বাসার শেষ কাচের গ্লাসটিও সফলভাবে ভাঙতে পেরে বুড়া আর গুড়া বিশ্বজয়ীর একটা হাসি দিল। আকস্মিক পিঠের মধ্যে দুমদাম করে গোটা ছয় কিল আর গালের মধ্যে এলোপাথাড়ি চড় তাদের বিশ্বজয়ের আনন্দকে ধূলিস্যাৎ করে দিল মুহূর্তেই। তাদের দুই সহোদরের কীর্তিতে ঘরের পোষা বিড়ালটাও দুটো লাথি খেলো বেহুদা। মহুয়ার মেজাজ দুপুর থেকেই সপ্তমে চড়ে আছে। এর যথেষ্ট কারণও আছে। টিভির রিমোট সারাঘরে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। বুড়া আর গুড়ার ভাঙা খেলনা হাফপ্যান্ট ফুলপ্যান্টের মাঝখানে কোথায় খুঁজবে রিমোট! রিমোট না পেলে বুড়ি শাশুড়ি তার কানের ব্যান বাজিয়ে দেবে। তার ওপর প্লাসটাও শেষ। রাতে খাওয়ার টেবিলে পানি খাওয়ার জন্য মেলামাইনের বাটি দেওয়া ছাড়া উপায় নেই তার।
বুড়া আর গুড়া সাক্ষাৎ ইবলিস। বুড়া এবার তৃতীয় শ্রেণীতে উঠলো, আর গুড়ার এখনো স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি। মহুয়ার শাশুড়ি এমনিতে চোখে কম দেখেন, কানে কম শোনেন, কিন্তু সন্ধ্যার পর ভারতীয় বাংলা সিরিয়াল দেখার সময় তার দৃষ্টি-কর্ণ অনেকটা সজাগ হয়, টিভির রিমোট যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখেন। ভদ্র মহিলার দৃষ্টি ও কর্ণের তুলনায় গলার স্বর বেশ খানিকটা উন্নত, নুন থেকে চুন খসলেই ক্যাঁ ক্যাঁ করে ওঠেন। প্রায় প্রতিদিনই মহুয়ার সঙ্গে তার গলা ফাটিয়ে চিৎকার চলে। মহুয়াও এদিক থেকে কম যায় না। তার কথার স্বর শাশুড়ির মতো চড়চড়ে না হলেও কুৎসিত ভাষা প্রয়োগ ও বিশ্রি অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শনে মহুয়া অদ্বিতীয়া। নেহাত নিজের দুরসম্পর্কের চাচার বাড়ি না হলে বাড়িওয়ালা মহুয়ার এ চমৎকার বয়ানের জন্যই হয়তো ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিত পরিবেশ নষ্ট করার অভিযোগে।
অবশেষে কুশন কভারের ভেতর থেকে ছয় ঘণ্টা পর রিমোটটা উদ্ধার করা গেছে, একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে টিভি অন করে মহুয়া, চ্যানেল ঘোরায় এদিক-সেদিক, হঠাৎ একটা বেসরকারি চ্যানেলের ব্রেকিং নিউজে মিনিট কয়েক হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে। তারপর এক ছুটে দৌড়ে যায় পাশের ফ্ল্যাটে। ভাই দীপ্র আমাকে একটু শমরিতা হসপিটালে নিয়া যাবা? ইমারজেন্সিতে যেতে হবে আমায় এক্ষুনি?
দীপ্র অবশ্যই নেবে, এই আধপাগলা মহিলার এমন ব্যকুল রূপ এর আগে দীপ্র কখনোই দেখেনি। ঝিগাতলার পাশাপাশি ফ্ল্যাটে আজ তারা কত দিন, কিন্তু কখনোই এই মহিলার সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো হয়ে ওঠেনি। তার উগ্র আর ক্ষ্যাপাটে রূপের জন্যই দীপ্র পাশ কাটিয়ে চলে। অথচ আজ কি কাতর হয়ে সাহায্য চাইতে এসেছে! কার বিপদ হলো কে জানে! মইনুল ভায়ের না তো?
মইনুল ভাইয়ের কথা মনে করে আতঙ্কিত হয় দীপ্র, কত চমৎকার মানুষ মইনুল ভাই। তবে তার বাম পাশের পাঁজরটা নিশ্চই কড়কড়া ছিলো, না হয় এত কটকটা বৌ তার মতো মানুষের কেমন করে জোটে! একথা একদিন বলেও ছিল দীপ্র, উনি হাসতে হাসতে দীপ্রর কাঁধে হাত রাখেন। আপনজনের মতোই বলেন: বুঝলে ভায়া দীপ্র, আমার বৌটারে চেনা এত সহজ না, সবাই তার বাইরের রূপটাই দেখে। আচরণে সে সাক্ষাৎ দেবী চণ্ডী। তাই লক্ষ্মীর মতো সাদাসিধা দেবী তার কাছে ভিড়তে ভয় পায়। এই আর কি!
