এক.
টিলার ধাপে ধাপে আনারস গাছ লাগিয়েছে সুবল। গারো পাহাড়ের ঢালে, ছোট ছোট টিলার ধাপে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে আগাছা সরিয়েছে। পানি দিয়ে মাটি নরম করেছে। তার একটু নিচেই নোংরা পানির একটা ডোবায় মা আর মাসীরা মাছের আঁশসহ গৃহস্থালি ময়লা ঝাঁপিতে করে এনে ফেলে। শূকরের রক্তভেজা বাঁশ-তক্তা ফেলে, উৎসবে-পার্বণে প্রস্তুত পঁচুই মদের আবর্জনা ফেলে এখানে। উঠোনের কোনায় যে ময়লার স্তূপ জমে, তাদেরও জায়গা হয় এই পঁচা ডোবায়। এর চারপাশে মাছি ভনভন করে ঘুরে বেড়ায়। তবে সবাই এখানে আসে দিনের বেলায়। সন্ধ্যা হলেই নাকি খারাপ আত্মারা এখানে আসে, এই কালো নোংরা পানিতে ওরা গা ডুবিয়ে গোসল করে। ডোবার পাড়ে পা ডুবিয়ে বসে থাকে। তখন ডোবার চারপাশের গাব গাছগুলোতে শহরের মতো বাতি জ্বলে। এগুলো নাকি আত্মার চোখ। জ্বলজ্বল করে জ্বলে। পাড়ার সবাই এসব জানে। সুবল তাই দিনের বেলায় এখানে আসে তার আনারস গাছগুলো দেখতে। ভয়ে ভয়ে, প্রতিদিন। একটু একটু করে বাড়ছে আনারস। তাতে রস জমছে। ভেবে সুবলের মুখেও জল আসে। গোটা চারেক আনারস, একই দিনে পাশাপাশি লাগিয়েছে এই ভেবে, এগুলো পাকলে বাড়ির সবাই একসঙ্গে বারান্দায় বসে খাবে। আম্বিকে একটু বেশি দেবে সুবল। কারণ আম্বির বয়স হয়েছে, তার শরীরটাও ভালো না।
হঠাৎ সুবলের চোখ গেলো ডোবার দক্ষিণ কোনায়, কী একটা যেন নড়ে উঠলো। নলখাগড়ার নিচে চলে গেলো যেন কিছু একটা, দৌড়ে। সুবলের গলা শুকিয়ে গেলো। একলাফে নেমে এল সে। মা এখানে আনারস লাগাতে বারণ করেছিল। বেলীও। সুবলের জেদ দেখে বেলী শেষে বলেছিল—একা একা আসিস না কিন্তু এখানে! দুজন মিলে আসব।
আজ বেলীরও আসার কথা ছিল গাছ দেখতে। বেলী আসবে বলেছিল। এলো না। বেলীদের ঘর সামনের এই কলাবাগানের ওপারে। সুবলের পিসির বেটি ও। একটুও সাহস নেই ওর। সুবল তার ঘরে যাবে না এখন! পশ্চিমে ওই বাতাবি লেবুর গাছটা। সেদিকে হাঁটছে সুবল। বাতাবি লেবুর গন্ধ কী মিষ্টি! সব ক্লান্তি যেন দূর হয়ে যায়। মন ভালো হয়ে যায়। বড়ো হয়ে সে বাতাবি লেবুর বাগান করবে। বাগান জুড়ে মিষ্টি ঘ্রাণ ছড়িয়ে থাকবে। এগারো বছরের সুবল সাংমা এমন করে ভাবে প্রায়ই। গতকাল গাছের মগডালে একটা বড়ো বাতাবি লেবু দেখেছিল সে। ভেবেছিল আজ সেটা ঘরে নিয়ে যাবে। কিন্তু আজ আর দেখতে পাচ্ছে না। হাওয়া হয়ে গেলো লেবুটা! নিশ্চয় কেউ নিয়ে গেছে। ওই পাড়ার বুজুর কাজ এটা। এই গাঁয়ে বুজুর মতো হারামি আর কে আছে! বুজু আরেংয়ের পাড়া কলাবাগানের ওপাশে বেলীদের ঘর পার হয়ে উত্তরে। ভোরবেলায় এ পাড়ায় এসে লেবুটা নিয়ে গেছে। মগডালে বসে সুবল একা একা ফুঁসছে। ওই পুবের গহিন জঙ্গলে ফেলে আসলে বুজুর উচিত শিক্ষা হতো।
দুই.
