সেই সকাল সাড়ে নয়টা থেকে হেঁটে হেঁটে কোমর থেকে পায়ের আঙুলগুলো পর্যন্ত ব্যথায় টনটন করছে। ভাদুরে গরমে গায়ের তেলচিটচিটে নীলচে ব্লাউজটা ঘামে ভিজে আবার শরীরের তাপেই শুকোচ্ছে। কাঞ্চননগরের এক বাড়িতে দু গ্লাস পানি আর একটা নাড়ু খেয়েছিল, এছাড়া সন্ধে পর্যন্ত পেটে আর কিছুই যায়নি। কোথায় খুঁজতে বাকি রেখেছে, কালিকাপুর, উদয়পুর, পবহাটি, বড়াতলা, ভুটিয়ারগাতি- এমনকি ৮-৯ কিলো দূরে সেই গোয়ালপাড়া খোয়াড় পর্যন্ত। কোথাও পাঁটীদুটোর সন্ধান নেই। ওরা সবসময় একসঙ্গেই থাকে, দেখতেও একরকম। পুরো কালোর ভেতর ডান কানের পেছনে ঘাড় পর্যন্ত শাদা দাগ আছে দুটোরই। নানা কথা শুনে-মেলে লোকে খালি খালি সময় নষ্ট করে, পুরুষ লোকেরা ড্যাব ড্যাব চোখে শরীরের দিকে তাকিয়ে থেকে সায়রার সঙ্গে রসিকতা করারও সুযোগ খোঁজে, কী ছাগল, পাঁটী ধাড়ি না খাসি?
পাঁটী
তালি হয়তো পাঁঠার কাছেই গেছে। তুমি মনে হয় সুমায়মত নেওনি। একটাকা-দুটাকার আইসক্রিম বিক্রেতা খোঁচা খোঁচা দাড়িঅলা লোকটা দাঁত কেলিয়ে হাসতে হাসতে পাঁঠার দৃষ্টিতেই সায়রাকে দেখে।
নিবা নাকি এট্টা মালাই, শরীর-মন সবই ঠাণ্ডা হবে!
কিন্তু অচেনা পুরুষমানুষগুলোর বাজে রসিকতা পর্যন্তই; জোড়াপাঁটীর সন্ধান কেউ দিতে পারে না। কেবল কি মাইল কে মাইল হাঁটা? ভ্যান ভাড়া টেম্পু ভাড়াও গেছে ২৫-৩০ টাকা। পাঁটী ছাগল হলেও ওদের চেহারা খাসির মতো চকচকে। ওদের আল্লার নাম নিয়ে জবাই দিয়ে কসাইরা হয়তো খাসি পরিচয়েই মাংস বেচবে। গত পরশুই নাছির দালাল বাড়ির ওপর এসে দুটোর পাঁচ হাজার দাম করে গেছে। সায়রা জানে হাটে নিলে ছয় হাজার টাকার কম হবে না। অবশ্য খাসি হলে একজোড়ার দাম এর দ্বিগুণ হতো। আল্লার দুনিয়ায় মানুষের মতো ছাগলেরও একই কপাল, মেয়ে বলে পুরুষের মতো দাম নেই। তবু ছাগলের খোশনসিব, গায়ের রঙ শাদা বাদামি বা কালোর জন্য মেয়েমানুষের মতো তার দামে হেরফের হয় না। সায়রা বা তার বর খুব বেশি কালো না হলেও তাদের মেয়েটা হয়েছে কালো কয়লা। মেয়ের যদিও হরিণী চোখ টিকালো নাক; তবু সায়রা জানে এ মেয়ে পার করতে তাদের খবর আছে।
