে গিয়ে অপেক্ষায় লগ্ন পেরিয়ে এসেছে। তার নিয়ামক এখন বৈধ আশ্রয়ে শেকড় গেড়েছে। তবু বেদানা যখন শোনে নওশাদ বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া লেগে প্রায় দিনই পাড়া মাথায় করে। আর এই পাড়ার কোনা-কানাচে বেয়ে তা বেদানার কানে আসে, সে তখন আত্মহারা হয়। নওশাদ নাকি বউকে একবার এও বলেছে, বেদানা যা দিতি পারে তুই পারিস না, তাই ওর কাছে না গিয়ে থাকতে পারি ন্যা…। আত্মপ্রসাদে বেদানার মনটা ভরে যায়। কিন্তু এর প্রকাশ বেদানার জানা নেই। সে তাই অক্ষম দু’কূলের মতো আপনার জোয়ারে আপনিই নদীর মতো ভেসে যায়। কূলভাঙা জলরাশির মতো কখনো ঘোলা হয়। সেও তেমনি বিমূঢ় কর্মকাণ্ডে আরও হয় উদ্ভট।
ফকিন্নি, এক বেশ্যার সাতে আমার তুলুনা কইরলা? ওই ফকিন্নির টান যদি না ছিঁড়তি পারবা, তো আমারে বে হইরে ক্যান আনছো। মা-বাপের মন রাখতি তুমি আমার জেবনডা কয়লা করছো। জমিলা বনেদি বাড়ির মেয়ে। বনেদি বাড়ির বউ। লেখাপড়া জানে। চালচলনও ভালো। জমিলা স্বামীর রুচির দীনতা দেখে চোখ কপালে তোলে। তারপর অভিযোগগুলো আওড়াতে থাকে। কিন্তু তা শোনা দূরে থাক, স্ত্রীর সে চোখ দুটি নামানোর ফুসরতও না দিয়ে হনহন করে বেরিয়ে যায় নওশাদ। ভোরে কারো কারো মুখে পাক খাওয়া বিপজ্জনক ধুলোর মতো, বহুল আলোচিত সেই অশ্রাব্য বুলি-ই ওড়াওড়ি করে—বেদানা আর নওশাদকে বড় জঙ্গলের নিজ্ঝুম পুকুরের দিক থেকে একসঙ্গে উত্থিত হয়ে যার যার পথে ফিরতে দেখেছে।
কিন্তু বেদানা হয়তো সেই যে কাল দুপুরে না খেয়ে শুয়ে পড়েছে তো আজ দুপুর পর্যন্তও কুণ্ডুলি ছাড়েনি। অথবা খেজুরগাছে রসের আয়োজন করতে ডালিম তার বাপের আমলের হাঁসুয়ায় ধার তুলে, রোদের তাপে বা চুলোর ঢিমে আঁচে ঠিলে পাঁকিয়ে তাতে ঠিকঠাক মতো রশি বাঁধতে একনাগাড়ে দু’দিন বাড়িই ছাড়েনি। সত্য মিথ্যার ভেদ এক করে ইদানীং বেদানার সম্পর্কে মিথ্যে অভিযোগও মাথাচাড়া দিতে শুরু করেছে। কিন্তু নওশাদকে আলিঙ্গনের আওতায় পেলে সে অবশ্য সব ভুলে যায়। দু’দিন না পেলে, অধিকারবোধ আবার অবলম্বন খোঁজে—শুধু রাঙা ফিতে, ক’টা রেশমি চুড়ি, আর ছুড়ে দেয়া তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের ক’টা টাকায় ক’দিন চলে?
