ইংরেজিতে আপনারা বলেন ‘জার্নালিস্ট’। বাংলায় সাংবাদিকও বলেন কেউ কেউ। কিংবা কখনো কখনো টিটকারি করে বলেন ‘সাংঘাতিক’। সাংবাদিকদের ব্যাপক প্রভাব ও ক্ষমতা—তা আপনারা মনে করেন। আদতে তা মনে হয় সত্য নয়। কেন সত্য নয়—তা ইবনে মোস্তাকের জীবনে চোখ বোলালেই বুঝতে পারবো। তবে অনেকে কিন্তু সাংবাদিক পরিচয়ে ব্যাপক মাত্রায় প্রভাব খাটান। তাও ভুল নয়।
ইবনে মোস্তাক অত্যন্ত সাধারণ সাংবাদিক। তিনি সাব-এডিটর। এই পদকে অনেকে আবার ‘সাংবাদিক’ মনে করে না। ইদানীং তো টিভিতে নিউজ প্রেজান্টারকেই সবচেয়ে বড় সাংবাদিক মনে করে অনেকে। তবে এও ঠিক, অনেক সাংবাদিকও টিভিতে নিউজ প্রেজেন্টার হন। তাদের কথা বলে নিলাম, তা না হলে তো তারা আবার ক্ষুব্ধ হয়ে উঠবেন। সাংবাদিকদের যে বেজায় ক্ষমতা ও প্রভাব—তা প্রদর্শনও করে ফেলবেন কেউ কেউ। যা দিনকাল পড়েছে, গল্পকে তো আর কেউ গল্প ভাবেন না। পছন্দ না হলেই তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন। যেন সবার সব কিছু পছন্দমতোই হতে হবে।
সত্যি কথা বলতে কী, আমার নামই ইবনে মোস্তাক। বয়স ৫২। গল্পটা ঠিক কোন জায়গা থেকে শুরু করবো, সেটা নিয়ে মুশকিলে ছিলাম। পরে ভাবলাম, যুবক কাল থেকে গল্পটা শুরু করা যেতে পারে।
যেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক শেষ করলাম, সেদিনই বাবা ইসহাক মোস্তাক ইন্তেকাল করেন। ভাগ্যের কী লীলাখেলা! ঢাকায় সে খবর এসে পৌঁছালো তিন-চারদিন পর। তখন তো হাতে হাতে মোবাইলফোন নেই, ইন্টারনেট নেই—এমনকী ঘরে ঘরে ল্যান্ডফোনও নেই। যেহেতু আমি হতদরিদ্র এক পরিবারের সন্তান, যেহেতু ঢাকায় দরিদ্ররা আগাছার মতো চলে; সেহেতু আগাছাদের কাছে সংবাদ পৌঁছায় অনেক দেরিতে। তাই বাবার মৃত্যুর পরদিন বাড়ির পাশের এক দোকানদারকে ঢাকায় পাঠানো হয় সংবাদটি আমাকে পৌঁছে দিতে।
চিঠি দেওয়া যেতো। কিন্তু এই চিঠি পৌঁছাতে অনেক দেরি হবে বলে মা সিদ্ধান্ত নেন দোকানদার সোহেলকে পাঠানোর। তিনি চেয়েছিলেন—ছেলে যেন দ্রুত বাড়ি যায়। জানাজা তো পাবে না, তবে মা এই নিঃস্ব সময়ে হয়তো আমাকে কাছে চেয়েছিলেন।
দোকানদার সোহেল শুধু জানতো আমি ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ি। এর বেশি তার কিছুই জানা নেই।
এবার বলুন, এভাবে কাউকে খুঁজে পাওয়ার কথা?
তবু তিন দিন পর ঠিক ঠিক মধুর ক্যান্টিনে যখন চা খাচ্ছিলাম, যখন ভাবছিলাম সামনে মাস্টার্স করবো—রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গবেষণা করবো, ভাষাচর্চা নিয়ে গবেষণা করবো—তারপর শিক্ষকতা পেশায় যাওয়ার চেষ্টা করবো—ঠিক তখনই সোহেল ঘাড়ে হাত রাখে।
চমকে উঠে জিজ্ঞেস করি—আরে সোহেল ভাই, আফনে এহানে?
সোহেল ভাইয়ের ছলছল চোখ প্রশ্নের উত্তরটা যেন দিয়ে দিচ্ছিল। তবে নিশ্চিত ছিলাম না—কে গেলেন? মা না কি বাবা?
লড়াইটা আমার এখান থেকেই শুরু। আমি মা-বাবা বড় সন্তান। আছে আরও দুই ভাই, দুই বোন। এই যে বিশাল এক সমুদ্র সামনে—এই নিয়ে ভাবনার শুরু বাবার কবরের সামনে দাঁড়ানোর পর থেকেই। এতদিন শহরে সংগ্রাম করলেও পরিবার নিয়ে কোনো ভাবনা ছিল না। ‘বাবা তো আছে’—এই যে বটগাছের ছায়াবাক্য—এ নিয়েই ছিলাম নিশ্চিন্ত। এখন বটগাছটা পড়ে গেলো। ছায়া নেই। চারিদিকে রুক্ষ এক প্রকৃতি। পায়ের নিচে মাটি যেন শুকিয়ে কাঠ। যেন মরুভূমির বালুময় অজানা পথে হাঁটতে হবে দীর্ঘসময়।
নিস্তার পাওয়ার জন্য রবীন্দ্রগবেষণা আর মাস্টার্সের চিন্তাটা ছেড়ে দিতে হলো। সন্ধান করতে হলো অর্থের। যে সমুদ্র কিংবা মরুভূমির বালুময় পথ পাড়ি দিতে হবে, তা অর্থের বাহন ছাড়া তো সম্ভব নয়।
আর তাই একদিন পৌঁছে গেলাম প্যাশন নোট বুকস্ নামে একটা প্রকাশনী সংস্থায়। প্রধান কাজ প্রুফ দেখা। বিশিষ্ট নোটবুক লেখকরা যেসব লেখা পাঠান, সেগুলোর প্রুফ দেখে লেখকের সঙ্গে কথা বলে সব ঠিকঠাক করে নেওয়াই হলো মূল কাজ। বেতন সেকালে বেশি ছিল না। এক হাজার টাকা। কখনো কখনো কাজ বেশি হলে প্রকাশক খুশি হয়ে দু’শ তিন শ’ বাড়িয়ে দিতেন। শুধু যে ওই প্রকাশনী সংস্থাতেই কাজ করতাম তা কিন্তু নয়। দৈনিক পত্রিকায় প্রদায়ক হিসেবেও কাজ করেছি। এ কাজটা অবশ্য ছাত্র থাকাবস্থায়ই শুরু।
এই টানাটানি তো একদিন শেষ হবেই হবে। ছেলে নিশ্চয়ই একদিন বাপ-দাদার জমি ফেরত নেবে। ছেলে তো শিক্ষিত। ‘পড়াশোনা করে যে, গাড়িঘোড়ায় চড়ে সে’— কে না জানে এই কথা!