আজকাল একজন মুটেমজুর, রিকশাঅলাও কালোমেয়ে শুনলে নাক সিঁটকায়। সায়রা তাই এক বছর আগে থেকেই বদনা সাইজের একটা মাটির ব্যাংক কিনে মেয়ের জন্য পয়সা জমাতে শুরু করেছে। তার নয় বছরের মেয়ে তাহেরাও এখন দিনদুনিয়া বুঝতে শিখেছে, তাই নিজের হাতে দুটো-পাঁচটা টাকা জমলে সে লজেন্স-আইসক্রিম না খেয়ে বহুজাতিক কোম্পানির ফর্সা হওয়ার একপাতা ক্রিম কেনে।
তাহেরা আজ দুটো পান্তা মুখে দিয়ে সকাল থেকে টান পায়ে ছুটে চলেছে মায়ের সঙ্গে সঙ্গে। দুপুর গড়ানোর পর থেকেই সে বলে আসছে, মা, বাড়ি চল। ও ছাগল আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। এতক্ষণ ২-৩ হাত বদলায়ে কনে চলে গিয়েচে তার ঠিক আছে! মানষি জবই করে খেয়েও ফেলতি পারে। বাড়ি চল মা, খিদেয় আমার পেট ব্যতাচ্চে।
খিদের কথা বলায় মেয়েকে উল্টো বকাঝকা করেও সায়রা আঁচলের গিঁট খুলে দুটো টাকা মেয়ের হাতে দিয়েছিল ঝালমুড়ি কিনে খেতে।
মোট চারটে বাড়িতে ঠিকা ঝিয়ের কাজ সায়রার। বাড়িওয়ালারা এতক্ষণ তার কোন খোঁজখবর না পেয়ে নিশ্চয়ই গালিগালাজ জুড়ে দিয়েছে। কাজ না-থাকে না থাক, পরের মাসে নতুন বাসা ঠিক করে নেবে, দুতিন শ টাকা দিয়ে ভদ্দরলোকের বউয়েরা তো সব তার মাথা কিনে নেয় নি। এর চেয়ে কোনো অপিসে সুইপার-ঝাড়–দারের কাজ করাও ভাল। একবার গিয়েওছিল বিসিকের জুটমিলে চাকরি করতে। কিন্তু ম্যানেজার আর সুপারভাইজারগুলো হাড়ে হারামজাদা। দেখে দেখে কেবল ভরাট শরীরের কমরয়সী মেয়েমানুষকে কাজে নেয়। আর দুতিন দিন পর ভাব বুঝে শরীরে হাত দেয়ার সুযোগ খোঁজে। রাতে ওভার টাইমের সময় তো একজন করে মাগী থাকেই ম্যানেজারের রুমে। বিলম্ব হয়নি, চতুর্থ রাতেই সায়রার ডাক পড়েছিল ম্যানেজারের ওই প্রমোদালয়ে।
সে-সময় সে দেখতে পায় দুটো পাঁটীরই যোনীদ্বারের কাছটা রঙ বদলানো আর ফোলা ফোলা। সন্ধ্যায় ঘরে আনার সময় সায়রার চোখে পড়েনি। তার মনে আসে ওই বাড়িতে সে কী কী পড়ে থাকতে দেখেছিল। বিষয়ের রহস্য উদঘাটন করে সায়রা প্রবল ঘৃণায় কেবল অস্ফুট গলায় বলে, হায়রে আল্লার দুনিয়া। হায়রে পুরুষ মানুষ!
তুমার বেতন পাশ্শো টাকা বাড়ায়ে দেব, তুমি সপ্তায় একদিন আমার খালি ইট্টু খোঁজখবর নিবা। আমার বউ আবার ঢাকায়ই থাকে। আপাতত এই দুই শো এ্যাডভান্স রাখো। ম্যানেজার হাত ধরে ওর মুঠোর ভেতর চকচকে নোটটা গুঁজে দিতে চাইলে সেটা কুঁকড়ে যায়।
কী কন, বাড়তি টাকা নেব ক্যান?
