আজ কেবলি মন খারাপের দিন। জিনাত চৌধুরীর মন খারাপ হতে থাকে। মন খারাপের কারণগুলো ভেবে আরও বেশি মন খারাপ হয়। অথচ আজকের দিনে তো আনন্দে থাকার কথা। তার বদলে একরাশ বিষণ্নতা তাকে ছুঁয়ে যায়। সারাটা পথ জিনাত চৌধুরী বিষণ্নতায় ডুবে থাকেন। কিছুটা আনন্দ আর কিছুটা উত্তেজনার শিহরণ যে নেই, তা নয়। তবু কেন যেন বিষণ্নতাই প্রকট মনে হয়। আমিনুল বুঝতে পারে বড় ম্যাডামের মন খারাপ। আজ বিকেলে রোহান স্যার চলে গেছেন বউ বাচ্চা নিয়ে। হয়তো সে কারণেই। গাড়ি চালাতে চালাতে নানা কথায় ম্যাডামের মনোযোগ অন্যদিকে ফেরাতে চায়। লাভ হয় না। জিনাত চৌধুরী হুঁ হা ছাড়া আর কোনো কথা বলেন না। বসুন্ধরার আশেপাশে এমনকি গুলশানে এত ভালো ভালো রেস্টুরেন্ট থাকার পরও বড় ম্যাডাম ধানমন্ডি কেন যাচ্ছেন, আমিনুল বুঝতে পারে না। তার বুঝে কাজ কী! বড়লোকের কাজকর্ম ড্রাইভারদের না বুঝলেও চলে। আপাতত ভিড় ঠেলে সাতটার মধ্যে ধানমন্ডি পৌঁছাতে পারলেই হলো। ফিরে এসে আবার বড় সাহেবকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে যেতে হবে। সাড়ে আটটায় অ্যাপোয়েন্টমেন্ট। সঙ্গে জিহান স্যার যাবেন বলেছেন। বড় সাহেব, মানে শাহেদ চৌধুরী অনেক দিন ধরেই একা একা বাইরে চলাফেরা করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। তার ওপর কয়েকদিন আগে পা ভাঙার পর থেকে শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না। জিনাত চৌধুরী বলেছেন, তাকে নামিয়ে দিয়ে আমিনুল চলে যেতে পারবে। রেস্টুরেন্টে তিনি তিন চার ঘণ্টা থাকবেন। ততক্ষণে ও বড় স্যারকে ডাক্তার দেখানোর পর বাসায় পৌঁছে দিয়ে আবার ফিরে আসতে পারবে। আমিনুল রাস্তার দিকে মনোযোগ দেয়। আজ অন্যদিনের চেয়ে ভিড় অনেকটাই কম। ভাগ্য ভালোই বলতে হবে।
জিনাত চৌধুরীর চোখ ফেটে কান্না আসে। সত্যি তো! চোখের পাপড়ি ভিজে উঠেছে। রাহাত একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আচ্ছা, বলো তো কান্না কি চোখ ফেটে আসে না কি বুক ভেঙে আসে?’ আসলেই! কান্না কি চোখ ফেটে আসে না কি বুক ভেঙে আসে, তা আজ বলতে পারেন না জিনাত চৌধুরী। শুধু পাপড়ি ভিজে যাওয়া টের পান। শুধু চোখেই না, বুকেও টের পান। রাহাতের ভাষায় ‘নন ইস্কেমিক কার্ডিয়াক পেইন’। রাহাত, মানে রাহাত মহিউদ্দিন। আজও এই বয়সেও ঠিক তেমন করেই কথা বলেন। আচ্ছা, মেয়েরা, মানে বুড়ো মহিলারা কি এই বয়সেও ওর কথা শুনে মুগ্ধ হয়? না কি জিনাত চৌধুরী আর পাঁচ জনের চেয়ে আলাদা? রাহাত মহিউদ্দিন তো তাই বলতেন। অথচ তার সব সময়েই মনে হয়েছে আসলে ব্যাপারটা উল্টো। রাহাতই আর পাঁচজনের চেয়ে আলাদা।
কাল রাত থেকে ঝড় ঝাপটাও কম যায়নি শরীরের ওপর দিয়ে। যদিও বলা হয় ‘শরীরের নাম মহাশয়/ যাহা সহাও তাহাই সয়’, এখনকি আর সেই দিন আছে! ষাট বছর বয়সে কার শরীরইবা মহাশয় থাকে! রোহানদের ফ্লাইট ছিল আজ দুপুরে। ক’দিন ধরেই ওদের যাওয়ার প্রস্তুতি চলছিল। ছেলেটা দুই বছর পর এসে মাত্র একমাস থেকেই চলে গেলো। এমনিতেই মন খারাপ ছিল সবার। তার ওপর তো গোছানোর ঝামেলা ছিলই। ওদের ফ্লাইট ছিল আরও দু’দিন আগে। কিন্তু এত কাছাকাছি এসে মায়ের জন্মদিনে একসঙ্গে থাকার সুযোগটা ছাড়তে চাচ্ছিল না রোহান। চেষ্টা করেছিল টিকিট বদলে আগামী কালের ফ্লাইট ধরতে। এই দিকে আবার বেশি দেরিও করা যাবে না। আগামী সপ্তাহেই ওকে জয়েন করতে হবে। পিএইচডি শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই ওদের ডিপার্টমেন্ট অফার দিয়েছে। এমন সুযোগ তো ছাড়া যায় না। কিন্তু আগামীকাল কাতার এয়ারওয়েজের ফ্লাইট নেই। তাই শেষ পর্যন্ত আজই যেতে হলো ওদের। অবশ্য আনুষ্ঠানিকতা মিস হয়নি। দুই ছেলে, ছেলের বউ আর নাতি নাতনিরা মিলে গোপনে সারপ্রাইজ পার্টির আয়োজন করে রেখেছিল মাঝ রাতে। ঘড়ির কাঁটা ১২টা পেরুতেই ‘হ্যাপি বার্থডে দাদুমনি’ বলে এক গাদা বেলুন, চকলেট আর কার্ড নিয়ে হাজির অম্লান, মেধা আর রোদেলা। দুষ্টুগুলো তবে এজন্যই রাত জেগে ছিল!
