কুমার নদীতে ভরা যৌবন এখন। বর্ষা আসবে আসবে করছে। বর্ষায় কুমার নদীর যৌবন উপচে পড়ে। ভাসিয়ে দেয় আশেপাশের সব খাল, বিল। বর্ষা আসতে দেরি নেই আর। একটানা ৪ দিন মুষলধারে বৃষ্টি হয়ে নদীর পানিকে বাড়িয়ে দিয়েছে। নদীর পাশেই লাগানো ডাঁটা ক্ষেত, কচুর বাগান, পুঁইশাকের গজিয়ে ওঠা কচিপাতা, বেগুন গাছ, ফুল আসা বরবটি গাছ—সব পানির নিচে। শেফালী একটা হরেক রঙের তালি দেওয়া ছাতা মাথায় দিয়ে পা টিপে টিপে নদীর পাড়ের দিকে এগিয়ে যায়। সন্ধ্যা হতে কিছুটা সময় বাকি। বৃষ্টির বেগ কম বলে বের হয় শেফালী। চারদিনের টানা বৃষ্টিতে ঘরের খাবার সব শেষ। চালের ড্রাম, ডালের কৌটো একদম ফাঁকা। হলুদ, নুনের বয়ামে এক দুই দিনের মসলা পড়ে আছে। রান্নার তেল তলানিতে এসে ঠেকেছে। কেরোসিন নেই একফোঁটাও। কাজে যেতে পারেনি স্বামী সিরাজ মিয়া। মালাই (আইসক্রিম) বেচে গ্রামে গ্রামে ঘুরে সে। একদিন কাজে যায় তো পাঁচদিন ঘরে ঘুমিয়ে কাটায়। গ্রামের মানুষ বলে, সিরাজ অইল গতর পালা পুরুষ পুলা। শেফালীও তা এখন অক্ষরে অক্ষরে টের পায়।
নদীর পাড় ঘেঁষেই চেয়ারম্যান সাহেবের বিশাল বাড়ি। পরপর পাঁচ বার চেয়ারম্যান হয়েছিল আলিম ভুঁইয়া। এখন বয়স হয়েছে, ইলেকশনের ঝামেলা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। তবু চার পাঁচ গায়ের মানুষ তাকে চেয়ারম্যান সাহেব বলেই ডাকে। আর তার বাড়িটা এই গাঁয়ে চেয়ারম্যান বাড়ি হিসেবেই পরিচিত।
চেয়ারম্যান বাড়ির চারপাশ ঘিরে ফলের বাগান। নাম না জানা হরেক রকমের ফুল ফুটে থাকে এ বাড়ির গেটে, বারান্দায়, ছাদে। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে শেফালী। সবসময়ের না হলেও মাঝে মাঝেই ডেকে পাঠায় শেফালীকে চেয়ারম্যান গিন্নি। কাজগুলো করে দিয়ে যাওয়ার সময় বাসি তরকারি, ভাত, ডাল যা থাকে গামলা ভরে নিয়ে আসে শেফালী। ভালো রান্না হলেও তার ডাক পড়ে চেয়ারম্যান বাড়িতে। আজকের রান্না চেয়ারম্যান বাড়ির লোক কালকে খেতে পারে না। ভাত তরকারি বেঁচে গেলেই শেফালীকে খবর দেয় তারা। অনেক সময় ফ্রিজ পরিষ্কার করে দিলেও, আগের কেনা মাছের কয়েক প্যাকেট দিয়ে দেয়। চেয়ারম্যান গিন্নিকে শেফালী আম্মা ডাকে।
ঈদের সময় জাকাতের কাপড়, ফিতরার টাকাটাও শেফালীরে দেয় তারা। শেফালী কৃতজ্ঞ তাদের কাছে। তারা এত সাহায্য না করলে দুই দুইটা ছেলে মেয়ে নিয়ে না খেয়ে মরতে হবে তাকে।
নদীর পাড়ের তার শখের কচু ক্ষেত নাকি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। খবর দিয়ে গেছে ও পাড়ার নুরুর বউ। শেফালীকে গিয়ে কচুগুলো তুলে আনতে বলে। একটা লাইট আর কাঁচি নিয়ে ছাতাটা চেয়ারম্যান বাড়ির দরজার পাশে রেখেই নদীতে যায় শেফালী। কচু বাগানে বুক পর্যন্ত পানি এসে গেছে। হাত দিয়ে চেষ্টা করেও টেনে তুলতে পারছে না কচু। কোনো উপায় না দেখে ডুব দিয়ে দিয়ে কাঁচির সাহায্যে তুলে আনছে বিশাল সাইজের এক-একটা কচু। কোনো কোনোটায় জড়িয়ে আছে কচুর লতি। ২০-২৫টি কচু তোলার পর শেফালীর গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। শীত করতে থাকে খুব। উঠতে যাবে এমন সময় পায়ের নিচে কাঁটার খোঁচা লাগে। শেফালীর অভিজ্ঞতা বলে দেয় এটা মাছ। পা দিয়ে চেপে ধরে ডুব দেয় শেফালী। হাতে বড় সাইজের একটা গলদা চিংড়ি। শীতের অনুভূতি উবে যায় কোথায় যেন। একমাস মাছ খেতে না পারা বাচ্চা দুটির মুখ চোখের সামনে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ঠিক তখনই চরকান্দা জামে মসজিদ এ মাগরিবের আজান শোনা যায়।
দুই.