না, তুমার ফিগারডা এখনো নায়িকা রেখার মতোন, খালি রোদি চামড়া ইট্টু পুড়ে গিয়েছে। টাকাডা দিয়ে কিছু সাবান-ছোনো কিনবা আর এট্টা দুডো আপেল কমলা কিনে খাবা।
ম্যানেজারের এগিয়ে আসার ধরন দেখে সায়রা দরজা খুলে দ্রুত বের হয়ে আসে, আর মিলে না ঢুকে সোজা বাড়ি। সায়রা জানে কাউকে কিছু বলে ফল নেই, মিলটা চেয়ারম্যানের, আর ম্যানেজার স্বয়ং মালিকের শালা। মিল চালানোর নামে বেজন্মা ব্যাটারা বেশ্যাখানা খুলে বসেছে, আর বাড়তি পাওনা পাচ্ছে শ্রমিক-ঠকানো মুনাফা। এসব চাকরির চেয়ে বাড়িতে ঝি-চাকরের কাজ করে, দুটো চারটে মুরগি-ছাগল পুষে খাওয়া ঢের ভালে।
যত কষ্টই হোক খুঁজে বের করবে, এত দামের একজোড়া ছাগল সে হেলায় হারাতে পারে না। বাচ্চাদুটো তারই হাতে বড়, ঠিকমতো দুধ ছাড়ার আগেই তাহেরার বাপ ওদের মাকে বেচে খেয়েছে। তারপর কাচের বোতলের মুখে রবারের বোট লাগিয়ে তার ভেতর গরুর দুধ ভরে কতদিন খাইয়েছে সায়রা। ওরা এখন কত বড়, স্তনের বাটও বড় হয়েছে, কদিন পরই ডাকবে, তখন কুড়ি-কুড়ি চল্লিশ টাকা দিয়ে ওদের গাছা দিয়ে আনতে হবে।
চলতে চলতে ক্লান্ত উপবাসী সায়রা তলপেটে ব্যথা অনুভব করে। না খেয়ে তো সে প্রায়ই থাকে, সেই পরিচিত ব্যথাটা তো ওপর দিকে বাম পাশে করে। এবার মনে পড়ে, সে ভুলেই গিয়েছিল সদর হাসপাতালে তার জরায়ুর অপারেশন হয়েছে বছরও হয়নি। ভারী কাজ, বেশি হাঁটাহাঁটি তার নিষেধ। কিন্তু সে বসে থাকলে ছাগল খুঁজে এনে দেবে কে? ঘরের পুরুষ মানুষ বলতে তাহেরার বাপ সেই সকালেই কাজে বেরিয়েছে, কোন পাড়ায় তা জানার উপায় নেই; আর ছেলের বয়স তো ছয়ও হয়নি। পশ্চিম আকাশ লালচে হয়ে উঠেছে, মাগরিবের আজান হতে আর বাকি নেই। ধান ক্ষেতের আইল ধরে উস্কোখুস্কো চেহারায় মা-মেয়ে শেষে বাড়ির দিকেই এগুচ্ছিল। কোমরের নিচ থেকে সায়রার শরীরে যেন কোনো শক্তি নেই। তার মনে হচ্ছিল আইলের ওপর পা মেলে বসে খানিক শব্দ করে কেঁদে নেবে। তবে তার পরিবর্তে বিড়বিড় করে সে সম্ভাব্য চোরদের অভিশাপ দিতে থাকে, বেজন্মা নটীর ছেলেগের উচিত শাস্তিই যেন আল্লাহ দেয়, আমার ছাগল বেচা পয়সা যার পেটে যাবে সে যেন গলা দিয়ে রক্ত উঠে মরে!