এভাবে এক বছর কোথা দিয়ে চলে গেলো টেরই পেলাম না। তারপর মনে হলো এই টাকায় তো জীবন চলবে না, আরও ভালো কাজ জোগাড় করতে হবে। যে পত্রিকায় প্রদায়ক ছিলাম, সে পত্রিকার একজন বিভাগীয় সম্পাদকের কাছে নিয়মিত চাকরি চাওয়া শুরু করলাম।
আমি যে মহা কাজের সেটা বোঝাতে সক্ষমও হই। চুক্তিভিত্তিক চাকরি পেলাম। পদটা ছিল ট্রেইনি সাব-এডিটর।
কী আশ্চর্য! স্নাতক শেষ করে এক বছর প্রুফের অভিজ্ঞতা থাকার পরও হতে হয়েছিল শিক্ষনবিশ। বিধাতার দেওয়া এই করুণ ভাগ্য মেনে নেওয়া ছাড়া তো উপায় নেই। কারণ সারাক্ষণ মাথায় চিন্তা—‘ঘরে মা, দুই ভাই, দুই বোন’।
চাকরি পেয়ে সারেনি। একদিন হাতে গ্রাম থেকে চিঠি এলো। ছোট ভাই মকবুল লিখেছে। বোনের বিয়ের সব ঠিক-ঠাক করেছেন মা। এই মুহূর্তে অর্থের প্রয়োজন।
আমার তো মাথায় হাত। বিয়ে মানে তো চাট্টিখানি কথা নয়! অনেক টাকার মামলা! কথা নেই, বার্তা নেই হুট করে বিয়ে ঠিক করার বিষয়টা একদমই ভালো লাগেনি। তবু, যেহেতু বিয়ে ঠিকঠাক, তাই আর কিছু করারও নেই। টাকা তো লাগবেই।
এই অবাঞ্চিত শহরে আমি নিজেই প্রায় অবাঞ্চিত। তাই রওনা দিলাম গ্রামে। বাপ-দাদার জমির কিছু অংশ বিক্রি করে বিয়ের আয়োজন সম্পন্ন করলাম। মাকে বলে এলাম, সময় হলে আবার এগুলো কিনবো মা, তুমি মন খারাপ করো না।
মা এই আশ্বাসেই খুশি। একদিন তো ভাগ্য ফিরবেই। এই টানাটানি তো একদিন শেষ হবেই হবে। ছেলে নিশ্চয়ই একদিন বাপ-দাদার জমি ফেরত নেবে। ছেলে তো শিক্ষিত। ‘পড়াশোনা করে যে, গাড়িঘোড়ায় চড়ে সে’— কে না জানে এই কথা!
যাই হোক। শহরে চাকরি চলছিল ভালোই। কিন্তু একদিন এক মর্মান্তিক অধ্যায়ের দেখা পেলাম। পত্রিকায় অফিসে হঠাৎ একদিন পুলিশ চলে এলো।
কেন এলো?
কোনো এক নিউজের জন্য নাকি প্রভাবশালী এক নেতার ইজ্জত চলে গেছে। সেই প্রভাবশালী নেতা মামলা ঠুকে দিয়েছেন সম্পাদকের বিরুদ্ধে। আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করে ফেলেছেন।
ভাবছিলাম, আরে সম্পাদক কি আর এত ঠুনকো মানুষ? এত সহজে তাকে ধরে নিয়ে যাবে নাকি?
এটা ভেবে পুলিশ-টুলিশে খুব একটা পাত্তা দেইনি। কিছুক্ষণ পর দেখা গেলো পুলিশের সঙ্গে সম্পাদক বের হয়ে গেলেন। বিষয়টা হয়তো সুরাহা হবে, এটা ভেবেছিল সবাই। কিন্তু বিপত্তি হলো পরের দিন। হাউজে একজন নতুন সম্পাদকের আগমন হলো।
এই পত্রিকা অফিসে ছিল তিন গ্রুপ। আকবর গ্রুপ, মান্নান গ্রুপ ও নোমান গ্রুপ। সৈয়দ আকবর ছিলেন সম্পাদক। তার সম্পাদক থাকাবস্থায় সরকার দলীয় একজন নেতার বিরুদ্ধে নিউজ গেলো! এত বড় আস্পর্ধা! এটা তো মানা যায় না। জেল-জুলুম থেকে তার রক্ষা হলেও প্রকাশক তাকে আর সম্পাদক রাখেননি। সেদিন রাতেই বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠিয়ে দেওয়া হলো আকবর সাহেবকে।
সারারাতই চললো সম্পাদক হওয়ার লড়াই। টিকে থাকা দুই গ্রুপের কে হবেন সম্পাদক? মান্নান সাহেব ও নোমান সাহেব কয়েক বছর থেকেই সোচ্চার ছিলেন সম্পাদক হওয়ার দৌড়ে। অফিসের এই রাজনীতিটা বড়ই কৌতুকপূর্ণ ছিল।
মান্নান সাহেব ও নোমান সাহেব দুজনই ছিলেন যুগ্ম সম্পাদক। দুজনের সঙ্গে সম্পাদক আকবর সাহেবের চমৎকার সম্পর্ক। এই চেহারাটা হলো বাইরে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তিন জনের কেউই কাউকে পছন্দ করতেন না। যেমন, সম্পাদক কোনো সিদ্ধান্ত দিলেন, দুজনই বলে উঠবেন, আরে চমৎকার সিদ্ধান্ত ভাই। আপনি বলেই এমন একটা সিদ্ধান্ত নিলেন। বাহ বাহ বাহ!