টিপ টিপ বৃষ্টি, হালকা বাতাস বইছে। নদীর পাড়ের গাছগুলো দুলছে মৃদু ছন্দে। একটা দুটো করে আলো বাড়তে বাড়তে নদীর বুকজুড়ে এখন আলোর বন্যা। যতদূর চোখ যায় আলো আর আলো। আলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মানুষের ফিসফিস, ঝুপঝাপ আওয়াজ। দূর থেকে দেখলে মনে হবে অসংখ্য জোনাকি যেন কোনো আনন্দ উৎসবে মেতেছে। যেখানে একটু আগে অন্ধাকারে শুধু বাতাসের শো শো শব্দ শোনা যাচ্ছিল, এখন সেখানে হাজারো আলোর মাতম।
নৌকা চলে এসেছে চার থেকে পাঁচটা। যাদের খ্যাপলা জাল আছে তারা নৌকায় করে জাল ফেলে মাছ ধরছে। নদীর কিনারে উঁচা জাল দিয়ে মাছ ধরছে বেশিরভাগ মানুষ। কেউ কেউ খালি হাতেই ধরছে।
শেফালীদের বাড়িটা নদী থেকে একটু ভেতরের দিকে। ছোট যে খালটা নদী থেকে বড় রাস্তার দিকে চলে গেছে, সেই খালের মাঝামাঝি, খালের পাড় ঘেঁষেই তাদের বাড়ি। একা একটা বাড়ি, অন্য বাড়িগুলো একটু দূরে দূরে। ঘরের সামনে দুটো আমগাছ। পেছনে বাঁশঝাড়। বাঁশঝাড় পেরুলেই চার-পাঁচ ঘর গেরস্থ বাড়ি। কায়সার শেক, তৈয়ব মিয়া, ইসমাইল সেক, সরো শেক, মাসুদ শেকদের বাড়ি। এরা সবাই এক বাড়িতে থাকে। এরাই শেফালীর প্রতিবেশী। আর যারা আছে তারা খালের ওপাড়ে। ওদের সঙ্গে তেমন যাওয়া আসা নেই তার। কায়সার শেকের বউ যখন শেফালীকে ডাকছিল তখন শেফালী চেয়ারম্যান গিন্নির দেওয়া বড় কচুটার কিছু অংশ কেটে নিয়ে তাতে হলুদ নুন মাখছিল। ভাত রান্না হয়ে গেছে, খুদের ভাত। তার সঙ্গে গরম গরম কচু ভাজা আর গলদা চিংড়িটা ভেজে খেতে দেবে ছেলে মেয়ে দুটিকে। ছেলে-মেয়েরা চুলার পাশেই মা’কে ঘিরে বসে রয়েছে। নড়ছে না একটুও।
—ও শেফালী। শেফালী। ডাকতে ডাকতে বাড়ির কাছেই চলে আসে আলেয়া, সবাই তাকে আলো বলেই ডাকে।
—শেফালী। ও শেফালী।
—কিডা? আলো বুজিনি? কী অইছে বুজি?
—কী অইছে কসনি? তোরে বুলাইতে বুলাইতে আমার গলা ভাইঙ্গা গেলো, আর তুই এহন কস বুজি কী অইছে? কানের মাতা খাইছসনি?
—চেইতো না বুজি, চেইতো না। আমি হুনলে কি এহেনে বইস্যা থাহি কও? আমি হুনি নাই বুজি। তুমি বসো। এ রত্না তোর কাকিরে ফিড়াহান দে।
—না রে না, বসবার আসি নাই। গাঙে যাবো। গাঙে মাছ গাবাইছে। পাইলা ভইরা ভইরা মানুষ মাছ মারবালাগছে। আমি হুনলাম কেবল। তাই তোরে খবরডা দিবার লাইগ্যা ডাকপালাগছি। নইলে তো আবার কইতি বুজি আমারে খবরডা কইলা না?
—মাছ গাবাইছে? তুমি যাও আমি রত্নার বাপরে নিয়া আইতাছি।
—হ। আমি গেলাম তাইলে তাগাদা আয়।
—হ আইতাছি যাও।
শেফালী তাড়াতাড়ি করে হাতল ছাড়া কড়াইয়ে বোতলের শেষ তেলটুকু নিংড়ে দিয়ে দেয়। গরম তেলে কচু আর চিংড়ি মাছ কড়া করে ভাজতে ভাজতে সিরাজ মিয়াকে ডাকতে থাকে।
—রত্নার বাপ, উডো। মেলা ঘুমাইছো। গাঙে মাছ গাবাইছে। হুনছ? ও রত্না তোর বাপরে ডাক। কয়ডা মাছ ধরা পারলি তো কয়দিন খাওয়া যাবে।
রত্না কাছে যেতেই খেঁকিয়ে ওঠে সিরাজ মিয়া—এই শয়তানের বাচ্চা তোগো জ্বালায় কি ঘুমাইয়াও শান্তি পাবো না? তোর মারে যাইয়া মাছ ধরবার ক। আমার মাছ খাওয়া লাগবে না।
রত্নার খুব মন খারাপ হয়। বাবা কখনোই কি ভালো কথা বলতে পারে না?
রত্না আর শাওনকে ভাত খেতে দেয় শেফালী। টিনের জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে দিয়ে ঘরের মাঝের পাঠকাঠির দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে। সিরাজকে আবার ডাকে—উডো, আমিও তোমার হাতে যাবানে, ছাওয়াল মাইয়া দুইডা ঘরে থাহুক। ওগো এই রাইতে নিলে জ্বর আসবার পারে। একমাস ধইরা মাছ কিনবার পারোনাই। পুলাপান দুইডা মাইনসের মুহের দিক চাইয়া থাহে। ও রত্নার বাপ! ওডো। আবার ঘুমাইয়া পড়লা নাহি?