হেমন্তের শুরুতেই বাতাসে হিম হিম ভাব। সন্ধ্যার মুখে সুবলের মা ইলা সাংমা ঘরের বারান্দায় বসে দ্রুত লয়ে বাঁশের চাটাই বুনছে। তার ঠোঁট শুকনো, উদাস চোখে বাইরে অপলক তাকিয়ে আছে। চাটাইয়ের দিকে না তাকিয়েই দক্ষ হাতে একমনে বুনে যাচ্ছে।
এ কাজে সে পটু সেই কিশোরী বয়স থেকে। কৈশোরে তার বড়ো দুই বোনও এ কাজে তার সঙ্গে পারতো না। চাটাই, কুলা, ঝুড়ি বোনায় তার তুলনা এই উপগোত্রে নেই। মা-বাবার প্রিয় মেয়ে সে। নকনা মেয়ে হিসেবে মায়ের সব সম্পত্তির মালিকও সে। স্বামীর সহযোগিতায় বাইশ বছর ধরে এই পরিবারকে আগলে রেখেছে। একচল্লিশ বছর বয়সি তিন সন্তানের জননী ইলা সাংমা দুই বোন ও এক ভাইকে খুব ভালোবাসে। আর্থিক সংগতি অনুযায়ী সহযোগিতাও করে। কিন্তু তাদের চোখে আনন্দের রেখা খুঁজে পায় না সে। সুখ তাদের সংসারে ধরা দেয় না। পরিশ্রম আর চেষ্টা ছাড়া কি সুখ আসে? এসব ভাবতে ভাবতে তার চোখের পাতা পূজার সুতোর মতো তিরতির করে কাঁপে।
তখনই তার বাবাকে মনে পড়ে যায়। কী মমতামাখা মুখ ছিল তার! অন্য সন্তানদের প্রতি ইলার এমন ভালোবাসা টের পেতেন তিনি। বুদ্ধি-পরামর্শ দিতেন। তার চলে যাওয়ার পর সবাই বুঝেছে তিনি ছিলেন এই পরিবারের খুঁটি হয়ে। বাজার থেকে ফিরে বুকে ব্যথার কথা বলতে বলতে হঠাৎ করেই মারা গেলেন। তখন ইলার মনে হয়েছিল মাথার ওপর থেকে সব ছায়া সহসা সরে গেছে! নিজেকে ভাসমান মনে হয়েছিল তার। পৃথিবীর সবই যেন দোদুল্যমান। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মৃতের সম্পর্কে শেষ কথা বলে ডাক্তার চলে গেলো। ইলার মা স্বামীর হাত পায়ে গভীর মমতায় হাত বুলিয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলছে। মাকে সামলাতে হবে। ইলা মায়ের কাছে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো। মা ইলাকে অঝোরে কেঁদে জানিয়েছিল, তার স্বামীর আত্মা সোমেশ্বরী নদী পার হচ্ছে। তাই তো হাত পা এত ঠাণ্ডা হয়ে গেছে!
ইলা সাংমার বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বের হয়। হাতের বোনার কাজের বেগ বেড়ে যায়।
বাবার মৃত্যুর মাস ছয় যেতে না যেতেই ওর মা খুব দুর্বল হয়ে পড়ে। ইলা ডাক্তার ডাকে, ডাক্তারের ওষুধপত্র খেয়ে কিছুদিন বেশ ভালোই ছিল। দিব্যি কথা বলতো সবার সঙ্গে। ভাত-মাংস খেতো। অভ্যাসবশত তামাক-চু খেতো। বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় এসে পিঁড়িতে বসে বসে গল্প করতো। এভাবে গত চার মাস ভালোই কাটছিল। হঠাৎ কী কারণে গতকাল রাত থেকে তেমন কথা বলছে না! উঠতে গেলেই ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। তার এখন ভালো চিকিৎসা করানো খুব প্রয়োজন।
অন্ধকার হয়ে আসছে। ইলার ভাবনায় হঠাৎই ছেদ পড়ল। উঠোনের আমড়া গাছের ডালে বসে একটা কাক তারস্বরে ডাকছে। কাকের অলক্ষুণে স্বর তার কানে আজ বিষের মতো বিঁধছে। আকস্মিকভাবে হাতের আধবোনা চাটাইটিই কাকের দিকে ছুড়ে মারলো সে।
তিন.