কিন্তু পরক্ষণেই দেখা যেতে সম্পাদকের অনুপস্থিতিতে বলে উঠলো, শালার পাগল ছাগল সম্পাদক হলে যা হয় আর কী! বালের একটা সিদ্ধান্ত নিছে। অফিসের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে।
দুই জনই মনে করতেন, সম্পাদক অফিসের বারোটা বাজাচ্ছেন। আবার মান্নান সাহেব ও নোমান সাহেব দুই জনই আলাদাভাবে সম্পাদককে দুজনের নামে নানান অভিযোগ হাজির করতেন। কী আজব এক দুনিয়া!
এগুলো নিয়ে অফিসে ব্যাপক হাসাহাসি হতো। অনেকে বলতেন, অফিসটা শেষ করে দিল মান্নান আর নোমান মিলে। অনেকে প্রশ্নও করতো, এগুলো কি আকবর ভাই জানেন না?
কেউ কেউ বলতো, উনি সবই জানেন। তবু কেন যে কিছু বলেন না, খোদাই মালুম।
তো, যখন আকবর সাহেব প্যাঁচে পড়ে বিদায় হলেন। তারপর সারা রাতের প্রতিযোগিতা-তদবিরে শেষ পর্যন্ত আহমদ মান্নান জয়ী হলেন। প্রকাশককে এই যুগ্ম সম্পাদক আশ্বস্ত করেছেন, তিনিই হলেন আসল মাঝি। সকালে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক কদম রাখলেন অফিসে। দুপুরে যখন অফিসে ঢুকলাম, জানতে পারলাম—চাকরি নেই!
কী আমার অপরাধ?
যখন সিংহরা বনে-জঙ্গলে লড়াই করে তখন আশেপাশে তাদের পায়ে পিষ্ট হয়ে কিছু পোকা-মাকড়েরও তো মৃত্যু ঘটে। তো, সেই পোকা-মাকড়ের মধ্যে আমিও পড়ে গেলাম।
যে বড় ভাই মঞ্জু হক চাকরি দিয়েছিল, সেই মঞ্জু ভাই ছিলেন সাবেক সম্পাদকের দলের লোক। অতএব, দল করি কিংবা না করি—আমি তো সম্পাদকেরই লোক হলাম। তাই না?
বিস্মিত হয়ে বুঝে পাই না—এটা কি আমার অপরাধ? বেশ কয়েকবার নতুন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করার আর্জি করলেও পাত্তা পাইনি। মাসের তখন ২৯ তারিখ। অবশেষে মঞ্জু ভাইয়ের বাসায় গেলাম।
—ভাই, আপনাদের গণ্ডগোলের মধ্যে আমি পড়ে গেলাম। আমার কী দোষ? একটু যদি মান্নান ভাইকে আপনি অনুরোধ করতেন।
কথা শুনে মঞ্জু ভাইয়ের মাথায় রক্ত উঠে গেলো। বললেন, ‘চুতমারানি কোথাকার। আমার চাকরি গেলো গা, আর তুই আছস তোর ধান্দা লইয়া। যা এখান থেকে।’
চাকরি করতে গিয়ে মঞ্জু ভাইয়ের কাছে গালি তো কম শুনিনি। তবু এক ধরনের স্নেহ ছিল। গালিকে স্নেহ হিসেবেই নিয়েছিলাম। চাকরি হারিয়ে এক অনিশ্চিত বিষাদে জীবনে আরেকবার হোঁচট খেয়ে ভেবে পাই না—আমার কী করা উচিত!