ওদের জড়িয়ে ধরে চুমু খেতেই রোহান আর জিহান এসে হাজির। সঙ্গে দুই বউ, তিথি ও মৌটুসি। সেই সঙ্গে ক্র্যাচে ভর দিয়ে এলেন শাহেদ চৌধুরী। কিছুদিন আগেই সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে ডান পায়ের হাড় ভেঙেছেন। কিছুদিন ট্র্যাকশনে ছিলেন ইউনাইটেড হাসপাতালে। এখনো ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না। ফিজিও থেরাপি চলছে। বোঝা গেলো এই সারপ্রাইজ দেওয়ার প্রকল্পে তিনিও জড়িত আছেন। জিনাত চৌধুরী ভেবেছিলেন হয়তো শরীর বেশি ভালো না লাগায় তিনি সন্ধ্যা বেলায়ই ঘুমিয়ে পড়েছেন। ঘুমিয়ে পড়েছিলেন সত্যি। কিন্তু জানা গেলো, মেধা কে বলে রেখেছিলেন যেন ঠিক পৌনে ১২টায় ডেকে দেয়।
এত হুলস্থুল দেখে জিনাত একটু লজ্জাই পেলেন, যদিও ভালোলাগাটাই ছিল তারও চেয়ে বেশি। তারপর বের করা হলো ম্যান্ডারিন থেকে অর্ডার করা কেক, আরও কিছু বেলুন আর মোমবাতি। কোথায় লুকোনো ছিল কে জানে! হয়তো কিচেনে কোথাও। আজকাল তো মৌটুসী আর কাজের মেয়েদের জন্য কিচেনে যাওয়াই হয় না তার।
কেক কাটা আর ক্যামেরার ক্লিকের পরই ছিল আসল সারপ্রাইজ। ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখা গেলো সেখানে প্রোজেক্টর লাগানো হয়েছে। জিনাত চৌধুরীর শৈশব থেকে শুরু করে তার সারা জীবনে বিভিন্ন সময়ে তোলা ছবি আর ভিডিওর কালেকশন নিয়ে বানানো হয়েছে স্থিরচিত্র আর ভিডিওর ফিউশন। পুরো ৪৫ মিনিটের প্রামাণ্যচিত্র। কী ছিল না সেখানে! বাবার কোলে উঠে আইসক্রিম খাওয়া থেকে শুরু। স্কুল, বান্ধবীদের সঙ্গে এক্কা দোক্কা, নুপুর আর নিপুনের সঙ্গে নানাবাড়িতে বেড়ানো, কক্সবাজার, মহাস্থানগড়, আরিচা ঘাটের ফেরি, ঢাকা ইউনিভার্সিটি, শাহেদ চৌধুরীর সঙ্গে বিয়ে, ব্যাংককে হানিমুন, শ্বশুর বাড়ির অর্ধ-বন্দি জীবন, জগন্নাথে শিক্ষকতা, শাহেদের সঙ্গে তার কনফারেন্স ও ট্রেনিংয়ের সময়গুলোতে ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া আর নিজের পিএইচডি করার সময় ব্রাসেলসের জীবন—সব কিছুই আছে। আহা, ছেলেদের ছেড়ে ব্রাসেলসের সময়গুলো কী কষ্টেই না কেটেছে! ভাবতে ভাবতেই শেষ দিকে চলে আসে সাম্প্রতিক কিছু ছবি আর ভিডিও ক্লিপ। সব শেষে পুরো পরিবারের একটা স্থির চিত্র। গত সপ্তাহে চন্দ্রায় ফ্যামিলি পিকনিকে তোলা। তার সারা জীবনের প্রামাণ্য দলিল। সব কিছুই আছে, শুধু জীবনের একটি অধ্যায় ছাড়া, যে অধ্যায় তিনি ছাড়া আর কেউই জানেন না। জিনাত চৌধুরীর কান্না পেয়েছিল। কিছুটা পুরোনো স্মৃতির কথা মনে করে, কিছুটা ছেলে, বউ আর নাতি নাতনিদের আয়োজনের ঘনঘটা ভালো লাগায়। এতটুকু আশা করেননি তিনি। ভেবেছিলেন হয়তো পরদিন সকালের নাস্তার সঙ্গে একটা কেক কাটা হবে। অথবা সবাই জেগে থাকলে মাঝরাতেই। কিন্তু তাই বলে এত কিছু!