লাত্থিটা ঠিক বুকে গিয়ে লাগে শেফালীর। ভাঙা চৌকিটা থেকে নিচে পড়ে যায় সে। হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, এই মানুষটার সন্তানের মা সে! এই মানুষটার সঙ্গে কাটাতে হবে তার বাকিটা জীবন!
লাথি মেরে গালাগালি দিতে দিতে আবার মুখ ঘুরিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে সিরাজ। ইদানিং খুব ঘুমায় সিরাজ। একটানা তিনদিনও ঘুমিয়ে কাটায় মাঝে মাঝে। ডাকলে রক্তবর্ণ হয়ে থাকা ঘুম জড়ানো চোখ মেলেই গালাগালি করতে থাকে। কখনো কখনো মার খেতে হয় শেফালীকে। বউ ছেলে মেয়ে কী খাবে সেই চিন্তা নেই তার। প্রথম প্রথম বুঝতে না পারলেও মানুষের মুখে শুনতে শুনতে এখন বেশ বুঝতে পারে শেফালী—একটু একটু করে সিরাজ ডুবে যাচ্ছে নেশায়!
তিন.
কোমরের সঙ্গেই দড়ি দিয়ে পাতিলটা বাঁধা। সন্ধ্যায় চেয়ারম্যানের ক্ষেতের কচু তুলতে গিয়ে ভিজিয়ে ফেলা কাপড়টা আবার পরে আসে শেফালী। এত কাপড় ভিজালে পরার মতো কিছু থাকবে না তার। সামনে ঈদ এলে আবার কাপড় পাবে সে মানুষের কাছে। জাকাতের কাপড়। বছরে দুই ঈদে যে কাপড় পায়, তা-ই পরের বছরের ঈদ পর্যন্ত পরার চেষ্টা করে। ছেলেটা হওয়ার পর থেকেই সিরাজ বদলে যেতে থাকে একটু একটু করে। ছেলেটা হওয়ার পর থেকে আর কোনোদিন কিনে দেয়নি শেফালীকে কিছু। আসেনি শেফালীর কাছে, ঘুমিয়েছে আলাদা বিছানায়।
—মা,মা এইদিকে এডা খ্যাও দাও।
পুরনো মশারি কেটে বাঁশের মাথা দিয়ে নিজেই উঁচা জাল বানিয়ে নিয়েছে শেফালী। কেনার সামর্থ্য নেই। একটা উঁচা জাল কিনতে সাত আটশ টাকা লাগে।
—রত্না ,সামনের কোনাডা ধরিস মা, এই কচুড়ির ধাপডায় খ্যাও দেই আগে।
রত্না পানিতে নামেনি, নামতে দেয়নি শেফালী। ও নদীর কিনারে দাঁড়িয়েই মার জালের কোনা উঁচু করে ধরে। শেফালী পাড় ঘেঁষেই মাছ ধরছে। রত্নার একহাতে হারিকেন, অন্যহাত দিয়ে জালের এক কোণা উঁচু করে ধরা। শেফালী একটা একটা করে কচুড়ি ঝাকি দিয়ে দিয়ে ফেলতে থাকে। কচুড়ির ছোবড়ার সঙ্গে যদি কোনো মাছ থাকে, তাহলে সেই মাছ জালে পড়বে, এজন্য কচুড়ি ফেলার আগে ঝাঁকি দিয়ে ফেলতে হয়।
হারিকেনের আলোয় চকচক করে ওঠে মা-মেয়ের মুখ। হারিকেনের মৃদু হলুদ আলোয় দেখতে পায় চারপাঁচটা বড় সাইজের রয়না, দুটো কই, তারা বাইম পাঁচ ছয়টা,আছে শিংও। মাছগুলো পাতিলে তুলে নেয়। জাল উল্টে ময়লা ফেলে দেয়। পরের খেও দেওয়ার জন্য প্রস্তুত সে।
বড় ভাতের পাতিলটা কানায় কানায় ভরে উঠেছে মাছে। রাতও অনেক হলো মনে হয়। সবচেয়ে কম মাছ পেয়েছে শেফালীরা। এর মধ্যে বড় বড় দুটো শোল মাছ আছে, আছে একটা মাঝারি সাইজের বোয়াল। ডিমওয়ালা বড় বড় পুঁটি, টেংরা, চিংড়ি অনেক। শেফালী এতেই অনেক খুশি। সবাই কত কত মাছ পেলো তা ওর দেখার দরকার নেই। আল্লাহ অনেক দিয়েছে শেফালীকে। এই মাছ ছেলেমেয়ে দুটোকে একমাস খাওয়াতে পারবে সে। চেয়ারম্যানদের বাড়ি বড় বড় দুইটা ফ্রিজ, সেখানেই রেখে দিতে পারবে অনায়াসে।
পানি পচে মাছ উঠে এসেছিল ওপরে। প্রতিবারই এমন এক-দুইবার হয়। যারা মাছ কিনে ছেলেমেয়েদের খাওয়াতে পারে না, আল্লাহ তাদের জন্যই এই ব্যবস্থা করে বলে শেফালীর বিশ্বাস। বাতাস ছেড়েছে আবার জোরেশোরে। মাথায় তুলে নেওয়া মাছের পাতিল একহাত দিয়ে ধরে অন্যহাতে জাল নিয়ে, সামনে হারিকেন ধরে পথ দেখানো মেয়েকে অনুসরণ করে বাড়ির দিকে রওনা হয় শেফালী।
চার.