সপ্তাহখানেক বাদে নতুন কাজের আশায় আবার পত্রিকা অফিসে ঘুরে ঘুরে হয়রান। এভাবে চলে গেলো কয়েকটা দিন। আগের অফিসের পাওনা বেতনও নাকি দেবে না। এ নিয়ে সম্পাদককে চিঠিও দিয়েছি। লাভ হবে না জানি, তবু দিয়েছি।
সেখানে একজন রিপোর্টার ছিলেন। নাম খন্দকার সায়েম। ক্রাইম রিপোর্টার। আমার সমবয়সী হবেন। তিনি একদিন পত্রিকা অফিসের সামনে বলেছিলেন, ‘আমিও খুঁজবো আপনার জন্য চাকরি।’
তার অপলক দৃষ্টিটার কথা এখনো মনে পড়ে। তখন অঝোরে কাঁদতে ইচ্ছে হয়। বুকচাপা বেদনা হয় বোনদের জন্য। কিছুই করা হলো না।
কেন বলেছিলেন? জানা নেই। সেদিন সায়েম আরেকটা কথাও বলেছিলেন। বলেছিলেন, ‘মোস্তাক ভাই, এই দেশে সাংবাদিকরাই সাংবাদিকদের শত্রু। আপনাদের বেতন হবে না—এ কথা সম্পাদক মিটিংয়েই বলেছেন। অনেকেই তাকে সমর্থন দিয়েছেন। যেন খুব খুশির একটা সংবাদ। আমি নিজেও নপুংসক। এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারিনি। আমার মতো অনেকেই প্রতিবাদ করতে পারেননি। কী করবে? সবারই তো চাকরি দরকার। খুব খারাপ লাগে, জানেন? কোনো সেক্টরের অনিয়ম-নিপীড়ন নিয়ে আমরা মিডিয়ায় কত লেখালেখি করি। অথচ কী আশ্চর্য! নিজেদের ঘর নিয়ে কোনো আলাপই নেই। এখানে বেতন নেই, চাকরির নিশ্চয়তা নেই, সুযোগ নেই, সুবিধা নেই। তবু আশ্চর্যরকমভাবে প্রতিবাদ নেই।’
আমি শুনে যাই। ভাবি, তাহলে কি এ পেশা থেকে দূরে সরে যাবো? মাস্টার্সে ভর্তি হবো? গবেষণা করবো? শিক্ষকতার চেষ্টা করবো? ভাবি, ভাবতে ভাবতে নতুন চাকরির সন্ধান করি।
এ পেশায় কেন যেন এক অনাবিল আনন্দ খুঁজে পাই। এক অগোছালো তথ্য যখন সামনে হাজির হয়, তখন যেন এক ওলোট-পালোট পৃথিবী সেখানে আবিষ্কার করি। তখন মন দেই সেই পৃথিবীকে সাজানোর। নিজের মতো করে নিয়ম মেনে এক ঘর যেন তুলে ফেলতে পারি সেখানে। কী অদ্ভুত এ নেশা, কী অদ্ভুত এই পেশা।
যেন শব্দের সঙ্গে শব্দের খেলা। এ খেলার মোহনায় বারবার হারিয়ে যেতে মন চায়। এই মোহনাই তো ঠিকানা। তাই সিদ্ধান্তই নেই, নাহ্ এ কাজ ছেড়ে গেলে নিশ্বাস নেওয়া যাবে না। টিকে থাকতে হবে যে করেই হোক।
একদিন সকালে সায়েম এসে হাজির। এসেই বললেন, ‘মোস্তাক ভাই, একটা চাকরি আছে, করবেন?
—কোন পত্রিকায়?
—নতুন একটা পত্রিকা আসতেছে। বড় এক ব্যবসায়ী। আপনি চাইলে কথা বলবো। তবে সুযোগ আছে প্রুফ সেকশনে। আপাতত সেখানেই ঢোকেন।
মনটা কিঞ্চিৎ খারাপ হয়। বানান দেখা গুরুত্বপূর্ণ কাজ, তবে আমি তো শব্দের খেলা খেলতে চাই। এই খেলাতেই তো জীবন। তবু রাজি হলাম। কী আর করবো?
নতুন পত্রিকা ‘দৈনিক সত্যপক্ষ’। এই পত্রিকা বাজারে আসেনি। কাজের মহোৎসব চলছে। মালিকপক্ষ খুব চায়—দ্রুত বাজারে নিয়ে আসবে সত্যপক্ষ। অফিস বেশ চাকচিক্যে ভরা। ব্যাপক অর্থ বিনিয়োগ করেছে বোঝা যায়। লোকবলও প্রচুর। যেখানে দুইজন থাকলেই চলে সেখানে আছে পাঁচজন। মালিককে বোঝানো হয়েছে, ভালো ভালো সব হ্যান্ডকে একত্র করা হয়েছে। মানুষ বেশি মানেই ভালো কিছু হবে। অনেক উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে তিন মাস পর বাজারে এলো সত্যপক্ষ। বাজারে ব্যাপক রাখ-ঢাক নিয়ে হাজির হলো পত্রিকা। চলতে থাকলো চাকরি।
এরই মধ্যে অনেক ঘটনাও ঘটলো। ছোট বোনেরও বিয়ে হয়ে গেলো। এ যাত্রায় কিছুটা বেঁচেছি বটে। ছোটবোন গ্রামে এক বিদেশফেরত ছেলের সঙ্গে প্রেমে মজে পালিয়ে বিয়ে করেছে। মা বিষয়টি মানতেই পারছেন না। গ্রামে শালিশও বসেছে। আমাকে ডাকা হয়েছিল, যাইনি। মনে মনে বলেছি, বোন পালিয়ে আমাকে বাঁচিয়েছে।
আমি কী পরিমাণ স্বার্থপর! তাই না?
তবে কয়েকদিন যেতেই খারাপ লাগা শুরু হলো। বোনকে কতদিন দেখি না। কত কাল কথাও হয় না। কতটুকু হয়েছে, তাও জানি না। বাড়িতেই তো যাওয়ার সময় করে উঠতে পারি না। এই বোন বিয়ে করে ফেললো? খুব খারাপ লাগতে লাগলো হুট করে। সিদ্ধান্ত নিলাম বাড়ি যাবো।
ঠিক ঠিক বাড়ি চলে গেলাম। বোনের শ্বশুরবাড়ি ঘুরে এলাম। সঙ্গে মিষ্টি, বিশাল আকারের রুই মাছও নিয়ে গেলাম।
বোনকে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘তোর পছন্দ আছে আমাকে জানালেই পারতি। এভাবে পালিয়ে মাকে কষ্ট দিলি কেন? একদিন গিয়ে মা’র পায়ে ধরে মাফ চেয়ে আসিস।’
বোন অপলক শুধু তাকিয়েই ছিল। হয়তো এই ভাই তার কাছে অচেনা। খুব বেশি কাছে পায়নি তো। মাসের মাঝামাঝি কিছু টাকা আসে। সে শুধু জানে এই টাকা বড় ভাই পাঠিয়েছে। এর বেশি ভাইয়ের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কই গড়ে ওঠেনি। তার অপলক দৃষ্টিটার কথা এখনো মনে পড়ে। তখন অঝোরে কাঁদতে ইচ্ছে হয়। বুকচাপা বেদনা হয় বোনদের জন্য। কিছুই করা হলো না।
দুই.