সে-সময় তাহেরা বলে ওঠে, মা এই রাস্তা দিয়ে আলি ক্যা। পাকা রাস্তা ধরে ভ্যানে চড়ে আসতাম। পা দুডো ব্যতা বিষ।
জবাবে সায়রা চেঁচিয়ে ওঠে, তোর বাপ তো আমার আঁচল ভর্তি টাকা দিয়ে দিয়েচে যে তুমার আমি চ্যানাচুর ভাজা খাওয়াব আর গাড়িতি ঘুরয়ে নিয়ে বেড়াব।
মা এট্টা ছাগলের ডাক শুনলে? তাহেরার চোখ চিকমিক করে ওঠে।
কই? সায়রার বুক ধকধক করে।
ইট্টু খিয়াল করো, ওই যে আবার ডাকালো, এ মা আমাগেরই তো পাঁটীর ডাক মনে হচ্চে।
কোনদিকতে আসছেরে মনি ডাকটা? সায়রার সারাদিনের অবসন্নতা যেন নিমেষেই দূর হয়ে যায়। বুকের ধুকপুকানি আরও বাড়ে।
মাঠের ওই পারে নতুন বাড়িডার কাচতে মনে হয়, তাড়াতাড়ি চলো দিনি।
ঘাসের ভেতর পা ডুবিয়ে ভাদরের পুরনো কাদা মাড়িয়ে ছাগলদুটোর শ্রুতিমধুর ডাক শুনে শুনে এগিয়ে যেতে যেতে সায়রা বলে, দুপোর বেলায়ই তো এদিক দিয়ে গেলাম, কই তখন তো ডাকটাক কিছু শুনলাম না। তার মনে হয় মুহূর্তেই কিভাবে ছুটে যাবে ওদের কাছে। বড় বড় ঘাস মাড়িয়ে মেয়ের হাত ধরে এগিয়ে যেতে যেতে সায়রা প্রাণভরে পাঁটীদুটোর ডাক শোনে। তাহেরা বলে ওঠে, মা, আমার মনে হয় আমাগের গলা শুনে ওরা বুছতি পেরেছে, তাই ডাকচে। সায়রা মনে মনে কথাটায় সায় দেয় এবং বলে, আহা সুনারা আমার, সারাদিন মনে হয় দানাপানি পেটে পড়িনি।
মাঠ পেরিয়ে পৌরসভার পাকা রাস্তা থেকে হাত পঞ্চাশেক দূরে একটা নতুন একতলা বাড়ি করছে কারা যেন। ছাদ তোলা হলেও জানালা-দরজা কিছু হয়নি। সায়রা প্রায় নিশ্চিত হয় ডাকটা ওর ভিতর থেকেই আসছে এবং ওদুটো অবলা প্রাণীর মালিক সে-ই। এর মধ্যে মসজিদ থেকে মাগরিবের আজান শোনা গেলে পশুদুটোর আর্তনাদ আরও বেড়ে যায়। ঘরের ভেতর ঢুকে প্রস্রাবের তীব্র গন্ধ পায় ওরা, বোধ হয় শুকনো মলও আছে এদিকে। বাড়ির মালিক না আসায় গত তিনচার মাসে এখানে ফেন্সিডিল, হেরোইনখোরদের আস্তানা হয়েছে। ওরাই আবার সরকারি দলের ভাড়াটে চেলা বলে কেউ কিছু বলতে আসে না। এই ফেলে রাখা বাড়িতেই তো মাস তিনেক আগে ঘটেছিল সেই পাঞ্জা কাটার ঘটনা। কোন একটা মেয়েকে নিয়ে কলেজেপড়া দুটো ছেলের মধ্যে রেষারেষি হয়। শেষে একজন অন্যজনকে এখানে ডেকে এনে দুই হাতের পাঞ্জা কেটে দেয়। অনেক লোকে এই বাড়িতে পড়েথাকা পাঞ্জাজোড়া দেখতে আসে। সায়রা তখন অবশ্য আসেনি, তবে নিজে চোখে দেখেছিল পুলিশ পলিথেনের ভেতর পুরে মানুষের দুটো তরুণ রক্তাক্ত কাটা পাঞ্জা নিয়ে যাচ্ছে।
ছোটছোট শেয়ালকাঁটা আর ঘাস গজিয়ে ওঠা ঘরের ভেতর আবছা আলোয় সায়রা কিছু কাঁচের বোতল, সিগারেটের পাছা, আর ঘন ঘোলাটে তরলভর্তি ব্যবহৃত বেলুন দেখতে পায়। দেখ মা দুডো বেলুন, বলে তাহেরা ব্যবহৃত গোলাপি রঙের কনডমদুটো বিশেষ উৎসাহে খুঁটে তুলতে যায়। সায়রা ওর হাত টেনে ধরে, ছি ওতা ধরতি হয় না! এমনিতেই খালি পেট, ভেতর থেকে ‘ওয়াক’ আসে সায়রার।
ক্যান মা?
