মাহিনুর আর কিরণ মজুমদার রুম মেট। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মাহিনুর ফিজিক্সে পড়ে। কিরণ মজুমদার সোসিওলজি। মিতা ছাত্রাবাসের ৩০৫ নাম্বার রুমে থাকে তারা। কিরণ মজুমদার আগে থেকেই এখানে থাকে। মাহিনুর এলে ম্যানেজারও একটু বিব্রত হলো। কারণ কিরণ যে প্রকৃতির ছেলে মাহিনুরের সঙ্গে টিউনিং হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই কম। কিরণ রাত জাগে। প্রচুর সিগারেট খায়। কথা বেশি বলে। কেমন একটু অস্বাভাবিক আচরণ তার ভেতরে আছে। ম্যানেজার সেটা জানে। এদিকে তার আবার রাজনৈতিক কানেকশানও আছে। এসব মিলিয়ে তাকে এখানে রাখাও যেমন বিব্রতকর, চলে যেতে বলাও বিব্রতকর। কী আর করা। ম্যানেজার নিরুপায়।
মাহিনুর এলে তার পুরো ইন্টারভিউ নেওয়ার পর একটা ফরম ধরিয়ে দিলো ম্যানেজার। বললো পনেরদিন পর যোগাযোগ করবেন। পনেরো দিন পর মাহিনুর এসে যোগাযোগ করলো অনেকটা বিরক্ত হয়েই। আরে বাবা মেসে উঠব তার মধ্যে এত কাহিনী কেন?
ম্যানেজার স্যরি বললো। জানালো আপনার তথ্যগুলো নিকটস্থ থানায় দেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে গ্রিন সিগন্যাল পাওয়ার পরই এখানে আপনার থাকার ব্যবস্থা পাকা হলো। আমরা এ রকমই করি।
মাহিনুর ভাবলো, ওরে সর্বনাশ! মেসে থাকতে হলেও এত কিছু! একটু স্বস্তিও পেলো। কারণ নিশ্চিন্তভাবে থাকা যাবে।
একটু পর ম্যানেজার তার মনটা খুব খারাপ করে দিলো। বললো আপনার একটু কষ্ট হবে। কারণ কিরণ নামের ছেলেটার ভেতরে কিছু অস্বাভাবিকত্ত রয়েছে। আপনাকে শিগগিরই অন্যরুমে পাঠানো হবে। কিছুদিন মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন।
মাহিনুর মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু হলো না। আরে কিরণ তো শুধু সিগারেটই খায় না। নিয়মিত গাঁজা খায়। গাঁজা খেয়ে সারারাত বকবক করে। ফিজিক্সের মতো সাবজেক্টে অনেক পড়াশোনা করতে হয়। গাঁজার গন্ধ আর বকবকানিতে পড়াই হয় না। হইচই করে। চিৎকার করে মমতাজের গান গায়। বুকটা ফাইট্টা যায়। বুকটা ফাইট্টা যায়। এই গানের প্যারোডিও করে। সেটা খবুই অশ্লীল। এটা ওটা অর্ডার করে। মাঝে মাঝে টাকা ধার নেয়। ফেরত দেয় না একবারও।
কিছুদিন পরই মাহিনুরের সঙ্গে তার লেগে গেলো। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে মেসের সবাই কিরণের পক্ষে নিলো। মাহিনুর সিদ্ধান্ত নিল ম্যাচ চেঞ্জ করবে।
একদিন দুপুরে মাহিনুর ঘুমাচ্ছিল। কিরণ নেই। মাহিনুর স্বপ্নে দেখলো তাকে কে যেন একটা পলিথিনের ভেতরে তুলেছে। পলিথিন চুপসে গিয়ে তার শরীরে চাপ দিচ্ছে প্রচণ্ড। চোখে-মুখে নাকে এমন চাপ দিচ্ছে যে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। হাঁস-ফাঁস করতে করতেই সে শুনতে পেলো পলিথিনটি ফেটে যাচ্ছে প্রচণ্ড শব্দসহ।
মাহিনুরের ঘুম ভেঙে গেলো। ঘেমে-টেমে এক জবুথবু অবস্থা। দরজায় টোকা দিচ্ছে কে যেন। সে তড়িঘড়ি করে উঠে দরোজা খুলে দিলো। কিরণ। খুব বিরক্ত হয়ে বললো সে, কতক্ষণ ধরে সে টোকা দিচ্ছে!