সত্যপক্ষ পত্রিকায় একবছর কাজ করে যাওয়ার সুযোগ হলো। সব ঠিকঠাকই চলছিল। বেতন একদম মাসের প্রথম সপ্তাহেই হয়ে যায়। হাউজের সবাই খুশি। কাজ চলছে দেদারছে। দক্ষতা বিচারে প্রুফ থেকে আমাকে নিয়ে আসা হলো নিউজ এডিটিং সেকশনে। কিন্তু পদের নাম পরিবর্তন হয়নি। পদ সেই প্রুফ রিডারই রইলো। তবে বেতন কিছু বাড়লো। ততদিনে সিদ্ধান্ত নিলাম বিয়ের। পাত্রী দেখছেন মা। আসলে চিঠিতে এক পাত্রীর ছবিও পাঠানো হয়েছে। মেয়ের নাম আকলিমা খাতুন।
ছবি দেখে প্রেমে মগ্ন হয়ে পড়েছিলাম। আর ভালো লাগে না। একাকী জীবনে তখন দরকার ছিল সঙ্গীর। যে বেতন পেতাম, এই শহরে ছোট্ট এক ঘরে থাকা সম্ভব বলেই মনে হয়েছিল। একদিন সকালে সত্যি সত্যিই রওনা দিয়ে গেলাম গ্রামে।
মাকে গিয়ে জানাই, আকলিমাকে পছন্দ হয়েছে। মায়ের সে কী আনন্দ। ছেলে এবার বিয়ে করবে। যাওয়ার আগে কিছু ধার-দেনা করে নিয়ে গিয়েছিলাম। জানতাম বিয়ে করলেই তো অর্থের প্রয়োজন। বিয়ে হলো। ছোটখাটো নয়, মোটামুটি গ্রামের একশ’ দেড়শো’ লোককে খাইয়েই বিয়ে সেরেছিলাম।
আকলিমা নিতান্ত সাধারণ। তখন সবে এইচএসসি পাস করেছে। আমি বয়সে অনেক বড়। তবু সুঠাম দেহের অধিকারী তো ছিলাম। বয়সের কোনো ছাপই চেহারায় ছিল না। তবে খসখসে চামড়ার পরতে পরতে ছিল জীবন সংগ্রামের ছাপ। এখনো মনে পড়ে আকলিমা প্রথম রাতেই বলেছিল, আমারে ঢাহা লইবেন না?
হাসতে হাসতে বলেছিলাম—অবশ্যই। এমন সুন্দরী বউ কেউ দূরে রাখবো কও?
এখন মাসখানেক পার হয়ে গেলো কিন্তু মকবুলের কোনো সংবাদ নেই। কোথায় গেলো, কিভাবে গেলো, কেমন আছে কেউ জানে না কিছু।
যখন বিয়ে সেরে একসপ্তাহ পর অফিস ফিরলাম, তখন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। অফিসে সবার মুখ গম্ভীর। অফিসে ঢুকেছে কম্পিউটার নামক এক যন্ত্র। এই যন্ত্রের কারণে অনেকের চাকরি চলে যেতে পারে। সম্পাদক বলে দিয়েছেন—যারাই কম্পিউটারে টাইপ করতে পারবে না, তাদেরই চলে যেতে হবে। আমি হলাম এক গরিব-সাধারণ মানুষ। আত্মবিশ্বাস একদম শূন্যের কোঠায়। এর আগে বহু শুনেছিলাম এই যন্ত্রের নাম। অফিসে এই যন্ত্রের আগমনে স্তব্ধ হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।
এ যেন এক ভয়ানক ভূত। কাছে গেলেই খেয়ে ফেলবে। ধরতেও হাত কাঁপে। অফিসে শুরু হলো প্রশিক্ষণ। একইসঙ্গে চলতে থাকলো তালিকা—কতজন কোন বিভাগ থেকে বাদ দেওয়া হবে। কাকে কাকে আর দরকার নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রশিক্ষণে আমি পরাজিত। এই যন্ত্রটা ধরতেই কাঁপাকাপি শুরু করে দিতাম। এটা প্রশিক্ষকের চোখে পড়েছিল বহুবার। তিনি বারবার জিজ্ঞেসও করেছেন, আপনি নার্ভাস হচ্ছেন কেন? এটাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। না শিখলে আর এগুতে পারবেন না।
মনে মনে হাসতাম। এই যন্ত্র এই গরিব দেশে কিভাবে জায়গা পাবে? মাথা নষ্ট নাকি? আর এটা বড়লোকের যন্ত্র। বড়লোক এটাতে ঠাসঠুস আওয়াজ করবে আর কাজ করবে। সাংবাদিকদের কলম ছিনিয়ে কোন প্রযুক্তি জায়গা করবে এই দেশে? এটা সম্ভব নাকি?