________________________________________________
জিনাত আগেই বলে রেখেছিলেন আজ সন্ধ্যায় পুরনো কয়েকজন কলিগ মিলে বাইরে ডিনার করার কথা। অনেক আগের প্ল্যান। তাই এখন আর বদলানো সম্ভব নয়। এছাড়া তিনি তো সবই গোছগাছ করে দিয়ে যাচ্ছেন। গিয়েই আমিনুলকে ছেড়ে দেবেন। জিহানও সঙ্গে যাবে বলেছে। শাহেদের কোনো অসুবিধেই হবে না।
________________________________________________
সবার হাতে হাতে মোবাইল ফোন আসার পর থেকে গত দশ পনেরো বছর ধরে আগের রাত থেকেই বন্ধু বান্ধব, সহকর্মী আর আত্মীয় স্বজনদের উইশ করা এসএমএস আসতে থাকে। অবশ্য সময়ের সঙ্গে এসএমএসের সংখ্যা কমে আসে। এখনো আসে, তবে দু’ চারটি। জিকো, হীরা, ঝুমা’পা এখনো খবর নেয়। জিনাত জানেন আর কোনো এসএমএস না এলেও একটি এসএমএস আসবেই। কাল রাতেও এসেছে। কেক কাটার ঘনঘটার মধ্যেও ব্যাগ খুলে এসএমএস চেক করেছেন এক সময়ে। রাহাত মহিউদ্দিনের এসএমএস। ‘জন্মদিনের স্বপ্নভেলা সাগরে ভাসালে তুমি/ ঝিনুক কুড়ানো সৈকতজুড়ে অস্থির বেলাভূমি।’ সত্যিই কি জিনাত এখনো রাহাতের ঝিনুক কুড়ানো সৈকত? নির্ঘাত ফ্ল্যাটারি। তবু এক অদ্ভুত ভালো লাগায় আবেশিত হন তিনি। ঠিক যেমন আবেশিত হতেন পনেরো বিশ বছর আগে। সবাই যখন প্রোজেক্টরের পর্দায় ব্যাস্ত তখন এক ফাঁকে রিপ্লাই দিয়েছিলেন, ‘থ্যাঙ্ক ইউ। কাল দেখা হবে, অস্থির হয়ে আছি।’ সত্যি তিনি অস্থির হয়ে আছেন। কতদিন দেখা নেই! কখন যে সকাল হবে, আবার বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হবে!
ঘুমোতে ঘুমোতে আড়াইটা বেজে গিয়েছিল। রোহানের ফ্লাইটের প্রস্তুতির জন্য আবার উঠতে হয়েছে সাত সকালে। বিদায় পর্ব, কান্নাকাটি, এয়ারপোর্ট ইত্যাদি সেরে বাসায় ফিরতে ফিরতে চারটা বেজেছে। ছেলে, বউ আর নাতি-নাতনি চলে যাবে বলে ক’দিন ধরেই মন খারাপ। ওদের ইমিগ্রেশন পার করিয়ে দিয়ে আবার নতুন করে কান্না পেয়েছিল। মৌটুসী কোনো রকমে জড়িয়ে ধরে এনে গাড়িতে বসিয়ে দিয়েছে। ছেলেটাকে তাড়াহুড়ো করেই যেতে হলো। ভাগ্যিস, তাও জন্মদিন উদযাপনের সময়টুকুতে মায়ের সঙ্গে থাকতে পেরেছে কয়েক ঘণ্টা।
বাসায় ফিরে স্বামীর দেখভাল করতে হলো খানিক। গত বছর পর্যন্ত শাহেদ চৌধুরীর ডারমাটোলজির রমরমা প্র্যাকটিস ছিল। ছেলেদের চাপে অবসর নিতে হয়েছে। তিনি চেয়েছিলেন আরও কিছুদিন চালাতে। অন্তত ব্রেইনটা একটিভ থাকতো, সময়ও কেটে যেতো। কিন্তু ছেলেরা কিছুতেই মানবে না। জিনাত চৌধুরী ‘হ্যাঁ-না’ কিছুই বলেননি। কিন্তু প্র্যাকটিস ছেড়ে দেওয়ার পর থেকেই শাহেদের শরীর ক্রমান্বয়ে খারাপ হচ্ছে। ঘুম হয় না ঠিকমতো। ইদানিং অল্পতেই মেজাজ খারাপ হয়, কখনো কখনো অতি প্রয়োজনীয় জিনিসও ভুলে যাচ্ছেন। শাহেদ চৌধুরীর ধারণা, ব্রেইনের চর্চা হচ্ছে না বলেই এমনটা হচ্ছে। অবশ্য ডা. শফিক বলছেন ‘ডিপ্রেশন’। সাইকিয়াট্রিস্টদের নিয়ে এই এক সমস্যা। সব কিছুতেই ডিপ্রেশনের গন্ধ পান। কিংবা হতেও পারে ডিপ্রেশন। জিনাত একদিন বলেছিলেন, হতেও তো পারে ডিপ্রেশন। শুনেছি রিটায়ারমেন্টের পর অনেক অ্যাকটিভ মানুষেরই না কি ডিপ্রেশন হয়। তুমি কি সাইকিয়াট্রিস্ট—শাহেদ চৌধুরীর উল্টো প্রশ্ন। স্বামীর চোখে মুখে বিরক্তি দেখে আর কথা বাড়াননি। তবে মন থেকে একেবারে মুছেও ফেলতে পারেন না। এর মধ্যে আবার ফিমার ফ্রেকচার। সন্ধায় অর্থোপেডিক সার্জনের কাছে ফলোআপ। অ্যাপোয়েন্টমেন্টের কাগজপত্র, এক্সরে রিপোর্ট সব কিছু গুছিয়ে দিয়ে তারপর তো বের হওয়ার সুযোগ পেলেন।