বড় বড় চোখ দুটি কালো আর গভীর তার চাহনি। চোখের পাপড়িগুলো ঘন-লম্বা। চিকানো নাক, ঠোঁট যেন কোনো শিল্পীর যত্নে আঁকা। ঘন চুল তার সরু মেদহীন কোমর ছাড়িয়ে গেছে, ছিপছিপে গড়ন কিন্তু রোগা নয়। ধবধবে ফর্সা তার গায়ের রঙ। মানুষ উপমা দিয়ে যেমন বলে দুধে আলতা গায়ের রঙ, শেফালীর গায়ের রঙ ঠিক তাই। তখন শেফালীর বয়স ১৪-১৫ বছর। সেভেন পর্যন্ত পড়াশোনা করিয়েই হাঁফিয়ে উঠেছিল শেফালীর বড় ভাই। শেফালীর বাপ তখন বিছানা নিয়েছে প্যারালাইজড রোগী হিসেবে। মা মারা গিয়েছে আরও বছর দুয়েক আগে। স্কুলে যেতে পারে না শেফালী গ্রামের বাজে কতগুলো চোখের জন্য। চোখ দিয়েই যেন তারা খেয়ে নেবে শেফালীকে।
বিয়ের প্রস্তাব একটার পর একটা আসতেই থাকে শেফালীর। গরিবের ঘরে সুন্দরী মেয়ে থাকাটাও একটা পাপ। সিরাজ মিয়া তখন ঢাকায় থাকে। গার্মেন্টস এ কাজ করে। দেখতেও সুন্দর ছিল তখন। সিরাজ মিয়ার তিন কুলে কেউ নাই, শেফালীকে শহরে রাখতে পারবে ভেবে বড় ভাই শহীদুল বাপ মারা যাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যেই সিরাজের হাতে তুলে দেয় বোনকে। বাবার রেখে যাওয়া যেখানে যেটুকুই আছে সব শহীদুল নিয়ে নেয়। মানুষের সমালোচনার ভয়ে শেফালীর বিয়েতে অনুষ্ঠানের কোনো কমতি করেনি সে।
বিয়ের পর সিরাজ ঢাকায় নিয়ে আসে শেফালীকে। ছোট এক কামরার একটা বাসায় গুছিয়ে সংসার করে শেফালী। তাকে কোনো কাজ করতে দেয়নি সিরাজ। আদরেই রেখেছিল। বিয়ের দুই বছরের মধ্যেই রত্না আসে তার কোলজুড়ে। শেফালীকে আরও বেশি ভালোবাসতে শুরু করে সিরাজ। ছুটির দিনগুলোতে শেফালীকে নিয়ে ঘুরতে বের হয় সে। শেফালী অবাক হয়ে শিশুর মতো ঢাকা শহরের বড় বড় বিল্ডিং দেখতে থাকে, মিরপুর চিড়িয়াখানা, সংসদ ভবন, রমনা পার্ক ঘুরে ঘুরে দেখে। রত্নার যখন একবছর বয়স, তখন আবার সন্তানসম্ভবা হয় শেফালী। শরীর খারাপ হয়ে পড়ে খুব। অফিস করে সিরাজের পক্ষে শেফালীর যত্ন নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। শেফালীকে গ্রামে পাঠিয়ে দেয় সিরাজ। বড় ভাইয়ের সংসারে বোঝা হয়ে আসে শেফালী। প্রথমে টাকা পাঠাতো সিরাজ, পরে আস্তে আস্তে টাকার সঙ্গে ফোন দেওয়াও বন্ধ করে দেয়। শেফালী তখন ছেলের মা হয়েছে। সিরাজের হঠাৎ পরিবর্তনে মন একদম ভেঙে যায় তার। ভাইয়ের সংসারে সব কাজ করেও দিন রাত কথা শুনতে শুনতে পাগল হয়ে যায়। স্বামীর কোনো বিপদ হয়েছে ভেবে আল্লাহর কাছে কাঁদতে থাকে। বিপদ না হলে যে মানুষটা তাকে এত ভালোবাসে, এভাবে কিছুতেই ভুলে থাকতে পারে না। শেফালীর কান্নাকাটি আর অনুরোধে চেয়ারম্যান চাচা আর বড় ভাই মিলে ঢাকায় যায় সিরাজের খোঁজে। সেখানে গিয়ে দেখে সিরাজ শেফালীর ঘরে, শেফালীর বিছানায় তুলেছে অন্য মেয়ে। এখনো বিয়ে করেনি তারা। বিয়ে করার স্বপ্নে বিভোর দুজন। আশেপাশের মানুষের মুখের কথা শুনে সিরাজের কাছে জানতে চাইলে সে স্বীকার করে সব।
সেদিন চেয়ারম্যান চাচা, শেফালীর বড় ভাই সিরাজকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিল গ্রামে। চেয়ারম্যান চাচার ছোট ভাই ঢাকার বড় পুলিশ অফিসার। তার সাহায্যে কিভাবে সিরাজকে রাজি করিয়ে গ্রামে আনা হয়েছিল, সে গল্প গ্রামের সবার মুখে মুখে। একটু সুযোগ পেলেই মানুষ তা শুনিয়েছে শেফালীকে আরও মসলা মাখিয়ে। কী দোষে শেফালীকে এমন সাজা দিলো সিরাজ, তা ভেবে পায়নি শেফালী। ভেবে পায়নি কিসের কমতি ছিল তার মধ্যে। সিরাজের বাপের ভিটায় পাঠকাঠির একটা ঘর তুলে দেয় চেয়ারম্যান ও বড় ভাই। চেয়ারম্যান বাড়িতে কাজ পায় শেফালী।
প্রতিবছর বর্ষায় ঘরের পাটকাঠি পাল্টায় শেফালী। দাম বাড়লে কিছু বিক্রিও করে। সিরাজের ভরসায় থাকে না সে আর। সপ্তাহে এককেজি চাল পারলে দেয়, না পারলে দেয় না সিরাজ। আগে অনেক চেঁচামেচি করতো শেফালী, তাতে কোনো লাভ হতো না বরং জুটতো মারধর। তাই আর কোনো চাওয়া-পাওয়া বা অভিযোগ নেই সিরাজের প্রতি।
পাঁচ.