দুঃখ করো না ভাই। তার শুধু আমার মায়ের সঙ্গেই না দুনিয়ার কারো সঙ্গেই বনিবনা হয় না। তবে এও সত্য মানুষটা মোটাবুদ্ধির হলেও এক নম্বর সলিড গোল্ড। আমার মা এতদিন বেঁচে আছেন শুধু মহুয়ার সঙ্গে নিত্য নতুন ক্যাচালের আনন্দে। রোজ অফিস থেকে ফিরলেই দেখি ঝগড়ায় কেউ একজন পরাজিত হয়ে ভাত না খাওয়ার পণ করে আছে। হয় মা, না হয় বৌ। হাহাহাহা।
শমরিতায় আজ অনেক ভিড়, পুলিশ আর সাংবাদিকদের আনাগোনাও লক্ষ করার মতো। মহুয়া রিসিপশনে ‘নিশাদ নূর ফিরোজ’ নামের প্যাসেন্টের খোঁজ জানতে চাইলে রিসপশনের মেয়েটি চমকে তাকায় মহুয়ার দিকে। দীপ্রও চমকেছে বেশ। কিছুক্ষণ আগে ব্রেকিং নিউজে তো এই নামটাই শুনল।
মেয়েটি জানায় নিশাদ নূর ফিরোজ এখন আইসিইউতে আছেন। প্রচুর রক্ত ক্ষরণ হয়েছে ওনার, চব্বিশ ঘণ্টা না গেলে অবস্থা বলা সম্ভব না।
মহুয়ার বিধ্বস্ত করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে মেয়েটির মায়া হয়, নরম স্বরে প্রশ্ন করে:
ফিরোজ সাহেব কে হয় আপনার ম্যাম?
মহুয়া উত্তর দেয়: বন্ধু, খুব কাছের বন্ধু।
না ভুল বলল মহুয়া, বন্ধু নয়, ফিরোজ নামটা মহুয়ার জীবনে একটা চমৎকার যন্ত্রণার নাম। প্রতিমুহূর্তে যন্ত্রণা দেওয়া কষ্টের নাম ফিরোজ। আজও ভেবে অবাক হয়, হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা মৃত প্রায় ফিরোজ এককালে মহুয়ার খুব কাছের কেউ ছিল। ছিল মহুয়ার আত্মার আত্মীয়। মহুয়ার মতো অসভ্য আনকালচার্ড রুচিহীন নারীর জন্য ফিরোজের মতো পুরুষ এসেছিল একগুচ্ছ সিজন ফ্লাওয়ার হয়ে। তার কৃষ্ণচূড়া তার নীলকণ্ঠ তার উদাসীন উইলোর ঝোপ ফিরোজ। তাকে অভিবাদন করার মতো অভিধা কি মহুয়ার আছে? নেই। কোনো কালে হবেও না।
ফিরোজ সুহীকে নিয়ে কানাডা সেটেলড হওয়ার পর প্রথম দুই বছর তাদের ঘর সংসারের খুঁটিনাটি বর্ণনা, বরফের ছবি, তুষার পাতের গল্প আর শ্যাম্পেইন পার্টির ছবিসহ পত্র নিয়মিতই পেত মহুয়া। পৃথিবীর অন্য প্রান্তে ফিরোজ-সুহী যখন শোকেসে তাদের স্বপ্নগুলো গুছিয়ে রাখছে, এ প্রান্তে মহুয়া তখন স্বপ্নভাঙার কষ্টে শরবিদ্ধ পাখির মতো কাটিয়েছে তার নির্ঘুম রাত। তার সাদা রঙের স্বপ্নগুলোতে পারাবত হয়ে উড়তে পারেনি তার আগেই রাস্তার গনগনে আগুনে পোড়া কালো পিচ বন্ধ করে দিল চলার পথ। মহুয়া রিকশার হুড তুলে চলত তখন। প্রচণ্ড গরমে ঝরে পড়া ঘামের সঙ্গে তার চোখের নোনা জল আলাদা করা যেত না। মহুয়া পাগলের মতো সারাদিন ঘুরতো এখানে-সেখানে দিনশেষে ফিরতো টোলারবাগের লেডিস হোস্টেলের অন্ধকার ঘুপচি রুমে। পরিত্যক্ত মহুয়া চাইত না তার কান্নার সুর বাতাস ছাড়া আর কেউ শুনতে পাক।
ফিরোজের সঙ্গে মহুয়ার দেখা হয় আসাদ গেটে আড়ংয়ের কাছে এক ফুচকার দোকানে। মহুয়া তখন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছিল ফুচকাওয়ালার সঙ্গে। পুরু একবাটি ফুচকা দোকানির মুখে থেতলে দিয়েছে সে, সঙ্গে গালি দিচ্ছে লোকটাকে সমানে। ব্যাটা ছেলের মতো ভঙ্গি: ‘শালার পুত শালা’ ফুচকার মধ্যে কেরোসিন তেল দিছস ক্যা, তোর বাপের জন্মে শুনছস কেরোসিন দিয়া ফুচকা খায়!