চৌধুরী গিন্নির প্রস্তাবে এই প্রথম বেদানা হিসেবি হয়ে ওঠে। একখানা সোনার নাকফুল কোনোদিনই কি তার নাকে উঠবে না? একদিন কেউ থলে ভরে তার জন্য একটু বাজার করবে না? মাঝরাতে তার নিজের উথাল-পাথাল ঘুমভাঙা জাগরণে কাউকে ঠেলে তুলতে পারে না পাশ থেকে। এপাশ-ওপাশ করতে করতে খড়ের ওপর বিছানো ছেঁড়াকাঁথা আদুল শরীরে তিরিক্ষি জ্বালা ধরিয়ে দেয়। আর তার কিঞ্চিৎ আগুন নিরসনেই নওশাদের বউয়ের মনে গভীর আঁচ ফুটে মানুষের কানে হুল গজিয়ে ছাড়ে।
বেদানাকে নিয়ে সংসারের কাজে খুব একটা জুত হবে না। এটা চৌধুরী বাড়ির চার গিন্নি ছাড়া, কর্তাব্যক্তিরাও জানেন। তাই তাকে দিয়ে যেমন চলছিলো, অভিযোগ আর কারোরই তার চেয়ে আরও ভালোর জন্য ছিলো না। কিন্তু যেকোনো, ফেরিওয়ালা থেকে ফকিরের হাঁক শুনলেও বেদানা ডেকে তথ্য-তালাশ শুরু করে দেয়। মেজাজ বিগড়ে সবাই অপেক্ষা করে সুযোগ বুঝে ওকে ফেরত পাঠাতে। আধবেলা, পোয়া বেলা বেদানার হাওয়া হয়ে থাকা কোনো বিষয় নয়। কিন্তু সকাল থেকে দিন পার হতে চললে আর বসে থাকতে পারে না কর্তাপ্রধান। দিনকাল যা। শেষে কিনা গ্রামের শত্রুমিত্র এক হয়ে বলে—ওকে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। সেই গিন্নির দায় বেশি, যে আপদটি বয়ে এনেছে, সে ঝামটা মেরে বললো—কলিই অলো, বেইচে দিছি! সাক্ষী-প্রমাণ লাগবি না?
চৌধুরীদের চার ভাইয়ের মধ্যে বড় যিনি, স্বয়ং সেই রবিউল চৌধুরী কনিষ্ঠ ভ্রাতৃবধূর উদ্দেশে হুংকার ছাড়লেন—তুমি যে ওই কুলটাকে বেচোনি, সেইডা প্রমাণ করতিই তো তোমার জান বেরিয়ে যাবেনি ছোটবউ!
ভাসুরের কথা শুনে দোয়া-দুরুদ পড়া শুরু করলো ছোটবউ। বহুদিন পর ঝিমিয়ে মাগরিবের নামাজও পড়লো রমরমা হিন্দি সিরিয়াল রেখে। তবু তার মুখের শুকনো ভাব সারলো না। রাতে খেতে বসে যেসব আলাপ হলো, তাতে যে ধরনের মন্তব্য শুনতে হলো, তার সবই পিলে চমকানো। বাড়িতে একটা ফোন করা যায় কি-না, ভেজা বিড়ালের মতো স্বামীর কাছে প্রস্তাবটা পাড়লো ছোটবউ। স্বামী নূরু চৌধুরী বললেন, দুই-তিনজনের মোবাইল নাম্বার আছে হিসাবের খাতায় লেখা। খোঁজ নেয়াডা কঠিন কিছু না। কিন্তু এতে করে গ্রামের কেউ সুযোগ নিতি পারে। শত্রুর তো মুখ চেনা যায় না। মাইয়েডা না গিয়ে থাকলি, ওর মা-ভাই আগাম খবর শুনে তুলকালাম কা- বাঁধাবেনে। আর গিয়ে থাকলি লুকিয়ে অন্যরকম ফন্দি আটপে না, তা কওয়া যায় না। গিয়ে থাকলি হাতেনাতে ধরতি অবে! আর না গিয়ে থাকলি খোঁজাখুজির মধ্যি লাইগে থাকতি অবে। কারণ না খাওয়া মানুষির ভয়ঙ্কর বুদ্ধির অভাব নাই।