অদূরদর্শী ভাবনায় হারিয়েছিলাম চাকরি। নতুন সংসার নিয়ে আবারও নিঃস্ব।
এই নিঃস্ব হওয়া নতুন কিছু নয়। ঘনঘন নিঃস্ব কিংবা পরাজিত হওয়ার বেদনা তো পুরনো। অন্যসময় ভেঙে গেলেও এবার আর ভাঙে পড়িনি। লড়াই যে চালাতে হবে, তা ঠিক ঠিক জানা ছিল। শুরু হলো নতুন চাকরির সন্ধান।
এরই মধ্যে কথা হলো একদিন সেই পুরনো পত্রিকা অফিসের মঞ্জু ভাইয়ের সঙ্গে। তিনি নাকি একটি পত্রিকা আনছেন। ইনভেস্টরও পেয়েছেন। বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান।
মঞ্জু ভাই বললেন, ‘দেখ মোস্তাক, তোরে আমার খুব পছন্দ। আমি যদি এবার পত্রিকা আনতে পারি তোকে বানাবো আমার ডাইন হাত। চিন্তা করিস না।’
এদিকে বাড়ি ভাড়া বাকি পড়েছে। বউ বারবার চিঠি দিচ্ছে ঢাকা আসবে বলে। সঙ্গে ঘটেছে আরেক কাণ্ড। গোপনে গ্রামের এক লোকের কাছ থেকে ধার করে অবৈধ পথে ছোট ভাই মকবুল গেছে মালদ্বীপ। সেখানে নাকি কাজ করবে। এ খবর কাউকে সে জানায়নি। যেদিন গেছে, সেদিন মকবুল তার এক বন্ধুকে একটা চিঠি দিয়ে গেছে মাকে দেওয়ার জন্য। এখন মাসখানেক পার হয়ে গেলো কিন্তু মকবুলের কোনো সংবাদ নেই। কোথায় গেলো, কিভাবে গেলো, কেমন আছে কেউ জানে না কিছু।
এছাড়া বিয়ে করার সময় যা টাকা-পয়সা ধার-দেনা করেছিলাম, সেসব নিয়েও চলছে দেন-দরবার। পাওনাদাররা বারবার ধরার চেষ্টা করছে। শুরুতে কয়েকদিন বলেছি, ভাই চাকরি পেলে ধার-দেনা শোধ করে দেবো। একটু ধৈর্য ধরেন। কিন্তু কেউ আর বিশ্বাস করে না।
সব মিলিয়ে আবার যেন অথৈ সমুদ্রে ভাসছি। প্রতিদিন একবার মঞ্জু ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করি, দেখা করি। মঞ্জু ভাইয়ের ওই একই আশ্বাস—হবে হবে, যখনই হবে তোকে ডাকবো।
কিন্তু কবে হবে? এর কোনো উত্তর জানা ছিল না।
এরই মধ্যে পরিচিত আরেক বড় ভাই জলিলের সঙ্গে দেখা হলো প্রেস ক্লাবে। সেখানে প্রায়ই যাওয়া হয়। একদিন বিকেলে জলিল সাহেব বললেন, তোমারে একটা চাকরি দিতে পারি। আমার একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা আছে। নাম হলো ‘সাপ্তাহিক অপরাধ’। এইখানে কাজ করো আপাতত।
ভাবলাম, যাক, কিছু একটা তো হলো। জলিলের দেওয়া ঠিকানায় হাজির হলাম। গিয়ে বিভ্রান্ত হলাম। ছোট্ট একটা কামরায় বড় টেবিলে বসে আছেন জলিল। তার সামনে ছয়-সাতটা চেয়ার। আর কিছুই নেই। এটা তাহলে কিসের অফিস? জলিল সাহেব স্বাগত জানিয়ে সাপ্তাহিক অপরাধের কয়েকটি কপি দিলেন।
বললেন, ‘তোমারে আমি আইডি কার্ড করে দিচ্ছি। তুমি যা কামাইবা তার ফিফটি পার্সেন্ট আমারে দিবা। তাইলেই চলবো। আর প্রতি সপ্তাহে একদিন এসে লেখাগুলা এডিট কইরা দিবা।’
এটা শুনে তো আমি হতবিহবল! আমি তো ভেবেছিলাম, কাজ করবো, মাস শেষে বেতন পাবো। এ-তো দেখি উল্টা। কামাবো কোথা থেকে?
—জলিল ভাই, আমি বুঝি নাই।
জলিল সাহেব চোখ বাঁকা করে বললেন, ‘আরে মিয়া কী বুঝো না? এই চুতিয়া শহরে সবই বুঝতে হবে। কী বুঝো নাই, কও?’
—আমি কোথা থেকে কামাবো? আমি তো ভাবলাম, আপনি কাজ দেবেন, আমি কাজ করে দেবো। মাসে মাসে বেতন পাবো।
জলিল সাহেব এবার হাসেন। হাসতে হাসতে বলেন, ‘ধুর মিয়া। কী চাকরি চাকরি করো? চাকরি করে এই শহরে কোনো সাংবাদিক হালায় টিকছে নাকি? ধান্দাবাজি করো। দেখবা শিনা উচাইয়া চলতে পারবা। বাজারে দরও বাড়বো। যত ধান্দাবাজি করবা, যত কামাইবা, ওপর মহলে যত চলাফেরা করতে পারবা, তত তোমারে সবাই তোয়াইবো।’
মাঝে মাঝে দৈনিক মুক্তিতে বেতনের ঝামেলাও হতো। এই ধরুন হুট করে দুই মাসের বেতন নেই। তারপর আবার বেতন শুরু হলো।
সেদিন সেখান থেকে এক চূর্ণ-বিচূর্ণ মন নিয়ে ফিরে আসি। আমি তো শব্দের সঙ্গে শব্দের খেলা খেলতে চাই। এসব ধান্দাবাজির খেলা তো জানা নেই। হই না গরিব, হোক না এই শহরে কিছুই নেই—তবু আত্মসম্মান তো আছে। দরকার হলে না খেয়ে মরবো কিন্তু এসব কামাইয়ে নজর দেবো না কখনো।
যাই হোক, শেষমেষ মঞ্জু ভাই ঠিকই নিয়েই নিলো। প্রায় ছয়-সাত মাস পর গতি হলো। শুরু হলো নতুন পত্রিকার প্ল্যানিং। আমাকে করা হলো সিনিয়র সাব-এডিটর। বেতনও খারাপ না। ভালো। এই শহরে একটা ছোট্ট বাসা ভাড়া করে বউকে শহরে নিয়ে আসার ক্ষমতা এখন হলো।
কিন্তু সুখ কী সয়? হুট করেই খবর এলো মা মারা গেছেন। বিচ্ছিন্ন জীবনটা যেন এই খবরে ছারখার হয়ে গেলো। মা ছাড়া এ জগতে আর কে আছে? পরম পরশ, স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা দিয়ে এখন কে আগলে রাখবেন আমাকে? কে আমার জন্য বাড়িতে অপেক্ষা করবেন? বাড়ি গেলে কে মাথায় হাত বুলিয়ে বলবেন, বাজান আইছো? কত্ত শুকাইয়া গেছো। খাও না?