কিরণ রুমে ঢুকলো। মাহিনুর বিছানায় বসে দেখতে পেলো মেঝেতে একটা পলিথিন পড়ে আছে। ফ্যানের বাতাসে কখানো ফুলে উঠছে কখনো চুপসে যাচ্ছে। কিরণ সেই পলিথিন হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকলো।
সপ্তাহ খানেক পর এক রাতে মাহিনুর আর কিরণ যথারীতি ঘুমাচ্ছিল। মাহিনুর স্বপ্নে দেখলো, কে যেন তাকে বালিশ চাপা দিয়ে মারছে। বাঁচার জন্য মরিয়া হয়ে সে চিৎকার দিচ্ছে। কিন্তু কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। অশুরের শক্তি নিয়ে হন্তারক তাকে হত্যা করার জন্য অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মাহিনুর বাঁচার যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। একসময় ঘুম ভেঙে গেল মাহিনুরের। ঘেমে নেয়ে একাকার। ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ। চোখ মেলে তাকাতেও ভয় লাগছে। বুঁজলেও ভয়। ঘুম ও স্বপ্নের রেশ কাটতে সময় লাগলো কিছুক্ষণ। তারপর দেখলো জানালা দিয়ে ভোরের আলো ঢুকছে। মাহিনুর কিছুটা স্বস্থি অনুভব করল।
আরেকটু ফর্সা হয়ে এলে সে লক্ষ করলো, কিরণের মুখের ওপরে বালিশ। বালিশ সরিয়ে তাকে ডাকতে লাগলো। কিরণ কোনো সাড়া দিলো না। তার গা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। সে মারা গেছে।
মেসের অন্য সদস্যরা এলো। ম্যানেজার মালিক, পরিচিতজন, ক্লাসমেট সবাই এলো। সব শেষে এলো পুলিশ। মাহিনুরকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেলো।
দুই.
ছাড়া পেয়ে মাহিনুর মেসে ফিরলো না। চলে গেলো গ্রামের বাড়ি। সিদ্ধান্ত নিলো ওখানে কিছুদিন থাকার। একটা সেমিস্টার মিস হলে তেমন কোনো ক্ষতি হবে না।
সে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে থাকলো রীতিমতো। বেড়াতে থাকলো আত্মীয় স্বজনের বাড়ি। ঘুরতে থাকলো এখানে সেখানে। সে দেখলো আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসছে সবকিছু।
এরকম ঘুরতে ঘুরতে একদিন লক্ষ করলো সে এমন এক জায়গায় ঘুরছে, যে জায়গাটি তার অতি চেনা। কিন্তু নামটি সে কিছুতেই মনে করতে পারছে না। গাছপালা চেনা, রাস্তা চেনা, আশে-পাশের বাড়িঘর চেনা। কিন্তু নামটা সে কিছুতেই মনে করতে পারলো না। হাঁটতে হাঁটতে সে এক ঘন জঙ্গলের দিকে যেতে থাকলো। এর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া চেনা রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ শুনতে পেলো সম্মিলিত কান্নার আওয়াজ। সময়টা সন্ধ্যা সন্ধ্যা। সে আশে পাশে লক্ষ করতে লাগলো কান্নাটা আসছে কোন দিক থেকে। সে দেখতে পেল রাস্তা থেকে বেশ ভেতরে কিন্তু বৃক্ষরাজি দ্বারা কম ঘনত্ববিশিষ্ট একটা জায়গায় সামান্য আলোর রেখা। সম্মিলিত কান্নার আওয়াজ তখনো চলছে। সে আলোটিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখলো—ওটা একটা কুপি বাতি। দরোজার ফাঁক দিয়ে যার সামান্য অংশই দেখা যাচ্ছে মাত্র। বাতাস লেগে লেগে মাঝে মাঝে কেঁপে ওঠা শিখাটিও আলোর ঢেউ সৃষ্টি করছে যেন। মাহিনুর ওই আলোর রেখা ধরে এগুতে