শাহেদ চৌধুরীর ইচ্ছে ছিল জিনাত তার সঙ্গে যাবেন। কেউ সঙ্গে থাকলে চলাফেরায় সাহস হয়। ড্রাইভারদের ওপর কি সবকিছুতে ভরসা করা চলে! রিটায়ারমেন্টের সময়টাই মনে হয় এমন। প্রতিদিন একটু একটু করে আত্মবিশ্বাস কমতে থাকে। কিন্তু জিনাত আগেই বলে রেখেছিলেন আজ সন্ধ্যায় পুরনো কয়েকজন কলিগ মিলে বাইরে ডিনার করার কথা। অনেক আগের প্ল্যান। তাই এখন আর বদলানো সম্ভব নয়। এছাড়া তিনি তো সবই গোছগাছ করে দিয়ে যাচ্ছেন। গিয়েই আমিনুলকে ছেড়ে দেবেন। জিহানও সঙ্গে যাবে বলেছে। শাহেদের কোনো অসুবিধেই হবে না।
জিনাত চৌধুরীর আসলে কলিগদের সঙ্গে কোনো কর্মসূচি নেই। কিন্তু রাহাতের সঙ্গে ডিনার প্রোগ্রামের কথা বললে বাসার সবাই কী ভাববে! যদিও কেউই রাহাত মহিউদ্দিনকে চেনে না। বললে হয়তো ভাবতো জিনাতের কোনো পুরোনো কলিগ হবে। তবু কে কী মনে করবে এই ভেবে একটু জড়তা লাগছিল। রাহাত মহিউদ্দিন বলেছিলেন, তোমার যত সব আজেবাজে ভাবনা। তুমি কি টিনএজার যেকোনো পুরুষ মানুষের সঙ্গে দেখা করতে গেলে লোকে ভাববে প্রেম করতে যাচ্ছো? এছাড়া তুমি তো সত্যিই প্রেম করতে আসছ না। আসছ পুরনো প্রেমের স্মৃতিচারণ করতে। দু’টোতো আর এক জিনিস না, তাই না? চাইলে তোমার বরকেও নিয়ে আসতে পারো। হা হা হা। জিনাত তবু বাসায় রাহাতের নাম বলতে চাননি। পুরোপুরি তো মিথ্যেও বলেননি। কারও সঙ্গে তো ডিনার করতেই যাচ্ছেন। কয়জন যাবে নির্দিষ্ট করে কেউ জিজ্ঞেস করেনি। এছাড়া রাহাত মহিউদ্দিন হয়তো সরাসরি কলিগ ছিলেন না, কিন্তু অনেকটা তো কলিগের মতোই। তিনিও অধ্যাপনা করতেন। যদিও জগন্নাথে নয়, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ব্যাপারটি নিয়ে বাসায় যতোই জড়তা থাকুক রাহাতের সামনে তো জড়তা থাকা চলবে না। যদিও দেখা হচ্ছে প্রায় দুই বছর পর। তবুও জিনাত চৌধুরী তার সামনে সেই আগের মতোই উচ্ছ্বল আর প্রাণবন্ত থাকতে চান। আজ এত বছর পর তাদের সম্পর্কের বর্তমান অবস্থাকে কিভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়, তা নিয়ে তিনি একটু বিভ্রান্ত। রাহাত অবশ্য মানতে রাজি নন। তিনি ‘অল অর নান ল’তে বিশ্বাসী। বলেছেন, আমি এ সবে নেই। হয় আমাদের সম্পর্কটা আগের মতোই আছে, না হয় একেবারেই নেই। আমি মাঝামাঝি কিছুতে নেই। এমনিতেই দু’ বছর অনেক কষ্ট দিয়েছ, কষ্ট পেয়েছ।
কেন, আমরা একটা স্বাভাবিক বন্ধুত্বের সম্পর্ক রাখতে পারি না? একটু আটপৌরে প্রেম জাতীয় হতে পারে বড়জোর। আমরা এখন দাদা দাদী হয়ে গেছি না?
আটপৌরে প্রেম, সেটা আবার কেমন?
এই ধরো আমাদের ফোনে কথা হবে। কখনো সখনো দেখা হবে। আমাদের দুই ফ্যামিলির আলাপ পরিচয় থাকবে।
ফোনে বা মুখোমুখি হলে আমাদের কী নিয়ে কথা হবে?