কলাম ধত্তি হয় না। আগে তুই চল ছাগল কনে আছে তাই দেখি। সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে দ্বিতীয় ঘরটাতে তারা গাছের ডালের ভেতর থেকে কালো পশুদুটোর অস্থিরতা দেখতে পায়, সায়রাকে দেখে ধরনটা বদলে ওরা হ্রস্ব স্বরে আরও ঘন ঘন ডাকতে থাকে। ঘরের অর্ধেকটা জায়গা গাছের কাচা ডালপাতায় ভর্তি। জানালার ফাঁকা জায়গাগুলোতে এমপির জনসভায় ও মিছিলে ব্যবহৃত একটি হলুদ অন্যটি শাদা রঙের পরিত্যক্ত ব্যানার টাঙানো। তাতে একজন দেশবরেণ্য নেতার উল্টো হয়ে থাকা ছবিও শোভা পাচ্ছে। বিষয়টা তাহেরার চোখও এড়ায় না। সে বলে, মা এখেনে মনে হয় পাটির মস্তানরা থাকে, ওই দেখ ওই কাপুড়ি এট্টায় কি বিরাট জনসভা আর এট্টায় দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ লেখা, তুই তো আবার কিছুই পড়তি পারিস নে। সায়রা খেপে গিয়ে বলে, আমার ওসব পড়ার দরকার নেই, ওই হাভাতেরাই তো শেষ করলো দেশটা।
তার বুঝতে বাকি থাকে না যারা চুরি করেছে ছাগলদুটোকে শান্ত রাখার জন্য তারা টাটকা পাতাসহ এতগুলো ডাল রেখে গেছে, এজন্যই দুপুরবেলা এপথে গেলেও সায়রা আর তাহেরা কোনে আওয়াজ পায়নি। ভাগ্যিস তাহেরা এখন টের পেয়েছিল, না-হলে কি আর কাল সকাল পর্যন্ত ওদের এখানে পাওয়া যেত, শয়তানগুলো নিশ্চয়ই খদ্দেরের সন্ধানে আছে, আর একটু অন্ধকার হলেই পাচার করে দিতো।
দুটো ডাল সরিয়ে সায়রা দড়ির বাঁধন থেকে ওদের মুক্ত করে। হাতে দুটো-তিনটে কাঁটা ফুটে যাওয়ায় বুঝতে পারে দ্বিতীয় ডালটা ছিল বরই গাছের। তাহেরার বাপ রাজমিস্ত্রির যোগালের কাজ করতে সকালেই বেরিয়ে যায়, সায়রা ভাবে সে কিছু জানার আগেই ছাগলদুটো খুঁজে পাওয়া গেল, বহুত শুকরিয়া আল্লার। না হলে ছাগল তো যেতোই, সঙ্গে জুটত স্বামীর হাতের লাঠি-ঠ্যাঙানি। অথচ ছাগলের মালিক কেবল সায়রাই।
সায়রা কেবল স্বপ্নে অদ্ভুত ওই শিশুদের দেখে না, বাস্তবে পশুদের দিকে তাকালে অর্ধেক মানুষের ছবি দেখতে পায়, আবার অনেক মানুষের চেহারায় চোখ রেখে সে কখনো পাঁঠা কখনো শূকর কখনো বা কুকুর দেখে।