অতএব সুবুদ্ধির পরাকাষ্ঠায় ধৈর্য ধরে ক’দিন অপেক্ষা করতেই হয়। তবু ধারেকাছে যে যেমন পারছে খোঁজ চলছে। মেয়ে মহলের ধারণা, বেশি বেতনের লোভ দেখিয়ে কেউ হয়তো ফুসলে বাড়ির ভেতর আটকে রেখে দিয়েছে। কিন্তু কোনো আগল ফসকে আস্ত বেদানার একদানা খবরও যখন বের হলো না। নাকাল অবস্থা অনিবার্য হতে দেখে, সপ্তাহখানেক পরে নূরু চৌধুরী দোকানের কর্মচারী, অথবা ভাতিজাদের আর কারো পরিমিতি বোধের ওপর ভরসা রাখতে না পেরে, নিজেই খুব রয়েসয়ে রওয়ানা হলেন। প্রথমে নিজেদের বাড়িতে ঢুকলেন। কিন্তু কানটা রাখলেন চতুর্দিকে উদগ্র। পাতে দ্বিতীয় দফা ভাত দিতে দিতে তাদের একলা বাড়ির পুরনো ঝি এরই মধ্যে কাঁপা গলায় বলতে লাগলো—এবার এট্টা ভালো কাজ করছো বাজান।
কী? নূরু চৌধুরী তাজ্জব বনলেন। কারণ কোনো ভালোতে বাপ-দাদার আলম থেকেই তাদের আদিখ্যেতা থাকে না। যা নিয়ে গ্রামবাসীর কাছে তারা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসতে পারে।
ওই যে বেদানা মাইয়েডারে বিয়ে দেছো। সবাই কয় জামাই খুব ভালো অইছে..। বেদানারে ছাড়া কিচ্ছু বোজে না। ঘরজামাই অতি চায়। দ্যাশেরতে জমিজাতি বেইচে এইহানেই আবার কিনে বলে গেরস্থি হরবে। ছাওয়াল য়িসাবেও বেশ শক্ত, সমর্থ…। আমি জামাই দেকতি গেছিলাম। কোঁকড়া কোঁকড়া চুল। চান্দের মতোন গড়ন!
নূর চৌধুরী ভাতের থালা ঠেলে তখনি উঠে পড়লেন। নিরাসক্তির ভাব ফুটিয়ে তুলতে যতটা পারলেন হাঁটতে হাঁটতে সচেষ্ট থাকলেন। কোনো ঐতিহ্যহীন, মাহাত্মহীন, নিুবিত্ত, উচ্ছিষ্টভোগী, গ্রামের এক কোণায় কিছু মানুষের আবাসস্থল ছলিমুদ্দি ফকিরের বাড়ির সীমানায় পা রাখতেই, বাড়িটির মুরুব্বি শ্রেণীর কেউ কেউও তার পিছনে হেঁটে জটলায় পরিণত হয়ে গেল। ওভাবেই নূরু চৌধুরী এগোতে থাকেন মৃত ছলিমুদ্দি ফকিরের তালপাতার ছাউনি, পাটখড়ির বেড়ার এতটুকু ঘরখানার দিকে। ক’দিনের দুশ্চিন্তায় তার চেহারায় কালসিটে ভাব এসে গেছে। তার ওপর এখন তিনি আরও গম্ভীর।
একটা কিছু আন্দাজ করে কৌতূহলী লোকজন হাঁক ছাড়ল—ঘরে কিডা বাইর অইয়া আসো! ডালিম মিঞা নাই? ও ডালিম মিঞা…। ডালিম ঘরে নেই। ওদের মা-ও এসময় বাড়িতে থাকে না। কলমি নতুন বউ। বউদের এরকম হাঁকডাকে বেরোতে নেই। তাই ঝাপখানা খুলে, সরিয়ে রেখে বেদানা বেরিয়ে এলো। চৌধুরীকে দেখে তার চোখা নাক-মুখে কোনো বিকার ধরা পড়লো না। বরং স্বাভাবিক বলে উঠলো, কাগা, আপনাগে কইয়ে আসতে পারি নেই। বাড়ি ছাইড়ে আমার মন টিকতিছেলো না।