বর্ষা এসে গেছে। কুমার নদীতে এখন ভরা যৌবন। মাঝে মাঝে সে ভয়ঙ্কর রূপ নেয়। কুমার নদ না নদী, এ নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। স্থানীয়রা সবাই নদী বা গাঙ বলে। কুমার তার দুকুল ছাপিয়ে আশেপাশের খাল বিলগুলোকে ভরিয়ে তুলেছে। এ সময় ফুলসুতি গাঁয়ের মানুষগুলো নৌকায় চলাফেরা করে। খালের এ পাড়ের মানুষ ওপাড়ে যাওয়ার জন্য কোথাও কোথাও দিয়েছে বাঁশের সাঁকো। ছোট ছেলেমেয়েগুলো সারাদিন সেই সাঁকোর বাঁশে ঝুলে থাকে। এটাই ওদের খেলা। একটু বড় ছেলেরা সাকো থেকে লাফ দিয়ে দিয়ে পড়ে পানিতে। সাঁতরে পাড়ে এসে আবার সাকো বেয়ে মাঝ বরাবর এসে পানিতে লাফিয়ে পড়ে। সারাদিন চলতে থাকে এভাবেই। একদল যায় অন্যদল আসে। এ সময় প্রায় সবার ঘাটেই বাঁধা থাকে নৌকা। নৌকায় করে বাজারে করতে যায় মানুষজন। বড় রাস্তার ওপাশে বিশাল চক (একসাথে অনেক মানুষের জমি যেখানে)। বর্ষাকালে সেই চক থাকে পানির নিচে ডোবে। শাপলা ফুটে সাদা হয়ে থাকে সকালবেলা। ফুলসুতি গ্রামের অনেকেই এ বর্ষাকালে মাছ ধরার কাজটা করে। বর্ষা শেষ হলে অন্যকাজ করে। চুন্নু খালাশির ছেলেদের ৩০ থেকে ৪০টি করে জাল আছে। সন্ধ্যেবেলা চক এ গিয়ে জাল ফেলে আসে, আজানের আগে নৌকা নিয়ে গিয়ে জাল তুলে নৌকার খোলে রেখে বাড়ি আসে। পরিবারের সবাই মিলে জাল থেকে মাছ ছাড়িয়ে বাজারে নিয়ে বিক্রি করে। এমন হাতে গোনা কয়েকজন আছে এ গায়ে। তাদের কাছে দেশি মাছ পাওয়া যায় সবসময়। চড়া দামে।
শেফালীর নৌকা কেনার সামর্থ্য নেই। দুই বছর আগে নিজেদের তাল গাছ কেটে বানিয়ে নিয়েছে ডুঙা। শেফালীর ঘাটে তাই বাঁধা থাকে ডুঙা। ডুঙায় করে শেফালী মিয়াবাড়ির মসজিদের কলে পানি আনতে যায়। মাঝে মাঝে ডুঙা নিয়ে শেফালীও যায় চকে। কয়েকটা হাস পোষে সে। হাসের জন্য শামুক আনতে যায়। তখন বেছে বেছে শাপলা তুলে আনে চক থেকে। কখনো কখনো অনেক বেশি তুলে আনে শাপলা। চেয়ারম্যান চাচাদের, আলো বু কে দেয় শেফালী। শাপলার তরকারি খুব ভালোবাসে শেফালী। ছেলেমেয়ে দুটোও ওর মতন। চিংড়িমাছের সঙ্গে শাপলা ভাজি, দেশি যেকোনো মাছ দিয়ে শাপলার ঝোল খুব ভালোবাসে শেফালী। মাছ না থাকলে শুকনো মরিচ ফোড়নে দিয়ে শাপলা ভাজি করে শেফালী। খুব ভালো হয় খেতে। মাঝে মাঝে নারকেল বাটা দিয়েও শাপলা রান্না করে। রান্নাটা কারও কাছে শেখেনি শেফালী। খেতে ভালোবাসলে রান্না নিজে থেকেই ভালো হয়ে যায়। মাঝে মাঝে ছেলেমেয়েরা বায়না ধরলে শাপলার ভেলা বানিয়ে খেতে দেয় ও। শাপলা ছোট ছোট সাইজ করে কেটে নারকেল পাতার শলা দিয়ে ভেলার মতো করে বানিয়ে বেসনে চুবিয়ে তেলে ভেজে নিতে হয়। রত্না আর সোহেল খেতে বসে মারামারি শুরু করে দেয়। ওদের দেখে শেফালীর ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে যায়। শেফালীও ছোটবেলা শাপলা খেতে খুব ভালোবাসতো।
ছয়.