রাতে ঘুমতে যাওয়ার আগে সায়রা কেরোসিনের কুপি নিয়ে টিনের চালের নিচে বারান্দায় বাঁশের মাচার তলায় ছাগলজোড়া একবার দেখতে যায়। ওরা বোধহয় হারিয়ে গিয়ে ভয় পেয়েছে। এখনো কেমন ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে ডাকছে। যেন কোনো কিছু নালিশ করতে চাইছে ওদের মালিকের কাছে। সায়রা একটু ভালো করেই খেয়াল করে ওদের। সে-সময় সে দেখতে পায় দুটো পাঁটীরই যোনীদ্বারের কাছটা রঙ বদলানো আর ফোলা ফোলা। সন্ধ্যায় ঘরে আনার সময় সায়রার চোখে পড়েনি। তার মনে আসে ওই বাড়িতে সে কী কী পড়ে থাকতে দেখেছিল। বিষয়ের রহস্য উদঘাটন করে সায়রা প্রবল ঘৃণায় কেবল অস্ফুট গলায় বলে, হায়রে আল্লার দুনিয়া। হায়রে পুরুষ মানুষ! ওরা পাটী দুটোর ওপর কেবল যে মাংস-চর্মের বিশেষ অঙ্গ প্রয়োগ করেছে তা-ই নয়, হয়তো লাঠিকাঠি ঢুকিয়ে অবলা অঙ্গের গভীরতা পরীক্ষা করেছে, এজন্যই কালচে প্রত্যঙ্গের বাইরের দিকটাও কেমন লাল হয়ে আছে। অবলা জীবদুটোকে আটকে রাখতে পারলে এমন পরীক্ষা কি আরও চালিয়ে যেতো ওই আদমসন্তানেরা, ভাবে সায়রা।
কালো রঙের দুটি পশুর যোনীতে ক্ষতচিহ্ন দেখে নারী হওয়ায় এপর্যন্ত সায়রা যে-টুকু যতবার পুরুষের অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শের বা পেষণের বা লালসার শিকার হয়েছে তার কিছু স্মৃতিচিত্রের দুর্গন্ধ কেন যেন দ্রুত খেলে যায় তার মাথার ভেতর। সায়রার আরও মনে পড়ে তার বাপের বাড়ির গ্রামে একজনের নাম ছিল ‘ছাগল-ঠাপানো’ ইউসুফ। পরে সরকারি দলে যোগ দিয়ে টাকা ছড়িয়ে আর আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টি কাজে লাগিয়ে ইউসুফ ইউনিয়ন পরিষদের কমিশনার হয়েছিল। এখন সায়রার কাছে ইউসুফের ও-রকম নামকরণের কারণ নতুন করে আরও স্পষ্ট হয়, সে আখ বা পাটক্ষেতে সুযোগ পেলেই ছাগলের ভেতর নিজের অঙ্গ পরিচালনা করতো। এভাবে দুবার নাকি ধরাও পড়েছিল। মওলানা-মোড়ল-পার্টি নেতার সালিশে ঠিক হয় সে মসজিদে গিয়ে তওবা করবে আর মসজিদ ফান্ডে ৫০০০ টাকা দান করবে। এখনকার ছেলেপেলে অবশ্য ইউসুফের সে নাম বা কীর্তি জানে না। সদরে বড় রাস্তার ধারে ধবধবে শাদা চার তলা বাড়ির মালিক সেই উইসুফের নাম এখন হয়েছে ডবল হাজী মেম্বর, উইসুফ এর মধ্যে দু-দুবার মক্কাশরিফ ঘুরে এসেছে। এখন আর ছাগলের প্রয়োজন হয়তো ইউসুফের হয় না। একটি প্রধান দলের থানা সেক্রেটারি পদ লাভ করে ক্ষমতা বাড়ায় বরং মেয়েমানুষ আগের চেয়ে সহজলভ্য এখন।