শরীর কেমন, ঘুম হচ্ছে কি না, ছেলে-মেয়েদের সংসার কেমন চলছে, নাতি নাতনিদের কী খবর ইত্যাদি। তুমি শুধু মাঝে মাঝে আমাকে কবিতা শোনাবে। আগে যেমন করে শোনাতে, ঠিক সেভাবে।
আমার খেয়ে-দেয়ে আর কাজ নেই!
জিনাত জানেন রাহাত এমন একজন মানুষ যার সঙ্গে আধাআধি সম্পর্ক হয় না। তার পারসোনালিটিই এমন, একেবারে ওভারহোয়েলমিং। যাকে বলে সর্বগ্রাসী। তাই তিনি আর কথা বাড়ান না। এসব এখন ভেবে বা বলে লাভ কী! তার চেয়ে পুরনো দিনগুলো যতটা কাছে পাওয়া যায়, জীবনের বাকিটা সময় ততটাই সুন্দর হবে। তার মনে পড়ে জুলিয়াস ফুচিকের কথা—আই লাভ মাই লাইফ, অ্যান্ড ফর ইটস বিউটি আই ফাইট। তার তো ফাইটও করতে হবে না এই বয়সে। ফাইট করা ছাড়াই তো জীবন সুন্দরতর হতে পারে। গড্ডালিকায় গা ভাসালেই চলে। যেমন ভাসিয়েছিলেন প্রায় দু’ দশক আগে।
শাহেদ চৌধুরীকে অ্যাপোয়েন্টমেন্টের জন্য রেডি করে দিয়ে নিজে একটু ঝটপট রেডি হতে শুরু করলেন। হোক না বুড় বয়স, তবু যতটুকু সম্ভব রাহাতকে ইম্প্রেসড করার ইচ্ছে। সোনালি সিল্কের শাড়ি পড়লেন যত্ন করে। রাহাতের সবচেয়ে পছন্দের রঙ। এতে অবশ্য কেউ কিছু মনে করবে না। জিনাত চৌধুরী এমনিতেই সব সময় রঙিন শাড়ি পড়েন, সেজেগুজে পরিপাটি থাকেন। ছেলেদের তা পছন্দ, শাহেদেরও। গহনাগাটিতে অবশ্য তার কোনো আদিখ্যেতা ছিল না। এই বয়সে তো প্রশ্নই নেই। মুক্তার একটা সেট পড়েছেন। আয়নায় কয়েকবার নিজেকে দেখে নিলেন। নিজের কাছেই নিজেকে বেশ এলিগ্যান্ট লাগছে। নিজে নিজে একটু হাসলেনও বটে। আচ্ছা, ষাট বছর বয়সে কারও এমন সখ থাকে? কেউ কি এমন পাগলামি করে? রাহাত বলেন, আমরা আমাদের সময়ের পঞ্চাশ বছর আগে জন্মেছি। আর পঞ্চাশ বছর পর পৃথিবীটা আমাদের মতোই হবে। তখন ষাট সত্তুর বছরে প্রেম করলে কেউ অবাক হবে না, বরং সেটাই স্বাভাবিক মনে হবে। প্রেম মানে যে পরকীয়া প্রেম হতে হবে, তেমন কোনো কথা নেই। দাম্পত্য প্রেমও হতে পারে। কই, আমাদের সমাজে তো বিয়ের কয়েক বছর পরই দাম্পত্য প্রেম উবে যায়। এক ছাদের নিচে স্বামী-স্ত্রী বাস করে সন্তানদের অভিভাবক হিসেবে, দম্পতি হিসেবে নয়। দৈহিক সম্পর্ক হয়তো থাকে। তাকে বলা যায় নিষ্প্রেম কাম। অনেক সময় ঠিক তাও না। প্রেমহীন, কামহীন একটা সম্পর্ক। নিজের শরীর দিয়ে আরেক জনের চাহিদা মেটানো মাত্র। সেই সম্পর্কটাও অনেকের বেলায় পঞ্চাশেই থেমে যায়। এই হিসেবে শাহেদ জিনাত দম্পতি অবশ্য অনেকটাই ভাগ্যবান। প্রেম থাকুক আর না থাকুক, শরীরের চাহিদা একেবারে ফুরিয়ে যায়নি কারোই।
শাহেদ চৌধুরীর বন্ধু ডা. তাহমিদ অবশ্য পঞ্চাশ বছর পর কী হবে, সেই থিওরিতে বিশ্বাসী নন। তিনি নামকরা ইউরোসেক্সোলজিস্ট। পঁচিশ বছর ক্যানাডায় কাটিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, ওয়েস্টার্ন সোসাইটিতে তো সত্তুর আশি বছরেও মানুষ হেলদি সেক্সলাইফ এনজয় করে। ফিজিক্যাল ডিক্লাইন হবে, এটা তো স্বাভাবিক। কিন্তু ভায়াগ্রা সিয়ালিস এগুলো আছে না? শাহেদকে বলেছেন, তোমার তো হাইপারটেনশন, হার্ট ডিজিজ এসব কিছুই নেই। তুমি চাইলেই যেকোনো একটা ট্রাই করে দেখতে পারো। হেলদি সেক্স লাইফ ডিপ্রেশন, স্ট্রেস, লোনলিনেস—এ সবের জন্যও থেরাপিউটিক। সেই থেকে শাহেদ চৌধুরী মাঝে মাঝে ট্রাই করেন। সময়টা ভালোই কাটে।