সকাল থেকেই টিপ টিপ বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি থামছেও না, আবার গতিও বাড়ছে না বৃষ্টির।
আজানের আগে উঠে রান্না বসিয়েছে শেফালী। আজ চেয়ারম্যান চাচাদের পাটের জাগ উঠবে। নদীর পাড়েই তুলবে। মাঝে মাঝে বড় রাস্তায়ও পাটের জাগ তোলে চেয়ারম্যান। শেফালী যায় না বড় রাস্তায় কখনো পাট নিতে। নদীর পাড়ে পাটের জাগ আনলে শেফালী নেয়, তবে সবসময় চেয়ারম্যান চাচার পাট-ই নেয়ও। অন্য কারও জমির পাট নেয়না শেফালী। অন্য সবাইকে পাঠকাঠি ৩ ভাগ করে ২ ভাগ দিয়ে দিতে হয়, আর এক ভাগ যে নেয়, সে পায়। চেয়ারম্যান চাচাদের পাট নিলে সব পাটকাঠি দিয়ে দেয় শেফালীকে। অন্যদের বেলায় আধাআধি ভাগ। আধা গেরস্তের আর আধা যে নেয় তার। কিন্তু শেফালীর বেলায় নিয়ম নেই কোনো। অন্যরা কথা শোনায় শেফালীকে, শেফালীর কী! ওর তো ফাডা কপাল, আমাগো মতো পুড়া কপাল না।
শেফালী ওসব বিদ্রূপ গায়ে মাখে না। কোনো উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন ও মনে করে না। সব পাটকাঠি দিয়ে দিলেও সে সব নেয় না। পাঠকাঠি শুকিয়ে ভালোগুলো বেছে বেছে দিয়ে আসে চেয়ারম্যান গিন্নিকে। বড় ভালোবাসে শেফালীকে তারা। শেফালী ও তাদের সব কাজ বলার সঙ্গে সঙ্গেই হাসিমুখে করে দিয়ে আসে। এছাড়া শেফালী খুব শান্ত আর নরম স্বভাবের মেয়ে। এ গ্রামে কারও সঙ্গে কোনোদিন উঁচুগলায় কথা বলেনি সে। শেফালীকে তাই ভালোবাসে সবাই।
গরম ভাত, ডাল আর হাসের ডিম ভেজে স্বামী সন্তানদের জন্য রেখে নিজে গত রাতের পান্তা ভাতগুলো পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে খেয়ে নেয়। পুরনো একটা কাপড় বের করে পরে নেয় শেফালী। পাট নিতে গেলে কাপড়ের কোনো চেহারা থাকে না। নষ্ট হয়ে যায় কাপড়। তাই পুরনো ছেঁড়া কাপড়গুলো এই পাটের সময়ে পরার জন্য গুছিয়ে রাখে শেফালী, গুছিয়ে রাখে এ গাঁয়ে শেফালীর মতো আরও অনেকে।
পিঁড়ি নিয়ে নদীর পাড়ের দিকে যায় শেফালী। একটা ভালো যায়গা বেছে নিয়ে পিঁড়িটা রাখে। কয়েকটা পিঁড়ি দেখতে পায় শেফালী ওর আশেপাশে। কেউ আরও আগে এসেই জায়গা রেখে গেছে। পাট নেওয়ার সময় এই বসার জায়গা নিয়ে খুব ঝামেলা হয় প্রতিবার। নদীর পাড় দিয়ে যে মাটির রাস্তাটা চলে গেছে, সে রাস্তার দুই পাশ দিয়েই মুখোমুখি বসে এ গাঁয়ের মহিলারা পাটের আঁশ ছাড়ায়। রাস্তা দিয়ে পুরো গায়ের মানুষ বাজারে বা বিভিন্ন কাজে যায়। তাই রাস্তার পাশেই যে ফাঁকা একটা জমির মতো জায়গা আছে সেখানে বসতে চায় সবাই। তাতে একটু হয়তো আড়াল হয়। যে যত আগে আসতে পারে, সে তার পছন্দমতো জায়গা নিয়ে বসতে পারে। আবার কোনো জায়গাটায় বসলে বেশি রোদ লাগবে না শরীরে এমন জায়গাও খুঁজে সবাই। এ গায়ের দুই- একজন আছে, যারা অন্যের পিঁড়ি দেখলেও মানে না নিয়ম, পিঁড়ি সরিয়ে নিজের পিঁড়ি রেখে বসে পড়ে। তখনই শুরু হয় ঝগড়া। শেফালী খুব হিসাব করে করে ঝামেলা করার মানুষগুলোকে এড়িয়ে চলে।
বৃষ্টি থামার কোনো চিহ্ন নেই। পিঁড়ি রেখে একটা গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ায় শেফালী। এখনো চক থেকে পাটের জাগ নিয়ে আসেনি কৃষাণেরা। পাট কাটার পর চকের পানিতেই জাগ দিয়ে দেয়। পাট আঁশ ছাড়ানোর মতো হলে বড় নৌকায় করে খাল দিয়ে নিয়ে আসে নদীর পাড়ে। চেয়ারম্যান চাচার বাড়ির সামনে। একদিনে যদি তিন চারটা জাগ ওঠে তবে বড় রাস্তায় তুলে দেয় কিছু পাট। রাস্তার পাশের মহিলারা নেয় সেগুলো। তবে নদীর পাড়ে তুললে বেশি সুবিধা হয়। পাট থেকে আঁশ ছাড়ানো শুরু হলে পাটের আঁশগুলো নদীর পানিতে ধুতে শুরু করে কৃষাণরা। নদীর পানিতে পাট ধুলে সে পাটের রঙ সুন্দর হয়। দাম ও ভালো পাওয়া যায় নাকি। এ সবই শেফালী পাটের আঁশ ছাড়াতে ছাড়াতে শুনেছে বহুবার। নদীর পাড়ের রাস্তা জুড়ে বাঁশের আড় বাঁধা, পাট ধুয়ে সেখানেই শুকাতে দেওয়া হয়। একদিক পাটের আঁশ ছাড়াতে থাকে মহিলারা অন্যদিকে শুরু হয়ে যায় পাট ধোয়ার কাজ। দুপুরের দিকে একবার বাড়ি গিয়ে খেয়ে আসে শেফালী। তারপর সেই সন্ধ্যা পর্যন্ত পাটের আঁশ ছাড়াতে থাকে। যাদের বাড়ি একটু দূরে তারা সঙ্গে করে ভাত নিয়ে আসে, আনে পানির জগ, পাতায় করে মুড়িয়ে নিয়ে আসে লবণ। যারা ভাত নিয়ে আসে সবাই একসঙ্গে বসে নিজেদের জীবনের গল্প করতে করতে ভাত খায় একসঙ্গে। প্রতিটি বর্ষায় এ গায়ের দুঃখ, কষ্ট, আনন্দ সব লেখা হয়ে থাকে পাটের আঁশ ছাড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে।
সাত.