দোকানি এই বদখত মেয়ে ছেলের আচরণে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়, পাশে দাঁড়িয়ে আশপাশের মানুষগুলো মজা দেখছিল। ফুচকাওয়ালার প্রেসটিজে লাগে। সেও কম যায় না, শুরু করে অশ্লীল গালিগালাজ, মুহূর্তে তা পৌঁছে যায় হাতাহাতিতে। একপর্যায়ে একটা শক্ত পুরুষের হাত তাকে টানতে টানতে নিয়ে আসে একটা মেরুন রঙের টয়েটোর সামনে। হাসতে হাসতে লোকটা মহুয়াকে শান্ত করার চেষ্টা করে, আরে আজব মেয়ে তুমি রাস্তা ঘাটে বখাটে ছেলের মতো ঝগড়া ফ্যাসাদ করো, হাতাহাতি করো। লজ্জা লাগে না?
মহুয়া প্রতিউত্তরে কিছু বলতে যায়, এত বড় সাহস! তার হাত ধরে টানে, মাইরা আজ তক্তা বানিয়ে দেবে। হায় হায় লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে আর বলা হয় না কিছু, কে এই লোক এত সুন্দর!এত গভীর চোখ মহুয়া এর আগে কখনো দেখেনি।
সেই চোখ ছিল ফিরোজের চোখ।
হসপিটালের ওয়েটিংরুমে দীপ্র মহুয়াকে বিস্ময়ের সঙ্গে দেখছে, এ কোন নারী, পাশাপাশি ফ্ল্যাট হওয়ার সুবাদে কতদিন ধরে দেখছে, এ নারী তো বড়ই রহস্যময়। ছেলে দুটোকে মারার সময় কি নিষ্ঠুর লাগতো তাকে, কি ভয়ঙ্কর চোখের দৃষ্টি অথচ তার সে চোখ দিয়ে এখন কত বড় বড় ফোটায় পানি পড়ছে।
কে হয় এই ফিরোজ নামের লোকটা তার?
ফিরোজ যে মহুয়ার কে হয়, কেউ কখনো কি তা বুঝবে? মনে হয় না, এমনকি ফিরোজও যখন বুঝেছে তখন অনেক দেরি। মহুয়া নিজেও তো বোঝেনি প্রথম। কেমন করে ফিরোজের সঙ্গে পরিচয়ের পর মহুয়ার জীবনটা পাল্টে যায়। বোঝেনি মহুয়া। একটুও বোঝেনি।
মহুয়ার সঙ্গে এর আগে কোনো যুবক আগ বাড়িয়ে কথা বলতে আসেনি, মহুয়ার রূপ এবং গুণ কোনোটিই কোনো ভদ্র শিক্ষিত ছেলের আকর্ষণ তৈরিতে যথেষ্ট নয়। কিন্তু ফিরোজ আকৃষ্ট হয়েছিল। ফিরোজ আকৃষ্ট হয়েছিল তার সহজতায়, আদিমতায়। মহুয়ার সবটাই তার ভালো লাগতো, মহুয়ার জন্য মেরুন টয়োটা বাদ দিয়ে রিকশা ধরল। হাঁটতে চলতে কত যে উচ্ছ্বাস তার। উচ্ছ্বাস সব তুচ্ছ তুচ্ছ বিষয়ে। পূর্ব রাতে রিভিউসহ টেলিকাস্ট দেখা হিন্দি সিরিয়ালের ঘটনার রগরগে বর্ণনায় আগ্রহ, এশিয়া কাপে বাংলাদেশ ভারত বা পাকিস্তানকে হারালে তার রঙের ডিব্বা নিয়া ছোটাছুটিতে আগ্রহ, সবচেয়ে বেশি আগ্রহ হোপের সামনের ফুটপাথের চক্রাবক্রা কামিজ দেখলে হামলে পড়ায়। আগ্রহ নাই শুধু একটা বিষয়ে সেটা পড়ালেখা। এ জন্য পরীক্ষায় মানোন্নয়ন নামক শব্দের সঙ্গে তার দারুণ সখ্য।
ফিরোজ যতই দেখে ততই অভিভূত হয়। কিছু কিছু চরম অস্বস্তিকর কাজও মহুয়া প্রচণ্ড সাহসের সঙ্গে করতে পারে। রাস্তায় ওর সঙ্গে হাঁটতে গেলে ফিরোজ দেখতো কি অবলীলায় মহুয়া যেখানে সেখানে থুতু ছিটিয়ে নোংরা করছে পরিবেশ। ঘেন্নাও লাগে না, লজ্জাও না। সর্দি আসলে ঘ্যোত করে নাক ঝেড়ে ওড়নায় হাত মুছে ফেলে। এত কদর্য অভ্যাস মহুয়া ছাড়া আর কোনো মেয়ের মধ্যেই সে ইতোপূর্বে দেখেনি।
রাস্তা ঘাটে যে খাবারই পায়, ক্ষুধা পেলেই মহুয়া গপ গপ করে খায়, পচা না বাসি তার খোঁজও নেয় না।
একি আজিব মেয়ে!