থাকলো। আলোটি ক্রমশ উজ্জ্বলতর হতে থাকলো। কান্নার আওয়াজও তীব্রতর হয়ে তার কানে বাজতে থাকলো। হাঁটতে হাঁটতে সে বাইরের দরোজার সামনে এসে হাজির হলো। ততক্ষণ সন্ধ্যা আরও গাড় হয়েছে। মাহিনুর সাহস করে দরোজাটা আরও খুলে ফেললো। দেখলো বারান্দায় এক মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে তার স্বজনরা কাঁদছে। সদ্যমৃত ব্যক্তিটির শিয়রের পাশে বাতিটি জ্বালানো। মৃত ব্যক্তিটিকে সে চেনে। কিন্তু নাম মনে করতে পারছে না। আরও আশ্চর্যের বিষয় কেউ তাকে লক্ষ করছে না। সে একে একে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে কিন্তু কেউ যেন তাকে দেখছেই না। মৃত ব্যক্তিকে ঘিরে কান্নারত সবাইকে তার চেনা চেনা মনে হচ্ছে কিন্তু কারও নাম সে মনে করতে পারছে না। বয়স্ক এক মহিলাকে সে দেখলো। যার মুখের দিকে তাকাতেই এক গভীর মায়ায় বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠলো। সম্ভবত তিনি মৃতের স্ত্রী। তাকে কত যে আপন লাগলো। কিন্তু তিনিও চিনতে পারলেন না।
মাহিনুর অগত্যা আশে পাশে তাকাতে লাগলো। বারান্দা ঘর সবকিছু তার চেনা। কিন্তু এটা কোন বাড়ি সে মনে করতে পারছে না। সামান্য হাট করা একটা ঘরের দরোজা দিয়ে সে ভেতরে তাকালো। অতিশয় আশ্চর্য নিয়ে লক্ষ করলো বারান্দায় সদ্য মৃত এক ব্যক্তিকে ঘিরে সম্মিলিত এই কান্নার আওয়াজের ভেতরেও এক যুবক নিশ্চিতভাবে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সে দরোজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো। দরোজা খোলার শব্দও তার কানে বাজলো।
এবং এবার সে অনুভব করতে লাগলো কেউ তাকে কান্না করতে করতে ঝাঁকাচ্ছে। মাহিনুর ধড়ফড় করে উঠে দেখলো ছোটবোন সাবিহা চিৎকার করে কাঁদছে। আসলে মাহিনুর ঘুমাচ্ছিল। ছোটবোন কাঁদতে কাঁদতে বললো, ভাইয়া, বাবা নেই।
মাহিনুর হতভম্বের মতো বের হয়ে এলো। দেখলো স্বপ্নে দেখা ওই দৃশ্যের বাস্তব মঞ্চায়ন যেন। শিয়রের পাশে সেই কুপি বাতি। বাবার পরনে হালকা ঘিয়ে রঙের ফতুয়া। তাকে ঘিরে সম্মিলিত কান্নার আওয়াজ।
তিন.
মাহিনুরের স্বাভাবিক হতে বেশ সময় লাগলো। তার কয়েকটি সেমিস্টার ড্রপ হয়ে গেলো।
বছর দুয়েক পর একদিন সে এক পুরোনো বন্ধুর বাসায় গেলো। সদ্য বিবাহিত বন্ধুর সঙ্গে গল্প করলে মনটা ভালো হয়ে উঠবে এই আশায়। বাসায় গিয়ে দেখলো বন্ধু ও বন্ধুর স্ত্রী বাইরে বের হচ্ছে। মাহিনুর খুব বিব্রত বোধ করলো। বললো তাহলে আজ আর বসব না। অন্যদিন আসব।
কিন্তু মাহিনুরের বন্ধু এবং বন্ধুর স্ত্রী রাজী হলো না। বন্ধু বললো, তেমন কোনো জরুরি কাজ না। হালকা পাতলা কেনাকাটা ছিল আরকি। তুই বোস। তোর ভাবীর সঙ্গে গল্প কর। আমি একাই বের হই। একটু পরই ফিরবো।
মাহিনুর কিছুতেই রাজি হতে চাচ্ছিল না। সে বারবার স্যরি বলছিল এই অসময়ে আসার জন্য। কিন্তু নাছোড়বান্দা বন্ধুর জন্য তাকে থাকতেই হলো।
সোফায় বসে টুকটাক কথা বললো বন্ধুর স্ত্রীর সঙ্গে। মাহিনুরের আড়ষ্টতা কিছুতেই কাটছিল না। একসময় বন্ধুর স্ত্রী উঠে গেলো। আপ্যায়নের প্রস্তুতি আর কি!