পাট ধোয়ার ফাঁকে ফাঁকে সবার চোখকে আড়াল করে দুটি চোখ মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখে নিচ্ছে শেফালীকে। সে চোখে নেই কাম, নেই কোনো লোভ, আছে শুধু নির্মল ভালোবাসা। ছেঁড়া, পুরনো, পাটের গন্ধ জড়ানো শাড়িতে শেফালীর সৌন্দর্য যেন আরও বহুগুণ বেড়ে গেছে। অভাব, দুঃখ কিছুই শেফালীর রূপকে কমাতে পারেনি বরং এই অভাবের সংসারে বড্ড বেমানান তালে বাড়ছে শেফালীর রূপ। মোহনীয়, স্নিগ্ধ সে রূপ। ২৬-২৭ এ পা দিয়েছে শেফালী। এখন সে কুমার নদীর মতোই ভরপুর। অথচ সিরাজ আরও ৮ বছর আগে থেকেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তার দিক থেকে। নেশার রাজ্যে সিরাজ এখন রাজা। সে রাজ্যেই তার বসবাস। সে রাজ্য ছেড়ে এই অভাবের দেশে বউ ছেলেমেয়ের দায়িত্ব নেওয়ার মতো বোকা সে নয়।
সুজিত, চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়িতে আসা কৃষাণদের মধ্যে সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ। স্বভাবেও খুব ভালো। রংপুর থেকে প্রতিবছরের মতো এবারও কৃষাণরা এসেছে পাট কাটা, ধোয়ার কাজে। চেয়ারম্যান চাচার পুরনো কাচারিতে থাকতে দিয়েছে ওদের। ওদের রান্নার দায়িত্ব পেয়েছে শেফালী। খুব সকালে আর রাতে এই দুইবেলা রান্না করে দেবে শেফালী। ১২ জনের একটি দল। সবাই একই এলাকার মানুষ। রংপুরের নীলফারির জলডাঙায় মানুষ এরা। পাটকাটা ধোয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত এরা থাকবে এখানেই।
কুমার নদীতে বুক পানিতে দাঁড়িয়ে পাট ধুয়ে যাচ্ছে সুজিত। মনটা আটকে গেছে শেফালীর সুন্দর নিষ্পাপ মুখটিতে!
সুজিতের নির্মল, পবিত্র ভালোবাসায় একসময় হেরে যায় তৃষ্ণার্ত শেফালীর মন। অভাবের যন্ত্রণায় চাপা পড়ে যাওয়া আদিম চাওয়াগুলো শরীরে প্রতিবাদ শুরু করে। নির্ভরতা যদি ভালোবাসার আরেক নাম হয় তবে ভালোবেসে ফেলে সে সুজিতকে। এই প্রথম তার কারও ছোঁয়ায় শিহরণ জাগে। স্বার্থপর হতে ইচ্ছে করে খুব। নির্ভরতার থালায় চিকন চালের ফুলের মতো ঝরঝরে সাদা গরম ভাতের স্বপ্ন দেখে শেফালী। স্বপ্ন দেখে একফালি ঝকঝকে উঠোনের, খোলা আকাশের, ভালোবাসাময় একটি ঘরের, সুখময় প্রতিটি রাতের।
স্বপ্ন দেখে সুজিতও। শেফালীকে বউ করে পাওয়ার স্বপ্ন দেখে সে। ছোট সংসারে নতুন অতিথির খিলখিল হাসির, খুনসুটির, শেফালীর কোলে মাথা রেখে পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখে সুজিত।
স্বপ্ন দেখায় কোনো পাপ নেই। ভালো থাকার স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে সবাই। স্বপ্নই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, ভুলিয়ে দেয় অবহেলিত সময়ের দাবি।
আট.