আহারে মা, তোমাকে ছাড়া আমার জীবনটা কিভাবে চলবে? তুমি আছো এই তো ছিল আমার অবলম্বন। দেখা নেই তাতে কি? মনে হতো সবসময়ই আছ আমার আশেপাশে।
এই করুণ জীবনের প্রতি কখনো কখনো নিজেরই করুণা হয়। শুধু হয় না যিনি ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ করেন, তার। এটা বুঝতে পারি, যখন এই মা-মরা সংবাদের মধ্যেই সুদূর মালদ্বীপ থেকে খবর আসে মকবুলের। অবৈধ শ্রমিক হিসেবে সে এখন রয়েছে জেলে। বাংলাদেশ মিশন এই খবর পৌঁছে দিয়েছে বাড়িতে। সব দুঃসংবাদের ভেতর এক তীব্র স্রোতের অনুভূতি আমাকে ভাসিয়ে নিতে চায়। তবু যেন আটকে থাকি, ভেসে যাওয়া তো যাবে না। টিকে তো থাকতেই হবে। মনে হচ্ছিল যেন একটা ম্যাচের বাক্সে সওয়ার হয়েছি, আর সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ে ভাসছে ওই বাক্স।
মাকে কবর দিয়ে ফেরার সময় আকলিমা আর প্রশ্ন করতে ছাড়েনি—ঢাকা কবে যাবো?
কী আশ্চর্য! এমন সময় এই প্রশ্ন করা যায়?
ফিরে এসে মকবুলের কথা খুব মনে পড়ে। কিন্তু কী করবো? কয়েকটা মানবাধিকার সংস্থায় যোগাযোগ করলাম। কেউেই দিশা দিতে পারে না। প্রত্যেকে বলে, বাংলাদেশ মিশন চাইলে এই সমস্যা সমাধান করতে পারে। একদিন সাংবাদিক পরিচয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবের সঙ্গেও দেখা করলাম।
সচিব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলেন, আপনি একজন সাংবাদিক, আপনার ভাই কিভাবে এই কাজ করলো?
কে বোঝাবে? কে বোঝাবে আমি এ জগতে একজন স্বার্থপর জীবন সংগ্রামী। ‘সব ঠিক হয়ে যাবে’, ‘একদিন সুদিন আসবে’—এই স্বপ্নেই কেটে যায় যাদের জীবন, তাদের কথা কে বুঝবে? কেউ তো বোঝার নয়।
অবশেষে মঞ্জু ভাইয়ের সম্পাদিত পত্রিকা ‘দৈনিক মুক্তি’ বাজারে এলো। ভাবলাম, দৈনিক মুক্তিই হয়তো দারিদ্র থেকে মুক্তি দেবে। তখন আমি অনেক ক্লান্ত জীবনের ভারে। আর এই ছোটাছুটি ভালো লাগে না। সংবাদপত্র দুনিয়ার বিভৎস চরিত্র উন্মোচিত হওয়ার পরও এই পেশাকে ভালোবেসে ফেলেছি, ছাড়ার কথা ভাবতেই পারি না। আমি তো শব্দের খেলোয়াড়।
তিন.
আমার আরেক ভাইও তো আছে। আপনাদের তো বলা হয়নি। ওর নাম মুরসালিন। সে নাকি গ্রামে এখন জুয়া খেলে দিন পার করে। মা-মরা মুরসালিন যদিও গ্রামে ভাবির পাহারাদার। আমি মাসে দুই তিন বার গ্রামে যাই। যেহেতু গ্রামে যাই, সেহেতু আকলিমাও সন্তানসম্ভাবা হয়। মুরসালিন গাঁজাও নাকি খায়। তবু গ্রামে বাস করা একা আমার স্ত্রীর জন্য মুরসালিনকে তো দরকার। তাই খুব বেশি শাসনও করা হয় না।
‘দৈনিক মুক্তি’তে এসে আরেকটা কাজ বাধ্য হয়েই করতে হয়েছিল। এখানেও ছিল কম্পিউটার। শেষমেষ এটার কাজ শিখতেই হয়েছে। শুরুতে অনীহা থাকলেও চাকরি হারানোর ভয়ে শিখেছি কম্পিউটারে টাইপিং। পরে মনোযোগ দিতে গিয়ে দেখলাম এটা তো কোনো কঠিন কিছুই না। শুধু শুধু আগের চাকরিটা হারিয়েছিলাম। ধৈর্য নিয়ে কাজটা শিখলেই হতো।
চার.