________________________________________________
জীবন দর্শনে দু’জনের অদ্ভুত মিল থাকায় আর যার যার ঘর সংসার নিয়ে অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থাকায় কোথাও কোনো ছন্দপতন হয়নি। একসঙ্গে ঘর করার ইচ্ছে যে কখনো কখনো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেনি, তা নয়। কিন্তু পরস্পরকে মনে করিয়ে দিয়েছেন নিজেদের পুরোনো অঙ্গীকার।
________________________________________________
নিজেদের সেক্সলাইফ অবশ্য বরাবরই হেলদি ছিল বলে শাহেদের ধারণা। জিনাত কখনো প্রকাশ্যে দ্বিমত করেননি। কিন্তু তিনি জানেন শাহেদের কাছে যা হেলদি বা পরিপূর্ণ মনে হয়েছে, তার কাছে তা ঠিক তেমনটা পরিপূর্ণ মনে হয়নি। এটা ঠিক তার প্রতি শাহেদ চৌধুরীর মমতা, ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ কোনো কিছুতেই কোনো কমতি ছিল না, এখনো নেই। এমনকি জিনাতের শরীরের প্রতিও তার আকর্ষণের তীব্রতায় কোনো ভাটা নেই এই বয়সে। তবু তার কাছে মনে হয়ছে দু’জনের কেমিস্ট্রিতে কোথাও যেন কিছু একটা ছন্দপতন আছে। তাই তো বিছানা ছাড়া অন্য সব সময় শাহেদ চৌধুরী বাবা কিংবা বড় ভাইয়ের মতো। প্রেমিক তো ননই, এমনকি বন্ধুও নন। অথচ জিনাত কামনা করেছিলেন তার স্বামী হবেন প্রেমিক এবং বন্ধু। যাকে বলে টোটাল রিলেশনশিপ। কিন্তু শাহেদ এই দূরত্বটুকু অতিক্রম করতে পারেননি। যদিও জিনাত স্বীকার করেন, শাহেদের মতো এমন আগাগোড়া ভালো মানুষ পাওয়া দুষ্কর, হয়তো রাহাতও নন। তবু তিনি তাকে মনের তৃপ্তি দিতে পারেন না। আর মনের তৃপ্তি না হলে শরীরের তৃপ্তি কখনোই পূর্ণাঙ্গ হয় না। হয়তো ছেলেদের কাছে এটা কোনো ম্যাটার করে না। কিন্তু মেয়েদের কাছে ম্যাটার করে। আর কারও কাছে না হোক, জিনাত চৌধুরীর কাছে বেশ ম্যাটার করে।
এই অপূর্ণতার দোলচালেই রাহাতের সঙ্গে তার সম্পর্ক এগিয়ে গিয়েছিল। পরিচয়টা নিছকই সাদামাটা। কাঠমন্ডুতে একটা কনফারেন্সে দু’জন এটেন্ড করেছিলেন নিজ নিজ ইউনিভার্সিটির হয়ে। রাহাত মহিউদ্দিনকে আর পাঁচ জনের চেয়ে আলাদা মনে হয়েছে। সবচেয়ে অবাক লেগেছে জিনাত যতই তার কাছে ঘেঁষতে চেয়েছেন রাহাতকে ততোই নির্লিপ্ত মনে হয়েছে। আবার সেই সঙ্গে এমনটাও মনে হচ্ছে যে তিনি জিনাতের বন্ধুত্ব এবং সান্নিধ্য উপভোগ করছেন। কিন্তু কেমন যেন একটা কৌতূহলহীন ভাব ধরে রেখেছেন। জিনাত চৌধুরী খেয়ালের বশে ভাবেন, তার প্রতি কোনো ছেলে আকৃষ্ট হবে না—এটা হতেই পারে না। তার মনে হয়েছে নিজের মনের অতৃপ্তি দূর করার ক্ষমতা এই মানুষটির আছে। তার কৈশোর মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। আজও তিনি নিশ্চিত নন যে এটা কি রাহাতের প্রতি তার আকর্ষণ না কি রাহাতকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করানোর জিদ কোনটা তাকে অ্যাডভ্যাঞ্চারাস করে তুলেছিল। চিঠিতে, ফোনে, চাইনিজে, কফিশপে তাদের সম্পর্কটা এগিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত আর রেষ্টুরেন্ট কিংবা কফি শপে সীমাবদ্ধ থাকেনা। জীবন দর্শনে দু’জনের অদ্ভুত মিল থাকায় আর যার যার ঘর সংসার নিয়ে অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থাকায় কোথাও কোনো ছন্দপতন হয়নি। একসঙ্গে ঘর করার ইচ্ছে যে কখনো কখনো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেনি, তা নয়। কিন্তু পরস্পরকে মনে করিয়ে দিয়েছেন নিজেদের পুরোনো অঙ্গীকার। তাই ঘর ছেড়ে আসতে হয়নি কারোই।