আরও কত কত ভালো ভালো অভ্যাস তার।
প্রায় প্রতিদিন রিকশাওয়ালাদের সঙ্গে একটাকা দু’টাকা ভাড়া বেশি নিয়ে ঝগড়া করে। রোজই কোনো না কোনো রিকশাওয়ালা তাকে নিয়ম করে মারতে চায়। ফিরোজের চোখে দেখা এই হচ্ছে মহুয়া চরিত্র।
সেই মহুয়ার ভেতরে পরিপাটি ফিরোজকে নিয়ে এক চরম বিভ্রান্তি জন্ম নেয়। মহুয়া প্রেমে পড়ে ফিরোজের, অসুস্থ রকম প্রেম। এর আগে কোনো পুরুষ মহুয়ার এতটা কাছে আসেনি, ফিরোজের মতো সর্বগুণ সম্পন্ন সুপুরুষতো দূরে থাক, পাশের ফ্লাটের তিনবার ম্যাট্রিক ফেল করা কোনো ছেলেও না। এ কারণে মহুয়া যখন প্রথম শুনলো ফিরোজের এফেয়ার আছে তখন সঙ্গে সঙ্গে কিছুক্ষণ সে নিঃশ্বাস নিতে পারেনি। তড়িঘড়ি করে হোস্টেলে ফিরে আসে, জ্বর ওঠে সে রাতে তার। বমিও হয় কয়েকবার।
তিনদিন পর ফিরোজের সঙ্গে যখন দেখা হয়, তখন ফিরোজ মহুয়াকে চিনতে পারে না। তিন দিনেই মনে হয় তিরিশ বছর বয়স বেড়ে গেছে তার। ফিরোজ প্রশ্ন করে কী হয়েছে মহুয়া, মহুয়া উত্তর দেয়: এতদিন পেটের ওপর আমি টর্চার করছিতো পেট এবার তার প্রতিশোধ নিচ্ছে মনে হয়। আমার পেটের যক্ষা হইছে ফিরোজ।
বলেই অসুস্থ রকম হাসতে শুরু করে, ফিরোজ অবাক হয় মহুয়ার পাগলা হাসিতে।
মহুয়া ফিরোজের কাছে তার প্রেমিকা সম্পর্কে কিছুই জানতে চায় না, তবু ফিরোজ আগ্রহ নিয়ে শোনায়- মেয়েটির নাম সুহী, ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে পড়ে। রেম্প মডেল সে। আনন্দ ২০০০ থেকে তার বায়োগ্রাফিসহ ছবি দেখায়, সুহী বর্তমানে একটা ডান্স ট্রুপের সঙ্গে দুবাই আছে।
মহুয়া হা হয়ে সুহীকে দেখে, এত রূপ আর এত গুণ, নিজের দিকে তাকিয়ে লজ্জায় কুঁচকে যায়। ছিঃ ছিঃ ছিঃ! কেমন করে সে ভাবলো ফিরোজের মতো কেউ তার প্রেমে পড়বে, ছিঃ ছিঃ! এত বেহায়া আর বেঢপ চিন্তা তার! এত দিনের নির্লজ্জ মহুয়া জীবনে এই প্রথমবারের মতো লজ্জা পায়। ফিরোজ বলেই যাচ্ছে, তার চোখে চকচকে খুশির ঝিলিক,বলে জানো মহুয়া সুহীকে সবাই ‘মালাইকা অরোরা’ বলে। আহ কি গর্ব ফিরোজের চোখে, কি অহঙ্কার!
হাসপাতালের ওয়েটিংরুমেও আজ মালাইকা অরোরাখ্যাত সুহী আলোচনার প্রধান ব্যক্তি। টিভি চ্যানেলের ব্রেকিং নিউজগুলোও বারবার দেখাচ্ছে রেম্প মডেল সুহী হোটেল ব্লুর ৩০৩ নম্বর কক্ষ থেকে পলায়নরত অবস্থায় লবিতে পুলিশের হাতে ধৃত। বহুবছর পর আবারও মহুয়া সমান বিস্ময় নিয়েই সুহীকে দেখছে। এই সেই সুহী! সেদিনের সেই সুহী।
সুহীর গল্প মহুয়া রাত দিন শুনতো, কত গিফট আর কত স্পেশাল ডে, যেগুলোর সঙ্গে এর আগে মহুয়ার কখনো পরিচয়ই ছিল না, তবু ফিরোজের আগ্রহে শুনতো সব, দেখতো সব। একবার ফিরোজ সুহীর জন্য কাশ্মিরি গোলাপের গন্ধওয়ালা একটা পারফিউম এনেছিল প্যারিস থেকে। মহুয়াকে দেখতে দিয়েছিল। মহুয়া তার গন্ধ শুঁকে বলেছিলো এটা তুমি কী এনেছ ফিরোজ? কেমন তেঁজপাতার গন্ধ! তোমার সুহী গায়ে মাখলে তো লোকজন পোলাও ভেবে ছুটে আসবে খাওয়ার জন্য।
মহুয়া কাঁদছে খুব। তার পিঠ ফুলে ফুলে উঠছে। দীপ্র অস্বস্তি বোধ করছে, বাসায় ফিরবে কি না জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছে না, অবশ্য মইনুল ভাইকে সে ফোনে সিচুয়েশন টা জানিয়েছে, মইনুল ভাই খুব বুঝদার মানুষ অনুমান করেছেন বিষয়টা। এ-ও বলেছেন, এটা মহুয়ার একান্তই ব্যক্তিগত কোনো অধ্যায়, আমি গেলে মহুয়ার অস্বস্তি হবে। ভাই কষ্ট হলেও তুমি একটু মহুয়ার পাশে থাকো, আমি সংসার দেখছি। দীপ্র অবশ্যই থাকবে, এমন ব্যক্তিত্বের মানুষের কথা কি ফেলা যায়?
