পর্ব-৩
একদিন ঘটক এসে সকিনার কথা বলে মজিদ খানকে। মজিদ খান বলে, তুমি মাইয়া দেহার ব্যবস্থা করো। এক কেজি গরম জিলাপি আর কমলা রঙের আমৃতি মিষ্টি নিয়ে মজিদ খান যায় সকিনা বিবিরে দেখতে। সকিনা বিবির গায়ের রঙ শ্যামলা, মাথায় চুল আছে বেশ ঘন ও কোমর অব্দি। নিতম্ব বেশ ভারী বুক, যা আছে চলনসই। মজিদ খান, মোবাশ্বের হাওলাদারকে বলে, আগামী শুক্কুরবার নিকাহের ব্যবস্থা করেন।
দশ হাজার টাকা দেনমোহর ধরে, মজিদ খান আর সকিনা বিবির নিকাহ কার্য সম্পন্ন হলো। লাল মালা শাড়ি আর চার আনা স্বর্ণের চেইন পরে সকিনা বিবি এলো স্বামীর সংসারে। প্রথম রাতে পাঁচবার সঙ্গম হলো দুজনের। মজিদ খান শেষবার সঙ্গম শেষ করে নতুন বিবিকে বুকে টেনে নিয়ে বলে, খুব সুখ পাইছি তোরে খেইলা। আমারে একটা পোলা দিতে পারবি না? সকিনা চুপ করে মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়।
সাপানিয়া গ্রামে কিছু জমি পছন্দ হইছে খান সাহেবের। উঁচু ভিটা চার জৈষ্ঠ। এক জৈষ্ঠতে হয় একুশ শতাংশ।
জমিটায় যেমন ধান হবে তেমন হবে রবিশস্য। টাকা দরকার। যে টাকার জন্য একমাত্র পুত্র হারিয়েছে সেই টাকা রাখতে দিয়েছে লতিফ কেরানির কাছে। লতিফ কেরানি জানিয়েছে সে শহরের এক আত্মীয়ের কাছে রাখতে দিয়েছে টাকা। একদিন সকালে গিয়ে মজিদ খান লতিফ কেরানির কাছে টাকা চায়। লতিফ কেরানি দুইদিন পর দেখা করতে বলে। দুইদিন পর গেলে লতিফ কেরানি বলে, তার আত্মীয় জানিয়েছে যে সিন্দুকে টাকা রেখেছিল সেই সিন্দুকের সব টাকা গায়েব হয়ে গেছে। মজিদ খান তখন যেন বোবা, কালা আর বধির হয়ে গেছে।
মজিদ শুধু এক অসহায় ডানা ভাঙা পাখির মতো, ল্যাংড়া নেকড়ের মতো বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে লতিফ কেরানির দিকে। লতিফ কেরানি পরিস্থিতি বুঝে তার স্ত্রীকে ডাক দিয়ে বলেন, খান সাহেবকে চা-নাস্তা দাও। বাটি ভরা রসগোল্লা, পরোটা, খাসির গোশত আর পায়েস পাঠিয়ে দেয় কেরানি গিন্নী। মজিদ খান সুতীব্র আক্রোশে সব ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে আসে। কেরানি সাহেব তখন মুচকি হেসে বলে মূর্খ কোথাকার! টকটকে লাল ফর্সা কেরানি সাহেবের মুখ ভর্তি কাঁচাপাকা দাড়ি। দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে কেরানি সাহেব বলে, অল্লাহু আকবার! এবার দোতলা দালান বাড়ির কাজে আত (হাত) লাগামু।
এবার রহিমের ওপর চলে অত্যাচার এর খড়গহস্ত। আর নিজের ছেলেকে কোলে নিয়ে সোনা, রাজপুত্র, মানিক বলে চুমুতে ভরাতে থাকে মজিদ। ছেলের নাম দেয় আরশাদ আলী খান।
কেরানী সাহেবের বাড়ি থেকে ফিরতে প্রায় সাড়ে বারোটা বেজে যায় মজিদ খানের। এসেই দেখে সকিনা মোবাশ্বের হাওলাদারকে থালা ভরা ভাত দিয়েছে আর লাউ দিয়ে রান্না করা শোল মাছ। সঙ্গে বাটিতে দেওয়া হয়েছে ঘন মশুর ডাল ভুনা। জীবনের চরমভাবে ঠকে গিয়ে মজিদ খানের এখন এমন অবস্থা যে, মাথায় ধান দিলে পটাশ পটাশ করে খই ফুটবে। তার ওপর বিয়ের প্রায় ছয় মাস হয়ে গেছে সকিনার গর্ভধারণের কোনো লক্ষ্মণ না থাকায় খান সাহেব সকিনার ওপর বেশ ক্ষ্যাপা। আর তার অনুপস্থিতিতে বাপকে অমন আহ্লাদ করে খাওয়াতে দেখে মেজাজ আরও বিগড়ে গিয়েছে। মজিদ মোবাশ্বের হাওলাদারের