বৃষ্টি পড়ছে দুপুরের পর থেকেই একটানা। শেফালীদের ঘরের পেছনে বাঁশঝাড়ের সামনে খানিকটা নিচু জায়গা। পানি জমে গেছে সেখানে। বৃষ্টির জমা পানিতে কতগুলো ব্যাঙ শুরু করেছে। ব্যাঙের ডাকে শেফালীর চিন্তায় ছেদ পড়ছে বারবার।
কাল সকালে চলে যাবে সুজিতরা। ওদের কাজ শেষ। শেফালীকে চুপিচুপি বুকের কাছে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে সুজিত অনেক বুঝিয়েছে। নতুন সংসার, ভালোবাসা, নির্ভরতার আশ্বাস দিয়েছে। শেফালীকে সে নিয়ে যাবে সঙ্গে করে। বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে গেলে সন্তানদেরও নিয়ে যাবে ওরা। শেফালীর এ অনাদৃত জীবনে সুজিত সুখের স্পর্শ। ডুবে গেছে শেফালী সে ভালোবাসায়। আজ সে ভাববে না সমাজের মানুষের কথা, ভাববে না সে গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার পর গ্রামের মানুষের তাকে নিয়ে যে নোংরা কথা বলবে সেগুলোর কথা। আজ শুধু নিজেকে নিয়েই ভাববে। সুজিতের যত্নে শেফালীর ভালোবাসার ফুল হয়ে সুগন্ধ ছড়াবে তাদের ছোট কুটিরে, এর বাইরে কিছু ভাবতে চায়ও না শেফালী।
রাত সাড়ে বারোটা। বারান্দায় ছেলেমেয়ে দুটোর মাঝে শুয়ে আছে শেফালী। ঘরের ভেতরে আধভাঙ্গা চৌকিতে ২ দিন ধরে ঘুমাচ্ছে সিরাজ। ঘুম নেই চোখে তার। অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে অনাগত দিনগুলোর আলোর রেখা খোঁজার চেষ্টা করছে। ঠিক এ সময়ে একটি বড় নৌকা নীরবে এসে থামলো শেফালীর ডোঙার পাশে। দুজন নৌকায় বসে থাকলো, পাঁচজন নামলো নৌকা থেকে, নিঃশব্দে। থামলো শেফালীর পাঠকাঠির দরজার সামনে। পাঠকাঠির কড়া (দরজা) নাড়ছে কেউ। কড়ার সামনে একটা কাঠের চেয়ার দিয়ে রাখে শেফালী সবসময়। তাই থাক্কা দিলেই খোলার ভয় থাকে না কড়া। শব্দ শুনে শেফালীর বুক কাঁপতে থাকো। তাহলে কি সুজিত ওকে নিতে এসে গেছে! কিন্তু সুজিতের তো আসার কথা না, শেফালী যাবে আজানের একটু পরেই বের হয়ে ফুলসুতি স্টেশনে। সেখানেই থাকার কথা সুজিতের। এমনই তো কথা হয়েছিল ওদের। ঠিক ৬ টায় রংপুরের গাড়ি ধরবে ওরা। সব ঠিক ছিল। তাহলে কি সুজিত আর দেরি করতে পারছে না, থাকতে পারছে না শেফালীকে ছেড়ে!
কড়া নাড়ার শব্দ জোরে হচ্ছে। শেফালী কাঁপা কাঁপা গলায় জানতে চায়—কিডা, কিডা এহানে?
—আমি, তোর চেয়ারম্যান চাচা, শেফালী দরজা খোল মা।
এত রাতে চেয়ারম্যান চাচা কেন? তাহলে কি সব জানতে পেরে গেছে চাচা? শেফালী কি পারবে না ভালোবাসার মানুষকে কাছে পেতে? না কি সুজিতের কোনো বিপদ হয়েছে! দরজা খুলতে খুলতে কত কী ভেবে যাচ্ছে শেফালী।
সিরাজকে কোমরে দড়ি পরিয়ে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে মাদক নিরাময় কেন্দ্রের লোক। চেয়ারম্যান চাচা বলেছিল অনেক আগে একবার সিরাজকে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে দেওয়ার কথা। কিন্তু খরচের কথা শুনে শেফালী চুপ হয়ে গিয়েছিল। সিরাজকে নিয়ে নৌকা ছাড়ার আগে চেয়ারম্যান চাচা বলে উঠলো, তোর এই বাবা থাকতে ভাবিস না মা!
ঘরে ঢুকে ঘুমন্ত ছেলেমেয়েদের বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল শেফালী। কেউ নেই তাকে বাধা দেওয়ার, সুজিতের সঙ্গে ঘর বাঁধতে আটকাবে না কেউ। যদিও সিরাজের ঘরে থাকা না থাকা সমানই ছিল। তবু আজ সিরাজকে নিয়ে যাওয়ার পর শূন্য ঘরে শেফালী বুঝতে পারছে একটা মানুষের উপস্থিতি তাকে কতটা সাহস জুগিয়েছে অলক্ষ্যে, নিশ্চিন্তে ঘুমানোর ভরসা দিয়েছে।
সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে সকাল হয়ে গেছে বুঝতে পারেনি শেফালী! ঘর থেকে বের হয়ে খালের ঘাটে গিয়ে দাঁড়ায় শেফালী। ভোরের বাতাস রাতজাগা বিধ্বংস শেফালীর চোখেমুখে পরম যত্নে হাত বুলিয়ে দেয়। চমকে ওঠে শেফালী, সুজিতের স্পর্শ টের পায় ও। গুমরে কেঁদে ওঠে। শেফালী। একদৌড়ে ঘরে এসে আধভাঙা শূন্য বিছানায় ঝাপিয়ে পড়ে কাঁদতে থাকে। নেশাগ্রস্ত মানুষটা, তার দেওয়া সন্তানেরা, পাটকাঠির এই ঘর, ঘাটে বাঁধা ডুঙা কখন যে মায়া নামক অদৃশ্য এক বেড়ি দিয়ে আটকে দিয়েছে শেফালীকে, তা সে বোঝেনি কখনোই।