টিভিতে লেটেস্ট আপডেট দেখাচ্ছে রেম্প মডেল সুহিকে মিডিয়ার লোকজন ছেকে ধরেছে অনবরত প্রশ্ন করে যাচ্ছে একটার পর একটা। একজনের প্রশ্ন ছিল এমন: আচ্ছা আপনার হাসবেন্ড তো প্রবাসেই থাকতো, ফিরল কেন? আপনার সঙ্গে তো শুনেছিলাম ছাড়াছাড়ি হওয়ার পথে, তো এখন সমস্যাটা কী ছিল?
সমস্যাটা কী ছিল, কেউ না জানলেও মহুয়া জানতো, বছর দুই কাটার পরই ফিরোজ সুহীর কাছে বুড়া আর গুড়ার মতো দুষ্টু মিষ্টি বেবি চেয়েছিল, উঠতি মডেল সুহীর পক্ষে এই দাবি পূরণ করা ছিল অযৌক্তিক। তার চোখে তখনোও মিরান্ডা কের, কেট মস, লুওয়েন হিলারির মতো সুপার মডেল হওয়ার স্বপ্ন। এত তাড়াতাড়ি নিজেকে কিভাবে নষ্ট করবে সে? অনামিকা ফ্যাশন শো-এর সেই চোখ ধাঁধানো সুন্দরীর কাছে এ দাবি ছিল তার ক্যারিয়ার নষ্টের ধান্দা। তার এত দিনের গ্রুমিং করা বিদ্যা, বিবি রাসেলের অপূর্ব সব স্টাইল ভুলে এখনই সে কেন ছুটবে ডক্টরের কাছে আল্ট্রাস্নো করতে? অসম্ভব।
এসব কথা মহুয়া ফিরোজের চিঠি থেকেই জেনেছিল, শেষের দিকে মহুয়া আর শুনতে চাইত না, তাই চিঠির ভাঁজ না খুলেই রেখে দিত যত্নে। মইনুলের সঙ্গে বিয়ের পর মহুয়া খুব করে জড়িয়ে যায় সংসারের হাঙামায়, শাশুড়িকে নিজের কাছে এনে রাখে। বছর ঘুরতেই বুড়ার জন্য বেবি শপের দোকানে ছোটে। ঘর আর সংসার হুল্লোড়ে ব্যস্ত হয়। তবু কানের মধ্যে সবসময় ফিসফিস করে বাজে ফিরোজের দীর্ঘশ্বাস! মহুয়া জানতো ফিরোজ সুখে নেই।
ফিরোজের চাওয়াগুলো ছিল খুব ছোট। সুহী শাড়ি পরে এসে তাকে চমকে দেবে, তার জন্য কোনো একবেলা নিজ হাতে রান্না করবে। এই টাইপ সহজ চাওয়া। সুহী অবশ্য শাড়ি পরেও তবে যে শাড়ি পরে, সেটা একজন শো-স্টপারের শাড়ি পরা। সে শাড়ি চোখ ধাঁধানো স্টেজেই ভালো লাগে, হুড তোলা রিকশায় না।
ফিরোজ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছিল মহুয়াকে, মহুয়া সুহী না পরুক তুমি অন্তত একটা দিন পরবে আমার জন্য এক রঙের তাঁতের শাড়ি, কপালে একটা টিপ, চোখে একটু কাজল।
সেদিন রাতেও মহুয়া ঘুমায়নি, এত অপমানিত লাগছিল তার নিজেকে। একপুরুষ তার অতৃপ্ত স্বপ্নগুলোর তৃপ্তি খুঁজছে তার কাছে, সে প্রক্সি দেবে সুহীর, মাঝ রাতে উঠে আয়না দেখে নিজেকে, তামাটে গায়ের চামড়ায় বিশেষত্বহীন অবয়ব, তবু সে সাজবে, এই প্রথম ফিরোজ তার কাছে কিছু চেয়েছে।
ভোর হতেই পাশের রুম থেকে ধার করে আনে শাড়ি, চুড়ি আর টিপ। এর আগে কখনো তার প্রয়োজন হয়নি এসবের। আজ প্রথম, হায়রে তবু এ সাজ তার নিজের সাজ নয়, সুহীর হয়ে সাজতে হবে তাকে, চোখে কাজল দিতে গিয়ে চোখ ভিজে লেপ্টে গেলো সব, সে কেন পারেনি এই সাজটা নিজের জন্য সাজতে। ঘর থেকে বেরুনোর আগে মহুয়া তার রুমের ছোট্ট আয়নায় আরেকবার নিজেকে দেখে, বাহ! একেবারে যাত্রাপালার সখী অথবা বাংলা সিনেমার এক্সট্রার মতো লাগছে তাকে দেখতে।
ফিরোজ মহুয়াকে দেখে হা হয়ে যায়। এত খুশি হয়, আবেগে মহুয়ার হাত চেপে ধরে। বার বার বলে: মহুয়া তোমাকে বউ বউ লাগছে, মনে হচ্ছে তোমাকে একশবার বউ বলে ডাকি।
বউ। বউ। বউ।
মহুয়া ভেঙে যায়, মহুয়া নিঃস্ব হয়ে যায়। এই মানুষটা কেন তার হবে না, কার কী ক্ষতি হতো যদি ফিরোজ শুধু মহুয়ার জন্য জন্ম নিত। স্রষ্টার ওপর রাগ হয়, কেন পারল না সে সুহী হয়ে জন্ম নিতে? মহুয়ার চোখ ভিজে যায়।
ফিরোজ প্রশ্ন করে, কাঁদছ কেন?