ইউসুফের কাছে হয়তো সরাসরি না শিখলেও এই নতুন কালের ছেলেরা কিভাবে কাজটা বুঝে নিলো ভেবে অবাক হয় সায়রা। সে আরও ভাবে, কেবল তাহেরাকে নয়, এখন থেকে পাটি দুটোকেও সামলে রাখতে হবে। বালিকা বয়সে কার কাছে যেন সায়রা শুনেছিল কোনো এক গ্রামে ছাগলের পেটে অনেকটা মানুষের চেহাররা বাচ্চা হয়েছিল। সে আগে বুঝলে দেখতে যেতো সেই গ্রামে। তবে সে মনে মনে কল্পনা করতে পারে মানুষের হাতপা আর ছাগলের মুখের একটা সদ্যোজাত শিশুর চেহারা।
পাটকাঠির বেড়ার ওপারে তাহেরা তার ছয় বছরের ভাইটিকে কোলের ভেতর নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে নিশ্চিত হলে বিড়ির শেষাংশে একটা লম্বা টান দিয়ে ছুড়ে ফেলে মকবুল। তারপর ঘুমন্তপ্রায় সায়রার কাঁধের কাছটা ধরে ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিতে গিয়ে টের পায় আজ বউ শরীরটা আড়ষ্ট করে রেখেছে, এ আড়ষ্টতা কেবল ঘুমের নয়। তখন অর্ধঘুমে সায়রা কোত্থেকে যেন তীব্র কামকাতর আদিম এক পাঁঠার গন্ধ পাচ্ছিল, পাঁঠাটা তার কাঁধে নাক ঘষছিল। কিংবা ঘুমটা হয়তো সত্যিই গভীর ছিল, ঘুমের ভেতর সে দেখতে পাচ্ছিল যেন কোনো অচেনা সময়ে এক রৌদ্রোজ্জ্বল হ্রদের ধারে কতকগুলো উন্মত্ত বুনো প্রবল রোমশ পুরুষ ছাগল এগিয়ে আসছে সদ্যস্নাতা কতিপয় নগ্ন নারীর দিকে।
এরপর কয়েক রাত সায়রা ছাগল সংক্রান্ত বিচিত্র সব স্বপ্ন দেখতো। তার পাঁটী হারিয়ে গিয়েছে। তাদের খুঁজতে খুঁজতে রাত হয়ে আসে, সায়রা ঢুকে পড়েছে এক অন্ধকার গলিতে, কতকগুলো বীভৎস্য পুরুষ একা পেয়ে তার দিকে তেড়ে আসছে। সে রাতে প্রচণ্ড বুক ধড়ফড়ানি নিয়ে জেগে ওঠে সায়রা, তারপর সারারাত আর ঘুমতে পারে না। আবার অন্য এক রাতে হয়তো স্বপ্নগুলো আরও অদ্ভুত রূপ নিয়ে আসে। সে দেখতে পায় অজস্র শিশু বিচিত্র কোলাহল করছে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো এক-দেড় বছরের শিশু গুলো অর্ধেক মানব অর্ধেক ছাগরূপী। এর মধ্যে তিনটে ছানা মানব ও ছাগের মিশ্র কণ্ঠে ‘ম্যাঁ ম্যাঁ’ ডেকে সারয়ার দিকে ছুটে এসে শাড়ির আঁচল সরিয়ে স্তনবৃন্ত খুঁজছে।
এরপর আরও আরও দিন কেটে যায়, পেরিয়ে যায় কালো শামুকের মতো সারি সারি রাত। সায়রা কেবল স্বপ্নে অদ্ভুত ওই শিশুদের দেখে না, বাস্তবে পশুদের দিকে তাকালে অর্ধেক মানুষের ছবি দেখতে পায়, আবার অনেক মানুষের চেহারায় চোখ রেখে সে কখনো পাঁঠা কখনো শূকর কখনো বা কুকুর দেখে। অবশ্য সে-সব মানুষকে লোকে জননেতা, মিল-মালিক, ঠিকাদার, ধর্মগুরু, আড়তদার কিংবা ছাত্র, মাস্টার, ড্রাইভার, হাবিলদার, তহসিলদার, দোকানদার, চৌকিদার প্রভৃতি রূপেই চেনে।