হারামজাদি, নষ্ট মাইয়ামানুষ…। চৌধুরী বেদানার গায়ে হাত তুলতে গেলে বয়স্ক ক’জন একসঙ্গে তাকে নিবৃত্ত করলো টেনে ধরে। বললো—থাক চৌধুরীর বিটা, ছুঁচো মাইরে হাত গন্দ করবা ক্যা? এরপর সময় ক্ষেপণ না করে নূরু চৌধুরী একাই নেমে যান। দাঁত কিড়মিড়িয়ে এ যাত্রার কেউ আর তার পিছে পিছে হাঁটে না। সবাই দাপাদাপি শুরু করেছে বেদানাদের ঘরের সামনে। দরজা দিয়ে পূর্ণিমার চাঁদের মতো স্পষ্ট হয়ে আছে একজন জড়সড় ফর্সা পুরুষমানুষ। ঘরে ফিকে মেঘের মতোও এতটুকু কোনো আড়াল নেই, এ সময়ে বিব্রতকর সবার চোখ থেকে তার একটু সরে থাকতে। ঝাপখানা সরিয়ে বেদানা সেই যে নিচে নেমে এলে সবার এফোঁড়-ওফোঁড় প্রশ্নে প্রকাশিত হয়ে পড়লো, চৌধুরী পরিবার বেদানাকে বিয়ে দেয়নি। তাহলে? প্রশ্ন ওঠে—ওই বিটারে পালি কোহানে? সরলমতি বেদানা ঘোরপ্যাঁচ খাটাতে চাইলেও, উত্তরটি সবার কাছে সরল অঙ্কের মতো অল্পক্ষণে প্যাঁচ খুলে আসল ফলাফল বেরিয়ে পড়লো। সে পালিয়ে আসার পথে লঞ্চঘাটেই শুক্কুর আলি লস্করের সঙ্গে প্রথম দেখা। তারপর লঞ্চে উঠে কথাবার্তায় সুবিধা বুঝে শুক্কুর আলি লস্কর আর পথ ছাড়েনি। সে বেদানাকে নিজে বাড়িতেই নিয়ে যেতে চেয়েছিলো। কিন্তু মা আর ছোট ভাইটির জন্য মন কেমন করায় বেদানা রাজি হয়নি। পরে লস্কর শিখিয়ে দিয়েছে—আমি যে যাবো তোর সাতে, বাড়ি গিয়ে কবি, আমাগো বে অইছে।
বেদানা আর ঘরে উঠতে পারেনি। অবস্থা আন্দাজ করে জড়ো হওয়া লোকজন একসঙ্গে হৈ হৈ করে উঠলো। তারপর ভিতরে ঢুকে একঝটকায় তারা বাইরে টেনে আনলো মানুষটিকে। লুঙ্গির গেরো কষে বাঁধা ছিলো না। পড়তে পড়তে সে তা ধরে বাঁধার চেষ্টা করছিলো মাত্র। কিন্তু ধাক্কা মেরে মেরে চৈত্রের গোবে নিয়ে ফেললো খোলা অবস্থাতেই। যেখানে ছোট কলস ডোবে না। একসেরি ঘটিবাটি ডুবিয়ে কলস ভরতে হয় কসরতে, সেইখানে চোবানোর নামে দুটোকে কাঁচামাটির জীবন্ত মূর্তির মতো বানিয়ে ছাড়লো বালকশ্রেণী। এরি ভেতর কেউ কেউ উৎসাহ ভরে গলা ফাটিয়ে বললো— মসজিদে যা, হুজুর ডাইকে আন! কলমা পড়াই দিই।
গোসলের পানি তোলার অতো হুজ্জত করার কেউ না থাকায়, দু’জনের গোসল ছাড়াই হুজুর ওদের বিবরণ শুনে দোয়া পড়া শুরু করলেন। দোয়ার ভিতরে চিকন করে দ্রুত বললেন—দুড্যারে অজু করাও!