মাহিনুর বসে থাকতে থাকতে হালকা ঘুমের ভেতরে চলে গেলো মুহূর্তেই। এবং একটি স্বপ্ন দেখলো। দেখলো এই শহরেরই এক জায়গায় একটি অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। সে খুব চেষ্টা করছে আহত অথবা নিহত ব্যক্তিটিকে দেখতে। কিন্তু পারছে না। জনজট ঠেলে সে ভেতরে ঢুকতেই পারছে না।
ভাবীর ডাকে ঘুম ভেঙে গেলো মাহিনুরের। হতভম্ব হয়ে সে বন্ধুর স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। বন্ধুর স্ত্রী বললো, আরে আপনি কি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন না কি? ইশ আপনার ঘুম ভেঙে দিলাম। স্যরি।
মাহিনুর একটু ইতস্তত করতে লাগলো। বললো, ভাবী, আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে আমার একটা জরুরি কাজ ছিল। আমার এখুনি উঠতে হবে। কাজটা সেরে আমি আসবো।
ভাবী হায় হায় করে উঠলো। বলেন কী! আপনার যত কাজই থাকুক আপনি এখন যেতে পারবেন না। নাস্তা খাবেন, আপনার বন্ধু আসবে তারপর যাবেন। তাও কাজ সেরে ফিরে আসতে হবে। আজ আমরা একসঙ্গে খাবো।
মাহিনুর একটু অভদ্রর মতোই আচরণ করে ফেললো। বললো, স্যরি ভাবী, আমাকে এখুনই উঠতে হবে। বলেই হন হন করে বের হয়ে গেলো।
সে প্রথমেই স্বপ্নে দেখা জায়গাটায় গেলো। কী সর্বনাশ! সত্যি সত্যি একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। আর যে ব্যক্তিটি মারা গেছে সে আর কেউ নয়। তারই বন্ধু। সে উপস্থিত জনতাকে বললো, আমি উনার বাসা চিনি। আপনারা এই ঠিকানায় পৌঁছে দিন। সে একটা কাগজে ঠিকানা লিখে দিয়ে চলে গেলো।
চার.
মাহিনুর আর ফিরলো না। পেছনের সবকিছু ফেলে সে চলে গেলো। তার মা ছিল, বোন ছিল। কারও কথা সে ভাবলো না। সে শুধু ভাবলো যাকে যে ভালোবাসছে সে-ই মারা যাচ্ছে। তাও আবার স্বপ্নের মাধ্যমে জানান দিয়ে। তার আত্মাটাই অশুভ হয়ে গেছে। সে এখন তার ভালোবাসার মানুষদের সঙ্গে থাকলে তারাও মারা যাবে। মাহিনুরের ফিজিক্স কমপ্লিটও করা হলো না।
পাদটিকা
মাহিনুরের স্বপ্নগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। একটা জাগতিক। কিন্তু সেই জাগতিক স্বপ্নটি ব্যর্থ হলো। তার ফিজিক্স কমপ্লিট হলো না। অন্যদিকে সে ঘুমের ভেতরে যে-স্বপ্ন দেখলো তা তার জাগতিক জীবনে ভয়ঙ্কররূপে প্রভাবিত করলো। তাকে তছনছ করে দিলো। কিন্তু সে একটা ভুল ধারণা নিয়ে চলে গেলো জীবন ও স্বপ্ন থেকে অনেক দূরে। কারণ তার ধারণার ভেতরে গলদ ছিল।
সে ভেবেছিল তার আত্মা অশুভ হয়ে গেছে। আসলে আত্মা কখনো অশুভ হয় না। তার যেটা হয়েছিল মনোবিজ্ঞানের ভাষায় সেটাকে বলা হয় প্রিকগনিশন অব ড্রিম। কিছু মানুষের এই ক্ষমতা থাকে। তারা স্বপ্নের মাধ্যমে অনেক কিছুর ইঙ্গিত পায়। এটা খুবই রহস্যময়। অব্যাখ্যেয়।