মহুয়া উত্তর দেয় কাজল লেপ্টে চোখে পড়ছে তাই কাঁদছি।
ফিরোজ বলে তুমি কেমন জানি পাল্টে যাচ্ছ মহুয়া। তোমার ক্ষ্যাপাটে পাগলাটে রূপ আজকে কেমন যেন কোমল হয়ে যাচ্ছে।
মহুয়া ধাতস্থ হয়, একটু হাসে, বলে নাহ্ কোমল হব কেন? বিয়ের পর বর দেখবে আমার ক্ষ্যাপাটে পাগলি রূপ!
কী করবে?
জানতে চাইছ কী করব?
বলা যায় আমাকে, শ্লীল না অশ্লীল?
ধুর ওইসব না, আমার খুব ইচ্ছা বরের সঙ্গে ফুলসজ্জার রাতে চুটিয়ে বিড়ি টানবো আর বাংলা মদ খাব। বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকব কিছুক্ষণ।
এরপর!
না থাক, আর বলা যাবে না তুমি মারবে আমায়।
না মারবো না বলো শুনি।
এরপর ফুল ভলিউমে হিন্দি গান বাজাবো আর বরের হাত ধরে নাচবো। মুন্নি বদনাম হয়ি ডারলিং তেরে লিয়ে…। ফিরোজ অদ্ভূত মুগ্ধ চোখে মহুয়াকে দেখেই যাচ্ছিল আর মহুয়ারও প্রলাপ থামছিল না।
ফিরোজ আমার ফ্যামেলি প্ল্যানিং শুনবে না?
হু বলো শুনি।
বছর বছর বাচ্চা নেব। বাসাটাকে ছোটখাটো একটা কিন্ডারগার্টেন বানিয়ে ফেলব। ছেলে হলে নাম রাখবো বুড়া আর গুড়া ওয়ান, টু, থ্রি আর মেয়ে হলে রাখবো মাঠ আর ঘাট ওয়ান, টু, থ্রি।
উফ এইতো সেদিনের কথা এসব। সেদিন কত হেসেছিল দুজন। ফিরোজের উস্কোখুস্কো চুল, চোখের মায়া, গা থেকে ভেসে আসা মিষ্টি সুন্দর দারুচিনির গন্ধ।
সুহীর কণ্ঠে চমকে উঠল মহুয়া টেলিভিশনের সাউন্ডটা বাড়িয়েছে কেউ একজন। পুলিশ ও সাংবাদিকদের সে বলছে, ফিরোজের সঙ্গে তার বারিধারার প্রপার্টি নিয়ে ঝামেলা ছিল, তাছাড়া ফিরোজের এক্সপোর্ট ইম্পোর্টের বিজনেসের সেও একজন পার্টনার, ডিভোর্সের পর প্রপার্টির কত অংশ সে পাবে, এটা নিয়েই ডিল করতে কাল দুজন হোটেল ব্লু তে মিট করেছে, আর এ উদ্দেশ্যেই ফিরোজ এতবছর পর দেশে এসেছিল। সুহী ফিরে আসার পরও একবারের জন্যও নাকি সে দেশে আসেনি, এ কারণেই কথা চালাচালির একপর্যায়ে তাদের তর্ক বেঁধে যায়, আর ফিরোজই প্রথম উত্তেজিত হয়ে ফল কাটার ছুরি নিয়ে সুহীকে আক্রমণ করে। সুহী আত্মরক্ষা করতে গিয়েই শুধু পাল্টা আঘাত করেছে। এই ছিল সুহীর স্টেটমেন্ট।
মহুয়া বিস্ময়ের সঙ্গে সুহীর মিথ্যে ভাষ্য শুনছে, প্রতিটা নিউজ চ্যানেল দেখিয়েছে হোটেল ব্লুতে কী হয়েছিল। তবু কত সহজে সাহসের সঙ্গে বলছে মিথ্যেগুলো। ফিরোজকে পুলিশ যখন উদ্ধার করে তখন পুরো শরীর তার রক্তাক্ত ছুড়ির আঘাতে। মাথায়ও ছিল ভারী কিছুর আঘাত। আর এদিকে সুহী কত অক্ষত। তার এক বন্ধুসহ হোটেল থেকে চেক আউট করার সময় পুলিশের কাছে ধরা পড়েছে হাতেনাতে। এক ওয়েটার দেখেছে ফিরোজের ঘুমন্ত অবস্থায় মুখ চেপে ধরে আঘাত পর আঘাত করেছে দুজন। সেই পুলিশকে ইনফর্ম করেছে। তাছাড়া সিসি টিভির ফুটেজ কি মিথ্যে বলবে?