কেউ একজন বলে উঠলো—অজুর আগে এগুলার গোছল লাগবি। ফরজ গোছল…।
অতো আয়োজন অতি অতি শালার বিটা পলাবেনে। দেহো না চোখ দুইডা কুতকততচ্ছে। ছাড়া পালিই বনবিলাইয়ের মতো দোড়োবেনে। শালা মানে অয় মাগীর দালাল। ও আসলে কয়দিন ফষ্টিনষ্টি কইরে বেদানারেও বেইচে দেয়ার মতোলবে ছেলো। ও মিয়ারা তুমরা ওরে ইন্দুর ছেঁচা দেও, আসল কতা বাইর অইয়ে পড়–ক…।
শেষের জনের কথা কারো কানে ঢুকলো না। তিনজন পুরুষমানুষ হুজুরের নির্দেশে একদল হয়ে বেদানাকে জিজ্ঞেস করলো মেহেরপুরনিবাসী আলামত লস্করের ছেইলে শুকুর আলি লস্করের সঙ্গে তুমারে বে দেয়া অতিছে, তুমি রাজ আছো? তিনবারের জায়গায় তিনজন মানুষ একই কথা বেশ কয়েকবার বলে ফেলেছে। কিন্তু বেদানার কান্নার হিক্কা আর থামেনি। সে কোনো কথা বলা দূরে থাক যেন শুনছেও না। ইতোমধ্যে তার মা এবং ভাই দুটিরও সেখানে আগমন ঘটেছে এবং এসব বিষয় বুঝতে কোনো মায়েরই খুব বেশি সময় ক্ষেপণ হয় না। বেদানার মা’রও হলো না।
ভিক্ষের ধামা কাঁখ থেকে কলমির হাতের ’পর নামাতে নামাতে ঘটনা শোনা সারা। আঁচল ঝেড়ে সারাদিনের ঘাম মুছে সে এসে পরম বাৎসল্যে বেদানার মাথায় হাত রেখে বললো—ক মা, ক রাজি আছি! তোর এট্টা গতি অলি আমার মইরেও শান্তি…।
আরও তিন-তিনবার করে, বাইশ বছরের জীবনে মোট নয়বার কবুল বলেও তিনটি বিয়ে কী স্বস্তি দিতে পেরেছে বেদানাকে? তিনবারই ফিরেছে সে খালি হাতে। দুচার হাজার করে মোহরানা ধার্য করা হলেও দুটো টাকা নিয়ে সে বেরোতে পারেনি কারো ঘর থেকে। তাই এই বিয়ে পড়ানোও তার কাছে অহেতুক ঠেকে। তার একঘেয়ে গোঙানির মধ্যে একজন বলে ফেললো—ক, কবুল কইয়ে ইবার ভালো অইয়ে যা!
মা’কে কাছে পেয়ে বেদানা তেজী হয়ে উঠলো। কুতকুতে চাহনির শুক্কুরের চোখের দিকে সরাসরি সড়কি’র মতো বড় চোখে তাকিয়ে বললো— রাজি আছি না তো ওরে দইরে আনলো কিডা? তোমরা তা জানো না?
মাগীর বুহে কইলজ্যার ধার আছে। না অলি মিঞাবাড়ির মান-সম্মান, সুখ-শান্তি খোয়ায় কীভাবে? নওশাদের মতো শিক্ষিত ছাওয়ালডারে পঁচাইয়া ছাড়ছে। সতীলক্ষ্মী বউডার কী বেগতি…।
নওশাদ আমারে ভালোবাইসে রাতিরবেলা ঘরের তে নাইমে আসে, সিডা আমার দোষ। কিন্তুক শ্যাষ রাতি নওশাদের বউ যে সেই জেনাখোর বিটারে কোলে জায়গা দেয়, তার বীজ প্যাটে ধরে, ছাওয়ালের মা অয়, সেইডা তার দোষ না? কোনো ভালো মানুষির মাইয়ে ঝুটো শরীর চাটে না! তার ওপর আবার সতীলক্ষ্মী? অমন সংসারের মুহি নাথি মাইরে যায় না ক্যান? খারাপ মানষির ঘর যে করে, সেও সমান খারাপ! মিঞাবাড়ির শুভাকাক্সক্ষীর গায়ে যেন পেট্রোল ঢেলে দিলো বেদানা।
খারাপ না তো কী? দেহিস, এ বিটাও বাগলো বুইলে! ফাও কয়দিন চাখলো আর কি!
আমারে ছাইড়ে বাগলি তোরা আবার টাইনে রাহিস! এসব কথা শুনে আর মানুষের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। নওল যুবতী শুভাকাক্সক্ষী আগুনের ছিটা নিয়ে ছিটকে সরে পড়লো। বেদানা নিজেও জানে, সড়াৎ গেরোর মতো এ বিয়ের বন্ধন খুলতেও জোরে টান লাগবে না।
আর মানুষটি যে ফেরেববাজ, তার মেজাজ-মর্জি প্রকাশের ধরন-ধারনে কী আর না বুঝেছে নির্বিঘ্ন ক’দিনে। তাই মুখরা পড়শিদের গতর কামড়ানো কথার উত্তর সে যত ঝাঁঝেই দিক, রাত পোহাতে পোহাতে মরদটা হুজুরের কলমার গেরোর তলে টেকে কি-না, বেদানা তার নিজের সন্দেহে নিজেই তলাতে থাকে।