সে আজ অনেক দিনের কথা। এর মধ্যে পেরিয়ে গেছে কতটা বছর। এই সম্পর্কের কি কোনোই পরিণতি নেই? অন্তত যবনিকা? দু’জনেরই ছেলে মেয়েরা বড় হয়েছে। কেউ বিয়ে করেছে, কেউবা সহসাই করবে। জিনাতের ইচ্ছের জয় হয়েছিল। ঠিক ইচ্ছে নয়, ইচ্ছের বিরুদ্ধে ইচ্ছে। এমন সর্বগ্রাসী পূর্ণতার একটা সম্পর্কের যবনিকা কেনই বা চাইবে! কিন্তু সময় তাদের বিপক্ষে। তাছাড়া এটা তো বংলাদেশ, আমারিকা কানাডা নয়। জিনাতের দৃঢ়তায় দেখা হওয়ার মাত্রা কমতে থাকে, যোগাযোগ ক্ষীণ হতে থাকে। তাই বলে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয় না। ঈদ, নববর্ষ, ভ্যালেন্টাইন্স ডে, জন্মদিন, নিজেদের সম্পর্কের বার্ষিকী—এই সব দিনে অন্তত যোগাযোগ হয়, কথা হয়, উপহার বিনিময় হয়। কষ্ট হলেও দু’জনই বাস্তবতা মেনে সময়ের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। কিন্তু গত দু’ বছর দেখাদেখি বন্ধ। জিনাত বলেন, তোমার সঙ্গে দেখা হলেই নিজেকে আটকে রাখতে পারি না। আমার পৃথিবী উলট পালট হয়ে যায়। সব কিছু ইচ্ছে করে। ঠিক যেমন ইচ্ছে করতো বিশ বছর আগে। কিন্তু অনেক তো বয়স হলো। প্লিজ! আমাকে তুমি দেখা করতে বলো না। তোমাকে না দেখে থাকতে আমার অনেক কষ্ট হবে জানি। কিন্তু দেখা করা কন্টিনিউ করলে কষ্ট আরও বেশি হবে। সত্যি আমি নিরুপায়। প্লিজ সোনা! একরাশ অভিমান নিয়ে রাহাত চৌধুরী মেনে নেন। তিনি জানেন, জিদ করলে জিনাতকে ফেরাতে পারবেন। কিন্তু তিনি আগেও কখনো কিছু নিয়ে তাকে জোর করেননি। এবারেও করেন না। হয়তো তিনি জোর করে কারও কাছ থেকে কিছু আদায় করতে শেখেননি।
তবে গত কয়েক সপ্তাহে দু’জনেরই মন আবার উচাটন হয়েছে। রাহাত বারবার দেখা করতে চাওয়ায় জিনাত কপট রাগ করেছেন। যদিও দেখা করার জন্য তিনিও কম অস্থির হননি। রাহাত মহিউদ্দিন বলেছেন, শুধুই তো দেখা করা, মুখোমুখি কথা বলা। আর তো কিছু না সোনা। আর কীই বা চাইতে পারে এই চৌষট্টি বছরের বুড়ো? শুধু তোমাকে দেখতে সাধ হয়। অবশ্য জোর করবো না। তুমি না চাইলে।
ন্যাকামি করো না। তোমাকে আমি চিনি না? দেখা হলেই বলবে, চলো একটু মনিপুরী পাড়া থেকে ঘুরে আসি। বৌদিকে বলে রেখেছি, তোমাকে নিয়ে যাবো।
ধুর, কী যে বলো! আজও কি সেই দিন আছে?
থাক, আর ন্যাকা সাজতে হবে না। আমার বরও অনেক দিন ন্যাকা সেজে ছিল। এখন আবার ডাক্তারের পরামর্শে কী সব ছাইপাশ ট্যাবলেট খাচ্ছে। তোমরা ছেলেরা সব্বাই এক।
মানে কী?
থাক, আর বুঝতে হবে না। তুমি খুবই চালাক। বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকো। দেখা হলে আবার নতুন কোনো বায়না ধরতে পারবে না। আর দেখা হবে দুই মাসে এক বার। ঠিক আছে?
দু’জনেই হাসে। ভবিষ্যৎ অজানাই থাকুক আপাতত। জিনাত নিজেও জানেন শেষ পর্যন্ত দেখা করা ঠেকানো যাবে না। তাছাড়া নিজেরও অস্থির লাগছে। কতদিন দেখা নেই। সেই ভরাট গলার কবিতা শোনা হয় না কতদিন!