ভাতের থালা লাথি দিয়ে উলটে দেয়। আর মুখে বলে অই হালার পো হালা আমার বাড়িতে গিলতে আইছিস? হালার খয়রাতি খয়রাত কইরা খাইতে পারো না? সকিনা কেবল বলে ওঠে, যে আপনে মানুষ! বুড়া মানুষটা কেবল মুখে খাওন দিছিল! আপনের চেয়ে নমরুদের দিলেও মায়া আছে! অমনি মজিদ সকিনার চুল ধরে বলে, ওরে চুতমারানি খানকি মাগী, আমার খাবি আমার পরবি আর বাপের জন্য দরদ চোদাবি! যা মাগী বাপের বাড়ি গিয়ে থাকন চোদা। মোবাশ্বের হোসেন একরকম পায়ে ধরে বলে, বাবা মুই আর কোনোদিন তোমাগো বাড়ি আমু না। মোর মাইয়াডারে পোতে নামাইও না। এই বলে সকিনার বাবা হনহনিয়ে বেরিয়ে যায়।
বিয়ের দুই বছর অতিক্রান্ত হলেও বংশধরের মুখ না দেখে সকিনার ওপর ত্যক্তবিরক্ত মজিদ। এরপর বিভিন্ন সময়ই বাপের বাড়ি চাল-ডাল টাকা-পয়সা দেওয়ার সন্দেহ উদ্রেক হয় সকিনার ওপর। মজিদ মনে মনে বলে, ধুউর! খালি রাইতের বেলার ধোনের সুখের লাইগা এইরহম হাতি পোষার দরকার নাই। যেই চিন্তা সেই কাজ। দ্বিতীয় বারও স্বামীর সংসার থেকে বাপের বাড়ি ফিরতে হয় সকিনাকে।
মামলা উঠিয়ে নিলেও মজিদের সঙ্গে ভাব-ভালোবাসা নেই সায়রা বানু ও তার মেয়ে জামাইদের সঙ্গে। আমেনা আর হাজেরা জব্বার খানের ঘরে এসেই বেড়িয়ে যায়। একরকম একা একাই নিজের রান্না নিজে করে খায় মজিদ। আর মনে মনে আরও যুবতী কাউকে কামনা করা সর্বক্ষণ।
একদিন কাজকর্ম কিছুই ভালো লাগে না মজিদের। কী এক চিন্তা সারাক্ষণ তাড়া করে ফেরে, এত জমিজমা আমি মরে গেলে কে খাবে! অই হালার পো হালার জামাইরা! নাহ! কিছু একটা করতে অইবে! এমন সময় খুব সুন্দর একটা ছোট বাচ্চা নিয়ে এক যুবতী ভিক্ষা করতে আসে। বেশ ফর্সা আর খাড়া নাক, কোঁকড়া চুল মাথায়, চোখগুলো ছোট হলেও ভাসা ভাসা। মজিদ প্রায় আধা কেজি চাল ভিক্ষা দিয়ে ভিক্ষুক যুবতীকে কাছে ডাকে। কাছে আসতেই বলে তোমার পোলাডা এত সুন্দর! ওর বাপ কই? আর তোমার নাম কী?
যুবতী উত্তর দেয়, মোর নাম হালিমা আর অর বাপ মইরা গেছে। নাইলে কী আর খয়রাত করতে নামি!
মজিদ বলে, যদি তোমার আর ভিক্ষা করন না লাগে?
তুমি রাজি! হালিমা বলে, ঠিক বুজি না বুজাইয়া কন।
মজিদ সরাসরি বলে, আমি তোমারে এই পোলাসহ নিকা করতে চাই। হালিমা বলে, রাজি আছি, তয় একখান কতা আছে। মজিদ বলে, পোলা সহই তো কইছি। আর কতা কী? হালিমা বলে, হ কইছেন ঠিকই, কিন্তু বিষয়ডা আরও পোক্ত হওন দরকার।। মজিদ জিজ্ঞেস করে, কী রকম? হালিমা বলে রহিমরে দত্তক নেবেন আর পিতৃপরিচয় দেবেন। আর বড় অইলে ঘর বানতে আর এট্টু গাছ-গাছালি লাগাইতে দুই জৈষ্ট জমি দেবেন। হালিমার বয়স আর নিজের একাকীত্বের বিবেচনায় রাজি হয়ে যায় মজিদ।
হালিমা চায় রহিম স্কুলে যাক, লেখাপড়া শিখে ছোট হলেও চাকরি করুক। কিন্তু মজিদ চায় রহিম তাকে ক্ষেত-ক্ষামারে কাজে সহযোগিতা করুক। রহিম যথাসম্ভব মজিদের কথামতো চলে। নিকাহের ছয় মাসের মাথায়ই হালিমা গর্ভধারণ করে। যথাসময়ে জন্ম দেয় কালো কুচকুচে এক পুত্র সন্তান। বুকের পাথর নেমে যায় মজিদের। এবার রহিমের ওপর চলে অত্যাচার এর খড়গহস্ত। আর নিজের ছেলেকে কোলে নিয়ে সোনা, রাজপুত্র, মানিক বলে চুমুতে ভরাতে থাকে মজিদ। ছেলের নাম দেয় আরশাদ আলী খান।
চলবে…
সাতটি পিতলের ড্যাগ-২॥ নুসরাত সুলতানা