মহুয়া বুঝলো সুহীর মতো মেয়েরা স্বার্থের জন্য সব পারে, অথচ এককালে সুহী হয়ে জন্মাতে না পারার ব্যর্থতা তাকে কতটা পুড়িয়েছে। ফিরোজের স্বপ্নকন্যা সুহী, পাকা সফেদার মতো গায়ের রং তার। আর আজ মনে হচ্ছে কোনো পুড়ে যাওয়া প্রেতের চামড়া এর গায়ে। মহুয়ার কত আক্ষেপ ছিল তার সব কিছুর জন্য।
আফসোস সুযোগ ছিলো না তখন পাল্টে যাওয়ার।
এখনও যেমন সুযোগ নেই ফিরোজকে হাসপাতালের বিছানা থেকে উঠিয়ে এনে একটা সুস্থ সুন্দর জীবন দেওয়ার।
আচ্ছা হসপিটালের আইসিউইতে কি ভাবছে ফিরোজ। তার মাথায় কি আছে মহুয়ার স্মৃতি!
নাহ থাকা উচিত না। তারওতো দায় আছে ফিরোজের এ অবস্থার জন্য। মহুয়া কি আগেই শোনেনি এ অশনি সংকেত? ফিরোজকে কেন সে বাধা দেয়নি এই চোরা পথে এগুতে। একদিনের ঘটনা এখনো স্পষ্ট মনে আছে মহুয়ার। তখন ফিরোজের সঙ্গে সুহীর বিয়ের সব কিছু ঠিক হয়ে গিয়েছে, এমনকি কানডা থেকে দুজনের কাগজপত্রও চলে এসেছে। সে সময় একদিন ফিরোজ ছুটে এসেছিল টোলার বাগে মহুয়ার হোস্টেলে, মহুয়া তার বিধ্বস্ত রূপে চমকে যায়, প্রশ্ন করে জানতে পারে গত রাতে সুহীর এবি ফ্যাশনের ‘ফ্যাশন নাইট’ ছিল। শো শেষে হ্যাং-আউটে বন্ধুদের সঙ্গে কোথায় যেন চলে যায়। কাউকে জানায়নি। শুধু ফিরোজের বারবার ফোনে বিরক্ত হয়ে একটা টেক্সট দিয়েছে, লিসেন, ডোন্ট ট্রাই টু ইন্টারাপ্ট মাই প্রফেশনাল ইস্যু, নট মোর দেন।
ফিরোজ সেদিন প্রচণ্ড মন খারাপ করেছিল। মহুয়াকে বলেছিল, সুহী এমন কেন মহুয়া? ও কেন এতটা র্স্বাথপর! দুদিন পর আমাদের সংসার।
এই মেয়েটা কি কখনো আমার আপন হবে?
সুহী কি একাই এত আত্মপ্রিয় মানুষ নাকি সব মেয়ের ভেতরের রূপটাই এমন? তুমিও কি এমন হবে মহুয়া?
মহুয়া সেদিন উত্তর দেয়নি। সে চাইলে বলতে পারতো সে কখনো সুহীর মতো নয়, না শরীরে না মনে। তার দেখার, বোঝার, জানার পরিধি খুব ছোট আর্ট লিটারেচার আর কালচারের জগৎ তার কাছে মিথ্যা। পাবলো পিকাসো, রবীন্দ্রনাথ বা বিবি রাসেল কারও সঙ্গেই তার আত্মার সম্পর্ক নেই। সে বাঁচতে চায় সহজভাবে, সেখানে তার বর, ঘর আর হাফডজন বাচ্চা-কাচ্চা ছাড়া কোনো স্বপ্ন নেই। তার বাচ্চারা আর্ট বলতে শিখবে বাংলাদেশের খেলার দিনে রংতুলি দিয়ে গালে বাঘের ছবি আঁকা, সাহিত্য বলতে জানবে নিউমার্কেটের তেঁতুল তলার নিচে বিক্রি করা প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার ছবির কভার পেজের সস্তা প্রেমের উপন্যাস, আর সংস্কৃতি মানে শাবনূরের বাংলা সিনেমা। পারফেক্ট তথাকথিত অশিক্ষিত মায়ের অশিক্ষিত সন্তানসহ সংসার হবে তার। তার সঙ্গে কি সুহীদের মতো মেয়েদের তুলনা চলে? সুহী হাজার পুরুষের আরাধ্য বলেই একপুরুষের আরাধনা তার কাছে তুচ্ছ লাগে, সুহীকে তুষ্ট করার ক্ষমতা শুধু একা এই ফিরোজের হবে? এও সম্ভব? সুহীর ছোটবেলা থেকে রপ্ত করা অভ্যস্ততা বাধা দেবে না প্রতিমহূর্তে? হাজার চোখের মুগ্ধতা রেখে সুহী কি কখনো পারবে ফিরোজের বুকে মাথা রেখে উট পাখির মতো চোখ ঢাকতে?