ভোর বেলাতেই সুবলের ঘুম ভেঙে যায়। ভোরে গারো পাহাড়ের শীতল বাতাস তার গায়ে মাখতে ভালো লাগে। আবছা অন্ধকার ধীরে ধীরে সরে যায়। চারপাশটা আলোকিত হয়। সব কিছু নতুন নতুন লাগে। নিজেকেও। উঠোনের জামরুল গাছটা ডোবার পাড় থেকে তুলে এনে লাগিয়েছিল সুবল। তাও এক মাস হলো। এরই মধ্যে গাছটাতে নতুন নতুন পাতা গজিয়েছে। প্রতিদিন সেই পাতার রঙ পরিবর্তন হয়। সুবল জামরুল গাছের গোড়ায় প্রতিদিন সকালে পানি দিয়ে হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসে। কিন্তু আজ কোনোদিকেই সুবলের মন নেই। মুখহাত ধুয়ে সে আম্বির কাছে আসলো।
তার আম্বি যখন সুস্থ ছিল তখন বারান্দায় পিঁড়ি পেতে বসে তাঁর কাছ থেকে কখনো সালজং দেবতার গল্প, কখনো পাহাড়ি জাদুকরের গল্প আবার কখনো বনকুসুমের গল্প শুনতো সে। গতকাল থেকে আম্বি আবার অসুস্থ হওয়ায় তার মা সারারাত ঘুমায়নি। বাবাও। সুবল দেখেছে রাতে না ঘুমালে মায়ের চোখ যেমন লাল দেখায়, আজ তেমন দেখাচ্ছে। আম্বির কাঠের চৌকির এক কোনায় বসে আছে। সুবল লক্ষ করলো তার আম্বি কিছুতেই ওষুধ খেতে চাচ্ছে না। বার বার মুখ সরিয়ে নিচ্ছে।
সুবলের আম্বি অনিতা সাংমার বয়স সত্তর বছর। তার জীবন কেটেছে এই সংসারে। হাসি কান্নায়। আনন্দ বেদনায়। ভালোবাসায়। কিন্তু দেবতারা কি তার প্রতি খুশি আছেন? দেবতাদের কথা না ভুললেও তাদের পূজা-অর্চনাও তো তিনি করেননি! জীবনের নানা ঘাত প্রতিঘাতে সে দেবতাদের সন্তুষ্টির জন্য পূজা-অর্চনা করতে পারেনি বটে, তাই বলে নিজের দায়বদ্ধতা কি এড়িয়ে যাওয়া যায়? তাদের সন্তুষ্টি লাভের জন্য কোনো পূজা-অর্চনা না করাই কি তার অসুস্থতার কারণ? ভাবতে ভাবতে শিউরে ওঠে সে। দেবতাদের অনুগ্রহ ও কৃপায় এই মানবজীবন। এই জীবনের কর্মফল যেমন হবে তার ওপর ভিত্তি করেই তো আমাদের দ্বিতীয় জীবন নির্ধারিত হবে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এসব ভাবতে ভাবতে অনিতার মনে জন্ম নেয় পাপবোধ, অনুশোচনা আর ভয়।
ইলা সাংমা মায়ের মুখে ওষুধ দিতে চাইলে অনিতা সাংমা ইলা সাংমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ইলা মাথা নিচু করে মার মুখের কাছে যায়। সুবলও এগিয়ে আসে তার আম্বির কাছে।
ইলা মায়ের কাছে জানতে চায়, কিছু বলবে আমা?
অনিতা সাংমা অস্ফুট স্বরে আওড়ে যায়, মিদ্দি আমুয়া। মিদ্দি আমুয়া…
অনেক কষ্টে বিড়বিড় করে বলছে। বার বার।
সুবল দেখলো তার আম্বির চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে বালিশে পড়ছে। মুখ হা হয়ে আছে। ঘনঘন নিশ্বাস নিচ্ছে তার প্রিয় মানুষ, তার আম্বি।
চার.
ক্লাস ক্যাপ্টেন বলে গেল, স্যার আসেননি তাই এখন বিজ্ঞান ক্লাসটা নাকি হবে না। সুবল হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। বিজ্ঞান ক্লাসের পর টিফিন পিরিয়ড। এদিক ওদিক তাকিয়ে বেলীকে খুঁজছে ও। ক্লাসের পেছনে দেখা গেল বেলীকে, হাত ইশারায় ডাকল। বেলী বান্ধবীদের সঙ্গে কথা বলছিল, সুবলকে দেখে এদিকে এসে বেঞ্চে বসলো। বললো, কাল তোদের বাড়ি গিয়েছিলাম। কোথায় গিয়েছিলি?
কখন?