যাওয়ার যে সময় হয়ে এলো। আমার জীবনের অলি-গলির গল্প বলা চলতে থাকলে দু’চারটা উপন্যাস লেখা হয়ে যাবে। তবে বলতে হয়, এভাবেই চলছিল জীবন। দৈনিক মুক্তিতে অনেক সময়ই কাটিয়েছিলাম। প্রায় দশ বছর মঞ্জু ভাইয়ের হাত ধরে জীবনের অনেক বিপর্যয়কে সামালও দিয়েছি। ছোট ভাইকে মালদ্বীপ থেকে দেশে ফেরাতে পেরেছি। তারপর গ্রামেই দুইভাইকে একটা দোকান করে দিয়েছি। এই শহরে ছোট্ট দুই কামরার বাসা ভাড়া নিয়ে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে এসেছিলাম। মাঝে মাঝে দৈনিক মুক্তিতে বেতনের ঝামেলাও হতো। এই ধরুন হুট করে দুই মাসের বেতন নেই। তারপর আবার বেতন শুরু হলো। কিন্তু ওই যে মাঝে দুই মাস গায়েব হয়ে গেলো, তা আর ফিরে এলো না। তবু ক্লান্ত হয়ে এখানেই দীর্ঘ সময় একই পদে চাকরি করে গেলাম।
দীর্ঘ ১০ বছর পর হুট করে মঞ্জু ভাই ডেকে বললো, মোস্তাক তোকে যে রিজাইন দিতে হবে।
—কেন ভাই?
মঞ্জু ভাই কিছুটা বিব্রত হয়ে বললেন, দেখ তোকে আমার খুব পছন্দ। আমাদের সবচাইতে পুরনো লোকও তুই। কিন্তু মালিকপক্ষ কস্ট-কাটিং করতে বলেছে। এজন্য প্রথমেই যাদের বেতন কিছু বেশি, তাদের সরাতেই হচ্ছে।
কিছুক্ষণ নীরব হয়ে ভাবলাম, মাত্র ৪০ হাজার টাকা এই শহরে অনেক বেশি?
তবু বললাম, ঠিকাছে ভাই। আমি চলে যাচ্ছি।
মৃতরা কি সব শুনতে পায়? কিন্তু আমি যে শুনলাম মেহরুবা ফিসফিসিয়ে বলে, ওনারা এতদিন কোথায় ছিলেন?
এই যে বারবার অসহায় হয়ে পড়া। এই যে সংবাদের আড়ালে স্বপ্ন ভেঙে যাওয়া—তা কি কেউ কখনো জানতে পেরেছে? কে বলবে—এসব শব্দের খেলোয়ারে গল্প? এরা মানুষ নাকি? না, মানুষ না, আপনারা বলেন সাংবাদিক।
এই সাংবাদিকেরা কি ভালো আছে?
কেউ বলে, খুব ভালো আছে।
কেউ বলে, কেউ ভালো নেই।
এরপরও চাকরি জোগাড় করতে তো হয়েছে। আবার হারিয়েছি। যেন হারানো আর পাওয়ার মধ্যেই জীবন পার হয়ে গেলো। আমি প্রায়ই বলি, সাংবাদিকদের চাকরি একটা সময় হয়েই যায়, শুধু বেতনের অঙ্কটা কমতে থাকে। চাকরিহারাদের কেউ চাকরি দিচ্ছে—এই তো বিরাট বিষয়। নাকি?
এই লড়াই সংগ্রামে আমার স্ত্রী আকলিমার ভূমিকা একটাই। সেটা হলো, সংসার কিভাবে সামাল দিতে হবে, কিভাবে সন্তানের খরচ চালাতে হবে—তার ইঞ্চি ইঞ্চি হিসাব করে পাক্বা হিসাবী হয়ে ওঠা আকলিমা যে মাত্র এইচএসসি পাস, তা আর বলবো না, সে হলো এক দেউলিয়া ব্যাংকের পাক্বা অ্যাকাউনটেন্ট।
আপনারা যারা ভাবেন, সাংবাদিকদের অনেক ক্ষমতা, তারাই এবার বলেন, আমার ক্ষমতা কোথায়? আমি তো জগতের সবার সঙ্গে দৌড়েছি, কেউ কি দেখেছে—ধীরে ধীরে আমার ধ্বংস হওয়া কিংবা ক্ষয়ে যাওয়া?
আপনাদের যখন গল্পটা বলছি, তখন আসলে আমার লাশটা ৩০-৪০ জন সাংবাদিকের সামনে কিংবা আরও ১০-২০ জন বেশিও হতে পারে। বড় বড় সাংবাদিকের সামনে সটান হয়ে শুয়ে আছি, কী সৌভাগ্য আমার! যখন চাকরি ছিল না, তখন এদের কতজনের দুয়ারে হাজির হয়েছি, কেউ কেউ ঢুকতে দিয়েছেন, কেউ কেউ দেখা করার ফুসরতই পাননি।
অথচ কী আশ্চর্য, কখনো ভাবিনি এত বড় সাংবাদিকরা আমার মৃত্যুর পর লাশের পাশে দাঁড়িয়ে মাইক বাজিয়ে শব্দদূষণ করে বড় বড় কথা বলে যাবেন! কী সৌভাগ্য আমার!
হঠাৎ নজর গেলো আমার পরিবারের দিকে। এই যে তামাশা চলছিল এসবই এক কোণায় নীরবে দাঁড়িয়ে আকলিমা আর আমার একমাত্র সন্তান মেহরুবা দেখছিল। দু’জনেই নীরবে তাকিয়ে ছিল আমার নিথর দেহের দিকে। আর মাইকে বড় বড় সাংবাদিক নেতারা গুণ-কীর্তন করে যাচ্ছিলেন। দেখলাম, আমার অভাগা মেয়ে মেহরুবা এক সময়ে তার মাকে প্রশ্ন করছে, আম্মা ওনারা সবাই কারা?
আকলিমা ভাঙা ভাঙা স্বরে বলেন, তোর বাপের বন্ধুরা।
দেখলাম, মেহরুবা আকাশের দিকে তাকালো। তারপর ফিসফিসিয়ে কী যেন বললো কিন্তু আকলিমা শুনলো না। ততক্ষণে আমার মুখটি সাদা কাফনে ঢেকে দেওয়া হলো।
মৃতরা কি সব শুনতে পায়? কিন্তু আমি যে শুনলাম মেহরুবা ফিসফিসিয়ে বলে, ওনারা এতদিন কোথায় ছিলেন?