________________________________________________
জিনাত চৌধুরী ভাবেন, সত্যি তার কোনো মুক্তি নেই। তার হাতে শেকল, পায়ে শেকল। এই শেকল নিয়েই তার আরও বহুদিন বাঁচতে ইচ্ছে করছে। তিনি তার অনামিকা এগিয়ে দেন।
________________________________________________
পুরনো দিনের কথা ভাবতে ভাবতে জিনাত চৌধুরী বুকে একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করেন। সেই ‘নন-ইস্কেমিক কার্ডিয়াক পেইন’। কথাটা মনে হতেই একটু হাসিও পায়। শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছেন দেখা করতে। রাহাতের পছন্দ আজকের দিন। জিনাতের জন্মদিন সেলিব্রেট করতে চান একসঙ্গে। ধানমন্ডি বত্রিশের কোনায় ‘সান্তুরে’ দেখা হবে সাতটায়। হঠাৎ করেই তিনি বিশ বছর আগের শিহরণ অনেকটাই ফিরে পান। হাল্কা মেক আপে ফিনিশিং টাচ দিয়ে এখুনি বের হবেন। সব শেষে লকার থেকে খুলে ছোট্ট একটা জিনিস ব্যাগে ঢোকালেন। সোনার পায়েল। বহু বছর আগে দেওয়া রাহাতের উপহার। এটা তার ভীষন পছন্দের। ডেটিংয়ের বিশেষ বিশেষ দিনগুলোয় জিনাতের এই পায়েল পরতে হতো। এটা নাকি রাহাতের টার্ন অন। অসভ্যতা আর কাকে বলে! আজ বারবার বলে দিয়েছেন এই পায়েলটা পরে যেতে। আস্ত পাগল একটা। এই বয়সে কেউ পায়েল পরে? যখন দিয়েছিলেন তখনো পায়েল পরার বয়স চলে গিয়েছিল। তবু তাকে খুশি করতে পরতে হতো। তাই বলে এই বয়সে? অসম্ভব! কিন্তু রাহাত গোঁ ধরেছেন। তাই ব্যাগে করে নেওয়া। গাড়ি থেকে নামার আগে পরে নেবেন। এই পায়েল পরা মানেই সেই দিনগুলোতে ফিরে যাওয়া, পুরনো শিহরণ ফিরে পাওয়া। টু বি অর নট টু বি।
আমিনুল ভালোই চালিয়ে এনেছে। জিনাত চৌধুরী সাতটা বাজার পাঁচ মিনিট আগেই পৌঁছে যান সান্তুরে। গাড়ি ছেড়ে দিয়ে ড্রাইভারকে বলেন দশটা নাগাদ ফিরে এলেই চলবে। এই সময়টা রেস্টুরেন্ট একেবারেই ফাঁকা থাকে। এদিক ওদিক তাকিয়েও কাউকেই দেখতে পান না। এক কোণে একটা টেবিলে চুপচাপ বসতেই দরোজায় দেখা গেলো রাহাত মহিউদ্দিন ঢুকছেন। এই দুই বছরে তেমন বদলাননি কিছু। তবে মাথার চুল আরও হাল্কা হয়েছে, চিবুকের ভাঁজ আরও গভীর হয়েছে। ভ্রূ সাদা হয়েছে, হাঁটার গতিও কমে গেছে অনেকটাই। হাঁটু টেনে হাঁটছেন। আর্থাইটিস ফ্লেয়ার আপ করেছে নিশ্চয়ই। দৃষ্টি আর হাসি বিনিময় হতেই জিনাত টের পান তার চোখের পাতা ভিজে উঠেছে। রাহাত মহিউদ্দিন পাশে বসতেই টিস্যুতে চোখ মোছেন। কুশল বিনিময় হতে হতে রাহাতের চোখ যায় জিনাতের পায়ে, পায়েলের চিকচিকে মসৃণতায়। তার চোখে আনন্দের আভা ফুটে ওঠে, যেমন উঠতো সেই দিন গুলোয়।
হ্যাপি বার্থডে জান! তোমাকে আজ ভীষণ সুন্দর লাগছে। ষাট বছর বয়সে তোমার চেয়ে সুন্দর কোনো মেয়ে এই পৃথিবীতে নেই, তা তুমি জানো?
জিনাত কোনো কথা বলেন না। তার চোখ দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় জল গড়িয়ে পড়ে।
তোমার হাতটা একটু দেবে। ধরতে ইচ্ছে করছে। কতদিন তোমাকে ছুঁয়ে দেখি না।
জিনাত বাম হাত এগিয়ে দিতেই রাহাত পকেট থেকে ছোট্ট একটা বক্স বের করেন। বার্থডে গিফট।
তোমার দেওয়া পায়েল তো এখনো আমার পায়ে শেকল হয়ে আছে। দেখো না, পরি কিংবা নাইবা পরি, এই শেকল কখনো ভাঙতে পারি না। পারবও না। নতুন করে আবার কেন শেকল পরাতে চাও? শেকল ছাড়াও আমি শেকলাবদ্ধই থাকবো। আমার কি আর মুক্তি আছে?
এবারে রাহাতেরও চোখ ভিজে ওঠে। তিনি জিনাতের অনামিকা কাছে টেনে নেন। এই আংটি পরার বয়স হয়তো তার চলে গেছে। কিন্তু তারা দু’জন কি বয়সের ধার ধেরেছেন কখনো? না কি বয়সের কাছে হেরেছেন? না হয় আংটিটা বক্সেই থাকবে। তবু তো থাকবে জিনাতের কাছে। রাহাত আসলে আর পাঁচ জন মানুষের মতোই স্বার্থপর। পায়েল আর আংটিতে করে নিজেকেই জিনাতের কাছাকাছি রাখতে চান সব সময়।
জিনাত চৌধুরী ভাবেন, সত্যি তার কোনো মুক্তি নেই। তার হাতে শেকল, পায়ে শেকল। এই শেকল নিয়েই তার আরও বহুদিন বাঁচতে ইচ্ছে করছে। তিনি তার অনামিকা এগিয়ে দেন।