বিকালে।
নখ খুঁটতে খুঁটতে সুবল বললো, আনারস দেখতে গেছিলাম।
একা একা?
তুই ভয় পাস?
না, গা ছমছম করে।
ওই হলো। আমি একাই গিয়েছিলাম। যাওয়ার পর কী হলো শুনবি?
সুবল চারদিকে তাকায়। বেলী চোখ বড় বড় করে আছে।
ডোবার ধারে কত আবর্জনা জমা হয়ে আছে, তার পাশ দিয়ে হঠাৎ কী একটা ছুটে গেল। কালো রঙের সুতোর মতো, চিকচিক করছিল। কিন্তু আমার ভয় লাগেনি—বেলীর চোখে চোখ রেখে সুবল বলে।
আর যাস না একা।
ভয় পাস না। আম্বি বলেছে, আমরা সবাই আগে জঙ্গলে বাস করতাম। সব বিপদ থেকে দেবতারা আমাদের রক্ষা করতো। শুধু পূজা দিয়ে দেবতাদের খুশি রাখতে হতো।
যাঃ আচ্ছা, তোর আম্বির তো খুব অসুখ।
হুম, জানিস, দেবতাদের পূজা করে না বলেই আমার আম্বির এমন অসুখ। এজন্যই তো অসুখ ভালো হচ্ছে না। তাই আম্বি পূজা করতে চায়।
তোদের ঘরে পূজা হবে? কবে?
জানি না। মা শুধু কাঁদে। পূজা করতে খামালকে দরকার হয়, যে পূজার মন্ত্র পড়বে। সেরকম খামাল তো নাই গ্রামে। বহুদূরে ওই মধুপুরে নাকি একজন আছে। তাকে আনতে পরাগদা গেছেন।
তিনি এলেই পূজা হবে? বেলীর চোখ জ্বলে ওঠে।
হুম। তুই আসিস। দেখবি। অনেক মন্ত্র পড়ে পূজা হয়। আমি খামালের কাছ থেকে মন্ত্র শিখে রাখবো।
তুই পারবি? বেলী মুখ টিপে হাসে।
হ্যাঁ, আমি সব লিখে রাখব। বড় হয়ে আমি খামাল হব। পূজা করব। মা তাহলে আর কাঁদবে না।
বেলী কিছু বললো না। সে দেখলো সুবল অন্যমনস্ক হয়ে গেছে। কেমন অচেনা অচেনা।
পাঁচ.
সকালবেলা পরাগদা মধুপুর থেকে ফিরে এসেই জানালো, সেই সাংসারেক খামাল আর বেঁচে নেই। তিনি দুদিন আগে মারা গেছেন। এখন অনিতা সাংমার চিকিৎসার জন্য শহরে যাওয়া ছাড়া আর উপায় নেই। শুনে সুবলের মা আর কাঁদেনি। আম্বিকে বড়ো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে পরাগদাকে বললো মাইক্রোবাসের ব্যবস্থা করতে। পরাগদা তক্ষুনি কোথায় যেন দৌড়ে গেল।
হালুয়াঘাট সদর পার হয়ে ময়মনসিংহ যেতে হয়। সেখানে বড় বড় ডাক্তার, হাসপাতাল। সবাই বলে, অসুস্থ মানুষ সেখানে চিকিৎসা পেয়ে সুস্থ হয়ে ওঠে। মা, বাবা, মেজদি আর পরাগদা গেছে আম্বিকে নিয়ে। সুবলের খুব ইচ্ছা ছিল যাওয়ার। আম্বি অসুস্থ হওয়ার পর থেকে ওই তো সবসময় আম্বির কাছে থাকতো! আম্বির যখন বার বার পানি পিপাসা পেতো। সুবল তাকে পানি এগিয়ে দিতো। পানি খেতে খেতে সুবলকে তার মা-বাবার কথা বলতো আম্বি, বলতো দেবতাদের কথা। পূজা-মন্ত্রের কথা বলে খুব আফসোস করতো। এ নিয়ে আম্বির মনে যে খুব দুঃখ ছিল সুবল সেটা বুঝতে পারতো!
আম্বির জন্য আর পূজা হলো না বলে সুবলেরও শেখা হলো না রোগের পূজা-মন্ত্র! কংস নদীর পাড়ে বসে আজ সুবলের বুকের ভেতরে নাম না জানা কোনো এক পাখি ডেকে যাচ্ছে উদাস দুপুরের মতো। আম্বির কথা ভেবে ভেবে ওর চোখ দুটো ভিজে ভিজে যাচ্ছে।