মহুয়া সেদিন এর কিছুই বলেনি, এমনিতেই ফিরোজ অস্থির ছিলো সুহীকে নিয়ে এ প্রশ্নগুলো তুলে আর প্রয়োজন কি তাকে আরও অস্থির করার!
রাত প্রায় শেষের দিকে মহুয়া আর দীপ্র একই ভঙ্গিমায় বসে আছে অনেক্ষণ, ক্লান্ত দীপ্র ঝিমুচ্ছে, মহুয়া স্থির। একেবারে ভোরের দিকে হসপিটালের ওয়েটিংরুমে হঠাৎ করে কর্মতৎপরতা বেড়ে গেলো কেন মহুয়া বুঝতে পারে না, পুলিশ আর সাংবাদিকরা ইমারজেন্সির দিকেই ছুটছে। রিসিপশনের মেয়েটি এত ভিড়ের মধ্যেও মহুয়াকে এসে জানায় ম্যাম আপনি কি একবার ওপরে যাবেন? যদিও খুব ভিড় তবু যদি একবার দেখে আসতেন।
মহুয়া হতভম্ব হয়ে প্রশ্ন করে কী দেখব?
মেয়েটি জানায়, চব্বিশ ঘণ্টা সময় আর লাগছে না ম্যাম। নাশিদ নূর ফিরোজ নামের প্যাশেন্ট এই মাত্র মারা গেছেন।
সংবাদটা শুনে কিছুক্ষণ সময় মহুয়া যেন কই চলে যায়, চোখ বন্ধ হয় যায় তার। মস্তিষ্ক চলে যায় হাজার হাজার মাইল দূরে। গ্রহ নক্ষত্র পার হয়ে যায় সে। ছায়াপথে দেখে কত বড় কালো কালো গর্ত, কোনোটাকে মনে হচ্ছে ঢাকার পচা দুর্গন্ধওয়ালা ডাস্টবিন, বিশ্রি গন্ধ, না না ডাস্টবিন না। হয়তো ম্যানহোল। আবার মনে হচ্ছে মাতৃগর্ভের ট্রমা। কি সুন্দর কুসুম কুসুম গরম আরাম! নীহারিকা সপ্তর্ষী মণ্ডল পার হয় মহুয়া, কৃষ্ণগহ্বরও পার হয়। এরপর দেখে ঝকঝকে আলো চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়া আলো। আর সে আলোয় একটা মুখ স্পষ্ট হয়ে ওঠে খুব প্রিয় একটা মুখ, ফিরোজের মুখ, সুহীর সঙ্গে ঝকঝকে আলোয় ফিরোজ বসে ছিল, তাদের বিয়ের দিন ছিল। মহুয়া বিদায় নিয়ে চলে এসেছিল যখন, তখন কি ব্যাকুল হয়ে তাকিয়ে ছিল ফিরোজ মহুয়ার দিকে, উদ্ভ্রান্ত এক দৃষ্টি, মহুয়া বুঝেছিল কি খুঁজছে ফিরোজ। যে সত্যিটা সে অনেক আগেই জানে আজ থেকে ফিরোজেরও জানা হয়ে গেল। ফিরোজ সেদিন জেনেছিল মহুয়া তার কে হয়!
মহুয়া চোখ খোলে এবার। খুব স্বাভাবিকভাবেই মেয়েটিকে জানায় যে, সে আর ফিরোজের ক্ষতবিক্ষত মৃত শরীর দেখবে না।
দীপ্রর সঙ্গে পথে বের হয়েছে মহুয়া। ঘরে ফিরছে, তার বাসায় অপেক্ষারত শাশুড়ি, মইনুল, বুড়া আর গুড়া। তাদের জন্য খাবার বানাতে হবে, বুড়ার ক্লাসটেস্টের খাতা কিনতে হবে, বাসায় পানি খাওয়ার গ্লাস লাগবে।
রোদ উঠছে। সামনে হয়তো শীত আসার কথা। মহুয়া দৃষ্টি যায় রাস্তার পাশের একটা সৌখিন ব্যালকনিতে, টবে একটা গাছে কয়েকটা অলকানন্দা ফুটে আছে। সেখানে রাতের জমে থাকা শিশিরের ওপর সকালের রোদ পড়েছে, কি চমৎকার লাগছে দেখতে, নগরের বুকে বুনো সৌন্দর্য, সংসার বা ফিরোজের মৃত্যু রেখে অন্য একটা প্রশ্ন মহুয়াকে এই সাতসকালে অস্থির করে দিচ্ছে।
আচ্ছা অলকানন্দা ফুলের কি গন্ধ আছে? কেউ কি পেয়েছে কখনো অলকানন্দার ঘ্রাণ?
মন্তব্য